‘কথারা কোথায় থাকে’—এই উক্তি মাথায় নিয়ে ঘুরতে ঘুরতেই সময় পেরিয়ে যায়। সময় কোন গহ্বরে যে হারিয়ে যায় তা বলা মুশকিল। তারা আর ফিরে আসে না। আসা ও না আসার দোলাচলে অনেক কথারা এসে ভিড় করছে গলা অবধি। কোন কথাটি আগে বেরিয়ে আসবে তা নিয়ে লেগেছে ঠেলাঠেলি। ঠেলাঠেলির চোটে কথারা জট পাকিয়ে ফেলছে। ফলে কোনো কথাই আর বেরিয়ে আসছে না। গলা অবধি এসে আবার তারা ফিরে যাচ্ছে। কথারা কোথায় ফিরছে? এরও হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে কি কথারা কোথাও ফিরে গোল হয়ে গল্প করছে? দেশের রাজনীতি, কূটনীতি কিংবা অর্থনীতি নিয়ে আলাপ জুড়েছে। নাকি হিরো আলম কেন হেরে গেল তা নিয়ে তর্ক করছে। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কথা কি কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে? এর উত্তর কে দেবে? তাকেই খুঁজতে খুঁজতে সময় বয়ে গেল। কথারা এলো না।
নদীর কিনার ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছে অসংখ্য কথারা ছোটো ছোটো ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে। কচুরিপানার ফাঁকফোঁকর দিয়ে তারা বেরিয়ে যাচ্ছে অনন্ত জলের চিরডেরায়। তাদের গল্পগুলো, তাদের সুখদুঃখগুলো পৃথিবীর আলোবাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। মানব শিরা-উপশিরায় তারা সেঁধিয়ে গিয়ে জন্ম দিচ্ছে একেকটি নতুন গল্পের। যন্ত্রের স্ক্রিনে কিংবা শাদাপাতায় তারা বসতি গড়ছে। মানুষের মতো তারা ভিড়ভাট্টা ঠেলে চলাফেরা করছে। কথা বলছে। সেই কথার কি কোনো শব্দ আছে? যদি থাকে তাহলে শব্দ সে কোথায় পায়? আর ভাষা? ভাষা তাকে কে দান করে? এতকিছু ভাবতে ভাবতেই সময় পালিয়ে যায়। আর ফিরে আসে না। গল্পগুলো কেবল কথা হিসেবেই রয়ে যায়।
অতিমারির সেই দিনগুলো আমরা ভুলতে বসেছি। সেই ভয় ভয় দূরত্বের মাসগুলো, বছর বছর করে পিছে পড়ে গেল। মানুষ আবার তার গতির দুনিয়ায় ফিরে এসেছে। আমার কথারা বাইরে বেরোবার প্রস্তুতি নিয়েছে। ঠেলাঠেলি দলাদলি করে যারা জয়ী হয়েছে, তারাই কেবল গল্পরূপে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। একটা জীবন বহু বহু গল্পের ভাঁড়ার। অনেক ঘট ও ঘটনার সাক্ষী তার চোখ। কোটি কোটি শব্দের ছাঁকনি তার কান। ভাষার বাহন তার মুখ। ভেতরে ভেতরে চলেছে নানান আস্কারা, কথাগুলো গল্পের পিঠে বসিয়ে দেবার উসকানি। কী রূপে তারা প্রকাশিত হতে চায়, তা নিয়ে ঘটছে হাজারো হয়রানি।
একটা গল্পের প্লট নিয়ে ভাবতে ভাবতে মাসের পর মাস চলে গেছে। একটা শব্দও লেখা হয়ে ওঠেনি। যা লিখতে চাই তার প্রাথমিক একটা খসড়া মাথায় মধ্যে জমাট বাঁধতে থাকে। কেবল লেখার শুরুটা করতে পারলেই আর চিন্তা করা লাগে না।
