বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’ : কামনা, বেদনা এবং প্রতিরোধের সুনিপুণ উপস্থাপনা

0

১.
১৯০১-১৯০২ সালে ‘নবপর্যায় বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় যখন ‘চোখের বালি’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কাহিনির জন্য শুরু থেকেই কট্টরপন্থী হিন্দু সমাজের সমালোচনার মুখে পড়েন। সমাজের অনেক সংস্কার এবং প্রথার বিরুদ্ধে ততোদিনে প্রতিরোধ গড়ে ওঠা শুরু হয়েছে। সতীদাহ প্রথা এবং বহুবিবাহ প্রথা রোধ হওয়ার পাশাপাশি ‘বিধবা বিবাহে’র প্রচলন হয়েছে। তবে রক্ষণশীল সমাজ তখনও তা সহজে গ্রহণ করেনি।

একজন অল্প বয়সী বিধবা নারী সারাটা জীবন ধরে যে ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা এবং বেদনার দুঃসহ ভার বয়ে বেড়ান, তা বোঝার মতো সংবেদনশীল মানুষের সংখ্যা সে সময়ে যথেষ্ট ছিল না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নানাবিধ ব্রত-আচার, নিরামিষ খাবার আর সাদা থানের জালে আটকে ফেলে তাদের গোটা জীবনটাকে ধ্বংস করাই ছিল যেন নিয়তি। অতঃপর রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মহামানবদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উজ্জ্বল আলোকরেখার মতো পরিবর্তন আসতে শুরু করে।

জীবনের সব কিছু বুঝে ওঠার আগেই যে মেয়েটি বিধবা হয়েছে, তার জীবনেও যে প্রেম আসতে পারে, একটি সুন্দর জীবনের সাধ থাকতে পারে, অথবা অতীতের সব দুঃস্বপ্নকে মুছে ফেলে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারে— তা মেনে নেওয়ার মতো শক্তি সাধারণ মানুষের তো ছিলই না, এমনকি সাহিত্যিকরা যারা কল্পনার ডানায় ভর করে ভ্রমণ করতে সক্ষম, তারাও এই দুঃসাহস দেখাতে পারেননি। বিধবা নারীর জীবনে প্রেম আসার সম্ভাবনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই যে প্রথম ‘চোখের বালি’তে দেখিয়েছেন এমন নয়, তারও আগে দেখিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩) এবং ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৮৭৮) উপন্যাস দু’টিতে কুন্দনন্দিনী এবং রোহিণী নামের দুই বিধবার রূপে উপন্যাসের নায়করা আকৃষ্ট হয়েছিল। কিন্তু উপন্যাসের শেষে তাদের দু’জনেরই মৃত্যু ঘটিয়ে বিধবার জীবনে পুনরায় সংসার যাপনে ফেরার সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণভাবে নাকচ করে দিয়েছিলেন তিনি। কুন্দনন্দিনীকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার পর ‘বিষবৃক্ষে’র শেষ লাইনে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমরা বিষবৃক্ষ সমাপ্ত করিলাম। ভরসা করি, ইহাতে গৃহে গৃহে অমৃত ফলিবে।’ অর্থাৎ বিধবার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার ফল যে ভয়াবহ হবে, তা নিয়ে পুরুষ সমাজকে সতর্কবার্তা দিয়েছেন তিনি। আবার ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’ও বিধবা রোহিণীকে তাঁর প্রেমিক গোবিন্দলাল স্বয়ং পিস্তলের গুলিতে হত্যা করেছিল। অর্থাৎ বিধবার জীবনে সুখ সমাপ্তি ঘটানোর মতো সাহস বা শক্তি কোনোটিই বঙ্কিমচন্দ্র দেখাতে চাননি অথবা পারেননি।

বঙ্কিমচন্দ্রের আরও প্রায় বাইশ বছর পরে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর উপন্যাসে বিধবার প্রসঙ্গ আনলেন সেখানে আরেকটু সাহসের পরিচয় পাওয়া গেল বটে। মৃত্যুর এক বছর আগে ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখে ‘চোখের বালি’র একটি সংস্করণের ভূমিকায় তিনি নিজেও লিখেছিলেন, ‘আমার সাহিত্যের পথযাত্রা পূর্বাপর অনুসরণ করে দেখলে ধরা পড়বে যে ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটা আকস্মিক, কেবল আমার মধ্যে নয়, সেদিনকার বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে। বাইরে থেকে কোন ইশারা এসেছিল আমার মনে, সে প্রশ্নটা দুরূহ।’

বর্ণনের সাহসিকতা বা কল্পনার বিস্তারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়তো বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন, কিন্তু বিধবার অন্তিম পরিণতির যে চিরাচরিত গঠন তা কি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও ভাঙতে পেরেছিলেন? সে প্রসঙ্গে পরে কথা হবে। আমরা বরং ফেরত আসি ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’তে।

বাঙালির জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে অবিচ্ছেদ্য এবং বিস্তারী প্রভাব, তা থেকে ঋতুপর্ণ ঘোষ নিজেও বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। রবীন্দ্র-সাহিত্যের প্রতি তাঁর ছিল প্রগাঢ় অনুরাগ। এজন্য ঋতুপর্ণের চলচ্চিত্রে ঘুরেফিরে বারবার এসেছে রবীন্দ্র অনুষঙ্গ। ‘চোখের বালি’ এবং ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাস অবলম্বনে দু’টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের সার্ধ-শত জন্মবর্ষে তাঁকে নিয়ে ‘জীবনস্মৃতি’ নামে একটি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্র জয়ন্তীতে রেডিও মির্চির জন্য নির্মাণ করেছিলেন শ্রুতিনাটক ‘স্ত্রীর পত্র’।

ঋতুপর্ণের চলচ্চিত্রে ঘুরেফিরে বারবার এসেছে রবীন্দ্র অনুষঙ্গ। ‘চোখের বালি’ এবং ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাস অবলম্বনে দু’টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের সার্ধ-শত জন্মবর্ষে তাঁকে নিয়ে ‘জীবনস্মৃতি’ নামে একটি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেছিলেন তিনি।

এর বাইরে তাঁর ‘অসুখ’ (১৯৯৯) চলচ্চিত্রের একটি বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা। এমনকি ‘বাড়িওয়ালি’ (২০০০) চলচ্চিত্রে বনলতার বাড়িটি যে সিনেমার শ্যুটিংয়ের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়েছিল তা হলো রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, ‘চোখের বালি’র চলচ্চিত্ররূপ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ঋতুপর্ণ ঘোষের মাঝে একটা দীর্ঘ সময় ধরে সুপ্ত ছিল।

