ভূমিকা
ভৌগোলিক দিক থেকে ইউক্রেন ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৯১ সালে এবং তারপর থেকেই বিশ্বের কাছে আলোচিত নাম ইউক্রেন। কেননা ইউক্রেন এবং তার শিল্পকলা বিভিন্ন ঘটনার জন্য বিশ্বব্যাপী আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতি দশক বা তারও বেশি সময় ধরে ইউক্রেনীয় সমস্যা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং প্রতিবারই সেসব বেদনাদায়ক রাজনৈতিক ঘটনা আন্তর্জাতিক মিডিয়া সংস্থাগুলোর জন্য মুখরোচক ও উত্তপ্ত বিষয় হয়ে উঠেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০৪ সালের পতনের ঘটনা, যা ‘অরেঞ্জ বিপ্লব’১ নামে পরিচিত। তবে সৌভাগ্য যে, ইউক্রেনের জন্য বৈশ্বিক সংস্কৃতি এবং গণচেতনার ওপর খুব বেশি ছাপ ফেলেনি। তবে এক দশক পরে, অর্থাৎ ২০১৩-১৪ সালের শরৎকালের এবং শীতকালের বিক্ষোভ গভীর চিহ্ন রেখে গেছে এবং তা শুধু ইউক্রেনীয়দের মনেই নয়, বরং বিশ্ববাসীর মনেও দাগ কেটেছে। এছাড়া ২০২২ সালের ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার সামরিক আক্রমণ বিশ্বের কাছে উত্তপ্ত বিষয়, যা বিশ্বকে রীতিমতো দুটি আলাদা শিবিরে বিভক্ত করেছে।
ইউক্রেনীয় সাহিত্য হাজার বছরের পুরনো, যা কিভান-রুস২ গঠনের সময় থেকে শুরু হয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগেও (নবম শতাব্দীর আগে) ইউক্রেনীয় পূর্বপুরুষদের উন্নত মৌখিক ভাষা ছিল। এ কথা সত্যি যে, বর্তমানে ইউক্রেনীয় সাহিত্য বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণবন্ত সাহিত্যগুলোর মধ্যে অন্যতম।
ইউক্রেনীয় সাহিত্যকে মূলত চারটি প্রধান বিভাগে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। এগুলো হলো: কথাসাহিত্য (উপন্যাস এবং ছোটোগল্প), কবিতা, নন-ফিকশন (আত্মজীবনী, স্মৃতিগদ্য ইত্যাদি) এবং শিশু সাহিত্য। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো কথাসাহিত্য, কবিতা এবং শিশু-সাহিত্য। জানা যায়, সমকালীন কবিতা ইউক্রেনীয় সাহিত্যের একটি খুব জনপ্রিয় শাখা।
ইউক্রেনীয় সাহিত্যকে মূলত চারটি প্রধান বিভাগে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। এগুলো হলো: কথাসাহিত্য (উপন্যাস এবং ছোটোগল্প), কবিতা, নন-ফিকশন (আত্মজীবনী, স্মৃতিগদ্য ইত্যাদি) এবং শিশু সাহিত্য। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো কথাসাহিত্য, কবিতা এবং শিশু-সাহিত্য। জানা যায়, সমকালীন কবিতা ইউক্রেনীয় সাহিত্যের একটি খুব জনপ্রিয় শাখা। কেননা হৃদয়স্পর্শী অভিব্যক্তি প্রকাশের চমৎকার মাধ্যম হিসেবে কবিতা উপভোগ করা হয় এবং বেশ কয়েকজন কবি স্বদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। অনেক ইউক্রেনীয়রা কবিতা রচনায় আত্মনিয়োগ করে, যদিও তারা কখনো তাদের কবিতা প্রকাশ করতে পারে না। যাহোক, অনেক ইউক্রেনীয়দের কাছে সাহিত্য হচ্ছে বিনোদন, অভিব্যক্তি এবং সারা জীবনের আবেগ প্রকাশের একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম।
বর্তমান প্রবন্ধে ইউক্রেনীয় সাহিত্যের ইতিহাস এবং উন্নয়নের বিভিন্ন ধাপ বা সময়কাল সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তবে সমকালীন ইউক্রেনীয় সাহিত্যের গতি ও প্রকৃতি, নারী লেখকের অবদান ও সাহিত্য সৃষ্টি, অভিবাসী লেখকদের ভূমিকা ও সাহিত্য কর্ম এবং বহির্বিশ্বে ইউক্রেনীয় সাহিত্যের পরিচিতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
ইউক্রেনীয় সাহিত্যের ইতিহাস ও উন্নয়ন
ইউক্রেনীয় সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। তবে ইউক্রেনীয় সাহিত্যের এই দীর্ঘ সময়ের পথ চলা বা উন্নয়নের ধারা মসৃণ ছিল না। লেখার ভাষা, যা খ্রিষ্টধর্মের সঙ্গে প্রবর্তিত এবং ধর্মীয় আচারের জন্য ব্যবহৃত, কথ্য ভাষার চেয়ে ধীর গতিতে পরিবর্তন হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনার কারণে কথ্য এবং লিখিত ভাষার মধ্যে ফাটল বছরের পর বছর ধরে প্রশস্ত হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে মঙ্গোল এবং তাতারদের অসংখ্য আক্রমণ; অন্যান্য রাজ্যের, যেমন লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড, রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, আগ্রাসনের জন্য ইউক্রেনের পরাধীনতা এবং মুদ্রণে ইউক্রেনীয় ভাষার সরাসরি নিষেধাজ্ঞা অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
লিখিত এবং কথ্য ভাষার মধ্যে পার্থক্যের ফলাফল হিসেবে উনবিংশ শতাব্দীতে কথ্য ভাষার বিকল্পের ওপর ভিত্তি করে একটি সম্পূর্ণ ‘নতুন’ সাহিত্যিক ভাষা গ্রহণ করা হয়। যদিও সেই ভাষা ইউক্রেনীয় জাতীয় সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য উপকারি ছিল, কিন্তু তা সাহিত্যের উন্নয়নে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলেছিল। মূলত লক্ষণীয়ভাবে উনবিংশ শতাব্দীর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সাহিত্যের মধ্যে ধারাবাহিকতা হারিয়ে গেছে বলে মনে করা হয়, এমনকি স্থানীয় ভাষায় সাহিত্যও মসৃণভাবে বিকশিত হয়নি।
সামগ্রিকভাবে ইউক্রেনীয় সাহিত্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে বিগত হাজার বছরের সাহিত্য প্রক্রিয়া মোটামুটিভাবে ছয়টি বিস্তৃত সময়ের সঙ্গে ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখা যায়, যেমন কিভান যুগ (কিভান পিরিয়ড), কোসাক যুগ (কোসাক পিরিয়ড) বা ইউক্রেনীয় সাহিত্যের মধ্যযুগ, স্থানীয় ভাষার সাহিত্য (ভার্নাকুলার লিটারেচার), ১৯২০-এর দশকের নবজাগরণ (রেনেসাঁ), প্রাক-স্বাধীনতা (প্রি-ইন্ডিপেন্ডেন্স) সময়কাল এবং সমকালীন (কন্টেম্পোরারি) সাহিত্য।
কিভান যুগ (কিভান পিরিয়ড)
