বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

আমার শিক্ষক শিল্পী সফিউদ্দীন আহমদ : আবদুস সালাম

0

ঊননব্বই সালে তৎকালীন চারুকলা ইনস্টিটিউট এ ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির পর্বে এর প্রতিষ্ঠাতাদের নাম আয়ত্ত করতে হয়েছে। কিন্তু কখনও তাদের দেখার সৌভাগ্য হয়নি। নব্বইয়ের জানুয়ারিতে ক্লাস শুরু হলেও ব্যক্তিগত কারণে সম্ভবত ফেব্রুয়ারিতে আমি ক্লাশ শুরু করি। চারুকলায় তখন প্রি-ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ক্লাস হতো। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে গ্যলারি ডানে রেখে প্রথম যে ক্লাশ রুমটা, সেখানে। সাত্তার ভাই তখন আমাদের ক্লাস এর সহকারী। (বর্তমানে ছাপচিত্র বিভাগে কর্মরত) ক্লাসের সামনে বসে অনুশীলন করছি, হঠাৎ চোখ পড়ল প্রধান ফটক দিয়ে একজন নিপাট ভদ্রলোক লম্বা, কাঁচা পাকা চুল, খদ্দরের একটি ফুল হাতা শার্ট পরে সোজা ভেতরে আসছে। আমার সামনে আসতেই দাঁড়িয়ে গেলাম। সালাম সম্বোধনের আগেই বিনয়ের সঙ্গে বললেন বসো বসো। আমি মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকি। সাত্তার ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম উনি কে?

সাত্তার ভাই অবাক হয়ে বলল— হেরে চিনেন না উনি হচ্ছেন শিল্পী সফিউদ্দীন। এই চারুকলার একজন প্রতিষ্ঠাতা। ততক্ষণে আমার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। এরকম ভদ্র পোশাকে আশাকে নিপাট ভদ্রলোক কোনো মানুষ আবার শিল্পী হয়! প্রথম অভিজ্ঞতা হলো।


সফিউদ্দীন আহমদ

শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমদের বাসায় জন্মদিন উদযাপনের পর তোলা, (১৯৯৭-১৯৯৮)। | ছবি : হোসেন শহীদ ইকো


প্রি-ডিগ্রি শেষ করে ঘটনাক্রমে আমি ছাপচিত্র বিভাগে ভর্তি হই। আমার মনে হয়েছিল এই বিভাগে ক্লাসের পরেও নিজের মতো রাত পর্যন্ত কাজ করা যায়। অন্তত অগ্রজ ভাইদের তাই দেখতাম। আমি বি.এফ.এ-র প্রথম বর্ষ থেকেই একটু নিজের মতো কাজ করতাম। তা নিয়ে আমার বন্ধুবান্ধব বাঁকা চোখে কথা বলত। তখন আমি বি.এফ.এ দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। আমার অগ্রজ ভাইয়েরা বলত এসব করো কিন্তু সফিউদ্দীন স্যার যেন দেখেন। দেখলে স্যার কিন্তু অনেক রাগ করবেন। এই সতর্কবাণী সত্ত্বেও আমি ক্লাসের কাজের ফাঁকেই নিজের মতো করে কাজ করতাম। কী হতো জানি না; কিন্তু একটু নিরীক্ষামূলক কাজেই আমার মনোযোগ বেশি ছিল।

টের পাইনি স্যার কখন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমি সহপাঠীদের সতর্কতামূলক কাশি শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখি স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তখন দিগ্বিদিক শূন্য; মনে হয় আজই চারুকলার শেষ দিন। ভয়ে আঁটোসাঁটো। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কী করছ? আমি থতমত খেয়ে বললাম, জি স্যার এমনি! তারপর আবারও প্রশ্ন আর কী করেছ? আমি বললাম না স্যার আর কিছু করিনি, এটাই।