Ritu 1

ঋতুপর্ণ ঘোষ (৩১ আগস্ট, ১৯৬৩– ৩০ মে, ২০১৩); ছবি সৌজন্য: ইন্দ্রনীল ঘোষ


রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৩ সালে। এর ঠিক ১০০ বছর পরে ২০০৩ সালে মুক্তি পেয়েছে ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচ্চিত্র ‘চোখের বালি’। মাঝে এক শতাব্দীতে পৃথিবীজুড়ে ঘটেছে অনেক পরিবর্তন, বদলে গেছে অনেক কিছুই। স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথ ‘চোখের বালি’ লিখতে যতটুকু স্বাধীনতা পেয়েছিলেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ এর চিত্ররূপ দিতে গিয়ে তার থেকে অনেক বেশি স্বাধীনতা উপভোগ করেছেন। ঋতুপর্ণ ঘোষই যে ‘চোখের বালি’র প্রথম চলচ্চিত্রায়ন করেছেন এমন নয়। এর আগেও কয়েকবার এই উপন্যাসটির চলচ্চিত্ররূপ এবং নাট্যরূপ প্রদান করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই ১৯৩৮ সালে সতু সেনের পরিচালনায় ‘চোখের বালি’র একটি চিত্ররূপ মুক্তি পেয়েছিলেন, যেটি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ দেখে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি চিঠির মাধ্যমে তাঁর অনুভূতি জানিয়েছিলেন। তবে বিধবাদের নিয়ে প্রগতিশীল ধারায় গত শতাব্দীতে যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, সেগুলোর কোনোটিই আশানুরূপ সাফল্য বা দর্শক আনুকূল্য লাভ করেনি। এদের তুলনায় এই শতাব্দীতে এসে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’ দর্শকদের মাঝে রীতিমতো আলোড়ন তুলেছে। আলাদা করে কি আছে ঋতুপর্ণের ‘চোখের বালি’তে? এখন আমরা এদিকটাতেই আলোকপাতের চেষ্টা করব।

 

২.
শুরুতেই ‘চোখের বালি’র গল্পে আসা যাক। উল্লেখ করা ভালো হবে, এই গল্প রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’র।

মহেন্দ্রের মা রাজলক্ষ্মী তার ছোটোবেলার খেলার সঙ্গী হরিমতির মেয়ে বিনোদিনীকে পুত্রবধূ হিসেবে ঘরে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মাতৃস্নেহ হারানোর দোহাই দিয়ে সে প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিল পুত্র মহেন্দ্র। ফলশ্রুতিতে অন্যত্র বিয়ে হয় বিনোদিনীর এবং কিছুদিন পরেই স্বামীর মৃত্যু ঘটলে অকালে বিধবা হয় সে।

Ritu 2

তিন বছর পরে মা আবার তার ছেলের বিয়ের জন্য তোড়জোড় শুরু করেন। এবারও মহেন্দ্র পুরনো অজুহাত দেখায়। মহেন্দ্রের কাকি অন্নপূর্ণা তাদের সাথে একই বাড়িতে বাস করতেন। স্বামী-সন্তানহীনা এ মহিলাটি মহেন্দ্রকে নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করতেন। অন্নপূর্ণার পিতৃমাতৃহীনা এক বোনঝি আশালতার সাথে মহেন্দ্রের বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করলেও প্রত্যাখাত হওয়ার আশংকায় তা তিনি কখনও প্রকাশ করতেন না। তবে মহেন্দ্র এ ব্যাপারটি ঠিকই অনুধাবন করত।

অবশেষে মহেন্দ্র তার বন্ধু বিহারীর সাথে ঐ বোনঝির বিয়ে দেবে বলে ঠিক করে সেই মেয়েটিকে দেখাবার জন্য কাকিকে প্রস্তাব করে। বিহারী মহেন্দ্রের বন্ধু হলেও তার মা রাজলক্ষ্মী এবং কাকি অন্নপূর্ণার স্নেহের পাত্র ছিল সবসময়। বিহারীর জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে মহেন্দ্র নিজেই বিয়ের জন্য মনস্থির করে এবং শেষ পর্যন্ত সে আশালতাকে বিয়ে করে। বিহারীও মেয়ে দেখতে গিয়ে আশালতাকে পছন্দ করেছিল, কাজেই আশালতার প্রতি তার একটা দুর্বলতা থেকে যায়।

Ritu 3

শুরু হয় মহেন্দ্র-আশালতার নতুন জীবন। স্ত্রী আশালতার প্রতি গভীর অনুরাগের কারণে দিন দিন ছেলের উপর কর্তৃত্ব হারাতে থাকে মা। আশালতা যেহেতু অন্নপূর্ণার বোনঝি— এ নিয়ে অন্নপূর্ণা ও রাজলক্ষ্মীর মনোমালিন্য শুরু হয়। অন্নপূর্ণা ধর্ম পালনের দোহাই দিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় কাশীতে, ছেলের উপর রাগ করে রাজলক্ষ্মী চলে যায় গ্রামের বাড়িতে। ফিরে আসার সময় সাথে করে নিয়ে আসে কন্যাসম বিধবা বিনোদিনীকে। অল্পদিনের মধ্যেই বিনোদিনী সংসারের সকলকে আপন করে নেয়। আশালতার সাথেও সই পাতায় সে। তাদের সেই সম্পর্কটির নাম দিয়েছিল ‘চোখের বালি’।

Ritu 4

মহেন্দ্রের সাথে পরিচয় হওয়ার পর মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি দুর্বলতা অনুভব করা শুরু করে এবং এরপরই উপন্যাসের মূল সংকটটি উপস্থিত হয়। একদিকে বিনোদিনীর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে মহেন্দ্র, আবার বিনোদিনীর দুর্বলতা সৃষ্টি হয় মহেন্দ্রের বন্ধু বিহারীর প্রতি। কিন্তু বিহারী আবার আশালতার প্রতি অনুরক্তভাব তখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মহেন্দ্র-বিনোদিনী-আশালতা-বিহারী: চার নরনারীর সম্পর্কের জটিলতা এবং মনস্তাত্ত্বিক টানা পোড়েনকে ঘিরেই এ উপন্যাসের সিংহভাগ আবর্তিত হয়েছে। বিহারীর প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করে বিনোদিনী যখন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, তখন প্রতিহিংসার আগুনে সে আশালতার সংসার জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছে। মহেন্দ্রের সাথে মিথ্যা ভালোবাসার অভিনয় তীব্রতর করে তুলেছে সে।

ছবিজুড়ে একটা ফেলে আসা সময়ের গল্প বলার চেষ্টা করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। তাই স্বদেশী আন্দোলনের মিছিলের শব্দ— ‘বন্দে মাতরম’ থেকে শুরু করে জগদীশচন্দ্র বসুর গাছের প্রাণ আবিষ্কার করা, নারী শিক্ষার প্রচলন, কিংবা সন্ন্যাসী নরেন অর্থাৎ স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর কথা উপন্যাসের বাইরে থেকে তিনি আলাদাভাবে চলচ্চিত্রে এনেছেন।

তবে উপন্যাসের শেষে সকল জটিলতার সমাপ্তি ঘটে। মহেন্দ্র ফিরে যায় আশালতার কাছে। বিহারী নিজেকে নিয়োজিত করে দেশসেবায় এবং বিনোদনীকে সে বিয়ের প্রস্তাব দিলেও বিনোদিনী বৈধব্যের কালিকে বরণ করে নিয়ে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। বিনোদিনীকে কাশীতে পাঠিয়ে সমাজের শুদ্ধতা বজায় রাখার নীতিতে একটি সন্তোষজনক সমাপ্তি টানেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

 

৩.
সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় কাহিনিকে পুরোপুরিভাবে অনুসরণের কোনো নিয়মতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা থাকে না পরিচালকের। ‘চোখের বালি’ নির্মাণের ক্ষেত্রেও এই স্বাধীনতাকে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। রবীন্দ্রনাথের আখ্যানকে ব্যবহার করে তাঁর ‘চোখের বালি’র এই নির্মিত চিত্ররূপ একেবারেই স্বতন্ত্র।

ছবিজুড়ে একটা ফেলে আসা সময়ের গল্প বলার চেষ্টা করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। তাই স্বদেশী আন্দোলনের মিছিলের শব্দ— ‘বন্দে মাতরম’ থেকে শুরু করে জগদীশচন্দ্র বসুর গাছের প্রাণ আবিষ্কার করা, নারী শিক্ষার প্রচলন, কিংবা সন্ন্যাসী নরেন অর্থাৎ স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর কথা উপন্যাসের বাইরে থেকে তিনি আলাদাভাবে চলচ্চিত্রে এনেছেন। ১৯০২ থেকে ১৯০৫ সালের মধ্যবর্তী সময়কে ধারণ করে এটি একটি ‘Period drama’.