প্রকৃত পক্ষে ইউক্রেনীয় সাহিত্যের ইতিহাস জানতে হলে ফিরে যেতে হয় এগারো শতাব্দীতে, বিশেষ করে কিভান রুসের খ্রিষ্টীয়করণের পরে। কিভান রুসের মূল সাহিত্যের বিকাশ ছিল সমৃদ্ধ মৌখিক লোক ঐতিহ্য, যা অনূদিত ধর্মীয় গ্রন্থের প্রচারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। কেননা অনূদিত সাহিত্য এবং সমৃদ্ধ মৌখিক লোক ঐতিহ্য উভয়ই কিভান-রুসের মূল সাহিত্যের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যাহোক, সেই প্রাচীনতম লেখা ছিল গির্জার জনসাধারণের জন্য প্রার্থনাদির বিধি এবং তা ওল্ড চার্চ স্লাভোনিক ভাষায় লেখা হয়েছিল, সত্যিকারের ইউক্রেনীয় ভাষায় নয়।
কোসাক যুগ (কোসাক পিরিয়ড) বা ইউক্রেনীয় সাহিত্যের মধ্যযুগ
ইউক্রেনীয় সাহিত্য চতুর্দশ শতকে বিকশিত হতে শুরু করে এবং ষোড়শ শতাব্দীতে মুদ্রণযন্ত্রের আবিস্কারের সঙ্গে এবং রাশিয়া ও পোলিশ আধিপত্যের অধীনে কোসাক যুগের উল্লেখযোগ্য উন্নত হয়। কোসাক যুগ ছিল অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক উত্থানের একটি ঐতিহাসিক সময়, যা ১৬৪৮-৫৪ সালের কোসাক-পোলিশ যুদ্ধে শেষ হয়েছিল।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কোসাকরা একটি স্বাধীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা নতুন ধরনের মহাকাব্যিক কবিতা জনপ্রিয় করেছিল, যা ইউক্রেনীয় মৌখিক সাহিত্যের উচ্চতর অবস্থান চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছিল। এসব অগ্রগতি পুনরায় সতের এবং আঠারো শতকের গোড়ার দিকে ফিরে এসেছিল, যখন ইউক্রেনীয় ভাষায় প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যাহোক, অবশেষে আঠারো শতকের শেষের দিকে ইউক্রেনীয় আধুনিক সাহিত্য আবির্ভূত হয়। ইউক্রেনীয় সাহিত্যের ঐতিহ্যময় আধুনিক যুগ ১৭৯৮ সালে ইভান কোটলিয়ারেভস্কির ইউক্রেনীয় ভাষায় ‘এনিডা’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনার মাধ্যমে শুরু হয়।
যদিও ইউক্রেনীয় সাহিত্যে কোসাক যুগ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল, তবে ১৬৫৪ সালের পেরেয়াস্লাভ চুক্তি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে তা হ্রাস পেতে শুরু করে এবং তখন ইউক্রেন ক্রমবর্ধমান রাশিয়ান আধিপত্যের অধীনে এসেছিল। ইউক্রেনীয় সাহিত্যে কোসাক যুগের অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ছিল পাশ্চাত্যের সাহিত্যে ক্লাসিকবাদের উত্থান।
যদিও ইউক্রেনীয় সাহিত্যে কোসাক যুগ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল, তবে ১৬৫৪ সালের পেরেয়াস্লাভ চুক্তি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে তা হ্রাস পেতে শুরু করে এবং তখন ইউক্রেন ক্রমবর্ধমান রাশিয়ান আধিপত্যের অধীনে এসেছিল। ইউক্রেনীয় সাহিত্যে কোসাক যুগের অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ছিল পাশ্চাত্যের সাহিত্যে ক্লাসিকবাদের উত্থান। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাশিয়ান সাম্রাজ্যে ক্লাসিকিজমের প্রভাব অনুভূত হতে শুরু করে।
ইউক্রেনীয় রোমান্টিক সাহিত্য বিকশিত হতে শুরু করে ১৮৩০-এর দশকে এবং দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রোমান্টিক কবি-চিত্রশিল্পী তারাস শেভচেঙ্কো আবির্ভূত হন। ইভান কোটলিয়ারেভস্কিকে ইউক্রেনীয় ভাষায় সাহিত্যের জনক হিসেবে বিবেচনা করা হলেও শেভচেঙ্কো জাতীয় পুনরুজ্জীবনের জনক হিসেবে গণ্য করা হয়।
স্থানীয় ভাষার সাহিত্য (ভার্নাকুলার লিটারেচার)
উনিশ শতকের শেষের দিকে আধুনিকতাবাদকে পথ ছেড়ে দিতে শুরু করে ইউক্রেনীয় সাহিত্যের বাস্তবতাবাদ। কেননা সেসময় কিছু সংখ্যক লেখক বাস্তবতার প্রতি লক্ষ্য রাখেননি এবং তার পরিবর্তে তারা একটি ইমপ্রেশনিস্ট ধারা নির্বাচন করেন। ইমপ্রেশনবাদী ছোটোগল্পের মাস্টার ছিলেন ভাসিল স্টেফানিক (১৮৭১-১৯৩৬)। তার গল্পগুলো মানুষের অস্তিত্বের বেদনা প্রকাশ করেছে। যাহোক, স্টেফানিকের সঙ্গে আরও দুজন লেখক যুক্ত হয়ে একটি সাহিত্য সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। তারা হলেন মার্কো চেরেমশিনা (১৮৭৪-১৯২৭) এবং লেস মার্টোভিচ (১৮৭১-১৯১৬)। যদিও তারা স্টেফানিকের অনুরূপ পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন, তবে তারা স্টেফানিকের মতো একই ভাবে সফলতা অর্জন করতে ব্যর্থ হন। ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার ভোলোদিমির ভিনিচেঙ্কোর (১৮৮০-১৯৫১) মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা এবং বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের নৈতিকতার প্রতি গভীরভাবে আগ্রহী ছিলেন। অন্যান্য আধুনিকতাবাদী গদ্য লেখকরা হলেন স্টেপান ভাসিলচেঙ্কো (১৮৭৯-১৯৩২), আর্খিপ টেসলেনকো (১৮৮২-১৯১১) এবং বোহদান লেপকি (১৮৭২-১৯৪১)।
যদিও বাস্তববাদী ইভান ফ্রাঙ্কো কিছু আধুনিকতাবাদী শ্লোক লিখেছিলেন, যেমন উঈদার্ড লিভস্ (১৮৯৬), কিন্তু আধুনিকতাবাদী যুগের সবচেয়ে বিখ্যাত কবি ছিলেন লেসিয়া উক্রাইঙ্কা (১৮৭১-১৯১৩)। তার কবিতার লড়াকু মনোভাব আত্ম-উপলব্ধির জন্য ইউক্রেনীয়দের ক্রমবর্ধমান সংগ্রামের জন্য সময়োপযোগী করে তুলেছিল।
১৯২০-এর দশকের নবজাগরণ (রেনেসাঁ)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্থানীয় ভাষার সাহিত্য সৃষ্টির পতন ঘটে। রাশিয়ান সাম্রাজ্য এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের পতন, ১৯১৭ সালের বিপ্লব, স্বাধীন ইউক্রেনের প্রতিষ্ঠা এবং ১৯২০-এর দশকে ইউক্রেনাইজেশনের সময়কালে সোভিয়েত শাসনের আপেক্ষিক উদারতা– সবই সাহিত্য কর্মকে নবজাগরণের দিকে পরিচালিত করেছে। সেই সময়ে অসংখ্য লেখকের আবির্ভাব ঘটে। তারা বিভিন্ন সাহিত্য দল এবং সংগঠন তৈরি করেন। এছাড়া তারা ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন এবং বিভিন্ন সাহিত্যের প্রবণতা (প্রতীকবাদ, অভিব্যক্তিবাদ, ভবিষ্যতবাদ, নব্যশ্রেণিবাদ, নব্যতত্ত্ববাদ ইত্যাদি) প্রকাশ করেন, যা সাহিত্য সমালোচনা এবং পাণ্ডিত্যের জন্য প্রয়োজন ছিল। ফলে সাহিত্যের নতুন ইতিহাস রচিত হয় এবং তা ছিল ইউক্রেনীয় সাহিত্যের ইতিহাসে দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুগের মধ্যে একটি।
