১.
দুপুরের একটু পর পর ভিডিও কলটা এলো। লাঞ্চের পর নিজের চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছিলাম। ডেস্কের উপরে রাখা ল্যাপটপের আইডল স্ক্রিনটা হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠল। কলটা এসছে স্কাইপে। মুম্বাই থেকে সোমশ্রী স্বরাজ। সোমশ্রীদি ওখানকার একটা এনজিওর অপারেশনাল হেড। নিশ্চয় নতুন কোনো ভিকটিম উদ্ধারের কেস। অথবা পুরোনো কোনো কেসের ফলো-আপের জন্য করেছে। আমি হেডফোনটা কানে লাগিয়ে কলটা রিসিভ করলাম।
দিদি নমস্তে।
নমস্তে। হাউ আর ইউ রাসেল?
বাকী কথাটা হিন্দিতে বললেন দিদি।
মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে, বংলাদেশী। কিন্তু কিছুতেই স্বীকার করছে না। নির্ভুল হিন্দিতে কথা বলছে। বলছে ইন্ডিয়ান। কিন্তু আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ও বাংলাদেশ থেকেই এসেছে। তুমি বাংলাদেশী জানলে তোমার কাছে সে সত্যি কথাটা স্বীকার করতে পারে। কথা বলবে?
আজ একটা মেয়েকে আমরা মুম্বাই পুলিশের সহযোগিতায় রেড-লাইট এলাকা থেকে উদ্ধার করেছি। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে, বংলাদেশী। কিন্তু কিছুতেই স্বীকার করছে না। নির্ভুল হিন্দিতে কথা বলছে। বলছে ইন্ডিয়ান। কিন্তু আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ও বাংলাদেশ থেকেই এসেছে। তুমি বাংলাদেশী জানলে তোমার কাছে সে সত্যি কথাটা স্বীকার করতে পারে। কথা বলবে?
আমি বললাম, ওকে লাইনটা দিন দিদি। আমি দেখছি।
ওকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রী ভেসে উঠল স্ক্রিনে। মায়াবী দুটো চোখ। কেন জানি না—যা কোনোদিন ঘটেনি তাই আজ ঘটল—আমার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। আমি জানি না চোখে জাতীয়তা লেখা থাকে কি না। কিন্তু আমার মন বলছে ও বাংলাদেশের মেয়ে।
তুম ইন্ডিয়ান? আমি আলতে করে হেসে জিজ্ঞেস করলাম। মেয়েটা উত্তরে বলল, হুমম।
এবার আমি বিশুদ্ধ বাংলাতে বললাম, ঠিক বলছ না। তুমি বাংলাদেশের মেয়ে। শোন আমি যশোর থেকে কথা বলছি। আমার নাম রাসেল। আমি একটা এনজিওতে কাজ করি। আমার এনজিও তোমার মতো যারা মানব পাচারের শিকার হয়ে ইন্ডিয়াতে চলে যায় তাদের দেশে ফেরত আনে। তোমাকে ফেরত আনার জন্য যা যা করা দরকার, তা আমরা করব। তোমার কোনো ভয় নেই। আমরা তোমার বন্ধু। ওই যে দিদি, সোমশ্রী দিদি—যাদের হোমে তুমি এখন আছো, উনি খুব ভালো মানুষ। মায়ের মতো। তোমার কোনো ক্ষতি হবে না ওখানে। কিন্তু দেশে ফিরে আসতে হলে তোমাকে সহযোগিতা করতে হবে। তুমি তোমার নাম ঠিকানা সত্যি সত্যি না বললে আমরা তোমার বাড়ি, আত্মীয়-স্বজনকে খুঁজে বের করব কীভাবে?
কাজ হলো। মেয়েটার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা বেরিয়ে এলো। আর চিবুক বেয়ে টপ টপ করে পড়তে শুরু করল নিচে। ধরা গলায় পরিষ্কার বাংলাতে বলল, আপনি আমাকে বাঁচাবেন?
আমি দৃঢ় কণ্ঠে বললাম, হ্যাঁ বাঁচাব।
কেন এত দৃঢ়কণ্ঠে বললাম? আমি এ পর্যন্ত অনেকগুলো মানব পাচারের ভিকটিম নিয়ে কাজ করেছি। সবার ক্ষেত্রে বলেছি, সাধ্যমতো চেষ্টা করব। কিন্তু এই মেয়েটির বেলায় আমার কী হলো? আমি তাকে বাঁচাব বলে কথা দিয়ে ফেললাম। কেন? ভেতর থেকে কোনো উত্তর পেলাম না।
তোমার নামটা বলবে?
জয়া।
এটা তোমার আসল নাম মনে হচ্ছে না। আসল নামটা বল। তোমার নাগরিকত্ব যাচাই করার জন্য লাগবে।
মেয়েটা দৃঢ়তার সাথে বলল, এটা আমার আসল নাম। আমরা মা আমাকে এই নামে ডাকে। পুরো নাম জাকিয়া সুলতানা জয়া।
আমি বললাম, ঠিক আছে। একদম ভয় পাবে না জয়া। আমরা তোমার সাথে আছি। তোমাকে দেশে ফেরত আনতে কয়েকটা দিন সময় লাগবে। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। আর সোমশ্রীদির কথামতো কাজ করবে। ঠিক আছে?
মেয়েটি ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিল।
একটুপর সোমশ্রীদি স্ক্রিনে এলে আমি বললাম, ইউ আর রাইট দিদি। সি ইজ বাংলাদেশী। হার নেম ইজ জাকিয়া সুলতানা জয়া। নাউ ইউ ক্যান আস্ক ইউর সাইকোস্যোসাল কাউন্সেলর টু কালেক্ট হার স্টোরি অব ট্রাফিকিং অ্যান্ড আইডেন্টিটি ডিটেইল্স। বেজ্ড অন ইউর কেইস ডিটেইল্স উই উইল কনডাক্ট হোম ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড টেক ফারদার অ্যাকশন টু রিপ্যাট্রিয়েট হার। থ্যাঙ্কস দিদি ফর ইউর হার্ডওয়ার্ক।
২.
