রবিবার, নভেম্বর ২৪

ঋতুপর্ণের নারী-নির্মাণে মাতৃত্ব : কেন তিনি অনন্য

0

ঋতুপর্ণ ঘোষ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি জানি আমার শহর না পারবে আমায় গ্রহণ করতে, না পারবে আমায় ফেলে দিতে।’ কত কারণেই তো এই কথার সার্থকতা অবশ্যম্ভাবী। তবে যদি স্রেফ একটি নির্দিষ্ট কারণ দেখাতে বলা হয় বাংলা চলচ্চিত্র জগতে ঋতুপর্ণের অমরত্ব প্রসঙ্গে, তাহলে সেটি হবে তাঁর চলচ্চিত্রের নারী-নির্মাণ।

নারীমনের প্রগাঢ় বিশ্লেষণ ও বিন্যাস তাঁর ছবিগুলোকে করে তুলেছে এতটাই অনুভূতিপ্রবণ ও সংবেদনশীল যে, সেগুলোকে চাইলে প্রশংসা করে সপ্ত আসমানে যেমন তুলে দেয়া যায়, তেমনই সমালোচনার নামে নিন্দার কাঁটা বিঁধিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করা যায়; কিন্তু তাঁকে ও তাঁর সৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করা? নৈব নৈব চ!

শুধু বাংলা কিংবা ভারতীয় চলচ্চিত্র কেন, গোটা বিশ্ব চলচ্চিত্রেই নারীত্বকে পুরুষতান্ত্রিকতার চিরন্তন ঘেরাটোপ থেকে বের করে এনে, এক বাস্তবসম্মত ও সত্যনিষ্ঠ রূপদান করায় অগ্রগণ্য ব্যক্তি হলেন ঋতুপর্ণ। নারীমনের প্রগাঢ় বিশ্লেষণ ও বিন্যাস তাঁর ছবিগুলোকে করে তুলেছে এতটাই অনুভূতিপ্রবণ ও সংবেদনশীল যে, সেগুলোকে চাইলে প্রশংসা করে সপ্ত আসমানে যেমন তুলে দেয়া যায়, তেমনই সমালোচনার নামে নিন্দার কাঁটা বিঁধিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করা যায়; কিন্তু তাঁকে ও তাঁর সৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করা? নৈব নৈব চ!

এই রচনার আলোচ্য বিষয়ও ঋতুপর্ণের ছবিতে নারীত্বের উপস্থাপন। তবে নারীত্ব বিষয় হিসেবে এত ব্যাপক ও বিস্তৃত যে, আলোচ্য বিষয়কে সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে কেবল মাতৃত্বে। নারীত্বের আলোচনায় মাতৃত্ব সর্বাগ্রে গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতিতে নারীত্বের জয়গান মূলত কেন্দ্রীভূত হয় নারীর মাতৃত্ব গুণে। এখানে নারীর জীবনের পরিপূর্ণতার প্রধান পরিমাপক যন্ত্র তার গর্ভে সন্তান ধারণের সক্ষমতা। দেবীরা পরম পূজনীয় মা হিসেবে। এমনকী দেশ, সে-ও আরেক মা, তাই তো তার প্রতি সন্তানদের এত দরদ, এত ভালোবাসা।


Titli & 19 April

তিতলি’ ও ‘১৯শে এপ্রিল’ সিনেমার পোস্টার


এখানে ঋতুপর্ণের ছবিতে মাতৃত্বের বিচিত্রতা আলোচিত হবে দুইটি ছবির আধেয়কে উপজীব্য করে। ছবি দুইটি হলো : ‘উনিশে এপ্রিল’ এবং ‘তিতলি’।

১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘উনিশে এপ্রিল’-এর কাহিনি আবর্তিত হয় অদিতি ও তার মা সরোজিনীকে কেন্দ্র করে।

কোনো এক উনিশে এপ্রিল, অদিতি যখন নিতান্তই শিশু, মারা যান তার বাবা মনীশ। এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। প্রকৃতির নিয়মে এসেছে আরেকটি উনিশে এপ্রিল, অর্থাৎ অদিতির বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। সদ্য ডাক্তারি পাশ করা অদিতি থাকে দিল্লিতে, কিন্তু ঘটনাক্রমে এ দিনে সে রয়েছে কলকাতায়, তার মায়ের বাড়িতে। তবে অদিতির মা সরোজিনী ব্যস্ত মানুষ, কেননা তিনি বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী; ফলে স্বামীর মৃত্যুবার্ষিকীর কথা বেমালুম ভুলে গেছেন, ঠিক যেভাবে তিনি উপস্থিত ছিলেন না স্বামীর মারা যাবার দিনটিতেও।

ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে দেখানো হয়, অদিতির বেড়ে ওঠার সময়টায় নিয়মিতই পেশাদারি ব্যস্ততায় দূরে দূরে থাকতে হয় সরোজিনীকে। তাই মায়ের প্রতি অদিতির মনে রয়েছে চাপা ক্ষোভ, কিংবা তীব্র অভিমান। মায়ের প্রতিভা ও খ্যাতিকে সে সুপ্রসন্ন দৃষ্টিতে দেখতে পারে না, বরং মাকে নিতান্তই স্বার্থপর একজন মহিলা বলে মনে করে। সরোজিনীও মেয়েকে কখনোই কাছে টেনে নেননি, কিংবা নিতে পারেননি। কারণ মেয়ের চোখে তিনি প্রয়াত স্বামীর অক্ষম অসূয়ার ছাপ খুঁজে পান। সময়ের সাথে সাথে মা-মেয়ের মাঝে সৃষ্টি হয় মহাদেশ-মহাসাগর দূরত্ব। তাদের পারস্পরিক আলাপচারিতায় বারবারই ঘটে সেই দূরত্বের, বিচ্ছিন্নতার বিচ্ছুরণ।

একে তো সরোজিনী স্বামীর মৃত্যুবার্ষিকীর কথা ভুলে গেছেন, মেতে রয়েছেন নাচ ও নাচের ছাত্রীদের নিয়ে, তার উপর আবার সকাল থেকেই বাড়িতে এসে বসে আছেন তার বিশেষ বন্ধু সোমনাথ। স্বাভাবিকভাবেই অদিতির জন্য এই ব্যাপারগুলো বড্ড পীড়াদায়ক। বিষয়টি আরও খারাপের দিকে মোড় নেয়, যখন টেলিফোনের মাধ্যমে সরোজিনী একটি অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার খবর পেলে মনীশের মৃত্যুবার্ষিকীকে ছাপিয়ে গোটা বাড়িতে এক উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। এদিকে অদিতির প্রেমিক সুদীপ তাকে ফোন করে জানায়, অদিতিকে সে বিয়ে করতে পারবে না, কেননা অদিতির মায়ের নাচের পেশাটিকে সুদীপের মা মেনে নিতে পারছেন না। সুদীপের ফোন পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে অদিতি। কিন্তু অদিতির আকস্মিক বিমর্ষতার কারণ বুঝে উঠতে পারেন না সরোজিনী। বুঝতে অবশ্য চানও না, কারণ তাকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়তে হয় মাদ্রাজের ফ্লাইট ধরতে; সেখানে গিয়ে গুরুজিকে প্রণাম করবেন তিনি।

19 April 1

উনিশে এপ্রিল সিনেমার দৃশ্যে অপর্ণা সেন ও দেবশ্রী রায়

বাড়িতে একা হয়ে পড়ে মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত অদিতি। হঠাৎ বাইরে শুরু হয় ঝড়বৃষ্টি। চলে যায় বিদ্যুৎ। ডেস্কে বসে লিখতে আরম্ভ করে সে, যা অনেকটা সুইসাইড নোটের মতো। ধীরলয়ে কাটতে থাকে সময়; সংলাপহীন তবে শব্দহীন নয়। ক্যামেরায় ধরা পড়ে মোমবাতির আলোয় অদিতির অশ্রুসিক্ত মুখ এবং টেবিলের উপর রাখা ঘুমের ওষুধ। নিখুঁতভাবে কানে বাজে বাথরুমের ট্যাপ থেকে জল পড়া, রকিং চেয়ারের দুলুনি এবং বাইরে বজ্রপাতের শব্দ। এমন একটি আবহের প্রস্তাবনা ঘটে যে, দর্শক নিজের অজান্তেই তার সবগুলো ইন্দ্রিয় বিনিয়োগ করে অদিতির অনুভূতির সাথে একাত্ম হয়ে উঠতে থাকে। মনের মধ্যে খেলা করে অন্য এক আশঙ্কাও : বাবার মৃত্যুর দিনে অদিতিও কি নিজের প্রাণনাশের মাধ্যমে প্রমাণ করবে ছবির নামকরণের সার্থকতা?

