উৎপলকুমার বসু বিগত শতাব্দীর পাঁচের দশকের কবি। বেঁচে থাকতেই যিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা কবিতা জগতের অনিবার্য নাম। তার কবিতা পাঠকের কাছে এক বিস্ময় আর রহস্যের আধার হিসেবে আবির্ভূত হয়৷ তিনি তো সকলের মতো লেখেন না, তার আছে এক ‘ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা’৷ যার সমুখে দাঁড়ালে মনে হয়, এর সকল শব্দই বুঝি অমোঘ— বিকল্পহীন!
উৎপলকুমার বসুর কবিতা জীবন দুটো পর্যায়ে ভাগ করা যায়। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি কৃত্তিবাস পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটলে তিনি তাতে যোগদান করেন এবং তাঁর কবিতায় একটা বড় বাঁক লক্ষ্য করা যায়। এই আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে ১৯৬৪ সালে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয় এবং যোগমায়া দেবী কলেজের অধ্যাপনার কাজ থেকে বরখাস্ত হন।
উৎপলকুমার বসুর কবিতা জীবন দুটো পর্যায়ে ভাগ করা যায়। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি কৃত্তিবাস পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটলে তিনি তাতে যোগদান করেন এবং তাঁর কবিতায় একটা বড় বাঁক লক্ষ্য করা যায়। এই আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে ১৯৬৪ সালে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয় এবং যোগমায়া দেবী কলেজের অধ্যাপনার কাজ থেকে বরখাস্ত হন। হয়তো এর সূত্র ধরেই ১৯৬৫ সালে কবি কলকাতা তথা ভারত ছেড়ে সুদূর লণ্ডনে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। লন্ডনে যাবার আগে কবির দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল; ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’ (১৯৬১) ও ‘পুরী সিরিজ’ (১৯৬৪)। ১৯৭৮ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। লন্ডনে থাকাকালীন তিনি কবিতা থেকে দূরে থাকলেও কলকাতায় ফিরে এসে আবার লিখতে শুরু করেন। এসময় প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আবার পুরী সিরিজ’ (১৯৭৮)। এরপর থেকে নিয়মিতভাবে তাঁর কবিতার বই প্রকাশিত হতে থাকে। এই সময়ের কবিতার বইগুলো হলো, লোচনদাস কারিগর (১৯৮২), খণ্ডবৈচিত্রের দিন (১৯৮৬), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯১), সলমা-জরির কাজ (১৯৯৫), পদ্যসংগ্রহ (১৯৯৬), কবিতাসংগ্রহ (১৯৯৬), সুখ-দুঃখের সাথী (২০০৬), কহবতীর নাচ (১৯৯৭), নাইট স্কুল (১৯৯৯), টুসু আমার চিন্তামণি (২০০০)। যেহেতু লন্ডনে বাস করার সময় তিনি কবিতা লেখেননি, তাই লন্ডন পর্বের আগে ও পরে— এই দুই পর্যায়ে তাঁর কবিতা ভাগ করা যেতেই পারে।
অসংখ্য কবি সৃষ্টির অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন তিনি। এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নিজেই বলেছিলেন, “কলকাতার অনেকে ঠাট্টা করে বলে যে, আমি নিজে এত কবি সৃষ্টি করেছি, যদি অভিযোগ করা হয়, বাংলায় এত কবি কেনো, তাহলে নাকি আমাকেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তবে এটা খুব গৌরবের কথা,কবিতা যিনি লিখবেন তিনি এত বেশি স্বাধীনতাকামী, সত্যি কথা বলতে কী, যারা ফিল্ম করেন, ছবি আঁকেন, তাঁদেরও একটি পিছুটান আছে। আমাকে ভাবতে হবে আমার ছবি বিক্রি হবে কিনা, আমার ফিল্ম কে দেখবে এসব আর কী। কিন্তু কবিরা এদিকটায় একদম ঢুকতে চায় না।”
উৎপলকুমার বসুর কবিতার পরিসর অত্যন্ত বিস্তৃত৷ তাঁর কবিতা যেন সমাজ, সংস্কার, কাঁটাতার, জাগতিক সবকিছু ছাড়িয়ে ছুঁয়ে নেয় প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে আদিম-চিরায়ত সেতু! ১৯৫০-র দশকের কবিতার বৈশিষ্ট্য পেরিয়ে তিনি নিজের মতো করে এক বিকেন্দ্রীক কবিতার ভাষা নির্মাণ করেছেন৷ ফলে একদম আলাদা করে তাকে চিনে নিতে আমাদের অসুবিধে হয় না৷ তিনি প্রচলিত ট্র্যাডিশনকে ভেঙে নিজের মতো করে গতি দিয়েছেন; কাব্যভাষা হয়ে উঠেছে ম্যাজিক্যাল৷ কবিতার প্রয়োজনে তিনি ভাষাকে যেমন শাসন করেছেন তেমনই অতিকথন ঝেড়ে ভাষার পরিমিত ব্যবহার করেছেন৷ অতিব্যবহারের আড়ষ্টতা কাটিয়ে যেসব প্রচল শব্দ তিনি অসামান্য দক্ষতায় কবিতার শরীরে প্রোথিত করেছেন তা এক ম্যাজিক্যাল ফর্মেরই নির্দেশক৷ অঞ্জন আচার্য যথার্থই লিখেছিলেন, “নিজের কবিতার ভাষাকে ক্রমাগত ভাংচুর করতে করতে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন এমন এক ম্যাজিক-উপত্যকায়, যেখানে পৌঁছতে পিঠে এক ব্যাগ অতি-প্রাকৃতিক মন্তাজ ও মাথায় এক আকাশ নক্ষত্র প্রয়োজন৷”
কিন্তু উৎপল সংখ্যা আর প্রকাশ হচ্ছে না৷ লেখকগণ খোঁজ নিচ্ছেন— তাগাদা দিচ্ছেন— সংখ্যাটি প্রকাশের জন্য৷ কিন্তু আয়োজন তো শেষ হচ্ছে না! যতোটা চাইছি— ততোটা হচ্ছে না! উৎপলকে আরও পড়ছি— জানছি— অনুভব করছি— নবরূপে তাকে আবিষ্কার করছি— বছর গড়িয়ে যাচ্ছে—৷
পুজো করতে নয়, আতশকাচের তলায় বুঝে নেবার কাঙ্ক্ষা থেকেই ২০১৫ এ প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করি বিন্দুর উৎপলকুমার বসু সংখ্যা প্রকাশের৷ তখনো বিন্দুর ওয়েবসাইট চালু হয়নি৷ সংখ্যার পরিকল্পনা করতে থাকি৷ সেই অনুযায়ী কাজ শুরু করলাম৷ এর মধ্যে আমাদের হতবিহ্বল করে উৎপল প্রয়াত হলেন ২০১৫-র অক্টোবরে৷ সংখ্যা প্রকাশের যে আয়োজন, তার সামান্যই অগ্রগতি হয়েছিলো তখন— পরের বছর সেপ্টেম্বরে মাত্র ছয়জন লেখকের প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশ করলাম বিন্দুর ক্রোড়পত্র— ‘স্পর্শ করে অন্য নানা ফুল’৷ কিন্তু পূর্ণাঙ্গ সংখ্যা প্রকাশের ভাবনা মাথায় রয়েই গেল৷ কেটে গেল আরও চারটি বছর৷ এর মধ্যে আরো অনেকের কাছেই প্রবন্ধ নেয়া হয়েছে৷ সেই সকল প্রবন্ধ কতদিন জমিয়ে রাখা যায়! এর মধ্যে বিন্দুর নানারকম কাজ হচ্ছে ৷ কিন্তু উৎপল সংখ্যা আর প্রকাশ হচ্ছে না৷ লেখকগণ খোঁজ নিচ্ছেন— তাগাদা দিচ্ছেন— সংখ্যাটি প্রকাশের জন্য৷ কিন্তু আয়োজন তো শেষ হচ্ছে না! যতোটা চাইছি— ততোটা হচ্ছে না! উৎপলকে আরও পড়ছি— জানছি— অনুভব করছি— নবরূপে তাকে আবিষ্কার করছি— বছর গড়িয়ে যাচ্ছে—৷ স্বাভাবিকভাবেই অনেকে ধৈর্য্যহারা হচ্ছেন৷ অপরদিকে নতুন নতুন প্রবন্ধ যুক্ত হয়েই চলেছে— কলেবর বৃদ্ধি হচ্ছে৷ এরই মধ্যে ২০১৯ এর মার্চে `বিন্দু’ ওয়েবসাইট এর যাত্রা শুরু হলো৷ পরিকল্পনায় খানিকটা পরিবর্তন এনে পরের বছর ঘোষণা দিলাম অনলাইনে উৎপলকুমার বসু সংখ্যা প্রকাশ করবো৷ ঘোষণা দেয়ার পর বিপুল সাড়া পেলাম বাঙলাদেশ ও ভারতের লেখকদের থেকে৷ যুক্ত হলো আরো নতুন প্রবন্ধ ও একটি কবিতা৷ সেই সব লেখাপত্র নিয়ে ২০২০ এর অক্টোবরে অনলাইনে প্রকাশিত হলো বিশেষ সংখ্যাটি৷ প্রকাশের পরই তা পাঠকমহলে সমাদৃত হলো এবং প্রস্তাব আসতে লাগলো— সংখ্যাটি প্রিন্ট করার৷ কিন্তু অনলাইন সংস্করণে যে কলেবর দাঁড়িয়েছে— তা মুদ্রণের ব্যায়ভার বহন করা বিন্দুর পক্ষে কষ্টসাধ্য হবে বুঝতে পারলাম৷ পাশে দাঁড়াল ঘাসফুল প্রকাশনার মাহাদী আনাম৷ কলেবরের কথা চিন্তা করে আমি প্রথমে লেখা সংগ্রহের পরিধি বৃদ্ধি করিনি৷ কিন্তু মাহাদী ভাই বিপুল উৎসাহ নিয়ে বইটা প্রকাশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ায় নতুন উদ্যমে আবার শুরু হলো কাজ৷ নতুন করে লেখা সংগ্রহ করতে লাগলাম৷ পুরনো/গুরুত্বপূর্ণ লেখা, সাক্ষাৎকার স-ব খুঁজে বেড়াতে লাগলাম৷ কোথায় কে কবে কী লিখেছেন, এধার ওধার করতে লাগলাম স-ব৷ শঙ্খ ঘোষের সাক্ষাৎকার পেলাম, উৎপলের সাক্ষাৎকার পেলাম কয়েকটা, উৎপল একবার বাঙলাদেশে এসেছিলেন সেই ভ্রমণের বিস্তারিত প্রতিবেদন পেলাম, সালভাদর দালির পেইনটিং এর সাথে উৎপলের রা-রা ডিমোক্রেসি কবিতা প্রসঙ্গে প্রবন্ধ পেলাম, উৎপলের সঙ্গীসাথী, তরুণ বন্ধু, যারা নিকট থেকে দেখেছেন তাকে তারা যেমন লিখলেন আবার তেমনই যারা কখনো সাক্ষাৎ পাননি তাঁর— তারাও লিখলেন! যেদিকেই বাড়িয়েছি হাত করতল ঢেকেছে মাধুকরী! ভারত ও বাঙলাদেশের অর্ধশত প্রবন্ধ মিলিয়ে বই প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠায় রূপ নিলো! ২০২১ এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশের পরিকল্পনা করলাম৷ সেই অনুযায়ী রাজীব দত্ত প্রচ্ছদ করলেন৷ সেই প্রচ্ছদে কভার ছাপা হলো৷ সব ঠিকঠাক চলছিলো৷ এর মধ্যে করোনা এসে হাজির— সাথে অনিবার্য লকডাউন— প্রেস-বাঁধাইখানা বন্ধ, বইমেলা ম্যাসাকার! আর্থিক ধ্বস নেমে এলো৷ উৎপলকুমার বসু প্রিন্ট করার বাস্তবতা রইলো না৷ ফেব্রুয়ারির পর আবার শুরু করলাম কাজ— কভার ছাপা হয়ে পড়ে রইলো প্রেসের গোডাউনে৷ দেখতে দেখতে আরো এক বছর চলে গেল! এর মধ্যে আরো তিনটি প্রবন্ধ যুক্ত হলো! কাজ থেমে রইলো না আসলে— চলতেই থাকলো৷ আমি তো এত বড় বই আগে কখনো করিনি! ফলে অন্যের যা করতে এক মাস লাগে, আমার লাগে তিন মাস! তবু কাজ তো হওয়া চাই মনের মতো৷ সময় বয়ে চলেছে৷ সে তো আর আমার জন্য বসে নেই! ওদিকে লেখক-পাঠকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত! পুরো ২০২১ সাল বইটা নিয়ে মুখ খুললাম না আর৷ শুধু কাজই করে গেলাম৷ কাজ সমাপ্তির মুখে হাতে এলো সাহিত্য আকাদেমী (ভারত) কর্তৃক ইংরেজিতে প্রকাশিত উৎপলের একমাত্র জীবনপঞ্জি! বাঙলায় অনুবাদ করে যুক্ত করা হয়েছে সেটিও৷
এই সকল কিছু বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে বলেই আমার ধারণা৷ ফেব্রুয়ারি ২০২২ এ বইটি পাঠকের হাতে তুলে দিতে আমরা সচেষ্ট৷ পাঠকের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত আমাদের সম্মিলিত পরিশ্রম৷ পাঠক, আপনার সমালোচনা প্রত্যাশা করি৷
জন্ম ৩০ ডিসেম্বর, কুড়িগ্রামে৷ ২০০৬ থেকে লিটলম্যাগ ‘বিন্দু’ (bindumag.com) সম্পাদনা করছেন। প্রকাশিত বই :
গদ্য : সুবিমল মিশ্র প্রসঙ্গে কতিপয় নোট ৷
কবিতা : বিগত রাইফেলের প্রতি সমবেদনা , মার্কস যদি জানতেন, হলুদ পাহাড় , চোখের ভেতরে হামিং বার্ড
মুক্তগদ্য: লোকাল ট্রেনের জার্নাল
e-mail: sammoraian@gmail.com