সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত আয়োজিত ১২-০৬-২০২১ তারিখ সন্ধ্যার ফেসবুক প্রশ্নোত্তর-সভাতে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট অনুবাদক অধ্যাপক অভিজিৎ মুখার্জি। আলোচনার বিষয় : অনুবাদ সাহিত্য। প্রশ্ন রেখেছেন সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত ও আরও অনেকে। অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে সেই আলোচনাটি আমাদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ায় শ্রী-তে এটি প্রকাশিত হলো। আমরা কথাসাহিত্যিক অলাত এহসান, সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত এবং শুভদীপ বড়ুয়ার কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
অভিজিৎ মুখার্জি—যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং জাপানিজ ভাষার অধ্যাপক ও জাপানিজ-সাহিত্যের বিশিষ্ট বাংলা অনুবাদক। জাপানিজ সাহিত্যিক ইয়ুকিও মিশিমা এবং হারুকি মুরাকামির উপন্যাস ও গল্প-সংকলন মূল-জাপানিজ থেকে অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক মুখার্জি। বর্তমানে তিনি একসঙ্গে একাধিক জাপানিজ-সাহিত্য অনুবাদকর্মে ব্যস্ত। এছাড়াও তিনি অনুবাদ করেছেন অজস্র ইংরেজি ছোটোগল্প ও প্রবন্ধ।
সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত— লেখক, বাচিক শিল্পী, এবং কলকাতা-দূরদর্শনের সঞ্চালিকা।
প্রশ্ন : অনুবাদ সাহিত্য বাংলা ভাষায় কবে থেকে জনপ্রিয় হলো? (প্রশ্ন করেছেন সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত)
উত্তর : যদি প্রকৃতই ‘জনপ্রিয়’ হওয়ার শর্তটা বিবেচনা করি, তবে সম্ভবত বিংশ শতকের গোড়ার দিকে যখন স্বাধীনতা আন্দোলন একটি অ-ইউরোপীয় বিকল্প সভ্যতার মডেল খুঁজছিল, এবং জাপানের মধ্যে অনেকাংশে সেটা পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করল, সেই তখন। ১৯০২ সাল থেকে বছর কুড়ি ধরে তখন বাংলা জনপ্রিয় পত্রপত্রিকাগুলোতে জাপান-কেন্দ্রিক যে বিপুল পরিমাণ লেখালেখি ছাপা হয়েছিল (যা আজকের অনেক অনুকূল পরিস্থিতিতেও একেবারেই অসম্ভব), তা নিশ্চয়ই অনুবাদে কথাসাহিত্য, লোকসাহিত্য, প্রবন্ধ সাহিত্য পড়ার ভিত্তিতে লেখা হয়েছিল। লেখকদের মধ্যে ঠাকুরবাড়ির অনেকে ছিলেন, সমাজের শিক্ষিত অংশের নানা প্রমুখজন ছিলেন। আমার ধারণা, জাপানি ভাষা শিখে নয়, ইংরিজি অনুবাদের মাধ্যমে এর উৎসের সঙ্গে বাঙালি লেখকরা পরিচিত হয়েছিলেন। এবং তারপর বাংলায় সম্পূর্ণ বা আংশিক অনুবাদের প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। সেগুলো জনপ্রিয় পত্রপত্রিকায় অতদিন ধরে ছাপা হওয়াও জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করে। জাপানিদের একটা অংশও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণেই হয়তো ইংরিজিটা শিখে নিতেন। প্রাচ্যের সভ্যতা হিসেবে আমাদের পরিচয় সম্পর্কে আমরা যখন সচেতন হতে শুরু করেছি, সেই সময় ওকাকুরা কাকুজো (তেনশিন) ভারতে এসেছিলেন, তাঁর সঙ্গে শিল্প ও সভ্যতা বিষয়ক বিস্তৃত চর্চায় অংশগ্রহণ করেছিলেন অনেকে। তিনি কিন্তু তাঁর ‘বুক অব টী’ সরাসরি ইংরিজিতে লিখেছিলেন। ঠাকুরবাড়ির প্রিয়ম্বদা দেবীর সঙ্গে ওঁর রোমান্টিক পত্রালাপও ইংরিজিতেই হতো।
ষাটের দশকের গোড়ার দিকেই আমি বাংলা অনুবাদে নানা বিদেশি কাহিনির বই হাতে পেতে থাকি, সত্তরের দশকের শুরুতে গিয়ে প্রায় বেশিরভাগ পশ্চিমী ক্লাসিকস বাংলা সংক্ষিপ্ত অনুবাদে পড়া হয়ে যায়। দেব সাহিত্য কুটীর প্রকাশ করতো ওগুলো। আমার সহপাঠিরা সক্কলে পড়ত ওগুলো। নানা পেশায় গিয়েও, এখনও তাদের যেটুকু সাহিত্যানুরাগ অবশিষ্ট আছে, সেই অভ্যাসের সুবাদেই।
আর ছিল সোভিয়েত দেশ থেকে অনুবাদ হয়ে আসা সেখানকার নানা কাহিনির বই। একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, বাংলা বইয়ের সম্মিলিত বাজার যখন বেশ বড়ো, তখন এদিককার প্রফুল্ল রায়, ননী ভৌমিক, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, অরুণ সোম, এঁদের অনুবাদে বহু বই ‘রাদুগা’ ও ‘প্রগতি’ প্রকাশনার থেকে বেরিয়ে আমাদের হাতে আসত এবং আমরা গিলতাম। বাংলাদেশের হায়াৎ মামুদ, দ্বিজেন শর্মা, এবং আরও ক’জন তখন পুরোদমে অনুবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন রাশিয়ান থেকে বাংলায়।
যেটুকু আমার নজরে এসেছে, তা থেকে এটুকুই বলতে পারি।