ঠিক সেই সময়ই দরজায় আবির্ভাব সরোজিনীর। আবহাওয়া খারাপ থাকায় ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়েছে তার, তাই বাড়ি ফিরে এসেছেন তিনি। মা-মেয়ের মধ্যে কিছু বিক্ষিপ্ত কথোপকথন চলে। হয় কিছু অতীতের স্মৃতি রোমন্থন। এক পর্যায়ে অদিতির সুইসাইড নোটটি চোখে পড়ে সরোজিনীর। অদিতি তখন বাথরুমে। ভীষণ উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন সরোজিনী। ভাবেন তার মেয়েটা বুঝি বাথরুমে বসে সুইসাইডের চেষ্টা করছে। কিন্তু না, বেরিয়ে আসে অদিতি। ঘটনাপ্রবাহের নাটকীয়তা শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছালে, অবশেষে ভেঙে পড়ে মা-মেয়ের মধ্যকার বিবদমান সম্পর্কের দেয়াল।

সরোজিনী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ছেলেমেয়ে মানুষ করার দায়িত্বটা খুব সহজ দায়িত্ব নয়, মিঠু। তাতে অনেক পরিশ্রম লাগে। আর সবাই সেটা একভাবে করেও না।’ জবাবে অদিতি আরও বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে, ‘তাই সবার ছেলেমেয়ে একরকম হয়ও না!’ এবার জানা যায় সরোজিনীর আত্মপক্ষ সমর্থনের আখ্যান। এতক্ষণ কেবল একতরফা ন্যারেটিভে সরোজিনীকেই খল বলে মনে হলেও, তার বয়ানে দৃশ্যমান হয় মুদ্রার অপর পিঠও। জানা যায়, তার উপর দিয়ে কতটা গেছে এক মিডিওকার স্বামীর হীনম্মন্যতাবোধের। কীভাবে কারো স্ত্রী বা কারো মা হয়ে ওঠা, নাকি নিজের স্বপ্ন, নিজের প্যাশনের পেছনে ছোটা— এই দুইয়ের টানাপোড়েনে নিরুপায় হতে হয়েছে তাকেও। একজন মাঝারি মাপের মানুষ, আর একজন মানুষ যে মনে-প্রাণে শিল্পী— তাদের সহাবস্থানটা কখনোই সহজ নয়; আর সেই অসহজেরই ভুক্তভোগী হতে হয়েছে সরোজিনীকে, ঠিক যেমন হতে হয়েছিল মনীশকেও।

এই ছবির মাধ্যমে ঋতুপর্ণ চিরাচরিত ‘আদর্শ নারী’-র চিত্রায়ন থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। সরোজিনীর মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন এমন এক নারীকে, যিনি আপাতদৃষ্টিতে ‘ভালো মা’ নন, যেটি কিনা সমাজে বিবেচিত হয় নারীত্বের মৌলিক বিশেষত্ব হিসেবে। 

এই ছবির মাধ্যমে ঋতুপর্ণ চিরাচরিত ‘আদর্শ নারী’-র চিত্রায়ন থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। সরোজিনীর মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন এমন এক নারীকে, যিনি আপাতদৃষ্টিতে ‘ভালো মা’ নন, যেটি কিনা সমাজে বিবেচিত হয় নারীত্বের মৌলিক বিশেষত্ব হিসেবে। তিনি মেয়ের বেড়ে ওঠার সময় তার পাশে থাকেননি, মেয়ের মনের খবর রাখেননি, মেয়ের পড়াশোনা বা ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে খুব একটা জানার চেষ্টা করেননি। এভাবেই, নারীমাত্রেই যে মাতৃত্বের ‘আদর্শিক বোঝা’ চেপে বসে কাঁধে, সরোজিনীকে দেখা গেছে তা থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে নির্ভার থাকতে।

