সত্যজিৎ রায় ছাড়া সিনেমার আলোচনা কেমন যেন জমে না। ঘরের লোক বলে এটাকে আবেগ বললে ভুল হবে। সিনেমার মধ্যে নিজেকে প্রকাশ, আর তা আজীবন করে যাওয়াটা আমি সাহস হিসেবে দেখি, যে সাহস আমাদের সংস্কৃতিরও একটা বড়ো অংশ।
‘ইন্ডিয়ান সিনেমা যখন কেউ ক্লাসিফাই করবে, তখন তার দুটো ভাগ হবে, সত্যজিৎ পূর্ব আর সত্যজিৎ পরবর্তী।’ কথাটি বলেন বরেণ্য চিত্র পরিচালক শ্যাম বেনেগাল, যাঁর নেয়া গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারটি এখানে অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি।
সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয় ১৯৮২ সালে। এখানে আমরা সিনেমার দর্শক সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা নি্রমাতা হয়ে ওঠা দেখতে পাব। জানতে পারব, সিনেমার প্রায় সব সেক্টরেই তার বিশাল অবদানের কথা ।
শ্যাম বেনেগালের সাথে ভালো সম্পর্ক আর সিনেমায় তার সম্পৃক্ততার সুবাদেই হয়তো আমরা এতো সাবলীল একটি আলোচনার সাক্ষাৎ পাই।
এই ইন্টারভিউতে সিনেমা দর্শক, সামাজিক প্রতিফলন, সিনেমার প্রতি ভক্তি সম্পকি্রত আলোচনা যখন এতো বছর পরেও একই মাত্রায় ভ্যালিড থাকে, তখন এটা পাঠ করা আমাদের অবশ্যকর্তব্য হয়ে ওঠে। এই মহান পরিচালকের শততম জন্মবার্ষিকী জন্মদিন উপলক্ষে্য শ্রী-র আয়োজনে চলুন পড়ে ফেলা যাক তাঁদের অমূল্য এই আলাপচারিতা।
সত্যজিৎ রায় : স্কুলের দিনগুলো থেকে আমি সিনেমার নায়কের প্রতি ইন্টারেস্টেড ছিলাম। আমি আসলে একজন সিনেমাপ্রেমী ছিলাম এবং পিকটার গো, ফটো প্লে, ফিল্ম পিক্টোরিয়াল এর মতো ম্যাগাজিন আমি নিয়মিত পড়তাম। ধীরে ধীরে কলেজের শুরুর সময়ে সিনেমার ডিরেকশনের দিকে আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে। ডিরেক্টর এর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সচেতন হতে থাকি। আমি জন ফোর্ড এর যে সিনেমাই পেয়েছি, দেখেছি। তারপর আরও বেশ পরে, ৪০ দশকের শুরুতে কিংবা ৩০ দশকের শেষে হলিউড কমেডি, হলিউড থ্রিলার আর বেশ কঠিন কিছু সিনেমা, যেমন, ৪০ দশকের শুরুতে বিলি ওয়াইন্ডারের ছবি, ‘ডাবল ইনডেমনিটি’, ‘ইন লাস্ট উইকেন্ড’, ‘মেজর এন্ড মাইনর’ এর মতো কমেডি, ‘লিও ম্যাফেরিড’ সিনেমা ‘ক্যারি গ্রান্ট’ এবং ‘আইরিন ডান’ যেটা খুবই সুন্দর ছিল। আমি এই সিনেমাগুলো টিভিতে দেখেছিলাম এবং এই কাজগুলো এখনও অপূর্ব। আর ফ্রাঙ্ক ক্যাপরা’র ৩০ দশকের ছবিগুলো, ‘ইট হ্যাপেন্ড ওয়ান নাইট, মি. স্মিথ গোজ টু ওয়াশিংটন’ আরও অন্যান্য।
তো, সিনেমাগুলো, প্রত্যেকটাই খুব সুচারুভাবে তৈরি করা। তাই আমার সিনেমাজ্ঞানও এইসব ভালো স্ক্রিপ্ট, ভালোভাবে পরিচালিত, ভালো অভিনীত সিনেমাগুলো থেকেই গড়ে উঠেছে।
আমার আমেরিকান সিনেমার সাথে পরিচয় হয়েছে যা ছিল ফ্রেঞ্চ ডিরেক্টরদের তৈরি করা, যারা ফ্রান্স ছেড়ে আমেরিকায় সেটেল্ড হয়েছিল যেমন, ডুভিবিয়ার, রেনোয়া আরও কয়েকজন। ফ্রিট্জ ল্যাঙ এর মতো কয়েকজন জার্মান ডিরেক্টরও ছিলেন। তারা আমেরিকাতে এসেও ফ্রেঞ্চ বা জার্মান ধাঁচেই সিনেমা বানাচ্ছিলেন। যেমন, রেনোয়া প্রথম যে সিনেমাটা আমি দেখেছি, ‘সাউর্থনার’ এইটা একটা আমেরিকান গল্প। আমেরিকান শিল্পীর অভিনয়ে কিন্তু দেখতে অন্য আমেরিকান সিনেমা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এটা যতটা না আমেরিকান হয়েছিল তারচে অনেক বেশি ফ্রেঞ্চ।
সিনেমা দেখে, এমন যে কেউই এই ফ্রেঞ্চ ডিরেক্টরের বানানো মুভি দেখে নতুন ধারা, স্টাইল বা এ্যাপ্রোচটা বুঝতে পারবে।
তো রেঁনোয়া যখন এখানে আসলেন, তখন আমি তাঁর আমেরিকান সিনেমাগুলোর সাথে পরিচিত, কিন্তু তাঁর ফ্রেঞ্চ সিনেমাগুলো আমি জানতাম না।
শ্যাম বেনেগাল : যখন আপনি সিনেমা বানানো শুরু করলেন, সিনেমার এখনকার অবস্থা নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল?
রায় : হ্যাঁ, ওই সময়ের বাংলা সিনেমার প্রতি ক্রিটিক্যাল ছিলাম, যা ফিল্ম সোসাইটির কয়েকটা বড়ো কাজের একটা। আমরা তখন বিদেশি সিনেমাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম এবং অইগুলোর সাথে ইন্ডিয়ান সিনেমার তুলনা করতাম। আমরা দেখি, আমাদের যারা কাজ করে তারা বাস্তবতাটা ধরতে পারে না। আবার বাজে ধরনের কমর্শিয়াল।
শ্যাম : আপনি যখন সিনেমা বানাবেন ডিসাইড করলেন, স্ক্রিপ্ট লেখাটাকে কীভাবে নিলেন?