গল্প কীভাবে লিখি? কোনো গল্পই আমি এক বসায় লিখে উঠতে পারি না। একটা গল্পের প্লট নিয়ে ভাবতে ভাবতে মাসের পর মাস চলে গেছে। একটা শব্দও লেখা হয়ে ওঠেনি। যা লিখতে চাই তার প্রাথমিক একটা খসড়া মাথায় মধ্যে জমাট বাঁধতে থাকে। কেবল লেখার শুরুটা করতে পারলেই আর চিন্তা করা লাগে না। গল্পটা নিজেই তার চরিত্রগুলো হাজির করে। আমি লিখি। কয়েক লাইন লিখেই থামি। দেখি আমি আর গল্পটা লিখছি না। গল্পের চরিত্রকে বামে হাঁটতে বললে সে শোনে না। সে তার নিজের পথ নির্মাণ করে। মাথার মধ্যে জড়ো হওয়া খসড়া আর কাজে লাগে না। দৃশ্যের পর দৃশ্য আর থাকে না। চরিত্ররা স্বাধীনভাবে চলে। ঘটনার খোলস পালটে তারা ভিন্ন এক ভাষাবলয়ের আশ্রয়ে নিজেদের চালান করে। আমার কিছুই করার থাকে না। কেবল অনুবাদক হিসেবে তাদের ভাষান্তর করি।
বছর দেড়েক হলো একটা গল্পের প্লট নিয়ে ভেবেই চলেছি। চরিত্রগুলো আমার মধ্যে চলাফেরা করছে। কিছুতেই তারা বাইরে আসতে চাইছে না। আমিও নাছোড়ের মতো তাদের ধরার চেষ্টায় নানা ফন্দিফিকির করছি। কিছুতেই বাগে আসছে না। লেখার টেবিলে বসে বসে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। মাঝেমধ্যে উটপাখির মতো টেবিলে মুখ গুঁজে থাকি। চরিত্ররা প্রসন্ন হয় না। তারা তখনই বাইরে বেরোবে যখন তাদের মর্জি। একজন লেখক হিসেবে আমার কী করার আছে? তাদের কি টেনেহিঁচড়ে খাতায় বসিয়ে দেবো? তা আমি পারি না। পারতে চাইও না। অপেক্ষা করা ছাড়া আমার আর গতি আছে বলে মনে হয় না।
শৈশবে দেখা কছিম পাগল কিংবা মিনা পাগলি যখন আমার গল্পে চলাচল করে তখন নিজেই অবাক হই। তারা কোথায় ছিল এত দিন? কোন গুপ্তকূপে লুকিয়ে ছিল তারা? ত্রিশ বছর আগের চরিত্ররা ভিড় করছে আমার লেখার মধ্যে। বুঝতে অসুবিধা হয় না এ আমার অভিজ্ঞতার ফসল। স্মৃতির নদী থেকে উঠে আসা জল। জীবনে চলার পথে হাজারো চরিত্রের সঙ্গে আমাদের মোলাকাত হয়। আড্ডা, হই-হুল্লোড়, চিন্তার আদান-প্রদান প্রতিনিয়ত ঘটেই চলে। কতটুকু ধরে রাখে আমাদের স্মৃতি? অনেক আগের বন্ধুর চেহারাও মনে আসে না। কিন্তু দেখা যায় সেই ব্যক্তি বহুকাল পরে মুখোমুখি হলে হারানো স্মৃতিগুলো আয়না হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। তারমানে কোনো কিছুই আমাদের স্মৃতিযন্ত্র মুছে ফেলে না। কেবল স্মৃতির পর স্মৃতির আস্তর জমে আবছা হয়ে যায়। জীবনের বাঁক পেরোনো অভিজ্ঞতারাশি আমার চরিত্র নির্মাণে সাহায্য করে।
