সত্যজিৎ রায়ের এই সাক্ষাৎকারটি জেমস ব্লু চলচ্চিত্রে অ-অভিনেতাদের পরিচালনার বিষয়ে তাঁর একটি গ্রন্থ রচনার প্রস্তুতি হিসেবে গ্রহণ করে টেপ-রেকর্ড করেন। বিশেষ এই গবেষণাটি পৃষ্ঠপোষকতা করে ফোর্ড ফাউন্ডেশন। এই সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় ব্লু ভারতে এসেছিলেন। তখন তিনি বিশ্ব খাদ্য ও জনসংখ্যা সমস্যার উপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য সংস্থার প্রযোজনায় ‘অ্যা ফিউ নোটস অন আওয়ার ফুড প্রবলেম’ শিরোনামের ৩৫ মিমি এ ধারণ করা ৪০ মিনিটের একটি রঙিন চলচ্চিত্র পরিচালনা করছিলেন। স্টিভেন লারনার ছিলেন এই চলচ্চিত্রটির সিনেমাটোগ্রাফার। সত্যজিৎ রায়ের বেশিরভাগ চলচ্চিত্রের সহকারী শৈলেন দত্ত এই সাক্ষাৎকারের রেকর্ডিংয়ে সহযোগিতা করেন। সত্যজিৎ রায় তখন এটা চলচ্চিত্রের কাজ করছিলেন যেটা তিনি একটা বানিজ্যিক কাজ ‘বড়ো তারকা নিয়ে দুঃসাহসী গল্প’ হিসেবে বর্ণনা করেন। ব্লু সত্যজিৎ রায়কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন— একজন লম্বা, ছয় ফিটের উপরে যা গড় ভারতীয়দের উচ্চতার তুলনায় অনেক বেশি; যার গভীর, দৃঢ় কণ্ঠস্বর। উচ্চতার চেয়েও তাঁর উদাত্ত কণ্ঠ বিস্মিত করে কারণ অভিজাত প্রতাপের সাথে অসাধারণ সূষ্ক্ষভাবে ইংরেজিতে কথা বলার ক্ষমতা রাখেন তিনি।
এই সাক্ষাৎকারটি ‘দি সামার ১৯৬৮’ সংখ্যাতে প্রকাশিত হয়।
সত্যজিৎ রায় : আমার মাথায় পুরো বিষয়টা সবসময়ই আছে। চলচ্চিত্রের পুরো বাঁকটাই আছে। কাট বলার পরে একটা দৃশ্য কেমন দাঁড়াবে তা আমি জানি। আমি এব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত থাকি এবং সেকারণে সম্ভাব্য সকল ক্লোজ, মিডল বা লং অ্যাঙ্গেল থেকে সিনটি ধারণ করি না। চূড়ান্ত কাট হওয়ার পরে এডিটিং রুমে কাটার মতো তেমন কিছুই থাকে না। কাট যা হবার সব ক্যামেরাতেই হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়— ‘পথের পাঁচালী’র মা-মেয়ের ঝগড়ার দৃশ্যটার কথা যেটা পুরোপুরি আমার মাথায় ছিল এবং আমি আমার সম্পাদককে শুধু বলেছিলাম সিনগুলো যুক্ত করতে; এখন ওটা, এখন এটা। এবং শক্তিশালী সেই দৃশ্যটা যেখানে দুর্গা মারা যায় সেখানে অনেক অনেক শট ছিল এবং সম্পাদক জানতই না সে কী করছে। পুরোটাই আমার মাথায় ছিল। সিনের ছোটো ছোটো অংশগুলো সব আমার হাতে ছিল এবং তারপর আমি একটার পর একটা বসিয়েছি, একটা বিটের পরে আরেকটা বিট মিলিয়েছি। আপনি দেখবেন, সম্পাদক শুধু আমাকে সাহায্য করেছিলেন কারণ আমাদের একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা ধরার তাড়া ছিল।
কিন্তু আমার সম্পাদক আসলেই খুব ভালো। তিনি প্রায়শই আমাকে খুব সৃষ্টিশীল পরামর্শ দেন। আপনি দেখবেন ছোটো ছোটো বিষয়গুলোতে, বিশেষত দীর্ঘ সংলাপের দৃশ্যে তিন থেকে চারটা চরিত্র থাকে যেখানে প্রতিনিয়ত কিছু জিনিস পরিবর্তন করার ফলে দৃশ্য আরও সুন্দর হয়। তার এসব পরামর্শগুলো খুবই ভালো।
আমি বুঝেছি আপনার অনেক চলচ্চিত্রে আপনি নিজেই ক্যামেরাতে থাকেন
১৯৬২, ৬৩ সালের দিকে যখন আমি ‘মহানগর’ শ্যুট করি তখন প্রথম ক্যামেরা চালিয়েছিলাম। সব শট, সবকিছুই। ‘অ্যারিফ্লেক্স’ নিয়ে পরিচালনা করাটা দারুণ; কারণ এটাই একমাত্র জায়গা যেটা আপনাকে বলে দেবে অভিনেতারা ঠিক কোথায়, আর তাদের একে অপরের সাথে সম্পর্কটা কী। পাশে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকাটা পরিচালকের জন্য একদম ভালো না।
আমার মনে হয়েছে আমি পরিচালনা ও শ্যুট একসাথে করতেই পারব না
আমার কাছে বেশ সহজ লেগেছে, কারণ, আমার দেখার ব্যাপারে অভিনেতাদের সচেতন থাকতে হয় না। কারণ আমি লেন্সের পেছনে থাকি। আমি দর্শকের পেছনে কালো একটা কাপড়ে মাথা ঢেকে বসে থাকি; সুতরাং আমি প্রায় সেখানে থাকিই না। আপনি দেখবেন, আমার কাছে এটা সহজ লাগার কারণ হলো অভিনেতারা স্বাধীন থাকেন এবং বিশেষ করে আপনি যখন জুম ব্যবহার করছেন। আমি সারক্ষণই জুমে কিছু না কিছু করছি, আরও ভালো করার চেষ্টা করছি।
যখন আপনি একজন ক্যামেরাম্যানের সাথে কাজ করেন দেখা যায় তিনি সর্বদাই বলছেন আরও একবার শটটা নিতে হবে। আমি সাধারণত বলি কেন? আমাকে বলো কেন? কোন কারণে আবারও নিতে হবে সেটার নির্দিষ্ট কারণটা তিনি কখনোই বলতে পারেন না। তিনি নিশ্চিত থাকেন না। যেটা আমি নিশ্চিত থাকি। কেবল পরিচালকই জানতে পারেন কখন টেকনিক্যাল ব্যপারটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কিছু শট, যেখানে এসব করাটা তেমন প্রয়োজনীয় নয়, কিন্তু অন্য কোনো একটা জায়গায় এটা অত্যাবশ্যক সেটার গুরুত্ব কেবল পরিচালকই বুঝতে পারেন। তাই এমনকি যদি একটু এভাবে প্যান করা হয় [হাতে একটা ঝাঁকির ভঙ্গি করে দেখিয়ে] সেটাও তেমন কোনো ব্যাপার না। এবং সিন রিটেকের বিষয়টিও তখনই আসে যখন আপনাকে অদক্ষদের নিয়ে কাজ করতে হয়। এসব কারণেই মূলত আমি ক্যামেরা নিজেই চালানো শুরু করি।
মহড়ার করার সময়েও তাহলে আপনি ক্যামেরা চালান?
