সাজ্জাদ শরিফ আশির দশকের অন্যতম প্রধান কবি। ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৬৩ সালে পুরান ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। প্রকাশিত কবিতার বই ‘ছুরিচিকিৎসা’ (২০০৬, মওলা ব্রাদার্স) ‘যেখানে লিবার্টি মানে স্ট্যাচু’ (গদ্য, ২০০৯, সন্দেশ) ‘রক্ত ও অশ্রুর গাথা’ (অনুবাদ, ২০১২, প্রথমা), ‘আলাপে ঝালাতে’ (সাক্ষাৎকার সংকলন, ২০১৯, প্রথমা)। তিনি বর্তমানে দৈনিক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। শিল্প-সাহিত্যসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাজ্জাদ শরিফের মুখোমুখি হয়েছেন জব্বার আল নাঈম
জব্বার আল নাঈম: আপনার অনেকগুলো পরিচয় জানি। এত কিছুর ভেতরে কোন পরিচয়কে সামনে রেখে আমরা শুরু করতে পারি?
সাজ্জাদ শরিফ: হা হা হা… দেখেন, পৃথিবীর কোনো মানুষেরই একটা পরিচয় নেই। এটা পলিটিক্সের বিষয়ও। ধরেন, মুসলমান সমাজের ভেতর সালমান রুশদী, দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীও আছে। আবার বিচারপতি হাবিবুর রহমান সাহেবের মতো লোকও আছে। সবাই একই ধর্মের লোক। দেখেন এ অঞ্চলের রবীন্দ্রনাথ সনাতন ধর্মের লোক। নরেন্দ্র মোদি সে-ও একই ধর্মের লোক। একই ধর্মে বিশ্বাসী। কিন্তু একই রকমের না। আবার এক মানুষের অনেক পরিচয়। যেমন ধরেন, আপনি যখন পুরুষের সমাজে বাস করেন তখন আপনি একজন পুরুষ। একজন নারী সমাজে আপনি একজন আলাদা লিঙ্গের মানুষ। আপনি যখন লেখালেখি করেন তখন আপনি একজন লেখক। যখন সাহিত্য উৎসবে যাবেন তখনও একই। আবার যখন ঘরে ফিরবেন তখন আপনি পরিবারের সদস্য। যখন নৌকার মধ্যে ১০ জন লোক থাকে, দেখা যায় ৫ জন সাঁতার জানে, বাকি ৫ জন সাঁতার জানে না। আপনি সাঁতার জানা দলের লোক। মানুষ অপরিসীম ও অসংখ্য পরিচয়ের ভেতরে বাস করে। প্রত্যেক মানুষই আলাদাভাবে অনেক পরিচয় বহন করেন।
এটা নিয়ে অর্মত্য সেনের, ‘আইডেন্টি এন্ড ভায়োলেন্স’ পড়েছি। পৃথিবীর সব বড়ো বড়ো লোকই একটা পরিচয় দেয়। মিডিল ইস্টের ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু করে মালয়েশিয়ার সবাই মুসলমান। কিন্তু মানুষ ছাড়া অন্যকোনো পরিচয় নেই। প্রত্যেক মানুষেরই নানা রকমের পরিচয় থাকে। একটার ভেতরে আরেকটা ঢুকে থাকে। কোনো একটা পরিচয়ের ভেতরে আরেকটা পরিচয় ক্যারি করে। সে যখন ফুটবল খেলা দেখতে যায় তখন সে ফুটবল প্রেমিক। কিন্তু সে ক্রিকেটেও আসক্ত। এরকম আছে না?
জব্বার আল নাঈম: তাহলে আপনি একজন কবির ভেতর সাংবাদিক না সাংবাদিকের ভেতর কবি?