পরদিনই ইমেইলে জয়ার কেস ডিটেইলস এসে গেল। সোমশ্রীদি ত্বরিত কাজ করতে পছন্দ করেন। একবার আমাদের সংস্থা ভিজিট করতে এসেছিলেন। এমন অমায়িক মানুষ আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। অমন বড়ো একটা অল-ইন্ডিয়ান সংস্থার অপারেশনাল হেড, কিন্তু কী সাধারণ! মমতা ব্যানার্জি স্টাইলে শাড়ি পড়েন, নো মেকাপ। কাজ করেন মানব পাচারের শিকার নারী ও শিশুদের নিয়ে; তাদের উদ্ধার করা, প্রত্যাবাসন করা, পুনর্বাসন করা এইসব। এন্টি-ট্রাফিকিং সেক্টরে দিদিদের সংস্থাকে বলা হয় ডেস্টিনেশন অর্গনাইজেশন, অর্থাৎ পাচার হয়ে যে জায়গাগুলোতে ভিকটিমরা চলে যায় সেই জায়গাগুলোতে এরা কাজ করে। অন্যদিকে, আমরা হচ্ছি সোর্স অর্গানাইজেশন, অর্থাৎ যে জায়গাগুলো থেকে সাধারণত মেয়েদের সংগ্রহ করা হয়—সে জায়গাগুলোতে কাজ করা অর্গানাইজেশন।
জয়ার কেস ডিটেইলস দেখলাম।… বয়স ২২। বাড়ি বরিশাল জেলার পান্তাডাঙ্গা গ্রামে। ‘পান্তাডাঙ্গা’ নামটা আমার মাথায় স্ট্রাইক করল। কেন? এই নামটা আমি কোথায় শুনেছি? মনে করতে পারছি না, তবে শুনেছি।
৯ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে, দারিদ্র্যের কারণে আর পড়ালেখা এগোয়নি। বাবা নেই। মা শরিফা খাতুন। সংসারে আর কেউ নেই। ভালোবেসেছিল পাশের গ্রামের আরজ আলীকে। মা তার ভালোবাসাকে মেনে নিতে পারেনি। আরজ আলীকে মা ঘৃণা করত। দু’বছর আগে এক রাতে তাই আরজের হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে সে। ফরিদপুরে আরজের এক আত্মীয়ের বাসায় তাদের বিয়ে হয়। তারপর তারা আনন্দ-ভ্রমণে বের হয়। চোরাপথে যশোরের চৌগাছা সীমান্ত পার হয়ে সোজা কোলকাতা। তারপর মুম্বাই। মুম্বাইতে আরজের কে এক আত্মীয় নাকি থাকে, সে ওদের দুজনকে কাজের ব্যবস্থা করে দেবে। দেশে না ফিরলেও চলে। ওখানে বাতাসে টাকা ওড়ে। শান-শওকতের কোনো অভাব হবে না। মুম্বাইতে সেই আত্মীয়ের বাসায় ওঠে ওরা। আত্মীয়ের নাম সেলিম ভাই। ফর্সা, সুপুরুষ, মুখে চাপ দাড়ি। লোকটাকে খারাপ লাগে না জয়ার। আরজ তাকে বলে, তুমি সেলিম ভাইয়ের সাথে গল্প কর, আমি কিছু খাবার নিয়ে আসছি। জয়া রাজি হয়।
মুম্বাইতে সেই আত্মীয়ের বাসায় ওঠে ওরা। আত্মীয়ের নাম সেলিম ভাই। ফর্সা, সুপুরুষ, মুখে চাপ দাড়ি। লোকটাকে খারাপ লাগে না জয়ার। আরজ তাকে বলে, তুমি সেলিম ভাইয়ের সাথে গল্প কর, আমি কিছু খাবার নিয়ে আসছি। জয়া রাজি হয়।
আরজ চলে গেলে সেলিম ভাই তাকে সরাসরি বলে, আমি আসলে আরজের কেউ হই না। আরজ আসলে তোমাকে আমার কাছে বিক্রি করে চলে গেছে। ও আর কোনোদিন ফিরে আসবে না।
…তারপর ক্যাপটিভ জীবন। অমানুষিক নির্যাতন। খরিদ্দারদের এন্টারটেইন করতে বাধ্য হওয়া। জয়া বুঝতে পারে তার সব স্বপ্নের কবর হয়ে গেছে। ভুল মানুষকে ভালোবেসে ভুল জীবনে এসে পড়েছে সে। দুবছর পর সোমশ্রীদির অর্গানাইজেশনের স্যোসাল ওয়ার্কাররা কাস্টমার সেজে পুলিশের সহযোগিতায় তাকে উদ্ধার করে।
…ঘটনায় কোনো বিশেষত্ব নেই। স্বামী স্ত্রীকে ভারতে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে বেচে দিয়ে এসেছে, এটা এখন খুব সাধারণ ঘটনা। শতকরা ২০ ভাগ মানব পাচারের ক্ষেত্রে স্বামীর জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু ‘পান্তাডাঙ্গা’ শব্দটা আমার মধ্যে খাবি খাচ্ছে, মগজের মধ্যে ডুব-সাঁতার খেলছে। কেন এত চেনা এই শব্দটা? কোথায় শুনেছি? অথবা কোনো এক সুদূর অতীতে আমি কি সেই গ্রামে ছিলাম? বাংলাদেশের সব গ্রামের নাম শুনলেই তো চেনা চেনা লাগে। লাগবেই তো। এজন্যেই তো বলা হয় গ্রামবাংলা। কিন্তু পান্তাডাঙ্গা আমার রক্তে একটা ঘূর্ণি তৈরি করেছে।
যেহেতু আমি এই প্রকল্পটার টিম লিডার, তাই আর দেরি না করে আমার একজন ইনভেস্টিশন অফিসারকে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে দিলাম। কালই সে পান্তাডাঙ্গা যাবে। দেখা করবে জয়ার মা শরীফা বেগমের সাথে। সমস্ত প্রয়োজনীয় তথ্য এবং কাগজপত্র সংগ্রহ করবে। মেয়েটাকে আমি বাঁচাব বলে কথা দিয়েছি। প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া যত দ্রুত সম্ভব শুরু করা দরকার।
৩.