বিনোদিনী চরিত্রটির আগমনী প্রস্তুতির জন্য ঋতুপর্ণ ঘোষ দর্শকদের নিয়ে গেছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ এ। সূচনাপর্বের সেই দৃশ্যে বিহারীর ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ থেকে রোহিণীর পরিচিতি পাঠ করার অংশটি যদি দেখি—

বিহারী: ‘রোহিণীর যৌবন পরিপূর্ণ— রূপ উছলিয়া পড়িতেছিল— শরতের চন্দ্র ষোল কলায় পরিপূর্ণ। অল্প বয়সে বিধবা হইয়াছিল, কিন্তু বৈধব্যের অনুপযোগী অনেকগুলি দোষ তাহার ছিল। দোষ, সে কালো পেড়ে ধুতি পরিত, হাতে চুড়ি পরিত, পানও বুঝি খাইত। এদিকে রন্ধনে সে দ্রৌপদীবিশেষ বলিলে হয়; ঝোল, অম্ল, চড়চড়ি, সড়সড়ি, ঘণ্ট, দালনা ইত্যাদিতে সিদ্ধহস্ত। আবার আলেপনা, খয়েরের গহনা, ফুলের খেলনা, সুচের কাজে তুলনারহিত। চুল বাঁধিতে, কন্যা সাজাইতে পাড়ার একমাত্র অবলম্বন…’

মহেন্দ্র: এবং এইসব গুণাবলির জন্য অবশেষে তাহাকে মরিতে হইল।

মহেন্দ্রের মা: তা বিধবা অশুচি করে বেড়াবে, ভগবান তাকে শাস্তি দেবে না?

মহেন্দ্র: ভগবান এত সহজে মৃত্যুদণ্ড দেয় না মা, হাকিম দেয়। বঙ্কিমবাবু হাকিম ছিলেন জানো তো?

মহেন্দ্রের মা: নবেল লিখলে ওরকম একটু সাজিয়ে লিখতে হয়। আমাদের মতো ছা-পোষা একাদশী করা বিধবাদের নিয়ে গপ্পো লিখলে আজকালকার ছেলেদের মন উঠবে?

মহেন্দ্র: আজকালকার ছেলেদের মন এমনিতেও উঠবে না। বঙ্কিমচন্দ্রের একটাও মেয়ে ইংরেজি জানে না।…

এখানে বঙ্কিম সাহিত্যের সমালোচনাপূর্বক বিশ শতকের শুরুতে নারী-পুরুষের মনস্তত্ত্ব উপস্থাপনের একটি সূক্ষ্ম প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। বিধবাদের রূপ-গুণ নিয়ে, তাদেরকে নিয়ে লেখা উপন্যাসেও মানুষের বিশেষ আগ্রহ আছে, কিন্তু বিধবারা যদি প্রথার বাইরে অন্য কোনো জীবনের স্বপ্ন দেখে তবে আবার সমাজ অশুচি হয়ে যায়। একদিকে নারীদেরকে শিক্ষিত করে তোলার পিছনে প্রবল আপত্তি, আবার ইংরেজি জানা মেয়েদের প্রতি শিক্ষিত তরুণদের গভীর আগ্রহ।

‘চোখের বালি’র শুরুতেই বিধবা বিনোদিনীর সাথে আমরা যখন পরিচিত হতে শুরু করি, তখন দেখতে পাই উপবাস-একাদশীসহ নানাবিধ আচারের দহনে দগ্ধ হয়ে এই বিনোদিনী দমে যায়নি। ভীতি-আতঙ্ক-কুণ্ঠা বা সংকুচিতভাব তার মাঝে পরিলক্ষিত হয় না, বরং সে অনেক বেশি সাবলীল এবং জীবনপিয়াসী। ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সে লুকিয়ে চকলেট খেতে দ্বিধা করে না, পুরুষের সামনে সে সাবলীলভাবে কথা বলে। চলচ্চিত্রের প্রথম অর্ধে ঋতুপর্ণ বিনোদিনীর বেদনাগুলোকে পরিস্ফুটিত করতে চেয়েছেন। আশালতার খুব কাছে অবস্থান করে তার বিবাহিত জীবনের খণ্ড খণ্ড আনন্দরূপ তার হৃদয়ে যে করুণ আলোড়ন তোলে তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।

দু’জন নারীর একজন আলতা পায়ে লালপেড়ে শাড়ি পরে উল্লসিত জীবন পার করছে, অন্যদিকে সাদাথান পরা সমবয়সী অপর নারীটির জীবনে কোনো উৎসব নেই, আনন্দ নেই। বিধবার বেদনার অন্য মাত্রাগুলোকেও এই চলচ্চিত্রে এনেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। যেমন, বিধবা আচার পালনের এক দিনে বিনোদিনীর মাসিক হওয়ার দৃশ্যটি। তরুণী বিধবার পুরুষের সংস্পর্শে আসা নিষিদ্ধ, তবে সন্তানধারণের সক্ষমতা বহনের চিহ্ন নির্দিষ্ট সময় পরপর কিভাবে তাদেরকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়, সেই বেদনাটুকু দর্শক হৃদয়ে জাগানোর প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয় এই সাহসী দৃশ্যে।

Ritu 5

বিধবা বিবাহের প্রচলন না থাকলেও রক্ষণশীল সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারগুলোতে সে সময়ে নানা অনাচার ঘটত। বিধবারা কেউ গর্ভবতী হয়ে পড়লে গোপনে তার গর্ভপাত করিয়ে ফেলা, কিংবা দূর কোনো তীর্থস্থানে ফেলে আসা, ক্ষেত্রবিশেষে বিধবা নারীটিকে মেরে ফেলার মতো নৃশংসতাও কম ঘটত না। সামাজিক শুচিবোধের দায় শুধু নারীর জন্যই ছিল, পুরুষের জন্য কোনো নিয়ম ছিল না। এই কুৎসিত দিকটিও চলচ্চিত্রে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। বিনোদিনীর হাত কেটে গেলে মহেন্দ্র যখন তাকে নিয়ে রাতে ইংরেজ ডাক্তারের বাড়িতে যায়, তখন পুরুষের সাথে বিধবা নারীকে দেখে ডাক্তার সাথে সাথেই ধারণা করে নেন, গর্ভপাত করাতে হবে।

এভাবে একটা সময় এবং সমাজকে ধারণ করার প্রয়াসে অনেকগুলো ঐতিহাসিক উপাদানের সংযোগে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’কে আপন ভঙ্গিতে বিনির্মাণ করতে চেয়েছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।

 

৪.
চলচ্চিত্রের দ্বিতীয়ার্ধে এসে আমরা বিনোদিনীকে ক্রমশ শরীর সর্বস্ব হয়ে উঠতে দেখি। তার বেদনার ভাষার থেকে এক সময় দেহের ভাষাই মুখ্য হয়ে উঠতে থাকে। তার মানসিক দুর্বলতা বিহারীর প্রতি, অথচ আশালতার প্রতি ঈর্ষাবশত মহেন্দ্রের যৌন আকর্ষণকে সে উপেক্ষা করে না। এমনকি মহেন্দ্রের বাড়ি থেকে বের হয়ে গহনাভরা গায়ে এক রাতে বিহারীর কাছে উপস্থিত হয়ে সে নিজেকে নিবেদন করে বলে ওঠে :