হ্যাঁ, অন্যথায় এটা করার কোনো মানেই থাকে না। আপনি দেখবেন শুধু প্রথম মহড়ার সময়ে আমি ক্যামেরার পেছনে থাকি না, যেখানে আমি বিষয়টা এবং অভিনয়য়ের খুঁটিনাটি দেখি। যদি সব ঠিকঠাকভাবে শেষ হয়ে থাকে তাহলে শট নেওয়ার একদম আগের মুহূর্তে আমি ক্যামেরাতে থেকে অন্তত দুবার মহড়া করিয়ে নিই, এটা দেখতে যে সত্যিই আমি এটাই পারব কিনা, আমার শরীর অনুমতি দিচ্ছে কিনা। কারণ মাঝেমাঝে ভীষণ ভয়ঙ্কর অবস্থানে থাকতে হয়; শুয়ে পড়ে বা আধা শোয়া বা হেলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আমি প্যানিং হাতল খুলে ফেলে সেটা দিয়ে অন্য জিনিসপত্র ধরি। আমি পুরো ক্যামেরা ধরে এর পিভটের দিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দিই।
ব্যক্তিগতভাবে, আমি মনে করি সুব্রত মিত্রর ক্যামেরার কাজ রাউয়াল কাউটাডের্র চেয়ে ভালো। কিন্তু জিয়ান্নি ডি ভেনানজোকে আমি ভীষণভাবে প্রশংসা করি। ‘৮ ১/২’ এর কাজটা অসাধারণ, মানে, আমি বলতে চাইছি সেসব সাহসী কাজ যা তিনি দুর্দান্ত ভাবে করেছেন। পুরোপুরি বললে অবশ্যই এটার কৃতিত্ব পরিচালকেরও কারণ কেবল ক্যামেরাম্যান একাই ওভার এক্সপোজড শট গুলোকে অসাধারণ শটে পরিণত করার পরিকল্পনা করতে পারেন না।
কখনো কখনো ক্যামেরাম্যানরা কোনো কারণ ছাড়াই এমন কিছু করে, যা আমি পছন্দ করি না। আমি বোঝাতে চাইছি, শুধুমাত্র কৌশল দেখানোর জন্য নিউ ওয়েভের পরিচালকদের অনেকেই এটা করে। আমি বলতে চাইছি গদার সবসময় এই কাজ করেন। কোনো কারণ ছাড়াই ক্যামেরা হাতে ধরে এটা চলছেই। ‘Une Femme Est Une Femme’ (এ ওমেন ইজ এ ওমেন) চলচ্চিত্রের একটা দীর্ঘ দৃশ্য যেখানে বেলমন্ডো বারে বা অন্য কোথাও বসে কথা বলছে তো বলছেই এবং হাতে ধরা ক্যামেরা এবং আপনি পর্দার কিনারা দিয়ে দেখবেন এটা এটা সারাক্ষণ কাঁপছেই [সহাস্যে]। এবং আপনি যা দেখতে চাচ্ছেন তা ফ্রেমেই নাই। আপনি খুব মজা পাবেন যখন দেখবেন যে ছেলেটা ক্যামেরা কত সুন্দরভাবে স্থির ধরে রাখতে পারছে।
অবশ্যই গদারের পুরোপুরি অন্য একটা স্টাইল আছে। আপনি দেখবেন, যেখানে আপনি সব অপটু জিনিসপত্র ব্যবহার করছেন, পুরোপুরি ইম্প্রোভাইজ করছেন এবং সবকিছু মিলিয়ে তা একটি কোলাজে পরিণত হয়। যেখানে ভালো, মন্দ সব নিরপেক্ষ। কিন্তু এটাকেও আমি অন্যধারার চলচ্চিত্র বলে মনে করি।
আমি ‘সিনেমা ভেরিত্তে’র কোনো চলচ্চিত্র দেখিনি শুধুমাত্র জিন রাউচের ‘লেস মাইত্রেস ফাউস’ (দ্যা ম্যাড মাস্টারস) ছাড়া যা আফ্রিকায় শ্যুট করা হয়েছে, যদিও ভয়াবহ কিন্তু অসাধারণ এবং শক্তিশালী। এবং একজনেরই পরিশ্রম এটা। এই মানুষটা রাউচই। ১৯৫৮ সালের ফ্লাহার্টি চলচ্চিত্র সম্মেলনে আমি রিচার্ড লিককের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম কিন্তু তাঁর কোনো ‘সিনেমা ভেরিত্তে’ আমি দেখিনি আবার ফরাসি ক্রিস মার্কারেও দেখিনি।
যদিও আমিও ‘সিনেমা ভেরিত্তে’ সম্পর্কে তেমন জানি না তবুও একদিক থেকে আমার কাছে মনে হচ্ছে এটা খুবই দারুণ এবং যুক্তিযুক্ত। এটা একটা আলাদা ধারা— আপনি দেখুন। আমার মনে হয় ফ্রান্সেস ফ্লাহার্টি আমার কাজ করার পদ্ধতি নিয়ে কিছুটা হতাশ হয়েছিলেন কারণ তিনি ভেবেছিলেন ‘পথের পাঁচালী’তে যারা অভিনয় করেছেন তারা সবাই গ্রামবাসী। কিন্তু আপনি কাজটা করতে কাকে ব্যবহার করবেন সেটা কোনো ব্যাপারই না কারণ চূড়ান্ত ফলাফলটাই সব। সকল শিল্পেই এমনটা হয়।
আমি অ্যারিফ্লেক্সে কাজ করি। কারণ এটা দিয়ে খালি চোখে দেখা যাবে না এমন অনেক ছোটো ছোটো জুম আপনি করতে পারবেন। আপনি জুমের মাধ্যমেই সর্বদা আপনার কাজের জোরটা দিতে পারবেন এবং এটার সাথে কাজ করাটা দারুণ। এবং কখনো কখনো আপনি খেয়ালই করবেন না এবং বেশিরভাগ সময়ই করা যায় না। এটা অনেক বেশি জুম করা না, খুব সামান্য সূক্ষ্ম কাজ। কখনো কখনো ট্র্যাকিং করার সময় জুম করা যায়। আমি জুম ভালোবাসি। আমার মনে হয় এটার কাজ চমৎকার; বিশেষভাবে এখন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কিছু একটা নির্দিষ্ট ভাবে সিনে ঢোকাতে গেলে আপনাকে যা করতে হবে তা হলো একটু জুম।
আপনি সংলাপ পরিচালনা কীভাবে করেন?
সকল অভিনেতারা ভয়ে থাকে কোথায় থামতে হবে বা বিরতি নিতে হবে; কারণ তারা নিজের ব্যপারটা বোঝে না। ‘অপুর সংসারে’ যেমন শর্মিলা ঠাকুরকে আমি বলব ‘আচ্ছা, এই জায়গায় থামতে হবে এবং এখান থেকে শুরু করবে, আমি বলব শুরু করতে’। সেভাবেই সে থামত এবং একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তে এসে তাকাত যা আগেই ঠিক করা থাকত। এবং তারপর আমি বলব এবার শুরু করো এবং সে আবার শুরু করবে। সুতরাং বিরতিগুলো এমনভাবে হবে, যেভাবে আমার প্রয়োজন। এরকম না করলে অভিনেতারা খুবই ভয়ে থাকে এই থামার জায়গাগুলো নিয়ে। কেবল অসাধারণ পেশাদার অভিনেতারাই এই বিরতির সত্যিকার শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে জানেন। অ-অভিনেতা ও অপেশাদাররা এই বিরতির গুরুত্বটাই বুঝতে পারে না। আমার জন্য, এই বিরতিগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: তাই প্রতিনিয়ত এটা নিয়ে কাজ করতেই হবে।
একবার মুখস্ত করে একজন অভিনেতার পক্ষে এমন অভিনয় করা ভীষণ কঠিন; যেখানে সে ভাবছে বা কথা বলছে কিন্তু তা শুধু মুখে আওড়ে যাওয়া মনে হবে না। মাঝেমাঝে এমন কিছু শব্দ থাকে যা সহজে আসেই না। এরকম শব্দের আগে আপনাকে বিরতি নিতেই হবে। অনেক ভাষা জানা এবং ভালো শব্দের দখল অনেকেরই থাকে না। তাই অভিনেতাভেদে এটা আপনাকে আলাদা করতে হবে এবং এই বিরতিগুলো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কখনো কখনো আপনি কোনো একটা শব্দ ভেবে পাচ্ছেন না, দ্বিধা হচ্ছে এবং অন্যকেউ এটা আপনার জন্য বলে দিল। তাই আমার সংলাপগুলো প্লাস্টিকের মতো লেখা হয়, মানে যার নিজস্ব চলচ্চিত্র বৈশিষ্ট্য থাকে, যেটা মঞ্চের সংলাপ নয় এবং সাহিত্যেরও সংলাপ নয়। কিন্তু সকল তোতলামি, আড়ষ্ঠতা, সঙ্কট রেখেই এটা যথাসম্ভব সজীব, জীবনমুখী করা হয়।
আপনি এটাকে সহজাত সংলাপ বলবেন না?
না, এটা সহজাত নয়; তবে এটাকে আমরা বাস্তবধর্মী বলতে পারি। এটা টেপ-রেকর্ডের মতো এমন না। কারণ তাহলে আপনার ধারণ করা মূল্যবান অভিনয়দৃশ্যগুলো আপনি অপচয় করবেন। আপনাকে স্বাভাবিকতা এবং কিছু নির্দিষ্ট জিনিস, যা শৈল্পিক, এমন কিছু নির্বাচন করতে হবে যাতে শিল্পীত কিছু তৈরি করা যায়। কিন্তু আপনি যদি ঘর-গৃহস্থলির অকপট ছবি তোলেন সেটা কোনোভাবেই শিল্প হয়ে ওঠে না। আমি বোঝাতে চাইছি নির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারলে এটাই আকর্ষনীয় হয়ে উঠবে কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত কাটাছাটা হচ্ছে ততক্ষণ কোনো দৃশ্যই, সেটা যে দৃশ্যই হোক না কেন তা নিজে থেকেই শিল্প হয়ে উঠতে পারে না। সেটাই হলো সৃজনশীলতা। আপনার ফ্রেম, কাটিং, শব্দ বাছাই করার রুচির মধ্য দিয়েই শৈল্পিক কিছু সৃষ্টি করা যায়।
‘পথের পাঁচালী’ কী সুসংগত শব্দেই শ্যুট করেন?
হ্যাঁ, একদম, কারণ অ-অভিনেতাদের দিয়ে ডাব করানোটা অসম্ভব হতো। পুরো বিপর্যয়। আমি চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কাজ হয়নি।
আপনি ডাব কীভাবে করেন? আপনি কি ফ্রেন্স সিস্টেম ব্যবহার করেন?
কোনো পদ্ধতি নয়। আমি আমার পদ্ধতিতেই কাজ করি। এমনকি আমি জানিও না যে, ফ্রেন্স সিস্টেমটা কী। দেখুন, আমি ডাবিং পছন্দ করি না কারণ এটা অনেক যান্ত্রিক। আমি স্বরলিপি পদ্ধতিতে কাজ চালাই— মানে, আপনার একটা চলার চিহ্ন বা সুর থাকতে হবে… আমার সহকারী, শৈলেন দত্ত এবং অন্যরা প্রত্যেকটা শব্দের জন্য একেকটা নোট বা কোড রাখে। আমাদের টেপ-রেকর্ডার থাকার পরেও, পথরেখা জানানোর একটা সুর থাকার পরেও এই চিহ্নগুলো রাখার প্রয়োজন হয়। আমি বারবার বাজিয়ে বাজিয়ে আমার নিজস্ব স্বরলিপি তৈরি করে নিই এবং তারপর সেটা ধরেই কাজ করি। কারণ কথাগুলো কীভাবে বলা হচ্ছে সেদিকেও আপনার নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয়। এভাবেই ঠিকঠাক মনে হয়, আসল কথার সাথে মেলানো যায়। আপনারও কথাগুলো মুখস্থ থাকতে হবে।
শেষ কাট হওয়ার পরে ডাব করার জন্য আপনি সাউন্ড স্টুডিওতে কখন যান? অভিনেতারা ছবিতে যা বলে আপনি কি হুবহু সেটার পুনঃনির্মাণের চেষ্টা করেন?
পুরোপুরিভাবে তাই করি। কিন্তু কখনো কখনো আরও ভালো করার চেষ্টা করি। সৌভাগ্যক্রমে তাদের সাথেই আমার ডাবিং থাকে যাদের কাজে পেশাদারিত্ব আছে এবং যারা আমার সাথে কাজ করতে পারে। কিন্তু যেকোনো ভাবেই হোক ‘পথের পাঁচালী’তে আমাদের কম-বেশি ব্যবহার করার মতো শব্দ ছিল। বেশি সংলাপ নয়, কোনো জনগণের ভিড় ছিল না; কারণ, ফিসফিসানির শব্দও এত কোলাহল তৈরি করতে পারে যা সুরটা নষ্ট করে দিতে পারে।
আপনি যেখানে ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণ করেছেন সেই গ্রামে গতকাল আমরা একটা শ্যুট করলাম
আপনি করেছেন? এখন আর চেনা যায় না। আগের সেই রূপটাই আর নেই। নষ্ট হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষেই একসময় খুব সুন্দর ছিল। বিশাল আয়তন জুড়ে কোনো কুড়েঘর, কোনো শরনার্থীদের কুড়েঘর ছিল না। … [ বি.দ্র. দেশভাগের ফলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরনার্থীরা বাংলার আরও অন্যান্য গ্রামের মতো ‘পথের পাঁচালী’র গ্রামেও এসে বসবাস শুরু করেছে]
অপু-ট্রিলজির প্রথম চলচ্চিত্র বানাবার সময় গ্রামের লোকজন কি সহযোগিতা করেছিল?
