যে কোনো ভাষাগোষ্ঠীর চারিত্র্য ও আত্মপরিচয় প্রকাশের পূর্ণতা লাভ করে ধন্য হয় সেই ভাষার কবিদের গভীরতম উচ্চারণের মধ্য দিয়ে। তাই একটি ভাষাগোষ্ঠী অথবা জাতির কবিতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে, সেই মানবগোষ্ঠীর আত্মার ক্রমবিকাশের বিভিন্ন পর্যায় ও স্বরূপ আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ একটি ভাষাগোষ্ঠীর ভাবনা-বেদনা ও স্বপ্ন-কল্পনার সামগ্রিক মানচিত্রটি সেই ভাষার মহত্তম কবিদের রচনায় মূর্ত হয়ে ওঠে। এবং একজন কবি যখন সার্থকভাবে তার সমগ্র জাতির প্রাণ, মন ও আত্মার প্রতিনিধিত্ব করবার শক্তি অর্জন করেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাকে বিশ্বমানবের প্রতিভূ রূপেও অনায়াসে গণ্য করা চলে। কারণ এ-কথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে মানুষের গভীরতম আবেগ ও আস্পৃহাসমূহের কিছু কিছু সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা কাল হতে কালান্তরে অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। তাই তো ভূতপূর্ব সময়ের সুমহান কবিবৃন্দ এখনও দুর্নিবারভাবে প্রাণবন্ত ও প্রাসঙ্গিক।
দর্শন, বিজ্ঞান ও শিল্পের বিভিন্ন শাখায় নিরন্তর ক্রিয়াশীল রয়েছে অস্তিত্বের অর্থান্বেষণের সুমহান জ্ঞান ও আনন্দের মহাযজ্ঞ। মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিচিত্র শাখাসমূহ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই সত্যই প্রতিপাদন করবার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে যে, আমাদের বহির্জগত ও অন্তর্জগত অর্থময়তার দ্যোতনায় আনন্দ-ভাস্বর। কিন্তু ঐসব শাস্ত্রজাত অর্থময়তা কখনই জীবন্ত ও প্রমূর্ত হয়ে ওঠে না মানুষের পঞ্চেন্দ্রিয় তথা গভীরতর ও ঊর্ধ্বতর বোধির আত্মায়। কবির একটি প্রধান কর্ম হচ্ছে অস্তিত্বের এই অনিঃশেষ অর্থময়তাকে বাণীমূর্তি দান করা ছন্দ ও চিত্রকল্পের মিলিত উচ্ছ্বাসে। এমনকি বিশুদ্ধ সঙ্গীতের তুরীয় শক্তি ও সৌন্দর্যও কখনও কখনও শব্দের সাথে সংযোজিত হয়েই অর্থদীপ্ত পূর্ণতা লাভ করে। যেমন রবীন্দ্রনাথ যদি শুধুমাত্র বিশুদ্ধ সুরসৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হতেন, তাঁর দিব্যোন্মাদনা-সৃষ্টিকারী সুরের সুরধুনী যদি লোকোত্তর শব্দমালার শিবজটায় বিধৃত করে না যেতেন, তবে কি তাঁর সঙ্গীত বাঙালিদের জন্য ক্রমাগত মাতৃস্তন্য হয়ে উঠতো?