মাঝে মাঝে সফিউদ্দীন স্যার ক্লাসে ঢুকে দেখতেন আমি সব গুছিয়ে ক্লাসের কাজ করছি। ঘটনাক্রমে একদিন স্যার ক্লাসে ঢুকেছেন, আমি নিজের কাজ করছি। টের পাইনি স্যার কখন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমি সহপাঠীদের সতর্কতামূলক কাশি শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখি স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তখন দিগ্বিদিক শূন্য; মনে হয় আজই চারুকলার শেষ দিন। ভয়ে আঁটোসাঁটো। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কী করছ? আমি থতমত খেয়ে বললাম, জি স্যার এমনি! তারপর আবারও প্রশ্ন আর কী করেছ? আমি বললাম না স্যার আর কিছু করিনি, এটাই। স্যার বলল না করেছ আমি তোমাকে দেখি, প্রায়ই দেখি এখানে কি যেন করো। দেখি বের করো আর কী করেছ। আমি অনেক অনুনয় বিনয় করেও যখন পার পাচ্ছি না। তখন মনে মনে ভাবলাম ধরাই যখন খেয়েছি, দেখাই। ছাপচিত্র বিভাগের লিথোগ্রাফি রুমে তখন বড়ো কাঠের ডেস্ক ছিল। তার একটিতে আমার সব কাজ। আমি সবগুলো বের করে স্যারের সামনে রাখলাম। স্যার আস্তে আস্তে সবগুলো কাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। কিছুই বলছেন না। দেখা শেষ হওয়ার পর বললেন, তোমার যদি এগুলো করতে ইচ্ছা হয় করো, কিন্তু ক্লাসের কাজটিও একটু করো। পাস করতে হলে ক্লাসের কাজ দরকার।

এই কথা বলে স্যার বেরিয়ে গেলেন। আমি বাচ্চাদের মতো চিৎকার দিয়ে আনন্দ করে আমার সহপাঠিদের সব বললাম। আর ঠেকায় কে? তারপর থেকে স্যার আমার সাথে দেখা হলে জিজ্ঞেস করতেন— নতুন কি কিছু করেছ? আমিও স্যারের এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য নিজের মতো কাজ করতাম।

আমি আমার নিজের ভাবনায় যা করতাম স্যারকে মাঝে মাঝে দেখাতাম। স্যার প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কথা না বলে শুধু বলতেন করে যাও। ভালো-মন্দ এক সময় নিজেই বুঝে যাবে।

তারপর থেকে সফিউদ্দীন স্যারের সাথে আমার অন্যরকম সখ্য তৈরি হয়। একদিন ক্লাসে স্যার একটি সাবজেক্ট সাজিয়ে বললেন এই অবজেক্ট গুলো নিয়ে কম্পোজিশন করো। আমার তখন অনেক জিজ্ঞাসু মন, আমি স্যার কে সরাসরি প্রশ্ন করলাম— স্যার, হোয়াট ইজ কম্পোজিশন? আমার সহপাঠী থেকে শুরু করে স্যার নিজেও যেন একটু বিস্মিত হলেন। আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন তোমরা কি কম্পোজিশন জানতে চাও? আমার বন্ধু টুটুলসহ অনেকেই সম্মতি দিল! তারপর স্যার কম্পোজিশন সম্পর্কে দীর্ঘ ধারণা দিলেন। কম্পোজিশন কী? কম্পোজিশন কত প্রকার হতে পারে। লাইন কম্পোজিশন, ফর্ম এর কম্পোজিশন, রং এর কম্পোজিশন, হাতে কলমে ধারণা দিলেন। তারপর সামনের স্টিল লাইফ দিয়ে হাতে কলমে বিস্তারিত বললেন। আমার শিক্ষাজীবনে এমন ক্লাস আমি কখনও পাইনি। ছবি আঁকার প্রধান বিষয়টি এমন সুন্দর করে স্যার বুঝালেন, জীবনে আর কখনও কম্পোজিশন নিয়ে ভাবতে হয়নি।


সফিউদ্দীন আহমদ

আরেকটি পুরনো ছবি। ছাত্র-ছাত্রী পরিবেষ্টিত শিল্পী সফিউদ্দীন আহমদ। | ছবি : হোসেন শহীদ ইকো