চলচ্চিত্রের দ্বিতীয়ার্ধে এসে আমরা বিনোদিনীকে ক্রমশ শরীর সর্বস্ব হয়ে উঠতে দেখি। তার বেদনার ভাষার থেকে এক সময় দেহের ভাষাই মুখ্য হয়ে উঠতে থাকে। তার মানসিক দুর্বলতা বিহারীর প্রতি, অথচ আশালতার প্রতি ঈর্ষাবশত মহেন্দ্রের যৌন আকর্ষণকে সে উপেক্ষা করে না।

‘আমি নিজের সাথে অনেক লড়াই করে তোমার কাছে এসেছি। আমাকে নাও। আমাকে দেখতে ইচ্ছা না করে, চোখ বুজে থেকো। আমি কিচ্ছু মনে করব না।’

বিহারী প্রত্যাখ্যান করে বলে ওঠে, ‘আপনার সাথে তো আমার কত মধুর স্মৃতি ছিল। সবটাকে একসাথে নষ্ট করে দিলেন!’

Ritu 6

বিধবা নারীর পুরুষের প্রতি এমন মরিয়াভাবে আকর্ষিত হওয়ার দিকটি হয়তো খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়, তবে বিনোদিনীর আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন রূপটি এখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে বিহারীকে লেখা একটি চিঠিতে অবশ্য বিনোদিনীর মনস্তত্ত্ব আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে :

‘প্রীতিভাজনেষু বিহারীবাবু,

বিধবার গায়ে গহনা দেখিয়া আপনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রশংসাবাক্য আমাকে সাহস যোগাইয়াছিল। নিজের অজান্তে কখন যে সে সাহস দুঃসাহসে পরিণত হইয়াছে এবং আপনার কাছেই হতভাগিনীকে টানিয়া আনিয়াছে, তা সত্যিই আমার অগোচর। নিজের ভিতরে সেই সাহসের উৎসকে খুঁজিতে গিয়া বারংবার ভুল করিয়াছি। একবারের মতো অন্তত ঠিক করিবার জন্য আপনার কাছে পৌঁছাইয়াছিলাম। সে অভিজ্ঞতা আপনাকে আনন্দ দেয়নি বলিয়া আমি সত্যিই লজ্জিত।

সমাজে আমার তিনটি পরিচয়— বিধবা, মেমসাহেব এবং যুবতী। সততই এই তিন পরিচয়ের আড়ালে আমার আসল পরিচয় ঢাকা পড়িয়া থাকে। যুবতী-মেমসাহেব-বিধবাও যে সাধারণ রক্তমাংসের নারীও হইতে পারে, সমাজ তাহা স্বীকার করে না।

আজ সম্পূর্ণ নিঃসঙ্কোচে বলিতে পারি যে, আমি, চতুর্থ পরিচয়টি আমি কেবল আপনার সাহসের মাঝে সন্ধান করিয়াছি। সংসার-অনভিজ্ঞা আশা, শুধুমাত্র সরলা এবং কাশীবাসিনী বলিয়াই আপনার অনুকম্পার অধিকারিণী। প্রথম দু’টি বৈশিষ্ট্য আর এই জন্ম ফিরিয়া পাইব না। অন্তত শেষটির কল্যাণেও যদি আপনার প্রীতিভাজন হতে পারি…’

অতঃপর একটা ভুলের মধ্য দিয়ে গিয়ে বিনোদিনী যেন ক্রমশ নিজেকে আবিষ্কার করতে শুরু করে। বিনোদিনীর জীবনের এই অংশটুকু ঋতুপর্ণ ঘোষ ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে, ‘আমার বিনোদিনী বিহারীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আত্মঘাতিনী হতে গিয়েছিল গ্রামের দিঘিতে। সেখানে সেই ঘাটে বসে, তারাভরা অনন্ত আকাশের তলা, রাত্রিময় অসীম ব্রহ্মাণ্ডের দিকে তাকিয়ে তার কাছে হয়তো সত্যি সত্যিই তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর যত মহেন্দ্র-বিহারী। আত্মহননের দড়ি কলসি নির্জীব ঢেলার মতো গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল নির্জন নিশাজলে।’ (ফার্স্ট পার্সন, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০০৭)

চলচ্চিত্রে সাধারণত পুরুষের চোখে নারীদেহ (Male gaze: Laura Mulvey, 1975) দেখানোর প্রবণতা বেশি। এর বাইরে নারীর চোখে পুরুষের দেহের প্রদর্শন প্রায় উপেক্ষিত। ‘চোখের বালি’তে ঋতুপর্ণ ঘোষ এই ধারণার বাইরে এসে দু’টোই একসাথে আনার চেষ্টা করেছেন। বিহারীর উন্মুক্ত পিঠ কিংবা কাশীর ঘাটে মুগুর ভাজতে থাকা পুরুষদের বলিষ্ঠ দেহের দিকে আগ্রহভরে তাকিয়ে থাকা বিনোদিনীকে তিনি যেমন দেখিয়েছেন, আবার ঐশ্বরিয়া রাইকে বিনোদিনী রূপে হাজির করার মধ্যে পুরুষতন্ত্রের যৌন মনস্তত্ত্ব ব্যবহারের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিনোদিনী চরিত্রে ঐশ্বরিয়া রাইয়ের শাড়ির আঁচল বারবার খসে পড়া, উন্মুক্ত কাঁধ পিঠের প্রদর্শন, বিছানায় শুয়ে নিজের হাত নিজে নিজে ছুঁয়ে আত্মরতি, কিংবা গহনায় অলংকৃত রূপ— সব শ্রেণির দর্শককে অবশ্যই এক ধরনের দর্শনগত পরিতৃপ্তি প্রদান করে।

বিনোদিনী চরিত্রে ঐশ্বরিয়া রাইয়ের শাড়ির আঁচল বারবার খসে পড়া, উন্মুক্ত কাঁধ পিঠের প্রদর্শন, বিছানায় শুয়ে নিজের হাত নিজে নিজে ছুঁয়ে আত্মরতি, কিংবা গহনায় অলংকৃত রূপ— সব শ্রেণির দর্শককে অবশ্যই এক ধরনের দর্শনগত পরিতৃপ্তি প্রদান করে। এর পাশাপাশি বিছানায় শায়িত অবস্থায় আশালতা ও মহেন্দ্রের অন্তরঙ্গ কথোপকথন, সঙ্গমদৃশ্য, চুম্বক থেকে চুম্বন, সিঁদুরের লাল রঙা মাখা দু’জনের মুখ, বুকে-ঘাড়ে লেগে থাকা কামের চিহ্ন অথবা দাম্পত্য জীবনের খুঁটিনাটি নিয়ে আশালতা ও বিনোদিনীর কথোপকথনজুড়ে যৌন সুড়সুড়ির উপাদান প্রবেশ করিয়ে চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক সফলতার দিকটিও নজরে রেখেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। তিনি নিশ্চিতভাবেই জানতেন, তাঁর ছবির এসব উপাদান ‘অশ্লীলতা’র বাইরে যৌনতার ‘শৈল্পিক’ রূপ হিসেবে গণ্য হবে এবং তাই-ই হয়েছে। বিনোদিনী চরিত্রে ঐশ্বরিয়া রাইয়ের পাশে আশালতা চরিত্রে রাইমা সেন যথেষ্ট আলো ছড়াতে সক্ষম হয়নি। সরলতাপূর্ণ কথা বলতে থাকা আশালতা চলচ্চিত্র জুড়ে উপস্থিত থাকলেও বিনোদিনীই দর্শকের মনোযোগের কেন্দ্রস্থলে থেকেছে।