প্রশ্ন : অনুবাদ কেন পড়ি আমরা? অন্য ভাষা, এবং অন্য দেশের সাহিত্যকে নিজের ভাষায় পড়তে চাই, এটাই কি একমাত্র কারণ? (প্রশ্ন করেছেন সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত)
উত্তর : হ্যাঁ, অন্য ভাষার কথাটা আসছে এই জন্য যে সময়ের দিক থেকে এবং ভৌগলিক পরিসরে যে মানুষেরা সরাসরি আমাদের কাছের/পরিচিত নন, তাদের কথা পড়তে গিয়েও আমরা দেখলাম নিবিষ্ট হয়ে উপভোগ করছি। সময় ও ভৌগলিক পরিসর নিরপেক্ষভাবেই মানুষ জিনিসটার মধ্যে অনেক মিল আছে একেবারে ভিত্তিতেই। বড়ো সাহিত্যিকদের মনন, পর্যবেক্ষণ ও কল্পনার প্রসাদে আমরা দেখলাম, একেবারে দূরের বা একেবারে অন্য সময়ের মানুষদের মধ্যে যেন আমরা নিজেদের অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছি। মনোবিশ্লেষক এরিক ফ্রামের বইতে আমরা পড়েছি যে মানুষের সবচেয়ে বড়ো আতঙ্ক হচ্ছে একলা হয়ে পড়ার। কাহিনি জিনিসটা মানুষকে একলা অবস্থাতেও সেই মানসিক বিপর্যয়ের থেকে রক্ষা করে, মনে মনে একটা সাহচর্য থাকে তো নানা চরিত্রের সঙ্গে। নানা দেশের উচ্চমানের সাহিত্য পড়ে আমরা আশ্বস্ত হতে থাকলাম, এই বিশাল পৃথিবীতে কী কী আমাদের আশ্রয় যোগায়, আর কী কী আমাদের বিভ্রান্ত করে। নিজেদের চিনলাম বলেই বলা যায়। তাই এককথায়, নিজেকে আরো সম্পূর্ণভাবে চিনে উঠতে আমরা অনুবাদে হলেও অন্য সময়ের, অন্য দেশের সাহিত্য পড়ি।
প্রশ্ন : একজন অনুবাদক নিজে যদি সাহিত্যিক না হন, তবে অনুবাদ ভালো হয় না। কথাটা কি ঠিক? (প্রশ্ন করেছেন সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত)
উত্তর : এখানে একটা অংকের হিসেব আছে। যতজন বড়ো সাহিত্যিক একটা নির্দিষ্ট ভাষায় আমাদের দরকার, তারচেয়ে বেশি সংখ্যক ভালো অনুবাদক দরকার। কারণ তাহলেই আমরা অন্য ভাষার সাহিত্যিকেরও নাগাল পেয়ে যাব। তাহলে আর অনুবাদক হলেই ভালো সাহিত্য প্রতিভা হতে হবে এই শর্ত রক্ষা করা যায় না। অনুবাদকের খুব ভালো সাহিত্যবোধ, বিপুল পাঠ, আর নানা ভাষাশৈলিতে দখল দরকার। ভাষার ওপর তার দখল সাহিত্যিকের সমান হতে হবে। কিন্তু তারপরেও সাহিত্য আরো অনেক বড়ো ব্যাপার, অনেক কষ্টের, যন্ত্রণার ভার বহন করার যাতনা। সাহিত্যিক হয়ে ওঠা মুখের কথা নয়। কিন্তু নানারকম গদ্য লেখায় চমৎকার দক্ষতা, উপযুক্ত রুচি ও সাহিত্যবোধের অধিকারি যোগ্য অনুবাদক পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণে তৈরি করা সম্ভব। সাহিত্যিক তৈরি করা সম্ভব নয়। একজন পামুক, একজন মুরাকামি, একজন নীল গেম্যান, অ্যালিস মানরো, কিংবা কোয়েৎজি কি আর প্রশিক্ষণে তৈরি হয়? অনুবাদককে সার্থক সাহিত্যিক না হলেও চলবে।
প্রশ্ন : সব বরেণ্য সাহিত্যিক এবং কবিরা জীবনে কিছু না কিছু অনুবাদের কাজ করে গিয়েছেন। কেন এমন হয়? একজন সাহিত্যিকের অনুবাদের কাজ করার প্রেরণা কী? (প্রশ্ন করেছেন সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত)
উত্তর : সাহিত্যিককে অনুবাদ করতে হবে, অন্ততপক্ষে শুরুর দিকটায় তো বটেই। অনুবাদক হিসেবে একজন বড়ো প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের সঙ্গে মানসিক ঘনিষ্ঠতা, তার দর্শনগত সাহচর্য, একজন উদীয়মান সাহিত্যিককে বুঝতে সাহায্য করে স্তরটাকে কোথায় নির্দিষ্ট করতে হবে। কী জিনিস সে নিজে অনুভব করেছে, আর সেটা কেমন পরিণতি পেয়েছে বড়ো স্রষ্টার হাতে গিয়ে। যা নেহাত প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনা, তাকে পরিষ্কার করে উপলব্ধিতে স্থাপন করে, একটু একটু করে কীভাবে একটি ব্যক্তিগত সৌধ গড়ে তুলতে হয়, অনুবাদ করতে গিয়ে তার পরিচয় পাওয়া যায়। হারুকি মুরাকামি আবার অন্য একটা কারণে দীর্ঘদীন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন অনুবাদের পিছনে, অথচ তখন তিনি পরিণত, পথ খুঁজে পেয়ে গেছেন। কারণ, ওঁর মনে হয়েছিল, এই স্কট ফিটজেরাল্ড, রেমন্ড কার্বার, রেমন্ড শ্যাণ্ডলার, ট্রুম্যান কাপোটদের লেখার সঙ্গে জাপানি পাঠকের পরিচয় ঘটিয়ে দিলে, তবেই জাপানি পাঠকেরা একদিন ওঁর লেখার কদর করতে শিখবে। পাঠক কিছু অনুধাবন না করলে আর লেখক কী? তাই অনুবাদ হচ্ছে লেখকের নিজের স্বার্থে। পাঠককে উপযুক্ত পাঠক করে তুলতে।
প্রশ্ন : মূল ভাষা না জানলে কি অনুবাদ করার প্রচেষ্টা পারতপক্ষে এড়িয়ে চলা উচিত? তেমনটা হলে কেন সেরকম বলে আপনি মনে করেন? (প্রশ্ন করেছেন সৌরভ অধিকারী)
