শুক্রবার, নভেম্বর ২২

আমিনুল ইসলামের কবিতায় ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং উত্তর-উপনিবেশবাদ : মঈন শেখ

0

১ম পর্ব


আমিনুল ইসলামের কবিতার মূল আলোচনায় যাবার আগে টি এস এলিয়টের ‘ঐতিহ্য ও ব্যক্তিগত প্রতিভা’ (Tradition and individual talent) নামক বিখ্যাত প্রবন্ধ থেকে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। ইতিহাসবোধ সম্পর্কে তিনি বলেছেন,‘ইতিহাসবোধ হলো এমন এক চেতনা যা পৃথক পৃথকভাবে ঐতিহ্য চেতনা ও সীমাহীন চেতনা এবং এ দুটির পরস্পর সমন্বয়, যা একজন লেখককে ঐতিহ্যিক করে তোলে। ইতিহাস চেতনার মানসিকতাকে বলা যায় যে, তা একজন লেখকের দায়িত্বকে তার সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে ও কালের স্রোতধারায় তা সূক্ষ্ণভাবে সচেতন করে তোলে। এই ইতিহাসবোধের চেতনা থেকেই আমিনুল ইসলাম হয়েছেন ঐতিহ্যিক। আর এই চেতনার মানসিকতা কবিকে করেছে সচেতন এবং লেখক সত্তায় হয়েছেন দায়িত্ববান। আমিনুল ইসলামকে আমার কেন জানি মনে হয় গন্তব্যবাদী কবি। অন্তত গন্তব্যের কাছাকাছি যাবার কিংবা থাকবার মনোবাঞ্ছা তাঁর যেন চিরকালীন। তাঁর গন্তব্য শেকড়ের দিকে। ইতিহাস ঐতিহ্যের দিকে। তাঁর চিন্তা-চেতনা আর কবিসত্তার একটা লোগো— তিনি ঐতিহ্যের সন্তান, ইতিহাসের বরপুত্র। একদিকে ঐতিহ্য তাঁর কবিতার বহিরাঙ্গ, তো অন্যদিকে ইতিহাস তাঁর অন্তঃসার। আমিনুল ইসলামের কবিতায় ইতিহাস চেতনা দেখে মনে হয়, কবি নিজেকে অহংকারী করে তুলছেন তাঁর অতীত পুরুষের সোনালি জমিন উড্ডীন করে। আবার কখনো মনে হয়, তিনি তাঁর কবিতাকে অমরত্ব দিতে চান সেই অতীতের ছোঁয়া দিয়ে। এক্ষেত্রে সাহিত্যাচার্য কবি মোহিতলাল মজুমদারের একটি কবিতার কথা মনে পড়ল। তাঁর কবি-ভাগ্য নিয়ে বলেছেন—

আমার স্বপন যাহা- ওরা তা সফল করে,
আমার কাহিনী যাহা, ইতিহাসে তাই গড়ে।
আমার বাঁশীর সুরে অতি দূর দূরান্তরে
পুরী মহাপুরী কত উঠে পড়ে থরে থরে!

এই চারটি চরণের মাঝে আমার প্রবন্ধের শিরোনামের একটা নিগূঢ়তা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আমিনুল ইসলামের সমস্ত কাব্য-স্বপন যেন সফলতা পায় ইতিহাস চেতনায়। কবিতার কাহিনী গড়ে দেয় ইতিহাস। তাঁর কাব্য-বাঁশরীর লালিত্য সুর যেন সেই ঐতিহ্য-বীণায় বাঁধা। তাঁর কাব্য-বৈভব হলো ইতিহাসের বৈভব। তাঁর কাব্য-বৈভব হলো ঐতিহ্যের বৈভব। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক ড. সফিউদ্দিন আহমদ আমিনুল ইসলামকে বলেছেন, শিকড়বৈভবের কবি। তিনি তাঁর ‘অমিনুল ইসলাম : শিকড়বৈভবের কবি’ প্রবন্ধে বলেছেন ‘আমিনুল ইসলামের কবিতায় আমাদের মহিমান্বিত অতীত ও গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য শাণিত ও প্রাণিত হয়ে ফিনিক্স আর ইকারোসের মতো জেগে ওঠে। তিনি যেন স্পন্দিত বুকে, গর্বে গর্বিত হয়ে বলতে চান যে আমরা পাশ্চাত্য বা অন্য কোন জাতির প্রতিধ্বনি বা কণ্ঠস্বর নই— আমাদের পায়ের নিচে হিমালয়ের মতো শক্ত একটি ভিত্তি আছে-এ ভিত্তিতে একবার স্বকীয়তার স্পর্ধাভরে দাঁড়ালেই আমরা সমগ্র বিশ্বে গর্বিত জাতি হিসেবে পরিচিত হবো। আমরা চিনতে পারবো আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে, আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে। আমরা হিমালয়ের শীর্ষচূড়া দেখবো, আকাশভরা সূর্যতারা দেখবো, সাগরপ্রান্তর সবই দেখবো—বিশ্বের সাথে বিশ্বাত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হবো— তবে দেশের মাটিতে পা রেখে। এজন্যই দেখা যায় আমিনুল ইসলামের কবিতায় যেমন আছে ঐতিহ্যের টান, তেমনি আছে বর্তমানের অবস্থান ও ভবিষ্যতের সোনালি ফসলের আহ্বান।’ তাঁর বলার যথার্থতা পাই প্রায় প্রতিটি কবিতার শরীর জুড়ে। তিনি জাতিক ও আন্তর্জাতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ব্যবহার তাঁর কবিতায় যেভাবে করেছেন, তা অতুলনীয়। আমিনুল ইসলামের এই ইতিহাস ঐতিহ্য চেতনা কবিতায় সরাসরি আসেনি, এসেছে তাঁর জীবন-চেতনার উৎস সেঁচে। কবি যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন অর্থাৎ শৈশব কৈশোর কেটেছে, তা বলতে গেলে আমাদের গৌরবময় ইতিহাস ঐতিহ্যগাঁথার চারণভূমি। আমিনুল ইসলাম গৌড় আর বরেন্দ্রভূমির সন্তান। তিনি সুযোগ্য সন্তানই বটে।

তিনি তাঁর কবি জীবনের শুরু থেকেই বরেন্দ্রভূমি তথা প্রাচীন বঙ্গভূমি এবং বঙ্গসভ্যতার কাব্যিক পুনর্নির্মাণ এবং উপস্থাপনকে তাঁর কবিতার অন্যতম প্রধান বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে, শরীর হয়ে, প্রাণ হয়ে, উপমা হয়ে, চিত্রকল্প হয়ে, উৎপ্রেক্ষা হয়ে বারবার এসেছে বরেন্দ্র অঞ্চলের নানা প্রসঙ্গ। দোয়াব, হরিকল, সমতট, রাঢ় ও বরেন্দ্রীর ইতিহাস, কিংবদন্তী, ঐতিহ্য, নদনদী, প্রত্নস্থাপত্য, নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস ও উপাখ্যান, কৃষি অর্থনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, প্রবাদবচন, লোকসংগীত প্রভৃতি আমিনুল ইসলমের কবিতার শরীর-প্রাণ গঠনে উপকরণ হয়ে উঠে এসেছে।

তিনি তাঁর কবি জীবনের শুরু থেকেই বরেন্দ্রভূমি তথা প্রাচীন বঙ্গভূমি এবং বঙ্গসভ্যতার কাব্যিক পুনর্নির্মাণ এবং উপস্থাপনকে তাঁর কবিতার অন্যতম প্রধান বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে, শরীর হয়ে, প্রাণ হয়ে, উপমা হয়ে, চিত্রকল্প হয়ে, উৎপ্রেক্ষা হয়ে বারবার এসেছে বরেন্দ্র অঞ্চলের নানা প্রসঙ্গ। দোয়াব, হরিকল, সমতট, রাঢ় ও বরেন্দ্রীর ইতিহাস, কিংবদন্তী, ঐতিহ্য, নদনদী, প্রত্নস্থাপত্য, নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস ও উপাখ্যান, কৃষি অর্থনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, প্রবাদবচন, লোকসংগীত প্রভৃতি আমিনুল ইসলমের কবিতার শরীর-প্রাণ গঠনে উপকরণ হয়ে উঠে এসেছে। আমিনুল ইসলাম তাঁর উৎসভূমিকে দেখেছেন একান্ত আপনার করে। এ দেখা দূর থেকে দেখা নয়। কারণ কবির শৈশব কৈশোর কেটেছে এই আবাসভূমিতে। কবি তার চারপাশে জোর করে কিছু খুঁজেননি। কবির সহজ উক্তি যার প্রমাণ— ‘কবিতা কীভাবে এবং কতটা জীবনের কথা বলে— কতটা গভীরভাবে আমাদের চারপাশের শৈল্পিক ছবি আঁকে— সেটুকু নিয়েই আমি তৃপ্ত থাকতে ভালোবাসি।’

এবার একটু পেছনের কথাও বলা দরকার। অবশ্য তা প্রাসঙ্গিকও বটে। চর্যাপদকর্তাদের মধ্যে যাঁদের স্থান শীর্ষে তাঁদের বাস ছিল বরেন্দ্র এলাকায়। মুহম্মদ আবু তালিবের মতে কানুপা, শবরী, লুইপা, সরহপা প্রভৃতি বরেন্দ্র এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। আর তাঁদের পদ বা গানে বরেন্দ্র বন্দনা এসেছে ঘুরে ফিরে। শুধু তাই নয়, ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ থেকে শুরু করে সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’, ভবিষ্যপুরাণ’ প্রভৃতি কাব্যে বরেন্দ্রভুমি বিভিন্নভাবে বর্ণিত ও বন্দিত হয়েছে। সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর রামচরিত কাব্যে বরেন্দ্রকে পৃথিবীর শির বলে অবিহিত করেছেন। শুধু তাই নয়, প্রাচীনকাল থেকে আদ্যাবধি ইতিহাস গ্রন্থসহ সাহিত্যের সকল শাখাকে বরেন্দ্রভূমির উজ্জ্বল্যগাঁথা বিভিন্নভাবে আলোকিত করে এসেছে। আর সবচেয়ে বেশি আলোকিত করেছে কাব্যভূবনকে। অবশ্য তা এসেছে কোন না কোন বিশেষ কারণে কতকটা খণ্ডিতভাবে। তবে এক্ষেত্রে কবি আমিনুল ইসলাম ব্যতিক্রম। তিনি আপাদমস্তক বরেন্দ্র অঞ্চলের ধুলাবালি আর কাদামাটিতে গড়া মানুষ। তাঁর কাব্যিক সত্তার বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে বিশাল বরেন্দ্রভূমি। তিনি ব্যতিক্রম এই জন্যেই যে, তিনি এক্ষেত্রে শুধু কবিতাকেই মহিমান্বিত করেননি, মহিমান্বিত অনেক ক্ষেত্রে করেছেন বরেন্দ্রভূমিকেও। কবির কাব্য ভাবনায় এসবের ছাপ কীভাবে এলো তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন নিজেই। একটি প্রবন্ধে তিনি বলেছেন— ‘আরেকটি বিষয় আমার জীবন ও কবিতার ক্ষেত্রে সত্য হয়ে আছে তা হলো আমার বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ, দেশবিদেশের ইতিহাস-ভূগোল-নৃতত্ত্ব পাঠ এবং আমার ভাবনায় ও কবিতায়-সেসবের ছাপ। আমি প্রায় সমগ্র বাংলাদেশ দেখেছি। আমি সোনা মসজিদ, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, মহাস্থানগড়, বেহুলার ভিটা, রামসাগর, নীলসাগর, মহীপালের দিঘি, দিবর দিঘি, কুসুম্বা মসজিদ, ভিমের পান্টি, কান্তজীর মন্দির, উয়ারী-বটেশ্বর, ময়নামতি-শালবনবিহার, শাহজালালের মাজার, জীবনানন্দ দাশের জন্মভিটা, পতিসর-শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিস্থান, সোনারগাঁও, বিভিন্ন জমিদারবাড়ি/ রাজবাড়ী, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল এবং খালবিলনদীসমুদ্র দেখেছি। তার সাথে দেখেছি ভারত, থাইল্যান্ড, মালেশিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্কের বহু ঐতিহাসিক শহর ও স্থান। এবং জানার চেষ্টা করেছি এসব স্থানের মানুষের অতীত-বর্তমান। আমার কাব্যভাবনার ওপর এসব দর্শন ও পঠনের প্রভাব পড়েছে গভীরভাবে এবং তাৎপর্যপূর্ণ ইতিবাচকতায়। আমি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত নিয়ে দীর্ঘকবিতা লিখেছি: আমি সোনা মসজিদ, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, মহাস্থানগড়, বেহুলার ভিটা, মহিপালের দিঘি, দিবর দিঘি, কুসুম্বা মসজিদ, উয়ারীবটেশ্বর, ময়নামতি-শালবনবিহার প্রভৃতিকে প্রচ্ছদ করে লিখেছি দীর্ঘতর কবিতা; আমি তুরস্কে বসে একাধিক কবিতা লিখোছ; লিখেছি থাইল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-ইন্দোনেশিয়ায় বসেও। অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় সিডনির ব্লু মাউন্টেন দেখতে যাই। সেখানে একজন আদিবাসী (Aboriginal)-কে দেখি। তিনি ব্লু মাউন্টেনে বাঁশি বাজিয়ে খাবারের অর্থ উপার্জন করতেন (হয়তো এখনও করে যাচ্ছেন)। এরাই অস্ট্রেলিয়ায় অরিজিনাল মানুষ, ঠিক আমেরিকায় যেমন রেড ইন্ডিয়ানগণ। এরা এখন নিজবাসভুমে পরাজিত এবং অস্তিত্বহীন হওয়ার পথে। বাংলাদেশের আদি মানুষদের একটি ধারা নৃতাত্ত্বিকভাবে অস্ট্রালয়েড। ব্লু মাউন্টেনে সেই অ্যাবরজিন্যাল (অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী) কে দেখে সাথে সাথে বিষয়টি আমার মনে পড়েছিল। তার গায়ের রঙ এবং মুখাবয়ব কালো বাঙালিদের মতোই। আমি আমার ভারত, মালেশিয়া, ফিলিপাইন্স, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও প্রচ্ছদে দেশপ্রেমের দীর্ঘ কবিতা লিখেছি। আমার কবিতায় জাতীয় ভূগোলের পাশাপাশি অথবা সংমিশ্রিত হয়ে উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক ভূগোল, মিথ ও ইতিহাস। বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক উৎস সন্ধানের পাশাপাশি আমি তার আন্তর্জাতিক যোগসূত্রটিও খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি। বিস্তৃত ভূগোলে শেকড়ের সন্ধান আমার অন্যতম প্রধান কাব্য-অন্বেষা।’ কবির এই স্বীকারোক্তি আমার আলোচ্য বিষয়কে পাঠকের কাছে নিশ্চয় সহজ করে তুলবে। তবে আমাদের বলতে আর দ্বিধা থাকবার কথা নয় যে, আমিনুল ইসলাম চর্যা পদকর্তাদের যোগ্য উত্তরসূরী, আর আমাদের অহংকারও।

অবশ্য এই অলোচানায় খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে উপনিবেশবাদ এবং উত্তর-উপনিবেশবাদের প্রসঙ্গও এসে পড়ে। সাহিত্যে-শিল্পে এবং প্রায় সবখানে ইউরোপীয় আধুনিকতার ধারণার সাথে জড়িয়ে আছে উপনেশবাদী প্রভুত্বমূলক মন এবং যুক্তি। ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবশেবাদী রাষ্ট্রগুলো তাদের উপনিবেশিত রাষ্ট্রসমূহের উপনিবেশ-পূর্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য-শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে উপনিবেশিত জাতিসমূহের মধ্যে নিজেদের সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে হীনমনা করে তুলেছিল। এমনকি এসব উপনিবেশিত দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এসব দেশের শিক্ষিতমানুষ এবং বিশেষত লেখক-বুদ্ধিজীবীগণ সেই হীনমন্যতা থেকে মুক্ত হতে পারেননি। তারা রয়ে গেছেন উপনিবেশবাদী শিল্প-সাহিত্য-ইতিহাসজ্ঞানের অন্ধ ভক্ত। এটি আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ভারত উপমহাদেশীয় রাষ্ট্রসমূহের জন্য প্রায় কমবেশি প্রযোজ্য। ভারত উপমহাদেশ দুশো বছর বৃটিশদের অধীনে ছিল। ঐ সময় তারা শুধু ভারতবর্ষকে শাসন শোষণই করেনি, এর ইতিহাস-ঐতিহ্য-শিল্প-সাহিত্যকে পাল্টে দিতে প্রয়াস পেয়েছে। তারা বৃটিশপূর্ব ভারতীয় ইতিহাসকে নানাভাবে বিকৃত করেছে। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভাজন ও পারস্পারিক ঘৃণার সৃষ্টি করেছে। বৃটিশরা আসার আগে ভারতবর্ষ নন্দনভাবনায়, সংগীতে, শিল্পকর্মে, কবিতায়, স্থাপতে, প্রকৌশলে কত উন্নত ছিল তার প্রমাণ অজন্তা-ইলোরা, কালিদাসের মেঘদূত, শাহজাহানের তাজমহল, তানসেন-আমীর খসরু-মির্জা গালিবদের সংগীত-কাব্যসাহিত্য এবং এমন আরও কত অজস্র কীর্তি। ইউরোপের কোথাও সিন্ধুসভ্যতার তুলনা ছিল না সেই যুগে। কিন্তু বৃটিশ ইতিহাসবিদ-বুদ্ধিজীবী-দার্শনিক-ধর্মতত্ত্ববিদগণ তাদের বিভিন্ন লেখায় ভারতীয় সবকিছুকে হীনমর্যাদায় উপস্থাপন করেছে। তাদের হাতে বিশেষত মুসলমান সুলতান-সম্রাট-নবাবগণ মসিলিপ্ত ভাবমূর্তিতে চিত্রিত হয়েছেন। তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারতীয় ইতিহাসবিদ-বুদ্ধিজীবী-দার্শনিক-ধর্মতত্ত্ববিদগণের একটি বড় অংশ সেই উপনিবশেবাদী অপতৎপরতায় নিজেদের সামিল করেছেন। এভাবেই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদ উজ্জ্বল মহিমা অর্জনে সফল হয়েছে।

এখনও আমাদের মধ্যে অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবী-সিভিল সোসাইটির সদস্য আছেন যারা নিজ জাতি, ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে হীন ধারণা পোষণ ও প্রচার করে আত্মতৃপ্তি পান এবং নিজেদের আধুনিক, আলোকিত, প্রগতিশীল বলে আত্মজাহির করেন। এ হচ্ছে উপনিবেশিত মন। উপনিবেশী শক্তি চলে গেছে , কিন্তু তাদের শিল্পগত ও সাংস্কৃতিক কুপ্রভাব রয়ে গেছে যা আমাদের গভীর হীনমন্যতায় জড়িয়ে রেখেছে। ফ্রাঞ্জ ফানোঁ, এডওয়ার্ড সাঈদ প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক-গবেষকের গবেষণামূলক লেখায় উপনিবেশবাদ, প্রাচ্যবাদ, উত্তর-উপনিবেশবাদ, বি-উপনিবেশিকরণ প্রভৃতি ধারণা সবিস্তারে বিভিন্ন দৃষ্টান্ত সহকারে আলোচিত হয়েছে।

এখনও আমাদের মধ্যে অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবী-সিভিল সোসাইটির সদস্য আছেন যারা নিজ জাতি, ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে হীন ধারণা পোষণ ও প্রচার করে আত্মতৃপ্তি পান এবং নিজেদের আধুনিক, আলোকিত, প্রগতিশীল বলে আত্মজাহির করেন। এ হচ্ছে উপনিবেশিত মন। উপনিবেশী শক্তি চলে গেছে , কিন্তু তাদের শিল্পগত ও সাংস্কৃতিক কুপ্রভাব রয়ে গেছে যা আমাদের গভীর হীনমন্যতায় জড়িয়ে রেখেছে। ফ্রাঞ্জ ফানোঁ, এডওয়ার্ড সাঈদ প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক-গবেষকের গবেষণামূলক লেখায় উপনিবেশবাদ, প্রাচ্যবাদ, উত্তর-উপনিবেশবাদ, বি-উপনিবেশিকরণ প্রভৃতি ধারণা সবিস্তারে বিভিন্ন দৃষ্টান্ত সহকারে আলোচিত হয়েছে। ফ্রাঞ্জ ফানোঁ তাঁর ‘জাতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলেছেন, ‘উপনিবেশবাদ একটি অধিকৃত দেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের ওপর শাসন চাপিয়েই সন্তোষ্ট থাকে না; সম্ভবত এ ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট প্রমাণাদি দাখিল করিনি। উপনিবেশবাদ একটি গোষ্ঠীকে কব্জা করে তাদের মস্তিষ্ক থেকে সমস্ত রূপরস ও সারবস্তুকে নিংড়ে নিয়েই সন্তোষ্ট থাকে না, একধরনের স্বেচ্ছাচারী যুক্তি দেখিয়ে উপনিবেশবাদ নিপীড়িত জনগণের অতীত ইতিহাসের দিকে হাত বাড়ায়, তাকে বিকৃত করে, কলঙ্কিত করে এবং ধ্বংস করে। প্রাক ঔপনিবেশিক ইতিহাসের এই অবমূল্যায়নের প্রচেষ্টা আজকে একটি দ্বান্দ্বিক গুরুত্ব লাভ করেছে।’৬ উপনিবেশবাদী অবমূল্যায়ন ও মিথ্যাচারজনিত কলঙ্ক থেকে নিজেদের ইতিহাস-শিল্প-সাহিত্য-ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় অবস্থান ও পরম্পরাকে মুক্ত করে সঠিক আলোয় উপস্থাপনের মাধ্যমে উপনিবেশবাদ শেখানো ও আরোপিত আত্মগ্লানি ও হীনমন্যতা থেকে মুক্তি লাভের প্রচেষ্টার নাম বি-উপনিবেশিকরণ বা ডিকলোনাইজেশন। এতে করে শুধু শিল্প-সাহিত্য-ইতিহাসই উপনিবেশবাদী মিথ্যা প্রোপাগান্ডা থেকে মক্ত হবে না, উপনিবেশিত মনও মুক্তি লাভ করবে। সংক্ষেপে এই হচ্ছে উত্তর-উপনিবশেবাদী মতবাদ।

বৃটিশ আমালেই উপনিবেশবাদবিরোধী প্রচেষ্টা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিভিন্ন লেখনীতে লক্ষ করা গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের বহুকথিত আধুনিক কবি-সাহিত্যিকদের বড় অংশই রয়ে গেছেন উপনিবেশিত মনের অধিকারী। অবশ্য জসীমউদদীন এবং আল মাহমুদ উত্তর-উপনিবেশিক মানসিকতার দুই বড় কবি। নব্বই দশকে আবির্ভূত কবি আমিনুল ইসলামের কবিতায় উত্তর-উপনিবেশবাদের গভীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। তাঁর বহু কবিতায় আমাদের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য যথাযথ মহিমায় উপস্থাপিত হয়েছে। আমিনুল ইসলাম অবশ্য কোথাও কখনো দাবি করেননি যে তিনি উত্তর-উপনিবেশিক কবি অথবা উত্তর-উপনিবেশবাদ তাঁর পছন্দের বিষয়। উপনিবেশবাদ বিষয়ে তাঁর কোনো রচনাও আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু তাঁর অজস্র কবিতায় কখনো বাংলাদেশ, কখনো ভারত উপমহাদেশ, কখনবো এশিয়ার ইতিহাস-ঐতিহ্য এমনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, যেসব খুব সহজেই উত্তর-উপনিবেশবাদের সাথে মিলে যায়।

এখানে বলে নেয়া ভালো যে আমিনুল ইসলাম অতীতচারী কবি নন। অতীত তার বিষয়ও নয়। ইতিহাস আলোচনাও তার বিষয় নয়। তিনি ইতিহাস সচেতন, কালসচেতন এবং ঐতিহ্যসচেতন কবি। তিনি বসবাস করেন বর্তমানে; তার চোখদুটো ভবিষ্যতের দিকে প্রসারিত। তিনি অতীত থেকে আলো নিয়ে বর্তমানকে আলোকিত করেন এবং ভবিষ্যতের যাত্রাপথে সে-আলোকে পথচেনার সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করতে চান। তিনি কোনো ঐতিহাসিক কবিতা রচনা করেননি। কোনো কিংবদন্তীর বর্ণনা দিতেও লেখেননি কোনো কবিতা। তিনি ইতিহাস-কিংবদন্তী-ঐতিহ্যকে তার কবিতার ঐশ্বর্য হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ইতিহাস-ঐতিহ্য-মিথ কখনো মূল বিষয়ের সাথে অঙ্গীভূত হয়েছে, কখনো চিত্রকল্প নির্মাণে, কখনো উপমা সৃষ্টিতে, কখনোবা সময়চেতনা জ্ঞাপনে ব্যবহৃত হয়েছে। এতে করে তার কবিতা অনেক বেশি ঐশ্বর্যময়, সৌন্দর্যমন্ডিত এবং ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে উঠেছে। অবশ্যই তিনি উদ্দেশ্য নিয়েই এসব ব্যবহার করেছেন। সেই উদ্দেশ্য হচ্ছে, এখন রাজনৈতিকভাবে ‘স্বাধীন’ কিন্তু মানসিকভাবে ‘উপনিবেশিত’ বাঙালি জাতিকে তার শেকড়ের সঠিক সন্ধানে আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করা এবং তার গৌরবের স্থানগুলোর ওপর আলো নিক্ষেপ করা। বৃটিশরা দুশো বছর ভাবত উপমহাদেশকে শাসন শোষণ করে অবশেষে চলে গেছে। কিন্তু তারা উপমহাদেশের মানুষের মনে যে-উপনিবেশ রেখে গেছে, তা আজও এদেশের উচ্চশিক্ষিত মানুষের একটা বড় অংশকে ‘উপনিবেশিত মন ’ এর অধিকারী করে রেখেছে। উপনিবেশিত মন নিয়ে বাঙালি দ্রুতই ভুলে যায় তার অতীত ও ইতিহাস। এটা আত্মঘাতী ব্যাপার। ইতিহাস-ঐতিহ্য বিস্মৃত হলে আত্মাভিজ্ঞান অর্জনেও মারাত্মক ভ্রান্তি ও ঘাটতি রয়ে যায়। আমিনুল ইসলাম বাঙালির বিস্মৃতিপরায়ণার বিষয়টি খুবই সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন কবিজীবনের প্রথম দিকে লেখা তার ‘শেকড়ছুঁয়ে’ নামক কবিতায়। প্রথমেই তিনি আত্মজিজ্ঞাসার সুরে বলেছেন,

চরের যোনিতে মুথাঘাসের মতোই কি জন্ম
আমার? নাকি আমি কোনো মহাকুলবৃক্ষের
গাঢ় প্রাণরস আর দুর্যোগবৈরী বীর্য বয়ে চলেছি
এ সত্তায়—যার শেকড় আফ্রিকার বাওবাব বৃক্ষের
মতো ছড়িয়ে আছে মহাকালের মৃত্তিকায়?
অথবা দারুচিনিদ্বীপ-সন্ধানী কোনো সাহসী
বিহঙ্গের চঞ্চুবাহিত বীজ হতেই কি নবরূপে
জন্ম আমার পিতৃবৃক্ষের— যা কিনা মাতৃজঠরের
মতো পেয়েছিল শ্যামল বদ্বীপের উর্বর আঁধার?

[ শেকড়ছুঁয়ে: মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম ]

অতঃপর তিনি নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিভিন্নজনের কাছে গেছেন। কারও কাছেই উত্তর মেলেনি। কারণ প্রায় সকলেই অতীতবিস্মৃতিতে বিভোর হয়ে আছেন। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়, ভাগ হয় বাংলা। অতঃপর ১৯৭১ সালে খন্ডিতবাংলার স্বাধীনতা লাভ। কিন্তু আসলে তো বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস এটুকু কালপরিসরে সীমায়িত নয়। ভূখন্ড হিসেবে বাংলার ইতিহাস লক্ষ বছরের অথবা কোটি বছরের ইতিহাস। জাতি হিসাবে বাঙালির ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের। বাঙালিরাই তো বাংলার প্রধান আদিবাসী। অথচ সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে, নাটকে, সিনেমায়, উপন্যাসে, গল্পে, কবিতায়, গানে, প্রচার মাধ্যমে লাখো বছরের কোটি বছরের বাংলাভূগোলের ছবি অনুপস্থিতপ্রায়। এদেশের বড় কবি, তুখোড় নাট্যকার, প্রখ্যাত ইতিহাস-বিশারদ কারও লেখাতেই বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য তার দীর্ঘ পরম্পরায় এবং সোনালি মহিমায় উপস্থাপিত হয় না। কারণ, উপনিবেশিত মনে সেই প্রেরণা ও সাহস আসে না। ফলে নতুন প্রজন্ম ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞ থেকেই বড় হচ্ছে। এই নিয়ে তার খেদোক্তি:

আমার ও মৃত্তিকার মাঝে এতটুকু ফাঁক নেই
অথচ এই নিয়ে বিশারদের হাতেও ধুলো ওড়ে;
কবিশ্রেষ্ঠ গান শোনান নগদের; নাট্যকারের কাছে
মুখ খুলে অপবাদে বিদ্ধ আমি আপাদমস্তক;
শিল্পকলার উঠানে বনসাইয়ের পাশঘেঁষে
তরুণ সংস্কৃতিকর্মী আর আমার নিজের চোখ
বাহান্নোর রক্তাক্ত উঠোন ঘেঁষে
দূরান্ধের মতো আটকে আছে সাতচল্লিশে।

আমার স্কুলপড়ুয়া মেয়ের একটা খেয়ালী প্রশ্নের
জবাব সংগ্রহে এত ঘাঁটাঘাঁটি, এতটা ধর্ণা!
রক্তোজ্জ্বল হলেও তার কৌতূহল নিবৃত্তিতে
আমার এই সঞ্চয় যথেষ্ট নয় মোটেও;

এখন এই আমি আর কার কাছেই বা যেতে পারি?

[ শেকড়ছুঁয়ে: মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম ]

এমন অভিজ্ঞতা ও মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আমিনুল ইসলাম আপন কবিতার ভুবনে ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সাথে নিয়ে পথ চলেছেন। কিন্তু পূর্বেই বলেছি তাঁর কবিতা ইতিহাসচেতনার হলেও ইতিহাসের নয়। তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রেমের কবিতার মধ্যে ইতিহাস, কিংবদন্তী, লোককাহিনী, রূপকথা প্রভৃতির অনুষঙ্গ জুড়ে দিয়েছেন। আমিনুল ইসলামের কবিতা যতটা অনুভব করবার, ঠিক ততটাই বিশ্লেষণ করবার। তিনি আত্মনিষ্ঠ কবি, তবে আত্মকেন্দ্রিক বলা যাবে না। আসলে তিনি যে জাতের কবি, তাতে ইতিহাস ও ঐতিহ্য-বিলাসী না হয়ে উপায় নেই। অর্থাৎ ইতিাহস ঐতিহ্যের উপমা তাঁর কাব্যের কারুকাজমাত্র নয়, ইতিহাসেই কাব্য। তাই আমার বলতে ইচ্ছা করে তিনি ইতিহাসের বরপুত্র। কারণ এত বেশি করে ইতিহাস নির্ভর কবিতা বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে খুব কম কবিই রুয়েছেন। এই ক্ষেত্রে আমিনুল ইসলাম শীর্ষস্থানীয় একজন। তবে সবচেয়ে বড় কথা, এই ইতিহাসচেতনা বা ইতিহাস ঐতিহ্যের ব্যবহার কখনই আরোপিত বলে মনে হয়নি। রয়েছে স্বাভাবিক গতিময়তা। তাঁর কবিতায় জাতিক ও আন্তর্জাতিক ইতিহাস এসেছে পাশাপাশি। এই ঘরানার একাধিক কবিতা রয়েছে ‘স্বপ্নের হালখাতা’ কাব্যগ্রন্থে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘পিছিয়ে যাওয়া মানুষ’ নামক কবিতাটি। এটি এমন একটি কবিতা, যেখানে শিরোনামের আদ্যোপান্ত নিহিত আছে। এই কবিতার আর একটি মজা হলো, পাঠ করবার সৌখিনতা। এর গাঁথুনি, শব্দচয়ন, আবার সেই সাথে ইতিহাস চয়ন হয়েছে অসাধারণ দক্ষতায়। এর শুরু এক মেজাজে আর শেষ হলো অন্য চূড়ায়। কবি শুরু করেছেন—

কবিতা প্লাবনে ভাসে; প্রাণহীন ছোটগল্প;
কে পড়ে নভেল! নাটক মুনাফা খোঁজে;
…………………
সবুজ ব্যাগ নিয়ে আমিও অনেকদিন
নগরনিবাসী;
কোন্ তরিকায় আজ আমার সমস্ত রাত মার্বেলদুপুর!
আমার বিছানা সোলেমানি-তখত হয়ে
প্রায়শ ঘুরে আসে সত্যবতীর ঘাট
বেহুলাবাসর হয়ে দখল-দরোজা!

কবিতাটির প্রস্তুতিপর্ব দেখে সহজেই অনুমান করা যায় কবি বড় কিছুর ইঙ্গিত দিতেই যাচ্ছেন। বাঙালি জাতির অহংকারের দিকগুলো কবি তুলে আনতে চাচ্ছেন সুকৌশলে। আর তিনি আফসোস করছেন, এর পরেও আমার কেন এতটা পিছিয়ে আছি। জাতি হিসাবে আমরা কেন পিছিয়ে পড়ছি, তার একটা ফিরিস্তি বলা যেতে পারে এই কবিতা। তিনি নিজের জাতিসত্তার সাথে অন্য জাতিসত্তার ইতিহাস মিলিয়ে দেখতে চেয়েছেন যোগ্য নৃতাত্ত্বিক হিসাবে। তিনি বাঙালি জাতির উৎসের সন্ধান করেছেন। বাঙালির জাতির একটা অংশ অস্ট্রালয়েড। কবি অস্ট্রেলিয়ার ব্লু মাউন্টেইনে সেখানকার আদিবাসীকে দেখেছেন এবং তার চেহারায় গায়ে ঘ্রাণে বাঙালি জাতির সত্তার ঘ্রাণ পেয়েছেন। তিনি চর্যাপদের আমলের শবর-শবরীদের আদি বাঙালির সাথে সিডনীর আদিবাসী সাইমনের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন, বলা যায় আবিষ্কার করেছেন। তিনি এই জাতিতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের বিষয়টি অতীতের সাথে বর্তমান, এশিয়ার ভূগোলের সাথে অস্ট্রেলিয়ার ভূগোল এবং আদিবাসী মানুষের সমুদ্রপথে যাতাযাতের দৃশ্যযোগে অভিনব চিত্রকল্পে চমৎকার শিল্পনৈপুণ্যে কবিতা করে তুলেছেন। কবিতার গায়ে মউমউ করে উঠেছে প্রত্নঘ্রাণ ; কবিতার শরীরে অলংকার হয়ে উঠেছে ইতিহাস-ঐতিহ্য; কবিতার প্রাণ হয়েছে ব্যাপ্ত মহাকাল। তিনি অতীতকে বর্তমান করে তুলেছেন। মহাকালের নীরবতা কথা বলে উঠেছে বর্তমানের উঠোনে।