শুরুর দিকে করেনি। সত্যকথা বললে প্রথমদিকে তারা শত্রুভাবাপন্নই ছিল। কিন্তু আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করেছিলাম এবং শেষপর্যন্ত আমরা তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার পেয়েছিলাম। কারণ সবমিলিয়ে আমরা প্রায় দুইবছর ওখানে ছিলাম। আমরা যখন চলে আসি তারা তখন আমাদের জন্য সত্যিই মন খারাপ করেছিল। আপনি কেবল ভদ্র ও নম্র হয়ে তাদের কাছে বসে, কথাবর্তা বলেই তাদেরকে সামলাতে পারবেন। মূলত তারা খুব ভালো মানুষ কিন্তু সন্দেহপ্রবণ। তারা নিশ্চিতভাবেই মনে করে সব ব্যবসারই অপ্রিয় উদ্দেশ্য আছে। আমরা ছিলাম একদম নবাগত, কেউই চিনত না আমাদের, এবং এখন লোকজনের দেখতে আসা ছাড়া এখন আর আমাদের কোনো সমস্যা হয় না।
উদাহরণস্বরূপ বলি, আমরা আমাদের নতুন চলচ্চিত্রের কাজ বারাসাতে শুরু করেছি। সেখানে ভিড় বাড়তে শুরু করে। এবং গত দুই তিন দিন ধরে প্রায় দুই হাজার নারী, শিশুরা শ্যুটিং দেখতে এসে ভিড় করছে। ওই চত্বরে একটা দেয়াল তৈরির কাজ চলছে, এবং সেই দেয়ালের বাইরে থেকে সবাই দেখার চেষ্টা করছে। আশেপাশের সব গাছ ভর্তি মানুষ। কিছু ডাল ভেঙে বারো জন নিচে পড়ে একজন গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। সৌভাগ্যবশত আমাদের চরিত্রদের মধ্যে একজন ডাক্তার অভিনেতা আছেন, তিনি প্রাথমিক চিকিৎসা করে তাকে হাসপাতালে পাঠান।
‘পথের পাঁচালী’র সেই গ্রামে গতকাল প্রায় দেড়শো লোক আমাদের পাশে এসে জড় হয়। সবাই ছিল খুব উত্তেজিত এবং…
হ্যাঁ, কিন্তু আমরা যখন ‘পথের পাঁচালী’ তৈরি করি তখন প্রায় কেউই দেখতে আসত না। অবশ্য প্রথম কয়েকদিন একটু আসত কিন্তু আমাদের কাজের প্রতি তারা আগ্রহ হারায়। তাই আমরা একদম কোনো বাধা-বিঘ্ন, হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাজটা চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম। কেউ চিনত না আমাদেরকে, সবাই ছিল নতুন, কোনো তারকা ছিল না। কিন্তু আমার মনে হয়, নতুন চলচ্চিত্রটাতে একজন বড়ো তারকা আছেন এবং তাকে ঘিরেই এই ভিড়টা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এটা বাদেও গোপন বা ডামি ক্যামেরা ব্যবহার না করে শহরের রাস্তাঘাটে আজকাল শ্যুটিং করাটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যদি আপনি এই ব্যবহারের কায়দাটা না বোঝেন তাহলে শ্যুটিং খুব ব্যয়বহুল হয়ে যায়। আপনি দেখবেন আমি ৪:১ অনুপাতে কাজ করি।
আপনি কী ‘পথের পাঁচালী’ ৪ : ১ অনুপাতে তৈরি করেছেন?
না, ওটাই আমার একমাত্র ছবি যেখানে আমার নেওয়া অনেক সিন চলচ্চিত্রে রাখা যায়নি। কিছু সিন নেওয়া শেষও হয়নি। এবং তখন আমি আমার কাটিং নিয়ে নিশ্চিত থাকতাম না তাই কিছু একদম ফেলে দিতে হয়েছিল। প্রথম দুই তিন দিনের কাজে কোনো কাটই হতো না। তারপরে আমি নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিই। কাজের মধ্য দিয়েই আপনি শিখে যাবেন এবং দ্রুত শিখবেন। আসলে আমরা মিতব্যায়ী হতে বাধ্য হয়েছিলাম। আপনার কাছে সমস্ত কিছু মাপা মাপা থাকলে এটা করতেই হয়।
অবশ্যই আপনি বলেছেন যে ‘পথের পাঁচালী’ তৈরির সময়ে আপনার ভিড়-ভাট্টার ঝামেলা হয়নি এবং সেসবের জন্য অভিনেতারাও ঘাবড়ে যাওয়ার কারণ ঘটেনি— কিন্তু এখনও কয়েকবার ‘টেক’ হওয়ার পরেও আপনি অ-অভিনেতাদের কাছ থেকে স্বাচ্ছন্দপূর্ণ আচরণ পাওয়ার বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত করেন?
মাঝেমাঝে অপেশাদার শিল্পীদের সাথে কাজ করাটা সহজ। আমার কাজ করার কোনো সুনির্দিষ্ট ধরণ নেই। আমি প্রত্যেক অভিনেতার সঙ্গে আলাদা আলাদা পদ্ধতি ব্যবহার করি। আপনাকে কায়দাগুলো পরিবর্তন করে নিতে হয়। কিন্তু আপনি যার সাথে কাজ করবেন তাকে ভালোভাবে জানতে হবে, তার ভাবভঙ্গি, ক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তা বুঝে নিতে হবে। কখনো কখনো আমি তাদের একদম পুতুলের মতো ব্যবহার করি এবং তাদেরকে প্রেরণাদায়ক কোনো কথা বলি না। আমি শুধু কিছু বিশেষ প্রতিক্রিয়া পাওয়ার চেষ্টা করি। যেমন বলা যায় ‘পথের পাঁচালী’তে যে ছেলেটা অপুর চরিত্র করেছে তার কথা— ওকে পুরোপুরি পুতুলের মতো ব্যবহার করা হয়। অস্পষ্ট কিছু কথা ছাড়া সে পুরো গল্পটাই জানত না। এবং এটা সত্যিই যে গল্পটা ছোটোদের গল্প নয়, এটা এক গভীর আবেগের গল্প যা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।
তার মানে আপনি শুধু তার অঙ্গভঙ্গিগুলো করতে নির্দেশ করেছেন?
একদম, পা থেকে মাথা পর্যন্ত সব গতিবিধিই— ‘এটা করে তারপর ওটা করো’ এভাবে। প্রথম দিন আমার কিছু সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। একদম সাদামাটা একটা শট ছিল যেখানে অপু ফুলের মাঠে হেঁটে হেঁটে ওর দিদিকে খুঁজছে। মনে পড়ছে? এবং সেই হাঁটাটা ঠিকঠাক পাওয়া খুব মুশকিল হলো। তাই আমি কিছু প্রতিবন্ধকতা রাখলাম পথে যা তাকে অতিক্রম করে করে যেতে হবে। এবং ওই জিনিসগুলো সরাতে সরাতে গেলেই শটটা সহজাত হয়ে উঠল। এটা না করলে সে একদম শক্ত হয়ে হাঁটছিল। আমি ওর পথে বিভিন্ন জিনিস রেখে বলি— ‘তুমি এই খড়টা সরাও তারপর এর পরেরটা সরাবে’— তেমন কোনো বাধা নয় কিন্তু এসব তাকে একটা উদ্দেশ্য সাধনের বিষয়ে সচেতন করে তোলে। কারও কারও জন্য শুধু শুধু হাঁটা বা তাকিয়ে থাকাটাই খুব কঠিন কাজ। অপুর প্রত্যেকবার মাথা ঘোরানোটাও ছিল নির্দেশমতো ‘এখন এদিকে তাকাও’! আমি একটা দফায় গিয়ে আমার ৩ জন সহকারীকে রাখি এবং প্রথমে ছেলেটাকে ‘এ’ ডাকবে তারপর ‘বি’ ডাকবে এবং তারপর ‘সি’। সেভাবে ছেলেটা হাঁটবে, তাকাবে, তারপর একটা ডাক শুনবে এবং তারপর আবার হাঁটবে। বিষয়টা এমন করা হচ্ছিল। একমাত্র এভাবেই করার ছিল। প্রথমে এভাবে আমি কাজ করিনি কিন্তু পরমুহূর্তেই আমার মনে হলো কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। তাই আমি বসে বসে চিন্তা করে এটা বের করে কাজটা করলাম। আমি সাধারণত তিনবারের বেশি ‘টেক’ গ্রহণ করি না। যদি দ্বিতীয় ‘টেক’ প্রথমটার চেয়ে ভালো না হয় তখন তৃতীটা নিই। আমি কখনোই ৫, ৬ বারের বেশি ‘টেক’ নিই না। কেবল ‘পথের পাঁচালী’র কুকুরের সাথে সম্পর্ক করার একটা দৃশ্য ছিল। আপনি দেখবেন যখন মিঠাইওয়ালা গ্রামে আসে এবং ছোটো ছেলে-মেয়েরা তাঁর পেছনে পেছনে দৌঁড়ায়; সেই একই শটে দেখবেন একটা কুকুরও তাদের সাথে দোঁড়াচ্ছে। কিন্তু ওটা কোনো পোষা বা প্রশিক্ষিত ককুর ছিল না। কুকুরটাকে ডাকা হচ্ছিল কিন্তু ওটা একজায়গায় বসেই থাকছিল, তাকাচ্ছিল আর কিছুই করছিল না। তাই এই শটটা নিতে ১১ বার টেক নিতে হয়েছিল। আমার এটা স্পষ্ট মনে আছে কারণে আমি আর কখনোই একটা শটের জন্য ১১ বার টেক নেইনি।
একজন পেশাদার অভিনেতা যিনি ‘পথের পাঁচালী’তে বাবার চরিত্রটা করেছেন তিনি বেশ কয়েকবার আমাদের হতাশ করেছেন। তিনি দীর্ঘস্থায়ী পেশাদার ছিলেন এবং তিনি সব কথা গুলিয়ে ফেলছিলেন। কারণ তাকে অনেকগুলো জিনিস একসাথে করতে বলা হয়েছিল। কথা বলা, অঙ্গভঙ্গি করা, আবার আলাপ করা সব একসাথে। এমন আমি প্রায়ই করি। যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি দেখবেন, কাজ করা ও কথা বলায় স্বচ্ছন্দ্য পাওয়াটা আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
আপনি কি সবসময় কাজ করার সাথে সংগত করে কথা বলে যাচ্ছে এমন দৃশ্য খুঁজে পান?