রায় : একটু কনফিডেন্স বাড়ার পর, আমি আমার দ্বিতীয় সিনেমায় স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবেই শুরু করলাম। তখন অবস্থা এমন ছিল যে আমাকে প্রডিউসার, ডিস্ট্রিবিউটারদের বাসায় বাসায় গিয়ে গল্পটা শোনানো লাগত যাতে তারা টাকা দেয়। তো আমি একটা খাতায় গল্পটা ড্রইং করে রাখতাম, সিনেমারই নানা দৃশ্যের। সাদা কালোতেই করেছিলাম। আমি যখন তাদের সিনেমার গল্পটা বলতাম তখন সাথে আঁকা ছবিটা দেখাতাম। পরে যখন সিনেমা বানানো শুরু করেছি, তখন অই স্টোরি বোর্ডের খাতাটাই আমার সম্বল ছিল। অভিনেতা, অভিনেত্রীদের সাথে শ্যুটিং এর এক সপ্তাহ আগেই সবটা বুঝিয়ে দেওয়া হতো। আমার ক্রু, ক্যামেরাম্যান, এসিস্ট্যান্টদের সাথেও আগেই মিটিং প্রয়োজনীয় সবকিছু বুঝিয়ে দেওয়া হতো। আমরা গল্পের স্ট্রাকচারটা জানি, গল্প কোন দিকে এগুবে তাও জানি। সৌভাগ্যবশত, কোনো স্ক্রিপ্ট ছিল না, কিছু নোটপাতি ছিল আরকি। যা ছিল পুরোটাই আমার মাথার ভেতর। ডায়লগগুলো সবই বই থেকেই নিতাম, কারণ আমি ডায়লগ লিখতে জানতাম না। আমার ডায়লগ লেখার মতো কনফিডেন্সও ছিল না তখন। তবে আমার ভাগ্য ভালো বিভূতিভুষণ নিজেই বেশ প্রাণবন্ত সব ডায়লগই লিখে গেছেন
কখন কোন লেন্সের ব্যবহার হবে, এটা সিনেমার সবচেয়ে কঠিন বিষয়গুলোর একটা। আবার যা যা লেন্স দরকার ছিল, সব ছিলও না। তিনটা ক্যামেরা ছিল (ওল্ড মিচেল, বোলেক্স, আইমোর আর সাথে ওয়াল ক্যামেরা)। যেটা যেটা ব্যবহার করা যেত, সেটা ব্যবহার করতাম। সবসময় সেটা সঠিক লেন্স হতো না।
শ্যাম : অনেকে বলে, সত্যজিৎ রায়ের নিজস্ব স্টাইল আছে সিনেমার। ‘পথের পাঁচালী’র কথাই বলেন, লেন্সের কিছু ব্যবহারে বেশ স্বেচ্ছাচারিতা দেখা যায়।
রায় : এটা হওয়া সম্ভব। কখন কোন লেন্সের ব্যবহার হবে, এটা সিনেমার সবচেয়ে কঠিন বিষয়গুলোর একটা। আবার যা যা লেন্স দরকার ছিল, সব ছিলও না। তিনটা ক্যামেরা ছিল (ওল্ড মিচেল, বোলেক্স, আইমোর আর সাথে ওয়াল ক্যামেরা)। যেটা যেটা ব্যবহার করা যেত, সেটা ব্যবহার করতাম। সবসময় সেটা সঠিক লেন্স হতো না। লেন্সের ব্যবহারে অবশ্য আমাদের খুব একটা অপশনও ছিল না। র্দীঘ সময় ধরে আমরা ৩৫-৫০ অথবা ৩৫-৭৫ দিয়ে কাজ করে গেছি।
শ্যাম : শুরটা কীভাবে করতেন? এই ধরেন, আপনার একটা ডিটেল স্ক্রিপ্ট নাই, তাতে কিভাবে বুঝতে পারবেন যে দৃশ্যটা ভালো হচ্ছে কি না?
রায় : যদি আপনার মাথার ভেতর গল্পটা ক্লিয়ার থাকে, আমার মনে হয় সেইটাই যথেষ্ট। আপনিতো শ্যুট করবেন যেইটা আপনার মাথায় আছে সেইটা, কাগজেরটা না।
আমরা মাসে ৪-৫ দিন শ্যুটিং করছিলাম, কখনো তার চেয়েও কম। একবার তো ছয় মাস কাজ বন্ধ ছিল টাকার অভাবে। কিন্তু এটাতেও কোনো সমস্যা হয়নি। স্ক্রিপ্ট লেখার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না কারণ আমাদের অগাধ সময় ছিল ছবিটি শেষ করার। আসলে সিনেমা বানানো শিখেছিলাম সিনেমা বানাতে এসে। তার আগে আমরা কিছুই জানতাম না। আমাদের দলের বেশিরভাগ মানুষই কিছু জানত না। এমনকি আমাদের এডিটরও ছিল নতুন। এর আগে সে মাত্র একটি সিনেমায় কাজ করেছিল।
শেষ কাটিং এর সময় আমরা একটু তাড়াহুড়া করেছিলাম, এটা সত্যি। তো, সে সময় তারা কিছু অপ্রচলিত জিনিস করেছে না বুঝেই। এটা করতে টানা দশ দিন দশ রাত লেগেছে, আর আমি পুরোটা সময়ই সেখানে ছিলাম কারণ ডেডলাইন ধরতে হবে।
শ্যাম : এটা আপনার প্রথম সিনেমা, তারপরও, সিনেমার উপর আমার চমৎকার কন্ট্রোল ছিল। বিশেষ করে ক্লাইমেক্সের দিকে, যখন হরিহর বাড়িতে ফিরে, তখনকার সিনটা একটা চমৎকার কাজ ছিল। আপনি কি সিকুয়েন্স অনুযায়ী, মানে, শুরুর দিক থেকে শুরু করে ক্রমেই শেষের দিকে, এভাবে শ্যুট করেছিলেন?
রায় : তো প্রথম অংশে বেশ কিছু… কাট কাট বিষয় দেখা যায়, কাটিংয়ে, অ্যাকটিংয়ে, সবকিছুতেই, অবশ্য আমি জানতাম কঠিন সব বিষয়গুলোই পরের অংশে আছে। ইন্দির ঠাকুরণের মৃত্যু দিয়ে শুরু আর ক্লাইম্যাক্সে দুর্গার মৃত্যু, তার বাবা, হরিহরের ফিরে আসা। তো এগুলো মধ্যে আমরা বেশ কিছু জিনিস শিখেছি। আর ভুলবেন না যে, এটা বানাতে আমাদের আড়াই বছর সময় লেগেছে। তার মানে এক বার শ্যুটিং করার পর আমাদের তিন-চার মাস এটাকে নিয়ে ভাবার সময় হাতে ছিল, রাশগুলো দেখে দেখে ভুলগুলো খুঁজে বের করা আর সেগুলো আবার না করার শিক্ষা নেওয়া। আমার মনে হয় দ্বিতীয় অংশটা প্রথম অংশ থেকে চোখে পড়ার মতো ভালো ছিল।
শ্যাম : অপু ট্রিলজি সম্পর্কে বলি।এ সিনেমাগুলোতে এমন অনেক কিছু দেখা যায় যা শুধুই ইনফরমেশন দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়নি, ক্যারেক্টারগুলো তুলে আনতে, তাদের আবেগ-অনুভুতি, তাদের সর্ম্পকগুলো তুলে এনেছে।যেমন ধরুন, ইন্দির ঠাকুরণ মারা যাবার পর তার ছোটো কাসার ঘটিটি যখন গড়িয়ে গিয়ে পানিতে পড়ে যায় ,তখন। তারপর ধরুন ‘অপরাজিত’তে, যখন হরিহর অসুস্থ অবস্থায় যখন শার্টের বোতাম লাগাতে যায় আর তার স্ত্রী এসে হাত সরিয়ে দিয়ে বোতামগুলো লাগিয়ে দেয়, তখন। আবার কুপ থেকে পানি তোলার সময় দড়ির একটা মাথা যে গাছের ডালে বাঁধা আছে তা দেখানো; এরকম যে ডিটেইলগুলো… তো এর পরের সিনেমাগুলোতে আপনি এরকম ডিটেইলস আর ব্যবহার করেননি তেমন। এর পেছনে কি কোনো কারণ আছে?
