মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩

আমার পায়ে একটি বল নিয়েই আমি জীবন সম্পর্কে জেনেছি : নাহিদ ধ্রুব

0

চারিদিকে সন্ত্রস্ত্র দৃষ্টি, দূর থেকে অস্পষ্ট কুয়াশার মায়াজাল মনে হলেও, খুব কাছে গিয়ে তাকালে বোঝা যায় পৃথিবীর সব অনুভূতি এসে জড়ো হয়েছে ওই চোখের পিচ্ছিল পথে। চলছে এক্সট্রা মিনিটের খেলা। ১ মিনিট পরেই হয়তো বেজে উঠবে বাঁশি। সূর্যের আলোতে চিকচিক করা বালুর মতো যে উজ্জ্বল জলের চিহ্ন কিছুক্ষণ আগে দেখা গিয়েছিল একজনের চোখে, তা যেন সংক্রামক কোনো ব্যধির মতো এখন ছড়িয়ে পড়েছে আরও অজস্র চোখের তারায়। ফ্রি-কিক অতঃপর গোল। যারা হেরে গেল, তারা কাঁদছে। যারা জিতে গেল কাঁদছে তারাও। এই মহাকাব্যিক দৃশ্য সহসাই দেখা যায় ৯০ কিংবা ১২০ মিনিটের ফুটবল ম্যাচে। দৈর্ঘ্যে ১২০ গজ আর প্রস্থে ৮০, ঘাসের চাদরে ঢাকা একটা মাঠে এভাবেই অনুভূতির সমস্ত দরোজায় করা নেড়ে যায় যে খেলা, তার নাম ফুটবল। জীবনের ৮০ ভাগ সময় যে খেলা নিয়ে মেতে ছিলাম উন্মাদের মতো, যে খেলা আমাকে দিয়েছে পরিপূর্ণ আনন্দ-বেদনার স্বাদ, যে খেলা আমার সুখ দুঃখের সাথী, সেটা কী শুধুই খেলা? মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে নিজের কাছে প্রশ্ন করি।

যখন সে স্রেফ শব্দ দিয়ে বদলে দিতে থাকে পুরো ড্রেসিং রুমের দৃশ্য, তা দেখে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল খুব পরিচিত এবং আমার প্রিয় সিনেমা ‘ডেড পোয়েট সোসাইটি’তে বলা রবিন উইলিয়ামসনের একটি কথা, ‘No matter what anybody tells you, words and ideas can change the world’।

কিছুদিন আগে একটা অ্যামেরিকান স্পোর্টস রিলেটেড কমেডি সিরিজ ‘টেড লাসসো’ দেখতে দেখতে হয়তো ওই প্রশ্নের উত্তর কিছুটা স্পষ্ট হয়েছিল। অ্যামেরিকান রাগবি টিমের কোচ, ফুটবলে পুরোপুরি নিরক্ষর টেড লাসসো যখন ইংল্যান্ডে আসে একটি ক্লাবের কোচ হয়ে এবং যখন সে স্রেফ শব্দ দিয়ে বদলে দিতে থাকে পুরো ড্রেসিং রুমের দৃশ্য, তা দেখে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল খুব পরিচিত এবং আমার প্রিয় সিনেমা ‘ডেড পোয়েট সোসাইটি’তে বলা রবিন উইলিয়ামসনের একটি কথা, ‘No matter what anybody tells you, words and ideas can change the world’। খুব স্বাভাবিকভাবে কিংবা মেটাফরিক্যালি চিন্তা করলে দেখা যায়, ফুটবলের বাস্তবতা অনেকটা এমনই। তাই তো ফুটবল হয়ে যায় আমাদের সামগ্রিক পরিচয়। ফুটবল যখন প্রতিবাদের ভাষা তখন কখনও কখনও স্টেডিয়াম হয়ে যায় ব্যাটেলফিল্ড। আমরা সগৌরবে বলে উঠতে পারি, নো মোর রেসিজম। আমরা দাঁড়াতে পারি প্যালেস্টাইন কিংবা ইউক্রেনের পাশে।


