উপন্যাস কেমন হওয়া উচিত? বা উপন্যাসের সংজ্ঞা কী? উপন্যাসের সংজ্ঞা দেওয়ার আগে আপনাদের একটি গল্প শোনাই চলেন, গ্রীক রাজা মিলিন্দ গিয়েছিলেন বৌদ্ধাচার্য নাগসেনের সঙ্গে দেখা করতে। নাগসন মিলিন্দকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মহারাজ, আপনি রথে চড়ে এসেছেন। কিন্তু রথ কী? জবাবে রাজা বললেন, রথ হলো চাকা–লাগানো একটা শকট, যা ঘোড়ায় টেনে নিয়ে যায়। ঋষি জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে ঘোড়া কি রথ? রাজা বললেন, না। তবে চাকাগুলো কি রথ? ইত্যাদি। (হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি) সাধারণ একটি রথের সংজ্ঞা দেওয়াই যদি এত কঠিন হয়, তাহলে উপন্যাসের সংজ্ঞা দেওয়া আরও কত কঠিন হবে চিন্তা করুন।
উপন্যাস নিয়ে নানা পণ্ডিতের নানা রকম সংজ্ঞা রয়েছে। যদিও সেসব মাথায় নিয়ে উপন্যাস লিখতে বসলে, উপন্যাসের ‘উ’ও হবে না। আমার ধারণা কথাসাহিত্যিকরা স্ব–স্ব নিয়মেই উপন্যাস লেখেন। এটাই করা উচিত। রাসেল রায়হানও ব্যতিক্রম নন। তিনিও তাঁর উপন্যাস নিজস্ব ভঙ্গিতে লিখেছেন।
২০২২ সালের বইমেলায় জ্ঞানকোষ প্রকাশনী থেকে প্রকাশ হয়েছে রাসেল রায়হানের উপন্যাস ‘আরও গভীরে’। এ বইটি নিয়ে ইতোমধ্যে পাঠকদের মধ্যে সাড়াও পড়েছে বেশ।
উপন্যাসটি পড়ার আগে আপনাকে একটি বিষয় সম্পর্কে জানতে হবে। যদি না জেনেই উপন্যাসটি পড়েন, তাহলে লেখককে ভুল বুঝতে পারেন। আপনারা অনেকে স্টকহোম সিনড্রম নিয়ে হয়তো জানেন। ভিক্টিমই শেষে গিয়ে অপরাধীর প্রতি মমতা অনুভব করে। অনেকেই আবার অপরাধীকে ভালোওবেসে ফেলে। বিস্ময় প্রকাশ করার মতো হলেও এটি সত্য। এক্ষেত্রে আমি দুটি ঘটনার উল্লেখ করতে পারি:
১. চারজন যুবক একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে। যুবকেরা পুলিশের কাছে ধরাও পড়ে। আদালতে বিচার শুরু হয়। প্রথম দিকে মেয়েটি খুব স্ট্রংলি তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেও পরবর্তিতে তার হৃদয়ে অপরাধীদের প্রতি ভালোবাসার উদ্রেক হয়। বিচারের সময়ই চার যুবককে মেয়েটি ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু এই যুবকেরা যেহেতু অপরাধী এবং সেই অপরাধ প্রমাণও হয়েছে, তাই তাদের শাস্তি অনিবার্য। তবে মেয়েটি যেহেতু তাদের ক্ষমা করে দিয়েছে, তাই তাদের হয় সর্বনিম্ন শাস্তি। দশ বছরের কারাদণ্ড। যুবকেরা যখন জেলে, তখন মেয়েটি রেগুলার তাদের সঙ্গে দেখা করতে যেত। তাদের সঙ্গে কথা বলত। আড্ডা দিত। শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে দারুণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু মেয়েটি বাস্তবে ছিল খুবই নিঃসঙ্গ। হয়তো নিঃসঙ্গতাকে সহ্য করার ক্ষমতা তার ছিল না। শেষে মেয়েটি আত্মহত্যা করে। আর একটি সুইসাইড নোট লিখে যায়, সেখানে যুবকদের অনেক প্রশংসা করে যায় সে।