দুদিন পর আমি হোম ইনভেস্টিগেশনের রিপোর্ট পেলাম।
সোমশ্রীদিদের করা কেস স্টোরির সাথে খুব বেশি বৈসাদৃশ্য নেই। তবে শরিফা বেগম জানেন না যে তার মেয়ের ভাগ্যে কী ঘটেছিল। এক রাতে সে উধাও হয়ে গিয়েছিল, সকালে উঠে তাকে আর কোথাও পাওয়া যায়নি। এটুকুই। তবে তার বা গ্রামবাসীর ধারণা আরজ আলীই তাকে পাচার করে দিয়েছে। দুয়ে দুয়ে চার করে নিলেই হয়।
তবে জয়া যে ওদের কাছে বলেছিল, শরিফা বেগম তার মা, সেটা ঠিক না। শরিফা বেগম তার বড়ো খালা। তবে খালা হলেও মায়ের চেয়ে কম নয়। জয়ার বয়স যখন ২ মাসও পুরো হয়নি, তখন একদিন এক সড়ক দুর্ঘটনায় ওর বাবা-মা দুজনেই মারা যান। শরিফা বেগম নিঃসন্তান ছিলেন। ১৯৭১ সালে তার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের কয়েক মাস যেতে না যেতেই স্বামী মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এবং নিখোঁজ হয়ে যান। স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায় স্বামীর ভিটেতেই অপেক্ষা করতে থাকেন। দীর্ঘ অপেক্ষা। শরিফা বেগমের স্বামী পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান ছিলেন। এক সময় শ্বশুর মারা যান, তারপর শাশুড়ি মারা যান। একা হয়ে যান শরিফা বেগম। তবু ভিটে আঁকড়ে পড়ে থাকেন।
অপেক্ষাময় একটা জীবন। স্বামী ফিরে আসার অপেক্ষা।
১৯৯৮ সালে জয়ার বাবা-মা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর শরিফা বেগম জয়াকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। তখন ওর নাম ছিল জাকিয়া সুলতানা। শরিফা বেগম নামের সাথে জয়া জুড়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধের আবেগ থেকে। তার স্বামীর মতো অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধারাই তো দেশের স্বাধীনতা এনেছিল। বিজয় এনেছিল। জয়া জুড়ে দিয়ে আসলে জাকিয়া সুলতানাকে শরিফা বেগম আপন সন্তানের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। অপেক্ষার একঘেয়ে কলকল ধ্বনির মধ্যে জয়া এক ভিন্ন সুর।
ভিন্ন আবেগ।
সংস্থার ইনভেস্টিশন অফিসারের নাম নিখিল। আমি তাকে কয়েকটি প্রশ্ন করলাম। নিজস্ব কৌতূহল থেকে।
শরিফা বেগম এখন কী করেন?
কিছুই না ভাই। চরম দুর্দশাগ্রস্ত। গ্রামের মানুষের দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর বেঁচে আছেন। হার্টের সমস্যায় ভুগছেন। বয়সও তো মেলা। চলাফেরা প্রায় করতেই পারেন না।
আগে কী করতেন? মানে সংসার চলত কীভাবে?
বিভিন্ন কাজ করতেন। মাটি কাটা, কৃষাণ দেওয়া, কখনও বাড়িতে বাড়িতে কাজ করা এইসব আর কি।
এলাকার চেয়ারম্যানের সাথে আপনার দেখা হয়েছে? আমার প্রশ্ন।
হয়েছে ভাই। নিখিলের উত্তর। উনিই তো জয়ার নাগরিকত্বের সনদ দিলেন। ভালো মানুষ বলেই মনে হলো।
উনার কাছ থেকে কিছু জানতে পারলেন? মানে জয়ার পাচারের ব্যাপারে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ওই আরজ আলী নাকি খুবই দুষ্টু প্রকৃতির মানুষ। তার বাবা ওই এলাকার বিখ্যাত রাজাকার ছিলেন। অনেক আগেই মারা গেছেন। আরজ আলী নাকি এহেন খারাপ কাজ নাই যা করে না। আমি মনে মনে বললাম, রাজাকারের ছেলে তো রাজাকারই হবে। নব্য রাজাকার। নিখিলকে প্রশ্ন করলাম, আরজ আলীর কোনো খবর করতে পারলেন?
বরিশাল শহরে তার বাড়ি আছে, ওখানেই থাকে বেশি। ওই ঘটনার পর শহরেও খুব একটা দেখা যায় না। ঢাকাতে কী সব কারবার-টারবার করে। চেয়ারম্যান আসগর আলীর সাথে তার একবার নাকি মাদারীপুরে দেখা হয়েছিল। আসগর আলী জিজ্ঞেস করেছিল, জয়াকে সে কোথায় পাচার করেছে?
নিখিল উত্তর দিল, গত ক’বছর ধরে সে গ্রামে খুব একটা থাকে না। বরিশাল শহরে তার বাড়ি আছে, ওখানেই থাকে বেশি। ওই ঘটনার পর শহরেও খুব একটা দেখা যায় না। ঢাকাতে কী সব কারবার-টারবার করে। চেয়ারম্যান আসগর আলীর সাথে তার একবার নাকি মাদারীপুরে দেখা হয়েছিল। আসগর আলী জিজ্ঞেস করেছিল, জয়াকে সে কোথায় পাচার করেছে? উত্তরে নাকি সে সাফ জানিয়ে দিয়েছে এ ব্যাপারে সে কিছুই জানে না।
পান্তাডাঙ্গা গ্রামটি কেমন?
থানা সদরের নিকটবর্তী গ্রাম। অনেক মানুষের কাছেই মোবাইল ফোন দেখা গেছে। ধনী-গরিব মিলিয়ে বসবাস।
গ্রামের কোনো বিশেষত্ব?
না কোনো বিশেষত্ব নাই। আর দশটা গ্রামের মতোই সাধারণ।
আমি মনে মনে বললাম, তবে পান্তাডাঙ্গা আমার মগজে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে কেন? গ্রামটি কি মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে সিগনিফিকেন্ট কোনো গ্রাম? মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা কোনো বইয়ে পড়েছি এই নাম? কিছুতেই মনে করতে পারছি না।
যাক গে। আমি দ্রুত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এন্টি-ট্রাফিকিং টাস্ক ফোর্স বরাবর জয়ার প্রত্যাবাসনের জন্য আবেদন করে দিলাম।
৪.
এটা একটা ইতিহাস।
মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে প্রত্যাবাসনের আদেশপত্রসহ জয়াকে মুম্বাই থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলো। প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত জটিল। কিন্তু সব মহলের ত্বরিত কর্মতৎপরতায় প্রায় অসাধ্য সাধিত হলো। সিকিউরিটি ব্রাঞ্চ থেকে ৫ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া হলো। ১০ দিনের মাথায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রিপ্যাট্রিয়েশনের অর্ডার হাতে পেয়ে গেলাম। অর্ডারের একটা কপি চলে গেল দিল্লীস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে।
সোমশ্রীদিরাও অত্যন্ত দ্রুত গতিতে মুম্বাই কোর্ট থেকে জয়াকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর বদলে মানব পাচারের ভিকটিম হিসেবে প্রমাণ করে স্বদেশে প্রত্যাবাসন করার রায় বের করে ফেলল।
১৫ দিনের মাথায় বেনাপোল বর্ডারে আমাদের সংস্থার পক্ষ থেকে হস্তান্তরনামায় স্বাক্ষর করে জয়াকে নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নিলাম। জয়াকে হস্তান্তরের সময় বেনাপোলের নো-ম্যানস ল্যান্ডে হাজির ছিলেন দুদেশের অনেক কুশীলব। ও পক্ষে সোমশ্রীদিসহ ডেস্টিনেশন অর্গানাইজেশনের ৩/৪ জন প্রতিনিধি, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ, ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তা এবং বিএসএফ কর্মকর্তা। এ পক্ষে আমাদের অর্গানাইজেশনের আমরা ৪ জন, ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তা, বন্দর থানার পুলিশ কর্মকর্তা এবং বিজিবি কর্মকর্তা।
আমি সশরীরে দেখলাম জয়াকে। একটা বিষণ্ন পদ্মফুল যেন ফুটে আছে সীমান্তে।
ওর সৌন্দর্যে ইন্দো-বাংলাদেশ সীমানারেখা ঝলমল করে উঠল। কী স্মার্ট এক উপস্থিতি! কে বলবে মাত্র নাইন পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। আমি জানি না মুম্বাইয়ের জীবন—যদিও তা ছিল নিপীড়নমূলক, অন্ধকারাচ্ছন্ন—তবুও সেই জীবনই তাকে এ স্মার্টনেস দিয়েছে কি না।
আমি ওর দিকে স্থিরচোখে তাকাতে পারছিলাম না। আমার চোখ সরে যাচ্ছে। মন সরে যাচ্ছে। কোথায় কে জানে।
সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমরা গাড়িতে উঠলাম। আমি আড়চোখে তাকালাম, জয়ার বিষণ্নতা একটু একটু করে কাটছে। মেঘ সরছে। আমি মনে মনে বললাম, তুমি তো জয়া, বিষণ্নতাকে জয় কর, নতুন করে বাঁচতে হবে যে…
জয়া আমার দিকে ফিরে একটা আলতো হাসি দিয়ে বলল, আপনি রাসেল ভাই না?
আমি বললাম, চিনেছো তাহলে?
ভিডিওকলে আপনাকে দেখেই তো আমার ভয় কাটল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
গাড়ি চলছে যশোর শহরের দিকে। জয়া বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
যশোরে।
যশোরে কেন? আমি বাড়ি যাব না? আমাকে কি আবার শেল্টার হোমে থাকতে হবে? হোম আমার ভালো লাগে না। দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি বাড়ি যাব। মার কাছে যাব।
আমি বললাম, উনি তো তোমার মা নন। খালা।
কে বলেছে! উনিই আমার মা।
ও। তা এতই যখন ভালোবাসো, তাকে ফেলে চলে গিয়েছিলে কেন? আমি আলতো ধমকের সুরে বললাম। ও স্রাগ করে বলল, এই প্রশ্নের উত্তর আমিও তো পাই না।
আবার চুপচাপ।
আমাদের কাউন্সিলর আপা পাশ থেকে হঠাৎ জয়াকে বললেন, দেখ আমাদের একটা টেম্পোরারি হোম আছে। সেখানে তুমি দুদিন থাকবে। কিছু আনুষ্ঠানিকতা আছে। তারপর তোমাকে তোমার বাড়িতে রেখে আসব।
আচ্ছা, বলল জয়া। আচ্ছা, মাকে এখানে আনলেন না কেন আপনারা?
আমি উত্তর দিলাম, আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উনার শরীরটা ততটা ভালো নেই। আসলে তুমি দুবছর আগে যেমনটি রেখে গিয়েছিলে তেমনটি তো আর নেই। দুবছরে অনেক কিছু বদলে গেছে।
আবার বিষণ্ন হয়ে গেল জয়া।
আমার কী হলো জানি না, সমস্ত নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে প্রশ্ন করে বসলাম, আরজ আলী যে একটা খারাপ ছেলে তুমি জানতে না?
জানতাম।
তাহলে ওকে বিশ্বাস করলে কেন?
হঠাৎ চোখ তুলে আমার দিকে তাকল জয়া। সম্পূর্ণ উন্মীলিত চোখ। সেই চোখে এক আশ্চর্য কুহেলি। যা ভেদ করা যায় না। বলল, ভালোবাসা গো রাসেল ভাই।
তারপর চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিল সে।
আমি ভালোবাসায় পড়লাম। জয়ার। জীবনে এই প্রথম বার।
৫.
১ মার্চ ২০১৮। জয়াকে তার পরিবারে ফিরিয়ে দিতে আমরা গেলাম রাজৈর উপজেলার পান্তাডাঙ্গা গ্রামে। আমি খুব উৎসাহ নিয়ে গেলাম। আমার না গেলেও চলত। কিন্তু আমি গেলাম, কারণ পান্তাডাঙ্গা কেন আমাকে উতলা করল, অস্থির করল—তার রহস্য যদি ভেদ করা যায় এই আশায়। আরও একটা কারণ ছিল। জয়াকে কোথায় রেখে আসছি, সেটা নিজের চোখে একটু দেখে আসা।
উঠানে পা দিতেই জয়া মা মা বলে চিৎকার করে উঠল। শরিফা বেগম অনেক কষ্টে বিছানা থেকে উঠে আসলেন। এ মিলন জননী ও সন্তানের। এর মধ্যে কোনো খাদ নেই। কোনো কালিমা নেই। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছেন। অন্তহীন কান্না।
আমরা চেয়ারম্যান আসগর আলীকে সাথে করে এনেছি। তার আগে তাকে কাউন্সেলিং করানো হয়েছে, মোটিভেশন দেওয়া হয়েছে। বোঝানো হয়েছে, জয়া কোনো রেড লাইট এলাকাতে ছিল না। সেরকম জায়গায় পৌঁছানোর আগেই পুলিশ তাকে ধরে ফেলে। আমরা তাকে ফিরিয়ে এনেছি। এখানে তার কোনো দোষ ছিল না। সে একটা অপরাধের নির্মম শিকার। তাকে সমাজে ফিরিয়ে নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। সমাজের একজন নেতা হিসেবে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব তার। তাকেই তার নিরাপত্তা দিতে হবে। আর দশজনকে বোঝাতে হবে তারা যেন জয়াকে হেনস্থা না করে ইত্যাদি।
এখানে তার কোনো দোষ ছিল না। সে একটা অপরাধের নির্মম শিকার। তাকে সমাজে ফিরিয়ে নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। সমাজের একজন নেতা হিসেবে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব তার। তাকেই তার নিরাপত্তা দিতে হবে। আর দশজনকে বোঝাতে হবে তারা যেন জয়াকে হেনস্থা না করে ইত্যাদি।
চেয়ারম্যান বললেন শরিফা বেগমকে, ও আপা কাইনদেন না। মেয়েরে ফেরৎ পাইছেন, হেইয়াই বড়ো কথা। ওরে নিয়ে বাঁচেন। নতুন করে জীবন আরম্ভ করেন, আপনার পাশে আছি মোরা ।
আমি দেখছিলাম শরিফা বেগমকে। একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী। নিখোঁজ স্বামীর জন্য এখনও অপেক্ষায় আছেন। অভাবে অনটনে শুকিয়ে গেছেন। কিন্তু ব্যক্তিত্বে কী এক দৃঢ়তা খেলা করছে।
জয়া উপরে খড়ের ছাউনি চাটাইয়ের বেড়ার বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। আমার সঙ্গীরাও এদিক ওদিক ঘুরছে। একলা পেয়ে শরিফা বেগমকে বললাম, একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে আপনাকে সালাম।
একটা অলৌকিক আনন্দ ঝিলিক খেলে গেল উনার চোখেমুখে। বললেন, আল্লাহ তোমার অনেক ভালো করবেন। তোমরাই আমার মাইয়াডারে ফিরাইয়া আনছো।
আমি বললাম, আপনার স্বামী কোন সেক্টরে যুদ্ধ করতেন?
উনি বললেন, তা তো জানি না। তয় এই বরিশাল অঞ্চলেই।
কীভাবে নিখোঁজ হলেন?
তা তো জানি না।
কী নাম ছিল উনার?
আব্দুল মোমিন খান।
আবার খটকা। নামটা এত পরিচিত লাগছে কেন? কোথায় শুনছি? খুব উতলা লাগছে। অস্থির লাগছে। পান্তাডাঙ্গা এবং আব্দুল মোমিন খান এই দুটো বিষয়ের সাথে আমার কোথায় যেন একটা লিঙ্ক আছে। লিঙ্কটা ধরতে পারছি না।
আমি বললাম, খালাম্মা আপনাকে বলি, আমরা জানতে পেরেছি আরজ আলী জয়াকে পাচার করেছিল।
উনি বললেন, আমার সেইডাই সন্দো ছিল। এটা ওই রাজাকারের বাচ্চার কাজ। ওর বাপ আমার সর্বনাশ করছিল। ওর পোলায় আমার মাইয়ার সর্বনাশ করল।
আমি বুঝলাম, আমি যার সাথে কথা বলছি তিনি শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী-ই নন। একজন বীরাঙ্গনাও বটে। বললাম, আপনি চান না অপরাধীর সাজা হোক?
একশবার চাই বাবা। কিন্তু আমার তো শক্তি নাই।
আপনাকে শুধুমাত্র একটা কেস ফাইল করতে হবে থানায়। আমাদের লোকেরা আপনার সাথে থাকবে। আমার সংস্থা মামলার সমস্ত খরচ বহন করবে। আপনাকে শুধু বুকে একটু সাহস রাখতে হবে।
উত্তরে উনি বললেন, আমি মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী। আমার সাহসের অভাব নাইরে বাবা।
আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। শরিফা বেগম বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন।
৬.
আজ ৫ দিন হয়ে গেল জয়াকে পরিবারের সাথে পুনঃএকত্রীকরণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট থানায় আরজ আলীকে আসামী করে একটা মানব পাচারের মামলাও দায়ের করা হয়েছে। পুলিশের উপরমহলে প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় পুলিশকে দিয়ে অপরাধীকে ধরার একটা পায়তারা চলছে। আরজ আলীও বসে নেই। অন্তরাল থেকে সেও প্রভাব খাটানেরার চেষ্টা করছে। মামলা তুলে নেওয়ার জন্য ভয়-ভীতিও দেখানো হচ্ছে বিভিন্নভাবে।
শরিফা খাতুন অকুতোভয়। এর শেষে দেখে ছাড়তে চান।
কিন্তু আমার অস্থিরতা কাটছে না। জয়া, পান্তাডাঙ্গা আর আব্দুল মোমিন খান এই তিনটি বিষয় আমাকে সুস্থির হতে দিচ্ছে না।
জয়ার ব্যাপারটা মগজ থেকে হৃদয়ে ঢুকে গেছে। ওর চোখ—দৃষ্টির লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ গভীরতায় কী লেখা আছে, তা ভাবতে ভাবতেই দিনরাত পার হয়ে যাচ্ছে।
আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বিষয়টাকে যুক্তি দিয়ে বিচার করতে বসলাম। এটা আমার ইনফ্যাচুয়েশন। জয়া সুন্দরী, আবেদনময়ী তাই আমি তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছি। এটা স্বাভাবিক, কদিন পর কেটে যাবে। তবে ভালোবাসা কী? কখনও ভালোবাসায় পড়িনি তাই প্রকৃত অনুভূতিটা জানি না। আচ্ছা যদি ধরে নেই ইনফ্যাচুয়েশন না, এটাই ভালোবাসা, তাহলে এই ভালোবাসার পরিণতি কী? একটা মেয়ে পাচার হয়ে মুম্বাইতে চলে গেছিল দুবছর আগে। এই দুবছরে হাতবদল হয়েছে বেশ ক বার। শত শত কাস্টমারকে যৌনভাবে তৃপ্ত করতে হয়েছে। এরকম একটা মেয়েকে কি ভালোবাসা যায়? যাবে না কেন? একশবার যায়। এই ঘটনায় ওই মেয়েটার কোনো হাত ছিল না। বরং অন্ধকারের কীটেরা ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। ভালোবাসা দিয়ে ওকে যদি দ্যুতিময় জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়, অন্যায় কোথায়? না কোনো অন্যায় নেই। কোনো অন্যায় নেই। এরপর? ওকে যদি আমি বিয়ে করি, কী হবে? চারিদিকে হৈচৈ পড়ে যাবে? তাতে কী হবে আমার? কী হারাবো আমি? সম্মান? সামাজিক অবস্থান? খেতাপুড়ি আমি সম্মানের, সামজিক অবস্থানের। মুক্তিযুদ্ধের মতো এটাও তো একটা যুদ্ধ! দেশের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, লক্ষ লক্ষ নারী ইজ্জত দিয়েছেন। তাতে তাদের সম্মান বেড়েছে না কমেছে? তাহলে আমরার সম্মান কমবে কেন? সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ, সেখানে আমিও তো একজন যোদ্ধা।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি যুদ্ধটা করব।
আমার অস্থিরতা কিছুটা কমল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। বাইরে মার্চের দুপুর খাঁ খাঁ করছে রোদ্দুরে। আমাদের অফিসের ঠিক পাশেই একটা সিমেট্রি। আমি তাকিয়ে রইলাম সিমেট্রির বে-বহা নির্জনতায়। নির্জনতার মধ্যে কবরের নামফলকগুলো কীরকম যেন সজীব লাগছে। সেই সজীবতার উপর ঝরে পড়ছে গাছের একটা দুটো শুকনো পাতা।
হঠাৎ একটা পুরোনো কবর আমার মাথার ভেতর ভেসে উঠল। ইয়েস!
চৌগাছায় আমাদের গ্রামের বাজারের পাশে একটা স মিল আছে। সাহা স মিল। তার পাশে পলেস্তরা খসা একটা নিঃসঙ্গ পাকা কবর। আগাছা জর্জড়িত। শৈশব কৈশোর থেকে আমরা বিপুল বিস্ময়ে কবরটাকে দেখেছি। স্কুলে যাওয়ার পথে দেখেছি, স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখেছি।
একলা কবর, একটা অতিকায় ছাতিয়ান গাছের তলে। কবরে নামফলক আছে। একটু বড়ো হলে বিবর্ণ শ্যাওলাস্নাত নামফলকটাকে পড়ার চেষ্টা করেছি। বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ আব্দুল মোমিন খান; মৃত্যু ১৩ ই মে ১৯৭১। কে এই মোমিন খান? বীর কেন? মুক্তিযোদ্ধা কী জিনিস? আর একটু বড়ো হয়ে আমার স্কুল শিক্ষক আব্বাকে প্রশ্ন করেছি এ বিষয়ে। আব্বা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সংবেদনশীল একজন মানুষ ছিলেন। গভীর মমতায় তিনি আমাকে ঘটনাটা বলেছেন।
৭.
১৯৭১ সালের ১৩ মে। আকাশ মেঘলা, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। দেশব্যাপী তখন পুরোদস্তুর গেরিলাযুদ্ধ চলছে। হঠাৎ গ্রামের বাজারে ৫/৬ জনের একটা মুক্তিযোদ্ধার দলকে দেখা গেল। তারা বলল যে তারা বরিশাল অঞ্চল থেকে এসেছে। যাচ্ছে সীমান্তের দিকে। সীমান্তের ওপার থেকে আর্মস এবং অ্যামুনিশনস আনার জন্য। তখন হামেশাই এই রাস্তা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্তের এপার-ওপার করতে দেখা যেত। গ্রামের মানুষ তাদের খাবার দিয়ে আশ্রয় দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করত।
দলটি ঠিকঠাকভাবেই এগোচ্ছিল। কিন্তু ঝামেলা হয়ে গেল বাজার পার হয়ে নদীর পাড়ে আসতেই। স্থানীয় রাজাকাররা পাক-আর্মিদের ছোটো একটি দলকে খবর দিয়ে আনিয়ে নদীর পাড়ে অ্যামবুশ পেতে রেখেছিল।
আচমকা ওদের মুখোমুখি হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধার দলটি। দলটির কাছে আর্মস ছিল। তা দিয়ে তারা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। যুদ্ধ হয়। এবং পাক-রাজাকার বাহিনী পিছু হটে যায়। মুক্তিযোদ্ধা দলের শুধু একজন যার নাম আব্দুল মোমিন—গুলিবিদ্ধ হন। গুলিটা তার চোয়ালের একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। গুলির আঘাতে তার জিহ্বাটা ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।
খবর পেয়ে গ্রামবাসীরা সেখানে ছুটে আসে। আমার আব্বাও সেখানে আসেন। অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও ছিল। আব্দুল মোমিনের চোয়াল থেকে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছিল।
বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশ্ন করলেন, ওর নাম কি?
মুক্তিযোদ্ধাদের একজন উত্তর দিল, আব্দুল মোমিন খান।
বাড়ি কোথায়?
বরিশাল। কিন্তু বরিশালের কোথায় সেটা তো জানি না।
আব্দুল মোমিন কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিলেন। জিহ্বা ছিঁড়ে যাওয়ায় আর রক্তধারার চাপে কথা বলতে পারছিলেন না। হাত দিয়ে ইশারা করছিলেন। বাবা বুঝতে পারলেন কাগজ-কলম চাইছেন। কেউ একজন ছুটে গিয়ে কাগজ-কলম আনল। আব্দুল মোমিন অনেক কষ্টে লিখতে পারলেন, পান্তাডাঙ্গা। তারপর নিথর হয়ে গেলেন।
সবাই মিলে স মিলের পাশের ওই জায়গাটায় তাকে সমাহিত করলেন। বাকি যুক্তিযোদ্ধারা বিদায় নিলেন। পরে গ্রামবাসীরা কবরটাকে পাকা করে দিলেন, নামফলক টাঙিয়ে দিলেন।
আমার হঠাৎ বিদুচ্চমকের মতো মনে পড়ল আমার ট্রাঙ্কে তো ‘পান্তাডাঙ্গা’ লেখা সেই চিরকুটটা থাকার কথা। বাবা আমাকে দিয়ে বলেছিলেন, এটা রাখো। একজন মুক্তিযোদ্ধার নিজ হাতে লেখা চিরকুট। অমূল্য সম্পদ।
কিন্তু ট্রাঙ্কটা কোথায় আছে আমি তো জানি না। বাবার মৃত্যুর পর আমরা পাকাপাকিভাবে যশোর শহরে স্থানান্তরিত হই। আমরা মানে আমি, মা আমার ছোটো ভাই; আমার বড়ো বোনের বিয়ে হয়েছে ঝিনাইদহের কালিগঞ্জে। বাসা শিফমেন্টের সময় আমার ছোটোবেলার সেই ছোট্ট ট্রাঙ্কটা আনা হয়েছে কি না আমার জানা নেই। মাকে ফোন করলে জানা যেতে পারে। কিন্তু আমি ফোন করলাম না। মনে হলো সরাসরি বাড়ি গিয়ে খুঁজে দেখা উচিত। অফিস থেকে বাসা ৫ মিনিটের হাঁটাপথ।
বাবার মৃত্যুর পর আমরা পাকাপাকিভাবে যশোর শহরে স্থানান্তরিত হই। আমরা মানে আমি, মা আমার ছোটো ভাই; আমার বড়ো বোনের বিয়ে হয়েছে ঝিনাইদহের কালিগঞ্জে। বাসা শিফমেন্টের সময় আমার ছোটোবেলার সেই ছোট্ট ট্রাঙ্কটা আনা হয়েছে কি না আমার জানা নেই। মাকে ফোন করলে জানা যেতে পারে।
মাকে বলতেই মা সেটা আলমারি খুলে বের করে আনলেন। পুরোনো জং ধরা ট্রাঙ্কটা ভাঙ্গারির দোকানে বিক্রি করে না দেওয়ার জন্যে আমি মার কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম।
ট্রাঙ্ক খুলে আমার বিস্ময়ের অবধি রইল না। একে একে বের হয়ে এলো একটি রাবারের অর্ধেকটা, দুটো পেন্সিল, কয়েক টুকরো মোমরং, একটি চাঁদা, একটি ভাঙা স্কেল, একটা ছোটো বাক্স দিয়ে বানানো বায়োস্কোপ, একটা কাগজের নৌকো, আর একটা চিরকুট। পান্তাডাঙ্গা লেখা।