আরো একটি কারণে মানবচৈতন্যের জন্য কবিতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সঙ্গীত। মানুষের চৈতন্য সর্বক্ষণ অক্লান্তভাবে তার সমস্ত সীমা ও বন্ধনকে চূর্ণ করে সেই মহাবৈপুল্যের মধ্যে মুক্তি চাইছে, যেখানে কোনো বাধার প্রাচীর তার অন্তহীন অগ্রযাত্রার প্রাণ-স্ফূর্তিকে ব্যাহত করে না।
কবিতার দুটি প্রধান মাত্রা বা রূপ আছে যারা যেনবা মন্ত্রবলে আমাদের সীমায়িত বাস্তবের বন্ধন ছাড়িয়ে নিয়ে যায় সেই অসীম চৈতন্যের বাধাহীন বিরাট প্রাঙ্গনে যেখানে সাময়িকভাবে হলেও আমরা মহাবিশ্বের অমোচনীয় একত্ব সম্পর্কে বিদ্যুচ্চমকে সচেতন হয়ে উঠি।
কবিতার দুটি প্রধান মাত্রা বা রূপ আছে যারা যেনবা মন্ত্রবলে আমাদের সীমায়িত বাস্তবের বন্ধন ছাড়িয়ে নিয়ে যায় সেই অসীম চৈতন্যের বাধাহীন বিরাট প্রাঙ্গনে যেখানে সাময়িকভাবে হলেও আমরা মহাবিশ্বের অমোচনীয় একত্ব সম্পর্কে বিদ্যুচ্চমকে সচেতন হয়ে উঠি। প্রথমটি হচ্ছে কাব্যের ধ্বনিময় রূপ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে তার অর্থময় রূপ। কবিতার ধ্বনিরূপটি যেন তার উল্লম্ব অক্ষ আর অর্থময়তার মাত্রাটি হচ্ছে অনুভূমিক অক্ষ।
কবিতার ধ্বনিময় রূপটি প্রত্যক্ষভাবে সেই অনাদ্যন্ত স্বরে নিনাদিত প্রণবধ্বনির সাথে আমাদের মন, প্রাণ ও দেহরূপ ত্রিপুটির সংযোগ ঘটায়। খণ্ড খণ্ড ধ্বনির স্পন্দন তখন সেই অখণ্ড শব্দব্রহ্মের সাযুজ্যলাভে শিহরিত হয়, বিশেষ উত্তীর্ণ হয় নির্বিশেষ একত্বের সমুদ্রবিস্তারে। ছন্দোবদ্ধ ধ্বনির অন্তরে তাই তার উৎসমুখে প্রত্যাবর্তনের জন্য দুর্বার আকুতি নিয়ত দেদীপ্যমান। কারণ সেই অখণ্ড নাদব্রহ্মেই তার উৎপত্তি, মধ্যবর্তী বিহার ও চূড়ান্ত পর্যবসান।
কবি শুধু আনন্দ দান করেই তার কর্তব্য কর্ম শেষ করেন না। তিনি জ্ঞানও বিতরণ করেন। অন্তর্জগত ও বহির্জগতকে আমরা একটি বিশেষ মুহূর্তে যে-ভাবে প্রত্যক্ষণ করে থাকি, সম্পূর্ণ নূতন একটি উৎপ্রেক্ষার আবেশ আমাদের সেই পূর্বতন অভিজ্ঞতা ও বিশ্ববীক্ষার আমূল রূপান্তর এনে দিতে পারে।
কবিতার অর্থময় রূপটিও অস্তিত্বের সেই অন্তর্নিহিত ও আধ্যাত্মিক একত্বের অভিসারী। ভাব ও ভাবনাঋদ্ধ চিত্রকল্পের মধ্য দিয়েই অর্থময় রূপটি অভিব্যক্ত হয়। আর চিত্রকল্পসমূহের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো উপমা ও উৎপ্রেক্ষা। (উভয় শব্দই যেহেতু একই ধরনের প্রতীতি ও অর্থের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে, তাই ব্যবহারের সুবিধার জন্য আমি এখানে উৎপ্রেক্ষা শব্দটিই বেছে নিলাম।) উৎপ্রেক্ষার ইন্দ্রজাল বিশ্বচরাচরের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য স্তর বা মাত্রাসমূহের কূটস্থ একত্ব সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে তুলতে পারে বিদ্যুৎক্ষিপ্র মুহূর্তের পরিসরে। যেখানে দুটি বিষয়ের মধ্যে কোনো আপাতসাদৃশ্য অনুভূত হচ্ছে না, সে-স্থলে সৌসাদৃশ্য দর্শনে মানুষ যুগপৎ বিস্মিত ও আনন্দিত হয়। একজন কবি যখন একটি নূতন ধরনের সাদৃশ্য সম্ভাবনাকে বাঙ্ময় প্রতিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন তখন তাঁর সাফল্যের সমতুল্য হতে পারে একজন বৈজ্ঞানিকের মৌলিক কোনো আবিষ্কার। এর মানে দাঁড়ালো এই যে নূতন উৎপ্রেক্ষা সৃষ্টির মাধ্যমে কবি মানবজাতির জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধতর করে তোলেন নিঃসন্দেহে। কবি শুধু আনন্দ দান করেই তার কর্তব্য কর্ম শেষ করেন না। তিনি জ্ঞানও বিতরণ করেন। অন্তর্জগত ও বহির্জগতকে আমরা একটি বিশেষ মুহূর্তে যে-ভাবে প্রত্যক্ষণ করে থাকি, সম্পূর্ণ নূতন একটি উৎপ্রেক্ষার আবেশ আমাদের সেই পূর্বতন অভিজ্ঞতা ও বিশ্ববীক্ষার আমূল রূপান্তর এনে দিতে পারে। তাছাড়া ব্রহ্মচৈতন্যের যে সর্বব্যাপী বিদ্যমানতা বিশ্বনিখিলের প্রতিটি বস্তু ও ব্যক্তির একত্বের ভিত্তিমূল, প্রতিটি উৎপ্রেক্ষার অন্তর্গূঢ় আস্পৃহা হলো জড়জগতের পার্থক্য-পরিপ্লুত প্রেক্ষাপটে অখণ্ডচৈতন্যের সেই একত্বের আভাসকে বারংবার মূর্ত করে তোলা।
আত্মশুদ্ধি ও স্বাতিক্রমের এক শাণিত হাতিয়ার হচ্ছে কবিতা। কবি এবং তাঁর রসজ্ঞ পাঠক উভয়েই কাব্যের সমুদ্রমন্থন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বার বার নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার শক্তি সঞ্চয় করে থাকেন।
আত্মশুদ্ধি ও স্বাতিক্রমের এক শাণিত হাতিয়ার হচ্ছে কবিতা। কবি এবং তাঁর রসজ্ঞ পাঠক উভয়েই কাব্যের সমুদ্রমন্থন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বার বার নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার শক্তি সঞ্চয় করে থাকেন। কারণ কবিতা তো একই সাথে যুদ্ধ আর তীর্থযাত্রা। কবিকে যুগপৎ সংগ্রাম করতে হয় বিচিত্রকর্মা সব শব্দ আর তার অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত অসংখ্য চিন্তা ও অনুভূতির সাথে। কখনও কখনও তার প্রতিবেশের সঙ্গেও তাঁকে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হতে হয়। তখন তার কণ্ঠস্বর রূপান্তরিত হয় বিদ্রোহী চেতনার অপ্রতিরোধ্য অগ্নিশিখায়। কিন্তু কবির প্রকৃত লড়াই হচ্ছে তাঁর ফুট ও অস্ফুট সব আবেগ উপলব্ধি ও চিন্তাকে শব্দময় করে তুলবার নিরবচ্ছিন্ন লড়াই। এই প্রক্রিয়া অনস্বীকার্যভাবে একই সাথে যন্ত্রণা-দীর্ণ এবং জ্যোতির্ময় আনন্দে মুখর। কবির উপল-বন্ধুর ও পিচ্ছিল পথ যেন ছুটে চলেছে আঁকাবাকা অবিশ্রান্ত বেগে কোনো এক পার্বত্য আকাশের নিয়ত পরিবর্তনশীল আলো আর বিদ্যুৎ চকিত অন্ধকারের নিচ দিয়ে এখনও অনাবিষ্কৃত সব আকাশ, পর্বত, নদী ও প্রান্তরের রহস্য উন্মোচনের উজ্জ্বলিত অভীপ্সায়। নিজের অসংযত ও বিশৃঙ্খল চিন্তা ও আবেগের সাথে যুদ্ধে আবির্ভূত হওয়ার অর্থ হচ্ছে বস্তুতপক্ষে অন্তর্লোকের দুর্দান্ত সব দানব ও দেববৃন্দের সঙ্গে যুদ্ধরত হওয়া। ভুক্তভোগী কবিমাত্রেই জানেন যে চৈতন্যলোকের ঐসব মহাবলশালী অধিবাসীদের রণোন্মত্ততাকে পদে পদে প্রশমিত করবার কাজটি কতোটা বিপদসঙ্কুল ও দুরূহ। খ্যাত ও অখ্যাত কতো শত কবি যে কাব্যসাধনার এই কুরুক্ষেত্রে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন, তার হিসেব কেউই জানে না। কিন্তু এই সমরাঙ্গনে সকলেই পরাভূত হন। না, কেউ কেউ কাব্যসিদ্ধির হিরন্ময় সিংহদ্বারে উপনীত হন। সৃষ্টিকর্মের যে অব্যর্থ উল্লাস এই অভিব্যক্ত জগতের মৃত্যুঞ্জয়ী চলিষ্ণুতার চালিকা শক্তি, সেই আনন্দ তখন কবির চৈতন্যকে পরিপ্লাবিত করে। দেবরাজ জিউসের মস্তক বিদীর্ণ করে যেভাবে সম্পূর্ণ অস্ত্রসুসজ্জিতা, জ্ঞান ও শক্তির চিরকুমারী দেবী পালাস আথিনার আবির্ভাব ঘটেছিলো, তখন সেভাবেই কবিতার জন্ম হয়। লোক হতে লোকান্তরে প্রসারিত কবির ব্যথা-ক্লিষ্ট পরিব্রাজন তখন সংসিদ্ধির পুণ্যতীর্থে চরিতার্থ হয়, অভিজ্ঞতা লাভ করে উচ্চারণের অনিবার্য যথার্থতা।
আরও একটি কারণে কবিতা প্রতিটি জাতির কাছেই অত্যন্ত সমাদরের সামগ্রী। কবিতা আমাদের এই পরম জ্ঞান ও সান্ত্বনা প্রদান করে যে মর্ত্যজীবনের বেদনা ও বৈক্লব্য যতো তীব্র বা দুর্বিষহ হয়ে উঠুক না কেন— সেই হলাহলকে অমৃতে রূপান্তরিত করা সম্ভব। কারণ কবিতার প্রাণকেন্দ্রে নিরন্তর রণিত হচ্ছে এক অনিঃশেষ আনন্দের শঙ্খধ্বনি।
আরও একটি কারণে কবিতা প্রতিটি জাতির কাছেই অত্যন্ত সমাদরের সামগ্রী। কবিতা আমাদের এই পরম জ্ঞান ও সান্ত্বনা প্রদান করে যে মর্ত্যজীবনের বেদনা ও বৈক্লব্য যতো তীব্র বা দুর্বিষহ হয়ে উঠুক না কেন— সেই হলাহলকে অমৃতে রূপান্তরিত করা সম্ভব। কারণ কবিতার প্রাণকেন্দ্রে নিরন্তর রণিত হচ্ছে এক অনিঃশেষ আনন্দের শঙ্খধ্বনি। যে নিরবচ্ছিন্ন আনন্দস্রোতে সপ্তলোক বিধৃত ও বিরাজিত আছে, সেই স্রোতোধ্বনির স্পন্দন আমরা শুনতে পাই ছন্দোবদ্ধ, নব নব অর্থদীপ্ত বাণীর ঝঙ্কারে। মহাকবি হোমারের ‘অডিসি’-তে টেলেমেকাস তাঁর মাতাকে বলছেন, ‘Men like best/a song that rings like morning on the ear.’ অর্থাৎ মানুষ সেই গানই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে যা তাঁর কর্ণকুহরে ঠিক প্রভাতের কলধ্বনির মতো বেজে ওঠে। এখানে ‘গান’ বলতে টেলেমেকাস চারণ কবির গাওয়া কবিতার কথাই বোঝাচ্ছেন। প্রতিটি ঊষায় নিদ্রোত্থিত প্রাণীকুল ও প্রকৃতির অসংখ্য আওয়াজ বিশ্বচরাচরে যে আনন্দ ছড়িয়ে দেয় স্বতঃস্ফূর্ত শক্তির স্যন্দনে, সেই আনন্দই প্রাণবন্ত হয়ে জ্বলে আছে কবিতার শোণিতধারায়। যদিও সেই পুনঃপুন আবিভূর্তা উষার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে শত শত রাত্রির আঁধার। টেলেমেকাসের উচ্চারণের নির্গলিতার্থ হচ্ছে এই যে প্রকৃত কবিতা প্রাত্যহিকতার পরিচিত প্রত্যক্ষণ ও ভাবনার নিদ্রা থেকে জাগ্রত করে আমাদের মুক্তি দেয় নবীকৃত চৈতন্যের সূর্যদীপ্ত অমৃতলোকের মোহানায়। তাই মানবীয় অস্তিত্বের এই মৃত্যুকবলিত বিভীষিকা থেকে, সাময়িক সময়ের জন্য হলেও, কবিতা আমাদের সমুদ্ধার করে। কাব্যরচনার ও কাব্যপাঠের মাহেন্দ্র প্রহরে কবি ও পাঠকের চৈতন্যের উপর নেমে আসে ঊর্ধ্বতর লোকসমূহের বোধিঋদ্ধ জ্ঞান, শক্তি আর ক্লান্তিহীন সৃষ্টির উল্লাস। সেই সৃষ্টির উল্লাসই কবি ও তাঁর পাঠককে মানব অস্তিত্বের চূড়ান্ত পরিণতির করাল ছায়া থেকে রক্ষা করে, মহাকাল সৃষ্ট মহাবিশ্বের সুবিরাট গুরুভার বহন করবার শক্তিকে অর্গলমুক্ত করে দেয় পর্বত-কন্দর হতে অকস্মাৎ ছাড়া-পাওয়া নির্ঝরের মতো।
কাব্যরচনার ও কাব্যপাঠের মাহেন্দ্র প্রহরে কবি ও পাঠকের চৈতন্যের উপর নেমে আসে ঊর্ধ্বতর লোকসমূহের বোধিঋদ্ধ জ্ঞান, শক্তি আর ক্লান্তিহীন সৃষ্টির উল্লাস।
উপসংহারে বলা যায় যে মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে অসুস্থ ও বিপর্যস্ত মানুষের জন্য কবিতা হচ্ছে সেই বিশল্যকরণী যা রাবণের শক্তিশেলের আঘাতে মূৰ্ছিত লক্ষণকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলো। আর কবি যেন কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণে’ বর্ণিত সেই পবননন্দন হনুমান যিনি আশঙ্কা-সঙ্কুল অন্ধ রাত্রে গন্ধমাদনের শিখরে শিখরে বিশল্যকরণীর অন্বেষণে ব্যর্থকাম হয়ে, রাবণের ভয়ে ভীত সূর্যদেবকে কক্ষতলে বন্দী করে, সমগ্র পর্বতটাকেই স্কন্ধে নিয়ে এক অতিকায় উল্লম্ফনে ক্রমাগত নিরাকৃত করে চলেছেন আকাশমার্গের যোজন যোজনব্যাপী তমিস্রার বিস্তীর্ণতা। অর্থাৎ দ্যাবাপৃথিবী যখন নিদ্রার কোলে লক্ষণের মতো অচৈতন্য, তখন সেই অপরাজেয় অঞ্জনাতনয়ের মতো চরাচরপ্লাবী তমসাবৃত শূন্যতার বক্ষঃস্থল দীর্ণ করে কবি ছুটে চলেছেন একাকী ও অকম্পিত, কাঁধে নিয়ে বিশ্ববেদনার গন্ধমাদন পর্বত, যার কোনো এক সংগুপ্ত শিখরে লুক্কায়িত আছে মৃত্যুজয়ী বিশল্যকরণী।