১
‘যে কোনোদিন তোর ফাঁসি টাসি হয়ে যাবে।’
কথা শুনে রিয়া ঠোঁট উল্টে হাসল। ওর কাঁধে ঝোলানো ছোট্ট ব্যাগ। একটুকরো কাপড় বের করে নাক মুছল। বললাম, ‘তোকে ঢাকা নিয়ে যাই চল।’
রিয়ার হাতে একটা চালকুমড়া আকৃতির বস্তু। গাঢ় সবুজ। তার ওর পশমি ঝিকমিক। মৃদু শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে জিনিসটার ত্বক ওঠানামা করছে।
‘আবার বানিয়েছিস?’
রিয়া দাঁত বের করে হাসল। সবুজাভ সাদা দাঁত। হাসি থামিয়ে নাক মুছল। ধূসরসবুজ চোখে দুষ্টুমি।
‘আমাকে বিপদে ফেলতে তোর ভালো লাগে খুব, না?’
রিয়া কোমল পা দুটো দুলিয়ে বলল, ‘লাগে।’
ওর কণ্ঠে ইদানিং পুরুষালি ভাব লেগে থাকে সর্দির কারণে।
রিয়ার ব্যাগে করে চালকুমড়া টাইপ জন্তুটাকে নিয়ে এলাম বাসায়। যথাসম্ভব শব্দ না করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলাম। মা বিকালের নাশতার জন্য ঝালপোয়া ভাজছে। ঘ্রাণে বাতাস ম ম।
রান্নাঘরে একটা হাড়ি ঝনঝনিয়ে পড়ল। আমি ব্যাগটা সাবধানে মেঝেতে নামিয়ে রেখে এগিয়ে গেলাম।
রান্নাঘরের পশ্চিম দিকটা খোলা। সমুদ্রের বাতাস আসছে। আকাশ লালচে। রাতে ঝড় এলে অবাক হবো না।
কড়াই ধুয়ে রাখতে গিয়ে হাড়ি গেছে পড়ে। শব্দটা ওটার। তুলে দিতেই মা তাকিয়ে হাসল। মায়ের হাসির ভেতর সবসময় একটা কষ্ট লেগে থাকে।
‘কখন পাব খেতে?’ ভুরু নাচিয়ে বললাম।
‘বাবা আসুক।’
ফিরে এসে ব্যাগটা তুলে নিয়ে আমার ঘরে চলে গেলাম। বিছানায় বসে চালকুমড়োটাকে বের করে চোখের সামনে তুলে ধরে দেখি, সবুজ পশমের নিচে উষ্ণ শরীরটা আগের নিয়মিত শ্বাসপ্রশ্বাসে ওঠানামা করছে।
‘ঘুমিয়ে গেলে ডেকে তুলিস না। নিজ থেকে উঠতে দিস,’ বলেছিল রিয়া।
‘কী কাজ ওর?’
‘মেঝেতে তোর জুতা দেখলেই খাটের নিচে পাঠিয়ে দেবে।’
‘মানে?’
‘আপাতত এই শিখিয়েছি। তোর মতো একজোড়া স্যান্ডেল কিনতে পঞ্চাশ টাকা খরচা হয়েছে, দিয়ে দিস।’
‘মরে গেলেও না!’
যন্ত্রণার শেষ নেই।
প্রাণিটা সবুজ চোখে আমার দিকে তাকাল। ওর সবুজ চোখের মাঝখানে কালো অন্ধবিন্দুটা গোলাকার না। তারকাকার। চোখে বড় বড় পাপড়ি, রিয়ার মতোই।
বললাম, ‘তুমি কে?’
প্রাণিটা আমার ঠোঁটের দিকে তাকাল।
‘কে তুমি?’ একই প্রশ্ন দ্বিতীয়বার।
প্রাণিটা এক লাফে আমার কোল থেকে নেমে পড়ল। চারটা তুলতুলে পা চালিয়ে মেঝেতে এলোমেলো হেঁটে একসময় টুক করে উঠে পড়ল আমার পড়ার টেবিলে।
টেবিলে আমার লেখা সাতটা বই। হাতে লেখা। সবচেয়ে মোটা বইটা সমাজ নিয়ে, সত্তর পাতা। সবচেয়ে ছোটো বইটা ধর্ম নিয়ে। বিশ পাতা।
প্রাণিটা কুণ্ডুলি পাকিয়ে তার ভেতর মাথা গুঁজল। হঠাৎ ‘ও, ভালো কথা,’ বলার ভঙ্গিতে বলল, ‘মেকি,মেকি!’
ওর নাম রাখলাম মেকি।
২
নীহারের বাজারের পশ্চিম প্রান্তে একটা ছাদখোলা মসজিদ। নির্বাসিতদের অনেকে পাঁচবার নামাজে আসে। নামাজের ইমাম আরাধন। সেবক শাহরিয়ার। মাগরিবের নামাজের পর একজন লোক দশজনকে বসিয়ে কিছু আলাপ করতে চেয়েছিল। আরাধন বানচাল করে দিল।
‘জটলা করা সরকারের নিষেধ!’
‘সরকারের দোহাই দেন কেন?’ মনে মনে বলল শাহরিয়ার। ‘এখানে তো আপনিই সরকার। ’
বইপত্রগুলো শেষবারের মতো ঝাড়ামোছা শেষ। শাহরিয়ার উঠে দাঁড়াল। আরাধন তার দিকে তাকিয়ে আছে।
‘মনে মনে কিছু বললে মনে হলো?’
শাহরিয়ার নতমুখে থাকল। বাতাসে তার ঢোলা পাজামা উরুর সঙ্গে সেঁটে আছে।
‘ঠিক আছে, যাও। তোমার ছেলে ভালো আছে? ওকে একদিন নিয়ে আসো। আলাপ করি।’
শাহরিয়ার চোখ তুলল না, মাথাও হেলাল না। এসময় হাতে জুতো নিয়ে মসজিদের উঠানে পা রাখল আসলাম। অন্ধকারে কাফন পরা মরদেহের মতো লাগল তাকে। এশা থেকে ফজর অবধি মসজিদে সেবার দায়িত্ব তার।
বসার ঘরে ঈয়নের লেখা ধর্ম বই পড়ছিল মালা। শাহরিয়ার দরজা ঠেলে ঢুকল।
‘শুভসন্ধ্যা!’ বলল মালা।
‘শুভসন্ধ্যা মালা! কেমন ছিলে সারাদিন?’ কপালে চুমু খেল শাহরিয়ার।
‘খুব ভালো। তুমি কেমন ছিলে?’
‘খুব ভালো। আরে, নতুন কিছুর ঘ্রাণ পাচ্ছি!’
‘ঝালপোয়া বানালাম। হাতমুখ ধুয়ে নাও।’
‘কেমন একটা বেড়াল বেড়াল গন্ধ।’
‘ওহ, ওটা ঈয়নের।’
‘ঈয়নের গা থেকে বেড়ালের গন্ধ আসছে?’
‘না না। রিয়া ওকে একটা আজব বেড়াল দিয়েছে।’
‘বলো কী!’
‘চিন্তাই হচ্ছে মেয়েটার জন্য।’
‘হওয়ারই কথা। আবার ধরা পড়লেই ফাঁসি। এখানে আরাধনের কথাই আইন।’
‘আরাধনই সব? বাকিরা? অন্য ধর্মেরও তো পুরোহিত আছে।’
‘সংখ্যালঘুত্ব মালা। ওর ওপর সভ্য অংশেই কথা চলে না। আর এখানে তো—’
‘কী অবস্থা বাইরে আর?’
মালার এগিয়ে দেওয়ার তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ চেপে চেপে মুছে নিচ্ছে শাহরিয়ার।
‘কুয়াশা, যথারীতি।’
‘এতো বাতাসেও যাচ্ছে না!’
‘ঘুরপাক খাচ্ছে।’
‘কোনো ব্যবস্থা নেবে না গভমেন্ট?’
‘ঢাকা থেকে বিজ্ঞানী আসার কথা। এলে ওরা খতিয়ে দেখত। আসছে না।’
‘কেন?’
‘নীহারে কেউ আসতে চায় না। প্রাণের ভয়।’ শাহরিয়ার মালার দিকে চেয়ার টেনে এগিয়ে দিয়ে বলেল, ‘বোসো।’ গলা চড়িয়ে ডাকল, ‘ঈয়ন, ঈয়ন ফ্লাক্স, হা হা হা!’
‘প্রাণের ভয় তো আমাদেরও আছে,’ মালা বলল।
‘আমরা তো বাতিলের খাতায় পাগলী!’
৩
মেকিকে নিয়ে খাবার ঘরে ঢুকলাম। পিঠা ভরা বোলটার দিকে তাকিয়ে মেকি চোখ পিটপিট করতে থাকল। মেকিকে দেখে বাবার চোখ গোল গোল হয়ে গেল।
‘এ কী রে? রিয়ার নতুন আবিষ্কার?’
বললাম, ‘হুঁ। নতুন যন্ত্রণা।’
‘কী কাজ ওর?’
‘বাদ দাও। কখন এলে?’
‘মুখহাত ধুয়েই ডাকলাম। অবেলায় ঘুম দিলি যে?’
‘মেকি ঘুমাল, দেখে আমারও পেল।’
‘মেকি নাকি নাম!’ বাবা দু হাত তুলে ডাকলেন, ‘মেকি, মেকি!’
মেকি হাই তুলল। একটা ঝালপোয়া হাতে নিয়েছিলাম। মেকি কেড়ে নিল। গরমে ওর পাতলা জিভ গেল পুড়ে। খো খো করে ফেলে দিল পিঠাটা। ধমকে উঠলাম। ‘কেন নষ্ট করলি? ফেলে দেবো বাইরে!’
মেকি হাসি হাসি মুখ করে কোলে বসে থাকল। বাবা বললেন, ‘এ তো বোধয় বুঝেছে তোর কথা!’
‘তা জানি না। তবে সম্ভাবনা আছে।’
একটা ঝালপোয়া ভেঙে ফু দিয়ে ঠান্ডা করলাম। তারপর মেকির মুখের সামনে ধরলাম। আর কিছু না হলেও লবণের স্বাদটা ওর ভালো লাগার কথা।
মেকি মুড়মুড়িয়ে খেতে থাকল। আমার ভাগের ঝালপোয়া থেকে ওকে দিচ্ছি। নিজের উদারতায় নিজেরই দমবন্ধ লাগছে। পঞ্চম ঝালপোয়া খাওয়ার পর মেকি লাফিয়ে কোল থেকে নেমে পড়ল। মুহূর্তে টেবিলে একটা হুটোপুটি। বাবা মা দুজনই দুজনের ভাগের ঝালপোয়া এগিয়ে দিয়েছে আমার দিকে।
এ দেখছি মধুর সমস্যা!
এমন সময় বাইরে হট্টগোল।
বসার ঘরে গিয়ে জানালা দিয়ে দেখলাম, পাবিহীন হাতির মতো হলদে শরীর নিয়ে এগিয়ে আসছে অ্যালকানি। পালাচ্ছে লোকেরা। ওদের পেছনে কিলবিল করছে অ্যালকানির সত্তরটা শুঁড়। সবাই ঝাটাঝট ঘরের জানালা লাগিয়ে দিচ্ছে, দোকানের ঝাঁপ ফেলে দিচ্ছে। যারা বাসায় ঢুকতে পারেনি তখনো, দমাদম কিল মারছে দরজায়।
আমার ঘাড়ের কাছে শ্বাস ফেলছে বাবা।
‘অনেকদিন পর বের হলো এ জিনিস।’
‘বাবা!’
বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমিও বাবাকে। দুজনের ধুকপুক দুজনই বুঝতে পারছি।
‘আমি মেকিকে দেবো না বাবা।’
‘ঠিক আছে ঈয়ন। কিন্তু কিভাবে কী করবে মাথায় আসছে না।’
‘আমার এসেছে। বিদায় বাবা। বোলো মাকে!’
মেকি বাড়ির পেছনের উঠানে মাছি ধরতে চেষ্টা করছে। আমি ওকে কোলে তুলে নিয়ে পশ্চিম দিকে ছুটতে শুরু করলাম। চাঁদের আলোর নিচে আমার সঙ্গে সঙ্গে ছুটছে বনগোলাপের ঝাড়, সোনালী বাঁশ, আর একারা নদীর মরা শাখা।
একতলা সাদা বাড়িটা দেখতে পেলাম। বাড়ির পেছনে মাথা তুলে আছে নারকেল গাছ। বাড়ির দুপাশে কলাগাছ বাতাসে পাতা নাড়ছে উদারার কানের মতো।
আমার চোখের সামনে উদারা, মুদারা, তারার টুকরো টুকরো শরীর চোখে পড়ল। এক কোণে লকলক করছে অ্যালকানির শরীর। আসলামের হাতের শিখা। আরাধন পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আগুনের আলোয় তার মুখের একপাশ সোনালী। ইশারা পেয়ে আসলাম রক্তাক্ত টুকরোগুলোর দিকে এগিয়ে আসতে থাকল। মেছো রক্তের গন্ধ বাতাসে।
বাড়ির কাছে গিয়ে কড়া নাড়ার আগেই দেখি, দরজা খোলা। রিয়ার বাবা মেঝেতে পড়ে আছেন। মা বিছানায় অচেতন।
রিয়ার ঘর তছনছ। তোষক উল্টে মেঝেতে পড়ে আছে। কাপড়চোপড় ঘরময় ছড়ানো।
বাড়ির দক্ষিণপাশে রিয়ার ছোটো পরীক্ষাগারের দিকে ছুটে গেলাম। বেড়ার ঘরটা দুমড়ে প্রায় মিশে আছে মাটিতে। পড়ে আছে ভাঙা তাক। ছেঁড়াখোঁড়া বইপত্র ছড়ানো। কাচের জারগুলো ভাঙা পড়ে আছে। মিষ্টি আলুকুঁচির ঘ্রাণে ভরে আছে বাতাস।
এক কোণে মেকির মতো তিনটি শিশুর মাথা থেঁৎলে দেওয়া। আমি মেকির চোখ আড়াল করে ঘুরে দাঁড়ালাম।
রিয়ার ঘরে গিয়ে বিছানার চাদরটা টেনে নিয়ে আবার এলাম পরীক্ষাগারে। মেকিকে কাঁধে চড়ালাম। বইগুলো রক্ষা করা চাই।
দ্বিখণ্ডিত পর্যায় সারণিসহ ছেঁড়াখোঁড়া কাগজগুলো সব এক করতে থাকলাম। বাজারের ঠোঙার খয়েরি কাগজময় কালো কালির ছোটো ছোটো অক্ষরে লেখা গবেষণার বিস্তারিত। রসয়ানের সূত্র, গাণিতিক অনুসিদ্ধান্ত, হাতে আঁকা প্রাণিদেহের ছবি।
বিছানায় দ্রুত দুটো গিঁট দিলাম। তারপর এক হাতে টানতে টানতে চললাম মূলবাড়িতে শোবার ঘরের দিকে।
খাটের নিচের অন্ধকারে ছুড়ে দিলাম।
কোথায় নিয়েছে ওরা রিয়াকে?
দূরে সমুদ্র গর্জন করছে। বিকেলের কথা মনে পড়ল।
রিয়াকে বলছি, ‘যে কোনোদিন তোর ফাঁসি টাসি হয়ে যাবে।’
আমার কথা ফিরিয়ে নিলাম প্রকৃতি। ফিরিয়ে নিলাম, মহানিয়মের দোহাই।
পেছনে ঘড়ঘড় শব্দ। অ্যালকানি এসে দাঁড়িয়েছে। কিলবিল করছে সত্তরটা শুঁড়। ওর কালো ভেজা চোখ দুটোয় চাঁদের আলো।
নিচু হয়ে দুটো পাথর কুড়িয়ে নিলাম।
কথাসাহিত্যিক। জন্ম- ১৯৮৭ সালের ৯ অগাস্ট, ঢাকায়। আহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক। প্রকাশিত গ্রন্থ: জঠর (২০১৬), কারখানার বাঁশি‘ (২০১৮)।