অভিজ্ঞতাই কি গল্প? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি। সব চরিত্ররা কিন্তু একঘরে বসবাস করে না। তাদের চলনবলন ভিন্ন, কথা বলার ভঙ্গীও আলাদা। খণ্ড খণ্ড অভিজ্ঞতা একেকটা মেজাজ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গল্পে উপস্থিত থাকে। নিজের পর্যবেক্ষণ ও কল্পনার মিশেলে স্মৃতিকথা ও পারিপার্শ্বিক দৃশ্যপ্রবাহ একটা গল্প গড়ে উঠতে সাহায্য করে। গল্পের বিষয় যাইই হোক না কেন তা অন্য কোনো গ্রহ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে না। তা মানবজীবনেরই প্রতিচ্ছবি। আমাদের দেখা, ভাবা ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ফসল। মানুষের জমে থাকা কথাগুলো ভাষার বাহনে প্রকাশিত হয়।
গদ্যে আমার বরাবরই ভীতি। কবিতার সঙ্গে গড়েছি ঘরবসতি। তবে গদ্য লিখব—এমন ভাবনা সব সময় ভেতরে ভেতরে কাজ করেছে। যা হয়তো অনেক দেরিতে হলেও আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে। আমি নিজেই অবাক হচ্ছি। সেই ভীতি মনে হয় কাটতে শুরু করেছে। আগে ভাবতাম, যা আমি লিখব সেই কথারা কোথা থেকে আসবে? আমার কাছে তো কোনো কথার কুয়ো নেই, যেখান থেকে বালতি বালতি কথা তুলে লিখে ফেলব কোনো গদ্যের বই। গদ্য লেখার জন্য সবচেয়ে বেশি কাজে লেগেছে আমার ভ্রমণ, পাঠ ও অভিজ্ঞতা। আরেকটি বিষয় আমার নজরে এসেছে, তা হলো লেখার ধৈর্য। একজন লেখককে হতে হবে প্রখর ধৈর্যশক্তির অধিকারী। কারণ গদ্যলেখা শ্রমসাধ্য কাজ। তাই এখানে ধৈর্যের পরীক্ষা বেশি। যেহেতু স্বেচ্ছায় পরীক্ষায় বসেছি, পাশ আমাকে করতেই হবে।
একবার এক গল্প লিখতে গিয়ে বেশ হোঁচট খেয়েছিলাম। দশ লাইন লেখার পর আর লিখতে পারছি না। পর পর কয়েক দিন টেবিলে বসেও লেখাটির দশটি লাইনও লিখতে পারিনি। পরে সেই লেখা রেখে দিয়েছিলাম। বেশ কয়েক মাস পর দেখি আরও বিশ-ত্রিশ লাইন লেখাটি এগোলো। কিন্তু আর সে এগোতে চায় না। সাধারণত লিখতে বসলে আমার এমনটা কখনো হয় না। কোনো গল্প লিখতে শুরু করলে তা মাস তিনেকের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। কখনো কখনো এর চেয়ে কম সময়েও লেখা শেষ করেছি। কিন্তু সেই গল্পটি শেষ করতে সময় লেগেছিল তেরো মাসের মতো। গল্প শেষ হবার সপ্তাহ দেড়েক পরে ঘটল আরেক ঘটনা। গল্পে যে জায়গার বর্ণনা আমি দিয়েছি এবং যে ঘটনা লিখেছি, হুবহু সেই ঘটনাই ঘটল সেখানে। আমি কিছুতেই এই সূত্রের হদিস বের করতে পারলাম না। এই টেলিপ্যাথির কোনো ব্যাখ্যা আমার কাছে হাজির হলো না। কল্পনায় নির্মিত চরিত্র বাস্তবে নিজের জানান দিল। কথা বলে উঠল। নিজেকেই নিজে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো।