Ibrahimobich

জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ


ব্রাজিল বললেই আমাদের প্রথমেই মাথায় আসে ফুটবলের কথা। অনেক অনেক যুদ্ধের শেষে, অ্যামাজন বনের নির্যাস নিয়ে যারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা বিশ্ব; শুধু মাত্র একটি বলকে কেন্দ্র করে। পৃথিবীতে এত দেশ, এত ভাষা, কতো কতো বিভক্তিতে ঠাসা, তবুও একটি বলকে কেন্দ্র করে সহজেই একটি গোল পৃথিবী আঁকা যায়। ম্যারাডোনাকে ঈশ্বর ভেবে অনেকেই তৈরি করে নতুন ধর্ম। যেমন ধর্মগ্রন্থের মতো মানুষ পাঠ করে ফুটবল নিয়ে গ্যালিয়ানোর বই। কেউ কেউ জমি বিক্রি করে তৈরি করে আকাশছোঁয়া পতাকা। শত অভাবের মাঝেও কেউ কেউ তুমুল পরাজয়ের পরেও জার্সি পরে ঘোরে। ফুটবলের সাথে তাই কবিতার খুব একটা পার্থক্য আছে, এমন কখনওই মনে হয়নি আমার; বরং বলা যায় মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। মাঝেমধ্যে মনে হয় কবিতা হচ্ছে অনেক যত্ন করে সঞ্চয় করা অর্থের বিনিময়ে কেনা মেয়েদের জুয়েলারি, না পরলেও তেমন ক্ষতি নেই, তবু ওই জুয়েলারি পরার স্বপ্নে বিভোর হয়ে অনেকেই কাটিয়ে দেন অনেক বিনিদ্র রাত। ছোটোবেলা থেকেই ক্লাব ফুটবলে আমি আর্সেনালের ফ্যান। তাই চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনালে আর্সেনালের পরাজয় সহজেই কেড়ে নিতে পেরেছিল আমার নাওয়া-খাওয়া। প্রতি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার পরাজয় আমাকে ফেলে দেয় ডিপ্রেশনের সমুদ্রে। এত এত পরাজয়ের পরেও কেন তবু ফুটবল? ওরা জিতলেও তো আমার বিশেষ লাভ হতো না, স্বাবলম্বী হতাম না আর্থিকভাবে কিংবা আমার জীবনে আসতো না কোনো নতুনত্ব। এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে আবিষ্কার করি, কোথাও মায়া রহিয়া যায়। এই মায়ার নাম হয়তো ভালোবাসা, যা শব্দ দিয়ে কখনও ব্যাখ্যা করা যায় না। বরং এই ভালোবাসা আমাদের সহনশীল হতে সাহায্য করে। এই ভালোবাসা আমাদের দেয় অপার্থিব আনন্দের স্বাদ। যখন এভাবে চিন্তা করি, জেনে যাই, আমাদের যাপিত জীবনে ফুটবলের চেয়ে আপন আর কিছু নেই। আমাদের মনে পড়ে যায় পেলের কথা, ‘যা অর্জন করা যত কঠিন, তা জয়লাভ করা ঠিক ততটাই আনন্দের’।

অমানবিক শক্তি না থাকলে, জীবনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া সম্ভব না। যখন ফুটবলের শক্তির উৎস খুঁজতে চেষ্টা করি তখন দেখা পাই এক মহৎ শিল্পের। এই শিল্প জানে জিঙ্গা, তিকিতাকা, টোটাল ফুটবলের ভাষা। মেইনটেনেন্স, টেম্পো, বিলড আপ, ডিরেক্ট প্লে, কাউন্টার অ্যাটাক, হাই প্রেস কিংবা ক্রসিং এই শিল্পের বর্ণমালা।

অমানবিক শক্তি না থাকলে, জীবনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া সম্ভব না। যখন ফুটবলের শক্তির উৎস খুঁজতে চেষ্টা করি তখন দেখা পাই এক মহৎ শিল্পের। এই শিল্প জানে জিঙ্গা, তিকিতাকা, টোটাল ফুটবলের ভাষা। মেইনটেনেন্স, টেম্পো, বিলড আপ, ডিরেক্ট প্লে, কাউন্টার অ্যাটাক, হাই প্রেস কিংবা ক্রসিং এই শিল্পের বর্ণমালা। এইসব ব্যাকরণ দিয়েই মহৎ শিল্পীরা আঁকেন জাদুবাস্তব ছবি। তাই তো ম্যারাদোনা কিংবা মেসি যখন ৬/৭ জনকে ড্রিবল করে, বাঁ পায়ের সাহায্যে খুঁজে পায় মহাজাগতিক ইন্দ্রজাল তখন স্থবির হয়ে বসে থাকা ছাড়া আমাদের কিছুই করার থাকে না। যে গ্রহ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই, যে গ্রহ আমাদের একেকজনের কাছে একেকরকম, সে গ্রহ থেকেই এসেছে এই শিল্পীরা, এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে তাই খুব বেশি দেরি হয় না আমাদের। হেড দিয়ে গোল করার জন্য যখন শিকারি ঈগলের মতো লাফিয়ে ওঠে ক্রিশ্চিয়ানো কিংবা দূরত্বের সীমা ভেঙে যখন বাই সাইকেল কিকে গোল করে ইব্রাহিমোভিচ তখন আমাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব। প্রতিটি পাস, প্রতিটি লং রেঞ্জ শট, প্রতিটি ইন্টারশেপশন, প্রতিটি ব্লক, প্রতিটি সেইভ, তাই প্রতিবার নতুন করে ভিন্ন ভিন্ন নন্দনের স্বাদ নিয়ে আসে। এ যেন সে-ই বোধ, যা সহজে যায় না এড়ানো।