সেই সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত কবি ছিলেন পাভলো টাইচিনা (১৮৯১-১৯৬৭)। তিনি রূপ, ছন্দ এবং চিত্রকল্পের একজন উদ্ভাবক, যা তিনি ‘ভিটাবাদের রোমান্টিকতাবাদ’৩ বলে অভিহিত করেছেন। ক্যানোয়িক মেট্রিক্স এবং শাস্ত্রীয় সম্প্রীতির জন্য তিনি সমসাময়িক পাঁচজন কবিকে একত্রিত করে একটি দল গঠন করেছিলেন, যা সাধারণত নিওক্লাসিস্ট হিসেবে পরিচিত। দলটি মাইকোলা জিরোভ (১৮৯০-১৯৩৭)-কে কেন্দ্র করে গঠিত হয় এবং সেখানে ছিলেন মাকসিম রাইলস্কি, মাইখাইলো ড্রাই-খেমারা, পাভলো ফেলিপোভিচ এবং ইউরি ক্লেন। যাহোক, সেই সময়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কবিরা হলেন ভ্যাসিল ব্ল্যাকিটনি, ওলেকসা ভ্লিজকো, ইয়াকিভ সাভচেঙ্কো, ডিমিট্রো ফালকিভস্কি, ডিমিট্রো জাহুল, জিও শকুরূপি, ভ্যালেরিয়ান পোলিশচুক, ম্যায়ক ইয়োহানসেন এবং দার্শনিক কবি ইয়েভহেন প্লাজুজিক প্রমুখ।
সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের প্রথম দিকের বছরগুলোতে ইউক্রেনীয় সাহিত্য বিকশিত হতে থাকে। তখন প্রায় সমস্ত সাহিত্য কর্মকে অনুমোদন দেওয়া হতো। সেই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বরা ছিলেন মাইকোলা খভিলোভি, ভ্যালেরিয়ান পিডমোহাইলনি, মাইকোলা কুলিশ, মাইখাইল সেমেঙ্কো প্রমুখ। তবে ১৯৩০-এর দশকে সাহিত্য তীব্র পতনের মুখোমুখি হয়েছিল এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পাশাপাশি অনেক সাহিত্যিক নিহত হয়েছিলেন। এছাড়া দু’শতাধিক লেখককে দমন করা হয়েছিল। সেসব নিপীড়ন স্তালিনের সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদের বাস্তবায়িত নীতির অংশ ছিল। মতবাদটি ইউক্রেনীয় ভাষার ব্যবহারকে দমন করে না, তবে লেখকদের তাদের সাহিত্য চর্চ্চাকে একটি নির্দিষ্ট শৈলী অনুসরণ করতে বাধ্য করেছিল। তবে স্তালিনবাদ-পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির অধীনে সাহিত্যের কার্যক্রম কিছুটা শিথিল করা হয়েছিল।
যাহোক, ১৯২০-এর দশকটি কোনোভাবেই শুধু কবিতার জন্য রেনেসাঁ ছিল না। মাইকোলা খভিলোভির গদ্য, শৈলী এবং তার বিভিন্ন গ্রন্থ জাতীয় প্রাণশক্তির প্রচলিত চেতনার অংশ ছিল। একই সময়ে ইউক্রেনীয় গদ্য ইউরি ইয়ানোভস্কির গীতিময় (লিরিক্যাল) রোমান্টিক কাজ এবং ভ্যালেরিয়ান পিডমোহাইলনির হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়েছিল। উল্লেখ্য, তিনি ইউক্রেনীয় সাহিত্যকে প্রথম আধুনিক উপন্যাস উপহার দিয়েছিলেন। অন্যান্য গদ্য লেখকদের মধ্যে ছিলেন মাইখাইলো ইভচেঙ্কো, আন্দ্রেই হোলোভকো, ইভান সেনচেঙ্কো, হেরিহোরি এপিক, ভোলোদিমির গজিটস্কি, আরকাদিই লিউবচেঙ্কো, বোরিস অ্যান্টোনেঙ্কো-ডেভিডোভিচ, ওলেকসা স্লিসারেনকো, হেরিহোরি কোসিনকা, হাস্যরসাত্মক ওস্তাদ ভ্যুশ্যনিয়া এবং প্রাবন্ধিক ও প্যারোডি লেখক কোস্ট বুরেভি।
প্রাক-স্বাধীনতা (প্রি-ইন্ডিপেন্ডেন্স) সময়কাল
গত শতাব্দীর শুরুর দিকে (১৯২০-এর দশকে) ইউক্রেনীয় সাহিত্যের নবজাগরণ হঠাৎ করে এবং নিষ্ঠুরভাবে শেষ হয়েছিল। পরবর্তী দশকে, অর্থাৎ ১৯৩০-এর দশকে, কমিউনিস্ট পার্টি সাহিত্যের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল। তারা সমস্ত স্বাধীন সংগঠন বিলুপ্ত করে লেখকদের ইউক্রেনের রাইটার্স ইউনিয়নে যুক্ত হতে বাধ্য করেছিল। তখন লেখকদের মধ্যে ভীতির সন্ত্রাস শুরু হয় এবং ১৯৩৮ সালের মধ্যে বেশিরভাগ লেখক পার্টির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। অন্যদিকে বাকিরা কারারুদ্ধ হন অথবা খুন হন অথবা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এভাবেই ইউক্রেনীয় সাহিত্যের বিকাশের সংক্ষিপ্ততম, কিন্তু সবচেয়ে কঠিন, সময়ের সমাপ্তি ঘটে। সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য সাহিত্যিক পদ্ধতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ভীতির সন্ত্রাস থেকে বেঁচে যাওয়া লেখকরা (যেমন পাভলো টাইচিনা, মাকসিম রাইলস্কি, মাইকোলা বাজহান, ভোলোদিমির সোসিউরা, ইউরি ইয়ানোভস্কি) তাদের আগের সাহিত্যকর্ম পরিত্যাগ করেন।
ইউক্রেনীয় সাহিত্যের নবজাগরণ হঠাৎ করে এবং নিষ্ঠুরভাবে শেষ হয়েছিল। পরবর্তী দশকে, অর্থাৎ ১৯৩০-এর দশকে, কমিউনিস্ট পার্টি সাহিত্যের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল। তারা সমস্ত স্বাধীন সংগঠন বিলুপ্ত করে লেখকদের ইউক্রেনের রাইটার্স ইউনিয়নে যুক্ত হতে বাধ্য করেছিল। তখন লেখকদের মধ্যে ভীতির সন্ত্রাস শুরু হয় এবং ১৯৩৮ সালের মধ্যে বেশিরভাগ লেখক পার্টির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন।
অন্যান্য বিষয়ের (যেমন সমষ্টিকরণ, পাঁচ বছরের পরিকল্পনা, শিল্পায়ন ইত্যাদি) ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়ের ইউক্রেনীয় সাহিত্যে ১৯৪০ এবং ১৯৫০-এর দশকে সাহিত্যের গুণমানের দিক থেকে খুবই নিরস ছিল। সেই সময়ের প্রতিনিধি সাহিত্যিক ছিলেন নাতান রাইবাক, ইভান লে, লিওনিড পারভোমাইস্কি, ইউরি স্মোলিচ, ঔপন্যাসিক ইরিনা ভিল্ডে এবং মাইখাইলো স্টেলমাখ; নাট্যকার ওলেকস্যান্দার কর্নিচুক এবং ইভান কোচারখা; কবি আন্দ্রি আন্দ্রেই মালিশকো। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন অন্য ঘরানার স্বতন্ত্র লেখক ভ্লাদিমির সুইডিনস্কে।