Ritu 7

চলচ্চিত্রে যৌন সুড়সুড়িদায়ক উপাদান রাখা একটা পুরনো পন্থা এবং পুরুষতন্ত্রের যৌন মনস্তত্ত্বকে মাথায় রেখে বাণিজ্যিক ধারার নির্মাতারা এটা নিয়মিতভাবে করে আসছেন। ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচ্চিত্রগুলো একইসাথে ব্যবসা সফল এবং শিল্পগুণসম্পন্ন। তবে বাণিজ্যিক সফলতার খাতিরে ‘চোখের বালি’তে নারীদেহের এই অতি ব্যবহার ঠিক যেন ঋতুপর্ণসুলভ নয়। আবার মুসলমানদের কোনো ধরনের উপস্থিতি না থাকা সত্ত্বেও চলচ্চিত্রের সূচনা এবং সমাপ্তিতে আজানের ধ্বনি সংযোজন করে অসাম্প্রদায়িক চিত্র আনার প্রয়াসও অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।

তবে বিনোদিনী চরিত্রে ঐশ্বরিয়া রাই যথার্থ অভিনয় দিতে পারেননি, অথবা তার দৈহিক ভাষার আড়ালে বেদনার ভাষা যে চাপা পড়ে গেছে, এমনটা বললেও অন্যায় হবে। বিধবা বিনোদিনীর ঈর্ষাবোধ, শারীরিক কামনা, জীবনের তৃষ্ণা এবং আবেগ অনুভূতির উত্থান-পতনকে বেশ ভালোভাবে ধারণ করেছেন ঐশ্বরিয়া রাই এবং তার মনস্তাত্ত্বিক রূপটিও সমানভাবে এসেছে এই চলচ্চিত্রে।

বিধবার বেদনা ফুটিয়ে তোলার জন্য তার ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত এবং শোকাবহ অবস্থাই মুখ্য হবে, সেই নিয়মতান্ত্রিকতা ভেঙে ফেলে বিনোদিনীকে আলাদাভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। তার লাস্যময়তা এবং শারীরিক আকাঙ্ক্ষা দর্শকের প্রথানুগত মূল্যবোধের ধারণায় আঘাত সৃষ্টি করবে, তবে এই আকাঙ্ক্ষা এবং বাসনা-কামনার আড়ালেই লুকিয়ে রয়েছে বিনোদিনীর প্রতিবাদ।

বিধবার বেদনা ফুটিয়ে তোলার জন্য তার ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত এবং শোকাবহ অবস্থাই মুখ্য হবে, সেই নিয়মতান্ত্রিকতা ভেঙে ফেলে বিনোদিনীকে আলাদাভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। তার লাস্যময়তা এবং শারীরিক আকাঙ্ক্ষা দর্শকের প্রথানুগত মূল্যবোধের ধারণায় আঘাত সৃষ্টি করবে, তবে এই আকাঙ্ক্ষা এবং বাসনা-কামনার আড়ালেই লুকিয়ে রয়েছে বিনোদিনীর প্রতিবাদ। সে নিশ্চিতভাবে জানে, মহেন্দ্রের সাথে তার এই সম্পর্ক সাময়িক এবং পরিণতিহীন। নিয়ম ভাঙতে গেলে মহেন্দ্রের তুলনায় তাকে মূল্য দিতে হবে অনেক বেশি। তাই বলে জীবনের তৃষ্ণাকে বিনোদিনী উপেক্ষা করে না। আবার পূজার ঘর, ঘোড়ার গাড়ি কিংবা গ্রামের বাড়িতে তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলোয় সে আকস্মিকভাবে টেনে আনে তার মৃত স্বামীর কথা। হতচকিত মহেন্দ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে ছুঁড়ে দেয় বিদ্রূপের হাসি।

যেহেতু মহেন্দ্রের সাথেই বিয়ে হতে পারত বিনোদিনীর, আশালতার সুখ এবং শান্তি দেখে স্বভাবতই সে ঈর্ষান্বিতবোধ করে। তবে সেই ঈর্ষাকে গতানুগতিক রূপ না দিয়ে আলাদাভাবে চিত্রিত করা হয়েছে এখানে। যেমন, বিবাহবার্ষিকীর রাতে আশালতাকে নিজের হাতে সাজিয়ে বিনোদিনী তাকে মহেন্দ্রের কাছে পাঠায়। আবার কাশীতে যেয়ে নিজের মধ্যে জন্ম নেওয়া স্বাধীনতাবোধের অনুভূতিও সে চিঠি লিখে জানায় আশালতাকে। ঈর্ষার চেয়ে দু’জন নারীর মধ্যের বন্ধন মুখ্য হয়েছে চলচ্চিত্রের শেষে। ‘নারীর বিরুদ্ধে নারী’র ঈর্ষাবোধের গতানুগতিক চিত্রায়ণের বাইরে এই চলচ্চিত্রে ‘পুরুষের বিরুদ্ধে পুরুষে’র ঈর্ষাবোধ ফুটিয়ে তোলায় বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। এজন্য মহেন্দ্র-বিহারী চরিত্রদ্বয়ের মধ্যে এক ধরনের তিক্ত-মধুর সম্পর্ক বিরাজ করে পুরো সময় ধরে।

 

৫.
বিনোদিনীর প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করে তার জন্য ঘরবাড়ি স্ত্রী ছেড়ে কাশীতে এসে উপস্থিত হয়েছে মহেন্দ্র। কিন্তু বিনোদিনী পেতে চেয়েছে বিহারীকে। এদিকে বিহারী যেহেতু আশালতার প্রতি অনুরক্ত, কাজেই ঈর্ষাবোধ থেকে আশালতার স্বামী মহেন্দ্রকে বিনোদিনী নিজের কাছে রেখেছে।।

এখানে চারজন নারী-পুরুষের একটি চক্র সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে কেউ কাউকে পাচ্ছে না। মহেন্দ্র চেয়েছে বিনোদিনীকে, বিনোদিনী চেয়েছে বিহারীকে, বিহারী দুর্বল আশালতার প্রতি, আশালতার দুর্বলতা তার স্বামী মহেন্দ্রের প্রতি। রবীন্দ্রনাথ এই চক্রের আকাঙ্ক্ষিত সমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন মহেন্দ্র-আশালতার পুনর্মিলন, বিহারীর মানবসেবা ব্রত এবং বিনোদিনীর কাশীগমনের মাধ্যমে।

Ritu 8

অন্যদিকে ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে চলচ্চিত্রের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন ভিন্নভাবে। তাঁর ‘চোখের বালি’তে মায়ের মৃত্যু এবং স্ত্রী আশালতার গর্ভধারণের সংবাদ পেয়ে মহেন্দ্র এখানেও নিজের বাড়িতে ফেরত গেছে। বিনোদিনী যে বিহারীকে এক সময়ে মনেপ্রাণে চেয়েছিল, সে যখন বিনোদিনীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় বিনোদিনী তাতে সরাসরি আপত্তি জানায় না। শুধু বিয়ের দিন সকালে একটি চিঠি রেখে সে হারিয়ে যায়।