ডিটেইলস এর ব্যাপারে আমি আগে থেকেই সচেতন ছিলাম। আপনাকে যেমন আগেই বলেছিলাম যে ডিটেইলস ব্যবহার করার যে আইডিয়াটা তা এসেছে আমি যেসব সিনেমা পছন্দ করি সেগুলো থেকে, আর অবশ্যই বিভূতিভূষন থেকেও (‘পথের পাঁচালী’র লেখক)। তিনি একজন লেখক, যিনি প্রায় সব ডিটেইলস দিয়ে থাকেন গল্পে যা খুব উপকারী আবার সিনেমেটিকও।
রায় : ডিটেইলস এর ব্যাপারে আমি আগে থেকেই সচেতন ছিলাম। আপনাকে যেমন আগেই বলেছিলাম যে ডিটেইলস ব্যবহার করার যে আইডিয়াটা তা এসেছে আমি যেসব সিনেমা পছন্দ করি সেগুলো থেকে, আর অবশ্যই বিভূতিভূষন থেকেও (‘পথের পাঁচালী’র লেখক)। তিনি একজন লেখক, যিনি প্রায় সব ডিটেইলস দিয়ে থাকেন গল্পে যা খুব উপকারী আবার সিনেমেটিকও। যেমন একটা গল্প বলি, একটা পরিবার, বাবা পাগল হয়ে যায় এবং তাকে ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব, তাই পরিবার তাকে দূরে কোথাও রেখে আসার প্ল্যান করেছিল। তার ছেলে আর কিছু প্রাপ্ত বয়স্ক লোক এই পাগল লোকটিকে নিয়ে মাইল তিনেক দূরে একটা ঝোপে রেখে আসে। ফেলে আসার সময় তার হাতে এক প্যাকেট বিড়ি, একটা সিগারেট আর একটা ম্যাচ দিয়ে আসে। ছেলেটার হঠাৎ তার বাবাকে ফেলে আসার জন্য পাপ বোধ হয়। সে ফিরে গিয়ে দেখতে পায় যে ঝোপের ওপাশ থেকে ধোঁয়া উঠছে। এইটা প্রচণ্ড সিনেমেটিক; কারণ পাগল লোকটা সিগারেট খাচ্ছে। তো এইরকম সিনেমেটিক দৃশ্য প্রায়ই সাহিত্য থেকে আসে, আরও বেশি আসে বিভূতিভূষণের কাছ থেকে। আমি এমন ডিটেইলস প্রায়ই ব্যবহার করতাম ডায়ালগের বিকল্প হিসেবে। মাঝে মাঝে আপনার হাতে কোনো অপশন থাকে না সাহিত্যের প্রতীক ব্যবহার করা ছাড়া যেমন, ‘জলসাঘর’ সিনেমায়, এখানে ঝামেলাটা হয়, এই জমিদার চরিত্র প্রায় ৪ মিনিট একাই স্ক্রিনে ছিল এবং শেষে কারো সাথে কোনো যোগাযোগও ছিল না। তো এইখানে গানের ব্যবহার করা যেত, কিন্তু সেটাও প্রতীকি। তো এখানে একজন ডিরেক্টরের আর কোনো উপায় থাকে না সাহিত্যিক সংকেত ব্যবহার করা ছাড়া, যেটা ব্যক্তিগতভাবে আমার পছন্দ না।
তবে আমার মনে হয় কি, অপু ট্রিলজির পরেও চারুলতা বা আরো কোথাও কোথাও এরকম অনেক ডিটেইলস আপনি পাবেন।
শ্যাম : যখন আপনি স্ক্রিপ্ট লিখতে থাকেন, এই ধরেন, বিভূতিভূষণের উপন্যাস নিয়ে, স্ক্রিপ্টিং এর সময়েই কি সবটা ডিটেল ভেবে রাখেন ? না কি শ্যুট করার সময় মনে হয়?
রায় : গুরুত্বর্পূণ ডিটেইলস স্ক্রিপ্ট স্টেজেই থাকতে পারে কিন্তু চলমান ডিটেইলস যেমন আপনি ‘অপরাজিতা’য় অসুস্থ বাবার কথা বললেন, যে অসুস্থ থাকায় বোতাম লাগাতে পারছিল না, তো তার স্ত্রী তাকে সাহায্য করল। এইরকম ডিটেইলস আমার বেশি চোখে পড়ে শ্যুট করার সময়। এই আইডিয়াটা আপনার হঠাৎ করে আসে যেটা ওই শ্যুট বা সিন বা অ্যাকশনকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলতে পারে। শ্যুট ইম্প্রোভাইজেশন এ সুযোগ সব সময় থাকে।
শ্যাম : অপু ট্রিলজিতে একটা বিষয় আমার খুব চোখে লেগেছে, যেটা আপনার আগে ইন্ডিয়ান সিনেমায় ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে হয় না। সেটা হলো আপনি তথ্য দেওয়ার জন্য ইনফর্মেশন সিন ব্যবহার করেন না। কোনো দৃশ্যকে ব্যাখ্যা করেন নাই। যেমন ‘অপুর সংসার’-এ অপু তার বন্ধুর সাথে রেললাইনে হাঁটতে হাঁটতে নিজের বায়োগ্রাফি লেখার কথা জানায়। এই দৃশ্য প্রচণ্ড মিত্যব্যয়িতার সাথে করা হয়েছে। আবার, আপনার পরের সিনেমাগুলোয় দেখা যায় আপনি কখনো কখনো ব্যাখ্যা করেছেন।
রায় : আমার মনে হয় এই বিষয়গুলো কাজ করার উপাদান থেকেই তৈরি হয় যা আপনি চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারবেন না। গতানুগতিক পদ্ধতি দিয়ে অনেক সময় কাজ করা হয় আবার কখনো হয় না।
‘অপুর সংসার’ এবং ওই ট্রিলজির বাকি সিনেমায় ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলো আমার কাছে আর কার্যকর না, কারণ আমি তাদের ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছি। এর আরেকটা বড়ো কারণ আমার কাজ করার উপাদানগুলো ভিন্ন, তাই এদের ট্রিটমেন্টটাও ভিন্ন।
শ্যাম : এর পেছনে কি আপনার নিজের জীবনের সাথে কোন সম্পর্ক আছে?
রায় : না, কারণ, সত্যি বলতে গ্রামের জীবন সর্ম্পকে আমার তেমন ধারনা ছিল না। আমার জন্ম শহরে এবং শহরেই বড়ো হয়েছি। বয়স ৩০ হবার আগে আমি একদমই গ্রাম চিনতাম না। কিন্তু দ্বিতীয় পার্টে অপুর কৈশোর এবং তার মা বিধবা হয়ে যাওয়া, এই মা এবং ছেলের সম্পর্কতে একটা আত্মজীবনীর ছাপ ছিল কারণ আমিও প্রায় একি অবস্থার ভেতর দিয়ে মানুষ হয়েছি।
শ্যাম : আপনি নিজেকে অপুর জায়গায় ভেবে দেখেছেন?