যাহোক, ইউক্রেনীয় সাহিত্য ধারাকে পুনরুজ্জীবিত করতে ষাটের দশক থেকে প্রতি দশ বছরের ব্যবধানে সফলতা অর্জন করেছিল। হয়তো এ কারণেই ষাটের দশক, সত্তরের দশক এবং আশির দশককে তিনটি আলাদা নামকরণ করা হয়েছে। এগুলো হলো: সিস্টদেসিয়াতনিকি (ষাটের দশক), সিমদেসিয়াতনিকি (সত্তরের দশক) এবং ভিসিমদেসিয়াতনিকি (আশির দশক)। উল্লেখ্য, এসব কোনো আনুষ্ঠানিক সাহিত্যিক দল ছিল না, বরং অন্যান্য প্রজন্মের পরিভাষার মতো, যেখানে লেখকরা বৈচিত্র্যময় এবং তারা হালকাভাবে একজন আরেকজনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল।
ইউক্রেনীয় ভিন্নমতাবলম্বী আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ষাটের দশকের ইউক্রেনীয় সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক শিল্পীদের ‘সিস্টদেসিয়াতনিকি’ প্রজন্ম হিসেবে পরিচিত। তারা সিস্টদেসিয়াতনিকি প্রজন্মের পদ্ধতিগত রুশীকরণ৪-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য সংগঠিত হয়েছিল এবং সোভিয়েত সাংস্কৃতিক মতাদর্শের দৃষ্টান্তের মধ্যে ইউক্রেনীয় সংস্কৃতি রক্ষা ও বিকাশের চেষ্টা করেছিল। ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে সাহিত্যকে প্রাণবন্ত করার ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন ধরনের দমন-পীড়ন ও গ্রেপ্তারসহ জঘন্য এবং অবৈধ আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছিল।
পরবর্তী দশকে, অর্থাৎ সত্তরের দশকে, ইউক্রেনীয় লেখকদের ‘সিমদেসিয়াতনিকি’ প্রজন্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সিমদেসিয়াতনিকি প্রজন্ম ষাটের দশকের প্রজন্মের (সিস্টদেসিয়াতনিকি) পরপরই এসেছিল, যারা ক্রুশ্চেভের নমনীয় হওয়ার সময় সোভিয়েত ইউক্রেনীয় সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল। যদিও সিমদেসিয়াতনিকি প্রজন্মের লেখকরা পরবর্তী প্রজন্মের ওপর খুবই প্রভাবশালী ছিল, তবুও তাদের সাহিত্যকর্ম আশির দশকের শেষের দিকের আগে প্রকাশিত হতে পারেনি। যাহোক, সিমদেসিয়াতনিকি প্রজন্মের বিশিষ্ট লেখকদের মধ্যে রয়েছেন ইউরি ভিনিচুক (জন্ম ১৯৫২), হৃৎস্কো চুবাই (১৯৪৯-১৯৮২) এবং ওলেহ লিশেহা (১৯৪৯-২০১৪)।
ইউক্রেনীয় লেখকদের একটি নতুন প্রজন্ম আশির দশকের শেষের দিকে আবির্ভূত হয়। তারা এমন এক প্রজন্ম, যারা ১৯৯১ সালে ইউক্রেনের স্বাধীনতার পরে সম্পূর্ণ সৃজনশীল স্বাধীনতা উপভোগ করার জন্য অগ্রগামী হয়েছেন। এসব লেখকদের ‘ভিসিমদেসিয়াতনিকি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং তারা আশিরর দশকের প্রজন্ম। যদিও ভিসিমদেসিয়াতনিকি শব্দটি প্রায়শই সোভিয়েতের শেষ লগ্ন ও সোভিয়েত-পরবর্তী ইউক্রেনীয় সংস্কৃতির আলোচনায় ব্যবহৃত হয় এবং বেশ কয়েকটি প্রকাশনা লেখকদের এই শিরোনামে আখ্যায়িত করেছে।
ইউক্রেনের স্বাধীনতার প্রথম দশকে, ভিসিমদেসিয়াতনিকি তাদের প্রতিভা এবং শক্তিকে ইউক্রেনীয় সংস্কৃতিকে নেতৃস্থানীয় করার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল। ফলে তারা তাদের ওপর উপনিবেশিক আরোপিত বিধিনিষেধ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। যাহোক, ভিসিমদেসিয়াতনিকি প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য লেখকরা হলেন ভ্যাসিল গাবোর (জন্ম ১৯৫৯), ইউরি আন্দ্রেকোভিচ (জন্ম ১৯৬০), ইভান মালকোভিচ (জন্ম ১৯৬১), আন্দ্রে কারকভ (জন্ম ১৯৬১) এবং ভিক্তর নেবোরাক (জন্ম ১৯৬১)।
যাহোক, অবশেষে যখন সুযোগ আসে, তখন ভিসিমদেসিয়াতনিকি প্রজন্ম তাদের উত্তরসূরী দুই প্রজন্মের বেঁচে থাকা লেখকদের সঙ্গে মিলে সোভিয়েত-পরবর্তী ইউক্রেনে ইউক্রেনীয় সংস্কৃতির বিকাশকে পরিচালিত করে।
১৯৯১ সালের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে সেন্সরশিপের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় এবং লেখকরা শিল্প, সংগীত এবং সাহিত্য ক্ষেত্রে সব সরকারী সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার শৃঙ্খল ভাঙতে সক্ষম হন। ফলে লেখকদের স্বাধীনতা এবং উন্মুক্ততা ইউক্রেনীয় সাহিত্য ভুবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পেরেছে, যা সোভিয়েত ও ধ্রুপদী যুগের বলয় থেকে দূরে সরে যায় এবং এমন একটি যুগে আবির্ভূত হয়, যেখানে লেখকরা সোভিয়েত ইউক্রেনে নিষিদ্ধ বিষয় সম্পর্কে লেখার স্বাধীনতা অর্জন করে।
সমকালীন ইউক্রেনীয় সাহিত্যের গতি ও প্রকৃতি
সমকালীন বা উত্তর-আধুনিক ইউক্রেনীয় সাহিত্য ১৯৯১ সাল থেকে ইউক্রেনীয় সাহিত্যকে বোঝায়, যখন ইউক্রেনীয় স্বাধীনতা এসেছে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য হিসেবে ইউক্রেনীয় লেখকদের সাহিত্য রচনায় যেসব বাঁধা-বিপত্তি ছিল, তা ১৯৯১ সালের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে সেন্সরশিপের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় এবং লেখকরা শিল্প, সংগীত এবং সাহিত্য ক্ষেত্রে সব সরকারী সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার শৃঙ্খল ভাঙতে সক্ষম হন। ফলে লেখকদের স্বাধীনতা এবং উন্মুক্ততা ইউক্রেনীয় সাহিত্য ভুবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পেরেছে, যা সোভিয়েত ও ধ্রুপদী যুগের বলয় থেকে দূরে সরে যায় এবং এমন একটি যুগে আবির্ভূত হয়, যেখানে লেখকরা সোভিয়েত ইউক্রেনে নিষিদ্ধ বিষয় সম্পর্কে লেখার স্বাধীনতা অর্জন করে। তবে অনেকে মনে করেন যে, পেরিস্ট্রোইকা৫-এর অধীনে এবং বিশেষ করে ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল বিপর্যয়ের পরে ইউক্রেনীয় সাহিত্যে প্রধান পরিবর্তনগুলো ঘটেছিল। অন্যদিকে কিছু গবেষক মনে করেন যে, আধুনিক ইউক্রেনীয় সাহিত্য ১৯৭০-এর দশকে শুরু হয়েছিল, যা ষাটের দশকের সোভিয়েত ভিন্নমতাবলম্বী লেখকরা প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