হ্যাঁ। যদি না সেটা এমন দৃশ্য হয় যেখানে অ্যাকশনের আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। অপু ট্রিলজির দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘অপরাজিত’তে একটা দৃশ্য আছে যেখানে বারান্দাতে অপুর মা মারা যাচ্ছে আর অপু পাশে বসে কাঁদছে। এবং সেখানে এক বৃদ্ধ কাকা হুক্কা খাচ্ছে আর অপুকে বলছে ‘জানিস তো মানুষ চিরদিন বাঁচে না, আজ হোক কাল হোক প্রত্যেকেরই মরে যেতে হবে, তাই কাঁদিস না’। এখন ওই লোকটি ছিলেন একদম আনকোরা (তিনি পরে মারা যান)। বেনারসের ঘাটে খুঁজে পেয়েছিলাম ওনাকে। তিনি জীবনে কখনও একটা চলচ্চিত্র দেখেননি। ৩০ বছর ধরে তিনি স্বস্ত্রীক বেনারসে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। আমি বলতে চাইছি সঠিক লোককে খুঁজে নিতে হবে। তাকে ঠিক মনে হয়েছিল তাই ওনার কাছে গিয়েছিলাম। কোনো বিশেষ চরিত্রের জন্য নয়। এবং তার কাছে জানতে চাই যে তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন কিনা। তিনি তখনই রাজী হয়ে বলেন : ‘কেন নয়?’ এবং তারপর একটা দৃশ্যে, একটাইমাত্র দৃশ্যে নির্দিষ্ট সময় ধরে তার কথা বলার ছিল। আমার কাট বলার কোনো সম্ভাবানা ছিল না কারণ সব তৈরি ছিল আর ওনাকেও বিষাদ আর হতাশাগ্রস্ত হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। আমি সংলাপগুলো কয়েকটি অংশে ভাগ করে দিই। তাকে বলা হয় শুধু একবার ধোঁয়াটা নেবেন তারপর কেবল একবার হুক্কাটা টানবেন এবং তারপর কিছুক্ষণের জন্য থেমে সংলাপ বলবেন। আচ্ছা, তিনি জানতেন কোথায় ধোঁয়া নিতে হবে, কোথায় একবার হুক্কা টানতে হবে; কিন্তু তিনি জানতেন না কোথায় সংলাপ বলাটা শুরু করতে হবে এবং সেটুকুর জন্যই পুরোপুরি আমার নির্দেশমতো করতে হয়েছিল।
আমি বুঝতে পারি ডি সিকাও পুতুলের মতো অভিনেতাদের ব্যবহার করার রীতি কিছুটা ব্যবহার করেছিলেন। আপনি দেখবেন কিছু জায়গায় তাদেরকেও হুবহু বলে দিতে হচ্ছে। আমার মনে হয় ‘বাইসাইকেল থিফের’ বাবাকে যতটা বলতে হয়েছে ছেলেটাকে ততটা বলা লাগেনি। ছেলেটি দুর্দান্ত, একদম অভাবনীয় ভালো। বিশেষভাবে শেষ দৃশ্যটা, যেখানে ছেলেটা বাবার হাত ধরে হাঁটছে আর কাঁদছে।
আমি ডি সিকার কাছে জানতে চেয়েছিলাম তিনি কীভাবে দৃশ্যটা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে ছেলেটার দারিদ্র্য নিয়ে খোঁচা দিয়ে তাকে কথা বলে কান্নায় উসকে দিয়েছিলেন। ডি সিকা বলেন : যখন আমি শটটা নিই তখন আমার নিজের উপর ভীষণ লজ্জা হচ্ছিল। আমার জন্য এটা অত্যন্ত লজ্জার ছিল। তিনি বলেন ‘আমার ছেলেটি খুব গরীব ছিল এবং মা-বাবা ও ভাই-বোনদের সাথে একই বিছানায় ঘুমাত এবং এসব নিয়ে সে খুবই গর্বিত ছিল। এবং সে তার পরিবারের দরিদ্র অবস্থা নিয়ে কাউকে মজা করতে দিতে চাইত না। তাই আমি ওর সাথে সেই নিষ্ঠুর মজাটাই করি। এটা ওকে কষ্টে পাগল করে ফেলে এবং কাঁদতে থাকে, কাঁদতেই থাকে।’ ডি সিকা বলেন, ‘এবং তারপর আমি সেই ছবিটা পাই’ এবং শেষে ডি সিকা বলেন : ‘শট শেষ হলে আমি ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলাম।’
আপনাকে সবসময় এসব পদ্ধতি ব্যবহার করতেই হয়। এছাড়া এটা ৫-৬ বছরের বাচ্চার কাছ থেকে আপনি কৃত্রিম আবেগ দিয়ে দারুণ অভিনয় আশা করতেই পারেন না।
এটা সাধারণত হয়েই থাকে। আপনাকে সবসময় এসব পদ্ধতি ব্যবহার করতেই হয়। এছাড়া এটা ৫-৬ বছরের বাচ্চার কাছ থেকে আপনি কৃত্রিম আবেগ দিয়ে দারুণ অভিনয় আশা করতেই পারেন না।
ডি সিকা এবং ওনার লেখক জাভাত্তিনি দুজনেই একটা দৃশ্য যথাযথভাবে করার সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলছিলেন। বিচার-বিশ্লেষণ শেষে তারা অভিনেতাদের সাধারণ কাজ করতে করতে প্রাসঙ্গিক সংলাপ বলার বিষয়টি রাখেন। কফি পাত্র তুলে নেওয়া, দরজা বন্ধ করা এবং আরও অনেক কিছু। এসব করার মধ্য দিয়ে তারা একটা যথাযথ পরিবেশনা তৈরি করেন। আপনি কি সিন তৈরিতে এমন কিছু ক্যবহার করেছেন?
হ্যাঁ, প্রায় কাছাকাছি। ‘মহানগরের’ গৃহস্থালির দৃশ্যে এমনটা করা হয়। প্রত্যেকে কিছু না কিছু করছে আর কথা বলছে এবং গল্পটা এগোচ্ছে, কাহিনিটা তৈরি হচ্ছে আর সম্পর্কগুলোও এর ভেতর দিয়েই তৈরি হচ্ছে। প্রত্যেক দৃশ্যেই ঘরের কোনো কাজকর্ম থাকছে এবং সেগুলো দিনের বেলাতে আলোর ব্যবহারের মাধ্যমে সেটা আরও শক্তভাবে দৃশ্য হয়ে ওঠে।
ধীরে ধীরে দিনের আলোর পরিবর্তনটা আপনি ছবিতে কীভাবে তৈরি করতেন?
সুব্রত মিত্র এবং তার সহকর্মী যারা এখন আমার ক্যামেরার কাজ করে তাদের সবাইকে নিয়ে আমরা আলোর জন্য একটা কৌশল ব্যবহার করি যেখানে স্টুডিওতেও আমরা দিনের আলোর চমৎকার ব্যবহার করতে পারি। সর্বোচ্চ পেশাদার দক্ষ শিল্পীরা সবাইকে বোকা বানিয়ে দিতে পারে। আমরা একধরনের বুস্ট আলো ব্যবহার করি। যদি দিনের বেলার দৃশ্য হয় তাহলে সরাসরি আলো ব্যবহার না করে আমরা বাইরের রোদের আলোর মতো একটা আলো তৈরির চেষ্টা করি। অথবা আমরা বাউন্স আলো ব্যবহার করি। বিশেষ করে আপনি যদি ‘চারুলতা’ দেখেন— নানান যুক্তিতে এটা আমার তৈরি সেরা ছবি। এবং ‘অপুর সংসারের’ সেই ছোটো ঘর, জায়গা, আবহ আমার জন্য উপযুক্ত আলোর ছিল। যদিও এটা স্টুডিওতে করা। জানালা দিয়ে আসা আলো এবং ক্যামেরার বাউন্স আলো আমরা ব্যবহার করেছিলাম। আপনি দেখবেন দিনের প্রত্যেকটা সময়ের আলোর মাত্রাটা খুব সতর্কতার সাথে ঠিক রাখা হয়। আমরা একটা সাদা কার্ড ব্যবহার করতাম নানা জায়গা থেকে— এখানে, সেখানে ব্ল্যাকবোর্ডের মতো করে। আলাদা আলাদা ধূসরতা তাই মেঘলা দিনের জন্য আলাদা আলো, রোদের দিনে আলাদা আলো, আবার মধ্য-দুপুরের জন্য আলাদা এবং খুব ভোরবেলার জন্য আলাদা ধরনের আলো তৈরি করা হয়। ‘অপুর সংসারের’ আলো মিলে যাওয়াটা ছিল একদম ব্যতিক্রম এবং সেটা কেবল আলোর মানিয়ে যাওয়া নয় বরং আবহসংগীতেরও চমৎকার মিল হয়েছিল। এটা অবশ্য সবসময়ই হয়। কারণ আপনাকে বাইরের অতিরিক্ত শব্দের মধ্যেই শটের পরে শট নিতে হয়। বার্গম্যানের ক্যামেরাম্যান ভেন নিকভিস্টের লেখা ‘অ্যামেরিকান সিনেমাটোগ্রাফার’ প্রবন্ধে পড়েছিলাম তাঁরা ‘থ্রো অ্যা গ্লাস ডার্কলির’ শ্যুটিং শেষ করার পরেই নিকভিস্ট দারুণ আলো ব্যবহারের পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন যেটা আমরা গত বারো বছর ধরে ব্যবহার করছি।
আমি যেমনটা বলছিলাম, বেনারসের যে বাড়িটায় অপুরা থাকত সেটাতো একটা স্টুডিও সেট। আমরা একটা বড়ো কাপড় দিয়ে চারদিকে ঘিরে দিয়েছিলাম উপর থেকে সূর্যের আলো পাওয়ার জন্য। আমাদের ঐ আলোটা আপনাকে গাঢ় গভীর চোখের প্রতিক্রিয়া দেবে। কিন্তু এটা কোনো ব্যাপারই না কারণ সবাইকে সুন্দর করাটার কোনো মানে নেই। মূলত আপনি একটা বাস্তবসম্মত ভাব রাখতে পারলেই আপনার পরিশ্রমের মূল্য পাবেন।
কিন্তু লোকেশনে কাজ করার সময়েও আমরা এটা করেছি। এসবের বাইরে রাঙতা, রূপালি কাগজের প্রতিফলন ব্যবহার করেছি। অবশ্যই আপনাকে সেসব ব্যবহার করতে হবে কিন্তু আমাদের সব ক্লোজ শট নেওয়ার সময় অসংখ্য সাদা কাপড় টানানো ছিল যার ফলে আমরা নরম বাউন্স আলোটা পাই। আমাদের রঙিন চলচ্চিত্র ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’তে হোটেলের অন্দরের শট ছিল। কিন্তু রঙের জন্য আমাদের কোনো আলো ছিল না। তাই আমরা যেটা করেছিলাম সেটা হলো— দুটো তিনটে চার ফিটোর বড়ো বড়ো আয়না ব্যবহার করেছিলাম। তাতে সূর্যের আলো ফেলে কাপড়ে টেনে নিই এবং সেটা চমৎকার হয়েছিল। আপনাকে সূর্যের আলোটা রাখতেই হবে। এবং সেটা ব্যবহারের ক্ষমতাও থাকতে হবে। মেঘলা দিন হলে আপনি শেষ কিন্তু যদি সূর্যের আলো এবং আয়নাটা থাকে তাহলে এটা জানালা দিয়ে আলোর প্রতিফলনের মাধ্যমে ঘরের ভেতরে আনতে হবে। এর মাধ্যমে আপনি যে মানের আলো পাবেন তা সত্যিই অসাধারণ। চারপাশের আলোর উপস্থিতিটা আপনি অনুভবই করতে পারবেন না। এতে করে সব জিনিসপত্র, সাজ-সরঞ্জামে ঝকঝকে আলোর প্রতিফলন হয় না।
আপনি অ-অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন কেন?
