আকাশবাণী কলকাতার পক্ষ থেকে সত্যজিৎ রায়ের এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয় ১৯৭৯ সালের ২৭ নভেম্বর। এটি গ্রহণ করেন অসীম রেজ। শ্রী-র ‘শতবর্ষে সত্যজিৎ’ সংখ্যার জন্য সাক্ষাৎকারটি ভিডিও থেকে অনুলিখন করেছেন আলী রেজা পিয়াল।
অসীম রেজ : নমস্কার সত্যজিৎ বাবু। আপনিতো একজন শুধুমাত্র চিত্রপরিচালকই নন একজন দারুণ চিত্রশিল্পী, সংগীতরসিক এবং লেখক। আমরা জানি প্রথম জীবনে আপনি চিত্রশিল্প নিয়ে ছিলেন এবং চিত্রশিল্পের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও আপনি দীর্ঘদিন জড়িত ছিলেন। অথচ পরবর্তী জীবনে আমরা দেখলাম আপনি চলচ্চিত্রকে আপনার প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন। কিন্তু অন্যান্য মাধ্যম ছেড়ে আপনি হঠাৎ চলচ্চিত্রকে আপনার প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে কেন ভালো মনে করলেন? যদি একটু বলেন।
সত্যজিৎ রায় : প্রথমত একটা কথা বলতে চাই যে আমি অন্যান্য মাধ্যমগুলো কিন্তু সম্পূর্ণ ছাড়িনি। যেমন আমি ছবি এখনো আঁকি। আমার নিজের একটা পত্রিকা আছে ‘সন্দেশ’ বলে। তার জন্য আমাকে রেগুলার ছবি আঁকতে হয়। তার উপর আমি লিখছি, যেটা আপনি নিজেই বললেন। আমি গপ্প লিখি এবং আমার নিজের ছবির জন্য আমার চিত্রনাট্য লিখতে হয়, সে কাজটাও করি। তাছাড়া, গান-বাজনা আমার শখ ছেলেবেলা থেকে। সংগীত রচনাও আমাকে করতে হয়। ছবির জন্য আবহ সংগীত লিখি। তারপর বর্তমান ছবির জন্য গান লিখেছি, গানের কথা লিখেছি, গানের সুর দিয়েছি ইত্যাদি।
আমি… সত্যি বলতে কি ছবি করার সঙ্গে সঙ্গে আমি অন্য কাজগুলো ছবি করার তাগিদেই কিছুটা, আর কিছুটা তার বাইরেও আমি চালিয়ে যাচ্ছি। ফিল্মটা বেছে নিয়েছি, কেননা বিজ্ঞাপনের আপিসে আমি দশবছর কাজ করেছিলাম। কাজটা আমার খুব ভালো লাগছিল না। আমি স্বাধীন শিল্পী হতে চেয়েছিলাম।
আমি… সত্যি বলতে কি ছবি করার সঙ্গে সঙ্গে আমি অন্য কাজগুলো ছবি করার তাগিদেই কিছুটা, আর কিছুটা তার বাইরেও আমি চালিয়ে যাচ্ছি। ফিল্মটা বেছে নিয়েছি, কেননা বিজ্ঞাপনের আপিসে আমি দশবছর কাজ করেছিলাম। কাজটা আমার খুব ভালো লাগছিল না। আমি স্বাধীন শিল্পী হতে চেয়েছিলাম। আপিসে বসে, ডেস্কে বসে কাজ করার মানে সেখানে একজন বস আছেন আর সেখানে মক্কেলরা আছে, তাদের কথাবার্তা শুনতে হয়, করতে হয়— এ আমার বেশিদিন ভালো লাগছিল না। কাজ হয়েছিল, এতে আমার উপকার হয়েছিল। আমি নানারকম ব্যপারে উৎসাহিত হয়ে পড়েছিলাম। অক্ষরের ব্যাপার, লেখার ব্যাপার, লিপির ব্যাপার, টাইপোগ্রাফির ব্যাপার— এগুলোতে আমার তখন অনেক ইন্টারেস্ট হয়েছিল। তাছাড়া তখনই আমি ‘সিগনেট প্রেস’ এর সাথে যুক্ত হয়েছিলাম। তাদের জন্য বইয়ের মলাট আঁকা, গল্পের জন্য ছবি আঁকা এই কাজগুলোও তখন বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সঙ্গেই করতাম। কিন্তু ফিল্মে আমার প্রচণ্ড উৎসাহ ছিল এবং সেটা ক্রমেই বাড়ছিল। এবং আরেকটা কারণ ছিল এই যে বাংলা ছবি দেখে মনে হতো ছবি আরও অনেক ভালো হতে পারে। এবং ছবির জগতে খুব বেশি সংখ্যায় প্রতিভাবান ব্যাক্তি ছিলেন না বলেই আমার ধারণা। যেখানে সেইসব ছবির সঙ্গে বাইরের ছবির সঙ্গে তুলনা করা যেত। তখন মনে হয়েছিল যে একটা ছবি করা যাক না, দেখা যাক না; কেননা ফিল্ম নিয়ে আমি পড়াশোনা করছিলাম। আমার বিজ্ঞাপনের কাজের ফাঁকে ফাঁকেই আমরা ফিল্ম সোসাইটি তৈরি করেছিলাম, ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা আরম্ভ করেছিলাম, ফিল্ম নিয়ে আলোচনা করতাম, সমালোচনা করতাম। কাজেই তারপরে আমি ফিল্মটায় গেলাম এবং প্রথম ছবিতেই যখন এতটা সাফল্য অর্জন করা হলো, সকলে মিলে ‘পথের পাঁচালী’, তখন তো ও লাইনটা ছাড়ার আর প্রশ্ন ওঠে না।
অসীম রেজ : আচ্ছা একটা ভালো আর্ট ফিল্ম বলতে আপনি কী বোঝান? চিত্রকলা বা আপনার সাহিত্যে বা সংগীতে যে ধরণের এবস্ট্রাকশন সম্ভব সেটা কি চলচ্চিত্রে সম্ভব?