ইউক্রেনীয় লেখকরা ১৯৯১ সালের স্বাধীনতার পর থেকে ফর্ম এবং শৈলী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। তারা শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবনের অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যের প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হন। বিদেশী প্রভাব ও অন্যান্য দেশের সাহিত্যের সহজ লভ্যতার জন্য এবং ইউক্রেনীয় সমাজের বর্ধিত স্বাধীনতা ও উন্মুক্ততার কারণে সমকালীন ইউক্রেনীয় সাহিত্য সোভিয়েত এবং শাস্ত্রীয় সময়ের সাহিত্য থেকে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করে। লেখকরা প্রায়শই পূর্বে নিষিদ্ধ বিষয়, যেমন হোলোডোমোর৬, যৌনতা, নিষিদ্ধ দ্রব্য বা ড্রাগ, বিপথগামী আচরণ, মানসিক বিপর্যয়ের প্রভাব, সামাজিক সমস্যা, ঐতিহাসিক স্মৃতির প্রতিফলন, নতুন শৈলী (উত্তর-আধুনিকতাবাদ, নব্য প্রগতির পুরোধা অর্থাৎ নিও অ্যাঁভন-গার্ড, অশালীনতা, সুরজহিক), বৈচিত্র্য এবং আলাদা ঘরানার মিশ্রণ, চমকপ্রদ প্রভাব এবং সামাজিক সমস্যা ও ঐতিহাসিক স্মৃতির প্রতিফলন ব্যবহার করে। অন্যদিকে এ সময়ে কিছু সংখ্যক ইউক্রেনীয় লেখক আবির্ভূত হয়েছেন, যাদের লেখায় যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ এবং ইতিহাস, স্মৃতি এবং দুঃখের পাশাপাশি ইউক্রেনের স্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং আনন্দ ও উৎসাহ-উদ্দীপনার নানান বিষয় উঠে এসেছে। এ কথা সত্যি যে, সমকালীন ইউক্রেনীয় লেখক এবং কবিদের সাহিত্য পড়ার সময় অনেক পাঠক হয়তো ইউক্রেনীয় স্বাধীনতা এবং স্বীকৃতির জন্য জীবন সংগ্রামের কাহিনী শুনতে পারে। তবে অনেক ভালো লেখায় দেশের ইতিহাস, মানুষের লুকানো আকাঙ্ক্ষা এবং শৈশব থেকে প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে অন্তর্নিহিত বিদ্রূপের কাহিনীও প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রতিটি শৈল্পিক পরিবেশের মতো ইউক্রেনীয় সাহিত্য কখনো সমজাতীয় ছিল না, এমনকি এখনো নয়। সব সময় কিছু মতাদর্শগত বা নান্দনিক বিভাজন অথবা শুধু মানুষের সহানুভূতি ও বিতৃষ্ণা ছিল। যাহোক, ১৯৯০-এর দশকের ইউক্রেনীয় সমকালীন সাহিত্যকে যদি খুবই রুক্ষভাবে দুটি অংশে বিভক্ত করা হয়, তবে বলা যেতে পারে যে সাহিত্যের মধ্যে ঐতিহ্যবাদী এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদীদের অস্তিত্ব রয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, এ দুটি দল হলো ‘বু-বা-বু’৬ এবং তথাকথিত ‘স্তানিস্লাভ ফেনোমেনন’ (স্তানিস্লাভ ফেনোমেনন দলটি ইভানো-ফ্রাঙ্কিভস্কের চেয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ সাহিত্য চক্র)। উল্লেখ্য, ইউরি আন্দ্রেকোভিচ (জন্ম ১৯৬০) দুটি দলের সঙ্গেই জড়িত।
এ কথা না বললেই নয় যে, অরেঞ্জ বিপ্লবের পর (অর্থাৎ ২০০৪ সালের পরে) সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সমকালীন ইউক্রেনীয় সাহিত্যে পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। সেসময়ে প্রকাশনা শিল্প গড়ে ওঠে এবং কয়েক ডজন নতুন লেখক আবির্ভূত হয়েছিল। ইউক্রেনের লভিভ শহরের বৃহত্তম বই মেলা এবং বিভিন্ন ধরনের প্রকাশনা ভিত্তিক অনুষ্ঠান অন্যান্য শহরেও অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেখা গেছে যে, দুর্ভাগ্যবশত নব্বইের দশকের কঠোর সাহিত্য বাস্তবতায় ফিরে এসেছে। অনেক প্রকাশক ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে এবং যারা টিকে ছিল, তারা নতুন লেখকদের লেখা প্রকাশ করার ঝুকি না নিয়ে একচেটিয়াভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং বিখ্যাত লেখকদের লেখা বেছে নিয়ে প্রকাশ করে, যা বিক্রয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারে এবং তারা যেন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।
যাহোক, নিচে তিনজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইউক্রেনের সমকালীন লেখকের উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সম্পর্কে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত তথ্য দেওয়া হলো।
ইউরি আন্দ্রেকোভিচ (জন্ম ১৯৬০) একাধারে একজন ইউক্রেনীয় গদ্য লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক এবং অনুবাদক। তিনি ১৯৮৫ সালে তিনি কবি ওলেকসান্ডার ইরভানেটস এবং ভিক্টর নেবোরাকের সঙ্গে ‘বু-বা-বু’ দল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার ইউক্রেনীয়-পন্থী এবং ইউরোপীয়-পন্থী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পরিচিত। ইতোমধ্যে তিনি প্রায় কুড়িটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন এবং অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।
আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ইউক্রেনীয় কবি, ঔপন্যাসিক এবং অনুবাদক সের্হি ঝাদান (জন্ম ১৯৭৪) বিদ্রূপ ও আত্ম-অভিব্যক্তিতে পূর্ণ এবং আন্তরিক ও সত্যবাদী লেখার জন্য ইউক্রেনের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘দ্য অরফানেজ’, ‘মেসোপটেমিয়া’ এবং ‘অ্যানারকি ইন দ্য ইউকেআর’।
লিউবকো দেরেশ (জন্ম ১৯৮৪) ইউক্রেনীয় সমকালীন সাহিত্যের একজন উল্লেখযোগ্য লেখক। মাত্র ষোল বছর বয়সে তার প্রথম উপন্যাস তরুণ পাঠকমহলে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং তখন তাকে ইউক্রেনীয় সাহিত্যের ভবিষ্যত কান্ডারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি তার বহুল আলোড়িত এবং পাঠক নন্দিত ‘কাল্ট’ উপন্যাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন শেষ হওয়ার পরে ইউক্রেনীয়দের তরুণ প্রজন্মের জীবন সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি আটটি উপন্যাস এবং দুটি শিশুতোষ গ্রন্থের রচয়িতা। ‘ইনটেনশন’ এবং ‘অ্যা বিট অফ ডার্কনেস’ তার বিখ্যাত উপন্যাস।
