কোভিড আক্রান্ত পৃথিবীর কথা এখন অনেকে ভুলে গেলেও এই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন একদিন সমগ্র মানবজাতিকে মহাবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। পেশাগত কর্তব্যহেতু অনেকরকম ঘটনা এবং হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সম্মুখীন হবার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল। আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-স্বজনের অসুস্থতা ও মৃত্যু প্রতিমুহূর্তে আমাকেও মৃত্যুর আশপাশেই হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছে। আমার পরিবারের সদস্যদের এবং আমার নিজের জীবনেও নেমে এসেছিল ভয়াবহ কোভিডের আঘাত। দীর্ঘদিন হাসপাতালে যমের সাথে টানাহেঁচড়া করে যদিও ফিরে এসেছি, বুকের ভিতরে করোনার চিরস্থায়ী প্রভাব রয়েই গেল। এ দুঃসময়ে নিকটজনের অমানুষ হওয়ার দৃশ্য যেমন দেখেছি, তেমনই অনাত্মীয় অপরিচিতের মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে অশ্রুসিক্ত হয়েছি। এ সময়টায় শুধু কোভিড পরিস্থিতিই নয়, আমাকে কোভিড-ব্যাবসা, কোভিড-রাজনীতি ছাড়াও শৈশবস্মৃতি, পরিবেশচিন্তা এবং জীবনদর্শনের নানা দিক আলোড়িত করেছে।

যথানির্দেশ উপুড় হয়ে আছি | জিললুর রহমান | প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর | ধরন: কবিতা | প্রকাশক: দ্বিমত পাবলিশার্স |মুদ্রিত মূল্য: ২৫০ টাকা | বইটি সংগ্রহ করতে এখানে ক্লিক করুন
নাম কবিতা ‘যথানির্দেশ উপুড় হয়ে আছি’ একটি সিরিজ বা বলা যায় বেশ ক’টি ছোটো ছোটো কবিতার সূত্রবদ্ধ সংকলন, যাতে আমার কোভিড-আক্রান্ত যন্ত্রণাক্লিষ্ট সময়টাকে ধারণ করতে পেরেছে বলে মনে করি। এই নাম কবিতায় আমার উপর্যুপরি কাশির দমক এবং শুশ্রুষাকারীদের বারবার উপুড় হয়ে থাকার নির্দেশে ওষ্ঠাগত প্রাণ রক্ষার পাঁয়তারার পাশাপাশি দেখেছি মৃত্যুর মিছিল, চিকিৎসক ও সুঁইদিদিদের আন্তরিক সেবাদান। বইটি ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ কবিতা দিয়ে শুরু হয়েছে। প্যান্ডোরার হাত দিয়ে জিউস যেভাবে বিশ্বময় মৃত্যু ও জরার বিষ ছড়িয়ে দিয়েছিল, কোভিড জীবাণু যেন প্যান্ডোরার কোনো গোপন বাক্স থেকে বেখেয়ালে বেরিয়ে পড়েছে। লকডাউনের দিনগুলো ছিল অনেকগুলো স্থবির দিনের সমাহার। বেঁধে রাখা ব্যাকপ্যাক পড়ে ছিল, সঙ্গীকে নিয়ে না পাহাড় না সাগর—কোথাও যাবার নেই—কেবল বসে থাকা, ‘কখন থামবে কোলাহল’! আর বসে বসে ভাবছিলাম, মানুষের অবিমৃষ্যকারী আচরণের কারণেই প্রকৃতি আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। অন্যথা, সকল জীব যখন নিঃশঙ্ক ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেবল মানুষই কেন এমন বন্দী জড়বৎ অবস্থায় নিপতিত? এসময় দেশে দেশে মানুষ মরেছে পোকার মতোন। ভারতে রেলপথ ধরে এগিয়ে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা মনে পড়ে; টের পাই ‘দিল্লী অনেক দূর’ প্রবাদের সারমর্ম। অন্যদিকে যখন সহকর্মী তার শেষ স্যালিউট দিয়ে ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে, তখন অন্য কোথাও কোনো এক বিচিত্রা বিচিত্রভাবে সেরে ওঠে মরণঘাতী রোগের আক্রমণ থেকে। অথচ সন্দীপনের বেহালার তার ছিঁড়ে যায়, ‘রাগ ঝরে পড়ে পরম প্রমাদে, কোথায় নিখোঁজ বেহালাওয়ালা’। বয়স্করা যাঁরা প্রতিদিন ভোরে সূর্যকে টেনে তোলে আকাশে, তাদের কেউ কেউ পরেরদিন ভোরে আর সূর্য তুলতে আসেন না। বুড়োরা সব ভুলোমন, কদিন আফসোস করে ঠিকই, তবে তারপর আবার তারা যথানিয়ম সূর্য তুলতে যায়।
এই বইটিতে কোভিড ছাড়াও রয়েছে পারিপার্শ্বিক আরও নানা বিষয়ের কবিতা— যেমন, লেনিনের দেড়শতম জন্মদিন স্মরণ। এখানে চে’র চুরুট নিয়ে যেমন লেখা রয়েছে, তেমনি আমাদের সামাজিক জীবনের লালফিতার হয়রানি, ঘূর্ণিঝড় রেমালের সাথে সাগরপাড়ে বড়ো হওয়ার অভিজ্ঞতার অভিক্ষেপ। আবার কখনও-বা তঞ্চঙ্গ্যা তরুণীর ফুলবিজু উদযাপনের উৎসবমুখর উজ্জ্বলতা। এরকম নানা বৈচিত্র্যের কবিতা এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। আমার জানামতে একমাত্র সন্দ্বীপেই দেখা যায় একটা বিশেষ ফুল— ‘পুন্ন্যাল ফুল’, যা জুনের সকালে ফোটে, তখন দ্বীপবাসী উৎসবের আমেজ উপভোগ করে, যেন পুন্ন্যাল তাদের জন্য ভাগ্য নিয়ে আসে। এই অস্থির সময়ে শৈশবস্মৃতি আঁকড়ে ধরেছে বহুবার। আমাদের উঠোনে ফোঁটা হাস্নুহানা ফুলের সৌরভ এবং মায়ের আবেগোচ্ছ্বল জ্যোৎস্নাপ্লাবিত সন্ধ্যা কিংবা মামাবাড়ি-সংলগ্ন জঙ্গল, যাকে আমরা বারিছা বলে থাকি, তার ঘন অরণ্যের অভ্যন্তরে শৈশবের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর স্মৃতি কিংবা চন্দনপুরার গলি এবং আশেপাশের ৫-৭টা পুকুরে একেকদিন একেকটায় সাঁতরে বেড়ানো দিনগুলো এবং ফায়ারব্রিগেডের বিল্ডিং থেকে ভেসে আসা বাঁশির মাতালকরা সুর এখানে উঠে এসেছে কবিতার ভাষায়। বইটি শেষ হয়েছে ‘দৌড়’ কবিতা দিয়ে, যেখানে দৃশ্যমান হয় যে আমাদের জীবন জুড়ে দৌড়ের কোনো শেষ নেই, আমরা দৌড়ে যাচ্ছি জীবনের কাছে ধরা পড়ে যাব বলে। বইটি এই বইমেলায় পাওয়া যাবে শব্দকথা প্রকাশনীর ১৭১ নম্বর স্টলে। এছাড়া লিটলম্যাগ চত্বরে পাবেন নিসর্গ-এর ৫৬ নম্বর স্টলে।
‘ইশকুলে বার্ষিক প্রতিযোগিতা জিনিসটা দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া দরকার। এখানেই প্রথম জেনেছি সহপাঠীরা বন্ধু নয়, শত্রু—প্রতিযোগী—প্রতিদ্বন্দ্বী। তারপর ক্লাস টেস্ট কিংবা বার্ষিক পরীক্ষায় মৃত্যুঞ্জয় আমাকে ডিঙিয়ে প্রথম হলেই বাবা রেগে কাঁই। আমিও দিলাম ভোঁ দৌড়—পালাই পালাই।
আর সেই মৃত্যুঞ্জয় যখন পরীক্ষার খাতা শূন্য রেখে মৃত্যুর কাছে পরাজয় মেনে নেয়, তখনও কি আমি তার সাথে পেরেছি প্রতিযোগিতায়? সে আমার ঢের আগে পৌঁছে গেল জীবনের শেষ সীমানায়…’

জন্ম ১৯৬৬ সালের ১৬ই নভেম্বর, চট্টগ্রামে।
তিনি আশির দশকে লেখালেখির যাত্রা শুরু করেন। কবিতা বিষয়ক নিবন্ধ লেখার পাশাপাশি কবিতা এবং নন্দনতাত্ত্বিক প্রবন্ধ অনুবাদ করেন। সম্পাদনা করেছেন ‘যদিও উত্তরমেঘ’ (২০১৭) নামের ছোটোকাগজ। তিনি ‘লিরিক’-এর সম্পাদনা পরিষদের সদস্য (১৯৯২-২০০৫) ছিলেন। ৭টি কবিতার বই, ৫টি প্রবন্ধ সংকলন এবং ৩টি অনূদিত বইয়ের রচয়িতা জিললুর রহমান। নাজিম হিকমতের রুবাইয়াতগুলি তিনিই প্রথম বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি একজন চিকিৎসকও।