সাজ্জাদ শরিফ: ব্যপারটি এমন না। আমি যখন সাংবাদিকতা করি তখন পেশার জন্য করি। যেটা নেশাও আছে। আবার যখন কবিতা লিখি এটা তো আমার প্যাশন। এখানে একটার সঙ্গে আরেকটার অন্তসূত্র বিদ্যমান। বাংলাদেশের মতো জায়গায় কবিতা লিখে খেয়ে বাঁচতে পারা যায় না। ফলে এটা একটা পেশা। ধরেন, এটা আমি না লিখে পারব না। আর যদি অনুবাদ প্রবন্ধের কথা বলেন, বেশিরভাগ প্রবন্ধ লেখা হয় অর্ডারে। চাহিদা থাকে তাই। তবে, এসব লেখা হয়— আমার চিন্তা থেকে, যা নিয়ে ভেতর এক ধরনের ডিবেট বা তর্ক হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সাহিত্যের মহল, সংস্কৃতি বা চিত্রকলা নিয়ে এবং যেকোনো বিষয় নিয়ে আন্ডার দ্য সান অর্থাৎ সূর্যের নিচে যত বিষয় আছে এগুলো নিয়ে যে কোনো মানুষ কৌতূহলী। মনে করি, এখানে নিজের একটা মত আছে। তবে, কবিতা প্যাশনের জায়গা, যে নাকি সবচে বাজে কবিতা লেখে বা যে সবচে ভালো কবিতা লেখে, সেও বলবে কবিতা আমার প্রাণের অবস্থান। এরশাদ সাহেবও বলবে। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, রবীন্দ্রনাথও বলবে। ফলে, আমি বাইরের কেউ না। আর প্যাশন তো থাকবেই।
জব্বার আল নাঈম: আমরা যখন লেখালেখি শুরু করি তখন জানতাম সাজ্জাদ শরিফ একজন কবি এবং ‘ছুরিচিকিৎসা’ একমাত্র প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। তারপরে আপনার কবিতার বই পাঠক দ্বিতীয়টি পায়নি। অনেকেই মনে করেন আপনি কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছেন? নাকি অন্য কারণ?
সাজ্জাদ শরিফ: হা হা হা… ব্যাপারটি এমন না। লিখেছি। ছাপাও হয়েছে। কিন্তু বই বের হয়নি। আবার যা লিখেছি তার সবটা যে ছাপা বা প্রকাশ হবে এমন না। কিছু লিখেছি এর কিছু প্রকাশ করেছি। এখানে দুটি উত্তর আছে। একটি হলো, আমি আগে এক রকম লিখতাম। দীর্ঘ সময় ধরে লিখতাম। এরও কারণ আছে। আমরা তখন একটা পত্রিকাতে লিখতাম। ‘গাণ্ডীব’ নামের পত্রিকাতেই আমরা লিখতাম। যদিও সেটি বছরে একবার বের হতো।
পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, আমি যে কাজটি করি তা এতো সময় খেয়ে নেয়। সেখানে সকাল দুপুর রাত বলতে কিচ্ছু নেই। এতটা সময় যায়! মাসের পর মাস যায় সময় পাই না। আমি অনেক সময় মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করি। দৈনিক চারঘণ্টা মাত্র ঘুমাই।
