‘All that I know most surely about morality and obligations I owe to football’— Albert Camus
কখনও শুনেছেন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন কোনো ফুটবলার? ব্রাজিলের কালো মানিক পেলে, ছিয়াশির মহানায়ক ডিয়েগো ম্যারাডোনা বা টোটাল ফুটবলের জনক ইয়োহান ক্রুইফের মতো সর্বকালের সেরা ফুটবলাররা অনেক অনেক ট্রফি জিতেছেন বটে কিন্তু নোবেল পাননি। ফুটবলে আবার নোবেল দেওয়া হয় নাকি? আপনার অনুমান শতভাগ সঠিক। অবশ্য এক ফুটবলার ঠিকই নোবেল পেয়েছিলেন। তিনি অবশ্য খেলার জগতের কোনো পরিচিত নাম নয়। তবে সেরা সাহিত্যিকদের তালিকা করলে ওপরের সারিতেই থাকবেন। ‘দ্য প্লেগ’, ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’ ও ‘দ্য মিথ অব সিসিফাস’-এর মতো সৃষ্টকর্ম যাঁর হাত দিয়ে সৃষ্টি। এবার নিশ্চয় বুঝে ফেলেছেন কার কথা বলছি? বিখ্যাত ফরাসি লেখক ও দার্শনিক আলবেয়ার কামু। একটু মজার ছলে বলতে গেলে, তিনিই একমাত্র ফুটবলার যাঁর হাতে উঠেছে নোবেলের মতো ভারী পদক। কিশোর বয়সে জন্মভূমি আলজেরিয়ার রেসিং ইউনিভার্সিটিতেই আলজেরিওসের জুনিয়র দলে খেলতেন কামু। সামলাতেন গোলপোস্ট। তাঁর দল উত্তর আফ্রিকান চ্যাম্পিয়নস কাপও জিতেছিল। ফুটবল সম্পর্কে সবচেয়ে আকর্ষণীয় কথাটি বলেছিলেন তিনিই, ‘নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের বিষয়ে আমার যা জ্ঞান তার জন্য আমি ফুটবলের কাছে ঋণী।’
আপনার মনে হতে পারে ফুটবল ভালোবাসতেন বলেই হয়তো জীবনের নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কে অমন উক্তি করেছিলেন কামু। আসলেই কি ফুটবল তেমন কিছু শেখায় আমাদের?
জীবনকে একটা ফুটবল মাঠ হিসেবে কল্পনা করুন তো। যেখানে আপনার সঙ্গী আরও ১০ জন আর প্রতিপক্ষ ১১ খেলোয়াড়— বল নিয়ে বিপদসীমায় ঢুকলে শত্রুর মতো যারা আপনার থেকে বল কেড়ে নেবে। নিতে না পারলে ট্যাকল করবে। ধাক্কা মারবে। আর সব কিছু এড়িয়ে যখন আপনি শটটা নিলেন গোলপোস্টের দিকে, অমনি গ্লাভস হাতে ছোঁ মেরে বল লুফে নিতে চিলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন এক গোলরক্ষক।
এই দেখুন, একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছি আপনাকে। আচ্ছা, জীবনকে একটা ফুটবল মাঠ হিসেবে কল্পনা করুন তো। যেখানে আপনার সঙ্গী আরও ১০ জন আর প্রতিপক্ষ ১১ খেলোয়াড়— বল নিয়ে বিপদসীমায় ঢুকলে শত্রুর মতো যারা আপনার থেকে বল কেড়ে নেবে। নিতে না পারলে ট্যাকল করবে। ধাক্কা মারবে। আর সব কিছু এড়িয়ে যখন আপনি শটটা নিলেন গোলপোস্টের দিকে, অমনি গ্লাভস হাতে ছোঁ মেরে বল লুফে নিতে চিলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন এক গোলরক্ষক। ফুটবল এমনই। কখনও আপনাকে এনে দেবে স্বর্গীয় সুখ। কখনও ডোবাবে কাঁদাজলে।
গোল পেতে কঠোর সাধনা আপনাকে করতেই হবে। তেমনই ব্যক্তিজীবনে সফল হতে চায় না এমন কে আছে? সফলতাও যে এমনি এমনি আসে না তা তো ভালো করেই জানেন। তার জন্য নিজেকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলে ফুটবল স্কোয়াডের মতো কোনো প্রতিষ্ঠানে জায়গা করে নিতে হয়। যেভাবে ব্রাজিলের ফাভেলা থেকে উঠে এসেছেন রিভালদো-রোনালদিনহোর মতো তারকারা। তাঁদের মতো ওপরে ওঠার সিঁড়ির জন্য একের পর এক ড্রিবলিং দিয়ে ছুটতে হয়। বল পায়ে যেভাবে ছুটে যান লিওনেল