২. স্টকহোমের একটি ব্যাংকে একদল ডাকাত ঢুকে পড়ে। ডাকাত দলনেতা কয়েক জন গার্ডকে সামনে পেয়ে গুলি করে মেরে ফেলে। পুরো ব্যাংক তারা কবজা করে নেয়। বাইরে থেকে পুলিশেরা তাদের থামানোর নানা চেষ্টা করে। কিন্তু কোনোভাবেই তারা থামতে চায় না। বেশ কয়েকটি শর্ত জুড়ে দেয়। তার মধ্যে অন্যতম ছিল তার এক বন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত তার বন্ধুকে মুক্তি দিলেও অন্যান্য শর্ত কেউ মানতে পারেনি। শেষে পুলিশ গ্যাস ব্লাস্ট করে। সবাইকে অজ্ঞান করে বন্দিদের মুক্তি করে দেয়। আর ডাকাতদের পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। আদালতে যখন বিচার শুরু হয়, ঘটে অদ্ভুত ঘটনা। সেখানে যত বন্দি ছিল, সবাই ডাকাতদের পক্ষে কথা বলে। কেউ বলে, আমি ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলাম, ডাকাতদের একজন আমাকে জ্যাকেট দিয়ে হেল্প করে। সবাই–ই তাদের পক্ষে কথা বলে।
রাসেল রায়হানের যে উপন্যাসটি আপনি পড়তে যাচ্ছেন, এ বইয়ের ভেতরের গল্পের এমনই বুনন, যেখানে আপনি প্রথম থেকেই আটকে যাবেন। এক লাইন আপনাকে নিয়ে যাবে, আরেক লাইনের দিকে।
তো এরকম ঘটনা ঘাটলে আরও অনেক পাওয়া যাবে। স্টকহোমের এ ঘটনাটি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, এর নামকরণ করা হয় স্টকহোম সিনড্রম।
এত কাহিনি কেন বললাম! কারণ রাসেল রায়হানের যে উপন্যাসটি আপনি পড়তে যাচ্ছেন, এ বইয়ের ভেতরের গল্পের এমনই বুনন, যেখানে আপনি প্রথম থেকেই আটকে যাবেন। এক লাইন আপনাকে নিয়ে যাবে, আরেক লাইনের দিকে।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মুনিয়া। ছোটোবেলা ধর্ষণের স্বীকার হওয়া মুনিয়া কীভাবে নিজের জীবন নিয়ে এগিয়ে যায়। তারই অ্যাখ্যান রয়েছে এ উপন্যাসে। মুনিয়াকে নিয়ে পাঠকদের মনে সহানুভূতি তৈরি হবে। এ চরিত্রটি এমনভাবে এঁকেছেন, আপনাদের মনে হবে এমনও মানুষ হয়। কিন্তু আগেই বলেছি স্টকহোম সিনড্রমের কথা। গল্পের স্পয়লার দিতে চাই না। শুধু এতটুকুই বলব, পাঠক উপন্যাসটি পড়ুন। নিশ্চিতভাবেই উপন্যাসের গভীরে আপনারা ঢুকে যাবেন।
এ উপন্যাসের গদ্য খুবই সাবলীল। যদিও উপন্যাসটি বড়োদের জন্যই লেখা। তবু স্বতঃস্ফূর্ত বাষার জন্য যেকোনো পাঠকই এ উপন্যাস এক নিশ্বাসে পড়ে যেতে পারবেন।
উপরের স্টকহোম সিনড্রমের যে ঘটনাটি বললাম, তা এ উপন্যাসে উঠে এসেছে। যেকোনো মনোযোগী পাঠক পড়লেই তা বুঝতে পারবেন। তবে উপন্যাসের বিস্তার আরও গভীরে। মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে লেখক দারুণভাবে খেলেছেন। পাঠকও সেই খেলায় অংশ নেবেন বলেই আমার বিশ্বাস।
জন্ম নবাবগঞ্জে। গল্পকার , উপন্যাসিক ও অনুবাদক। প্রকাশিত উপন্যাস : ‘নিজের সঙ্গে সঙ্গম’।