আমি অ-অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করাটা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ভেবেছিলাম। কিন্তু এমন কিছু গল্প আছে যেখানে অ-অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করার কথা ভাবতেও পারবেন না। আমি সেরকম কিছু চলচ্চিত্র তৈরি করেছি যেমন ‘দেবী’ এমনকি ‘জলসাঘর’ বা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। শেষেরটা সংলাপবহুল এবং সম্পদশালী পরিবারের গল্প নিয়ে তৈরি।
তাহলে যখন অনেক বেশি সংলাপের কাজ থাকে তখন পেশাদার অভিনেতাদের সাথে কাজ করার প্রতি বেশি ঝোঁক অনুভব করেন?
আমি করি, হ্যাঁ আমি করি। যদি না… আপনি দেখুন, অ-অভিনেতা মানেই এমন নয় যে তার অভিনয়ের কোনো ক্ষমতা থাকবে না। আমি বোঝাতে চাইছি অনুকূল নয় এমন এবং অপেশাদারের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। দুটো আলাদা বিষয়। এদের মধ্যে…। ‘পথের পাঁচালী’র বৃদ্ধাকে আমি আসলেই অ-অভিনেতা বলব না; কারণ তার মঞ্চের কাজের কিছু অভিজ্ঞতা ছিল আর সংলাপ মুখস্ত রাখার ক্ষমতাও ছিল। ‘অপরাজিত’র বৃদ্ধ লোকটি একদম তাৎক্ষণিক পাওয়া। তিনি ছিলেন একদম আনকোরা যার অভিনয়ের কোনো জ্ঞান বা ধারণাই ছিল না। তাদের দিয়ে ভালো কাজ করানোটা তখনই সম্ভব হবে যখন আপনি তাদের কাছে একটা বিশেষ আবেগ পৌঁছে দিতে পারবেন। যদি সে এটা বুঝতে পারে, তাহলে সে সেটা করতেও পারবে। কিন্তু সবসময় তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে সম্পর্কিত করে আবেগটা অনুভব করাতে হয়।
আমি একবার ডি সিকাকে ‘উমবার্তো ডি’-এর বৃদ্ধ লোকটাকে তিনি কীভাবে তৈরি করেছিলেন সে ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম …
হ্যাঁ, কিন্তু ডি সিকার বৃদ্ধ লোকটি পুরো ছবিটা জুড়েই ছিল। আর আপনি দেখবেন আমার ছবির বৃদ্ধ লোকটি একসপ্তাহ বা কিছু সময়ের জন্য ছিল। ‘উমবার্তো ডি’র বৃদ্ধ লোকটি ইতালির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। আমি যতদূর জানি তাকে খুব কম বলা লাগত। তিনি সবসময় একা থাকতেন। যদি কোনো অভিনেতার এই ক্ষমতা না থাকে তাহলে তাকে পরিচালনা করার ব্যাপারে আপনাকে অনেক সচেতন থাকতে হবে। কারণ সে কতটুকু অঙ্গভঙ্গি করবে সেটার সীমাই জানে না এবং এর কারণে পর্দার সামনে অনেক বেশি করে ফেলে।
এবং সেজন্য আপনি অঙ্গভঙ্গিও নির্দেশ করে দেন?
হ্যাঁ, একদম। সবসময়। পেশাদার শিল্পীদের বেলাতেও এটা করতে হয়। আমার মনে হয় বেশিরভাগ লোকেরই ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে কম অভিনয় না করে বরং অতিরিক্ত কিছু করার প্রতি বেশি প্রবণতা কাজ করে, এমনকি যারা কখনো অভিনয় করেনি তাদেরও।
অপুর দিদিকে কী আপনি খুব নিয়ন্ত্রিত ও শৃঙ্খলিতভাবে পরিচালনা করেছিলেন?
অপুর চেয়ে অনেক কম। মেয়েটির সহজাতভাবেই ভীষণ প্রতিভা ছিল। আমার যেটা প্রয়োজন সেটা অবশ্যই ওকে বলতাম কারণ অভিনেতাদেরকে বলতেই হবে আপনি কী চাইছেন।
মাঝেমাঝে আমি প্রতারণা করতাম; যেমন, হঠাৎ অপুর অজান্তে ওর পাশে আতশবাজি জ্বালানো হলো এবং ও এমন একটা অভিব্যক্তি করলো যেটা পরে ব্যবহার করা হলো। আমরা ‘পথের পাঁচালী’তে এটা করেছি। বিশেষত যেখানে দুর্গা পুতুলের গলার হারের বিষয়টি নিয়ে মায়ের কাছে বকা খেয়েছে এবং অপু পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। এবং সব অভিব্যক্তিই একরকম কৌশলে বের করে আনতে হয়।
আপনি কি সেখানে আতশবাজি ব্যবহার করেছিলেন?
আতশবাজি ঠিক না। ছেলেটাকে একটা কাঠের চৌকির উপর দাঁড় করানো হয় এবং আমার একজন সহকারী একটা লাঠি নিয়ে টুলে পাশে আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং ওই অভিব্যক্তিটা তৈরি হয়। এসব করাই লাগে সবসময়; এবং শিশুদের সাথে অবশ্যই। পৃথিবীর সব ধৈর্য্য আপনার থাকা লাগবে। এবং মাঝেমাঝে তারা দুর্দান্ত। ‘মহানগরের’ ছেলেটা একটা আশীর্বাদ উপহার। সাত বছর বয়স কিন্তু সংলাপ মুখস্ত রাখার অসাধারণ ক্ষমতা। আমি ওর সংলাপ বাড়িয়ে দিয়েছিলাম, কারণ আমি দেখলাম ও ক্যামেরার সামনে দারুণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলতে পারে।
তাহলে যেভাবে বললেন যে সাধারণত আপনি অ-অভিনেতাদের কাছ থেকে যেটা চান সেই অভিনয়ভঙ্গিটা দেখিয়ে দেন অথবা তাদেরকে বলেন যে আমি যেমন বলব তেমন করবে; অথবা তাদের যথাযথ অভিব্যক্তি বের করে আনার জন্য কৌশল ব্যবহার করেন?
বিশেষ পরিস্থিতিতে এসব কৌশল করা হয়। খুব সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি পাওয়ার জন্য। কিন্তু একটা সাধারণ সিন হলে আপনার এমনটা করার সুযোগ নেই। আপনাকে বলে দিতে হবে আপনি কী চাইছেন। কিন্তু তারপরেও কোথায় হাতটা রাখতে হবে, কীভাবে মাথাটা ঘোরাবে এবং কোথায় অল্প একটু সামনে এগিয়ে যাবে এসব নির্দেশ সবসময় করে দিতে হবে।
আপনি মহড়া করেন?
খুব বেশি নয়।
মহড়া ছাড়া ৪:১ অনুপাতে কীভাবে তৈরি করেন?