মেসি। অথবা নেইমার যেভাবে ডস দিয়ে বোকা বানান ডিফেন্ডারদের। তারপর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো গোলপোস্টে নিতে হয় তীব্র গতির শট। গোলার মতো ছুটে যাওয়া সে শট গোলপোস্টের নিশ্চিদ্র প্রহরীকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে যাবে জালে। আপনার সফলতাও তদ্রুপ। অনেক কাটাকুটির পর গঞ্জালো হিগুয়েনের মতো সহজ গোলের সুযোগ হাতছাড়া করলে আর নিস্তার নেই। স্টেডিয়ামে বসে দুয়ো শুনতে হবে দর্শকদের। রাগে চুল ছিঁড়বেন কোচ। জীবন বাস্তবতার সঙ্গে সাযুজ্য পাচ্ছেন তো? ব্যর্থ হলে আপনি হবেন সফলদের হাসির পাত্র। আর সফলতা এলে হয়ে উঠবেন ব্যর্থদের আইকন।
কিন্তু জীবনে তো সফলতাই সবকিছু নয়! এমনকি ভালো খেলোয়াড়ও একজন মানুষ। তাঁর ভেতরেও নীতি-দুর্নীতি থাকে। কিন্তু ম্যাচের আগে তিনিও চান নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য দলে জায়গা পেতে। চোটে বা ফর্মহীনতার কারণে একবার যদি জায়গা হারান তবে নিজেকে আবার দলে দেখতে অনেকদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে আপনাকে। জীবন এমনই প্রতিযোগিতাপূর্ণ যে আপনার জায়গা নেওয়ার জন্য আরও ১০ জন হা করে বসে আছে। জায়গা ধরে রাখতে একজন ফুটবলারকে খাটতে হয় প্রচুর। পরিশ্রম ছাড়া আর কোনো উপায় যে নেই!
আমি বলছি না, মানুষ হিসেবে আপনি অত্যন্ত খারাপ বা ভালো (প্রকৃত অর্থে প্রাণী মাত্রই এই দুই বিশেষ্য পদের মিশেল)। আপনার এই ভালো-মন্দ-নীতি-রাজনীতি সব মূলত টিকে থাকার জন্য লড়াই। এর জন্য আপনাকে কতো না পরিশ্রম করতে হয়! কিন্তু সফল হতে গিয়ে নৈতিকতা বিসর্জন দিলে আম ও ছালা দুই-ই যাবে। কামু তাঁর উক্তিতে এসবকে ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন কি না জানি না। অস্তিত্ববাদী দার্শনিক হিসেবে তাঁর যে খ্যাতি সেখানে ফুটবলের এই টিকে থাকার অস্তিত্বও হয়তো প্রভাব রাখতে পারে। আমি জোর দিয়ে তা বলতে পারব না, কেবল অনুমান করে বলা। আমি বিষয়টাকে এভাবেই ভেবে নিয়েছি। আপনি ভিন্নভাবে ভেবে নিতে পারেন।
আজ থেকে ৬২ বছর আগে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান কামু। কৈশোরে ফুসফুসের ক্ষতিকর রোগ টিউবারকুলোসিসে আক্রান্ত না হলে হয়তো বুটজোড়া তুলে রাখতেন না। খেলা ছাড়লেও তিনি আমৃত্যু ভালোবেসে গেছেন ফুটবলকে। ছিলেন ক্লাব রেসিং ইউনিভার্সিটিতেই আলজেরিওসের সমর্থক। কিন্তু ফ্রান্সে এসে সমর্থন করতেন রেসিং ক্লাব দে প্যারিসকে। কারণ তাঁর সাবেক দলের জার্সির সঙ্গে ফ্রান্সের এই ক্লাবটির জার্সি ছিল প্রায় একই। ১৯৫৭ সালে নোবেল জয় করেন কামু। একই বছর ‘ফ্রান্স ফুটবল’ তাঁকে ফুটবল নিয়ে একটি লেখার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু নোবেল প্রাপ্তির পর ব্যস্ততার কারণে লেখাটা তেমন বড়ো করে লিখতে পারেননি। ‘ফ্রান্স ফুটবল’ লেখাটা প্রকাশ করে ১৯৫৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর সংখ্যার ব্যাক পেজে। ওই সংখ্যার কাভার ফটো করা হয়েছিল ইউরোপিয়ান ফুটবলের বর্ষসেরা পুরস্কার জেতা রিয়াল মাদ্রিদ কিংবদন্তি আলফ্রেডো দি স্তেফানোর ছবি দিয়ে।
পেনাল্টি বা টাইব্রেকারে গোলরক্ষক ছাড়া আর কেই-বা আছে দলকে জেতানোর জন্য! অনেক চাপ ও উদ্বিগ্নতা তাকেই তো সামাল দিতে হয়! তার ঢাল বলতে তো ওই গ্লাভসজোড়া। স্পট-কিক নেওয়ার আগে ঝানু সমরবিদের মতো গোলরক্ষক পড়ে ফেলেন প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের মনকে। চোখ দেখে স্থির করেন কোনদিকে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। সেই স্নায়ুযুদ্ধে বেশিরভাগ সময় তিনি হারেন বটে। তবে সে ব্যর্থতা ভুলে জীবন যুদ্ধের মতো তাকে ফের দায়িত্ব পালন করে যেতে হয় গোলপোস্টের।
কামু মনে করতেন, ফুটবলের সবচেয়ে নাটকীয় ও দার্শনিক ভূমিকাটা পালন করেন গোলরক্ষক। নিজেও গোলরক্ষক ছিলেন কিনা! একলা কাকতাড়ুয়ার মতো গোলপোস্ট রক্ষা করেন গোলরক্ষক। লড়াইয়ের সরঞ্জাম নিয়ে অন্যের লড়াই দেখতে থাকেন গোলরক্ষক। প্রতিপক্ষ যখন এগিয়ে আসে তখন নিজের ঘর বাঁচানোর জন্য সতর্ক হয়ে ওঠেন তিনি। ডাক দিতে থাকেন সতীর্থদের পিছিয়ে আসা বা এগিয়ে যাওয়ার জন্য। মাঝে মাঝে তিনি কৌশল বুঝে বল ঠেলে দেন সতীর্থের দিকে। পেনাল্টি বা টাইব্রেকারে গোলরক্ষক ছাড়া আর কেই-বা আছে দলকে জেতানোর জন্য! অনেক চাপ ও উদ্বিগ্নতা তাকেই তো সামাল দিতে হয়! তার ঢাল বলতে তো ওই গ্লাভসজোড়া। স্পট-কিক নেওয়ার আগে ঝানু সমরবিদের মতো গোলরক্ষক পড়ে ফেলেন প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের মনকে। চোখ দেখে স্থির করেন কোনদিকে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। সেই স্নায়ুযুদ্ধে বেশিরভাগ সময় তিনি হারেন বটে। তবে সে ব্যর্থতা ভুলে জীবন যুদ্ধের মতো তাকে ফের দায়িত্ব পালন করে যেতে হয় গোলপোস্টের। আমি হলফ করে লিখে দিতে পারি, গোলরক্ষক ছাড়া আপনি কোনো ফুটবল দল গঠন দূর কি বাত, মাঠেই নামতে পারবেন না। তেমনি জীবনের জন্য প্রথমত আপনাকে নিজেই নিজের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে উঠতে হয় এবং সামাল দিতে হয় ঘর। ঠেকাতে হয় শত্রুর একেকটি মারণাস্ত্র। তার জন্য প্রথমে আপনাকে পরিশ্রম করে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। তারপর সাহায্য করতে পারবেন আপনজনকে।
ফুটবল কেবল খেলাই নয়, দর্শনও। যে দর্শনে কেবল হার-জিত থাকে না। থাকে একসঙ্গে পথ চলার বার্তাও। লিভারপুলের অ্যান্থেম বা ক্লাব সংগীত ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক এ্যালোন’ নিশ্চয় অনেকবার শুনেছেন। জীবনের অর্থটাই হলো, ‘সবাইকে নিয়ে চলো।’ জয়-পরাজয় শেষে প্রতিপক্ষের দিকে হাত বাড়িয়ে বলো, ‘দারুণ খেলেছো।’ লড়াই ও মারামারি হবে। তবে সব ভুলে শেষ পর্যন্ত ফুটবলই মানুষকে নিয়ে আসে এক কাতারে। এমনটা আর কোথাও দেখা যায় না।
এই কারণেই হয়তো কামুর মতো তাঁর বন্ধু জ্যাঁ-পল সার্ত্র, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, জে কে রাউলিংয়ের মতো লেখক ও জ্যামাইকান সংগীতশিল্পী বব মার্লে ফুটবলকে এত ভালোবাসতেন। জীবনের অসংখ্য ঝড়-ঝাপটা সইলেও তাঁরা জানতেন, ফুটবলারদের মতো হারার আগে হাল ছাড়া যাবে না। দৌড়ে যেতে হবে টানা ৯০ মিনিট। ফুটবলের মতো জীবনকে অর্থবহ করতে সমাজে বিস্তার ঘটাতে হয় শিল্প ও নান্দনিকতার। ফুটবলে পাওয়া শিক্ষাটাই কামু পরে তাঁর জীবনে কাজে লাগিয়েছিলেন।
উপল বড়ুয়া। জন্ম: ১৯ ডিসেম্বর। রামু, কক্সবাজার। প্রকাশিত বই: কানা রাজার সুড়ঙ্গ (কবিতা), উইডের তালে তালে কয়েকজন সন্ধ্যা (কবিতা), তুমুল সাইকেডেলিক দুপুরে (কবিতা) ও ডিনারের জন্য কয়েকটি কাটা আঙুল (গল্প)।