19 April 2

উনিশে এপ্রিল সিনেমার দৃশ্যে অপর্ণা সেন ও দেবশ্রী রায়

আবার ঋতুপর্ণ দেখিয়েছেন আপাতদৃষ্টিতে এক ‘খারাপ স্ত্রী’-কেও, যিনি তার স্বামীর মৃত্যুবার্ষিকীর কথা ভুলে যান, মেতে থাকেন কেবল নিজের নাচ, পুরস্কার, গুরুজি প্রভৃতিকে নিয়ে। এভাবেই ‘সম্বন্ধমূলক আকাঙ্ক্ষা’-র বাইরে গিয়ে যে নারীর ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাও থাকতে পারে, তা-ও উপস্থাপিত হয়েছে, যা অনেক দর্শকের কাছেই অপরিচিত ও অনারামদায়ক। আর শুধু দর্শকই বা কেন, সরোজিনীর এই রূপ তো মেনে নিতে পারেনি তার নিজের মেয়েও, যে আধুনিকা, উচ্চশিক্ষিতা ও ভাবপ্রবণ, কিন্তু মানসিক নৈকট্য বা পক্ষপাত প্রদর্শন করেছে বাবার জন্যই, মায়ের জন্য নয়।

তবে সরোজিনীর এই অপরিচিত, ভিন্নধর্মী রূপও কিন্তু আরোপিত, কৃত্রিম বলে মনে হয় না। কেননা সমাজ-নির্ধারিত গৎবাঁধা জেন্ডার রোল থেকে তিনিও ছিলেন না পুরোপুরি নিষ্কৃতিপ্রাপ্ত। সেই নিষ্কৃতি বাস্তবায়িত হয়েছে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে, কিছু অনিবার্য প্রক্রিয়ায়। বিয়ের পর বছর তিনেক তিনি চেয়েছিলেন ‘অ্যাডজাস্ট’ করতে, সংসারী আটপৌরে জীবনে নিজেকে সীমিত রাখতে। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে বনিবনার অভাব, অথবা মানসিকতার আকাশ-পাতাল প্রভেদের ফলে, অহংয়ের অসম লড়াইয়ের সুবাদে, নিজের জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে হয়েছে তাকে। শেষমেশ তিনি যে স্টেরিওটাইপ ভাঙতে পেরেছেন, এটিই হয়তো তার উত্তরণ; যা সহজাত, স্বতঃস্ফূর্ত ও ফলাফলসূচক। তবে সেজন্য তাকে কিছু মূল্যও ঠিকই চোকাতে হয়েছে; দুঃসহ মানসিক যাতনা, সাংসারিক নিঃসঙ্গতা ও স্বামী-সন্তানের সাথে বৈরিতার বিনিময়ে।

এদিকে ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আরেকটি মা-মেয়ের সম্পর্কের কাহিনি ‘তিতলি’। তিতলি এক টিনেজ মেয়ে, যে প্রচণ্ড মাত্রায় মোহগ্রস্ত জনপ্রিয় চিত্রতারকা রোহিত রায়কে নিয়ে। এই বয়সের মেয়েরা যেমন হয় আর কি! তিতলিও স্বপ্ন দেখে একদিন সে রোহিত রায়কে বিয়ে করে, তার সঙ্গে সংসার পাতবে। এসব পরিকল্পনার কথা বড়োমুখ করে শোনায়ও তার মা উর্মিলাকে।

Titli

তিতলি সিনেমায় অপর্ণা সেন ও কঙ্কনা সেন শর্মা

গল্পের প্লট এগিয়ে যায়, যখন মা-মেয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা দেয়, তিতলির বাবাকে নিয়ে আসার জন্য। যাত্রাপথে থামতে বাধ্য হয় তারা। কারণ সামনে একটি গাড়ি নষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক লোক এসে তাদেরকে অনুরোধ করে, গাড়িতে নাকি একজন খুবই ‘ইম্পর্ট্যান্ট ফিল্মস্টার’ রয়েছেন, তিনি তাদের যাত্রাসঙ্গী হতে পারেন কি না। কাকতালীয়ভাবে, তিতলি-উর্মিলার যাত্রাসঙ্গী ভদ্রলোকটি আর কেউ নন, স্বয়ং রোহিত রায়!