রায় : আমার মনে হয় এটা করা দরকারি। যখন এই চরিত্রের শৈশব থেকে যৌবন নিয়ে তিনটা সিনেমা বানাচ্ছেন, তখন অবশ্যই নিজেকে ওখানে ভেবে দেখতে হবে, নয়তো চরিত্রটির পুরোপুরি মূল্যায়ন সম্ভব নয়।
শ্যাম : যখন আপনি শুরু করেন, তখন কি তিনটি সিনেমা বানাবেন বলে শুরু করেন?
রায় : মোটেই না। আসলে তখন আমি একটা সিনেমার পরেই আর ভাবতে পারছিলাম না। তারপর ঘটনাক্রমে আমি দুইটা বানাই, যখন দর্শক এটাকে গ্রহণ করতে শুরু করে তখন। তার আগেই অবশ্য আমি বিজ্ঞাপন ছেড়ে ফিল্ম মেকিং এর সিদ্ধান্ত নিয়ে নেই। তারপর আমি সাবজেক্ট খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। তারপর হঠাৎ মনে হলো অপুকে নিয়েই আরেকটা সিনেমা কেন নয়? ‘অপরাজিত’ নামে বই তো আছেই। আমি বানিয়ে ফেললাম। তারপরও আমার মাথায় ট্রিলজির চিন্তা আসে নাই কারণ অপরাজিত বক্স অফিসে ভালো ব্যবসা করতে পারে নাই। তো আমি সম্পূর্ণ আলাদা কিছু ভাবছিলাম। আমি একটা কমেডি করলাম যেটা তুলনামূলক ভালো চলেছিল। তারপর ‘জলসাঘর’ বানালাম। ‘পরশ পাথর’ নামের যে কমেডি ফিল্ম বানালাম সেটাও খুব ভালো করল না। তাতে আমি আবার ভাবতে শুরু করলাম কি বানানো উচিত। তো আমি সিদ্ধান্ত নিলাম নাচ, গান নিয়ে সিনেমা করার যা মানুষ দেখে অভ্যস্থ। যদিও বানাতে গিয়ে এটা আর দশটা ফর্মুলা সিনেমার মতো হালকা কিছু আর থাকল না।
যখন ‘অপরাজিত’ ভেনিসে পুরস্কার জিতল, আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, আমি কোনো ট্রিলজি ভাবছি কি না, তখন আমি রাজি হয়েছিলাম।
শ্যাম : আপনার ‘চারুলতা’র পরের সিনেমাগুলোতে কিছু স্পষ্ট পরিবর্তন দেখা যায়। শুরুর দিকে যে সিনেমাগুলো আপনি বানিয়েছিলেন সেগুলেতে আমরা একটা লিরিক্যাল ধারা দেখতে পাই। কয়েকটা সিনেমা এমনও ছিল যে এই ধারা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। তারপর ‘চারুলতা’ দিয়ে এর শেষ হয় আর আপনি একটা ভিন্ন ধরনের সেন্সিবিলিটি নিয়ে কাজ শুরু করেন। এর কারণ কী মনে করেন?
রায় : আমি একটা জিনিস করার চেষ্টা করছি সেটা হলো নিজেকে রিপিট না করা। আমি ট্রিলজি বানিয়েছি, ঠিক আছে। মাঝে কমেডি আর একটা পুরনো যে সময়, যেমন জমিদারি টাইমের সিনেমা বানিয়েছি। সময় সময় সেখানে ফিরে গেছি, যেমন, ‘দেবী’ এটা ১৯ শতক নিয়ে একটা সিনেমা। আমার মনে হয় ডিরেক্টর শুধু থিম বা গল্প দেখেই মুগ্ধ হয় না। কিছু গল্পের ভিজুয়াল দিকও তাকে মুগ্ধ করে। আমি অতীত নিয়ে পুনরায় তৈরি করতে চাই, এইটা আমাকে প্রচণ্ড টানে। তো আমি মাঝে মাঝে এটা করি আর চারুলতা তারই সর্বোচ্চ প্রকাশ।
আমার মনে হয় ডিরেক্টর শুধু থিম বা গল্প দেখেই মুগ্ধ হয় না। কিছু গল্পের ভিজুয়াল দিকও তাকে মুগ্ধ করে। আমি অতীত নিয়ে পুনরায় তৈরি করতে চাই, এইটা আমাকে প্রচণ্ড টানে। তো আমি মাঝে মাঝে এটা করি আর চারুলতা তারই সর্বোচ্চ প্রকাশ।
শ্যাম : আপনার নির্দিষ্ট ফটোগ্রাফিক স্টাইল তৈরি করেছেন যখন আপনি আপনার প্রথম সিনেমা বানান। কারণ ইন্ডিয়ান সিনেমা অধিকাংশ সময় নির্ভর করে একটা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা অনুভূতির উপর, সেইটা খুবই সৌর্ন্দয সচেতন যা অভিনেতাদেরও খুব ভালো দেখাতে সাহায্য করে। আর আপনি সেটাকে পাল্টে দিয়েছেন। তো এটা কি ইচ্ছাকৃত? আপনি কি সচেতনভাবে এটা করতে চেয়েছেন?
রায় : এটা পুরটাই সচেতনভাবে করেছি আমি। আমি আমার ক্যামেরাম্যানের সাথে সিনেমার শুরুতেই আলোচনা করেছি। আমরা দুজনই কার্টিয়ের ব্রেঁসো’র ভক্ত এবং আমরা ন্যাচারাল লাইটের উপর যতটা সম্ভব আস্থা রাখার চেষ্টা করেছি। সূর্যের আলোর ব্যবহার করেছি আমরা যতটা সম্ভব। আলোর উপর ভিত্তি করে শ্যুটিং টাইম ঠিক করেছি। আসলে শ্যুটিং এর শুরুতে আমরা অনেকের সাথে কথা বলেছি, ওনারা আমাদের বলেছে যে তোমরা বৃষ্টিতে শ্যুট করতে পারবে না, আবহাওয়া খারাপ থাকলে পারবে না, এইটা পারবে, ওইটা পারবে না এমন অনেক কথা। অবাক হয়ে আমরা ১৬ মি.মি. ক্যামেরা দিয়ে সবরকম আলোতে শ্যুট করে এক্সপেরিমেন্ট করেছিলাম। এক্সপেরিমেন্টের রেজাল্ট আমাদের মন মতোই ছিল। তাই আমরা এই বাস্তবধর্মী ফটোগ্রাফি করার সিদ্ধান্তটাই নিলাম।
সত্যি বলতে ন্যাচারাল লাইটের সমস্যাটা দেখা যেতে শুরু করে যখন আমরা স্টুডিওতে শ্যুট করা শুরু করলাম। কারণ দিনের বেলা শ্যুটিংয়ে তখন ডিরেক্ট লাইট ব্যবহার করা হতো যে কারণে সব চরিত্রের ছায়া দেখা যেত। চরিত্রগুলো একটা ওয়ালের মধ্যে ঘুরে বেড়াবে এই ব্যপারটা আমার পছন্দ হতো না মোটেই। তো আমি লাইট বাউন্সার ব্যবহার করতে শুরু করলাম। ‘পথের পাঁচালী’তে এর ব্যবহার কম, কারণ সেখানে রাতের শ্যুটিংগুলো শুধু স্টুডিওতে করা হয়েছিল। কিন্তু ‘অপরাজিত’তে স্টুডিওতে যে বাসা বানানো হয়েছিল, মানে যে বাসায় পরিবারটা থাকত। আর ওই বাসাগুলোতে সূর্যের আলোর ঢোকার একটাই রাস্তা সেটা হচ্ছে বাড়ির মাঝে যে উঠানটা। বানারাসে প্রায় সব বাড়িই এমন। তো আমরা উপরের এই ফাঁকা জায়গাটা একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেই লাইটটাকে বাউন্স করবার জন্য। তাতে লাইটটা আর ডিরেক্ট সূর্যের আলো থাকল না।
শ্যাম : যখন আপনি সিনেমা বানানো শুরু করলেন তখন পুরোপুরি ব্লক লেন্সে কাজ করতেন। আর জুম লেন্স আসার পর আপনি আর ব্লকে ফিরে যাননি। কোনো নির্দিষ্ট কারণে?
