‘আমার আমি হয়ে ওঠার পিছনে যে ঘনিষ্ঠ পারিবারিক আত্মীয়টি আমাকে বারবার ঠেলে দিয়েছেন চরম কঠিন পরীক্ষার সামনে এবং সযত্নে রক্ষা করেছেন যেকোনো প্লাবনের অবসাদ আর অন্ধকার থেকে, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ। এক একটি বিশেষ মুহূর্তে তাঁর একই কথা নানাভাবে অর্থবহ হয়েছে। এমন দুঃসহভাবে ধ্রুব বলে মনে হয়েছে যে, কখন যেন আমি বুঝে গিয়েছি— তিনি ছাড়া সত্যিই পথ নেই’ —ঋতুপর্ণ ঘোষ
রবীন্দ্র সার্ধশতবর্ষ যাপনের জন্য গঠিত কমিটির একজন সদস্য হিসেবে প্রস্তুতকৃত প্রস্তাবের ভূমিকায় ঋতুপর্ণ ঘোষ এভাবেই তাঁর জীবনে রবীন্দ্রপ্রভাবের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। সৃষ্টিকর্মের সফলতায় নিজেকে অবিরত ব্যস্ত রেখে যখনই একান্ত করে নিজের কাছেই ফিরেছেন, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ টের পেয়েছেন তখনই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে আশ্রয় খুঁজেছেন। নিকষ অন্ধকারে পথ খুঁজতে গিয়ে সমর্পিত হয়েছেন তাঁর একান্তজন রবির কাছে। সকল সৃষ্টিকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে তিনি সন্ধান করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গানের ওপারে’র দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ কিংবা ঈশ্বরের। অবশেষে সেই ‘জোব্বাধারী অনিন্দ্যমুর্তিতে’ই ঋতুপর্ণ খুঁজে পেয়েছেন তাঁর প্রাণের মানুষের, তাঁর ঈশ্বরের।
ঋতুপর্ণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি ও দর্শনকে আমৃত্যু ধারন করেছেন। তাঁর জীবনদর্শন ও সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাশাপাশি সত্যজিৎ রায়, মহাভারত এবং বৈষ্ণব পদাবলীর প্রভাবের কথাও বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও লেখার মাধ্যমে অকপটে স্বীকার করেছেন।
ঋতুপর্ণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি ও দর্শনকে আমৃত্যু ধারন করেছেন। তাঁর জীবনদর্শন ও সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাশাপাশি সত্যজিৎ রায়, মহাভারত এবং বৈষ্ণব পদাবলীর প্রভাবের কথাও বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও লেখার মাধ্যমে অকপটে স্বীকার করেছেন। ঋতুপর্ণের কাছে মহাভারত যেখানে সভ্যতার রূপরেখা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেখানে সভ্যতার এক ধারা। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুযাত্রাকে মহিমান্বিত করতে তাঁর সাথে তুলনা করেছেন যুধিষ্ঠিরের শূন্য রথযাত্রার। তাঁর প্রতিটি সিনেমাতেই কোনো না কোনোভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপস্থিত রয়েছেন। পারিবারিক আত্মীয় হয়েও ঋতুপর্ণের কাছে তিনি কেবলই একজন ‘রবি’ হয়ে উঠেছেন, যে রবির সাথে অভিমান করা যায়, জাপটে ধরা যায়, অন্ধকারে পথের দিশা পাওয়া