অবশ্যই কম বেশি এই অনুপাতটাই থাকে। কিন্তু ‘চারুলতা’ ছাড়া আমার সব চলচ্চিত্রে অনেক ত্রুটি আছে। ‘চারুলতাকে’ আমার বানানো চলচ্চিত্রগুলোর ভেতর সবচেয়ে ত্রুটিমুক্ত বলা যায়।
আমি অন্তত একবার মহড়া করাই। দুই তিনবারও করাই। সবসময় একটু হলেও মহড়া থাকে। যদি স্টুডিওতে শ্যুট হয় তাহলে সেট, সরঞ্জাম, জিনিসপত্র সব ঠিকঠাক তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কোনো মহড়া হয় না। কারণ আমি মঞ্চের মহড়ার মতো বসার ঘরে বসে মহড়া আমি করি না। আমি এমন পারি না। কথাগুলো পড়তে বলি। কখনো আমি পড়ে নিই একবার কিন্তু অভিনয় করি না। আমি অভিনয়টা অল্প দেখিয়ে দিই কিন্তু খুব বেশি না।
একজনের অভিনয়ের স্বতন্ত্র রীতিটা পুরোপুরি নির্দেশ করে দিয়ে নষ্ট করি না। আমি সবসময় একজনের নিজস্ব অভিনয়ের ধরণ ও সে কতটুকু আমাকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে সেটা খুঁজে বের করতে পছন্দ করি। আপনি দেখুন আমি সেই লোকটাকে অভিনয় করতে বলি, প্রথমে কোনো ভঙ্গি ছাড়াই কথাগুলো শুধু পড়ি। কোনো কিছু ছাড়া এবং তারপর ভঙ্গিগুলো বলে দিই। এভাবে করতে হবে, কীভাবে তোমার কাচঘড়িটা তুলবে, বা এভাবে ফুলের টবে জল দেবে। প্রথম মহড়াটা আমি একদম কাচামাল হিসেবে ব্যবহার করি কারণ আমি তখন জানি তারা কী করতে পারে। কখনো কখনো তারাও আমাকে ধারণা দেয়, কখনো তারা আমার আকাঙ্ক্ষার চেয়ে বেশি ভালো করে। আপনি দেখবেন এসবের জন্যই আমি এটা ব্যবহার করি।
অ-অভিনেতারা কী তাদের সম্ভাবনা হারায়?
বারবার মহড়া করার কারণে? না, তা নয়। একটা শট ১৫ বার নেওয়া হলে সেটা খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়ে যায়। প্রায় অনিবার্যভাবে খারাপ হয়ে যায়। দ্বিতীয়বারের শটটা যদি ভালো উন্নত না হয় তবে প্রথমটার চেয়ে তখন তৃতীয় বার নিতে হয়। না পারলে কখনো আমি এর বেশিবার শট নিই না।
যদি কোনো অপেশাদার শিশু বা বয়স্ক অভিনেতা ঘাবড়ে যান তখন কী করেন? এমন কী কখনো হয়েছে?
হ্যাঁ শিশুদের সাথে এটা হয়েছে। তবে একটা মেয়েকে পেয়েছিলাম যাকে দিয়ে আমি কিছুই করাতে পারিনি। তার পুরো অংশটা বাদ দিতে হয়েছিল। কলকাতায় অপুর একজন বান্ধবী ছিল। আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। অনেক উত্তর আসে কিন্তু কেউ তেমন ভালো ছিল না। তারপর আমরা একদম উপযুক্ত দেখতে সেই মেয়েটাকে খুঁজে পাই। কিন্তু ক্যমেরার সামনে মেয়েটার এমন ভাবভঙ্গি ছিল যা অংশটার সঙ্গে একদম মানায় না। সে দৃশ্যপটটাই পাল্টে ফেলেছিল। আমরা যদি ওটা রাখতে পারতাম তাহলে অপুর মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকার বিচ্ছিন্নতাটা ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যেত। মেয়েটি ছিল এমন একটা অনুষঙ্গ যা শহরে অপুকে গ্রাম থেকে টেনে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু সে ছবিটাতে থাকল না এবং এটা একটা ছোটো রহস্য হয়ে রইল; মায়ের থেকে দূরে থাকার কারণ তার অনিবার্য তারুণ্য। এটা একটা রীতি, এমন কিছু ঘটে, তাই বান্ধবী না থাকলেও। আমার ধারণা আমি সৌভাগ্যবান আমার অভিনেতাদের দিকে থেকে কারণ ক্যমেরাভীতি থাকলে আপনার আসলে কিছুই করার থাকে না। যদি তারা ঘাবড়ে আড়ষ্ঠ হয়ে যায় তাহলে তাকে একটু সময় দিয়ে পরের দিন করানোর চেষ্টা করা বা অভিনেতা পরিবর্তন করা ছাড়া আপনার তেমন কিছই আপনার করার থাকে না।
যদি আমি একটু টেকনিক্যাল হই তাহলে অ-অভিনেতাদের নিয়েও ৪:১ অনুপাতে আমি দারুণ কাজ করতে পারি, যেমনটা আপনি করেছেন। আমার ধারণা এটার একটা অংশ কাস্টিং-এর কারণে হয়।
হ্যাঁ, চরিত্রদের মুখ, কণ্ঠে, কেমন দেখায় সেটা খুব বেশি নির্ভর করে। অর্ধেক কাজ তখনই করা হয়ে যায়।
সাধারণত স্ক্রিন টেস্ট করে আমরা ক্যামেরার ফিল্ম অপচয় করি না। কোনো বিশেষ অবস্থা ছাড়া। কারণ, একটা মেয়ে দেখতে হয়তো ঠিকঠাক কিন্তু বাচনভঙ্গি বা চলনভঙ্গি তার ঠিকঠাক নাও হতে পারে। তাই আমি তাকে শুধু ক্যামরার সামনে দেখতে চাই এবং সেখানেই স্ক্রিন পরীক্ষাটা হবে।
আপনি কাস্টিংয়ের জন্য কী ধরনের পরীক্ষা নেন?
আমি তেমন কিছুই করি না। সাধারণত স্ক্রিন টেস্ট করে আমরা ক্যামেরার ফিল্ম অপচয় করি না। কোনো বিশেষ অবস্থা ছাড়া। কারণ, একটা মেয়ে দেখতে হয়তো ঠিকঠাক কিন্তু বাচনভঙ্গি বা চলনভঙ্গি তার ঠিকঠাক নাও হতে পারে। তাই আমি তাকে শুধু ক্যামরার সামনে দেখতে চাই এবং সেখানেই স্ক্রিন পরীক্ষাটা হবে। সাধারণত এটা অল্প একটু সময়ের হলে আমার আপত্তি থাকে না, কিন্তু সেটা শুধু দেখা এবং তারপর দুই ঘণ্টা ধরে ঘরে বসে কথা বলে তাকে বুঝে নিতে হয়। এটাই করা হয় সাধারণত।
কারও ক্যামেরাভীতি কাটানোর জন্য আপনি তেমন কিছু করেন? আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য কিছু করেন?
সাধারণত আমি সেটা হওয়ার সুযোগ দিই না। এছাড়া আমি ভিড়ও এড়িয়ে যাই। কারণ আমি মনে করি প্রথমবার একজন ব্যক্তি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াচ্ছে আর এত লোক তাকে দেখছে এটা তার জন্য খুব কঠিন। কিন্তু এমন কোনো ক্ষেত্রে যেখানে চারপাশে শ্যুটিং ক্রু আছে; খুব অল্প সংখ্যক ক্রুই থাকে সাধারণত। এটা কোনো জনাকীর্ণ জায়গা নয়। এটা একটা স্টুডিও। হলিউডের মতো নয়।
অ-অভিনেতাদের নিয়ে শ্যুটিং করার সময় আপনি কী কী পদ্ধতিতে শটটা তৈরি করেন? মহড়া করে এবং অভিনেতা ও অন্যান্য যন্ত্রকলাকুশলীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন?
অবশ্যই, আমি সাধারণত পেশাদার ও অপেশাদার অভিনেতাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না। আপনি দেখবেন আমি কারও জন্য কোনো বিশেষ আয়োজন বা ব্যবস্থা করি না। ‘দেখো, এই লোকটা নতুন তাই একে একা ছেড়ে দাও এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে দাও’ এর বেশি কিছু না। আমি শুধু তাদের ছেড়ে দিই এবং দেখি কী ঘটে।
তাহলে আপনি কোনো শটে মহড়া কীভাবে তৈরি করেন আর ক্যামেরার জন্য প্রস্তুত করে তোলেন?
আমি শিশুদেরকে বড়োদের মতো করেই দেখি। তাদেরকে আমি আমার আত্মবিশ্বাসের জায়গায় নিয়ে আসি। এছাড়া সাধারণত আমি আমার নির্দেশনা শিশুদেরকে একদম ফিসফিস করে বুঝিয়ে দিই। আমি কখনো জোরে তাদের সাথে কথা বলি না। আমি তাদের কানে কানে আস্তে কথাটা বলি। এতে তাদের মনে হয় এটা তার আর আমার ভেতরের কোনো বিশেষ গোপন কথা। এভাবেই যোগাযোগটা তৈরি করা হয়। এবং এর কারণে সে দ্রুতই খুব আগ্রহ বোধ করে। এর পুরোটাই থাকে আমার পূর্ব পরিকল্পিত। যদি লোকেশনে হয় তাহলে আমি কাজ শুরু হওয়ার আরও কিছুদিন আগে সেখানে চলে যাই। আমি সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অনেক কৌশল ও সিদ্ধান্ত নিই ওই সময়টাতে। কারণ লোকেশন অনুযায়ী স্ক্রিপ্টের অনেক কিছু পরিবর্তন করতে হয় পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই। কারণ এমন কিছু প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় যেমন বাতাস এমন একটা দিক থেকে বইছে, গাছেরাও দুলছে আর সেটা আপনি শটে রাখতে চাইছেন তখন পুরো সেট-আপ পরিবর্তন করতে হয় কিন্তু যদি স্টুডিওতে করা হয় তাহলে সবই অঙ্কিত থাকে। আপনি দেখবেন, কারণ আমার পুরো দৃশ্যকল্পটাই কিছুটা গ্রাফিক রূপে থাকে। এটা টাইপ রাইটারে লেখা তেমন কোনো কাগজপত্র না।
যন্ত্রকুশলীদের সাথে তো আপনার কথা বলাই থাকে কিন্তু কোনো দৃশ্য করার আগে আপনি সবসময় কী অভিনয় শিল্পীদের সাথে কথা বলেন?