রায় : ‘চারুলতা’তে প্রথম জুম লেন্স ব্যবহার শুরু করি। আমি নিজে ক্যামেরা চালানো শুরু করি তখন। কারণ আমার মনে হয়ছে, স্ক্রিনে কি হচ্ছে তা দেখার এইটাই সবচেয়ে ভালো জায়গা। জুমের সাহায্যে (ব্লিম্প জুম) বড়ো বড়ো ডায়লগের সময় হাইলাইট করতে ব্যবহার করেছি। এইটা আগে থেকে ভাবা থাকত না, তৎক্ষনাৎ ভেবে নিতাম। লেন্সের মধ্যে দিয়ে দেখার সময় আমার যদি কখনো মনে হতো যে একটু কাছে গেলে বা একটু দূরে গেলে ভালো হবে, তখন এই কাজটা করতাম। এটা আসলে ট্র্যাকিং এর বদলে ব্যবহার করতাম আমি। অন্য সময় কোনো বিষয়কে ফুটিয়ে তুলতে জুমের ব্যবহার করেছি। এই ব্যাপারটা কথায় বোঝানো একটু কঠিন। উদাহরণ দেই। ‘চারুলতার’ একটা শট, যখন চারুর একাকীত্বের দীর্ঘ শটের পর, শেষে সে অপেরা গ্লাস দিয়ে তার স্বামীকে দেখে এবং তারপর অপেরা গ্লাসটা রেখে দেয়। আর সাথে সাথে জুম আউট করা হয়। এইটা একটা অলংকারের মতো। চিঠির শেষে বা কোনো প্রবন্ধের শেষেও যেমন ব্যবহার করা হয়, আবার সাধারণ কোনো চরিত্রের খুব কাছে পৌঁছাতে আমরা ট্র্যাকিং ব্যবহার করে খুব কাছে যাই, যেটা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মনোযোগ নষ্ট করতে পারে। জুমের সাহায্যে ওটা আমি দূর থেকে করতে পারছি।
শ্যাম : আপনি তো জানেন ব্লক লেন্সের মধ্যে দিয়ে চরিত্র ও পরিবেশের মধ্যে একটা সর্ম্পক স্থাপিত হয় যেইটা জুম লেন্সে খুব একটা হওয়ার সুযোগ নাই।
রায় : আমি জুমকে ট্রলির বদলে খুব কমই ব্যবহার করেছি। উদাহরণ হিসেবে ধরেন একটা চরিত্র একটা বস্তু দেখে যা তাকে প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলে, তখনই সেই বস্তুটাকে আমরা দেখাই। স্বাভাবিকভাবে, আমরা ট্রলির ব্যবহার করব যদি গুরুত্ব প্রকাশ করতে চাই, কিন্তু চরিত্রটা তো অবশ্যই ওই বস্তুর দিকে হাটছে না। বরং ওই বস্তুটাকে কাছে আনা হচ্ছে। আমার মনে হয় এখানে জুমটাই বেশি লজিক্যাল ব্যবহার করা।
শ্যাম : আমি এক জায়গায় পড়েছিলাম আপনার শ্যুটিং এর জায়গা ঠিক করার বিষয়ে। ব্যাপারটা এমন ছিল যে, যেখানে শ্যুট করবেন তার আশেপাশে একটা নির্দিষ্ট প্যার্টানে সেট বানাতেন। আপনিই বলেছেন যে, এই আপনি ছাড়তে পারেন না। ওই প্যার্টানে ফিরে যান। আপনি এই ব্যাপারে আরেকটু বলেন কারণ এই ব্যাপারটা থেকে আমি নিজেও অনেক শিখেছি।
রায় : আমার মনে হয় না প্রথম সিনেমা বানানোর সময় আমি এই বিষয় নিয়ে অবগত ছিলাম না। প্রথম দুটি সিনেমাতে বাড়িটি, বয়স্ক মহিলার বাড়ি, উঠান এইগুলো একই হওয়ায় মনে হয় আমার নির্দিষ্ট জায়গা থেকে শ্যুট করা উচিত ছিল এতে দর্শকদের ওই ভৌগলিক অবস্থাটা বুঝতে সুবিধা হতো।
আজকে ‘পথের পাঁচালী’ দেখলে আমি বুঝতে পারব ব্যাপারটা। হয়তো বা এজন্য দর্শকরাও একটু বেশি সময় নেয় অভ্যস্ত হতে।
কিন্তু লোকেশনে এঙ্গেল একবারে নির্দিষ্ট করে দেয়া সম্ভব না, কারণ পাল্টাতে হয় গল্পের প্রয়োজনেই। অনেক সময় লাইট আপনাকে বাধ্য করে পরিবর্তন করতে। অনেক সময় এমন হয় যে, আপনি নতুন কোনো এঙ্গেল পেয়েছেন যা আগে আপনার চোখে পড়ে নাই। শ্যুটিং এর সময় এটা সবসময় হতে থাকে।
শ্যাম : আপনার সিনেমায় আসার আগে ইন্ডিয়ান সিনেমায় কখনো পারির্পাশ্বিক শব্দ ব্যবহার করা হয় নাই। যা ব্যবহার করা হতো সবই বানানো ইফেক্ট দেওয়া হতো। তো আপনি এই বিষয়টা নতুন এনেছেন। কেন করলেন? কী আপনাকে অনুপ্রাণিত করল?
রায় : সাউন্ডের ব্যাপারে আমার যা মনে হয়, আমরা এই ব্যাপারে খুব একটা মৌলিক ছিলাম না। ইউরোপে যেটা করা হয়ে গেছে ওটারই রিপিট করে যাচ্ছিলাম আমরা। ইন্ডিয়ান সিনেমা থেকে খুব একটা শিখি নাই। আসলে ইন্ডিয়ান সিনেমা দেখে যতটা না কি করতে হবে শিখেছি, তারচে বেশি শিখেছি কি করা যাবে না।
‘পথের পাঁচালী’ আর ‘অপরাজিত’তে প্রায় সব রকম ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ এই দুটো সিনেমাতে ডায়লগ খুব কম। তো ইফেক্ট ব্যবহার করাই হয়েছিল দীর্ঘ নীরবতার অংশটাকে আড়াল করার জন্য।
শ্যাম : মিউজিকেও আপনার কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন শুরু করেন, তখন আপনার সিনেমায় ঘটনাক্রমে নানা রকম মিউজিক আসতো, যেমন, ক্লাইম্যাক্সে বা ইমোশনাল মুহূর্তের আন্ডারলাইন মিউজিক। সময়ের সাথে এগুলোর ব্যবহার আপনার সিনেমায় কমে আসে। মিউজিক নিয়ে আপনার এই বির্বতন নিয়ে ভেবেছেন কখনো?