লেখার সময় আমি সব ইন্দ্রিয়ের বাতায়ন খোলা রাখি। কথারা এসে ভিড় জমালে লিখতে শুরু করি মনের জার্নাল, দেহের জার্নি। এ জার্নি আমাকে নিয়ে যায় ভিন্ন মোহিনীভুবনে। যেখানে নতুন নতুন কথারা কথা বলাবলি করে। যেখানে একজন মেরাজুল ‘চিচিংফাঁক…কাঁঠালপাক’ বলে হাঁক দিয়ে ওঠে।
লেখার সময় আমি সব ইন্দ্রিয়ের বাতায়ন খোলা রাখি। কথারা এসে ভিড় জমালে লিখতে শুরু করি মনের জার্নাল, দেহের জার্নি। এ জার্নি আমাকে নিয়ে যায় ভিন্ন মোহিনীভুবনে। যেখানে নতুন নতুন কথারা কথা বলাবলি করে। যেখানে একজন মেরাজুল ‘চিচিংফাঁক…কাঁঠালপাক’ বলে হাঁক দিয়ে ওঠে। যেখানে শিমুলতলার শিমুলের ঘরের টিনে লাল লাল শিমুলফুল পড়ে। যেখানে সনেকার স্বামী গফুরের রিকশা আটকে যায় রেললাইনে। যেখানে আবুল কাশেমের স্ত্রী মরিয়ম জীবিত থেকেও মৃত হয়ে যায়। যেখানে রেজাউল ফরাজীর আত্মা সাইকেল চালিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়। যেখানে চন্দন বৈশ্যের আলোবিপণি তারামণ্ডলীতে স্থান করে নেয়। যেখানে একজন আবদুল করিমের জীবন থেকেও হয় অকূল অঙ্গহারা। যেখানে স্যামুয়েল বাসকে কোনো বিচার পায় না। যেখানে একজন গুলবার আলির শুরু হয় ভাতবাহিত নড়াচড়া। যেখানে একজন করিমনকে ভুট্টা পোড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও পোড়াতে হয়। যেখানে জবা ও ঘ্রাণের কুসুম ফোটে না। যেখানে একজন আফরোজার তলপেটতে শিরশিরানি শুরু হয়। যেখানে অন্ধকার কুণ্ডলীর মধ্যে কেউ কাউকে খুঁজে পায় না। যেখানে কথারা থামতেই চায় না।
কথার পিঠে কথারা আসে, কোথায় থাকে? কেউ জানে না। হয়তো সকলেই জানে, কেউ বলে না। সান্ধ্য আলোয় কথারা ঝাঁক বেঁধে আসে। মাংসের দোকানে গোল হয়ে বসে। কথা বলে। চিৎকার করে। রাত গভীর হলে তারা কোথায় উধাও হয়, কেউ জানে না। একজন লেখকের সাধনা সেই হারানো কথাগুলো ডেকে আনে। মানুষের কথা ফের মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেয়। পৃথিবীর আলো-বাতাস ও প্রাণের কাছে তার ঋণ রয়ে যায়। তার আয়ুক্ষয় ও রক্তক্ষরণের দাগ কোথাও থাকে না। কথারা কেবল তার চোখ চেপে ধরে। ভাষা সৌন্দর্য তৈরি করে। কথা আসে, চলে যায়। লেখকের নিয়তি ঝুলে থাকে কথার কুহকবাগানে।
কবিতা ও গল্প লেখেন। লেখালেখির ঝাউবাংলোয় মগ্ন থাকাই তার আরাধ্য। জন্ম ও বেড়েওঠা পদ্মাপারের রাজশাহীতে। জীবন-নির্বাহের জন্য কাজ করেন গণমাধ্যমে। ‘ধানের ধাত্রী’ কবিতাগ্রন্থের জন্য ২০১৫ সালে কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার এবং ২০১৭ সালে ‘ডুমুরের আয়ু’ গ্রন্থের জন্য বিশাল বাংলা সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। তার প্রকাশিত গল্পের বই ‘সান্ধ্য মাংসের দোকান’।