আমার বাড়ি
বাঁশ আর বাঁশ। সবুজ গাছে ঘেরা আমার বাড়ির চারিপাশ। হাজার হাজার পাখি আর লক্ষ প্রজাপতি। ঘরের সামনে বাগান ভরা হলুদ কলাবতী। দু-তিনশ মুরগি আছে চারপাঁচশ হাঁস। কৃষ্ণচূড়া ফুল আছে সুদৃশ্য পলাশ। বয়েরা হরতকী আছে আমলকী। বড় দিঘি পাড়ে আছে সাদা চখাচখি। পূর্ব পাশে গোরুর গামার উঁচু উঁচু ঘাস। চারিদিকে বাঁশ।
পরীদের বল
নদীগুলো চোখের মতো, চোখে তারা ভাসে। আকাশের পাখি এক নদী দেখে হাসে। সেই পাখি আমি। মাঝে মাঝে নামি। খেয়ে যাই জল। পাখিরা আকাশে যেন পরীদের বল। গাঙচিলগুলি। যেন রংতুলি, দিয়ে আঁকা ছবি। নদী যেন কবি। আঁকাবাঁকা কত লেখা। লিখছে সে একা একা। কাগজ যেন তার জমি ঘর বাড়ি। কৃষকের নারী, নদী দেখে হাঁসে। চোখে তারা ভাসে। সেই তারা আমি। মাঝে মাঝে নামি। খেয়ে যাই জল। পাখিরা আকাশে যেন পরীদের বল।
নতুন বাজার
চর আর চর । তার মাঝে ঘর। কাছে নদী দূরে সাগর মজার জীবন সুখেই আছি বন্যা জনমভর।
সাগর খালা যমুনা বোন খালের পাড়ে বাড়ি। বনের কাছে মনের কথা ধানের ক্ষেতে রোদের কাছে নতুন বধূর শাড়ি। বাজার দিন তেলের বোতল চটের ব্যাগে চাল। মায়ে বানায় দাদু বানায় বিক্রি হবে জাল।
দুধের গাভি বাঁশের জগ ফজর নামায পড়ে। নানা যাবে রোজ দিতে রোজ বাজার হোটেল ঘরে। নানার বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে বাজার পড়ে। মামার বাড়ি গেলে ঘুমাই মামতো বোনের ঘরে।
চৌরাস্তা মোড় শখের দোকান চকলেট পান বিড়ি। চটের নিচে খুচরো টাকা বসার নিচে পিঁড়ি। পাতার ঘর…টিনের দোকান…লন্ডি সেলুন হলে। বট গাছ আর মুদি দোকান নতুন বাজার খোলে।
দিনের পরে দিন চলেছে মাসের পরে মাস। নদীর মাঝে নতুন বাজার চরের দূর্বাঘাস।
কত নতুন পুরান যে হয় পুরান নতুন সাজে। সমুদ্রগো শক্তি দিও নতুন নতুন কাজে।
ধান
নতুন ধান উঠলে আমি তোমার বাড়ি যাবো।
চিতই পিঠা তৈরি করে মিঠাই দিয়ে খাবো।।
নিজের জমির পাকা ধান আলে দাঁড়িয়ে দেখার একটা হলুদ সুখ আছে। আবার কাস্তে নিয়ে ক্ষেতে নেমে যাওয়ার মধ্যে একটা লাল সুখ। কিষাণদের তাড়া দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় সবুজ আর গান গেয়ে ধান কাটায় একটা ম্যাজেন্টার ভালোবাসা আছে।
আশি পার্সেন্ট কৃষক আজো ভূমিহীনই আছে।
ধান বোঝা করে নিজের ছোট উঠোনে ফেলার মধ্যে নীল সুখ। আর পরের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা গেরুয়া জ্বালা আছে।
কৃষকের মেয়েরা আজও ছড়া কুড়ায় আর ছেলেরা কামলা খাটে অথবা মাছের নৌকায় যায়।
নিজের গরু দিয়ে ধান মাড়াইয়ের একটা আকাশী বেহেস্ত আছে। ছোট নাড়ার ঘর…উঠানে বরই গাছ…বিচ্ছেদী গান গেয়ে বরই খাওয়া দেখার মধ্যে শীতের কাঁথার আরাম আছে।
নব্বই পার্সেন্ট গ্রামে নেইকো চকি। আছে শুধু শীতের মোটা কাঁথা আর হোগলার নিচে নতুন ধানের নাড়া।
ধান ঘরে তুলে মটকী বা ডোলার মধ্যে রাখা অথবা বড় একটা নাড়ার চাউলি দিয়ে দেওয়ার মধ্যে একটা জমিদারী শান্তি আছে। শান্তিটা রংধনুর আর নদীর মতো সুন্দর।
মন
নদীর কাছে যারা থাকে মন খারাপ হলে তারা ঢেউয়ের কাছে যায়। নদী তো নারীর মতো। নারী তো রাতেই মধুর। মাঝির বেটারা রাত করে ঘরে ফেরে। তারা তো কুমার, নদী তো তাদের।
মেঘনা নদী কালো যুবকদের মুগ্ধ করে আষাঢ় শ্রাবণ এলে।
আমরা যারা বড়লোক আছি। মানে অবৈধ টাকা খেয়ে বাঁচি। তারা মন খারাপ হলে ছাদে যাই। আমাদের মেয়েরা বাথরুমে গিয়ে কাঁদে। আশি পার্সেন্ট ধনীর বাড়ি কালো টাকা আছে।
গরীবেরা কোথায় যায়।
চাষীর মন খারাপ হলে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে সন্ধ্যায় হাটের দিকে যায়। কিন্তু বধূরা কোথায় কাঁদে। পাতিল মাঝার ফাঁকে আঁচল ভিজে ওঠে পিতার কথা ভেবে।
মাওলানারা মন খারাপ হলে মসজিদে যায়। কিন্তু তার পুত্র যে নাস্তিক, সে কোথায় ভালো করে মন। সে কী করে তখন।
প্রাণীর মন খারাপ কেন হয়। কখনো মানুষের মন যদি না হতো খারাপ, আমার মন ভালো হতো খুব।
মস্ত বড় চাষী
শিখে চাষ। নিয়ে ঘাস। বাড়ি ফিরে আসি। আমার দিকে তাকিয়ে থাকে মাঠের মধ্যে চাষী।
পুকুর পারে। লেজ নাড়ে। তিনটি গরু বাধা। একটা কালো একটা হলুদ ছোট্র বাছুর সাদা। চারির মধ্যে দিয়ে ঘাস। শ্রাবন কিংবা পৌষ মাস।লাফিয়ে পরি পুকুরে। এই মধ্য দুপুরে। আমার সঙ্গে পাল্লা দেয় কয়েকটা রাজহাঁস। এই বার মাস। এই বারমাসী । বড় হলে আমি হব মস্ত বড় চাষী।
মৃত্যুর স্থান
এই যে পুকুর। কয়টা নেড়ি কুকুর। দু’চারটে গরু। গায়ের সবুজ ধান ক্ষেত আলগুলো সরু। বিচ্ছিন্ন বাড়ি। মাঠের মধ্যে হঠাৎ একটা লাল টুকটুকে শাড়ি। এই সব ছেড়ে । গাছের আম গাছের থেকে খাচ্ছি নিজে পেড়ে। যাবো কোন দেশে। ফুল পাখি আর মাঠের ধান আকাশ ভালোবেসে। কৃষক হওয়ার ধান্দা করি। কৃষকে গুরু ধরি। হয়ে তার শিষ্য। এ আমার বিশ্ব। মরতে চাই চরে । কোন গ্রামের কৃষক বাড়ির ছোট্র নাড়ার ঘরে।
কল
একটি রাইস মিলের মালিক হওয়ার ইচ্ছে নিয়ে বড় হয় কৃষকের ছেলে। বাড়িতে মেহমান এলে ঝাইজাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সকাল কিংবা দুপুর বেলায়। জগ নিয়ে ছোট ভাই তার পিছুপিছু যায়। আগে ভাগে চাড়া দিতে হয় খালের মোড়ে মোড়ে।
যেখানে খালের পাড়…লম্বা টিনের ঘর…সামনে ধান শুকানো ইট অথবা মাটির উঠোন…পাশেই সিদ্ধ করার চুলা ও তাফাল…বিরাট তুসের ঘর…এবং মস্ত চাকাওয়ালা একটি ইঞ্জিন থাকলে সেই স্থানকে বলা হয় রাইস মিল।
আমার এমন একটি রাইস মিলের মালিক হওয়ার ইচ্ছে আজও বুকের ভেতর। কৃষকের ধানকে আমি চাল করে দেব
শুনেছি সত্যের যুগে ধান গাছে ধরতো চাল। কোন নতুন জামাই শ্বশুড় বাড়ি থেকে ভরপুর খেয়ে ফেরার পথে ক্ষেত থেকে অবহেলায় চাল ছিঁড়ে খেয়েছিল বলে ধান হয়ে গেছে সব।
এক জোড়া গরু অথবা একটা ট্রিলারের মালিক হওয়ার আশা নিয়ে বড় হয় কৃষকের ছেলে।
মাছ
পুকুরে অনেকগুলো মাছ ভাসছিলো। আমারও ভাসতে ইচ্ছে হয়েছিল প্রবল। যদি মাছ হতাম সৃষ্টির শুকনো পাতা মুখের মধ্যে পুরে আবার ছেড়ে দিতাম। আমার গায়ে লালা জাতীয় এক প্রকারের পানির ওল থাকতো। মানুষ যদি পরীর মতো যা ইচ্ছে তাই হতে পারতো।
এক আউলিয়া পরীদের স্বর্ণের কই করেছিল। সে যদি আমার গুরু হতো। আমি যদি নদীর কোন মাছ হতাম আর সুলেমান বাদশার আংটি খেয়ে ফেলতাম।
কখনো কি মানুষ মাছ হবে? এমন কথা কোন ধর্মগুরু বা নবী বলেছিল কি? নোমরুদ বাদশা মাছেদের মানুষের খাদ্য করেছিল, আল্লাহকে মারতে গিয়ে। কিন্তু মাছেরা কি পূর্বে মানুষ ছিল, হলুদ পাখির মতো? শ্বাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া করে যে বধূ হলুদ মেখে পাখি হয়ে ছিল।
পুকুরটা অন্যের বিদেশী মাগুরগুলো পরের । যেখানে দাঁড়িয়ে দেখছি সেটাও আমার নয়। যে টাকাটা দিয়ে মাছেদের জন্য মুড়ি ক্রয় করেছি সেটা পিতার। আমার শুধু ইচ্ছেটা। মাছেদের আমি মুড়ি খাওয়াবো প্রতিদিন।
দেহ
আমি জানি ইতোমধ্যে আমাকে কিছুটা পঁচিয়ে দিয়েছে জ্ঞান। পঁচে গন্ধ বের হওয়ার আগেই শিড়দাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়েছি আর সারিয়ে নিচ্ছি আমার ক্ষত। আমি জানি আমার পঁচা থেকেও জন্ম নেবে কোন কীট। যার খবর পাবেনা বিজ্ঞান। যার খবর পাবে না ধর্ম। শুধু একজন কৃষক আমার পঁচা দিয়ে তৈরি করুক সার অন্তত এইটাই আমি চাই।
জন্ম ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার উত্তর মাদ্রাজ গ্রামে। এসএসসি সনদ অনুসারে জন্ম তারিখ ১লা জানুয়ারি ১৯৮১। ২০০০ সাল থেকে বিভিন্ন ছোটকাগজের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন ছোটকাগজে লেখা ছাপা হচ্ছে। দুটি বই। কাব্যগ্রন্থ : ১. দুধভাই। ২. রূপজালিয়া।