শুরুতে আমি কম্পোজার ছিলাম না। আমি অন্য কম্পোজারদের নিয়ে কাজ করছিলাম, রবি শংকর, বেলায়েত, আলী আকবর ও অন্যান্য। কিন্তু আমি সবসময় জানতাম মিউজিকটা কোথা থেকে আসবে। তো কম্পোজারদের আগেই বলে দিতাম যে, দেখেন এই এই পয়েন্ট গুলোতে আমার মিউজিক দরকার। এভাবে কাজ হচ্ছিল।
রায় : শুরুতে আমি কম্পোজার ছিলাম না। আমি অন্য কম্পোজারদের নিয়ে কাজ করছিলাম, রবি শংকর, বেলায়েত, আলী আকবর ও অন্যান্য। কিন্তু আমি সবসময় জানতাম মিউজিকটা কোথা থেকে আসবে। তো কম্পোজারদের আগেই বলে দিতাম যে, দেখেন এই এই পয়েন্ট গুলোতে আমার মিউজিক দরকার। এভাবে কাজ হচ্ছিল। কিন্তু কিছু সমস্যাও দেখা যায়, কারণ, আমি নিজের আইডিয়াও দিচ্ছিলাম তাদের এবং প্রফেশনাল মিউজিশিয়ানদের নির্দেশ দেওয়াও কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। তারা ফিল্মের দিকে প্রফেশনাল ছিল না যদিও। তবে রবি শংকর একজন প্রচণ্ড প্রতিভাধর ব্যাক্তি ছিলেন আর আগে ব্যালেট কম্পোজ করায় তার ফিল্মের বিষয়েও ভালো ধারনা ছিল।
পরবর্তীতে আমি নিজেই কম্পোজ করা শুরু করি। দুইটা কারণে তা হলো, কম্পোজারদের পাওয়া খুব কঠিন আর কাজ করানোর মতো ভালো কম্পোজারও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আর এতো ফিল্ম কম্পোজার ছিল না যার কাছে আপনি যেতে পারেন, এজন্য নিজে কাজ শুরু করি। আমার একটা পিয়ানো আছে। তবে আমি অনেক শিষ বাজাই আর গুনগুন করি।
আমি মিউজিকের ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছি। একজন ডিরেক্টর মিউজিক বেশি ব্যবহার করে তার দর্শককে মাথায় রেখে কারণ সে ভয় পায় যে দর্শক ওই দৃশ্যের মুডটা ধরতে পারবে না। তাই সে ওইটা মিউজিক দিয়ে আন্ডারলাইন করতে চায়। এটা করা দুঃখজনক। আমি এটা করতে চাই না, আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের মিউজিশিয়ানরা সবাই বোম্বতে, তাই মিউজিকে দ্বিতীয় সারির আর্টিস্টি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তো আপনার ক্রিয়েটিভ হতে হবে আর সরল বিষয়াদির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
শ্যাম : ট্রিলজিতে খুব সুন্দর একটা মিউজিক…
রায় : আমার সবসময় মনে হয়েছে, এমন একটা কিছু থাকা দরকার, সেটা সিনেমা জুড়ে ফিরে ফিরে আসবে যেন একটা ঐক্যবদ্ধতা তৈরি হয়। ‘পথের পাঁচালী’র মিউজিক খুবই চমৎকার। এটা রবি শংকর এর কৃতিত্ব। সিনেমা দেখার আগেই তার মাথায় এই মিউজিকটা ছিল।
শ্যাম : মিউজিক্যাল আইডিয়া ইন্ডিয়ান না ওয়ের্ষ্টান?
রায় : সিনেমার উপর নির্ভর করে। ধরেন ‘পথের পাঁচালী’ বা ট্রিলজির যেকোনো সিনেমার জন্যই অবশ্যই ইন্ডিয়ান মিউজিক দরকার। আমি ইন্ডিয়ান ওয়েস্টার্ন ফিউশনও করি, যেমন, কলকাতা নিজেই একটা ফিউশন, এর জীবনযাত্রাও।
মিউজিক নিয়ে আগ্রহ স্কুল থেকেই ছিল। ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক দিয়ে শেখা শুরু করলেও পরে ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিক্যাল নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করি। আমি ঘুমানোর সময় একটা সিম্ফোনি ছেড়ে ঘুমাতাম আর এইভাবেই শিখেছি। ওয়েস্টার্ন নোটেশন আমি সচেতনভাবে শিখিনি তখন। কিন্তু কম্পোজ করব বলে ঠিক করি, তখন এই নোটেশন আমাকে শিখতে হয়। কিন্তু পরে দেখা গেল বেশিরভাগ মিউজিশিয়ান বাংলা নোটেশন ব্যবহার করে, যে কারণে আমাকে আবার বাংলা নোটেশনে ফিরতে হয়।
অবশ্য আমি বছরে মাত্র ১৫ দিন কম্পোজার। বাকী সময়ে পিয়ানোতে হাতও পড়ে না আমার।
শ্যাম : এডিটিংয়ের ব্যাপারে আপনি গতানুগতিক বিষয়টাকেই ধরে রেখেছেন। আপনার কখনো মনে হয় নাই এই ধারাতেও পরিবর্তন দরকার?
রায় : গল্পটাকে সবচেয়ে সুন্দর উপায়ে বলা যায়, এডিটিংয়ের তো এই একটাই লক্ষ্য।
জটিল গল্প নিয়েও আমি কাজ করেছি যেমন, ‘অরণ্যের দিন-রাত্রী’ কিংবা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’— এই সিনেমাগুলোতে কোনো প্রধান চরিত্র নাই যাকে ধরে গল্পটা বেড়ে উঠে। এখানে একদল মানুষ, কিংবা একটা পরিবার। তো আমি চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব সহজ করে গল্পটা বলার কারণ দর্শকের সাথে যোগাযোগ নিয়েও চিন্তা করা লাগে।
শ্যাম : আপনার ফিল্মে ডায়লগের ব্যবহার সম্পর্কে অনেক কথা হয়েছে। ডায়লগগুলো কথা বলার মতোই ধারনা করা হয় আর এই বাংলা সিনেমায় অস্বাভাবিক। এটা আপনি কোথা থেকে পেয়েছেন?
রায় : একটু আগে যেমন বললাম, শুরুতে ডায়লগ লেখার মতো আমার সাহস ছিল না। আমার সৌভাগ্য ছিল আমি বিভূতিভূষণের লেখা ব্যবহার করছিলাম। তার লেখায় ডায়লগগুলো এত বাস্তবধর্মী ছিল যে কারণে আমি তা সরাসরি সিনেমায় ব্যবহার করতে পেরেছি।
পরের সিনেমাগুলোতে, যেমন ‘জলসাঘর’, ‘পরশ পাথর’ এইগুলোতে আমি ডায়লগ লেখা শুরু করি। আমি ধীরে ধীরে আরও বেশি ডায়লগ লেখা শুরু করলাম যা সিনেমায় প্রচণ্ড কার্যকর হতে থাকে। আপনি জানেন যে ডায়লগ শুধু চরিত্রগুলোর পরিচয় দেয় না, গল্পকে এগিয়ে নেওয়া, তথ্য দেওয়া, মুড বোঝাতে পারে। এখানেও আমি যতটা সম্ভব মিতব্যায়ী হবার চেষ্টা করেছি। মানুষের কথা বলার ধরন পরীক্ষা করতে হবে এবং সঠিক পর্যবেক্ষণটাকে সিনেমায় তুলে আনতে হবে। গ্রামের দৃশ্যপট তুলে ধরতে গ্রামীণ ভাষা ব্যবহার করতে হবে। আঞ্চলিক হওয়া আবশ্যক না, কারণ এতে শিল্পীদের সমস্যায় পড়তে হতে পারে। ট্রিলজিতে আমি বিভূতিভূষণের লেখা ব্যবহার করেছি, আবার ‘অশনি সংকেত’-এও আমি বিভূতিভূষণের লেখার কাছে ফিরে গেছি। এইটা গ্রামীণ/গ্রাম্য ভাষা হিসেবে গ্রহণযোগ্য।
শ্যাম : বাচ্চাদের সিনেমা নিয়ে, যদিও আপনি বলেছেন আসলে এটা সবার জন্য। তো আপনার করা বাচ্চাদের সিনেমায় দেখা যায় প্রাপ্তবয়স্করাও কিছু শিশুসুলভ আচরণ করে থাকে। এটা কি আপনার নিজের মতো কল্পনা? নিজের মতো করে পৃথিবীকে দেখা?