সমকালীন ইউক্রেনীয় সাহিত্যে নারী লেখকের অবদান ও সাহিত্য সৃষ্টি
সমকালীন ইউক্রেনীয় সাহিত্যে নারী লেখকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, যদিও সঠিক কারণ কারোর জানা নেই। কেউ কেউ মনে করেন যে, সোভিয়েত যুগে সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সম্ভাবনা নিতান্তই কম ছিল ( যদিও তখন লেখক হওয়া কেবল মর্যাদাপূর্ণই ছিল না, অনেক লেখকের জন্য লাভজনকও ছিল, বিশেষ করে যারা সোভিয়েত শাসনের ‘অনুগত’ থেকে প্রদত্ত রাষ্ট্রীয় তহবিলের সুযোগ-সুবিধা পেত)। অন্যদিকে অনেকের ধারণা যে, ইউক্রেন ধীরে ধীরে তার পুরনো পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অবশিষ্টাংশ ঝেড়ে ফেলছে।
ইউক্রেনের রাজনৈতিক স্বাধীনতার (১৯৯১ সাল) ঠিক আগে এবং পরে ইউক্রেনীয় সাহিত্য ভুবনে নারী লেখকদের বিস্ফোরণ ঘটেছে। গত দুই দশক ধরে অসংখ্য আকর্ষণীয় এবং প্রতিভাবান নারী লেখকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তারা ছোটোগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ রচনা ছাড়াও সাংবাদিকতা সহ বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখছেন।
ইউক্রেনের রাজনৈতিক স্বাধীনতার (১৯৯১ সাল) ঠিক আগে এবং পরে ইউক্রেনীয় সাহিত্য ভুবনে নারী লেখকদের বিস্ফোরণ ঘটেছে। গত দুই দশক ধরে অসংখ্য আকর্ষণীয় এবং প্রতিভাবান নারী লেখকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তারা ছোটোগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ রচনা ছাড়াও সাংবাদিকতা সহ বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখছেন। এসব লেখার মধ্যে বাস্তবতাবাদ, যাদুকরী বাস্তবতাবাদ, পরাবাস্তবতাবাদ, গভীরতম বুদ্ধিবৃত্তিক রচনা, নতুন আবিস্কৃত নারীবাদী দৃষ্টিকোণ, দার্শনিক গদ্য, মনস্তাত্ত্বিক রহস্য এবং আরও অনেক বিষয় দেখা যায়। এছাড়া তাদের অনেকের লেখায় নিজেদের অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ অংশ পাওয়া যায়, যা গভীর আধ্যাত্মিকতা থেকে শুরু করে যৌনতা এবং আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের অকপট চিত্রায়ন (স্বীকারোক্তিমূলক গদ্য) পর্যন্ত বিস্তৃত। সেসব লেখায় ট্রাজেডি এবং হাস্যরস ছাড়াও মাঝে মাঝে ট্র্যাজেডির ভেতর হাস্যরসের উপাদান থাকে। অনেক নারী লেখকের উপজীব্য বিষয় নাগরিক জীবনের টানাপোড়েন। অন্যদিকে অনেকের লেখায় দেখা যায় গ্রামীন জীবনে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং অবিভক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের গভীর ক্ষত, যা সমগ্র জাতির ওপর মানসিক আঘাতের চিহ্ন রেখে গেছে।
সমকালীন ইউক্রেনীয় সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য নারী লেখকদের মধ্যে রয়েছেন ওকসানা জাবুস্কো (১৯৬০), লারিসা দেনিসেঙ্কো (১৯৭৩), স্পিতলানা পোভালিয়্যায়েভা (১৯৭৪), ইরেনা কারপা (১৯৮০), সোফিয়া আন্দ্রেকোভিচ (১৯৮২), তানিয়া মালয়েরচুক (জন্ম ১৯৮৩) এবং ক্যাটারিনা বাবকিনা (১৯৮৫)। এসব নারী লেখকদের মধ্যে কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও উল্লেখযোগ্য সাহিত্য কর্ম তুলে ধরা হলো।
ইউক্রেনীয় বুদ্ধিজীবী, কবি, লেখক এবং সাহিত্য সমালোচক ওকসানা জাবুঝকো তার লেখায় নারীবাদ, মানবিক সমস্যা এবং দেশপ্রেমের সংমিশ্রণের জন্য পরিচিত। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘ফিল্ডওয়ার্ক ইন ইউক্রেনীয় সেক্স’, ‘অ্যা কিংডম অব ফলেন স্ট্যাচুজ’ এবং ‘লেট মাই পিপল গো’। উল্লেখ্য, লেখিকা তার আধা-আত্মজীবনীমূলক ‘ফিল্ডওয়ার্ক ইন ইউক্রেনীয় সেক্স’ উপন্যাসে নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে যৌনতাকে অকপটে চিত্রায়িত হয়েছে। বলা বাহূল্য, তার পূর্ববর্তী ইউক্রেনীয় নারী লেখকদের সাহিত্যে যৌনতা উপস্থাপন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ বিষয় ছিল। তবে ইউক্রেনীয় পুরুষ লেখকরা এর আগে পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে যৌনতা সম্পর্কে সাহিত্য রচনা করেছেন।
লারিসা দেনিসেঙ্কো একাধারে একজন ঔপন্যাসিক, শিশু সাহিত্যিক, সাহিত্য ও শিল্প সমালোচক এবং আইনজীবী। তার গদ্যের বিষয়বস্তু মূলত আত্মজীবনী নির্ভর। তবে সমসাময়িক অন্যান্যদের তুলনায় তিনি তার লেখায় যথেষ্ট কম স্বীকারোক্তিমূলক উপাদান ব্যবহার করেন এবং প্রকাশ ভঙ্গিতে তিনি আরও সংযত। তিনি আটটি উপন্যাসের রচয়িতা। ‘দ্য সারাবান্দে অব সারা’স ব্যান্ড’ উপন্যাসের জন্য তিনি ২০০৯ সালে বুক অব দ্য ইয়ার পুরস্কার লাভ করেন।
স্পিতলানা পোভালিয়্যায়েভা একজন ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সাংবাদিক, কবি এবং অনুবাদক। তিনি প্রায়শই তার গদ্যে যাদুকরী বাস্তবতা ব্যবহার করেন, যা শৈলীর দিক থেকে পরিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ। ‘দ্য সিমর্গ’ তার বিখ্যাত উপন্যাস এবং পরবর্তীতে এ উপন্যাসের কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
সোফিয়া আন্দ্রেকোভিচ একজন ইউক্রেনীয় কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং অনুবাদক। ইতোমধ্যে তিনি ছয়টি উপন্যাস রচনা করেছেন। ‘ফেলিক্স অস্ট্রিয়া’ তার অন্যতম সেরা উপন্যাস। এ উপন্যাসের জন্য তিনি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। সমালোচকদের মতে তার সাহিত্য বিস্তারিত বিবরণে সমৃদ্ধ। কেননা তার লেখায় মানুষ এবং চারপাশের পরিবেশ অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে বর্ণনা করা হয়। তার একাধিক গ্রন্থ ইংরেজিসহ ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