উত্তর : আমাদের ক্ষেত্রে, অর্থাৎ বাংলায় অনুবাদের ক্ষেত্রে মূল ভাষা জানা না থাকলে, বইটার ইংরিজি অনুবাদ থেকে ফের বাংলায় অনুবাদ করার চল আছে। প্রাচ্যের একটা ভাষার সাহিত্যের অনুবাদক হিসেবে আমার যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, এবং ট্র্যান্সলেশান স্টাডিজের বিখ্যাত ফরাসি পণ্ডিত পল রিকার (Paul Ricoeur) যেকথা স্পষ্টভাবে বলেছেন, উভয়ের ভিত্তিতে এটুকু বলে রাখি যে পশ্চিমের সমাজে বিদ্যমান যে সভ্যতাগত শ্রেষ্ঠত্বের অভিমান বা শভিনিজম, ইংরিজির অনুবাদক প্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার শিকার হয়ে নিজেই মূল টেক্সটকে ছাঁটকাট বা কখনো পরিবর্তন করতে থাকেন। যা কিছু খানিকটা ভিন্নরকম বা ‘ভিনদেশি’, তাকে কোনোরকম মধ্যস্থতা করতে না দেওয়ার প্রবণতা জিনিসটা প্রথম থেকেই নানা ধরনের ভাষাগত গোষ্ঠিকেন্দ্রিকতাকে গোপনে পুষ্টি জুগিয়েছে, এবং যেটা আরো গুরুতর ব্যাপার, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদকেও মদত জুগিয়েছে। ইংরিজি বা ফরাসি ইত্যাদি পশ্চিমী গ্রহীতা ভাষাকে (যেখানে সংস্কৃতিরও একটা ভূমিকা আছে) কোনোরকম ‘ভিনদেশি’-র মুখোমুখি করানোর পরীক্ষায় বসানোতে এই অনুবাদকদের, দেখা যায় প্রবল অনীহা এবং প্রায় প্রতিরোধই। পল রিকার বলছেন যে এঁরা কিছুতেই এটা গ্রহণ করতে পারেন না যে ‘ভিনদেশি’ মানে কিন্তু আজব নয়। উনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে অনুবাদকের দায়িত্ব হচ্ছে পাঠককে এই ‘ভিনদেশি’-র সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসতে এবং সে ব্যাপারে অস্বস্তি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করা। আমার নিজেরও অভিজ্ঞতা হলো যে অধিকাংশ ইংরিজি অনুবাদক সে কাজে মোটেই উৎসাহী নয়। একটা উপন্যাস বা গল্প তো কেবল স্টোরিলাইনটা নয়, কতরকম পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবই তো মূল লেখক তার মধ্যে দিয়ে রাখছেন, এবং সেখানেই বড়ো লেখকদের, এবং সার্থক সাহিত্যকীর্তির অনন্যতা, বৈশিষ্ট। স্টোরিলাইনের অতিরিক্ত যা কিছু, তা অনেকাংশে হারিয়ে যাওয়ার পর যা পড়ে থাকে, তা মূলের লেখকের পক্ষে মর্মান্তিক। সেটার আবার দ্বিতীয়বার বাংলায় অনুবাদ হলে, পাঠক সত্যিই ভয়ানকভাবে প্রতারিত হন। যদি কোনো অলৌকিক ম্যাজিকের বলে পাঠক মূল ভাষাটা তক্ষুণি আয়ত্ত্ব করে ফেলে মূল বইটা পড়ে ফেলেন, তিনি হতোভম্ব হয়ে যাবেন। কী ছিল মূলে, আর কী হয়েছে দু’বার অনুবাদ হয়ে! মূল লেখকের দুর্ভাগ্য, এই বিকৃত হয়ে যাওয়া লেখাটি পড়ে অনেকেই গেরামভারি ভাবে লেখকের ভালোমন্দ বিচার করতে বসেন, একেবারে নস্যাৎ করে দেন কখনো বা। ফেসবুকে প্রায়শই চোখে পড়ে। হাসিও পায়, বিষণ্নও লাগে।
প্রশ্ন : অনুবাদ করে অনুবাদকের প্রাপ্তি কী? বা কী প্রাপ্তি হলে তা যথার্থ প্রাপ্তি বলে মনে করা যেতে পারে? (প্রশ্ন করেছেন সৌরভ অধিকারী)
উত্তর : প্রাপ্তি বহুরকম। তবে তার মধ্যে যথেষ্ট অর্থাগমের দিকটি অনুপস্থিত থাকলে বাস্তবে দেখা যায়, ভালো অনুবাদকের অভাব তৈরি হয়। সেটা ছাড়াও যেদিকগুলো গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো হলো—
ক) যদি ধরে নিই যে উচ্চমানের কোনো সাহিত্যকৃতি অনুবাদ করছেন, তাহলে যথেষ্ট সময় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটা টেক্সটের সঙ্গে মনেপ্রাণে জড়িয়ে থাকার ফলে অনুবাদক একজন প্রতিভাশালী মেধাবী মানুষের খুব ঘনিষ্ঠ সাহচর্য পাচ্ছেন। এতে তার নিজের মনোজগতে এবং সাহিত্য নিয়ে চিন্তার ধাঁচায় নানারকম সংযুক্তি ঘটে। ঝুম্পা লাহিড়ি ওঁর সাম্প্রতিকতম বইটাতে উঠতি লেখকদের ঐকান্তিকভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন, শুরুতে নিজের লেখার পাশাপাশি যথেষ্ট অনুবাদ করা চালিয়ে যেতে। এতে তাদের নিজেদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথটা সুগম হয়। দৃষ্টিভঙ্গি উন্মুক্ত হয়, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়ে। হারুকি মুরাকামি, যথেষ্ট খ্যাতি পাওয়ার পরেও বহুকাল নিষ্ঠা নিয়ে বিদেশি লেখকদের লেখা অনুবাদ করে গেছেন পাশাপাশি। বছরখানিক আগে সেসবের একটা পূর্ণাঙ্গ সংকলন তোকিওতে বড়ো অনুষ্ঠান করে প্রকাশ করা হয়েছে।
খ) আত্মবিশ্বাস, ধৈর্য, মনোবল অনেকটা বেড়ে যায়। কাজটা সম্পন্ন হলে, এবং কিঞ্চিত প্রশংসিত হলে দিব্যি আত্মপ্রসাদের অনুভূতি হয়। তৃতীয়-বিশ্বের একজন গড়পরতা মানুষের কাছে সেটুকুই বা কম কি?