রায় : বাচ্চাদের সিনেমায় বাচ্চা অভিনেতা-অভিনেত্রী থাকতে হবে বলে আমি মনে করি না। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ দিয়েও বাচ্চাদের সিনেমা হতে পারে। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ এ কোনো শিশুশিল্পী নাই, অন্তত প্রধান কোনো চরিত্রে।
সোনার কেল্লার চরিত্রগুলো আমার বানানো। তো গল্পগুলো সবই একটা বয়ঃসন্ধিকালীন বাচ্চার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা, যেমন ধরেন শার্লক হোমসের ওয়াটসনের মতো।
শ্যাম : এ পর্যন্ত দেখা গেছে আপনি একটু বয়স্ক লেখকদের গুরুত্ব বেশি দেন, যারা এ শতাব্দীর শুরুর দিকে লিখে গেছে। আপনি সুনীল গাঙ্গুলীর লেখা নিয়েও সিনেমা করেছেন কিন্তু আপনার কোনো বিশেষ কারণে ঐ সময়টা পছন্দ? ঐ সময়ের লেখা?
রায় : এইটা আমাকে ভাবতে হবে আসলে যে ব্যাপারটা সত্যি কি না। ট্রিলজি বাদে বিভূতিভূষণের গল্প নিয়ে করেছি ৪টি ছবি। বাকি সবই তুলনামূলক নতুন লেখকের। শহরকেন্দ্রিক সব সিনেমাই নতুনদের লেখা, হয় সুনীল অথবা শংকর অথবা আমি নিজেই।
যখন আমি লেখি, যেমন ‘নায়ক’ অথবা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, আমি যাদের সরাসরি চিনি, তাদের নিয়ে লিখতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করি, কারণ এ বিষয়টার সাথে আমি পরিচিত। আমি ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের নিয়ে লিখতে পারি না, কিন্তু আমি বানাতে চাই একটা সিনেমা, সেজন্য আমার গল্প দরকার, উপাদান দরকার, যা আমি এখনোও পাইনি।
শ্যাম : কোনো ছোটোগল্প বা উপন্যাস যখন আপনি সিনেমা বানানোর জন্য নেন, স্ক্রিপ্টে কতটুকু নিজে থেকে দেন এটাকে সিনেমা উপোযোগী করে তুলতে?
রায় : সিনেমা অনুসারে পরিবর্তন হতে থাকে। আপনি সব সময়ই পরিবর্তন করতে থাকেন। ধরেন ‘পথের পাঁচালী’র মতো গল্পে শুধু চরিত্রগুলো বাদ দেওয়ার কাজ। আমি একবার গুনে দেখেছিলাম, উপন্যাসটিতে ৩০০ চরিত্র ছিল। সিনেমায় ব্যবহার করেছি ৩০টি। এমনভাবে বাদ দিতে হবে যেন দর্শকদের মনে না হয় যে কিছু বাদ যাচ্ছে বা এমন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু ছোটোগল্পে একটা জমিদার জমিদার ভাব ছিল, যেটা আমাকে পরিবর্তন করতে হয়েছে, সমসাময়িকতা বা বাস্তবধর্মী করে তুলতে। ‘তিন কন্যা’ গল্পের সবগুলো সাথেই আমাকে এ কাজ করতে হয়েছে।
নতুন লেখকদের কাজগুলোতে পরিবর্তনটা অন্যরকম। স্ক্রিপ্ট তৈরির সময় দেখি প্রধান চরিত্র হঠাৎ পাল্টে যায়। এইটা লেখকদের একটা সীমাবদ্ধতা চরিত্র গঠনে, কারণ সিনেমায় চরিত্রটাকে একটা লজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট এর মধ্য দিয়ে যেতে হয় আর এটা করতে গিয়ে অনেক সময় গল্পের গঠনও পাল্টে যায়। অনেক সময় শেষটা মনের মতো থাকে না, আপনাকে ঠিক করে নিতে হয়।
সঠিক পরিস্থিতিতে সঠিক কাজটা করতে হবে। আর এটা তৈরি হয় পর্যবেক্ষণ থেকে, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। গল্পটা অন্য কারো হতে পারে। আবার অনেক ঘটনা থাকতে পারে যা আপনি নিজে অনুভব করেন নাই। কিন্তু গল্পে একটা লজিক থাকা আবশ্যক যেটা আপনার বানানো সিনেমাটাকে সত্যতা প্রদান করে।
আমি নেগেটিভ ইমেজ ব্যবহার করেছি কয়েকটা সিকোয়েন্সে। কেন করেছি বলি। সিনেমার শুরুতেই ছেলেটির বাবা মারা যায়। আর লোকটিকে বাইরে নিয়ে আসা হয়। আমার মনে হয়ছে যে, ওখানে নরমাল ইমেজ ব্যবহার করলে দর্শকদের মৃত্যু সর্ম্পকে বিশ্বাস করানো যেত না। তো এই শুরুতেই নেগেটিভ ব্যবহার করার ফলে, বাকি সিনেমাতেও এটি ব্যবহার করার উপলক্ষ্য পাই।
সাধারণত আমার ট্রিক্সে আগ্রহ কম। আমার আগ্রহ সাবজেক্ট এবং তার ঘনত্ব। একটা ছবি দিয়ে আপনি কতটা বলতে পারেন? একটা ছবির ভেতর কতটা আটাতে পারেন কোনো ছদ্মবেশ বা ট্রিক না খাটিয়ে।
শ্যাম : আপনি সব সময় একজন বাস্তবতার পর্যবেক্ষক ছিলেন। তো আপনার বক্তব্য সবসময়ই ছিল ডাইরেক্ট।
রায় : আমার মেজাজ? আমার মনে হয় ফিল্মমেকার হিসেবে আমি ডাইরেক্ট থাকতেই পছন্দ করি যদি এটা আদৌ সম্ভব হয়!