চিঠিটা আশালতার উদ্দেশ্যে—

‘ভাই বালি,
…মনে পড়ে? তুই বারবার জিজ্ঞেস করতিস, দেশ কি? পিসীমার দেশের বাড়ি আর মকবুলের দেশের বাড়ি আলাদা কেন? বিহারীবাবু যে দেশের কাজ করেন, সে কোন দেশ? তোর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার পরে সেই চিন্তা আমাকে বড়ো ভাবিয়েছে রে। তোর আর আমার মধ্যে বাইরে অনেক অমিল ছিল। তবুও আমরা সই পাতিয়াছিলুম। বেশ ছিলুম দর্জিপাড়া স্টেটের দোতলার অন্তপুরে। সেটাই ছিল আমাদের রোজকার জগৎ। যদি ‘দেশ’ বলতে চাস তাও বলতে পারিস। অমন বাইরের অমিল নিয়ে মিলেমিশে থাকাটা এদেশে নতুন নয়। তাই আমরাও নতুন কিছু করিনি, বালি।

তাই বলে অন্তরের মিল বলতে সত্যিই কি কিছু ছিল না? ছিল। সংসার করার সাধ; ওই যে বললুম ওই দর্জিপাড়ার স্টেটের অন্তপুরের বাইরে আমরা আর কিচ্ছু দেখিনি। তাই আমাদের দেখা একটা মানুষকে নিয়ে দুজনেই সেই সাধ মেটাতে চেয়েছি। তাতে সাধও মেটেনি, আমাদের ছোট্ট দেশটুকু ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কার্জন সাহেবের আইন সত্যিই যদি ফলে, তবে এখন থেকে তুই আর আমি আলাদা দেশে থাকব। সেই দুই দেশে বসে আমরা যদি নিজে নিজে এত দিনকার অপমান, দুঃখ আর বঞ্চনার কথাই কেবল ভাবি, তাহলে তো আমরা প্রথম থেকেই হার মেনে নিলুম। আসলে দেশ তো মনের মধ্যে, বালি।

Ritu 9

…যেদিন ওই দর্জিপাড়ার স্টেট ছেড়ে কাশী ঘাটে গিয়ে দাঁড়ালুম, সেদিন প্রথম জানলুম সত্যিকারের দেশ কাকে বলে! সেখানে হেঁশেল, উঠোন, খড়খড়ি, এঁটো শকড়ির বাইরেও যে একটা বিরাট জগৎ, সে তো আমরা বইয়ে পড়েছি রে! আর ভেবেছি গল্পকথা। মহাভারতে আছে অভিমন্যু মায়ের পেটের মধ্যেই মস্ত বীর হয়েছিল। তোর পেটে যে সন্তান, সে তোর সাথে সাথে রোজ গঙ্গা স্নান করেছে। দোহাই বালি, সে ছেলেই হোক আর মেয়েই হোক, তাকে কেবল ওই দর্জিপাড়ার স্টেটের দোতলার বাড়িতে আটকে রাখিস নে। দেখবি, সত্যিকারের দেশ কাকে বলে, সেই একদিন তোকে বুঝিয়ে দেবে।’

ঘর দুয়ার, সংসারের মায়া কাটিয়ে বিনোদিনী তাই তার দেশকে আপন করে পেয়েছে। সাধারণ কামনা বাসনার উর্ধ্বে উঠে সে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে তৃপ্ত হয়েছে। বেনারসের ঘাটে মৃত্যুপথযাত্রী একজন বৃদ্ধার অন্তিম মুহূর্ত দৃশ্যায়নের কথা এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়। শুধু বিলাস বা ভোগের জীবন নয়, অপেরা গ্লাস চোখে বিনোদিনী তাকেও দূর থেকে মনোযোগ দিয়ে দেখে। এমনকি যে লাল রঙের শালটি সে নিজের গায়ে জড়ানোর জন্য মহেন্দ্রের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিল, সেটি সে পরম মমতায় বিছিয়ে দেয় বৃদ্ধার গায়ে। বৃদ্ধার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ বিনোদিনীকে বুঝিয়ে দেয়, মৃত্যুই মানুষের জীবনের অন্তিম পরিণতি, পরমতম সত্য। আর এই সত্যের অনুভব বাসনা-কামনা মুছে দিয়ে তাকে এক নতুন পথের দিশা দেয়, এমনটাও বলা যেতে পারে।

২০০৫ সালে এশিয়া সোসাইটির নার্মীণ শেখকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ঋতুপর্ণ ঘোষ বলেছিলেন, ‘আজকেও ‘চোখের বালি’ পড়লে বোঝা যায়, এই উপন্যাসের সমাপ্তি এমন হতে পারে না। অনেক পাঠক চেয়েছিলেন, বিনোদিনীর সাথে বিহারীর বিয়ে হোক। আমি মনে করি, আজ থেকে ৩০ বছর আগেও বিনোদিনীর সাথে বিহারীর বিয়ের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটতে পারত। তখন বিধবা বিয়েকে উৎসাহিত করা হচ্ছিল, সবাই তখন মনে করত, আরেকবার বিয়ে হলে বিনোদিনী নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে। কিন্তু আজকের অবস্থা তো ভিন্ন। এখন নারীর জীবন চালানোর জন্য পুরুষের পরিচয়, উপাধি বা অন্য কোনো অনুষঙ্গের প্রয়োজন হয় না। বিনোদিনী আগে পুরুষের সঙ্গ পেয়েছে, বিয়েও করেছে, কিন্তু এগুলো তাকে কিছুই দেয়নি। একা থাকাটাই তাকে এই জিনিসটা বুঝতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। সে নিজেকে বুঝতে পেরেছে, নিজের শক্তিকে অনুভব করেছে এবং তার মাঝে আত্মমর্যাদাবোধের জন্ম নিয়েছে। সুতরাং তার বেঁচে থাকার জন্য এখন আর পুরুষের প্রয়োজন নেই।

চলে যাওয়ার সময় বিনোদিনী একটি চিঠিতে সে তার নিজের ‘দেশে’র কথা লেখে। এখানে ‘দেশ’ বলতে কিন্তু কোনো রাষ্ট্রকে বোঝানো হয়নি, নিজের আপন জগৎ বা ক্ষেত্রকে বোঝানো হয়েছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন আর বিনোদিনীর জীবনের ঘটনাগুলো একসাথে ঘটছে, কিন্তু সেই স্বাধীনতা আন্দোলনে আবার নারীর কোনো স্থান নেই। সুতরাং নারীর কোনো নিজস্ব দেশ নেই, সে যেমন তার স্বামীর নাম বহন করে, তেমনি স্বামীর দেশই তার দেশ— স্বামী যে দেশের সেও সেই দেশের। কিন্তু একজন নারীরও নিজস্ব জগৎ থাকতে পারে, কোনো নির্দিষ্ট পরিচয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়া তার উচিতও না। পুরুষ কখনো তার আত্মপরিচয় পরিবর্তন করতে পারে না, কিন্তু নারী পারে। একজন স্বাধীন নারীর জন্য এই একান্ত নিজস্ব জগৎ বা ক্ষেত্রকেই আমি ‘দেশ’ বলব। চলচ্চিত্রের শেষে বিনোদিনী এই ‘দেশে’র কথাই চিঠিতে লেখে।’

অর্থাৎ, বিনোদিনীর দেশ বলতে ভারতবর্ষ নয়, বরং তার অন্তর্জগতের স্বাধীনতাকে ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন তিনি।