গ) আমার নিজের ক্ষেত্রে, মুরাকামি ও মিশিমার লেখা অনুবাদ করতে গিয়ে আরেকটু খুঁটিয়ে বৌদ্ধদর্শনের সঙ্গে পরিচিতি হয়েছে, এ জগতের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা সম্বন্ধে ধারণা একটা রূপ পেয়েছে। প্রশান্তি অর্জন করতে চাইলে, এর উপযোগিতা আছে বৈকি।
প্রশ্ন : ছোটোদের জন্য করা abridged translation এর বা একই ভাষায় করা abridged version এর ভূমিকা সাহিত্যে বা ছোটোদের জন্য কীরকম গুরুত্বপূর্ণ? (প্রশ্ন করেছেন সৌরভ অধিকারী)
উত্তর : বড়োদের জন্য সংক্ষিপ্ত ভার্সান জিনিসটার অর্থ কী, আমি আজও বুঝিনি। যদিও সে জিনিসও প্রকাশ করা হয়। পাঠক হিসেবে, হয় তুমি সাহিত্যপাঠ উপভোগ কর, নতুবা কর না। যদি কর, পুরোটা পড়লে তবেই প্রাপ্য আনন্দটুকু পাবে। ছোটো করে কাহিনিটুকু শুধু জেনে রেখে লাভ কী? ও জিনিস কফিহাউজের টেবিলে কিংবা ফেসবুকে কাজে আসে, সাহিত্যপ্রেমীর সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু শিশুদের জন্য সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করতে হয়। সংক্ষিপ্ত না করলে কী ক্ষতি, সে আলোচনা অন্য দিকে গড়িয়ে যাবে। তবে শিশুরা সংক্ষিপ্ত অনুবাদ পাঠ করলেও অনেক লাভ। আমরা ছোটোবেলায় নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, সুধীন্দ্রনাথ রাহা, এঁদের অনুবাদে যাবতীয় পশ্চিমী ক্লাসিকস, দেব সাহিত্য কুটীর প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত অনুবাদে পড়েছি, আজও আমার প্রজন্মের (জন্মে থেকেই যারা টিভি পায়নি) অন্যান্য বাঙালি মধ্যবিত্ত মানুষের সঙ্গে আমার রুচির যে মিলটুকু পাই, এমনকি বোধহয় সামাজিক/পারিবারিক ভূমিকার ধারণায় যেটুকু মিল পাই, তার উৎসে আছে ঐসব হরেক কাহিনি গোগ্রাসে গেলার বহুবছরের কমন অভ্যাস। আমার আশেপাশের বয়েসের অজস্র লোক এখনো যে কখনো সখনো হলেও এক আধটা গল্পের বই পড়তে আগ্রহী হয়, বা সাহিত্যের আলোচনা হলে অস্বস্তি বোধ করে না, সে কিন্তু ওই সংক্ষিপ্ত অনুবাদ পড়ার অভ্যাসের প্রসাদে।
একজন খুব প্রখ্যাত সাহিত্যিক কলকাতায় এসে এক ভাষণে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, মানুষ হচ্ছে একমাত্র প্রাণী যে গল্প বলতে এবং শুনতে ভালোবাসে। এটার পিছনে অস্তিত্বের মনস্তাত্ত্বিক একটা তাগিদ আছে। এবং এটা তার বেঁচে থাকার জন্য দরকার। নিজেদের জীবনধারা যে সময় নিজেদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন গল্পের ভূমিকাটা অটুট রাখতে, শিশুদের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ পড়ার ব্যবস্থাটা খারাপ নয়।
প্রশ্ন : ইংরিজি বই, অন্য ভাষা থেকে অনুদিত ইংরিজি বই নয়, আমাদের বাঙালীদের বা ভারতীয়দের, প্রয়োজনে একটু সপ্রচেষ্ট হয়ে কী ইংরিজিতে পড়াই শ্রেয়? এতে করে মূলভাষায় পড়ার আনন্দ তো পাওয়া যাবেই, তাছাড়া হয়তো ইংরিজি অনুবাদের পেছনে সমাজ হিসেবে আমাদের যে সময় ও প্রচেষ্টা ব্যয় হওয়ার কথা তা বরঞ্চ অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের অনুবাদে ব্যয় করা যায়। আপনার কী মত এ বিষয়ে? (প্রশ্ন করেছেন সৌরভ অধিকারী)
উত্তর : উঁহু, এ ব্যাপারে পরিস্থিতি বেশ ঘোরালো, আমাদের শিক্ষার মানের কারণে। আমি ভারতের কথা বলছি। বাংলাদেশের পরিস্থিতি অতটা খুঁটিয়ে জানি না। এখানে আমরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সময়টায় নানা মাত্রায় ইংরিজি ভাষাটার সংস্পর্শে থাকি। এছাড়াও খেলাধুলার ধারাবিবরণী, টেলিভিশনের নানা প্রোগ্রাম, সিনেমা ইত্যাদি সূত্রে ইংরিজির থেকে বিচ্ছিন্ন হই না। কিন্তু শিক্ষার মান সর্বত্র সমান নয়, খুব বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাপদ্ধতি সর্বত্র অনুসরণ করা হয় না, শিক্ষকদের যোগ্যতাতেও বৈষম্য আছে। তাই একটা বড়ো অংশ ইংরিজিতে এতটা সড়গড় হয় না যে সেই ভাষার সাহিত্য সরাসরি ইংরিজিতেই খুব অনায়াসে উপভোগ করতে পারে। তারা বরং বাংলায় অনুবাদ পড়তেই আগ্রহ দেখাবে। অথচ পড়াটা খুব জরুরি। যেমন আমি মনে করি, অমিতাভ ঘোষের পরিবেশ বিষয়ক বই/উপন্যাসগুলো প্রত্যেক নাগরিকের পড়ে ফেলা উচিত। এরকম আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। কেবল একটা অংশ ইংরিজিতে ততটা স্বচ্ছন্দ হয়, যাতে সরাসরি ইংরিজি মূল বইটাই পড়ে ফেলতে পারে। তাদেরও আবার একটা খুব ছোটো অংশ অনুবাদ করতে উৎসাহী। এবার আমি যদি বলি, তাঁরা বরং সেই অনুবাদে সময় নষ্ট না করে ফরাসি, জার্মান, চীনা, কোরিয়ান শিখে নিয়ে সেসব ভাষায় অনুবাদ করুক, সেই প্রস্তাব খুব বাস্তবসম্মত হবে না। প্রথমত, তত ভালো শেখানোর ব্যবস্থা পাঁচটা কি ছ’টা বড়ো শহরের বাইরে একেবারেই নেই। থাকলেও, ফরাসি বা স্প্যানিশ কি জার্মানের কথা বলতে পারি না, চীনা, জাপানি, কোরিয়ান ভাষা সেই পর্যায়ে শিখে উঠতে বছর দশেকের পরিশ্রম লাগবে। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, আমাদের মতো অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে, শেখা হলে, তারা তখন সাহিত্য অনুবাদের মতো ব্যাপারে না গিয়ে টেকনিক্যাল অনুবাদ, প্রশাসনিক বা বাণিজ্যিক নথিপত্রের অনুবাদ করতে বেশি আগ্রহী হবে, কেননা উপার্জনের সুযোগ ও পরিমাণ অনেক বেশি সেক্ষেত্রে। নতুবা অন্য দেশে চলে যাবে। গরীব দেশে উচ্চ সংস্কৃতি অর্জন করার অনেক বাধা পদে পদে। তাই, ইংরিজিতে লেখা সাহিত্য বাংলায় অনুবাদে তত ক্ষতি কিছু নেই, কেননা আমরা তো কোনো শভিনিজমে ভুগি না অনুবাদক হিসেবে, বিকৃতির আশঙ্কা কম।
প্রশ্ন : একজন দক্ষ অনুবাদক যখন সাহিত্য অনুবাদ করেন, তখন অনুবাদ করার যে ‘exercise’ এর মধ্যে দিয়ে ওঁকে যেতে হয়, তাতে করে কি সাধারন পাঠক একই সাহিত্য পাঠ করে যে আস্বাদ পান, তার থেকে অনেক স্বতন্ত্র আস্বাদ অনুবাদক করে থাকেন? এই অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু শোনার অপেক্ষায় থাকলাম। (প্রশ্ন করেছেন সুশান্ত মুখার্জি)
উত্তর : আমি নিজে খুব স্লো-রীডার। একটা তিনশো পাতার বই পড়তে আমার দু’সপ্তাহ মতো সময় লেগে যায়, কখনো বা বেশিই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেককে চিনি, যাঁরা দু’রাতে পড়ে ফেলবেন। এতটা সময় নিয়ে পড়ার পরেও দেখেছি, আবার যদি কখনো সেই একই বই কয়েকবছর বাদে আবারও খানিকটা পড়তে বসি, আবারও নতুন নতুন দিক ফুটে ওঠে লেখাটার এবং লেখকের বার্তাটার। নানা সংলাপ ও ঘটনাবলির মধ্যে তাৎপর্যগত সংহতি আরো একটু জোরালো হয়। মাথার ভেতরে নিজের অজান্তেই একটার সঙ্গে আরেকটার একটা যোগসূত্র তৈরি হয়। পাঠটা আরেকটু সম্পূর্ণতর হয়। এবার ভাবুন, সেখানে দু’সপ্তাহের জায়গায় যদি দেড় কি দু’বছর ধরে ওটা মাথার ভেতরে নিরবচ্ছিন্নভাবে আশ্রয় পায়, যেটা অনুবাদ করতে গেলে হয়, তখন আরো কতটা অভিভূত হওয়ার সুযোগ থাকে লেখকের কৃতিত্বে! প্রকৃতপক্ষে, আমার নিজের ক্ষেত্রে, লেখকের ও লেখাটার প্রতি এই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকা মুগ্ধতাই মূল মোটিভেশন হিসেবে কাজ করে। শেষ বিচারেও, পাঠকের প্রশংসা, সামান্য কিছু আর্থিক প্রাপ্তি, একটা কাজ শেষ করে ওঠার আত্মতৃপ্তি, এগুলোর চেয়েও অতবড়ো যে মনীষা হয়, প্রতিভা হয়, অতখানি গভীরতা হয়, মানুষের প্রতি অতখানি ভালোবাসা যে একজন বড়ো লেখক মনের মধ্যে পোষন করেন, সেই পরিচয়টাই আপ্লুত করে রাখে। নিজের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ি, বইটা অনুবাদ করতে নিয়েছিলাম বলে। এককথায়, অনুবাদকের উচ্ছ্বাস, সাধারণ পাঠকের পক্ষে অর্জন করে ওঠার সম্ভাবনা কম।
প্রশ্ন : প্রতিটি ভাষাতেই কিছু শব্দের অর্থ ও প্রয়োগ, ব্যাকরণগত ব্যবহার, বা অভিব্যক্তি থাকে। যাকে উপযুক্ত প্রতিশব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় না কিংবা এককথায় ভাবার্থ ফুটিয়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়ে, যেটাকে ভাষার untranslatability বা অনুবাদ-অসাধ্যতা বলা যেতে পারে। জাপানি ভাষার ক্ষেত্রে এই সমস্যার সম্মুখীন কতটা, কীভাবে হয়েছেন, তা নিয়ে যদি একটু বলেন। (প্রশ্ন করেছেন নির্মাল্য বিশ্বাস)