সত্যজিৎ রায় : চিত্রকলায় অ্যাবস্ট্রাকশন সম্ভব, সংগীতে সম্ভব, সাহিত্যে আর কী করে সম্ভব? কারণ সাহিত্য একটা গল্প বলে অনেকক্ষেত্রেই এবং ফিল্মও গপ্প বলে, কাহিনিপ্রধান বলা যেতে পারে। সাধারণত ফিল্মকে যেটা বলে, কাহিনিপ্রধান। কাজেই সেখানে একটা গল্প, সাধারণ দর্শক যখন ছবি দেখতে যায় তাঁরা গল্পই দেখতে যায়। কিন্তু সে গল্পকে বলার মধ্যেই আর্ট। সেটাই হচ্ছে আর্ট। সেটা অ্যাবস্ট্র্যাক্ট শিল্প, তাকে বিমূর্ত শিল্প নিশ্চয়ই বলা যায় না, কেননা ছবিতে আমরা ফিল্ম দেখতে গিয়ে যখন মানুষ দেখছি, একধরণের জীবনযাত্রা দেখছি, পরিবেশ দেখছি, নাটক দেখছি, তখন সেটাকে আর অ্যাবস্ট্র্যাক্ট কী করে বলা যায়? সেখানে মানুষ ভীষণভাবে ইনভল্বড হয়ে যায়। কিন্তু কথা হচ্ছে ফিল্ম নানারকম হতে পারে। সেতো আপনারাও জানেন। আপনারা নানারকম ছবি দেখেন, আপনারা বোঝেন। যেরকম সাহিত্য নানারকম হতে পারে, একজন লেখক তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে, তাঁর কতরকম অভিব্যক্তি, কতরকম তাঁর ভাষার ব্যবহারের ওপর কতরকম তাঁর মধ্যে তারতম্য আসতে পারে, তাঁর বিষয়বস্তুর মধ্যে কতরকম তারতম্য আসতে পারে। তার কিছুটা কাব্যধর্মী হতে পারে, কিছুটা একেবারে বাস্তবধর্মী হতে পারে, নানারকম হতে পারে। ফিল্মেও সেরকমই হয়। ফিল্মটাকে কাজেই… আপনি আর্টফিল্ম বলছেন যেটা, সেটাও… আর্টফিল্ম কাকে বলে আমি নিজে ঠিক জানি না। কেননা আমার মনে হয় আমি নিজে যে ধরনের ছবি করি তাতে আমি গল্পই বলার চেষ্টা করি কিন্তু সেই বলাটার মধ্যেই একটা বলতে পারেন আর্টিস্টিক বা শিল্পসুলভ কতগুলো গুণ যাতে থাকতে পারে সেইদিকে আমি দৃষ্টি রাখি। এবং সেটা খুব সাদামাটা ভাবেও বলা যায়। কোনোরকম তাতে কল্পনার প্রয়োজন হয় না বা কোনোরকম শিল্পের প্রশ্ন না তুলেও ছবি করা যায়। যেটা অনেকেই করে। কিন্তু ফিল্মের একটা আলাদা… শিল্পমাধ্যম তো বটেই সেটা তো আপনারাও স্বীকার করেন। কাজেই সেই শিল্পমাধ্যমটাকে ঠিক শিল্পীসুলভ দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করার মধ্যেই আর্ট।
অসীম রেজ : কিন্তু আমরা অনেক সময় আপনার ফিল্মে দেখেছি, বিশেষত আপনার একটি বিশেষ ছবির কথা মনে হচ্ছে, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ যেখানে অনেক ক্ষেত্রেই চলচ্চিত্রের ভাষা সাংকেতিক হয়ে গেছে এবং আমাদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়েছে এবং আমাদের মনে হয়েছে যে আপনি চলচ্চিত্রের ভাষাকে আমাদের তথাকথিত গণসংযোগের যে ভাষা তার থেকে আলাদা রাখতে চান।
সত্যজিৎ রায় : না, একরকম হয় যে, যেমন ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ প্রধানত কিন্তু কথার ছবি। প্রত্যেকেই কথা বলছে গোড়া থেকে শেষ অব্দি। একটা ফ্যামিলি, একটা বিকেল। তারা ভাগ হয়ে যাচ্ছে, দার্জিলিং শহরে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাবা মা একসঙ্গে। দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়ে আলাদা হয়ে গেছে, আর বড়ো মেয়ে তার স্বামীর সঙ্গে মতবিরোধ চলছে, মনোমালিন্য চলছে। ছোটো একটি নাতনি আছে