ধরেন, উদাহরণস্বরূপ বলি, এটা কি মাস? গত মে-জুন-জুলাই এই তিনটা মাস গড়ে মনে হয় আমি সাড়ে চার ঘন্টা করে ঘুমিয়েছি। আমার কাজের এতই প্রেশার ছিল। আর তখন আমি কবিতা লেখার সময়ই পাইনি। আবার আমার কবিতা লেখার প্রক্রিয়াটা একটু ভিন্ন। এমন যে, আমি লিখলাম আবার লিখলাম বা ফেলে রাখলাম এসব পারি না।
আমার বন্ধু শাহাদাতকে দেখতাম সে প্রথমে কবিতার মধ্যাংশ লিখত। তারপর শেষাংশ এবং পরে আবার বলত কবিতার প্রথমাংশ লিখলাম। একেক জনের একেক ধরন।
আমার কবিতা লেখার ধরনটা একেবারে সম্পূর্ণ করতে হয়। হয়তো এর ভেতরেই খাচ্ছি, ঘুরছি বা বাইরের কাজ করছি। কিন্তু আমার চিন্তা কবিতা কেন্দ্রিক। আবার কোনো কারণে যদি অসম্পূর্ণ রয়ে যায়, আমার কবিতাটি আর হয় না। ফলে এই বিচ্ছিন্নতার কারণে কবিতা লেখা আর হয়ে ওঠে না। বলতে পারেন, এটা এক ধরনের ব্যর্থতা। নিজের চরিত্রের অসমর্থতা। আরেকটাও ব্যপার আছে, আমি লিখি কিন্তু প্রকাশ করি কম। এটা বলতে পারেন আমার একটা বৈশিষ্ট্য। আর কম লেখা বা বেশি লেখাকে ম্যাটার করে বলে মনে করি না। পৃথিবীর অনেক বড়ো বড়ো কবি আছেন যারা খুবই কম লিখেছেন। ধরেন, টিএস এলিয়ট সারা জীবনেই কবিতা লিখেছেন মাত্র বিরাশিটি। সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কবিদের একজন। কম লিখেছেন ভালো লিখেছেন। গত এক’শ দেড়’শ বছরের মধ্যে বিখ্যাত বা ভালো কিছু করে থাকলে টিএস এলিয়টই করে দেখিয়েছেন। ওদের যে গুরু সে কবিতা লিখেছে মাত্র আটটি। কবিতার বই প্রকাশ করেননি। এজরা পাউন্ড বা অন্যরা তার কবিতা দেখে। জীবনানন্দ মরে যাওয়ার পর অনেক বড়ো কবি হয়ে গেলেন। কিন্তু জীবনানন্দ জীবদ্দশায় টোটাল কবিতা ছিল আড়াই’শ বা তিন’শ। আবার ধরেন, অনেক অনেক কবিতা লিখছেন কিন্তু হচ্ছে না। আবার না লেখাটাও বড়ো ব্যপার না। তো আমি আছি এর মধ্যবর্তী স্থানে।
জব্বার আল নাঈম: টিএস এলিয়টের ৮২ সংখ্যাটি উল্টালে আপনার ছুরি চিকিৎসার কবিতার সংখ্যা সমান হয়ে যায়।
সাজ্জাদ শরিফ: হা হা হা… ভাবিনি তো। আসলে কবিতা লেখা তো অনেক কঠিন। আর আমার কবিতা ভালো কিংবা খারাপ তা তো বলা আরও মুশকিল। আমার কবিতা কোন পাঠকের কাছে পৌঁছাবে আর কোন পাঠকের কাছে পৌঁছাবে না, অদৌ পৌঁছাল কি না তা জানি না। কিন্তু, আমার কথা হলো, যদি হয় এর মধ্য দিয়েই হবে। আর যদি না হয় এর মধ্য দিয়েও হবে না।
জব্বার আল নাঈম: আপনি বলেছেন জীবন-জীবিকার তাগিদে সাংবাদিকতায় এসেছেন। একটা সময় বিমা কোম্পানিতে ছিলেন। প্রাইভেট ফার্মে কাজ করেছেন। সবশেষে সাংবাদিকতায় থিতু। আপনি কবিতা লেখার কারণেই সাংবাদিকতা বেছে নিয়েছেন?