উত্তর : একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য এখানে দিয়ে রাখি, জাপানির সঙ্গে এধরনের ব্যাপারে বাংলার নৈকট্য প্রায়ই আমাকে চমকে দেয়। ইংরিজিতে লেকচার দিয়ে জাপানি শেখানো যতটাই ঝঞ্ঝাটপূর্ণ, বাংলায় শেখানো ততটাই অনায়াসসাধ্য। নানা বাংলা শব্দের একেবারে ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হয়তো আমাদের জানা নেই পরিষ্কার করে, কিন্তু ব্যবহার জানি; বহু এমন জাপানি শব্দ পেয়েছি, যা একাধিক চৈনিক আইডিওগ্রামের সমাহারে গঠিত এবং ঐসব বাংলা শব্দ এতটাই নিখুঁতভাবে সেগুলোর একেকটার প্রতিশব্দ যে ওই আইডিওগ্রাম থেকে বাংলা শব্দটার ব্যুৎপত্তিগত অর্থটা ধরা যায়। মাত্র দু’একদিন আগেই এভাবে আমি স্বতঃপ্রণোদিত কথাটা জাপানিতে পেলাম। ভারি মজা লাগে। তবে একথা সত্যি যে আসলে তো ট্র্যান্সলেশান বলে আলাদা কোনো প্রক্রিয়া হয় না, জানতে হয় অন্য একটি ভাষায় কথাটা কীভাবে বলার চল আছে। যদি আদৌ চলই না থাকে, তবে ফুটনোট তো আছেই। কিন্তু আবার ‘ফুটনোট কন্টকিত’ বলেও একটা কথা আছে। রসের হানি ঘটে বেশি ফুটনোটের ভিড় থাকলে। ওইজন্য, শুধু ভাষাটা শিখলেই হয় না, ঐ সমাজের প্রত্যক্ষ এবং ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতাও অনুবাদকের থাকা খুব জরুরি। ঠিক কেমন মানসিক প্রতিক্রিয়া থেকে একজন জাপানি একটা কথা বলছে, সেটা সম্বন্ধে নিশ্চিত থাকলে অনুবাদকের পক্ষে তার নিজস্ব স্বাধীনতা ও বিচার প্রয়োগ করাই বিধেয় বলে আমি মনে করি।
সমস্যা হয় ইন্টার-টেক্সচুয়ালিটির ক্ষেত্রে। একে তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইন্টারটেক্সচুয়ালিটির ব্যবহারে বেশ খানিকটা শ্লেষ মিশে থাকে, মূলটিকে অনুবাদক শ্লেষাত্মক ব্যবহারের গ্লানির মধ্যে ফেলবেন কি না, সেটাও একটা বিবেচ্য বিষয় হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ইন্টারটেক্সচুয়ালিটির ক্ষেত্রে মূলে টেক্সটের ওই অংশটুকু সেইসব পাঠক সমাজের সাধারণ আবেগ ও সংস্কারের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত, সেটা হুবহু অনুদিত টেক্সটে আনতে খুঁজে খুঁজে একটা সমান্তরাল কিছু বের করা চারটিখানি দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। মণিভূষণ ভট্টাচার্যের ‘গান্ধীনগরে এক রাত’ কবিতায়, এক তরুণকে পুলিশ গুলি করে মারলো, আর কবিতায় শেষ লাইনটা লেখা হলো, ‘গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা’। এর নিশ্চিন্ত হওয়ার মতো অনুবাদ করা তো মুশকিলই। তখন অগতির গতি ফুটনোটই ভরসা।
আর বাগধারা ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেখেছি, জাপানিদের বাগধারাগুলো বুঝতে, একটু কমনসেন্স ব্যবহার করলে আক্ষরিক অনুবাদ করলেও খুব অসুবিধা হয় না বাংলার পাঠকদের। অন্যথায় যুতসই বাংলা বাগধারা যদি কিছু অনুবাদকের তখন মনে পড়ে, সেটা লেখাই যায়। নতুবা ফুটনোট।
প্রশ্ন : আপনি জাপানি থেকে বাংলাতে অনুবাদ করেছেন। ভবিষ্যতে কি বাংলা থেকে জাপানিতে অনুবাদ করতে আগ্রহী হবেন? এই মুহূর্তে বাছতে বললে কোন দু’একটি বাংলা সাহিত্যকর্মকে আপনি সবার আগে জাপানি পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে চাইবেন ও কেন? (প্রশ্ন করেছেন নির্মাল্য বিশ্বাস)
উত্তর : বুদ্ধদেব বসু পরিষ্কার বলে গেছেন, ভালো অনুবাদ হতে গেলে টার্গেট ল্যাংগুয়েজ বা গ্রহীতা ভাষা যেন অনুবাদকের মাতৃভাষা হয়। কথাটা আমি খুব মানি। সেকারণেই আমি কখনো বাংলা থেকে জাপানিতে অনুবাদ করতে রাজিই হব না।
তবে বাংলা কী কী লেখা আমার কাছে অগ্রাধিকার পাবে জাপানিতে বা অন্য ভাষায় অনুবাদ যদি কেউ করে, সেকথা উঠলে বলব, সেরকম অজস্র লেখা আছে, তবে সর্বপ্রথম যে কবি/লেখকেরা আসবেন, তাঁরা হলেন, বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দ দাশ, সুকুমার রায়ের লেখা, আর তারসঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের বেশ কিছু ছোটোগল্প। এছাড়াও প্রেমেন্দ্র মিত্রের নানারকম ছোটোগল্প, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের আগেরদিকের লেখা গল্প ও উপন্যাস। এগুলো আমার হৃদয়ের খুব কাছের।
প্রশ্ন : বিদেশী কবিতার বাংলা তর্জমা নিয়ে আপনার কী মতামত ? (প্রশ্ন করেছেন অনির্বাণ বব মজুমদার)
উত্তর : আমি কবিতার তেমন নিবিষ্ট পাঠক নই, কবিতা অনুবাদেরও চেষ্টা করিনি কখনো, তাই মতামত দিতে যাওয়া ঠিক হবে না।