সে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরকম এরকম… নানারকম… সেখানে গপ্পটা যেভাবে এগোচ্ছে সেটা কথামারফত। কথা মারফত চরিত্রগুলো ক্রমশ ফুটে উঠছে। সেখানে কী সাংকেতিক ভাষার কথা বলছেন আমি জানি না। আমার মনে হয় গপ্পটার মধ্যে যেটা… ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ যখন প্রথম মুক্তি পায় তখন সেটা সাধারণের গ্রহণের পথে কতগুলো বাধা সৃষ্টি করেছিল। কারণ ‘কাঞ্চনজঙ্ঘার’ গল্পে, যেটা লোকে সাধারণত অভ্যস্ত, সাধারণ দর্শক যাতে অভ্যস্ত, সেটা হলো একজন কেন্দ্রস্থ চরিত্রকে তারা ফলো করতে চায়। তাদের সঙ্গে আইডেন্টিফাই করতে চায়। তার কি ঘটছে না-ঘটছে, কি নাটকের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, কি দ্বন্দর মধ্যে দিয়ে সে চরিত্র এগুচ্ছে এইটে তারা লক্ষ্য করতে ভালোবাসে। এখানে কোনো একজন কেন্দ্রস্থ চরিত্র নেই, এখানে পুরো ফ্যামিলিটাই কেন্দ্র। সেইজন্য মানুষের বা দর্শকের ইন্টারেস্টটা ভাগ হয়ে হয়ে যাচ্ছিল। সেটাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। একটা নতুন কিছু করার চেষ্টা করা, যেখানে একজন কেন্দ্রস্থ চরিত্রকে আমি অনুসরণ করব না। যেখানে একটা ফ্যামিলিই হবে কেন্দ্র। যদিও তার মধ্য থেকেও একটা বিশেষ চরিত্রর ওপর আমার একটু পক্ষপাতিত্ব নিশ্চয়ই লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সেই ছোটো মেয়ে, যার সাথে সেই অশোক বলে ছেলেটির একটি সম্পর্ক শেষপর্যন্ত গড়ে ওঠে। এখন এটাও আমি বলব যে ছবির দৈর্ঘ্য হয় মোটামুটি ধরুন দেড়ঘন্টা থেকে দুঘন্টা। যেসমস্ত ছবি খুব একটা সহজ সরল পথ বেছে নেয় না, সেখানে হয়তো একবার দেখে সে ছবির সম্পূর্ণ রস গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আমার নিজের মনে হয় যে ভালো গান, ভালো গ্রামোফোন রেকর্ড, মানে কথার কথা বলছি, আমি একটা ভালো ধ্রুপদী সংগীতের রেকর্ড কিনলাম, আমার এত ভালো লাগল যে আমাকে বারবার শুনতে হচ্ছে। তারমানেই হচ্ছে তারমধ্যে এতরকম জিনিস আছে, গুণ আছে ছোটো ছোটো, যেগুলো বারবার শুনলে পরে তবে সঠিক হৃদয়ঙ্গম করা যায়। পুরো জিনিসটার ফর্মটা মাথার মধ্যে আসে। সেরকম ফিল্মও, আমি বলব, আমার মনে হয় না ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ খুব কঠিন ছবি। যেমন আজকালকার তরুণ পরিচালকদের মধ্যে, বাংলাদেশে বেশি না হলেও, শুধু বাইরেও তাঁরা একধরণের চলচ্চিত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন যেখানে তাঁরা ধরেই নিয়েছেন সেটা সাধারণ লোকের দেখার জন্য নয়। সেখান ভীষণ একটা ব্যক্তিগত,সংকীর্ণ একটা পদ্ধতি তাঁরা ব্যবহার করছেন। কিন্তু আমি ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সম্মন্ধে সেটা ঠিক বলে মনে করি না। সেখানে আলাদা আলাদাভাবে বিচার করে দেখলে সবকটা ঘটনাই খুব সহজবোধ্য। সবকটা সম্পর্কই এবং সবকটা নাটকের উপাদানই খুব সহজবোধ্য এবং সাধারণের গ্রহণযোগ্য।
অসীম রেজ : প্রসঙ্গত আপনি বললেন সংগীতের যে ফর্ম চলচ্চিত্রে সেই ফর্ম আপনি ব্যবহার করেন। তাহলে কি আপনার মনে হয় যে চলচ্চিত্র এবং সংগীত মূলত একটা জায়গায় এক?