লেখালেখি ছাড়া আসলে আমার অন্যকোনো যোগ্যতা নেই। আর যারা লেখালেখি করেন তাদের জন্য সাংবাদিকতা ভালো। অধ্যাপনাও ভালো। তো শিক্ষকতার ক্ষেত্রে শিক্ষার জন্য বা পড়ালেখার জন্য যে সময় ব্যয় করতে হবে তা আমার নেই। আমি তো বখে যাওয়া ছেলে। সো, আমার বেলায় তা করার সুযোগ নেই।
সাজ্জাদ শরিফ: লেখালেখি ছাড়া আসলে আমার অন্যকোনো যোগ্যতা নেই। আর যারা লেখালেখি করেন তাদের জন্য সাংবাদিকতা ভালো। অধ্যাপনাও ভালো। তো শিক্ষকতার ক্ষেত্রে শিক্ষার জন্য বা পড়ালেখার জন্য যে সময় ব্যয় করতে হবে তা আমার নেই। আমি তো বখে যাওয়া ছেলে। সো, আমার বেলায় তা করার সুযোগ নেই। এটা একটা ব্যাপার। আর সাংবাদিকতায় তো প্ল্যান করে আসিনি। বন্ধুরা পত্রিকা করেছিলেন ৯১ সালে। সেখানে যুক্ত হয়ে বন্যার স্রোতের মতো প্রবাহিত হয়ে গেছি। একটা সময় মায়া জন্মেছে। একটা কাজে দীর্ঘদিন থাকলে যেমন মায়া জন্মে। দীর্ঘদিন একটা বিড়াল পুষলেও মায়া জন্মায়। তাই না?
ধরেন, হাতপাতালে আপনার বাচ্চা জন্মায়। ঘটনাচক্রে সেখানে অন্য বাচ্চা চলে আসে। ব্যাপারটি আপনি জানেন না। দেখা যায়, বাচ্চাটি আপনি লালন-পালন করেছেন। যদিও আপনার সাথে তার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। এই পেশাটার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি। যৌবনের পুরোটা সময় কাটিয়েছি। আর পত্রিকায় কাজ করতে করতে অনেক কিছু দেখেছি শুনেছি আর শিখেছি। ফলে এখানেই থেকে গেছি।
জব্বার আল নাঈম: আমি শিকারের সন্ধানে চলি/ দিগন্ত পাড় হয়ে/ অন্ধের লাঠি হাতে…
ক্যালকুলেশন করলে দেখা যায়, মানুষ আসলে অন্ধের লাঠি হাতে শিকারের সন্ধানে ছুটছে তো ছুটছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ। এটা কি আপনার কবিতার স্বার্থকতা?
সাজ্জাদ শরিফ: শোনেন, এখানে সত্যি কথা কি, আমার কবিতা আমার পক্ষে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। বিষয়টি হলো, কবিতা লেখা অদ্ভুত একটি প্রক্রিয়া, যেখানে সচেতন বা সজ্ঞানে লেখা কাজ করে না। এটা এমন এক অবস্থানে থেকে প্রত্যেকে লেখেন সচেতনতা বা সজ্ঞানতা কাজ করে কম। কবিতা যুক্তির বাইরের জগৎ থেকে আসে। পৃথিবীকে আপনি উপলব্ধি করছেন। আপনি কবিতা লিখছেন কখন? যখন আপনি স্বাভাবিকভাবে ভাষা দিয়ে কোনো কথা বলতে পারছেন না। ধরেন, যে ভাষায় আপনি কথা বলেন সে ভাষায় আপনি যখন মনের কথা প্রকাশ করতে পারছেন না তখনই আপনি কবিতার আশ্রয় নিচ্ছেন। ফলে, একজন কবি কবিতায় যা বলছেন কবিতার বাইরে তা বলতে পারছেন না। আমি বলতে চাচ্ছি না যে বলার সাধ্য নেই। কিন্তু, আমার পক্ষে বলা বেশ কঠিন।
