জাহাঙ্গীর কেন, কোনো মুঘল সম্রাটকে নিয়েই লেখালেখির ইচ্ছে ছিল না আমার। ইচ্ছেটা তৈরি করল একটি বই। আব্রাহাম এরালি-র ‘Emperors of the Peacock Throne’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের শেলফে পাওয়া অসাধারণ এক বই। গল্প না ইতিহাস বোঝা কঠিন। শুরুটা মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবরের পিতা উমর শেখ মির্জার পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত কবুতরের ঘর এবং অজস্র কবুতরসহ নিচের পাহাড়ি নদীতে পড়ে মারা যাওয়ার গল্প। প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই আর চোখ সরানোর উপায় নেই। ইংরেজিতে যেসব বইকে ‘unputdownable’ বলে তেমনই একটি। পড়তে পড়তে সমস্ত শক্তি আর সীমাবদ্ধতা, মহানুভবতা আর নির্মমতা নিয়ে বাবর ও তাঁর বংশধরদের ইতিহাস যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। সে বইটি পড়েই সিদ্ধান্ত নিই হয় এটির অনুবাদ করব নয়তো এর আলোকে কিছু একটা লিখব। তারই ফল: ময়ুর সিংহাসনের সম্রাটেরা, ২০১৯ বইমেলায় যেটি প্রকাশ করে বাতিঘর।
এরালি মুঘলদের নিয়ে আমার মনে যে আগ্রহের সূচনা করে দিলেন সেটি মেটানোর জন্য একের পর এক বই পড়তে লাগলাম মুঘলদের নিয়ে। কী বৈচিত্র্য উজবেকিস্তানের ছোট্ট রাজ্য ফারগানা থেকে এসে গোটা ভারতবর্ষ তিন শতাব্দীর বেশি সময় শাসন করে যাওয়া এই রাজবংশটির! জাতিতে চাগতাই তুর্কি, তৈমুর লংয়ের সরাসরি বংশধর— অথচ নাম হলো ‘মোঙ্গল’-যে পরিচয় বাবর সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করতেন!
২০২১। শতাব্দীর ভয়াবহতম মহামারীতে আক্রান্ত গোটা পৃথিবী। ঘরে বন্দি হয়ে আছি, এরই মধ্যে মুঘলদের নিয়ে আরেকটি বইয়ের খবর পেলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না সেটি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সিলেট বাতিঘর থেকে বইটি কিনে আনালাম। বইয়ের নাম ‘Jahangir: An Intimate Portrait’। লিখেছেন পার্বতী শর্মা। চতুর্থ মুঘল সম্রাট নুরুদ্দিন মুহম্মদ জাহাঙ্গীরের অতুলনীয় এক জীবনী। এরালির মতোই গল্পের ঢঙে লেখা। পড়তে পড়তে আবার একটি পরিকল্পনা মনের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করল। এবার আর ইতিহাস নয়, লিখব জাহাঙ্গীরকে নিয়ে আস্ত একটা উপন্যাস। কিন্তু লিখতে বসার আগে আদ্যোপান্ত জানতে হবে খেয়ালী এই সম্রাটকে, জ্যান্ত মানুষের চামড়া ছাড়ানোর নৃশংসতা যিনি দেখাতে পারেন, আবার কবিতা কিংবা শিল্পীর আঁকা ছবির সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে থাকতে পারেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ফিকশন আর নন-ফিকশন মিলিয়ে বেশ কয়েকটি বই পড়লাম, আর না-লেখা উপন্যাসটির পৃষ্ঠাগুলো মনের মধ্যে জন্ম নিতে লাগল। ২০২১-এর শুরুর দিকে হাত দিলাম উপন্যাসে, মাসতিনেক পর শেষ হলো। এটিই হলো ‘আলমপনাহ্’ লেখার গল্প। আমার এ পর্যন্ত লেখা সবচেয়ে বৃহদায়তন উপন্যাস।
কী দেখাতে চেয়েছি এই উপন্যাসে? বিস্মরণ আর বিভ্রান্তির আঙরাখা সরিয়ে পাঠকের চোখের সামনে জীবন্ত করে তুলতে চেয়েছি অনেকের চোখেই ছয় মহান মুঘলের মধ্যে সবচেয়ে কম উল্লেখযোগ্য জাহাঙ্গীরকে। একই সঙ্গে দেখাতে চেয়েছি সতেরো শতকের সূচনালগ্নের ভারতবর্ষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বাস্তবতাকে।