পরদিন একটু দেরি করে ক্লাসে যাওয়া। স্যার হন্তদন্ত হয়ে আসলেন, বললেন আমি সেই সকাল থেকে এসে বসে আছি। গতকাল তোমাদের যা বলেছিলাম তা একটু সংশোধন করতে হবে। এই যে সামনের যেই সাবজেক্টটা তার কম্পোজিশনে একটু সমস্যা আছে। বলতো তোমরা ধরতে পারো কি না? আমাদের অপরাগতার পরে স্যার নিজেই দেখালেন যে এই ঘোড়াটার যে লাইন তা কিন্তু ব্যালেন্স না। মনে হয় একটু ঘুরিয়ে এই দিকে দিলে, কম্পোজিশনটা ব্যালেন্স হবে। আমরা অবাক হলাম একজন শিক্ষকের ছাত্রদের প্রতি কতটুকু নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা থাকলে একটা বিষয়কে সম্পূর্ণভাবে ছাত্রদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য ভাবতে পারেন।

আমার মনে হয় এই ধরনের কোনো ক্লাস আমি ছাত্রজীবনে পাইনি। যতটুকু শিখেছি আমি সেই শিল্পী শিক্ষক সফিউদ্দীন স্যারের কাছ থেকে। শুধুমাত্র যে ছবি আঁকা তা নয়, জীবন দর্শন, শিল্পী জীবন, সংগীত, সাহিত্য, এসব নিয়েও, কথা বলতেন। ১৯৯৮ সালে আমি সর্বকনিষ্ঠ শিল্পী হিসেবে জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে সম্মানিত হই। তখনও পুরস্কার দেওয়া হয়নি। আলভী স্যারের কাছ থেকে আমি জেনেছিলাম। কাউকে বলা হয়নি।

সফিউদ্দীন স্যারের সাথে বারান্দায় আমার দেখা। স্যার কাঁধে হাত রেখে বললেন। আমি আলভীর কাছ থেকে শুনেছি। শোনো তোমার কাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য কি জানো? তোমার কাজে এক ধরনের চমক আছে। তোমার কাজ হচ্ছে চমক দেওয়া। যতদিন তোমার এই বৈশিষ্ট্য ধরে রাখবে ততদিনে তুমি শিল্পী। চেষ্টা করো এই চমকটা যেন শেষ না হয়। আরও অন্যান্য প্রসঙ্গে বলার পর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা যা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে তা হলো স্যার প্রায় বলতেন। জীবনের বেলায় অল্পতে সন্তুষ্ট হও, কিন্তু শিল্পে কখনও সন্তুষ্ট হবে না। শিল্পে সন্তুষ্ট হলে শিল্প মরে যায়।

স্যার তখন সাদাকালো সিরিজের কাজগুলো করছিলেন। আমার সাথে দেখা হওয়ার পর স্যার তার স্টুডিওতে নিয়ে গেলেন। কাজগুলো দেখিয়ে আমাকে থতমত খাইয়া বললেন, দেখ তো কাজগুলো ঠিক আছে কি না। একটু পরামর্শ দাও। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম।

সফিউদ্দীন স্যারের ছেলে আহমেদ নাজিরের সাথে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। চারুকলায় তখন বিকেলে সিনিয়ার জুনিয়র দারুণ আড্ডা হতো। এই আড্ডা আসলে জুনিয়রদেরকে অনেক সমৃদ্ধ করত। তো আহমেদ নাজিরের সাথে সম্পর্কের কারণে বহুবার স্যারের বাসায় যাওয়া হতো। স্যার তখন সাদাকালো সিরিজের কাজগুলো করছিলেন। আমার সাথে দেখা হওয়ার পর স্যার তার স্টুডিওতে নিয়ে গেলেন। কাজগুলো দেখিয়ে আমাকে থতমত খাইয়া বললেন, দেখ তো কাজগুলো ঠিক আছে কি না। একটু পরামর্শ দাও। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই স্যার বললেন, অনুজদের কাছ থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। তুমি বলো। আমি আসলেই সেই দিন কিছুই বলতে পারিনি। নিজেকে স্যারের কাজ নিয়ে বলার যোগ্য ভাবিনি। এই ঘটনাটি এখনো আমার মনে দাগ কাটে। আমি নিজেও চেষ্টা করি অনুজদের পরামর্শ শোনার। যা স্যারের কাছ থেকেই শেখা।