যেমন, এরোপ্লেন বা হেলিকপ্টার বা একটা গাড়ির উদাহরণ আছে। আপনি দেখবেন আমাদের কবিতায় প্রাইম উপাদান বা মৌলিক উপাদান যেগুলোতে মানুষ থাকে—মানুষের বেঁচে থাকা—মানুষের সম্পর্ক—মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের যে পদ্ধতি আছে, তাতে প্রত্যক্ষ রিপ্রেজেন্টেশন পাবেন না। আমার কবিতা হলো, একটি অর্গানিক প্রক্রিয়া। আমার কাছেই ব্যাখা নেই। কদিন আগে দেখলাম কবি মাদল হাসান একটি কবিতার ব্যাখা করেছে। আমরা এরশাদের শাসনামলে বড়ো হয়েছি। তখন রাজনৈতিকভাবে খুবই টালমাটাল অবস্থা। তরুণরা তখন সবাই লড়াই করছে। আবার মারা যাচ্ছে। ফলে সে সময়ের কিছু কবিতা থাকতে পারে। আসলে থাকাটা স্বাভাবিক। আমরা বড়ো হয়েছি প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে। আমিও তখন মিছিল-মিটিং এ যোগ দিচ্ছি। অনেকেই সঙ্গী ছিল। সেখানে আমার চারপাশের অবস্থানও থাকতে পারে। পরিবেশেরও ভূমিকা ছিল। আবার আমার ব্যক্তিগত কিছু বিপর্যয়ও থাকতে পারে। আসলে আমরা কবিতা যে রকম লিখতে চেয়েছিলাম…
জব্বার আল নাঈম: কী রকম কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন?
সাজ্জাদ শরিফ: দেখেন কবিতা দুই রকমের হতে পারে। বা দুই ভাবে হয়। একটা রাজনৈতিক অন্যটি প্রেমের। অথচ, এছাড়াও মানুষের অনেক অনুভূতি আছে। আমরা যখন পৃথিবীতে বেঁচে থাকি আমাদের অন্তরের একটা জগৎ আরেকটা বাইরের জগৎ। যখন একজন লোক অন্তরঙ্গভাবে রাতের শয্যায় স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হতে যাচ্ছেন, তখন টিভিতে যদি দেখায়— ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট। তাহলে রাষ্ট্র কিন্তু ব্যক্তির ব্যক্তিগত অবস্থানে ঢুকে যাচ্ছে। তাহলে কোথায় রাষ্ট্র? আর কোথায় ব্যক্তিগত অবস্থান? আসলে একটা একটার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। ভেঙে দেয়। গ্রাস করে।
জব্বার আল নাঈম: এ নিয়ে আপনাদের আলাদা কোনো ভাবনা ছিল?
সাজ্জাদ শরিফ: ছিল। ইচ্ছা ছিল। কবিতার জগৎ নিয়ে আমাদের একটা ইচ্ছা ছিল, এটাকে এমনভাবে করতে হবে যেন দুইটা জগতে মানুষ অনায়াসে আসা যাওয়া করতে পারে। ফলে ব্যক্তিগত আর সামাজিক যেখানে কোনো পার্থক্য থাকবে না। আমার চারপাশে যা কিছু ঘটছে আমার মনের মধ্যে যা কিছু ঘটছে তার মধ্যে একটা যোগ থাকবে বা থাকতে হবে। আমাকে যদি বলেন একটা পার্টিকুলার কবিতা লিখতে তা আমার পক্ষে কঠিন হবে।
জব্বার আল নাঈম: আপনার কবিতা তো রাজনৈতিক ইঙ্গিত দেয়। যেমন : টসবগে লাভার উপরে, সন্নাস ভেঙে লক্ষ বছর/ ঝরাচ্ছি বীজ ছড়িয়ে চলছি।
সাজ্জাদ শরিফ: আপনার প্রশ্নটিও রাজনৈতিক। সারা পৃথিবীর মানুষ নায্য অধিকার পায় না। এটাই সত্যি কথা। সারা পৃথিবীতে লড়াই চলছে। মানুষ মুক্তির সাধনা করছে। কিন্তু, মুশকিলটা হচ্ছে মানুষ একটা প্রাণী। ধরুণ, আমি একটা প্রাণী। আমি ততক্ষণ পর্যন্ত মুক্ত না যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি মুক্ত না হবেন। মানুষ অন্যকে যুক্ত করে নিজেকে মুক্ত করতে পারে। ভাই, মানুষ এক অদ্ভুদ প্রাণীর নাম। ফলে, এই যে সবাইকে নিয়ে মুক্ত হবার সংগ্রাম সেটাই মানুষের চরিত্র। সংগ্রাম কখনই শেষ হয়ে যায়নি। আপনি যদি পার্টিকুলারলি দেখেন দেখবেন মানুষের পরিবর্তন কই? ভেবেছি মানুষ সচেতন হবে। কিন্তু, হয় না।
জব্বার আল নাঈম: এই যে সচেতনতার কথা বললেন, আসলে বাহ্যিক এত চাপে একজন মানুষের কতটা সচেতন হওয়া সম্ভব?