কী দেখাতে চেয়েছি এই উপন্যাসে? বিস্মরণ আর বিভ্রান্তির আঙরাখা সরিয়ে পাঠকের চোখের সামনে জীবন্ত করে তুলতে চেয়েছি অনেকের চোখেই ছয় মহান মুঘলের মধ্যে সবচেয়ে কম উল্লেখযোগ্য জাহাঙ্গীরকে। একই সঙ্গে দেখাতে চেয়েছি সতেরো শতকের সূচনালগ্নের ভারতবর্ষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বাস্তবতাকে। ইতিহাসকে আশ্রয় করে এর আগেও উপন্যাস লিখেছি আমি। সাড়ে তিন হাজার বছর আগের মিশরকে নিয়ে লিখেছি ‘নেফারতিতি’। ঔপন্যাসিকের হাতে অতীতকে নতুন করে নির্মাণ করার যে ‘পোয়েটিক লাইসেন্স’ থাকে তার যথেচ্ছ ব্যবহারে আমি বিশ্বাসী নই। এ কারণে ‘নেফারতিতি’তে কল্পনার ঘোড়াকে ইচ্ছেমত ছুটতে দেইনি, দেইনি ‘আলমপনাহ্’তেও। উদাহরণস্বরূপ, জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আনারকলি নামে এক কল্পিত চরিত্রের প্রেম নিয়ে বহু গল্পগাথা আছে, মুঘল-ই-আজম চলচ্চিত্রের অন্যতম উপজীব্যও সেটি। কিন্তু ‘আলমপনাহ্’-তে আনারকলির অস্তিত্বই নেই, কারণ মূলধারার ইতিহাসবিদদের কেউই স্বীকার করেন না আনারকলি নামে কেউ জাহাঙ্গীরের জীবনে ছিলেন। তাহলে ‘আলমপনাহ্’ কি নেহাতই ইতিহাসের চর্বিত চর্বন? তাও নয়। ইতিহাসের সত্যকেই উপন্যাসের আদলে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। যেসব ঘটনাপর্ব বিস্মৃতির কুয়াশায় ঢেকে গেছে, কল্পনার তুলিতে সেখানে নির্মাণ করেছি উপন্যাসের বাস্তবতাকে। কল্পকাহিনি নয়, ইতিহাসের দায় মিটিয়ে একটি উপন্যাসই রচনার চেষ্টা করেছি। কতটুকু সফল বা ব্যর্থ হয়েছি সেটি পাঠক বলবেন।
সতেরো দশকের সূচনাপর্বটি কেবল মুঘলদের নয়, ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। মহামতি আকবরের মৃত্যুর পর রেখে যাওয়া বিশাল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে নানা সংশয় অনেকের মনে। আবার এই সেই সময়, ভারতের অতুল বৈভবের লোভে পর্তুগিজদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যখন এদেশের মাটিতে পা ফেলতে শুরু করেছে ব্রিটিশ বণিকেরা।
সতেরো দশকের সূচনাপর্বটি কেবল মুঘলদের নয়, ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। মহামতি আকবরের মৃত্যুর পর রেখে যাওয়া বিশাল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে নানা সংশয় অনেকের মনে। আবার এই সেই সময়, ভারতের অতুল বৈভবের লোভে পর্তুগিজদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যখন এদেশের মাটিতে পা ফেলতে শুরু করেছে ব্রিটিশ বণিকেরা। আকবরের জ্যেষ্ঠ পুত্র নতুন সম্রাট জাহাঙ্গীরের মধ্যে রাজোচিত সব গুণই ছিল, কিন্তু একইসঙ্গে ছিলেন ভীষণ রকমের খেয়ালী আর আবেগপ্রবণ। স্ত্রী মেহেরুন্নিসা তথা নূরজাহানের বিশাল প্রভাব ছিল তাঁর ওপর। এদিকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী পুত্র খুররম (শাহজাহান) শ্বশুর আসফ খানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পরিকল্পনা করছে মসনদ দখলের। সব মিলিয়ে দরবারের ভেতরে বাইরে চরম উত্তেজনা। ষড়যন্ত্র, পাল্টা ষড়যন্ত্রের ঢেউ সামলেই টানা বাইশ বছর রাজত্ব করেছেন জাহাঙ্গীর। মুঘলকুলশ্রেষ্ঠ পিতা এবং তাজমহলের স্রষ্টা পুত্র-এই দুই প্রবল ব্যক্তিত্বের কাছে কিছুটা ম্লান হলেও নানা কারণেই মনে রাখতে হবে জাহাঙ্গীরকে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সম্রাজ্ঞী নূরজাহান ও তাঁর প্রবাদপ্রতিম প্রেম, যা জাহাঙ্গীরের শাসনকালকে ভিন্ন এক মহিমা দিয়েছে। বস্তুত নূরজাহানকে বাদ দিয়ে জাহাঙ্গীরকে কল্পনা করা কঠিন। ‘আলমপনাহ্’ উপন্যাসে জাহাঙ্গীর ও নূরজাহানের প্রণয়গাথাকেও ইতিহাসের আলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
‘আলমপনাহ্’ পড়ার মাধ্যমে উপন্যাসপাঠের আনন্দের সঙ্গে মুঘলদের সম্বন্ধে পাঠকদের জানার আগ্রহ কিছুটা হলেও যদি নিবৃত হয় তাহলেই আমার শ্রম সার্থক। সবার জন্য শুভকামনা।
জন্ম ফেনীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বর্তমানে একই বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। লেখালেখির শুরু নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, পত্রপত্রিকায়। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি ইতিহাস, তথ্যপ্রযুক্তি, ছোটোদের জন্য রূপকথা নানা বিষয়ে লিখেছেন। বিশেষ আগ্রহ অনুবাদে। সিলভিয়া প্লাথের ‘দি বেল জার’ ছাড়াও ইতিহাসভিত্তিক কয়েকটি বই অনুবাদ করেছেন। মোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বাইশ।