হ্যাঁ, তারা কম-বেশি দৃশ্যপটটা জানে এবং ঠিক কোন সিনটার শট কোনদিন নেওয়া হবে এটাও তারা আগে থেকে জানে। অপেশাদার অভিনেতারাও সেটা জানে। আমি বলতে চাইছি পুরো বিষয়টিই সবাই জানে। যদি এটা একটা বড়ো গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয় তখন তারা পুরো গল্পটাই জানে। কারণ আবারও আমাদের একটা পাঠপর্ব হয় যেখানে তাদের প্রায় সবাই উপস্থিত থাকে। যদি কোনো ব্যস্ত অভিনেতা সেদিন সময় দিতে না পারেন তাহলে আমি তার সঙ্গে আলাদাভাবে সময় দিই, সেটা আমার বাড়িতেও হতে পারে। সুতরাং তারা সকলেই গল্পটা জানে কম-বেশি।
এবং আপনি যখন সেট বা লোকেশনে যান তখন আপনার ক্যামেরাম্যানের আঙ্গেলগুলো তখনই জানা থাকে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ অবশ্যই। যদি আমি আগেরদিন সন্ধ্যায় নতুন কিছু ভেবে কোনো পরিবর্তন না করি। কোনো পরিবর্তন হলে সেটা দ্রুত তাকে জানাতে হয়। পরের দিন সকালে আমি লোকেশনে পৌঁছে প্রথমে যেটা করি সেটা হলো তাকে বলি ‘দেখো আমি নতুন অ্যাঙ্গেল ভেবেছি’। যেমন নতুন চলচ্চিত্রটায় আমরা ভিড় এড়ানোর জন্য প্রতিনিয়ত কিছ না কিছু পরিবর্তন করছি।
তাহলে আপনি যখন সেটে যান এবং যন্ত্রশিল্পীরা তৈরি হচ্ছে তখনই আপনি মহড়া শুরু করেন নাকি অপেক্ষা করেন?
সবকিছু তৈরি হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করি। আলো তৈরি শেষ হওয়ার পরে আমি মহড়া করি।
আপনি কি আপনার টেকনিশিয়ানদের সাথে আদৌ পুরো বিষয়টার মহড়া করে নেন?
কিছু কিছু বিষয় করি। এখান থেকে এখানের চলনগুলো। যদি কোনো জটিল সিন হয়; যেমন ১৫ জন লোক একইদৃশ্যে একসাথে চলাফেরা করবে, কথা বলবে তাহলে সেটার মহড়া আপনাকে করতেই হবে। পুরোপুরি যত্নের সাথে করা চাই।
অনেক মানুষকে সাথে নিয়ে বড়ো সিন করা ছাড়া পুরো সেট তৈরি না হলে আপনি মহড়া করেন না?
ওরকমই প্রায়। নাহলে বারবার ব্যাঘাত ঘটে। মহড়ার সময় আমি কোনো ব্যাঘাত পছন্দ করি না। কিন্তু চলার জন্য, আলোর জন্য স্বাভাবিকভাবেই ক্যামেরাম্যান জানেন অভিনেতারা ঠিক কী করবে, তারা কখন কোন অবস্থানে গিয়ে দাঁড়াবে। তাই সেটা হয়েই যায়, কিন্তু যথাযথ মহড়া শুরু হয় সেট পুরো তৈরি হওয়ার পরে। এবং মহড়ার পরপরই আমি শটের টেক নিয়ে নিই। একদম পরেই। যখন সেটা তাদের হৃদয়ের মধ্যে সজীব থাকে।
এবং সেই মুহূর্তে আর কোনো টেকনিক্যাল ব্যাঘাত ঘটে না?
ছোটো একটা। প্রত্যেক ক্যামেরাম্যান চূড়ান্ত মহড়ার সময় অন্তত একবার ব্যাঘাত ঘটায়। এটা ঘটতে বাধ্য কিন্তু এটা তেমন বড়ো কিছু নয়।
দুই বছর ধরে ‘পথের পাঁচালী’র শ্যুটিং চলাকালিন সময়ে আপনার অ-অভিনেতারা পুরোদস্তুর অ-অভিনেতা হয়ে না থেকে কি ‘অভিনয়’ শুরু করেন?
তারা প্রত্যেকে আনকোরা ছিল না। ওদের মধ্যে কিছু পেশাদার অভিনেতারাও ছিল। কিন্তু আমাদের বৃদ্ধা মহিলাকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা ছিল, কারণ চলচ্চিত্রটা বানাতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছিল এবং আপনি জানেন না আসল সময়ে কী হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে যখন শ্যুটিং বন্ধ ছিল তখন আমরা যথাসম্ভব সচেতনতার সাথে ওনার স্বাস্থ্যের খবরাখবর রাখতাম, তিনি কেমন আছেন। কারণ অর্ধেক হওয়ার পরে আমরা একজনকে হারিয়েছিলাম; মিঠাইওয়ালা, যিনি ক্যান্ডি বিক্রি করতেন। এর ফলে ওই চরিত্রে দুজন মোটা লোক ছিলেন, একজনের পরবর্তীতে আরেকজন। ‘পথের পাঁচালী’র কাজ পুরোটা শেষ হওয়ার দুই মাস পরে ওই বৃদ্ধা মারা যান। কিন্তু তিনি পুরো চলচ্চিত্রটা দেখে যেতে পারেননি।
আপনি ওনার কাছ থেকে দুর্দান্ত অভিনয় পেয়েছেন। যেমন সেই বিখ্যাত মুহূর্তটা যখন তিনি অসুস্থ অবস্থায় ফিরে আসেন, প্রতিবেশির কাছ থেকে একটা শাল নেওয়ায় যখন পরিবার থেকে তাকে একঘরে করে দেওয়া হয়।
যখন সে একটু জল খেতে চায়। হ্যাঁ এই চিত্রটা খুবই পরিচিত। অভিনেতারা বুঝতে পারে যে তাকে বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করতে হবে। যে সংলাপগুলো দেওয়া হয় তা যদি সঠিকভাবে মনঃপূত ও স্বাভাবিকভাবে বলতে পারে তখন আপনি সেটা পাবেন। আপনি দেখবেন লোকেশনে এমন কিছু জিনিস ঘটে যা স্টুডিওতে ঘটে না। চারপাশে সত্যিকার পরিবেশ, গাছ-পালা এবং অন্যান্য কিছু থাকলে তারা দারুণ স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে অভিনয় করতে পারেন।
এসসো (ESSO )-এর প্রযোজনায় ওয়ার্ল্ড থিয়েটার সিরিজের অংশ হিসেবে একটা শর্ট স্টোরি ফিল্ম তৈরি করাটা আমার জন্য ছিল একটা নতুন অভিজ্ঞতা। এগুলোর কিছু ছিল গ্রিস থেকে, কিছু সুইডেন, কিছু ইংল্যান্ডের। ভারতীয় অংশে ছিল তিনটি শর্ট ফিল্ম। একটা ছিল বোম্বের ব্যালে নাচের দল নিয়ে। একটা রবি শঙ্করের সেতার বাদন নিয়ে এবং পরিচালক সেখানে কিছু সংগীত ব্যাখ্যা করেন। এর মধ্যে তারা আমাকে বলেন আমার পছন্দের কোনো গল্পে ইংরেজি ভাষার সংলাপ রেখে কয়েক মিনিটের একটা ছোটো ছবি বানাতে। আমি কখনো ইরেজি ভাষায় বাংলা ছবি বানাতে চাই না। তাই দুটি বাচ্চাকে নিয়ে একটা সংলাপবিহিন ছবি বানালাম, টু। একটি দরিদ্র ও একটি ধনী ছেলে। এটা মোট ১৬ মিনিটের ছবি।
এবং এই ছবিটাও আপনি যেভাবে বলেছেন সেই যথাযথ নিয়ন্ত্রণে তৈরি করেছেন?
হ্যাঁ, কারণ এটা ৩ দিনে শ্যুট করা হয়েছিল। এটা এত দ্রুত করা হয়েছিল যে আমি অভিনেতা বালকদুটিকে গল্প বা কিছুই বলতে পারিনি। তাদের শুধু কিছু জিনিস করতে বলা হয় এবং এটা হলো কাটিং যা ছবিটাকে দাঁড় করিয়েছিল। আপনি দেখবেন, পুরো গল্পটা জুড়ে অনেক ক্রিয়াকলাপ রয়েছে। বিশেষত ধনী ছেলেটির। এটা একটা চলমান-সময়ের ছবি যা পনেরো মিনিটে শেষ করা হয়। এটা একটা ১৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবি। ধনী ছেলেটা একটা বিরাট বাড়িতে একা, আগের রাতের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সে বেলুন, খেলনা এবং আরও অনেক কিছু পেয়েছিল। ছবিটার শুরুতে আপনি দেখতে পাবেন ধনী পরিবারের ছেলেটির মা গাড়িতে করে বেরিয়ে যাওয়ার পরে ছেলেটি সারা বাড়িতে একা হয়ে পড়ে। তখন সে নিজের ঘরে গিয়ে যান্ত্রিক খেলনাগুলো নিয়ে খেলতে থাকে, সাজাতে থাকে। এবং তখন হঠাৎ জানালা দিয়ে দেখতে পায় খুপরিতে থাকা খুব গরীর একটি ছেলে তার নিজের ছোটো একটা বাঁশি, ঘুড়ি প্রভৃতি খেলনা নিয়ে খেলছে। এই দুজনের ভেতরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তাদের নিজেদের অবস্থান দেখানো এবং যখন গরীব ছেলেটি ঘুড়ি ওড়াতে শুরু করে ধনী ছেলেটির ঘুড়ি নেই, তাই সে হিংসা বোধ করে আর সেটা নেওয়ার চেষ্টা করে। সে ঘুড়িটা নিচে নামানোর চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না কিন্তু তখন সে একটা ছোটো এয়ার-গান নিয়ে এস লক্ষ্য স্থির করে ঘুড়িটিতে গুলি করে। ঘুড়িটি নিচে পড়ে যায়। এবং এরপর ধনী ছেলেটা তার সব যান্ত্রিক খেলনা চালিয়ে দেয়। কিন্তু তার রোবটটি হাঁটতে থাকে আর আগের তৈরি করা খেলনা ইটের তৈরি স্তম্ভটা ভেঙে দেয়। এবং ধনী ছেলেটি হঠাৎ শুনতে পায় গরীব ছেলেটি আবার তাঁর ছোটো বাঁশিটি বাজাচ্ছে। সুতরাং গরীব বাচ্চাটিই একদিক থেকে অদম্য। এটাই চুড়ান্ত ব্যাখ্যা।
এবং এই ছেলে দুটি অভিনেতা হিসেবে জানতই না গল্পটা কী ছিল?
না। তাদেরকে এটা খেলার মতো করতে বলা হয়, কিন্তু তারা নিহিত অর্থটা জানত না। তারা আদতে কিছইু জানত না। কারণ তাদের দুজনকে বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালনা করা হয়। আমরা তাদের সম্পর্কটা তৈরি করি প্রতিনিয়ত তাদের অভিনয় অংশটি পাশাপাশি বসিয়ে পেছনে ও সম্মুখের কাটিংয়ের মাধ্যমে। যখন গরীব বাচ্চাটিকে মুখোশ পরে লাফাতে, নাচতে বলা হয় তখন তাকে বলা হয় না যে সে এটা ধনী বাচ্চটিকে দেখানোর জন্য করছে। সে এটা করছিল একটা সুনির্দিষ্ট দিকে তাকিয়ে। এবং ধনী বাচ্চাটিকেও একইভাবে করানো হয়। আমি বলতাম ‘এটা করো, ওটা করো’ শুধু এটুকুই।
প্রায়ই আপনার চলচ্চিত্রে বিশেষত ‘তিন কন্যাতে’ যেমন স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ অভিনয় শিল্পীর মুখে ছিল যা এটাকে খুব জীবন্ত করে তোলে। আমি মনে করি একজন সত্যিকারের শিল্পীর থাকা সবচেয়ে জরুরী। এটাতে কোনো এডিটিংয়ের কিছু থাকে না
হ্যাঁ আমি জানি। আমার তখন একটা প্রতিভাবান মেয়ে ছিল ‘পোস্টমাস্টারের’ জন্য মানে চলচ্চিত্রটার প্রথম পর্বের জন্য। একটা দারুণ মেয়ে, মাত্র ১১ বছর বয়স কিন্তু সত্যি জ্ঞানী আর বোঝাপড়াসম্পন্ন এবং আমি তাকে গল্পটা বলতে পারতাম। কিন্তু অবশ্যই গল্পটা সে আগেই পড়েছিল কারণ এটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুব ছোটো একটা গল্প যেটা সবাই জানে। কিন্তু তাকে খুব অল্প কিছুই আমি বলে দিতাম যেমন, ‘তুমি কখন যাবে, এখানে তাকাও এবং ওখানে তাকাও।’ যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তার সবই নির্দেশনা অনুযায়ী করা হতো। প্রায়ই কোনভাবে কোনদিকে তাকানো হবে, কতক্ষণ তাকে থামতে হবে সেটা খুব সতর্কতার সাথে মহড়া করানো হতো। এসবের মধ্য দিয়েই ভাবটা সৃষ্টি হতো আমি মনে করি। এমনকি আমি যে লোকটাকে নিয়েছিলাম তার জন্যও এটা করা হতো যদিও তিনি একজন পেশাদার অভিনেতা।
বিরতি নিয়ে খেলেছেন?
হ্যাঁ একদম। কারণ এটা না করলে দুঃখবোধটা দেখানো যায় না।
আপনি কি একজন সুরকারও?
হ্যাঁ,। কিছুটা। এখন আমি কম্পোজ করছি। আমার নিজেকে সুরকার বলতেই হয়। এমনকি স্কুলের দিনগুলো থেকে চলচ্চিত্রের আগে পর্যন্ত সংগীত ছিল আমার প্রথম ভালোবাসা। পশ্চিমা ও ভারতীয় উভয় উচ্চাঙ্গ সংগীত। চলচ্চিত্রে সংগীতের আনুষঙ্গিক ব্যবহারে আমি খুব সচেতন থাকি।
কিছু পরিচালক যেমন করে সেটে সংগীত চালিয়ে অভিনেতাদের তৈরি করেন, আপনি তেমন করেন?
না, আমি এটা করিনি। অনেক ভারতীয় পরিচালক এটা করেন। দুঃখের গান চালিয়ে দেন বেদনার সিনের ভাবটা সৃষ্টি করার জন্য। কিন্তু আমি মনে করি পরিচালক স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সেই ভাবের মধ্যে চলে যান। আমি সেই ভাবটার ভেতরেই থাকি। আপনাকে আবেগটা অভিনেতাদের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে হবে আপনার কথার বাচনভঙ্গিমা দিয়ে, আপনি যেভাবে তাদের সাথে কথা বলেন তার ভেতর দিয়ে। এবং এটা যদি কোনো বুদ্ধিমান অভিনেতা হন, আর তার যৎসামান্য বোধবুদ্ধি থাকে, তাহলে সে নিজেই এটা অনুভব করতে পারবে। রেকর্ড বাজানো! এটা আমার কাছে প্রায় অতিমাত্রায় নাটকীয় লাগে। কখনো কখনো আমার চেষ্টা ছাড়াই ভাবটা তৈরি হয়ে যায়। ‘পথের পাঁচালী’তে সেই দৃশ্যটা, যেখানে বাবা ফিরে আসে আর মা কন্নায় ভেঙে পড়ে, এটা একটা ভীষণ বিষাদের সিন। বৃষ্টি পড়ছে, পড়ছে এবং জলকাদা আর আলোও ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। এসব কিছু বেদনার ভাবটা তৈরি করে ফেলে এবং সবই এটাকে মূল সিন হিসেবে অনুভব করতে পেরেছিল। এই দৃশ্যে সবাই উদ্বেলিত হয়ে চাপাস্বরে কথা বলছিল। এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তৈরি হয়েছিল। এটা সৃষ্টি করতে আমার তেমন কোনো পরিশ্রম দিতে হয়নি।
শিল্পীরা জানতেন কী সিন হতে চলেছে?
হ্যাঁ। আমি তাদের বলি যখন আমার মানসিকভাবে আঘাত পাওয়া কোনো আবেগের সিন করি। আবেগপূর্ণ ট্রমা সিনে পৌঁছাতে হবে। আমি কোনো কিছু চাপিয়ে না দেওয়ার চেষ্টা করি। এই আবহটা সৃষ্টি করতে আমি নিজে একটা নির্দিষ্ট মাত্রার উপরে কথাই বলিনি।
আপনি কী সেটে আপনার শ্যুটিং ক্রুদের চুপচাপ শান্ত থাকতে জোর দেন?
হ্যাঁ, আমি এটা করেছি। কারণ মাঝেমাঝে কারও মধ্যে বাচালতা বা ফাজলামি করার স্বভাব থাকে। আমি তাকে বলে দিই এমন না করতে।
আমার কোনো একধরনের গল্পের প্রতি বিশেষ আগ্রহ নেই। আমি নানান ধরনের চলচ্চিত্র তৈরি করতে চাই।
আমি আপনার প্রথম দিকের সকল ছবিই দেখেছি, এবং আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আপনি পুরোপুরি সুনির্দিষ্ট প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটা চিন্তাশীল মেজাজ তৈরি করেন এবং তার কারণে কাটিংয়ের পরে কী প্রভাব পড়বে সেটা ভাবতে হয় না।
এটা অপুর ট্রিলজিতে খুব ব্যবহার করা হয়েছিল। আমার মনে হয় পরের চলচ্চিত্রগুলোতে আর তেমন কিছু ব্যবহার করা হয়নি। ‘মহানগর’ কম চিন্তাশীল। কারণ এর গল্পটাই সেরকম নয়। আমার কোনো একধরনের গল্পের প্রতি বিশেষ আগ্রহ নেই। আমি নানান ধরনের চলচ্চিত্র তৈরি করতে চাই। এটা যদিও একটা উদ্ভট কল্পনা আমার যে আমি সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের চলচ্চিত্র বানাতে পারব এতসব কৌশল আর কাটিং করে। সম্ভবত মানুষের সজীব অভিনয়ের জন্য এটা হয়েছে। কারণ ‘মহানগরের’ গল্পটি একদম চিন্তাশীল গল্প নয়।
আপনার কাজের ধরণগুলো যোগ করলে যে সার পাওয়া যায় তা হলো— একটা খুব, খুব শক্তিশালী ও যত্নের প্রস্তুতি, খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ মহড়া এবং একটা স্বতঃস্ফূর্ত ফলাফল।
খুব বেশি যত্ন সহকারে প্রস্তুতি নিতে হয় স্বতঃস্ফূর্ত ফলাফল পাওয়ার জন্য। আপনি দেখবেন এটাই আসল জায়গা। এই ফলাফলটা পেতে আপনাকে প্রস্তুতি নিতে হবে। এটা পরিকল্পনাহীনভাবে আরও উন্নত করা যেতে পারে, কাটিংয়ের মাধ্যমে করতে হয় অথবা এটা পেতে আপনাকে প্রস্তুতি নিতেই হবে। আপনি যদি সারাজীবনের জন্য একটা প্রভাব রাখতে চান তাহলে আপনার সমস্ত প্রস্তুতি সেই লক্ষ্যের দিকে যাবে। আপনি দেখুন, আমি সম্ভবত আরও একটু ভালো করতে করতাম যদি কাঁচামালের তেমন কোনো সমস্যা না থাকত এবং অর্থ নিয়ে ভাবতে না হতো। কিন্তু আপনি এই খরচটা করতে না পারলে এটা করতে পারবেন না। আপনার পেছনে যিনি অর্থ লগ্নি করছেন তাকে আপনি সচেতনভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হতে দিতে পারেন না। মানুষের কাছে আপনার নির্দিষ্ট কিছু দায়বদ্ধতা আছে। মোট কথা, এটা আপনার নিজের টাকা নয় এবং আমার কোনো বড়ো বাজারও তৈরি হয়নি। বাজার খুব খুবই অনিশ্চিত বিশেষত এখন, পাকিস্তান হওয়ার পরে এবং পশ্চিমের জন্য। যদিও আমি প্রাথমিকভাবে পশ্চিমের জন্য আমার চলচ্চিত্র তৈরি করি না। প্রথমত আমার মনে আমার নিজের দর্শক আছে, কারণ পশ্চিম নিয়ে কেউ নিশ্চিত হতে পারে না। এখন জাপানি ছবি, এমনকি জাপানি ছবিও সেখানে ভালো করছে না। নিউইয়র্কে জাপানি ছবি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই আমি যখন একটা ছবি তৈরি করি তখন আমি কী চাই সে ব্যাপারে একদম সুনিশ্চিত থাকতেই হবে। খুব, খুব সুনিশ্চিত। অভিনয়ের ব্যাপারে, সেটাপ নিয়ে, কাটিং নিয়ে সর্বোপরি সবকিছু নিয়েই নিশ্চিত থাকতে হবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন। সাহিত্যের গবেষণায় ব্রতী। প্রবন্ধ লেখেন। অনুবাদ করতে ভালোবাসেন।