স্বভাবতই দারুণ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে তিতলি, ভেসে বেড়াতে থাকে তার স্বপ্নের দুনিয়ায়। কিন্তু শিগগিরই একটা জোর ধাক্কা খায় সে। আঁচ করতে শুরু করে, তার মায়ের সাথে রোহিত রায়ের সম্ভবত একটা গোপন অতীত রয়েছে। যখন তাদের গাড়ি এক গ্রামে এসে পৌঁছায়, গাড়ি থামিয়ে তিতলি যায় কিছু জিনিস কিনতে। উর্মিলা ও রোহিত রায়ের সামনে সুযোগ আসে তিতলির অনুপস্থিতিতে, নির্জনে কথা বলার। হাঁটতে হাঁটতে অতীতের স্মৃতিচারণা করেন তারা। জানা যায়, তাদের দুজনের প্রেম ছিল। কিন্তু উর্মিলার বাবা-মা তাকে রোহিতের সঙ্গে বিয়ে দেন না, কেননা রোহিতের তখন নিছকই ছন্নছাড়া জীবন, অভিনেতা হিসেবে কোনো স্থিতি বা নিশ্চিত ভবিষ্যৎ নেই।

গাড়িতে ফিরে তিতলি আবিষ্কার করে, তার মায়ের চুলে ফুল গোঁজা। এবার গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায় তার কাছে। সে উপলব্ধি করে, তারই স্বপ্নের পুরুষের সাথে একসময় রোমান্টিক সম্পর্ক ছিল তার মায়ের। এই নব-উন্মোচিত সত্য মা-মেয়ের সম্পর্কে এক গভীর জটিলতার সূত্রপাত ঘটায়।

সে রাতে ঘুম আসছিল না বলে বারান্দায় এসে দাঁড়ান উর্মিলা। মনে করতে থাকেন সারাদিনের ঘটনাগুলো। তখন তিনি দেখতে পান তিতলির ঘরে বাতি জ্বলছে। তিতলির ঘরে যান তিনি, এবং আরও একবার আমরা দেখতে পাই মা-মেয়ের অস্বস্তিকর কথোপকথন। এবার সেখানে নাটকীয়তার পারদ যেন আরও উর্ধ্বমুখী, কেননা দুজনেই যে কোনো একদিন ভালোবেসেছেন বা এখনো ভালোবাসেন একই মানুষকে!

এই ছবিটিও মাতৃত্বকে এক নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করে। সে আঙ্গিক হলো মায়েদের যৌনতা, মায়েদের রোমান্টিকতা। মা মানেই যে তথাকথিত সতী-সাধ্বী নারী, স্নেহময়ী-মমতাময়ী, সন্তানের সুখ-সমৃদ্ধিই তার জীবনের একমাত্র কাম্য, তা তো নয়। এর বাইরেও মানুষ হিসেবে, স্বতন্ত্র ব্যক্তিবিশেষ হিসেবে, মায়েদের আরও অনেক রূপই থাকে, থাকতে বাধ্য। তার মধ্যে কয়েকটিকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে ছবিটি।

এই ছবিটিও মাতৃত্বকে এক নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করে। সে আঙ্গিক হলো মায়েদের যৌনতা, মায়েদের রোমান্টিকতা। মা মানেই যে তথাকথিত সতী-সাধ্বী নারী, স্নেহময়ী-মমতাময়ী, সন্তানের সুখ-সমৃদ্ধিই তার জীবনের একমাত্র কাম্য, তা তো নয়। এর বাইরেও মানুষ হিসেবে, স্বতন্ত্র ব্যক্তিবিশেষ হিসেবে, মায়েদের আরও অনেক রূপই থাকে, থাকতে বাধ্য। তার মধ্যে কয়েকটিকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে ছবিটি। আর সেই আলোয় নিয়ে আসাটাও যেন নতুন মাত্রা পায় সেটির অনন্য নন্দনময় উপস্থাপনে।

Titli 1

তিতলি সিনেমার দৃশ্যে অপর্ণা সেন

বাইরে তখন ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। মেয়ের সাথে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে উর্মিলা যান জানালা বন্ধ করতে। সেটি করতে গিয়ে গায়ে চাপানো শালটা কিছুটা সরে যায়, আর উদ্ভাসিত হয়ে যায় তার মাদকতাময় শরীরটি। নাইটি পরিহিত মায়ের পিঠ, স্তনের কিয়দাংশ তিতলিকে দাঁড় করায় আরেক সত্যের মুখোমুখি, যা অনস্বীকার্য, কিন্তু এতদিন তার জন্য ছিল অভাবনীয়। কী সেই সত্য? তা হলো : তার মা-ও একজন নারী, তারও রয়েছে একটি শরীর, তারও রয়েছে যৌনতা ও প্রেমবোধ। এ যেন ‘ফিমেল গেজ’ এর সার্থকতম দৃষ্টান্ত, যেখানে মেয়ে দেখছে তার মায়ের শরীর, আর সেই দর্শন তাকে নিয়ে যাচ্ছে বৃহত্তর দর্শন, উপলব্ধি ও অনুধাবনের কাছাকাছি।