এতো ভালো ভালো স্মৃতির পরেও কিছু দুঃখজনক স্মৃতি আমার মনে সংরক্ষিত আছে। যেটা আমি কখনও শেয়ার করিনি। কেউ কি জানে ছাপচিত্র বিভাগে স্যারের শেষ ক্লাস কোনটি? কেন স্যার আর কোনো ক্লাস নেননি? কেউ কি জানে শেষের দিকে স্যার কেন কোনো ক্লাসে ঢুকতেন না? আমি অনেক অনুনয় সত্বেও স্যার বিভিন্ন ব্যস্ততার কথা বলে চলে যেতেন। স্যার যে কি অভিমানী, সেটার জীবন্ত সাক্ষী আমি। আমাদের দেশে অপ্রিয় সত্য কথা প্রকাশিত হয় না। তাই অনেক কিছুই দৃষ্টির আড়ালে, ঘটনার আড়ালে চাপা পড়ে যায়। তাই বিতর্ক এড়াতে আমিও চেপে গেলাম। হয়তো অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে তা আলোচিত হবে। আমি স্যারের সেই সময়ের সেই করুণ চেহারা কোনোদিন ভুলব না। যা মনে হলে এখনো আমি ব্যথিত হই।

আমরা ছাত্র বয়সেই স্যারের জন্মদিন পালন করার জন্য সকালবেলা স্যারের বাসায় যেতাম। তারপর ৭৫তম জন্মদিনে শিল্পকলায় মহা আড়ম্বরে উদযাপিত হয়েছিল। সেই জন্মদিনে কোনোরকম পারিশ্রমিক ছাড়াই, মঞ্চসজ্জা, অনুষ্ঠান পরিকল্পনা থেকে শুরু করে, একটি আর্কাইভ প্রদর্শনীর আয়োজন এর সাথে যুক্ত ছিলাম। ওই অনুষ্ঠানটি এত আন্তরিক এবং জমকালো ছিল যে, আয়োজক সুবীর’দা নিজেও বিস্মিত হয়েছিলেন। স্যারের প্রতি শিল্পীদের শ্রদ্ধা সেদিন উপলব্ধি করেছি।

আজকে যখন স্যার এর জন্ম এবং মৃত্যু দিনে ফুলের মালা নিয়ে অনেকেই শ্রদ্ধা জানাতে যায়, আমার মনে পড়ে তাদের কারো কারো অশ্রদ্ধার কারণেই স্যার শেষ দিকে কখনও ক্লাস নেননি এবং ক্লাসে ঢুকতেন না। আমি স্যারকে আমার হৃদয় থেকে আজীবন ভালোবাসবো এবং স্যারের আদর্শ মেনে চলার চেষ্টা করব। স্বভাবগত কারণেই বাহ্যিক ভালোবাসার প্রকাশ আমার কখনও হয়ে ওঠে না। সেজন্য যাওয়া হয় না জন্ম কিংবা মৃত্যুদিনের ফটোসেশনে। শততম জন্মবার্ষিকীতে স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। যদি কখনও সুযোগ হয় আরও বিস্তারিত লেখার তখন আরও অনেক গল্প এবং ঘটনা লেখা হবে।

একটি দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহের কথা বলে লেখাটা শেষ করছি। সফিউদ্দীন স্যারের কোনো সাক্ষাৎকার সহজে কেউ নিতে পারেনি। যেটাতে স্যার কখনও স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন না। মনে হয় আমিই একটা অডিও ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। যেটা আমার সংগ্রহে আছে। যদি কখনও সুযোগ পাই, তবে সবাইকে শোনানোর ব্যবস্থা করব।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।