তানিয়া মালয়েরচুক সমকালীন ইউক্রেনীয় কথাসাহিত্যের অন্যতম মেধাবী এবং একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখিকা। তিনি বাস্তব এবং পরাবাস্তবের মধ্যে এক ধরনের সূক্ষ রেখা অনুসরণ করেন, যেখানে স্বপ্ন ও বাস্তবতা একত্রিত হয় এবং পরিচিত জিনিসগুলো হঠাৎ অপরিচিত আকৃতি ধারণ করে। মার্কিন অনুবাদক এবং অধ্যাপক মাইকেল এম. নেইদানের ভাষায়: ‘তার (তানিয়া মালয়েরচুক) নিজের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য এবং নিজের লেখা ও বক্তব্যের আলাদা শৈলী খোঁজার জন্য তিনি উত্তর-আধুনিকতার মতো প্রভাবশালী সাহিত্যিকদের প্রবণতা এড়িয়ে চলেন। তার নিজস্ব পথটি শৈলীগত জটিলতা ও মৌখিক কৌশল থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, তবে হালকাভাবে চিন্তাশীল সরল পথে পরিচালিত করে। তার গদ্য অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং মিতব্যয়ী, তবুও আকর্ষণীয় এবং সব সময় আসল বক্তব্য ধারণ করে। তিনি কিছুটা চেখভের আধুনিক সংস্করণের মতো যাদুকরী বাস্তবতার শৈলীতে লিখছেন।’
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে চেকোস্লোভাকিয়ায় প্রাগ বসন্তের সময় ইউক্রেনীয় সাহিত্যের প্রসার ঘটেছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ইয়েভা বিস এবং ভাসিল দাতসির মনস্তাত্ত্বিক ছোটোগল্প, সেরহি মাকারা এবং স্টেপান হোস্টিয়াকের কবিতা এবং ইউরি বাচার সাহিত্য সমালোচনা। যদিও সেসময়ে কোন প্রধান কথাসাহিত্যিক বা কবি আবির্ভূত হয়নি, তবে কিছু ইউক্রেনীয় সাহিত্য কার্যকলাপ যুগোস্লাভিয়া, রোমানিয়া, পোল্যান্ড, এবং অন্যান্য দেশে বিদ্যমান ছিল, যেখানে ইউক্রেনীয়রা বসতি স্থাপন করেছে।
অভিবাসী লেখকদের ভূমিকা ও সাহিত্য কর্ম
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে চেকোস্লোভাকিয়ায় প্রাগ বসন্তের সময় ইউক্রেনীয় সাহিত্যের প্রসার ঘটেছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ইয়েভা বিস এবং ভাসিল দাতসির মনস্তাত্ত্বিক ছোটোগল্প, সেরহি মাকারা এবং স্টেপান হোস্টিয়াকের কবিতা এবং ইউরি বাচার সাহিত্য সমালোচনা। যদিও সেসময়ে কোন প্রধান কথাসাহিত্যিক বা কবি আবির্ভূত হয়নি, তবে কিছু ইউক্রেনীয় সাহিত্য কার্যকলাপ যুগোস্লাভিয়া, রোমানিয়া, পোল্যান্ড, এবং অন্যান্য দেশে বিদ্যমান ছিল, যেখানে ইউক্রেনীয়রা বসতি স্থাপন করেছে। এছাড়া অন্যান্য দেশেও (যেমন কানাডা, গ্রেট ব্রিটেন, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) ইউক্রেন-বংশোদ্ভূত লেখকদের উপস্থিতি দেখা যায়, তবে তারা সংখ্যায় খুবই নগন্য। উদাহরণ হিসেবে গুটি কয়েক নাম বলা যায়, যেমন ইংল্যান্ডের অভিবাসী ইউক্রেন-বংশোদ্ভূত স্পিতলানা পিরকালো (জন্ম ১৯৭৬) লন্ডন ভিত্তিক লেখক, সাংবাদিক এবং অনুবাদক। তিনি ইউক্রেনীয়, ইংরেজি এবং রাশিয়ান ভাষায় লেখেন। এছাড়া রয়েছেন ফ্রান্সের অভিবাসী ইরিনা কারপা (জন্ম ১৯৮০) এবং ইউক্রেনীয়-রাশিয়ান-ইহুদি-আমেরিকান কবি, অধ্যাপক, সমালোচক এবং অনুবাদক ইলিয়া কামিনস্কি (১৯৭৭)।
জানা যায়, ১৯৬০-এর দশক থেকে কানাডায় ইউক্রেনীয় সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। সক্রিয় লেখকদের মধ্যে কবি বোরিস ওলেকসান্দ্রিভ (বোরিস হৃবিনস্কির ছদ্মনাম), বোহদান মাজেপা, ভিরা ভরস্কো, স্ভিতলানা কুজমেঙ্কো, টিওডোর মাতভিজেঙ্কো, ভোলোদিমির স্করুপস্কি, ল্যারিসা মুরোভিচ, ইরিনা মাকারিক, মারিয়া রেভাকোভিচ, মার্কো ক্যারিনিক, ড্যানিলো স্ট্রুক এবং ওলেকসান্ডার অলিজনিক উল্লেখযোগ্য। এসব নারী কবিদের মধ্যে অনেকেই প্রাচীন পন্থী এবং অনেকেই আধুনিকতাবাদী। কথাসাহিত্যে ইভান বদনারচুক এবং ওলেকসান্দার স্মোতরিচ ব্যাপকভাবে পরিচিতি পেয়েছে। মাইকোলা কোভশুন নাটক লিখেছেন এবং ওলেহ জু ইহুদিকিজ প্রতীকি কবিতা লেখার পাশাপাশি অনুবাদে খুব সক্রিয় ছিলেন।
বহির্বিশ্বে ইউক্রেনীয় সাহিত্যের পরিচিতি
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বর্তমানে ইউক্রেনীয় সাহিত্য বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণবন্ত সাহিত্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। তবে পরিতাপের বিষয় যে, বিভিন্ন ভাষাভাষী, বিশেষ করে ইংরেজি, পাঠকের কাছে স্বল্প পরিচিত। তাই ইউক্রেনীয় সাহিত্যের উত্তরণ ও বিস্তারে এবং সাহিত্যকে স্বদেশি ও ভিনদেশি পাঠকদের কাছে পরিচিত করার জন্য বিভিন্ন সংকলন, ম্যাগাজিন, জার্ণাল এবং ওয়েবম্যাগ ইত্যাদির ভূমিকা অপরিসীম।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইউক্রেনীয় সাহিত্যের প্রচারের জন্য ‘কন্টেম্পোরারি ইউক্রেনীয়ান লিটারেচার সিরিজ’ ২০১৮ সালে ‘দ্য হোয়াইট চক অফ ডেজ: দ্য কন্টেম্পোরারি ইউক্রেনীয়ান লিটারেচার সিরিজ অ্যান্থোলজি’ প্রকাশ করে। এ সংকলনে পনেরজন ইউক্রেনীয় লেখকদের সাহিত্য কর্ম ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়। আরেকটি সংকলন হলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০১৪ সালে প্রকাশিত এবং মাইকেল এম. নেইদান সম্পাদিত ‘হারস্টোরিজ: অ্যান অ্যান্থোলজি অব নিউ ইউক্রেনিয়ান উইমেন প্রোজ রাইটার্স’। এ সংকলনে আঠারোজন ইউক্রেনীয় নারী লেখকের ইংরেজিতে অনূদিত ছোটোগল্প এবং উপন্যাসের নির্বাচিত অংশ স্থান পেয়েছে। এছাড়া সমকালীন ইউক্রেনীয় লেখকদের নির্বাচিত ছোটোগল্প ও কবি নিয়ে বৃটিশ সাহিত্য ম্যাগাজিন ‘ওয়ার্ডস উইদআউট বর্ডার্স’ (আগষ্ট, ২০১৪) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যাপোফেনী’ ম্যাগাজিন (ফেব্রুয়ারি, ২০১৮) বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে।
শেষ কথা