দেখা যাচ্ছে, ‘উনিশে এপ্রিল’-এর সরোজিনী কিংবা ‘তিতলি’-র উর্মিলা, মা হিসেবে কেউই প্রচলিত মাতৃরূপের প্রতিনিধিত্ব করেন না। অর্থাৎ যে ধরনের মাকে আমরা নাটক-সিনেমায় দেখে থাকি, যে ধরনের মায়ের মাধ্যমে মা চরিত্রের সাধারণীকরণ করা হয়, তাদের সাথে সরোজিনী বা উর্মিলার বিস্তর ফারাক।

দেখা যাচ্ছে, ‘উনিশে এপ্রিল’-এর সরোজিনী কিংবা ‘তিতলি’-র উর্মিলা, মা হিসেবে কেউই প্রচলিত মাতৃরূপের প্রতিনিধিত্ব করেন না। অর্থাৎ যে ধরনের মাকে আমরা নাটক-সিনেমায় দেখে থাকি, যে ধরনের মায়ের মাধ্যমে মা চরিত্রের সাধারণীকরণ করা হয়, তাদের সাথে সরোজিনী বা উর্মিলার বিস্তর ফারাক। কিন্তু তাই বলে কি সরোজিনী বা উর্মিলা নিপাতনে সিদ্ধ, এবং সবসময় আমরা নাটক-সিনেমায় যেমন মায়েদের দেখা পাই, তারাই সাধারণ ও স্বাভাবিক? মোটেই না।

সরোজিনীর মতো উচ্চাভিলাষী নারী তো আমাদের সমাজে প্রচুর রয়েছেন। আবার এমন অনেকেও রয়েছেন, যারা হয়তো সরোজিনীর মতো ব্যক্তিজীবনে সফল নন, প্রতিভার যথাযথ বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ; কিন্তু তারাও যে বুকের মধ্যে সরোজিনীর মতো বাঁধন ছিড়ে বেরিয়ে আসার বাসনাকে সঙ্গোপনে লালন করেন না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে? আবার উর্মিলার মতো নারীও তো কম নয়, যারা হয়তো সাংসারিক চাপে আজ এক ভিন্নমূর্তি ধারণ করেছেন, কিন্তু তাদের মাঝেও যথাযথভাবেই নিহিত রয়েছে প্রাক্তন প্রেমবোধ কিংবা অপূর্ণ যৌনতার তাড়না।

Titli 2

তিতলি সিনেমার দৃশ্যে অপর্ণা সেন ও মিঠুন চক্রবর্তী

এখানেই আসলে ঋতুপর্ণ অনন্য। তিনি সাহসী, তিনি নির্ভীক। তাই পূর্বসূরী, সমসাময়িক ও উত্তরসুরী অধিকাংশ নির্মাতা যেখানে নারীত্বকে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের খোলসে বন্দি করে রেখেছেন, বিশেষত মাতৃত্বকে একটি অমূলক কিন্তু স্বস্তিদায়ক অবয়বের মাধ্যমে মিথ্যার ডালা সাজিয়ে গেছেন বছরের পর বছর, সেখানে ঋতুপর্ণ প্রকৃত বাস্তবতাকে সবার সামনে হাজির করেছেন, মাতৃত্বের মিথকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। দর্শকমনে সুখের আবেশ ছড়ানোর বদলে, সজোরে ধাক্কা দিয়েছেন তাদের চেতনায়, মননে। এই ঋতুপর্ণকে হয়তো আপনি খিস্তি-খেউরের প্লাবনে ভাসাতে পারেন, শূলে চড়াতে পারেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত করতে পারেন; কিন্তু তাঁকে অগ্রাহ্য করবেন কীভাবে?

মাত্র ৪৯ বছরের জীবনে ভারতীয় চলচ্চিত্রকে যে মজবুত পাটাতনের উপর ঋতুপর্ণ দাঁড় করিয়ে গেছেন, সেটিকে অস্বীকার করে সামনের দিকে এগোনো যে অসম্ভব!

ঋণ স্বীকার : Alison Macdonald (2009), ‘Real’ and ‘Imagined’ Women: A Feminist Reading Of Rituparno Ghosh’s Film.

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম বাগেরহাটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যয়নরত। লিখতে ভালো লাগে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।