আমি ঘুরি পথে ও প্রান্তরে;
সিডনির ব্লু মাউন্টেনে
কৃষ্ণকায় আদিবাসি সাইমনকে দেখে
মনে হয়েছিল—
পুরনো পুঁথির মতো গায়ে তার পরিচিত ঘ্রাণ;
যেন সে আমারই সেই আদিবংশধর—
শিমুলের ফুল গুঁজে চেয়ে থাকতো শবরীর চুলের খোঁপায়;
তুফানের ঢেউ লেগে নৃতাত্ত্বিক তরীখানা
পর্বতের কোল ছেড়ে
ভিড়েছিল একদিন করতোয়া তীরবর্তী বৃক্ষের পাড়ায়!
আমি তার পাশে বসে উঠিয়েছে বেশ কিছু ছবি;
আমি কি বাতিকগ্রস্ত?
নাকি আমার রয়েছে কোন অদ্ভুত ইন্দ্রিয়—
যা আমাকে জাগিয়ে দেয় ইতিহাসের মোড়ে মোড়ে নিদ্রিত উঠোনে।

সত্যিই আমিনুল ইসলামের আছে এক অদ্ভুত ইন্দ্রিয়, যা তাঁকে জাগ্রত রাখে ঘুমন্ত ইতিহাস পাড়ায়। তাই তো কবি ইন্দোনেশিয়ার কালিমান্টামের গভীর জঙ্গলে শুনেছেন রাঙামাটির শ্যামা আর কোকিলের গান। তিনি শ্যামদেশের গিরিময় কাঞ্চনবুরীতে কাওয়াই ব্রীজ আর আত্মত্যাগী সৈন্যদের সমাধিফলক দেখে মনে করেছেন নিজ দেশের দেশপ্রেমিক আর আত্মত্যাগীদের কথা। তিনি খুঁজেছেন ঈশা খাঁর বীরত্বের নিশানা, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, মজনু শাহের নাম। তিনি ভীত সন্ত্রস্থ, কারা মুছে ফেলতে চাচ্ছে এঁদের নাম। অথচ ‘ইতিহাসের মোড়ে মোড়ে যা আমাদের যুগিয়েছে অসম সাহস’। এই কবিতার শেষে কবির আর্তচিৎকার ভেসে আসে এইভাবে—

ও হে সোমপুর বিহারের শূন্য মহাকাল!
হে পুণ্ড্রবর্ধনের আলোক-আঁধারি!
হে সোনামসজিদের স্বর্গময়ী ছায়া!
তোমরা আমাকে নাও—
অতীতের পুত্র আমি ভুল করে এসে গেছি
বিস্মৃতিপ্রিয় এক শ্যামরং জনতার একচোখা উঠোনে।

বাঙালি জাতির বয়স নিয়ে একাধিক রকমের মতামত রয়েছে। তবে একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, রাঢ় এবং বরেন্দ্র হচ্ছে বাংলার প্রাচীনতম ভূখন্ড। বাঙালির ইতহাস অথবা উৎসের সন্ধান করতে গেলেই প্রথমে আসে রাঢ়-বরেন্দ্রীর নাম। ভাগ্যান্বেষণ কিংবা রাজ্য লিপ্সার বশে আমাদের এই ভূখন্ডে এসেছে অনেক পরাশক্তি। এদের মধ্যে কেউ ধন সম্পদ লুণ্ঠন করে পালিয়ে গেছে নিজদেশে। আবার কেউ বরেন্দ্রভূমির প্রেমে পড়ে থেকে গেছেন চিরদিনের মত। আমাদের বরেন্দ্রীর সংস্কৃতি কেউ বুকে ধারণ করে নিয়ে গেছেন স্বভূমে, আবার কেউ তার নিজের সংস্কৃতি নিয়ে এসে মিশিয়েছেন বরেন্দ্রীর দেহমনে। এইভাবে ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয়েছে নতুন সভ্যতা নতুন জনপদ। বনজঙ্গল সাফ করে গড়ে উঠেছে নতুন জনবসতি। বরেন্দ্রীর বিভিন্ন নদীর তীরে গড়ে ওঠে অনেক জনপদ। বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা মিলে তৈরি হয়েছে নতুন সংস্কৃতির ধারা। আমিনুল ইসলাম তার কবিতায় এই সংস্কৃতি-ধারার ছবি এঁকে ছেন চমৎকারভাবে।

০১.
একদিন বরেন্দ্রের ভাতের সুঘ্রাণে
সমুদ্র জঙ্গল ভেঙে এসেছিল মুগ্ধপায়ে
তুর্কী-চীন-মগ-আরবি-মঙ্গল-তাতার;
আজও সেই মুগ্ধছাপ গাঙেয় তল্লাট জুড়ে রয়েছে নিভৃতে;
তারাও গিয়েছে নিয়ে নকশীকাঁথার বুক, যমুনার প্রেম
মধ্যপ্রাচ্যে, মহাচীনে, আফ্রিকার গহীন অন্তরে
সঙ্গোপনে বাতি জ্বেলে অম্লান আজো তা ঝড়ঝঞ্ঝা রুধি।

[ সরল অভিজ্ঞান/ মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম ]

০২.
বদলগাছীর রোড ধরে আসে মহাকালের গান;
ধর্মং শরণাং গচ্ছামি—
বুদ্ধং শরণাং গচ্ছামি—
সঙ্ঘং শরণাং গচ্ছামি—
পেছনে শ্রীজ্ঞান অতীশের ছায়া।

[ ভোরের হাওয়ায় ভাসে বাংলাদেশ/ মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম ]