যায়। যে রকমটি আমরা তাঁর পরিচালিত ‘অসুখ’ সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেখতে পাই। মানসিক অস্থিরতায় রোহিনী অন্ধকারে আলোর খোঁজ করে যখন তার বাবাকে আকুল হয়ে ডাকে, তখন রোহিনীর পেছনের দেয়ালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাদাকালো ছবিখানি অন্ধকারের মধ্যেও কেমন উজ্জ্বল হয়ে আশার আলো জাগিয়ে রাখে। অসুখ চলচ্চিত্রে ঋতুপর্ণ ঘোষ বিভিন্ন সময়ে রোহিনীকে সামনে রেখে পেছনের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবির উপরও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে ভরসার প্রতীক হিসেবেই এসেছেন। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আশ্রয় করে অনিরুদ্ধকে উদ্দেশ করে রোহিনীর ভারাক্রান্ত কণ্ঠে শোনা যায় ‘রাজার দুলাল যাবে আজি মোর ঘরের সমুখ পথে/আজি এ প্রভাতে গৃহকাজ লয়ে রহিব বল কী মতে’।
হাসপাতাল থেকে মাকে দেখে বাবার সাথে ঘরে ফেরার সময় রোহিনী যখন শিশুদের পরীর সাজে রাস্তা পার হতে দেখছে, ঋতুপর্ণ তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে আবহ হিসেবে ররবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হারিয়ে যাওয়া’ কবিতাটি নিয়ে আসেন। রোহিনী তার বাবার সাথে সিঁড়ি বেয়ে ঘরে প্রবেশ করা পর্যন্ত কবিতাটির পুরো আবৃত্তিটাই আমরা শুনতে পাই।
‘…তারায় ভরা চৈত্রমাসের রাতে/ফিরে গিয়ে ছাতে/মনে হল আকাশপানে চেয়ে/আমার বামীর মতোই যেন অমনি কে এক মেয়ে/নীলাম্বরের আঁচল্খানি ঘিরে/দীপশিখাটি বাঁচিয়ে একা চলছে ধীরে ধীরে। /নিবত যদি আলো, যদি হঠাৎ যেত থামি/আকাশ ভরে উঠত কেঁদে, হারিয়ে গেছি আমি।’
কবিতাটি শেষ হবার সাথে ফ্ল্যাশব্যাকে ঋতু ফিরে যান অনিরুদ্ধ-রোহিনী-মৃত্তিকার কবিতা ও গানের আড্ডায়, যেখানে ওই কবিতাটিই রোহিনীর কণ্ঠে পাঠ শেষে মৃত্তিকা ও অনিরুদ্ধর দ্বৈতকণ্ঠে শোনা যায় ‘দীপ নিভে গেছে মম নিশীথ সমীরে’ গানটি। রোহিনী আবৃত্তিতে যতটা সাবলীল, গানে ততটা নয়। তাই অনিরুদ্ধর সাথে একসাথে না গাইতে পারার বেদনা রোহিনীর মুখে ফুটে ওঠে। ফ্ল্যাশব্যাক শেষে আমরা রোহিনীকে বিষণ্ন ব্যাথায় ওই গানটি গাইবার চেষ্টা করতে দেখি যা রোহিনীর কণ্ঠে ব্যথা হয়েই বাজে। চরম হৃদয় যন্ত্রণায় কান্নাভাঙা কণ্ঠে রোহিনী গাইবার চেষ্ঠা করে, ‘ভয় পাছে শেষ রাতে ঘুম আসে আঁখি পাতে’। পরপর কবিতা ও গানের সংঘর্ষের মন্তাজে রোহিনীর মানসিক অবস্থাকে ঋতুপর্ণ তাঁর সিনেমার ভাষাতেই প্রকাশ করেন। বামীর মতোই রোহিনী মনের যে ‘দীপশিখা’টি কোনোভাবে বাঁচিয়ে একা চলছিল, সেই দীপ এখন নিভে গেছে! অসুখ চলচ্চিত্রটির মূল সুরে জড়িয়ে আছে এই কবিতাটিরই ছায়া, যাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যান্য গান ও কবিতার ব্যবহারে একটি নান্দনিক রূপ পায়।
আরেকটি দৃশ্যে রোহিনী যখন তার মাকে সঞ্চয়িতার কবিতাটি পড়ে শোনায় তখন রোহিনীর মাকে বলতে শোনা যায়, ‘সঞ্চয়িতা পড়িয়ে তোকে কত ঘুম পাড়িয়েছি ছোটোবেলায়, তুই হঠাৎ ঘুমের ওষুধ ধরলি কেন রে?’ সাথে সাথে আমাদের মনে পড়বে ঋতুপর্ণের মাও ছোটোবেলায় তাঁকে সঞ্চয়িতা পড়ে শোনাতেন।
আরেকটি দৃশ্যে রোহিনী যখন তার মাকে সঞ্চয়িতার কবিতাটি পড়ে শোনায় তখন রোহিনীর মাকে বলতে শোনা যায়, ‘সঞ্চয়িতা পড়িয়ে তোকে কত ঘুম পাড়িয়েছি ছোটোবেলায়, তুই হঠাৎ ঘুমের ওষুধ ধরলি কেন রে?’ সাথে সাথে আমাদের মনে পড়বে ঋতুপর্ণের মাও ছোটোবেলায় তাঁকে সঞ্চয়িতা পড়ে শোনাতেন। মৃত্তিকার সাথে অনিরুদ্ধর প্রেমের ঈঙ্গিত পেয়ে রোহিনী তার মানসিক অবস্থা বোঝানোর জন্য অনিরুদ্ধকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসের কাদম্বরী দেবীর আত্নহত্যার পূর্বমুহূর্তের বর্ণনা পাঠ করতে বলে। এভাবে সিনেমায় বিভিন্ন দৃশ্যে ছবি-গান-কবিতার ব্যবহারের মাধ্যমে ঋতুপর্ণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিপর্যস্ত রোহিনীর পরম আশ্রয় করে তোলেন, যেভাবে তিনি নিজে তাঁর রবির কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে তাঁর চিন্তার প্রতিফলন পাওয়া যায় তাঁর পরিচালিত ডকুড্রামা ‘জীবনস্মৃতি’তে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে ঋতুপর্ণ যখন একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের অনুরোধ পেলেন তখন তিনি এটাকে শুধু একটি তথ্যচিত্রের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইলেন না, তাই জীবনস্মৃতিতে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সাজিয়ে তুললেন তাঁর মতো করেই, যেখানে ঋতুপর্ণ নিজেই একটি চরিত্র। জীবনস্মৃতিতে ঋতুপর্ণ ও রবীন্দ্রনাথ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যান। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বালক রবিকে ঋতুপর্ণ চোখের সামনেই দেখতে পান। আবার রবিও উৎসুক দৃষ্টিতে ঋতুপর্ণকে দেখেন। যেনবা ঋতু ও রবির এ এক লুকোচুরি খেলা। ঋতুপর্ণ রবির সেইসব দিনে ফিরে গিয়ে নিজেকে রাধারূপে কল্পনা করে তাঁর রবিকে কৃষ্ণরূপে দেখতে চেয়েছেন। দরজা খুলে রাধারূপী ঋতু পায়ে পায়ে ছন্দ তুলে বারান্দা দিয়ে এগিয়ে যান রবির দিকে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজে, ‘আও আও সজনি-বৃন্দ/হেরব সখি শ্রীগোবিন্দ/শ্যামকে পদারবিন্দ/ ভানুসিংহ বন্দিছে।’
কী প্রেমময়তায় গভীর গোপনে তিনি অবগাহন করেন তাঁর প্রিয় গোবিন্দ রবিকে! এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ের দৃশ্যের পিঁড়িও সাজান স্বয়ং ঋতু। ঋতুপর্ণের চিন্তা ও চেতনার রবীন্দ্রনাথকেই সাজিয়ে তুলেছেন তাঁর তথ্যচিত্র ‘জীবনস্মৃতি’তে।
‘চোখের বালি’ নির্মাণের সময় ঋতুপর্ণ সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর মতো করেই অনুভব করতে চাইলেন অকাল বৈধব্যের যন্ত্রণা ও সম্পর্কের জটিলতাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে লাল রং যেখানে কামনার প্রতীক, ঋতুপর্ণের কাছে তা বিদ্রোহেরও প্রতীক হয়ে ওঠে। চোখের বালি চলচ্চিত্রে তাই লাল রঙের এত আধিপত্য। মহেন্দ্রকে আকৃষ্ট করার জন্য উপন্যাসে বিনোদিনীকে যখন লাল শাল গায়ে দিয়ে ঘুমানোর অভিনয় করতে হয়, সেখানে ঋতুপর্ণের চোখের বালিতে মৃত্যু পথযাত্রী বৃদ্ধার গায়ে বিনোদিনী লাল শাল পরিয়ে দেয়। আবার ঋতুপর্ণ বিধবা বিনোদিনীকে আশালতার লাল ব্লাউজ পরিয়ে কামার্ত করে তোলেন, একইসাথে তথাকথিত নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীও করে তোলেন। উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক পত্রালাপের ব্যবহার করেছেন। ঋতুপর্ণও তাঁর নিজস্ব রচনার বিভিন্ন পত্রালাপের মাধ্যমে ঘটনার বর্ণনা কিংবা বিশ্লেষণ করেছেন যা যথেষ্ট রাবীন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। ঋতুপর্ণ রবীন্দ্রসৃষ্টি ও তাঁর দর্শনের সাথে এতটাই একাত্ম যে ঋতুপর্ণ রচিত পত্রগুলোর শৈলীর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্রশৈলী একাকার হয়ে গেছে। চোখের বালি উপন্যাস নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি চিঠির অংশ দিয়েই ঋতুপর্ণ তাঁর চলচ্চিত্র শুরু করেন। শুরুতেই পর্দায় ভেসে ওঠে ‘চোখের বালি বেরবার অনতিকাল পর থেকেই তার সমাপ্তিটা নিয়ে আমি মনে মনে অনুতাপ করে এসেছি, নিন্দার দ্বারা তার প্রায়শ্চিত্ত হওয়া উচিত’। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিনোদিনীকে ঋতুপর্ণ নিজের মতোই সাজিয়েছেন। ঋতুপর্ণের বিনোদিনী মহাবিশ্বের সৌন্দর্য ও তার বিশালতা অনুভব করে মহেন্দ্র-বিহারীর বিচ্ছেদের দুঃখকে তুচ্ছ করতে পেরেছিল। ঋতুপর্ণের ভাষায়, ‘আমার বিনোদিনী বিহারীর কাছে প্রত্যাখাত হওয়ার পর আত্মঘাতিনী হতে গিয়েছিল গ্রামের দিঘিতে। সেখানে সেই ঘাটে বসে, তারাভরা অনন্ত আকাশের তলা, রাত্রিময় অসীম ব্রহ্মাণ্ডের দিকে তাকিয়ে তার কাছে হয়তো সত্যি সত্যিই তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর যত মহেন্দ্র-বিহারী। আত্মহননের দড়ি কলসি নির্জীব ঢেলার মতো গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল নির্জন নিশাজলে।’ তাই চোখের বালি উপন্যাস যেখানে বিনোদিনীর কাশীবাসে শেষ হয়, সেখানে ঋতুপর্ণের বিনোদিনী স্বাধীনচেতা হয়। আশালতার কাছে বিনোদিনীর লেখা চিঠি যা অবধারিতভাবে ঋতুপর্ণের রচিত, সেখানে চিন্তা ও চেতনায় এক নতুন বিনোদিনীকেই দেখা যায়। সেই চিঠিতে বিনোদিনী তার ‘চোখের বালি’ আশালতাকে যে দেশের কথা বলে তা তার একান্ত মনেরই ভুবন। তাই সে লেখে ‘আসলে দেশ তো মনের মধ্যে বালি’।
চলচ্চিত্রটিতে কয়েকটি পত্রালাপ রয়েছে যা ঋতুপর্ণের নিজস্ব রচনা হলেও ভীষণভাবে রাবীন্দ্রিক। বিশেষত চলচ্চিত্রটির শেষভাগে নলিনাক্ষের কাছে হেমনলিনীর চিঠির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সিনেমার শুরুতেই হেমনলিনীকে লেখা রমেশের চিঠিতে ঋতুপর্ণের রবীন্দ্রপ্রীতির আরেকটি বড়ো নমুনা রয়েছে।
উপন্যাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ঋতুপর্ণ নির্মাণ করলেন তাঁর আরেকটি রবীন্দ্রছবি ‘নৌকাডুবি’, যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র হেমনলিনী রবীন্দ্রনাথকেই বিয়ে করতে চায়। তার পিতার সাথে কথোপকথনে হাস্যরসের মাধ্যমে এ অভিপ্রায় ব্যাক্ত করলেও, এ থেকে ঋতুপর্ণ ঘোষের রবীন্দ্রপ্রীতির একটি নমুনা পাওয়া যায়। এই চলচ্চিত্রে ঋতুপর্ণ রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহারে ভীষণভাবে সফল হয়েছেন যা কাহিনির সাথে সামঞ্জস্যতা লাভ করে। চলচ্চিত্রটিতে কয়েকটি পত্রালাপ রয়েছে যা ঋতুপর্ণের নিজস্ব রচনা হলেও ভীষণভাবে রাবীন্দ্রিক। বিশেষত চলচ্চিত্রটির শেষভাগে নলিনাক্ষের কাছে হেমনলিনীর চিঠির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সিনেমার শুরুতেই হেমনলিনীকে লেখা রমেশের চিঠিতে ঋতুপর্ণের রবীন্দ্রপ্রীতির আরেকটি বড়ো নমুনা রয়েছে। চিঠির এক জায়গায় রমেশ লিখছে, ‘আমাদের বাড়ির একটি ভারী আসবাবের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভদ্রলোকের যা যা বই প্রকাশিত হয়েছে প্রতিটির একেক কপি অর্ডার করে দিয়েছি। ছোঁয়াছুঁয়ির ঝামেলায় না গিয়ে একটি আলাদা বুককেসের ব্যবস্থা করা হয়তো সমীচীন, কারণ তুমি যতই বল তুমি ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস কর না, এই একজন ঠাকুর যে তোমাকে আপাদমস্তক ভক্তিমতী করে ছেড়েছেন সে তো কারো আর অজানা নয়। ভাবছি একজন পূজারী ব্রাহ্মণ ঠিক করলে কেমন হয়? তুমি না আসা অবধি অন্তত বুককেসের সামনে নিয়ম করে একটু ফুল বেল পাতা পড়ে। এও ভাবছি তোমার জন্মদিনের দিন সন্ধ্যায় তোমার বাড়িতে যখন যাব, তোমার বাবার কাছে বিবাহের প্রস্তাবটা পেড়ে ফেললে ভালো হবে। বেশী দেরী করলে তোমার কবি যে তোমাকে হরণ করে নেবেন না, সে ভরসা আমার নেই।’ এই চিঠি পাঠের মাঝে মাঝে হেমনলিনীর কণ্ঠে ‘খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি’ গানটি ব্যবহার করা হয়। গানের শেষের দিকে একটি দৃশ্যের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি, যেখানে টেবিলের উপর রবীন্দ্রনাথের ছবির সামনে বর্ণিল ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। হেমিনলিনী চেয়ারে বসে গান গাইতে গাইতে রবীন্দ্রনাথের ছবির দিকে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকায়। এরপর হাতের উপর মাথা আলতোভাবে রেখে একটি স্নিগ্ধ হাসি উপহার দেয়। এই দৃশ্যটি হেমনলিনীর পিতা ক্যামেরাবন্দি করেন, যার মাধ্যমে ঋতুপর্ণ দৃশ্যটিকে একটি বিশেষ মর্যাদাই দিতে চেয়েছেন।
নিজের যাপিত জীবনের একান্ত ভুবনের নিঃসঙ্গতার অনুভবে ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রথার বাইরের একজন মানুষ হিসেবে পরিগণিত হলেও এ বিষয়ে সব সময় নির্বাক থাকেননি। অধিকারের প্রশ্নে কোনো সংস্কারে আবদ্ধ ছিলেন না। লৈঙ্গিক তারল্য নিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রান্তিক মানুষদেরই প্রতিনিধি। তাই ভারাক্রান্ত মনে ঋতুপর্ণ লিখেছিলেন, “সাফল্যের একটা বর্ম না থাকলে, হতেই পারত আমিও ওদের মত সংশয়াকুল নির্বাক হয়ে থাকতাম। ‘চিত্রাঙ্গদা’ আমাদের এই সমস্ত প্রান্তিক মানুষের, অনেক না-বলতে-পারা কথার উচ্চারণ।” চিত্রাঙ্গদা চলচ্চিত্রটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদার মন ও মানস বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে, নিজস্ব দর্শনে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৃত্যনাট্য চিত্রঙ্গদা থেকে তিনি এ ব্যাপারে বিভিন্ন সংকেত পেয়ে যান। মহাভারতে চিত্রবাহনের কন্যা চিত্রঙ্গদা নারী হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও চিত্রবাহন তাকে পুরুষ বলে গণ্য করে বড়ো করে তুলেছেন এবং অর্জুনের সাথে এই শর্তে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করালেন যে চিত্রাঙ্গদার গর্ভজাত পুত্র চিত্রবাহনের বংশধর হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই চিত্রঙ্গদার আখ্যান গড়লেন অন্যভাবে। ঋতুপর্ণের ভাষায় ‘মহাভারতের চিত্রঙ্গদা সুন্দরী, অর্জুন তাকে দেখে প্রণয়াসক্ত হয়ে তার পাণিপ্রার্থী হন। রবীন্দ্রনাথের অর্জুনের কাছে বালকবেশী চিত্রাঙ্গদা উপহাসের পাত্রী। সে না সুযোগ্য নারী, যার প্রতি প্রণয়দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যায়, না সে যথার্থ পুরুষ যার সঙ্গে যুদ্ধ করা যায়।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদায় অর্জুন প্রথম বালকবেশী চিত্রাঙ্গদাকে উপহাস করেন, পরে সুরূপা চিত্রাঙ্গদার প্রেমাসক্ত হলেও তিনি চিত্রাঙ্গদাকে তার আপন রূপেই গ্রহণ করেন। সিনেমায় রুদ্র পুরুষ শরীরের কাঠামো নিয়ে জন্মগ্রহণ করলেও, মন ও আচরণগতভাবে ভীষণভাবে নারী, রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা যেমন নারী হয়ে জন্ম নিয়েও আচরণে পুরুষালী। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করেও রুদ্র নামী কোরিওগ্রাফার। বাবার ইচ্ছের কারণে সে ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু মনে সর্বদাই এক শিল্পীর বাস। তার বাবার ইচ্ছে ছেলে ছেলের মতো হবে কিন্তু রুদ্র বিশ্বাস করে নিজের লৈঙ্গিক পরিচয় বেছে নেওয়ার স্বাধীনতায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৃত্যনাট্যের বিনির্মাণে ঋতুপর্ণের চিত্রাঙ্গদায় পার্থ লৈঙ্গিক তারল্যের রুদ্রর প্রতি প্রণয়াসক্ত হলেও রুদ্রর ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের পর পুরো বিষয়টাকে ‘হাফথিং’ বলে উপহাস করে। পার্থ রুদ্রর আপন রূপেরই প্রেমে পড়েছিল, যেভাবে ররবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদায় অর্জুনের কণ্ঠেই উচ্চারিত হয়েছিল প্রণয়োচ্ছ্বাস ‘চিত্রঙ্গদা’ রাজকুমারী একাধারে মিলিত পুরুষ ও নারী, সেভাবে অর্ধনারীশ্বর রুদ্রর প্রতিই পার্থর প্রণয়োচ্ছ্বাস জেগেছিল। তাই রুদ্রর ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের পর পার্থকে বলতে দেখি, ‘If I have to have a woman, I”ll rather have a real woman. Not this synthetic one’। ঋতুপর্ণ ঘোষের চিত্রাঙ্গদা সিনেমাটি ইচ্ছের গল্প, আত্মনুসন্ধান ও আত্নপরিচয়ের উপলব্ধির গল্প। ঋতুপর্ণ রুদ্রর এক সংলাপের মাধ্যমে বিষয়টিকে এভাবে স্পষ্ট করেন, ‘চিত্রাঙ্গাদার বাবা, মনিপুরের রাজা চেয়েছিলেন তার একটা ছেলে হোক, হয়েছিল একটা মেয়ে। তাকে তিনি ছেলেদের মত করে বড়ো করে তুললেন, তারপর সে জঙ্গলে গিয়ে অর্জুনের সাথে মিট করল, তার মেয়ে হতে ইচ্ছে হল, তারপর সে মদনের সাথে গেল টেল… সেইসব আলাদা ইস্যু। Now the moot point is Chitrangada is a story about wishes। ওর বাবার ইচ্ছে ভার্সেস ওর ইচ্ছে। ক্লিয়ার? চিত্রঙ্গদা একটি ইচ্ছের গল্প, that you can choose your gender।’ চলচ্চিত্রটি কিছুটা ঋতুপর্ণের অটোবায়োগ্রাফিক্যাল হওয়ায় এটা বোঝা যায় যে ঋতুপর্ণের যাপিত জীবনের বিভিন্ন সংকটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিত্রাঙ্গদা’য় তিনি এর ব্যাখ্যা খুঁজতে চেয়েছেন। রুদ্রর অবচেতন মনে শুভর সাথে কথোপকথনের মাধ্যমেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদার বিভিন্ন বিশ্লেষণ উঠে আসে। রুদ্রর ‘চিত্রঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যটিও ‘অটোবায়োগ্রাফিক্যাল’ হয়ে যাচ্ছে কি না এ নিয়ে রুদ্রর প্রতি শুভকে প্রশ্নও করতে দেখা যায়। পার্থকে (প্রসঙ্গত মহাভারতে অর্জুনের আরেক নাম পার্থ) ধরে রাখার জন্য রুদ্র নিজের সেক্স পরিবর্তন করার কষ্টকর প্রক্রিয়ায় গিয়েও শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারল না। পার্থ ঘর বাঁধল তাদেরই নাট্যদলের সুন্দরী কস্তুরীর সাথে। বিভিন্ন জাদুবাস্তবতায় স্বপ্ন ও বাস্তবতা একাকার করে ঋতুপর্ণ সমান্তরালভাবে বলেছেন রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদার গল্প, আরেক সম্পর্কের গল্প। চিত্রাঙ্গদার ছায়ায় রুদ্র ও অর্জুনের ছায়ায় পার্থর অতি সংবেদনশীল সম্পর্কের গল্প নির্মাণ করেছেন ঋতুপর্ণ তাঁর নিজস্ব শৈলীতে। রুদ্রর অবচেতন মনে শুভর সাথে কথোপকথনে রুদ্র একসময় আত্নপরিচয়ের সন্ধান পায়। আত্মউপলব্ধির ওই পর্যায়ে রুদ্রর সেই সংলাপটি ভীষণ রকম সংবেদনশীল হয়ে যায়, ‘বাবা-মা আমার ঘরটি খুব সুন্দর করে সাজিয়েছেন, মা নতুন পর্দা এনেছেন, আমি বাড়ি যাই!’
চলচ্চিত্রটি কিছুটা ঋতুপর্ণের অটোবায়োগ্রাফিক্যাল হওয়ায় এটা বোঝা যায় যে ঋতুপর্ণের যাপিত জীবনের বিভিন্ন সংকটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিত্রাঙ্গদা’য় তিনি এর ব্যাখ্যা খুঁজতে চেয়েছেন। রুদ্রর অবচেতন মনে শুভর সাথে কথোপকথনের মাধ্যমেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদার বিভিন্ন বিশ্লেষণ উঠে আসে। রুদ্রর ‘চিত্রঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যটিও ‘অটোবায়োগ্রাফিক্যাল’ হয়ে যাচ্ছে কি না এ নিয়ে রুদ্রর প্রতি শুভকে প্রশ্নও করতে দেখা যায়।
ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর সবকটি চলচ্চিত্র মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় ৫১টি গান ও ৭টি কাব্যাংশ ব্যাবহার করেছেন। এছাড়াও মানুষের জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব নিয়ে ‘গানের ওপারে’ নামের একটি টিভি সিরিয়ালের চিত্রনাট্যও তিনি রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে রেডিও মির্চির জন্য নির্মাণ করেছিলেন শ্রুতিনাটক ‘স্ত্রীর পত্র’। ঋতুপর্ণের লৈঙ্গিক পরিচয় নিয়ে অনেকেই আড়ালে কিংবা সামনা সামনিই হাসি-ঠাট্টা করেছেন, ঋতুপর্ণ কখনো জবাব দিয়েছেন কখনো এড়িয়ে গেছেন। তাঁর যাপিত জীবনের নিজস্ব ভুবনে ঋতুপর্ণ ঘোষ ভীষণভাবেই একা ছিলেন। তাই অভিমানী ঋতুপর্ণ লেখেন, ‘প্রথার বাইরে বাস করার এই অবধারিত ট্রাজেডি আমাকে বারবার ভেঙেছে, দুমড়েছে, ছিঁড়েছে, কুটেছে— এমন করে রক্তাক্ত করেছে যে, মনে হয়েছে, এর চেয়ে মৃত্যুও বোধহয় অনেক বেশী কাম্য। একদিক থেকে আমি পরম ভাগ্যবান, আমার একজন চিরপ্রণয়ী আমাকে কখনও ত্যাগ করে যাননি। আমার রবীন্দ্রনাথ। নিগুঢ়তম অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যেতে যেতেও বইয়ের তাকে হাত রাখলেই বারবার করে পেয়েছি তাঁর প্রণয়ের উত্তাপ।’
তথ্য সহায়িকা
১. প্রবন্ধ: মধুর তোমার শেষ যে না পাই: ঋতুপর্ণের চলচ্চিত্রের চিরসখা রবীন্দ্রনাথ, লেখক: তুষার বিশ্বাস, বই: ‘ঋতুপর্ণ এবং…’, সংকলন ও সম্পাদনা : অর্পণ ও তপোজা। প্রকাশক: দেজ পাবলিশিং, কলকাতা।
২. ঋতুপর্ণ ঘোষ: চলচ্চিত্র, জীবন ও সাক্ষাৎকার, লেখক: নাফিস সাদিক, প্রকাশক: বাতিঘর।
৩. ‘ফার্স্ট পারসন ১’ এবং ‘ফার্স্ট পারসন ২’, লেখক: ঋতুপর্ণ ঘোষ, পরিকল্পনা ও সম্পাদনা : নীলা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রকাশক: দেজ পাবলিশিং, কলকাতা।
৪. ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ নিয়ে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে ঋতুপর্ণ ঘোষের কথোপকথন। ইউটিউব লিংক: মিল্টন মিউজিক: https://youtu.be/8Lf5pzcBK8w?si=0_CFoAeVD5lESH2।
পেশায় ব্যাংকার। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। শাবিপ্রবির চলচ্চিত্র বিষয়ক সংগঠন চোখ ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে চলচ্চিত্র বিষয়ক ছোটোকাগজ ‘প্রক্ষেপণ’ সম্পাদনায়ও যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েব পত্রিকায় নিয়মিতভাবে চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রবন্ধ ও গল্প লিখছেন।