সত্যজিৎ রায় : একটা ভীষণ বেসিক মিল আছে চলচ্চিত্র এবং সংগীতের। যেমন সংগীতও… একটা ছবি দেয়ালে টাঙানো আছে সেটা আপনি দু’মিনিট ধরে দেখবেন, পাঁচমিনিট ধরে দেখবেন নাকি আটমিনিট ধরে দেখবেন সেটা সম্পূর্ণ আপনার মর্জির ওপর নির্ভর করছে। এবং অনেকে বলবেন যে আমি পাঁচমিনিট দেখেই ছবিটাকে পুরো বুঝে ফেলেছি আবার অনেকে বলবেন, না আমার আরও বেশি বারবার দেখার দরকার হচ্ছে। একটা বই, একটা উপন্যাস আপনার পড়তে লাগল দু’দিন, আমার পড়তে লাগল পাঁচদিন, আরেকজনের পড়তে লাগল তিনঘন্টা। এরকমও তো হয়! এবং সেটা যখন ইচ্ছে হয় আপনি মাঝে মাঝে থামছেন, ভাবছেন, বই বন্ধ করছেন, লেখক কি বলল সেটা হৃদয়ঙ্গম করছেন, আবার খুললেন, আবার পড়লেন এভাবে একটা বই আপনি পড়তে পারেন। কিন্তু একটা ফিল্মকে, যখন আপনাকে অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়ে বসিয়ে দেওয়া হলো, তখন ওই দেড়ঘন্টা বা দু’ঘন্টা ধরে সেটা পুরোটা চলার পরে এবং সেই একবারের মধ্যেই আপনাকে পুরো জিনিসটাকে বুঝে ফেলতে হচ্ছে। সেরকম সংগীতও— সংগীত যখন একটা রেকর্ড, আপনি যখন গ্রামোফোন নিডিলটি রাখলেন সে যতক্ষণ না রেকর্ডটা শেষ হচ্ছে এবং সেটা একটা নির্দিষ্ট সময়, সেই সময়ের মধ্যে তার বিস্তৃতি, তার ফর্ম, এই ফর্মটা হচ্ছে একটা সময়ের মধ্যে বিস্তৃত। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিস্তৃত যেটা এদিক ওদিক করবার কোনো উপায় নেই। সংগীতও যেরকম, চলচ্চিত্রও সেরকম। সেখানে একটা ভীষণ মিল রয়েছে। কাজেই সংগীতের যেমন ছন্দের প্রয়োজন, চলচ্চিত্রেরও সেরকম ছন্দের একটা প্রয়োজন হয়। একেবারে হয়তো সরাসরি মিল দেখাতে গেলে মুশকিল হয়ে যাবে কারণ সংগীত গল্প বলে না। চলচ্চিত্র গল্প বলে। কিন্তু একটা অন্তর্নিহিত ছন্দবদ্ধতা ফিল্মের মধ্যে রয়েছে।
অসীম রেজ : আপনার প্রিয় সংগীতকার কারা? বিশেষত বিদেশি সংগীতের প্রতি আপনার ভালোবাসা আমরা জানি।
সত্যজিৎ রায় : আমার তো ফিল্মের চেয়েও অনেক আগে বিদেশি সংগীতের সম্পর্কে আমার কৌতূহল জেগে উঠেছিল। তখন আমি ভীষণভাবে বেঠোফেন, মোৎজার্ট এদের বাজনার রেকর্ড শুনেছি। তারপরে এসে এটা ক্রমশই বেড়েছে এবং ফিল্ম তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে আমার রেকর্ড কেনার কাজ চলেছে এবং ততদিনে ধরুন আমি যখন কলেজে উঠি তখন থেকে আমার কিন্তু ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীত সম্বন্ধেও একটা সমান গভীর কৌতূহল এবং ইন্টারেস্ট… ভালোবাসা তখন উঠেছে। তখন আমরা রাত জেগে কনফারেন্সে যেতাম, গান শুনতাম তখনকার দিনে। আলাউদ্দিন খাঁর গান। তখনো রবিশংকর টবিশংকর তত ওঠেননি আর কী। কিন্তু তখনকার দিনে যারা বড়ো ছিলেন, হাফিজ আলী, আলাউদ্দিন বা আফায়াজ খাঁ বা গোলাম আলী— এদের সব গান আমরা প্রচুর শুনেছি। দুটো পাশাপাশি, দুটোর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমার মনে হয় আমি দুটোকেই সমান ভালোবাসতাম। কোনোটাকে বাদ দিয়ে জীবন কল্পনা করতে পারতাম না।
অসীম রেজ : আপনার বই ‘Our Films, Their Films’ আমরা দেখেছি আপনি বলেছেন যে সংলাপ মাঝে মাঝে প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এবং আপনি ওখানে সাইলেন্ট ফিল্মের কথা বলেছেন। আপনি কি সাইলেন্ট ফিল্ম করার কথা কিছু চিন্তা করছেন?