ইউক্রেনীয় সাহিত্য শুধুমাত্র ইউক্রেনীয় ভাষা এবং রাশিয়ান ভাষা, প্রো-ওয়েস্ট এবং প্রো-রাশিয়ান মধ্যে বিভক্ত নয়, বরং সরকারী এবং স্বতন্ত্র লেখকদের মধ্যেও ফারাক দেখা যায়। সরকারী সাহিত্য রাষ্ট্র পরিচালিত লেখক ইউনিয়নের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্টি হয়। সংগঠনের সদস্যদের সাহিত্য প্রায়শই প্রকৃত সত্যের চেয়ে আরও বেশি কল্পনার উপস্থিতি দেখা যায়। কেননা এসব লেখক পর্যায়ক্রমে সরকারী পুরস্কার পান। দেখা গেছে এমন গ্রন্থের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কার পেয়েছেন, যা কোন বইয়ের দোকানে পাওয়া যায় না। সেসব বই আত্মীয়, সহকর্মী এবং বন্ধুদের জন্য প্রকাশিত হয়। সংগঠনের কর্মকর্তা আঞ্চলিক লেখক ইউনিয়ন পরিচালনা করে, কনভেনশনের জন্য একত্রিত হয়, এমনকি মাঝে মাঝে সংবাদপত্র প্রকাশ করে। অন্যদিকে, স্বাধীন বা বেসরকারী ইউক্রেনীয় সাহিত্যিকেরা কোন রাষ্ট্রীয় সমর্থন ছাড়াই সাহিত্য রচনা করে। তাদের কোন অনুদান, কোন সরকারী সংস্থা, কোন সম্মেলন, কোন পুরষ্কার এবং কোন ভর্তুকিযুক্ত প্রকাশনা নেই। এছাড়া তাদের সমর্থন করার জন্য কোন সরকারী বা বেসরকারী প্রোগ্রাম নেই।
ইউক্রেনীয় সাহিত্য এখনো বিশ্বব্যাপী অনেক পাঠকের কাছে অজানা বা অনাবিস্কৃত। ইউক্রেনের বাইরে বেশিরভাগ মানুষ ইউক্রেনীয় ভাষায় কথা বলে না। এছাড়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে এক ধরনের উত্তর-ঔপনিবেশিক পক্ষপাতও রয়েছে। অনেকে মনে করেন যে, ইউক্রেনীয় সাহিত্য কেবল রাশিয়ান সংস্কৃতির একটি অংশ এবং মানের দিক থেকে নিকৃষ্ট। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল। কেননা ইউক্রেনের অনন্য এবং নির্দিষ্ট সাহিত্য ঐতিহ্য আছে।
শুরু থেকেই কবিতা ইউক্রেনীয় সাহিত্যের একটি খুব জনপ্রিয় শাখা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং মর্যাদার সঙ্গে আজো তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। তবে বর্তমানে অনেক কবি ও কথাসাহিত্যিকের পদচারণায় ইউক্রেনীয় সাহিত্য স্বদেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে পরিচিতি পাচ্ছে এবং আগামিতে আরও প্রসারিত হবে। এ কথা সত্যি যে, অনেক ইউক্রেনীয়দের জন্য সাহিত্য হচ্ছে বিনোদন, অভিব্যক্তি এবং জীবনের এক অদ্ভূত আবেগ।
টীকা
১ অরেঞ্জ বিপ্লব – অরেঞ্জ বিপ্লব ছিল ২০০৪ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে থেকে ২০০৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ইউক্রেনে সংঘটিত বিক্ষোভ এবং রাজনৈতিক ঘটনার সংমিশ্রণ, যা ২০০৪ সালের ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের রান-অফ ভোটের তাৎক্ষণিক পরিণতিতে সংঘটিত হয়েছিল এবং ব্যাপক দূর্নীতি, ভোটার ভীতি প্রদর্শন এবং নির্বাচনী জালিয়াতির জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছিল।
২ কিভান-রুস – মধ্যযুগীয় (৮৬২-১২৪২ খ্রিস্টাব্দ) রাজনৈতিক ফেডারেশন, যা আধুনিক বেলারুশ, ইউক্রেন এবং রাশিয়ার অংশে অবস্থিত।
৩ ভিটাবাদের রোমান্টিকতাবাদ (ইংরেজিতে রোমান্টিসিজম অব ভিটাইজম) – এক ধরণের মতবাদ বা তত্ত্ব, বিশেষ করে লেখক ডি এইচ লরেন্সের ধারণায় বিশ্বাস করা হয় যে, মানুষের উচিত তার সহজাত প্রবৃত্তি এবং আবেগকে তার অতি-উন্নত বুদ্ধির সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ করে তোলা।
৪ রুশীকরণ – ইউক্রেনের রুশীকরণ ছিল ইউক্রেনে রাশিয়ার জাতীয়, রাজনৈতিক ও ভাষাগত অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্য ইম্পেরিয়াল রাশিয়ান এবং পরে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত আইন, অনুশাসন এবং অন্যান্য ক্রিয়াকলাপের সরকারী পদক্ষেপ। সেই পদক্ষেপ ছিল সাংস্কৃতিক আত্মীকরণের এক বিশেষ রূপ, যেখানে অ-রাশিয়ানরা, অনিচ্ছাকৃতভাবে বা স্বেচ্ছায়, রাশিয়ান সংস্কৃতি এবং রাশিয়ান ভাষার পক্ষে তাদের সংস্কৃতি এবং ভাষা ত্যাগ করতে বাধ্য থাকবে।
৫ পেরিস্ট্রোইকা – তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন বা সংস্কারের নীতি বা অনুশীলন, যা ১৯৭৯ সালে লিওনিদ ব্রেজনেভ প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে মিখাইল গর্বাচেভ বাস্তবায়ন করেন।
৬ হোলোডোমোর (সন্ত্রাস-দুর্ভিক্ষ বা মহাদুর্ভিক্ষ নামেও পরিচিত) – ১৯৩২ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউক্রেনের সংগঠিত দুর্ভিক্ষের কারণে লক্ষ লক্ষ ইউক্রেনীয়কে হত্যা করা হয়েছিল।
৭ বু-বা-বু (ইংরেজিতে Bu-Ba-Bu, যা ‘Burlesque’, ‘Balagan’, এবং ‘Buffonada’ শব্দ ত্রয়ীর আদ্য দুই অক্ষর দিয়ে গঠিত) – এ দলের লেখকরা ইউক্রেনীয় অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এক নতুন অনুভূতি তৈরি করার দিকে মনোনিবেশ করে। তারা নতুন মুক্ত কাব্যিক ভাষার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন যা সোভিয়েত এবং জাতীয়তাবাদী উভয় ট্যাবুকে ভেঙে দিয়ে নতুন ধারা প্রবর্তন করেছিল।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: বর্তমান প্রবন্ধ লেখার জন্য অসংখ্য প্রবন্ধ, নিবন্ধ এবং গবেষণা পত্রের প্রকাশিত তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। সেসব লেখার লেখকদের প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।
গল্পকার, ছড়াকার এবং অনুবাদক। লেখালেখির শুরু সত্তরের মাঝামাঝি। ঢাকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতায়, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে তার মৌলিক এবং অনুবাদ গল্প। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে দুটি গল্পের সংকলন, চন্দ্রপুকুর (২০০৮) ও কতটা পথ পেরোলে তবে (২০১০)। এছাড়া, তার অনুবাদে আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৩), নির্বাচিত নোবেল বিজয়ীদের সেরা গল্প (২০১৩), ইরানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৪), চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প ও নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে।