একটা পাখি
একটা বুড়ো পাখি
বিভিন্ন গাছের ডালে, পাতার পিছনে
চোরের মতো বসে থাকে।
তার ওড়াউড়ি প্রায় শেষ, বউ নিখোঁজ
ছেলেমেরাও!
এই গাছ থেকে ওই গাছে যায়
গানও প্রায় শেষ
অভ্যাসের দোষে মাঝেমধ্যে
একটু-আধটু শব্দ করে
তারপর স্তব্ধ থাকে
ছোটো চোখ দিয়ে বড়ো আকাশটা দেখে
আকাশের দূরত্ব দেখে
আর ভাবে, একদিন, কত কত দিন
আকাশরে সে উড়ায়েছে তার
ডানায়
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে
স্বপ্ন দেখে, দেখে সে মরে গেছে
আর পৃথিবীর সব পাখি তারে
কবর দিয়ে গেছে আকাশে
আশেপাশে ওড়ার আওয়াজ
আওয়াজে তার মৃত্যু ভেঙে যাচ্ছে
সে জেগে উঠছে
যেভাবে পৃথিবীর সকালে জাগে তরুণ পাখিরা
আমি বিক্রি করি আমার জ্ঞান
কারা আমারে কিনে নেয়
আমি চিনতে পারি না
তবু হাসিমুখে বিক্রি হই
ওরা আমাকে বলে,
এমন একটা বন্দুক বানাও
যে বন্দুকটি নিজেই নিজের গুলি বানাতে পারে
যে বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে ইচ্ছা করা মাত্র
বেরিয়ে যাবে তিনকোটি বিরাশি লাখ গুলি
আর গুলিরা যেদিকে মানুষের গন্ধ পাবে
ছুটে যাবে আর হত্যা করবে
হত্যা করতে করতে ক্লান্ত হলে
ফিরে আসবে আবার বন্দুকের পেটে
আমি তাদের বলি,
আপনারও মানুষ
গায়ে মানুষের গন্ধ
যদি হত্যা করে ফেলে?
তারা চিন্তায় পড়ে যায় আর বলে,
‘তাহলে আগে আমাদের অন্যকিছু বানাও
অর্থাৎ আমাদের সিংহ বানিয়ে দাও
অথবা কুমির
সব মানুষ মরা শেষ হলে
আবার আমাদের মানুষ বানিয়ে দিও।’
আমি ‘আচ্ছা’ বলি।
আর ওদের সিংহ বা কুমির বানাতে লাগি
কিন্তু কোথাও একটু ভুল হয়
আর ওরা সাপ ও শূকর হয়ে যায়
তাদের আমি বনের পথ দেখিয়ে
বন্দুকের পরিবর্তে গান বানাতে থাকি
গানের শব্দে, বন ছেড়ে, একদিন
ওরা এসে আমার পাশে দাঁড়ায়
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ
সাপ আমাকে চোবল মারতে থাকে
আর শূকর ছিঁড়ে নিতে থাকে
আমার মাংস ও হাড়।
পুরাতন পৃথিবীতে নতুন মানুষ আসে
জানে না সে আসিয়াছে বুড়া পৃথিবীতে
দেখে কিছুই নতুন নয়
বৃদ্ধ বালিশ
দরজা
পুরাতন ইশকুল
বৃদ্ধ মাস্টর
মরণাপন্ন নদী
মাটিতে অনেক রক্ত
বাতাসে অনেক দীর্ঘশ্বাস
পানিতে বিষ
তার ভালো লাগে না
একদিন সে আকাশ দেখে
আর মনে হয়, পুরাতন পৃথিবীর উপর নতুন আকাশ
মেঘ দেখে, পুরাতন পৃথিবীর উপর নতুন মেঘ
মেঘের পাশে পাখি দেখে, নতুন পাখি
সবুজ গাছ দেখে তার মনে হয়
পুরাতন পৃথিবীতে নতুন গাছ
ঘাসরে নতুন লাগে
ধানরে নতুন লাগে
তার মনে হয়, পুরাতন পৃথিবীতে সে একা না
ভাবে, পৃথিবীরে নতুন করতেই এসেছে সে
যেভাবে বৃষ্টি আসে, মেঘ ওড়ে, ফুল ফোটে
একটা প্রেমের কবিতার মতো
সাপ হয়ে যাই
আর চোবল মারি তোমার হাতে
তুমিও বিড়াল হও
আর কামড়াও আমার ঘাড়ে
কোনো কোনো রাতে এমন ঘটনা ঘটে
মানুষের বাড়িতে
আকাশে তখন তারা থাকে কি থাকে না
ঘুমন্ত মানুষের জানবার কথা না
তবে অমর আকাশ থাকে
আর দেখে
ভালোবাসার বিনিময়ে
মানুষের ছেলে ও মেয়ে
সাপ ও বিড়াল হয়ে মৃত্যু-মৃত্যু খেলে
যাতে সকালে
জীবিত মানুষেরা দেখে
দুইটা কবরের অপেক্ষায়
দ্বিখণ্ডিত একটা প্রেমের কবিতার মতো
পড়ে আছে দুইজন নর ও নারী
সম্পর্ক
গাছের সাথে ফুলের
আর মায়ের সাথে সন্তানের
সম্পর্ক ছাড়া
আর সবই ব্যবহারের সম্পর্ক
আর ব্যবহার মানেই সহিংসতা
জুতার সাথে পায়ের
মাটির সাথে লাঙলের
গাছের সাথে কুড়ালের
স্ত্রীর সাথে স্বামীর
ছাত্রের সাথে শিক্ষকের
হিংস্র সম্পর্কই সত্য
ফুলের ব্যবহার মানে
গাছের গর্ভ থেকে ছিঁড়ে আনা ফুল
মানুষের ব্যবহার মানে
মায়ের গর্ভ থেকে ছিঁড়ে আনা সন্তান
যেখানেই সে পা রাখে, কবর
যেখানেই মাথা রাখে, গিলোটিন
যেখানেই হাত রাখে, আগুন
অতএব হে মানুষ, হে ফুল,
মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা মানে মুক্তি নয়
শিকারি বেষ্টিত বনে প্রবেশমাত্র
এখানে সম্পর্কের স্বপ্ন ছেড়ে
নিহত হবার জন্য উদগ্রীব হও
তোমার রক্তাক্ত মৃত্যুর ছবি—
পৃথিবীর পিকাসোর চিত্রের ইতিহাস
মায়ের অশ্রুর নহর
আর তোমার মুক্তির দাউদাউ
সোনালি দলিল।
কবি ও অনুবাদক। জন্ম ৬ জানুয়ারি ১৯৭৮। কটারকোনো, মনু, কুলাউড়া, মৌলভীবাজার। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি ও লোকপ্রশাসনে স্নাতকোত্তর। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ : কবিতা : অন্ধ পৃথিবীর জানলাগুলি, নদীমাতৃক পৃথিবী মেঘমাতৃক আকাশ, প্রেগন্যান্ট পাগলি ও অন্যান্য কবিতা। অনুবাদ : চূর্ণচিন্তন, দূরাগত স্বর, আর্থার শোপেন হাওয়ারের কথাগুলি প্রবন্ধ : আধুনিক কবিতা বিষাদবৃক্ষের ফুল ও অন্যান্য প্রবন্ধ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস : এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে। ই-মেইল : imdadmra@gmail.com