শ্যাম : ইন্ডিয়ান সিনেমায় আপনার অবস্থান অনেকটা চমৎকার বিচ্ছিন্নতা বলা যায়। আপনি বেশ একাকী, যে ধরনের সিনেমা আপনি বানান, বা, যে চিন্তা আপনি ধারণ করেন। এটা কি আপনাকে কোনোভাবে প্রভাবিত করেছে? কারণ প্রকাশের যথেষ্ট জায়গাও নাই আবার প্রতিযোগীতাও নাই।
রায় : এটা তো আমার বানানো না। কেউ নিজে একটা ট্রেন্ড চালু করতে চাইতে পারে। কিন্তু বাংলায় ভালো ডিরেক্টর আছে, যাঁরা আমার সাথেই কাজ করে যাচ্ছে। আমার সমসাময়িক… শুরুই ছিল তাদেরও, যেমন ঋত্বিক, মৃনাল। তাঁরা দুজনই খুব ভালো কাজ করে। ঋত্বিক নিয়মিত না করলেও মৃনাল বেশ নিয়মিত কাজ করছে। ঋত্বিক নিয়মিত কাজ করছে না কিন্তু তার বানানো সিনেমাগুলো অনেক শক্তিশালী, আমার থেকে অনেক আলাদা কিন্তু অনেক প্রভাবশালী।
ফিল্ম বানানো খুবই ঝামেলার একটা কাজ। একটা সিনেমা বানানোর সময় কোনো গ্রামার বা স্কুলের কথা মাথায় আসে না। শুধু কাজ করে যাওয়ার কারণ এটা জীবিকা। নিজেকে প্রকাশ আবার জীবিকাও উপার্জন করেন, অনেক বাধা পার করে। নিশ্চিতভাবেই এখানে সিনেমা বানানো কোনো সহজ কাজ না।
শ্যাম : কিন্তু আপনার কি উদ্দীপনা, প্রেরণার প্রয়োজন পড়ে? নিজ থেকে যেইটা করেন তার বাইরে?
রায় : কোন উদ্দীপনার কথা বলছেন? আমার অনেক সিনেমাই দর্শক গ্রহণ করে নিয়েছে। এখানে না করলেও বিদেশে তা গৃহীত হয়েছে। তো একটা সিনেমা করার পর সন্তুষ্টিও পেয়েছি। আমার প্রায় কোনো সিনেমাতেই টাকা নষ্ট হয় নাই। সময়ের সাথে খরচ উঠে এসেছে। তো খুশিই বলা যায়। কঠিন অংশটা হচ্ছে সিনেমাটা বানানো।
শ্যাম : দর্শক সর্ম্পকে কিছু বলেন।
রায় : দর্শক মূল্যায়ন করার জন্য একটা সময় প্রয়োজন। ডিরেক্টর যখন সিনেমাটা বানায়, তখন সে একটা দর্শক শ্রেণি ভেবে নেয়। ডিরেক্টর যখন কোনো গল্প নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে, সে আশা করে যে একটা শ্রেণির দর্শকও সেটা গ্রহণ করবে।
দর্শক মূল্যায়ন করার জন্য একটা সময় প্রয়োজন। ডিরেক্টর যখন সিনেমাটা বানায়, তখন সে একটা দর্শক শ্রেণি ভেবে নেয়। ডিরেক্টর যখন কোনো গল্প নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে, সে আশা করে যে একটা শ্রেণির দর্শকও সেটা গ্রহণ করবে।
প্রথম দিকে আমার মনে হয় আমি প্রচুর ভুল করেছি। যেমন ‘পথের পাঁচালী’ সাফল্য পেলেও, ‘অপরাজিত’ পায়নি। আর পায়নি সেটা পুরো পৃথিবীতেই। এটা আকর্ষণীয় কারণ আপনি সিনেমায় একটা নির্দিষ্ট রিঅ্যাকশন পাচ্ছেন, দর্শক কলকাতা হোক কিংবা নিউইর্য়ক। দর্শকদের সাথে সিনেমা দেখতে গেলে বোঝা যায় সিনেমায় ভুল আছে, যেটা হয়তো দর্শক ধরতে পারে না সবসময়।
যেহেতু আমি নিজেকে পুনরাবৃত্তি না করার চেষ্টা করেছি, তো যা করেছি প্রায় সবকিছুতেই একটা ঝুঁকি ছিল। কারণ আমি নতুন কিছু চেষ্টা করছিলাম, যেটার সাথে দর্শক এখনো পরিচিত নয়।
দর্শকও আগের চেয়ে ম্যাচিউর এবং বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে উঠেছে। ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্ট এর জন্য কিছু, আবার নতুন সিনেমা দেখা সাংস্কৃতিক প্রয়োজন থেকে কিছু। আর তারা আমার ট্রেন্ডকে খুব ভালো করে অনুসরণ করেছেআমি শহরের দর্শকদের কথা বলছি। শহরের বাইরের অবস্থা সর্ম্পকে আমার ভালো ধারনা নেই।
শ্যাম : মানবতাবাদী জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি?
রায় : এটা হইতো বা আমার ফ্যামিলি থেকে পাওয়া। বাবা-মার কাছ থেকে।
শ্যাম : একটা প্রচণ্ড শক্তিশালী যুক্তিবাদী ইমেজ দেখতে পাই। যেইটা ব্রাহ্মণ হয়ে বড়ো হয়ে ওঠাও হতে পারে।
রায় : হতে পারে, অবশ্যই হতে পারে। যদিও একজন এ বিষয়টা নিয়ে সচেতন থাকে না। কারণ আমি জন্ম নিয়েছি একজন ব্রাহ্মণ হয়ে। রূপান্তর যা হবার তা অনেক আগেই হয়ে গেছে। তো আমার বাড়িতেই আমি একটা নির্দিষ্ট আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, আর্দশ শিখেছিলাম সেই ছোটো থেকেই, যেটা কেউ সচেতনভাবে করতে পারে না। এটা আমরা দেখতে দেখতে শিখি।
শ্যাম : কখন আপনার মনে হলো আপনি আপনার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন? প্রথম কখন বুঝতে পারেন?
রায় : একজন চিত্রশিল্পী হিসেবেআমি সিনেমা বানানোর আগে একজন চিত্রশিল্পী ছিলাম, আপনাকে অবশ্যই ভালো পর্যবেক্ষক হতে হবে, মানুষের নানা আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আর আপনি যদি বাস্তবধর্মী আঁকাআঁকি করেন, যেটা আমি করতাম, তাতে আরও বেশি পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন ছিল। মানুষের আচরণ, আকার-আকৃতি, পরিবেশ এ সবকিছুই আমি পর্যবেক্ষণ করতাম।
শ্যাম : রাগ সর্ম্পকে
রায় : আমার মনে হয় রাগ সেখানেই থাকা উচিত যেখানে রাগ দরকার। আপনি আমার সাম্প্রতিক সিনেমায় তা পাবেন। এটা ছাড়া আমি রাগকে বিড়ম্বনা হিসেবেই দেখি। শান্তিনিকেতনে আমার প্রফেসর মি. নন্দলাল বোস একবার আমাকে বলেছিলেন, দুই ধরনের মানুষ হয়। একদল যারা প্রচুর রাগী আর রাগের প্রকাশও করে। কিন্তু আমার কাছে তাকেই প্রচুর শক্তিশালী লাগে যে রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই কথাটা আমার সাথে থেকে গেছে। বিদ্রুপ, বিড়ম্বনা আমার কাছে ভালোই লাগে। কেন তা বলতে পারব না। হতে পারে মৃত্যুর সাথে তুলনা করলে জীবনটাই একটা বিদ্রুপ।
কবি ও অনুবাদক।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত। কবিতা ও অনুবাদ ভালো লাগে।