আর্সেন ওয়েঙ্গার

আর্সেনাল কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার


ফুটবল নিয়ে কতো চমৎকার সব বই হয়েছি রচিত। গুণী নির্মাতারা তৈরি করেছেন দারুণ সব সিনেমা। ফুটবল নিয়ে চমৎকার সব কথা বলে গেছেন কতো মহারথী। ফুটবল কখনও প্রেম, কখনও রাজনীতি। এসবের বাইরেও মাঝেমধ্যে মনে পড়ে জিদানের বলা একটি কথা, ‘ফুটবল খেলার জন্য আমার বুট ছিল না, তাই আমি একবার কেঁদেছিলাম। কিন্তু, একদিন আমার একজন মানুষের সাথে দেখা হয়েছিল, যার পা নেই।’ বহু পুরাতন কথা, নতুন মোড়কে বলা, এমন আপনার মনে হতেই পারে। যেমন এই পুরাতন কথাটা একই সাথে রিপ্রেজেন্ট করে ভিন্ন ভিন্ন দর্শনকে। ফুটবলে আমার অসম্ভব প্রিয় মানুষ, আর্সেন ওয়েঙ্গার, যাকে মানুষ আর্সেনালের কোচ হিসেবে জানে, যাকে আমি একজন মহৎ ফিলোসফার হিসেবে মানি। বলেছিলেন, ‘তুমি যদি কোনো বিষয়ে বিশ্বাস না রাখতে পারো, তবে তোমার লক্ষ্য অর্জনের কোনো সুযোগই নেই’। ফুটবল নিয়ে বলা এই কথা তো আমাদের যাপিত জীবনেরই অংশ। তাই যখন কেউ জিজ্ঞেস করে, কেন এত ফুটবল দেখো কিংবা ফুটবলে কোথায় নন্দন আছে? তখন রোনালদিনহোর মতো আমারও বলতে ইচ্ছে হয়, ‘আমার পায়ে একটি বল নিয়েই আমি জীবন সম্পর্কে জেনেছি।’

ফুটবলে আমার অসম্ভব প্রিয় মানুষ, আর্সেন ওয়েঙ্গার, যাকে মানুষ আর্সেনালের কোচ হিসেবে জানে, যাকে আমি একজন মহৎ ফিলোসফার হিসেবে মানি। বলেছিলেন, ‘তুমি যদি কোনো বিষয়ে বিশ্বাস না রাখতে পারো, তবে তোমার লক্ষ্য অর্জনের কোনো সুযোগই নেই’।

নন্দন থেকে দর্শন, দর্শন থেকে বোধ, বোধ থেকে তৈরি হওয়া আমাদের ক্রোধ—ফুটবল মিশে আছে সবখানে। এই অনুভূতির মধ্যে কোনো খাঁদ নেই, নেই কোনো ছলচাতুরী। তাই, ৪ বছর পর পর ফিরে আসা একটা টুর্নামেন্টকে ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ বলে স্বীকার করে নিতে আমাদের কোনো সমস্যা হয় না। তাই তো, শীতের মধ্যরাতে যখন জোনাকিরাও ঢলে পড়ে ঘুমে, তখনও একটা ম্যাচ জয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করতে চুল খুলে রাস্তায় নেমে পড়ে কিশোরীরা, ভুভুজেলার শব্দকেও মনে হয় পিয়ানোর সুর। জীবনের অসংখ্য বিপত্তির মাঝে, এত এত এপিটাফের ভাঁজে ফুটবল যেন আত্তারের কনফারেন্স অব দ্যা বার্ডের সেই পাখি, যার সন্ধানে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে দিতে পারি একটা জীবন। কারো কাছে অনর্থক, কারো কাছে মিনিংলেস উন্মাদনা। কেউ কেউ এই উন্মাদনা দেখে গড়াগড়ি খায় চাঁদে, কিন্তু আমরা যারা ফুটবল ভালোবাসি, তারা অন্তত জানি, ফুটবল ইজ মোর দ্যান অ্যা গেইম, ফুটবল ইজ সিরিয়াস।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২ ডিসেম্বর, ১৯৯১; বরিশাল। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় স্নাতক। পেশায় সাংবাদিক। প্রকাশিত বই : মৃত্যুর মতো বানোয়াট  [কবিতা; ২০১৭] থাকে শুধু আলেয়া  [কবিতা;২০১৯], হিম বাতাসের জীবন  [গল্প ;২০২০], উদাসীনতা, সঙ্গে থেকো; [উপন্যাস; ২০২১] ই-মেইল : dhrubonahid@gmail.com

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।