আমি তাকিয়ে রইলাম পান্তাডাঙ্গার দিকে। হাতের লেখা মোটেও সুন্দর নয়। সুন্দর হওয়ার কথাও নয়। যিনি এটা লিখেছেন তিনি মৃত্যুপথযাত্রী ছিলেন। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা হতে গেলে হাতের লেখা সুন্দর হওয়ার কোনো প্রয়োজনও নেই। সম্ভবত ঝর্ণা কলম দিয়ে লেখা হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে কালি জাবড়ে গেছে। অস্পষ্ট হয়েছে। আর একটু লালচে হয়েছে।
এই চিরকূট আমাকে পৌঁছে দিতে হবে শরিফা বেগমের কাছে। তাকে এনে স্বামীর কবর দেখাতে হবে। অনেক দায়িত্ব আমার।
আচ্ছা, তিনি তো স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে আছেন। কবে তার স্বামী ফিরে আসবে। স্বামীর মৃত্যু সংবাদ দেওয়াটা কি ঠিক হবে? এতদিনের অপেক্ষা। আমি ঝড়ো গতিতে চিন্তা করছি। আসলে অপেক্ষার ব্যাপারটা ভণিতা। অপেক্ষা নামক একটা বাতাবরণ তৈরি করে তার মধ্যে নিছক দিনাতিপাত করা। তিনি খুব ভালো করেই জানেন, স্বামী তার বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে তখনই ফিরে আসত। …বরং বাংলার মাটিতে তার শহিদ স্বামীর একটা সম্মানজনক কবর হয়েছে, এটা জানলে তার ভালো লাগবে।
আমি পরদিনই পান্তাডাঙ্গা রওনা হবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।
রিইন্টিগ্রেশনের পর ফলোআপ একটা রুটিন কাজ। আমি না গেলে অন্য কাউকে যেতে হতো।
৮.
ঘড়িতে সকাল ৯ টা। পান্তাডাঙ্গার উদ্দেশে আমি অফিসের গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, এই সময় আমার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল।
চেয়ারম্যান আসগর আলী কলটা করেছেন। ওনাকে আমার নাম্বার দিয়ে এসেছিলাম।
হ্যালো। স্লামালাইকুম।
রাসেল সাহেব বলছেন?
জি বলছি। কেমন আছেন চেয়ারম্যানসাহেব?
শোনেন, এদিকে একটা ঝামেলা হয়ে গেছে ভাইসাব। জাকিয়াগো বাড়িতে কাল রাতে আগুন লাগছিল। আমার ধারণা ওই আরজ আলীর দলই আগুনটা লাগায়। মা-মাইয়া দুইজনই পুড়ে গেছে। ওগো সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হইছিল। জাকিয়া পথেই মারা গেছে। ওর মার অবস্থা ভাইসাব খুবই আশংকাজনক।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আমি বিড় বিড় করে বললাম, আমি আসছি হে বীরাঙ্গনা।
বরিশাল পৌঁছাতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। ডাক্তার বললেন, প্রায় সেভেনটি পারসেন্ট বার্ন। বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
আমি বললাম, ডক্টর, উনি একজন বীরাঙ্গনা। ওনাকেই বাঁচাতেই হবে।
আমরা তো চেষ্টার ত্রুটি করছি না। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।
আমি অনেক কষ্টে তাকে দেখার পারমিশন পেলাম। কেবিনে একটা মমি শুয়ে আছে। মুখমণ্ডলও পুরোটা ব্যান্ডেজ। সেই ব্যান্ডেজের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে যন্ত্রণাকাতর ধ্বনি বেরিয়ে আসছে।
আমি ডাকলাম, খালাম্মা।
উনি ব্যান্ডেজের ভেতর থেকে চোখ পিট পিট করে তাকালেন।
আমি একটা খবর নিয়ে এসেছি।
কী খবর বাবা? অনেক কষ্টে বললেন তিনি।
দেখুন তো এই চিরকুটের লেখাটা চিনতে পারেন কি না? আমি চিরকুটটা শরিফা বেগমের চোখের খুব কাছে মেলে ধরলাম। উনি অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর মাথা নাড়লেন।
আমি পুরো ঘটনাটা উনাকে বললাম।
শুনে উনি শ্লেষ্মাবিজড়িত অস্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, এখন আমি শান্তিতে মরতি পাবো। আমার স্বামীর লাশ যে শেয়ালে কুকুরে খায় নাই, বাংলাদেশের মাটিতে কবর হয়েছে, এতেই আমি খুশি।
তারপর চোখ বুজলেন। হয়তো চিরতরে।
গদ্যে-পদ্যে সমান বিচরণ। পেশায় উন্নয়ন কর্মী। ২০০২ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় গল্প সংকলন ‘হ্রেষাধ্বনি ও অন্যান্য কণ্ঠস্বর’ দিয়ে আত্মপ্রকাশ। উল্লেখযােগ্য গ্রন্থসমূহের মধ্যে ‘স্পর্শপুরাণ’ (উপন্যাস), ‘বিহঙ্গ হত্যার পূর্বাপর’ (উপন্যাস), ‘কুহেলিবৃত্তান্ত’ (কাব্যগ্রন্থ), ‘হৃৎপিণ্ড ভরতি ভেজা পলল’ (কাব্যগ্রন্থ), ‘রংছুট কোয়েলের বিষণ্নতা’ (কাব্যগ্রন্থ) উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যের পথ-পরিক্রমায় তার সম্বল স্বকৃত ভাষাশৈলী। শব্দকে ব্রহ্মজ্ঞান করেন। শব্দ-সংঘাত সৃষ্টি করে তা থেকে বিচ্ছুরিত বিভার ভেতর খুঁজে ফেরেন শিল্পের অন্তর্গূঢ় রহস্য। জন্ম সদ্য স্বাধীন দেশের মাটিতে, যশোর জেলায়।