বরেন্দ্র অঞ্চলের মূল অধিবাসীরা পুণ্ড্র, দ্রাবিড়, শবর, অষ্ট্রিক, কিরাত। পরবর্তীতে এদের জাতীয়তাভিত্তিক নাম বাঙালি। যাদের গায়ের রং প্রায় শ্যামল বা কৃষ্ণকায়। তারা পশু শিকারী, মৎস্য শিকারি এবং কৃষক। তাদের হাতে গড়ে উঠেছে প্রাচীন সভ্যতা। তাই তাদের বাদ দিয়ে বরেন্দ্রীর পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না। বাংলা ভূখন্ডের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন অংশ রাঢ় ও বরেন্দ্র। বরেন্দ্রর আদিবাঙালিরা শবর-শবরী। তাদের হাতেই বাংলাসাহিত্যের শুভসূচনা যা চর্যাপদ নামে খ্যাত। তখন বরেন্দ্র অঞ্চলে আখ বা ইক্ষু বা পুন্ড্র এবং শিমুল ছিল বৃক্ষ ছিল প্রচুর পরিমাণে। শবরীরা শিমুলফুল মাথায় দিতে সাজতো এবং কার্পাস তুলা দিয়ে তৈরী কার্পাসিকা পরিধান করতো। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে এর ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির অবদান সবচেয়ে বেশি। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন সূচিত করে পরবর্তী স্বাধীনতা সংগ্রামের। ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে ফুল দেয়া হয় শহীদ মিনারে। কবি শবরীদের সেই ফুল আর ভাষা শহীদদের স্মরণে দেয়া ফুলের মধ্যে সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার যোগসূত্র রচনা করেছেন। এবং এই পথেই বাঙালি জাতির কবির পরিচয় সূত্র খুঁজেছেন—

তাই তো ফাগুন এলে আমার বোন পলাশের মালা গাঁথে,
এবং আমি আমার যুবতীর খোঁপায় দিই প্রস্ফুটিত লাল;
আর উদাস দুপুরে খুঁজে ফিরি
আমাদের অস্ট্রিক আত্মীয়ের পদচিহ্ন—
যে তার যুবতীকে নিয়ে
বরেন্দ্রীর শিমুলচিহ্নিত ইতিহাসের রাঙাপ্রান্তরে লুকিয়ে আছে।

[ শিমুল চিহ্নিত ভালোবাসা/ শেষ হেমন্তের জোছনা ]

বাঙালির সভ্যতার মূলে আছে তার সুজলাসুফলা নদীবহুলা ভূগোল এবং তার মুখের ভাষা। সে আজীবন ভালোবেসেছে তার মুখের জবান ও ভাষাকে। তাই কোনো রক্তচক্ষুর ভয়েই সে তার মুখের ভাষাকে জলাঞ্জলি দেয়নি। রৌরব নরকের ভয়ও তাকে ভীত করতে পারেনি। আর্য রাজারা বাঙালিকে নানা নেতিবাচক হীন বিশেষণে আখ্যায়িত করেছে। তার মুখের ভাষাকে নরকে যাবার অন্যতম কারণ বলে হুমকি দিয়েছে। কিন্তু বাঙালি তার মুখের ভাষা ত্যাগ করেনি। বরং অনুকূল পরিবেশে ও পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কৃত, আরবী, ফার্সী ভাষায় লিখিত ধর্মপুস্তক ও সাহিত্যকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। সুলতানী আমলে বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। অনার্য বাঙালির মুখের ভাষা নাগরিকদের প্রায় সর্বজনীন ভাষা হয়ে উঠেছে। আমিনুল ইসলামের বিভিন্ন কবিতায় বাঙালি ও বাংলা ভাষা বিকশিত হয়ে ওঠার দিকটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এবং উপভোগ্য শিল্পসফলতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আর সেখানেও আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের জয়জয়কার। কারণ বাংলাভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ সাধন সম্পর্কিত সঠিক ইতিহাস জানাও নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব যাতে করে তারা ইতিহাস বিকৃতির ইতিহাস দ্বারা বিভ্রান্ত না হয়। কারণ এটাই দুর্ভাগ্যজনক সত্য যে এসব নিয়ে বহু মিথ্যাচার ঘটেছে অতীতে। অজ্ঞতা এবং অকৃতজ্ঞতা দুটোই ক্ষতিকর।

কানসাটের মাটিতে স্তব্ধ জোছনায় কান পাতলে শুনতে পাবে
গৌড়সভায় বেজে চলেছে কবিয়াল নরেশ শীলের গান
অথবা
পরাগল খাঁকে পাশে বসিয়ে মহামতি সুলতান শুনে যাচ্ছেন
কবীন্দ্র পরমেশ্বরের মহাভারত—
তাঁহান আদেশে মালা মস্তকে ধরিলা
কবীন্দ্র পরম যত্নে পাঁচালী রচিলা।।

[ ঢাকার মেয়ে চন্দনাকে/ শরতের ট্রেনে শ্রাবণের লাগেজ ]

বাংলাদেশের অন্যতম এক নদী মহানন্দা। এর কোলেই হেসে খেলে কেটেছে আমিনুল ইসলামের শৈশব। তার অনেক কবিতায় এই নদী এসেছে নানা প্রসঙ্গে। এ নদী কবির বড় আপন। আর তাইতো মহানন্দাকে নিয়ে লিখলেন দীর্ঘ কবিতা ‘ মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম’। বইও প্রকাশিত হল এই কবিতার শিরোনামেই। আমরা যেন কবিতার রাজ্যেও পেয়ে গেলাম এ এক নতু অদ্বৈতমল্ল বর্মণকে। এই কবিতায় কবি মহানন্দার চারপাশে গড়ে ওঠা জনজীবনকে এঁকেছেন চমৎকারভাবে। মহানন্দা সেতুকে কবি বলেছেন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের প্রশস্ত কাঁধ। যার নীচে ৭১-এ শহীদ হন তিনি। কবিতা শেষে কবির হাহাকারও ব্যক্ত হয়েছে। আমরা যে উজানের শাপে অভিশপ্ত। কবি বলেছেন— ‘উজানের শাপে মালোদের নৌকাগুলো ধরেছে চুলোর পথ…।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ তথা বৃহত্তর রাজশাহীর ঐতিহ্য ‘সবুজ ও সুস্বাদু সোনা’ বাহারি আমের কথাও আমিনুল ইসলাম আনতে ভুলেননি। এক্ষেত্রে ধন্য রাজশাহী, ধন্য রাজশাহীর আম। ‘মহানন্দা’ শিরোনামে আর একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা স্থান পেয়েছে ‘তন্ত্র থেকে দূরে’ নামক কাব্যগ্রন্থে। ঐতিহাসিকদের মতে, প্লাইওসিন যুগে বরেন্দ্রীর অন্যতম প্রধান নদী মহানন্দার জন্ম। মহানন্দার জন্ম প্রসঙ্গে ‘মহানন্দা’ শীর্ষক কবিতায় আমিনুল ইসলাম যা বলেন, তাতে লক্ষাধিক বছরের পুরোনো বঙ্গভূমির কথাই প্রকারান্তরে ব্যক্ত হয়।

আবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ তথা বৃহত্তর রাজশাহীর ঐতিহ্য ‘সবুজ ও সুস্বাদু সোনা’ বাহারি আমের কথাও আমিনুল ইসলাম আনতে ভুলেননি। এক্ষেত্রে ধন্য রাজশাহী, ধন্য রাজশাহীর আম। ‘মহানন্দা’ শিরোনামে আর একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা স্থান পেয়েছে ‘তন্ত্র থেকে দূরে’ নামক কাব্যগ্রন্থে। ঐতিহাসিকদের মতে, প্লাইওসিন যুগে বরেন্দ্রীর অন্যতম প্রধান নদী মহানন্দার জন্ম। মহানন্দার জন্ম প্রসঙ্গে ‘মহানন্দা’ শীর্ষক কবিতায় আমিনুল ইসলাম যা বলেন, তাতে লক্ষাধিক বছরের পুরোনো বঙ্গভূমির কথাই প্রকারান্তরে ব্যক্ত হয়। এই কবিতায় কবি জাতি হিসেবে বাঙালির মহাকালের উঠোনে যাপিত জীবনের ধারাবাহিক ছবি তুলে ধরেছেন যা দেখে বঙালি তার পথপরিক্রমা, অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য, শাসনকর্তার পরিবর্তন, রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে এবং বর্তমানের উঠোনে দাঁড়িয়ে মহাকালের বিশাল ভূগোলটি দেখে নিতে পারে। আমিনুল ইসলামের শক্তিমত্তা এখানেই যে তিনি ইতিহাস-ঐতিহ্য-মিথকে কবিতার উপকরণ করেছেন তবে শৈল্পিক দক্ষতাগুণে সেসব উপকরণ অসাধারণ উপমা-চিত্রকল্প-উৎপ্রেক্ষার সোনালি অলংকারে উন্নীত হয়েছে। ফলে তার কবিতা নান্দনিক সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।

দেবরাজের বরে নাকি পুন্ড্র বরেন্দ্র,
তুমি কি সেই আর্শীবাদ গাঢ় প্রাণরসে?
সর্পিলী যদিও শরীর, অমৃত আনন্দ
বাতাস বাজালে বাঁশি তরঙ্গ নূপুর হয়ে অন্তর প্রকাশে।

প্লাইওসিন দিনে যখন ওষ্ঠাগত প্রাণ
মহলড্রিম জলকন্যা ভরাকুম্ভ কাঁখে লয়ে পুন্ড্রে এলে নেমে
কত মারি খরা তাপ টানে পাত্রখান
অফুরান জলসত্র, অকাতর তুমি আরো অনার্যের প্রেমে।

[ মহানন্দা/ তন্ত্র থেকে দূরে ]

আমিনুল ইসলামের আর একটি মিথনির্ভর সোনালি কবিতার নাম ‘বেহুলার ভিটা’। কবিতাটি নিম্নরূপ:

মহাকালের বুকে ধূসর আঁচলে আবৃত স্তন
স্তন হতে চুঁয়ে নামা দুধ
ঝরনার মতো মিশে যায়
কালের করতোয়ায়।
সেই জল পান করে দুই তীরে বেড়ে ওঠে শিশুরা
তাদের পরনে ইস্কুল-ড্রেসের মত ভালোবাসার ইউনিফ্রম।

[ বেহুলার ভিটা/ জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার ]

এই কবিতা কলেবরে ছোট হলেও আবেদনে বিশাল। বাঙালি জাতির প্রধানশক্তি তার প্রেম। এই প্রেমই তাকে টিকিয়ে রেখেছে যুগের পর যুগ প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত নদীমাতৃক উঠোনে। চাঁদ সওদাগর, বেহুলা, লখিন্দর এরা বাঙালিই আদি বংশধর। এসব মানুষ প্রকৃতির কাছে হার মানেনি। মৃত্যুর কাছেও স্বীকার করেনি পরাজয়। সাপে-কাটা লখিন্দরকে বাঁচিয়ে তুলতে বেহুলা স্বর্গপুরীতে নেচেছিল। ফিরিয়ে এনেছিল পতির প্রাণ। বাঙালির এই প্রেমসত্তা এত প্রবল যে সে কখনো অন্যজাতির উঠোন বা রাষ্ট্র আক্রমণ হানতে যায়নি। কোনো লুণ্ঠনে বা শোষণে যায়নি অন্য কোনো দেশ। বাঙালির এই প্রেমিক ও শান্তিবাদী সত্তার প্রতিফলন দেখা যায় তার কবিসত্তা ও বাউলসত্তার মাঝে সবচেয়ে বেশি। বেহুলার শান্তিবাদী প্রেমসত্তা বাঙালির জাতিসত্তার মৌলিক উপকরণ হয়েছে। এখনে কবি মহাকালকে নারী হিসাবে দেখেছেন। রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে বেহুলার ভিটা। আর প্রেম ভালোবাসার কেন্দ্র। কিংবদন্তীর বেহুলাকে তিনি বর্তমান বাঙালি জাতির সত্তায় জননী-সন্তানের সমান্তরালে উপস্থাপন করেছেন। অতীতে ঘটনার ওপর নির্মিত মিথ পুনর্গঠিত হয়ে বর্তমানের বিরাজমানতায় উন্নীত হয়েছে।  [চলবে…]


তথ্যসূত্র:

১.T. S. Eliot: Tradition and individual talent, Sacred Wood, 1933.
২. মোহিতলাল মজুমদার: মোহিতলাল-কাব্যসম্ভার: স্বপন-পসারী। কবি-ভাগ্য। মিত্র ও ঘোষ, কলকাতা।
৩. ড. সফিউদ্দিন আহমদ: উৎসের সন্ধানে, সমাচার প্রকাশনী, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ ২০১৬।
৪.আমিনুল ইসলাম: ‘আমার কবিতা: কাছের কেন্দ্র—দূরের পরিধি’, কবিতাসমগ্র, অনন্যা: ঢাকা- ২০১৬।
৫.আমিনুল ইসলাম: বিশ্বায়ন বাংলা কবিতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ; আমার কবিতা লেখার পেছনে। মুক্তদেশ প্রকাশনী, ২০১০- ঢাকা।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২২ নভেম্বর ১৯৭৯, রাজশাহীর তানোর উপজেলার পাড়িশো গ্রামে। পেশা শিক্ষকতা। গল্প ছাড়াও লিখেছেন উপন্যাস, প্রবন্ধ, কিশোর সাহিত্য, কবিতা ও গান। সম্পাদনা করেছেন কয়েকটি ছোটোকাগজ। তিনি বাংলাদেশ বেতারের একজন তালিকাভুক্ত গীতিকার। মঈন শেখের লেখা প্রথম উপন্যাস ‘কুসুমকথা’ ছাপা হয় ভারতের দেশ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় ২০১৯ সনে (১৪২৬ ব.)। এর পরপর তাঁর নাম অনেকটা আলোচিত হতে থাকে সাহিত্যিক মহলের বিভিন্ন আড্ডায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অল্প সময়ের মধ্যে দেশ-এর ওই শারদীয় সংখ্যা ফুরিয়ে যায় বাংলাদেশের পত্রিকার বিভিন্ন স্টল থেকে। সেই বছরই কলকাতার আন্তর্জাতিক বইমেলা উপলক্ষ্যে ‘কুসুমকথা’ বই আকারে প্রকাশ করে আনন্দ পাবলিশার্স। এই উপন্যাসের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলা-উর্দু লিটারারি ফোরামের সাহিত্য পুরস্কার-২০২০’ প্রদান করা হয় মঈন শেখকে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।