তথাকথিত মূল্যবোধ এবং সামাজিক শুদ্ধতা রক্ষার দায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেভাবে ‘চোখের বালি’র সমাপ্তি টেনেছিলেন, তা রীতিমতো হাস্যকর বটে। সেখানে দেখা যায়, মহেন্দ্রের কাকিমা অন্নপূর্ণার সাথে বিনোদিনী কাশীবাসী হওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে। তাদের বিদায় নেওয়ার শেষ মুহূর্তটি উপন্যাসের শেষে ঠিক এভাবে বর্ণিত হয়েছে—

মহেন্দ্র আসিয়া প্রণাম করিয়া বলিল, ‘বৌঠান, মাপ করিয়ো।’ তাহার চোখের প্রান্তে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়াইয়া আসিল।
বিনোদিনী কহিল, ‘তুমিও মাপ করিয়ো ঠাকুরপো, ভগবান তোমাদের চিরসুখী করুন।’

Ritu 10

অর্থাৎ যে বিনোদিনীর প্রেমে উন্মত্ত হয়ে মহেন্দ্র বাড়ি ছাড়া হয়েছিল, তাকেই সে প্রণাম করে ক্ষমা চাইল। আবার অনুশোচনায় চোখ থেকে দু’ ফোঁটা অশ্রুও গড়িয়ে পড়ল। শুধু বর্তমান না, সেই অতীতের প্রেক্ষাপটেও এমন সমাপ্তি বেশ আরোপিত। নিজে ব্রাহ্মসমাজের অনুসারী হয়ে হিন্দু বিধবার কথিত শুদ্ধাচার নষ্ট করার মতো দুঃসাহস সেই সময়ে দেখাতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তিনি নিজেও জীবনের শেষ পর্যায়ে ‘চোখের বালি’র সমাপ্তি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। ১৯৪০ সালে বুদ্ধদেব বসু যখন তাঁর সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের সমাপ্তি নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেন, তার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ যে চিঠিটি লিখেছিলেন সেটির একটি লাইন চলচ্চিত্রের শুরুতেই ঋতুপর্ণ ঘোষ কালোপর্দায় আমাদের দেখান— যেখানে বলা হয়েছে :

‘চোখের বালি’ বেরবার অনতিকাল পর থেকেই তার সমাপ্তিটা নিয়ে আমি মনে মনে অনুতাপ করে এসেছি, নিন্দার দ্বারা তার প্রায়শ্চিত্ত হওয়া উচিত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২৪ জুন, ১৯৪০।’

ফলে সমাপ্তিতে পরিবর্তন আনার এই পূর্ণ স্বাধীনতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ দিয়ে গেছেন। ঋতুপর্ণ ঘোষ নারীর মাঝে স্বাধীনতাবোধ জন্ম নেওয়ার প্রসঙ্গ দিয়ে চলচ্চিত্রে যেভাবে সমাপ্তি টেনেছেন সেটিও প্রশংসনীয়।

 

৬.
২০০৩ সালের প্রেক্ষিতে একইসাথে বিশাল বাজেটের এবং একটি ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র ‘চোখের বালি’। ‘চোখের বালি’ নির্মাণের স্বপ্ন ঋতুপর্ণ ঘোষ বয়ে বেড়িয়েছেন দীর্ঘ সময় ধরে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডি সেন্টারের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সত্যজিৎ চৌধুরী তাঁর একটি লেখায় বলেছেন, কিভাবে ঋতুপর্ণ ঘোষ এর চিত্রনাট্য লেখার সময় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে সংরক্ষিত রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা থেকে ‘চোখের বালি’র প্রথম পাঠ পরবর্তীতে পুস্তকাকারে প্রকাশিত উপন্যাসের সাথে মিলিয়ে দেখেছেন। একটি নির্দিষ্ট সময়ের যথাযথ চিত্রায়ণ নিশ্চিত করতে তাঁর সযত্ন শ্রম এবং বিচিত্র পরীক্ষণের ছাপ লেগে রয়েছে পুরো চলচ্চিত্রজুড়ে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডি সেন্টারের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সত্যজিৎ চৌধুরী তাঁর একটি লেখায় বলেছেন, কিভাবে ঋতুপর্ণ ঘোষ এর চিত্রনাট্য লেখার সময় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে সংরক্ষিত রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা থেকে ‘চোখের বালি’র প্রথম পাঠ পরবর্তীতে পুস্তকাকারে প্রকাশিত উপন্যাসের সাথে মিলিয়ে দেখেছেন। একটি নির্দিষ্ট সময়ের যথাযথ চিত্রায়ণ নিশ্চিত করতে তাঁর সযত্ন শ্রম এবং বিচিত্র পরীক্ষণের ছাপ লেগে রয়েছে পুরো চলচ্চিত্রজুড়ে।

যাঁর ছবি দেখে চিত্রনির্মাতা হবেন বলে ঠিক করেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ, সেই সত্যজিৎ রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে ‘চারুলতা’র (১৯৬৪) কিছু দৃশ্য এখানে পুনঃনির্মাণ করেছেন তিনি। চড়ুইভাতির দিনে বিনোদিনী ও আশালতার দোলনায় দোল খাওয়া, কিংবা অপেরা গ্লাসের সাহায্যে বিনোদিনীর দূরে দেখার প্রচেষ্টা ‘চারুলতা’য় মাধবী মুখোপাধ্যায় অভিনীত সেই অনন্য দৃশ্যগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

‘চারলতা’য় (১৯৬৪) চারুর হাতের অপেরা গ্লাসটা ছিল বিস্তৃত জগতকে দূর থেকে কাছে আনার সহায়ক হিসেবে, যা তার দৃষ্টিকে আরও প্রসারিত করে। অন্যদিকে ‘চোখের বালি’তে বিনোদিনীর হাতে অপেরা গ্লাসটি ব্যবহৃত হয়েছে তার দর্শনগত যৌন পরিতৃপ্তির দিকটি নির্দেশ করতে, যা দিয়ে সে মহেন্দ্র-আশালতার শোবার ঘরের জানালায় উঁকি দিতে পারে, আবার কাশীর ঘাটের পালোয়ানের মুগুর ভাজা কিংবা রাতের গানের জলসা দেখতে পারে।

Ritu 11

সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’ (১৯৬৪); ছবিস্বত্ব: আর ডি বনশল এন্ড কোম্পানি

Ritu 12

অপেরা গ্লাস হাতে ‘চোখের বালি’র (২০০৩) বিনোদিনী

তাছাড়া এই চলচ্চিত্রে লাল রঙের ব্যবহারের কথাও আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয়। আশালতার লাল রঙের নিজে ব্লাউজ পরে দেখানো, কিংবা পরবর্তীতে কাশীতেও বিনোদিনীর লাল রঙের চাদর পরা নিয়মতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহকে নির্দেশ করে। তৃষা গুপ্তাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ঋতুপর্ণ ঘোষ এ প্রসঙ্গে নিজেই বলেছিলেন :

‘১৯০২ সালে ‘লাল’ ছিল কামনার রং, কিন্তু গোটা বিশ শতক আমাদেরকে দেখিয়ে গেল যে, লাল বিদ্রোহের রংও বটে। কাজেই ২০০৩ সালে আমি যখন লাল রং ব্যবহার করছি, তাতে কামনার সাথে বিদ্রোহকেও বোঝাচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেহেতু গত ১০০ বছর দেখে যেতে পারেননি, কাজেই এখানে আমি তাঁর থেকে এগিয়ে থাকছি।’