সাজ্জাদ শরিফ: সারা পৃথিবীতে পুঁজিবাদের নামে শাসনতন্ত্র চালু হয়েছে। সেখান থেকে কারো রেহাই নেই। এখন কবিতা লিখে সেগুলো থেকে পার পাওয়া যাবে তাও বলা যাবে না। কবিতা মানুষের মতোই অসহায়। কবি যেটা করতে পারে। দেখুন কবির কাজ দুটি, একটি ক্রমাগত ভাষাকে আক্রমণ করে ভাষাকে টিকিয়ে রাখা। যে ভাষা মানুষের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ভালোবাসা সব সময়ই সঞ্চরণ করতে পারে। মানুষের স্বপ্নের যেন মৃত্যু না ঘটে। ফলে মানুষ একটা প্রাণী যারা সীমা অতিক্রম করতে পারে। অন্য কেউ তা পারে না। দেখবেন এখনকার মানুষ খুবই স্পিডে দৌড়ে লক্ষ্যে পৌঁছে। কিন্তু অন্য প্রাণীরা তা পারছে না। বা পারবে? দেখা যায় পরবর্তী বছর সে রেকর্ড থাকছে না। আরেকজন ভেঙে ফেলতে পারে। কারণ মানুষ কোনো সীমার মধ্যে কোনো কালে আটকে থাকতে পছন্দ করে না। আটকায় না। তো কবিতা হচ্ছে মানুষ যে বারবার সীমানা ভাঙে তা প্রমাণের বড়ো একটা জায়গা।
কবিতা হচ্ছে সেই জিনিস যেটা মানুষকে অতিক্রম করায়। আর যে ভাষার জগতে থাকি তার সাথে সম্পর্ক রাখতে হয়। ভাষার সাথে সম্পর্কের ফলে কবিতার জন্ম। ফলে মানুষরে মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে যে মুক্ত হবার স্বপ্ন। কবিতার মধ্যে তা ফুটে থাকে। এমনকি কবিতা যে সব সময় প্রতিবাদী হবে এমনটাও নয়। কোনো একটা ব্যক্তিগত অনুভূতির কথাও কবিতা হতে পারে। কবিতায় কোটি কোটি মানুষের অনুভূতির প্রকাশ পায়।
জব্বার আল নাঈম: ভাই, কবিতায় কোটি কোটি মানুষের অনুভূতি থাকে যেমন তেমনি চিত্রকল্পও থাকে। কথা হলো, উত্তরাধুনিক কবিতার চিত্রকল্প কেমন হবে?