সত্যজিৎ রায় : না, ও জিনিসটা তো একেবারে অবসোলিট হয়ে গেছে। ওটা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তবে আমরা সবাক ছবির মধ্যে মধ্যেই এমন একটা মুহূর্ত তৈরি করার চেষ্টা করি যেখানে কথার প্রয়োজন হয় না। এবং বিশেষ করে কতকগুলো…কি বলব! অনেক ছবিতেই এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে যেখানে বলতে পারেন শ্রেষ্ঠ মূহুর্তগুলো এমন যেখানে কোনো কথা বলা হয়নি। যেখানে শুধু ছবির সাহায্যে, ইমেজের সাহায্যে বা কোনোকিছু ডিটেইলের সাহায্যে মানুষের মনে যে ধাক্কাটা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল সেই ধাক্কাটা দেওয়া সম্ভব হয়েছে বা এমনকি সংগীতের সাহায্যে দেওয়া হয়েছে। যেমন আমি উদাহরণ দেই— ‘পথের পাঁচালী’তে যখন সেই হরিহর, দুর্গার শাড়িটা এনে দিচ্ছে এবং সর্বজয়ার কান্না, সেখানে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে না, সেখানে শুধু সংগীতের শব্দ। সেই কান্নার পরিবর্তে সংগীত ব্যবহার করা হয়েছে। এবং তারপরে আরও… ‘পথের পাঁচালী’তে কথা খুব কম ছিল। ‘পথের পাঁচালী’তে এরকম অজস্র জায়গা আছে যেখানে কথা খুব বেশি ব্যবহার করা হয়নি। যেখানে নানারকম জিনিস দেখিয়ে, এনিওয়ে… যেমন ইন্দির ঠাকুরনের মৃত্যতে সে অনেকগুলো ছোটো ছোটো ডিটেইল আছে যেগুলো— ঘটিটা গড়িয়ে পড়ে যাওয়া, সেখানে কথার বেশি প্রয়োজন হয়নি। পরের দিকের ছবিগুলোতেও যেমন চারুলতা বা ইদানীংকার ছবি কিছু কিছু মনে করা যেতে পারে ‘জন অরণ্য’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ অনেকগুলোতেই এমন দৃশ্য নিশ্চয়ই আছে। তবে আমি কথাটাকে বাতিল করতে চাই না। কথার মধ্যেও, ফিল্মের সংলাপটা একটা আলাদা ব্যপার। সেটা নাটকের সংলাপও নয়, সেটা উপন্যাসের সংলাপও নয়। চলচ্চিত্রের সংলাপ এমন একটা ব্যাপার, তার একটা আলাদা ধর্ম আছে, একটা আলাদা চরিত্র আছে। সেটা রপ্ত করতে একটা সময় লাগে। আমি বলব না যে আমার প্রথম দিকের ছবির সংলাপ খুব সার্থক। সত্যি বলতে কি, যখন ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিতা’ করি তখন আমার নিজের স্বরচিত সংলাপ খুব কমই ছিল। বিভূতিভূষণের লেখার একটা গুণ হচ্ছে তিনি এমন সংলাপ লেখেন যে মনে হয় আমি লোকটার কথা কানে শুনতে পাচ্ছি। তাঁর কানটা এমনই আশ্চর্য ছিল যে তিনি লোকের বাচনভংগি এবং শব্দ, একেক শ্রেণির লোক, বিভিন্ন শ্রেণির লোকেরা কিরমভাবে, তাদের শব্দচয়নের মধ্যেও যে পার্থক্যটা আছে, সেটা বিভূতিভূষণ অসাধারণ ভালো বুঝতে পারতেন। এবং সেভাবেই লিখতেন। সুতরাং ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ করতে গিয়ে আমাকে নিজের খুব একটা মাথা খাটাতে হয়নি সংলাপ লেখার ব্যাপারে। বিভূতিভূষণ থেকেই আমি আমার সংলাপ পেয়ে গেছি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। সামান্য যখন একেক সময় হয় যে অভিনেতা বলতে গিয়ে একটুখানি অসুবিধা বোধ করেন, তখন বোঝা যায় যে এখানে ফিল্মের সংলাপ হবে। এখানে এই শব্দটার বদলে এই শব্দ ব্যবহার করলে বোধহয় সুবিধা হবে বা এই শব্দটা বাদ দিলে হয়তো সুবিধা হবে। এরকম অনেকসময় হয়েছে। পরে ক্রমশ ‘তিনকন্যা’, ‘দেবী’, ‘অভিযান’ এইসব থেকে সংলাপটা সম্মন্ধে আমি ভীষণ সচেতন হয়ে পড়ি। এবং সংলাপের একটা ব্যাপার হচ্ছে সেটা যে শুধু গল্প বলায় বা চরিত্র পরিস্ফুটনে সাহায্য করবে তা নয়। সেটা এমন সংলাপ হওয়া উচিত যেটা অভিনেতার পক্ষে বলা সহজ হবে। যেটা কানে শুনলে মনে হবে যে হ্যাঁ, এই চরিত্র এরকমই কথা বলবে। এই অবস্থায়, এই বিশেষ অবস্থায় এই ধরণেরই কথা বলবে, এইভাবেই কথা বলবে, এইসবই বলবে, এই শব্দগুলোই তারা প্রয়োগ করবে। সেটা ক্রমশ হয়ে হয়ে এখন আমার ধারণা হয়েছে সংলাপ ব্যপারটা আমার এখন অনেকটা রপ্ত হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন থেকেই এবং আমাকে আর মূল উপন্যাসের সংলাপের ওপর খুব নির্ভর করতে হয় না। মুল উপন্যাস পড়ে তার থেকে যেগুলো আমার হৃদয়কে স্পর্শ করে সেটা চরিত্রই বলুন বা প্লটই বলুন, ঐ দিকগুলোর দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হয়। এই তিনটে চারটে ব্যাপার রয়েছে। মানে কত কম কথায় মূল জিনিসটা ব্যক্ত করা যায়। ছবিতে সময়ের দাম ভীষণ। তাই দীর্ঘ কাল ধরে… দীর্ঘসূত্রিতা বা মন্থরতা চলে না। যদিও সেটাও বিষয়বস্তু নির্ভর। একেকসময় বিষয়বস্তু এমনই হয় যে সেটার মেজাজই হয় ঠাঁই। যেটা নিয়ে তাড়াহুড়ো করা যায় না। যেমন মুম্বাইয়ের ছবিতে যেমন মারধোর মারপিট, অ্যাকশন যাকে বলে, আমাদের সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনে অ্যাকশন তো তেমন নেই। তাই আমাদের গপ্পোও, আমার জোরটা একটুখানি মনস্তত্বের দিকে তাই বেশি। মনস্তত্ত্ব, একটা চরিত্রকে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা যাতে দর্শক তাকে পুরোপুরি চিনতে পারে। যাতে সে কি করছে না-করছে তার জীবনে কি ঘটছে না-ঘটছে সে সম্বন্ধে যেন একটা কৌতূহল মনে জাগ্রত হয়। একটা লোককে যদি চিনতে না পারি তাহলে তো তার সঙ্গে কোনো হার্দিক সম্পর্ক হয় না। সেই চরিত্রগুলোকে চিনিয়ে দেওয়ার মধ্যে সংলাপের একটা ভূমিকা আছে নিশ্চয়ই। একমাত্র সংলাপই যে কাজটা করে তা নয়। সে কি করছে না-করছে তার অ্যাকশন যেটাকে বলে সেগুলোও… ওই যে বলছিলাম ফিল্ম জিনিসটার মধ্যে অনেকগুলো ব্যপার মিলেমিশে একাকার হয়ে রয়েছে। সেগুলোকে সবসময় আলাদা করে ভাগ করা যে যায় তা না। ভাগ করার খুব একটা প্রয়োজনও আছে বলে আমি মনে করি না।
অসীম রেজ : সংলাপের কথা তো জানলাম। মাঝে আপনার ‘অশনি সংকেত’ চলচ্চিত্রে রং ব্যবহার নিয়ে আমাদের সজ্জন দর্শকদের কাছে খুব একটা দুর্বোধ্য বলে মনে হয়েছে। আমরা ভেবেছি যে এরকম দুর্ভিক্ষের ছবিতে রং ব্যবহার করা হলো কেন, এধরণের আপত্তি আমরা অনেকে শুনেছি। কিন্তু আমরা জানি যে রংকে আপনি একটা বিশেষ উপাদান হিসেবে চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন। চলচ্চিত্রের রং এর বিষয়ে আপনি যদি কিছু বলেন।
সত্যজিৎ রায় : আমি আগে ‘অশনি সংকেত’ সম্বন্ধে দুটো কথা বলে নেই। সেটা হলো এই যে যারা এই ধরনের আপত্তি তুলেছেন তারা আমার মনে হয় না মূল উপন্যাসটা আদৌ মন দিয়ে পড়েছেন। বিভূতিভূষণের লেখাতে এইটা একটা বিশেষ বক্তব্য ছিল যে ১৯৪৩ এর যে মন্বন্তর সেটা কিন্তু খরার থেকে হয়নি। ফসলের কোনো অভাব ছিল না এবং হয়েছিল কতকগুলো কৃত্রিম কারণে। যেকারণে ওটাকে ম্যান মেইড ফেমিন বলা হয়। বিভূতিভূষণ বারবার তাঁর গল্পের মধ্যে দেখিয়েছেন যে প্রকৃতি সুন্দর এবং প্রকৃতি সেই মন্বন্তরের সময়েও অসুন্দর ছিল না। সেখানে তার প্রাচুর্য্য, তার মধ্যে সবুজ, শ্যামলা, ফুল, ফল সবই ছিল তখন। কিন্তু মানুষগুল মরছিল। এই কনট্রাস্টটাই হচ্ছে ‘অশনি সংকেত’ এর সবচেয়ে বড়ো কথা। যে কারণে আমি রং ব্যবহার করে দেখাতে চেয়েছিলাম যে যেহেতু লোকে মরছে বা খেতে পারছে না সেহেতু পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি যে তাতে অসুন্দর হয়ে যাচ্ছে বা তারাও যে এতে অংশগ্রহণ করছে তা নয়। দুটোর মধ্যে একটা কনট্রাস্ট এবং সেটাই হচ্ছে এই ছবির শিল্পের কথা। এরকম হতে পারে যে… তাছাড়া আরেকটা কথা আমি বলব যে রঙের মধ্য দিয়ে অনেক বেশি ইনফরমেশন দেওয়া যায়। যেটা কথা… যেকারণে অনেকসময় সংলাপ ব্যবহার না করলেও চলে। যেমন উদাহরণ দিচ্ছি, ধরুন সাদাকালো ছবিতে একজন মেয়ে যদি একটা হলদে শাড়ি পরে বা নীল শাড়ি পরে সেটা কিন্তু স্ক্রিনে সাদা দেখাবে। কিন্তু আপনি যদি বিধবা বোঝাতে চান তাহলে রঙিন ছবিতে সেই মহিলাকে ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড় করালেই তিনি বিধবা হয়ে যাবেন। কাউকে বলতে হবে না ‘আহা ওর স্বামী মারা গেলেন সেদিন তাই দেখো না থান পরে রয়েছে’ এরকম কথা কাউকে বলতে হবে না। তারউপর সিঁথির সিন্দুর ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ছবিতে বোঝা যায় না। লাল আর কালোর তফাত করা যায় না। কাজেই কালো চুলের মধ্যে সিঁদুর এক্সপোজড হয় না। দেখা যায় না। সেখানে রঙে বিবাহিত যদি বোঝাতে চান, একবার মুখটা এলেই তক্ষুণি সেই ইনফরমেশনটি অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছে যাবে। এছাড়া আরও অনেক ইনফরমেশন দেওয়া যায়। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘাতে’ সেটা আমি প্রথম এক্সপেরিমেন্ট করেছিলাম। যে একেকজন চরিত্র— তার জামা, যে পোশাকটা পরেছে সেই বিশেষ বিকেলটায়। এখানে কিন্তু জামার কোনো পরিবর্তন ছিল না, এটা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘার’ একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। এজন্য আমি রংটা আরও বেশি ব্যবহার করেছিলাম। যে দুঘন্টার গল্প, তারা বিকেলে বেড়াতে বেড়িয়েছে, দুঘন্টা পরে গল্পটা শেষ হয়ে যাবে। সেখানে তাদের পোষাক পরিবর্তন করার কোনো প্রশ্নই উঠছে না। তাদের একেকটা গ্রুপকে যখন দেখা যাচ্ছে সেই রংয়ের তারতম্যের মধ্যে সেই গ্রুপের একজন বাপ, গম্ভীর মানুষ তিনি, ধূসর রঙের স্যুট পরেছেন। তারপর তার স্ত্রী একটা লালপেড়ে শাড়ি পরেছেন। এগুলো থেকে বাঙালির মনে একটা অনুরণন জাগে আরকি। ছেলে সে উশৃঙ্খল, সে হালকা মনের প্রকৃতির ছেলে, সে একটা নানা রংয়ের রংদার পুলওভার পরেছে। তার চরিত্র তার থেকে ফুটে বেরোচ্ছে। এইরকম আর কী ব্যাপার। এইধরণের জিনিস ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইটে সম্ভব না। যেটা কালারে প্রচুর সম্ভাবনা আছে। এখন যখন রংটাকে আমরা কন্ট্রোল করতে পারি। ক্রমশই তো টেকনোলজি এগিয়ে যাচ্ছে তার সঙ্গে সঙ্গে রংয়ের ওপর কন্ট্রোলও আমাদের বেড়ে যাচ্ছে।
তরুণ পরিচালক বলতে এখন সত্যি কথা বলতে যাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা দেখেছি তারা কিন্তু বাংলাদেশের বাইরে। তারা প্রধাণত দক্ষিণ ভারতের। কর্নাটকে, কেরালাতে বা ওই ধরনের আর কি। এমনকি অন্ধ্রতেও রয়েছে দু-একজন।
অসীম রেজ : তরুণ পরিচালকদের মধ্যে, কাদের মধ্যে সম্ভাবনা দেখতে পান আপনি?
সত্যজিৎ রায় : তরুণ পরিচালক বলতে এখন সত্যি কথা বলতে যাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা দেখেছি তারা কিন্তু বাংলাদেশের বাইরে। তারা প্রধাণত দক্ষিণ ভারতের। কর্নাটকে, কেরালাতে বা ওই ধরনের আর কি। এমনকি অন্ধ্রতেও রয়েছে দু-একজন। হিন্দির মধ্যেও দুই-একজন তো উঠেছেন। যেমন : শ্যাম বেনেগাল একজন। যার কাজ আমার বেশ ভালো লাগে। বাংলায় আমি খুব বেশি সম্ভাবনার কোনো নজির আমি পাইনি। এমনিতে ছবিই কম হচ্ছে। দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বাংলা ছবি। তবে হয়তো আসবে। ওই কিছু কেরালার আদুরগোপাল কৃষনান অথবা ওদিকে গিরিশ কার্নাড আছে, এম.এস.সাথ্যু যিনি ‘গরম হাওয়া’ করেছিলেন, এদের খুব যে তরুণ বলব তা না, তবে নতুন একটা ঢেউ যেটা আসছে সেটা হচ্ছে। তবে তার কেন্দ্র বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণে।
ধরুন একটা লোক, আমি লোকই বলছি পরিচালক এখনো বলছি না। একজন লোক সে কিছু ভালো অভিনেতাকে একত্র করতে পারল। একটি ভালো ক্যামেরাম্যানকে সংগ্রহ করতে পারল, একটি পৃষ্ঠপোষক সংগ্রহ করতে পারল, একটি ভালো সম্পাদক সংগ্রহ করতে পারল, একজন সংগীত পরিচালক সংগ্রহ করতে পারল, একটা গল্প থেকে একজন চিত্রনাট্য তাকে করে দিল, সে কিন্তু ছবি করতে পারে। এবং সে ছবি মোটামুটি উৎরেও যেতে পারে। কিন্তু আপনি খোঁজ নিলে জানতে পারবেন যিনি পরিচালক, তিনি সবচেয়ে কম জানেন, এই কজনের মধ্যে। এটা একটা প্যাটার্ন। কাজেই এটা বিচার করা খুব মুশকিল। সেইক্ষেত্রে ফিল্মটা একেবারেই একটা যৌথশিল্প হয়ে যাচ্ছে।
অসীম রেজ : একজন ভালো চিত্র পরিচালক হতে গেলে কী কী গুণ থাকা দরকার বলে আপনার মনে হয়?
সত্যজিৎ রায় : এটা উত্তর দেওয়া খুব মুশকিল আমার পক্ষে। প্রথমত একারণেই কঠিন, কারণ আমার মনে হয় চিত্র পরিচালক ভালো হতে হলে প্রথমত তো ফিল্মের খুঁটিনাটি, ফিল্মের টেকনিকের ব্যপার, ক্যামেরা যন্ত্রটাকে জানতে হবে, সাউন্ড, কতগুলো টেকনোলজিকাল দিকটাকে রপ্ত করতে হবে। তারপর চোখটা খুব ভালো থাকতে হবে। মানুষ চিনতে হবে। পরিবেশ চিনতে হবে। এবং কতগুলো বিষয় যে, ছবিটা যে করছে সেটা সম্পর্কে প্রচণ্ড উৎসাহ মানে যেটা তাকে ইন্সপায়ার করবে সেই ধরনের আগ্রহ থাকতে হবে। ভালো চিত্রপরিচালকের অজস্র গুণ থাকা দরকার। হয় কি, আমাদের দেশে যেটা হয় অনেক সময়, আমি বাংলাদেশেও দেখেছি এটা যে, পরিচালক যে খুব বেশি কিছু জানেন তা না। তার নির্ভর হচ্ছে ধরুন… এটা প্রায় হয়… এটা একটা প্যাটার্ন বলা যেতে পারে। ধরুন একটা লোক, আমি লোকই বলছি পরিচালক এখনো বলছি না। একজন লোক সে কিছু ভালো অভিনেতাকে একত্র করতে পারল। একটি ভালো ক্যামেরাম্যানকে সংগ্রহ করতে পারল, একটি পৃষ্ঠপোষক সংগ্রহ করতে পারল, একটি ভালো সম্পাদক সংগ্রহ করতে পারল, একজন সংগীত পরিচালক সংগ্রহ করতে পারল, একটা গল্প থেকে একজন চিত্রনাট্য তাকে করে দিল, সে কিন্তু ছবি করতে পারে। এবং সে ছবি মোটামুটি উৎরেও যেতে পারে। কিন্তু আপনি খোঁজ নিলে জানতে পারবেন যিনি পরিচালক, তিনি সবচেয়ে কম জানেন, এই কজনের মধ্যে। এটা একটা প্যাটার্ন। কাজেই এটা বিচার করা খুব মুশকিল। সেইক্ষেত্রে ফিল্মটা একেবারেই একটা যৌথশিল্প হয়ে যাচ্ছে। এবং সেখানে পরিচালকের অবদান হয়তো সবচেয়ে কম। কিন্তু যেহেতু তিনি একজন পাকা অভিনেতা নিয়েছেন বা একাধিক পাকা অভিনেতা নিয়েছেন তাঁরা খানিকটা জিনিসটাকে নিজেদের মতো করে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। নিজেদের মতো করে গড়েপিটে নিয়েছেন। ভালো সম্পাদক আছেন, তিনি ছাঁটাইটা ভালো করেছেন। ভালো ক্যামেরাম্যান আছেন, তিনি পয়সা পাচ্ছেন বলে হয়তো তারা ইন্সপায়ার্ড হচ্ছেন। কিন্তু সেটাকে তাঁরা চাকরি হিসেবে ধরে নিয়ে তাদের মতো, তাদের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তাঁরা মোটামুটি ছবিটা দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। সেখানে কিন্তু পরিচালকই নাম কিনছেন। কিন্তু ভেতরের ঘটনা হচ্ছে, তিনি সবচেয়ে কম জানেন।
প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র। কিন্তু আগ্রহ এবং প্যাশন সিনেমাকে কেন্দ্র করে। সিনেমা নির্মাতা হবার উদ্দেশ্যে সে একাধিক শর্টফিল্ম তৈরি করেছে। সিনেমা নির্মানের পাশাপাশি লেখালেখিতে আগ্রহী। প্রকাশিত অনুবাদের বই রিচার্ড ফাইনম্যানের লেখা ‘সিক্স ইজি পিসেস’।