Ritu 13

সেট ডিজাইনিংয়ে যত্নের চাপ আর যথার্থ আবহ সঙ্গীতের সম্মিলন একটি সময়কে অন্যরূপে ফিরে এসেছে ‘চোখের বালি’ চলচ্চিত্রে। রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি রাধা-কৃষ্ণের বিরহ সূচক একটি গান এখানে পুনঃপুন বেজে উঠেছে, ‘মাধব মিলন তরে আমার রাধা, বাসর সজ্জা করে বসি শুদ্ধ নিকুঞ্জমঞ্জিরে…।’ বিধবা বিনোদিনীর বেদনাকে ফুটিয়ে তুলতে গানটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মূল অভিনয়শিল্পীদের পাশাপাশি দু’জন ডাবিংশিল্পীর কণ্ঠের সুনিপুণতার কথা আলাদাভাবে উল্লেখ না করলেই নয়। এখানে ঐশ্বরিয়া রাইয়ের কণ্ঠ দিয়েছেন শ্রীলা মজুমদার এবং রাইমা সেনের কণ্ঠ দিয়েছেন সুদীপ্তা চক্রবর্তী।

এটা ঠিক যে, ‘চোখের বালি’র চিত্রগ্রহণ থেকে শুরু করে রঙের ব্যবহার, সাজপোশাক এবং অলংকারের জৌলুস, দেয়ালে ঝোলানো ডাচ চিত্রকর রেমব্রান্টের পাশাপাশি অন্যান্য চিত্রকলা, সেট ডিজাইনিংয়ের আভিজাত্য, বলিউড তারকার উজ্জ্বল উপস্থিতি, উচ্চমার্গীয় সুর ও সংগীতের সম্মিলনসহ প্রভৃতি কারণে দর্শক-সমালোচকদের কাছে এর এতো সমাদর। তবে এই সৌন্দর্যবর্ধন বা আড়ম্বরের আড়ালে পরিচালকের গভীর অন্তর্দৃষ্টি বা মহৎ চলচ্চিত্রের উপকরণ যে কতটা লুকিয়ে আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। ২০০২ সালে সঞ্জয় লীলা বানশালির ‘দেবদাস’ মুক্তির পরে পুরো ভারতবর্ষজুড়ে চলচ্চিত্রে আড়ম্বর এবং আভিজাত্য প্রদর্শনের আলাদা জোয়ার আসে। ‘চোখের বালি’তেও সেই আড়ম্বরকে ছোঁয়ার চেষ্টা প্রবল বলে অনুভব করি; দেখার সময় মুগ্ধতা জাগায় বটে, তবে অন্তরে বিশেষ সাড়া জাগায় না।

আক্ষরিক অনুবাদে ‘চোখের বালি’কে ‘Sand in the Eye’ বা ‘Eyesore’ রূপে অনুবাদ করা যায়, তবে ঋতুপর্ণ ঘোষ এই ছবির ইংরেজি টাইটেল দিয়েছেন ‘A Passion Play’। অর্থাৎ নিষিদ্ধ কামনার উপস্থাপনাকেই তিনি এই চলচ্চিত্রের কাহিনিকেন্দ্র রূপে বিবেচনা করেছেন।

আক্ষরিক অনুবাদে ‘চোখের বালি’কে ‘Sand in the Eye’ বা ‘Eyesore’ রূপে অনুবাদ করা যায়, তবে ঋতুপর্ণ ঘোষ এই ছবির ইংরেজি টাইটেল দিয়েছেন ‘A Passion Play’। অর্থাৎ নিষিদ্ধ কামনার উপস্থাপনাকেই তিনি এই চলচ্চিত্রের কাহিনিকেন্দ্র রূপে বিবেচনা করেছেন। এই নামেই হিন্দিতে ডাবিং হওয়ার পর ছবিটির আন্তর্জাতিক মুক্তি ঘটে।

‘বাংলা ভাষায় নির্মিত শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র’ হওয়ার পাশাপাশি আরো দু’টি বিভাগে ২০০৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে ‘চোখের বালি’। এছাড়া ২০০৩ সালে লোকার্নো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘গোল্ডেন লেপার্ড’ এর (শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র) জন্যও মনোনীত হওয়ার পাশাপাশি ২৫টিরও চলচ্চিত্র উৎসবে এটি প্রদর্শিত এবং প্রশংসিত হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে এই স্বতন্ত্র এবং অনন্য উপস্থাপনটি ঋতুপর্ণ ঘোষের একটি উল্লেখযোগ্য নির্মাণ হিসেবে বিবেচিত হয়। পাশাপাশি সময় ও সমাজের চিত্রায়ণ এবং সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে ‘চোখের বালি’র আবেদন সামনের দিনগুলোতেও সমানভাবে অক্ষুণ্ন থাকবে।


ঋণস্বীকার:

১. ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ‘চোখের বালি’, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৩০৯ বঙ্গাব্দ।
২. Interview of Rituparno Ghosh by Nermeen Shaikh, ‘Rituparno Ghosh and the ‘Intellectual Film’ in India’, Asia Society, 2005. Retrieved from: http://www.asiasociety.org/arts-culture/film/rituparno-ghosh-andintellectual-film-india//
৩. Bakshi, Kaustav, ‘Chokher Bali: Unleashing Forbidden Passions.’ Silhouette 9, no. 3, 2011, pp. 1- 9. Retrieved from: http://silhouette-mag.wikidot.com/vol9-3-kaustuv.
৪. শরমিন, মনিরা, ‘সুশীল রুচির শিল্পিত মোড়কে আবৃত ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচ্চিত্র ‘চোখের বালি’তে রুচি ও যৌনতার প্রশ্ন’, নারী ও প্রগতি, ২০১১।
৫. Chakraborty, Aishika, ‘Playing Passion Over Penance: Re-viewing Chokher Bali (1902-2002)’, Silhouette: A Discourse on Cinema, November 10, 2012. Retrieved from:
https://learningandcreativity.com/silhouette/playing-passion-over-penance-re-viewing-chokher-bali-1902-2002/
৬. Bose, Mandakranta, ‘Political Aesthetics of Nation and Gender in Rituparno Ghosh’s Chokherbali’, Ed. Heidi R. M. Pauwels, Indian Literature and Popular Cinema: Recasting Classics, London: Routledge, 2007, pp. 191–202.
৭. Interview of Rituparno Ghosh by Trisha Gupta, Tehelka Magazine, Volume 5 Issue 38, September 27, 2008. Retrieved from blog ‘Chhotahazri’: http://trishagupta.blogspot.com/2008/09/rituparno-ghosh-interview.html?m=1
৮. Macdonald, Alison, ‘Real’ And ‘Imagined’ Women: A Feminist Reading of Rituparno Ghosh’s Films’, UCL, 2009.

©লেখাটিতে ব্যবহৃত পোস্টার এবং ছবির স্বত্ব: শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস, ২০০৩।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২ এপ্রিল ১৯৯৯ সালে, সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জে। শিক্ষাজীবনের সূচনা এবং বেড়ে ওঠা সেখানেই। কৈশোর কেটেছে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যয়নরত। সাহিত্য, চিত্রকলা এবং চলচ্চিত্রের প্রতি অনুরাগ থেকে বিচিত্র বিষয়ে লিখতে ভালোবাসেন। প্রকাশিতব্য গ্রন্থ: ‘ঋতুপর্ণ পাঠ: চলচ্চিত্র, জীবন এবং অন্যান্য'।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।