প্রশ্ন : ‘আমরা ছোটোবেলায় নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, সুধীন্দ্রনাথ রাহা, এঁদের অনুবাদে যাবতীয় পশ্চিমী ক্লাসিকস, দেব সাহিত্য কুটীর প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত অনুবাদে পড়েছি, আজও আমার প্রজন্মের (জন্মে থেকেই যারা টিভি পায়নি) অন্যান্য বাঙালি মধ্যবিত্ত মানুষের সঙ্গে আমার রুচির যে মিলটুকু পাই, এমনকি বোধহয় সামাজিক/পারিবারিক ভূমিকার ধারণায় যেটুকু মিল পাই, তার উৎসে আছে ঐসব হরেক কাহিনি গোগ্রাসে গেলার বহুবছরের কমন অভ্যাস।’ দেব সাহিত্য কুটীরের অনুবাদ-সিরিজে ‘কাউন্ট অফ মণ্টেক্রিস্টো’ পড়েছিলাম ছেলেবেলায়, বীররস, আত্মত্যাগ, উদারতা, প্রেম, এতসব ব্যাপারগুলো সরাসরি বুঝতে কিছু না পারলেও, হয়তো শুধু গল্পের কারণেই বইটি হয়ে উঠেছিল খুব প্রিয় একটি বই। অনেক পরে, বৃহৎ কলেবরের ইংরেজি অনুবাদ পড়তে গিয়ে এক জায়গায় আটকে পড়তে হয়েছিল। যখন সেই তরুণ নায়ক (তখনও তিনি ভাবতে পারেননি, কাউন্ট হবেন একদিন) বাসতিঈ-কারাগারে এক দার্শনিকের কাছে ইতিহাস আর দর্শনের পাঠ নিচ্ছেন, সেই প্রাজ্ঞ দার্শনিককে প্রথমেই তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, ঈশ্বরে তাঁর বিশ্বাস নেই। কারণ তিনি কেবলই প্রতারিত হয়ে এসেছেন। সেই দার্শনিক বলেছিলেন, ‘তুমি হয়তো বিশ্বাস করো না, কিন্তু ঈশ্বর তোমাকে বিশ্বাস করেন। তিনি জানেন, তুমি আছ।’ আমার মনে এখনও একটা কথা আসে, হেমেন্দ্রকুমার যদি ওপরের কথাগুলো (সংলাপ)-কে একটু সরল করে হলেও, সেই শিশু-পাঠ্য অনুবাদে তুলে ধরতেন, তবে কি খুব কঠিন হতো ব্যাপারটা বাঙালি-শিশুদের জন্য? বলতে চাইছি, শিশুপাঠ্য অনুবাদও কি শিশুর আপন দেশজ-সংস্কৃতি এবং সমাজ-চিন্তার ওপর খুব বেশি নির্ভর করে? (প্রশ্ন করেছেন শুভদীপ বড়ুয়া)
উত্তর : এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে যা দেখা গেল, তাতে তো সেটাই মনে হচ্ছে। যে কথাগুলো বাদ দিলেন হেমেন্দ্রকুমার, সেগুলোর অপরাধ কী, বোঝা দুস্কর। সামাজিক একেকটা পর্যায়ে এরকম হয়তো কোনো ট্যাবু লেখক/অনুবাদকদের ক্ষেত্রেও তৈরি হয়, খতিয়ে দেখলে যার যাথার্থ বোঝা মুশকিল।
এখানে সম্ভবত লেখক/অনুবাদক ইত্যাদিদের মধ্যে সমাজচিন্তার চরিত্র (পড়তে পারেন, ট্যাবু) সাধারণ লোকের চেয়ে দ্রুত পাল্টানোর ঝোঁক তুলনায় বেশি।
প্রশ্ন : বিদেশি সাহিত্যের মূল আস্বাদন করতে হলে হয় মূল ভাষাটি জানতে হবে অথবা দক্ষ অনুবাদকের অনুবাদ পড়তে হবে। যেহেতু প্রথমটি প্রায় অসম্ভব সুতরাং দ্বিতীয় পন্থাটিই শ্রেয়। সেক্ষেত্রে ইংরেজি বা ফরাসির দাদাগিরি এড়িয়ে মাতৃভাষায় এই বইগুলোর অনুবাদ পড়াটাই ভাল নয়কি? বিভিন্ন ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদক হিসেবে এটাই আমার প্রশ্ন। (প্রশ্ন করেছেন রিতা রায়)
উত্তর : সেটাই আমি ওপরে একটা প্রশ্নের উত্তরে লিখেছি। সরাসরি বাংলা অনুবাদে পড়ার কথা বলেছি। ইংরিজির হাত ঘুরে যে অনুবাদ, সেটা কেন বাঞ্ছিত মানে পৌঁছয় না, ব্যাখ্যা করেছি।
প্রশ্ন : অনেক সময় ফরেন ল্যাংগুয়েজ এর কোনো ফ্রেজ বা ইডিয়ম অনুবাদ করার দরকার পড়ে। সেটা আবার বাংলায় এক লাইনে বোঝানো সম্ভব হয়ে ওঠে না ব্যাকগ্রাউন্ডটা না এক্সপ্লেন করে। সেরকম সিচুয়েশনটা আপনি কীভাবে ডিল করেন? (প্রশ্ন করেছেন সুপ্রতীক শীল রয়, জাপান কনসুলেট)
উত্তর : একটু আগেই নির্মাল্য বিশ্বাসের উত্তরে ঠিক এগুলোই আলোচনা করলাম।
প্রশ্ন : যেকোনো ভাষা শেখার সময় গদ্য এবং পদ্যের অবদান কি আলাদা হয়? এবং, আপনার মতে, কোনটি একটি ভাষাকে বেশি সুন্দর ভাবে প্রদর্শন করে? (প্রশ্ন করেছেন কিন্নরী সাহা)
উত্তর : পদ্য যেহেতু কখনো লিখিনি, খুব নিয়মিত পাঠকও নই কবিতার, এর উত্তর দেওয়া মুশকিল আমার পক্ষে। তবে একটা জিনিস কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ— চমৎকার গদ্যকার অথচ হাত দিয়ে একলাইনও সার্থক কবিতা বেরোয়নি কখনো, এমন কিন্তু বহু উদাহরণ আছে। অথচ সত্যি বড়ো কবি, কিন্তু গদ্যটা একেহারেই জোরালো নয়, এমন উদাহরণ কিন্তু একটিও নেই। সে যাই হোক, যে কথাটা মনে রাখা জরুরি, সেটা হলো, ভাষা সুন্দর হয় প্রকৃতপক্ষে চিন্তায় নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা ও অভিনবত্ব থাকলে। কবিতা বা গদ্য, এদের স্বাদ আলাদা। দুটোর সৌন্দর্যের মধ্যে তুলনা যে করা যায় না, এমন নয়, কিন্তু সোজাসাপটা সিদ্ধান্তে পৌঁছনো কঠিন।
প্রশ্ন : যে দেশের বই অনুবাদক অনুবাদ করছেন, সেই দেশের সংস্কৃতি অথবা সেই দেশ সম্পর্কে অনুবাদকের একটা ভালো ধারণা থাকা কি খুব জরুরি নয়? (প্রশ্ন করেছেন দীপ মণ্ডল)
উত্তর : খুবই জরুরি। একান্তই জরুরি। লেখক তাঁর বার্তাটাকে নানা পরিস্থিতির অবতারণা ও বর্ণনা করে ধীরে ধীরে একটা রূপ দিচ্ছেন। কিন্তু রূপটা ধারণ করছে কোথায়? পাঠকের মনে। অথচ বিদেশি ভাষার পাঠক সেইসব পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত নয়, সরাসরি একটা পরিস্থিতির বর্ণনা তার মনে তৎক্ষণাৎ কোনো লজিকের আশ্রয় পায় না। লেখক তাঁর নিজের সামাজিক বৈশিষ্ট্যকে মাথায় রেখে একটা লজিকের কাঠামো গড়ে তুলেছেন, অনুবাদককে সেটা টের পেতে হবে, এবং তবেই সে নিজের ভাষার পাঠকের কাছে একটা সর্বজনবোধ্য ছবির ক্রমোন্মোচন ঘটিয়ে তুলতে পারবে। মূল সমাজে কেমনটি ঘটার কথা, সেটা তাকে অনুমান করায় পারদর্শি হতে হবে।
প্রশ্ন : এর আগে দেখেছি, বিভিন্ন সময় হারুকি মুরাকামি তার অনুবাদকদের নিয়ে কর্মশালা করেছেন। সরাসরি লেখকের এই কর্মশালায় আসলে কি বিষয় নিয়ে কথা বলা হয়? (প্রশ্ন করেছেন এহসান ইসলাম)
উত্তর : সেটা জানি না।
প্রশ্ন : এখনও আমরা আফসোস করি, নিশ্চিত তিন-চারটি নোবেল আমাদের হাতছাড়া হয়েছে যথার্থ অনুবাদ এবং যথাস্থানে যথাযথভাবে তুলে না ধরতে পারার জন্য। বিভূতিভূষণ, তারাশংকর, মানিক, সতীনাথ। এ নিয়ে আপনার মতামত কী? অনেকগুলো দশক পেরিয়ে এসেও কি আমরা ওই খামতিগুলো দূর করায় যথেষ্ট উদ্যোগী হয়েছি? আর সাম্প্রতিক কালে বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করার সম্ভাবনা সম্পর্কে আপনার মতামত আশা করছি। (প্রশ্ন করেছেন অসিত কর্মকার)
উত্তর : নোবেল পুরস্কার পাওয়া, না পাওয়ার সঙ্গে সাহিত্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির এখন আর তেমন ঘনিষ্ঠ যোগ কিছু নেই। এমনিতেও যে সাহিত্যিকরা আধুনিক কালের সাহিত্যের মূল স্তম্ভ বলে বিবেচিত হন সিরিয়াস পাঠক মহলে, তাঁরা প্রায় কেউই নোবেল পুরস্কার পাননি। কারুর তেমন খেদও নেই সেই নিয়ে। সাহিত্যের জগতটা এইসব পুরস্কারের সাহায্য ছাড়াই পরস্পরের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত হচ্ছে। আমাদের সাহিত্যিকদের মধ্যে কার কার লেখা অনুবাদের অভাবে জগতসভায় ঠিকমতো পেশ হলো না, একেকজনের কাছে তার একেক তালিকা থাকবে, এতে অন্যায্য কিছু নেই। বোর্হেস পাঠকদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে ‘সাহিত্য কোনো প্রতিযোগিতা নয়’। জীবনানন্দ দাশের বেশ কিছু কবিতার প্রত্যাশা ছাপিয়ে চমৎকার অনুবাদ করেছেন ক্লিন্টন সীলি, আমাদের আফসোস একটু কমেছে। আমার ভালো লাগবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমার রায় (সুকান্ত চৌধুরী ‘আবোলতাবোলের’ বেশ ভালো অনুবাদ করেছেন যদিও) পুরোটা, সত্যজিৎ রায় ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের বেশ কিছু গল্প, শীর্ষেন্দুর আগেরদিকের বেশ কিছু লেখা যদি অন্যান্য ভাষাভাষীদের উপভোগ্য হয়ে ওঠার মতো করে অনুবাদ হয়। সার্থক অনুবাদ করার মতো লোক আছেন, কেন হয়নি জানি না। হয়তো যেটুকু হয়েছে তাতে পাঠকের আন্তর্জাতিক বাজারকে তেমন ইমপ্রেস করতে পারেনি। তবে নোবেলের সম্ভাব্য প্রাপকের যে দীর্ঘ তালিকাটা অনেক সময়ই শুনি, তার খানিকটা অংশ খেয়ালখুশিতে তৈরি হওয়া মিথ। তবুও অবশ্যই অনুবাদ হওয়ার যোগ্য মানের। আমরা পৃথিবীর এককোণে একটি অকিঞ্চিতকর অস্তিত্বের গৌণ জনগোষ্ঠী, নোবেলের সংখ্যাটা বাড়িয়ে ভাবলে একটু শান্তি পাই। কিন্তু কেন যেন আন্তর্জাতিক সাহিত্য পড়ায় অতটা আকৃষ্ট হই না। প্রকৃত পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের ধারণা সংযোগহীনই থেকে যায়।
রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে প্রকৃত সাহিত্যিকের চরম দ্বন্দ্ব থাকার কথা। কারণ, রাজনীতি জোর দেয় পরিস্থিতির একটামাত্র চিত্র যেন তৈরি হয়, আর সাহিত্যিকদের কাজ হলো নানা চিত্র পেশ করা। অথচ আমাদের সাহিত্যিকদের দেখি বড্ডো রাজনীতির একনিষ্ঠ ও সহৃদয় সহায়ক ভূমিকায়। সেখানেই সিরিয়াস পাঠকদের অতৃপ্তি তৈরি হচ্ছে হয়তো।
বলে রাখি, জাপান থেকে এযাবত মাত্র দু’জনকে দেওয়া হয়েছে। একজন খুবই উঁচু স্তরের, অন্যজনকে অধিকাংশ জাপানিই যোগ্য মনে করে না। কিন্তু এই মুহূর্তে জাপানের অন্তত পাঁচ ছ’জন লেখক লেখিকাকে জগত হামলে পড়ে পড়ছে, অবিশ্বাস্য দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে তাদের খ্যাতি। জাপানিরা ভ্রূক্ষেপও করে না, কে নোবেল পেল বা না পেল।
…