সাজ্জাদ শরিফ: আপনি এখানে দুটি বিষয় উপস্থাপনা করেছেন। আর প্রত্যেকটি নিয়ে আলাদা আলাদা আলোচনা করা যায়। একটি হচ্ছে কবিতা কোন দিকে যাবে সেটা কেউ জানে না। আমি যদি জানতাম কবিতা এদিক বা সেদিক যাবে তাহলে আমি ওইভাবেই লিখতাম। হয়তো প্রত্যেকেই সেইভাবে লিখত। কবিতা বা যেকোনো শিল্পের কোনো রকম ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। আপনি লিখবেন বা ভালো একজন কবি যে কবিতা লিখবেন, যে পথে লিখবেন, সেগুলোই ভালো কবিতা। যখন ভালো মানের কবি ধারণা করবে কবিতা উত্তর দিকে যাবে। তখন কবিতা দক্ষিণ দিকে যাবে না। কবিতা উত্তরমুখী হবে।
আমাদের এখানে চিত্রকল্প নির্ভর কবিতা… কবিতা তো চিত্রকল্প আর ধ্বনি দিয়ে কথা বলে। এ দুটিকে দিয়ে কথা বলা সম্ভব। সাউন্ড আর ছবিই কবিতা। আমার কাছে যেটা মনে হয় চিত্রকল্পের চেয়ে ধ্বনির উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে গেছে। এটা আমার কাছে সমস্যাই মনে হয়।
জব্বার আল নাঈম: আর দ্বিতীয়ত কোনটা?
সাজ্জাদ শরিফ: বলছি। আমাদের এইখানে একটা প্রবলেম আছে। সারা পৃথিবীতে আমরা ধরে নেই কবিতা কোনো মানুষ লিখছে। মানুষের নিজস্ব একটা স্বভাব আছে, মানুষ তার স্বভাবের ভেতর দিয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যেক মানুষ এক। কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যেক মানুষ আলাদা। আমি যখন একজন কবিকে পড়ি। কেন পড়ি? আমি কিন্তু কিছু একটা বৃত্ত রচনা করে থাকি। আমরা আমাদের ইগো আর অহংকারের ভেতরে বন্দি হই। যখন আবার একজনের কবিতা রেখে আরেকজনের কবিতা পড়ি তখন আমার ইগো থেমে যায়। কারণ, সেই কবি এমন একটা অনুভূতি দেখায়, সেই অনুভূতির ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়। তার অনুভূূতির ধাক্কায় আমাকে দূরে ফেলে দেয়। আমি নতুন জ্ঞান আহরণ করি। একেক মানুষ একেক কবিতা লেখেন আবার নিয়ে আসেন। আমাদের এখানে সেই ছকবাঁধা নিয়েমে লেখা হয়। যেটা আমাদের জন্য বাধা।
যারা সক্ষম কবি তাদের বোঝা উচিত, ভাবা উচিত আমার পৃথিবী আমি যেভাবে দেখছি যেভাবে লিখছি সেইভাবেই লিখব এবং ভাব প্রকাশ করব। আমরা করি কি, অনুভূতিগুলোকে সবাই এপ্রিশিয়েট করতে থাকি। ফলে ধরে নেই এটাই ভালো কবিতা। আমাদের এখানে চিত্রকল্প নির্ভর কবিতা… কবিতা তো চিত্রকল্প আর ধ্বনি দিয়ে কথা বলে। এ দুটিকে দিয়ে কথা বলা সম্ভব। সাউন্ড আর ছবিই কবিতা। আমার কাছে যেটা মনে হয় চিত্রকল্পের চেয়ে ধ্বনির উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে গেছে। এটা আমার কাছে সমস্যাই মনে হয়। আগের দিন, যেমন রবীন্দ্রনাথ—ত্রিশের জীবনানন্দ— এমনকি কাজী নজরুল ইসলামও। পরবর্তীতে যে কবিরা এসেছেন তারাও ধ্বনির ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এর অবশ্য একটা কারণ ছিল, তখন তো আর ছাপানোর যন্ত্র ছিল না। ফলে মানুষ যখন শুনবে তখন তা মনে রাখবে। তারপর কানে কানে পরবর্তী জেনারেশনের কাছে কবিতা প্রেরণ করবে। আমরা এখনও চন্ডিদাসের কবিতা পড়ি। কেন পড়ি? তখন তো ছাপাখানা ছিল না। তখন মানুষ শুনেই মনে রাখতে পারত। কানের মধ্যে অনেক কিছুই ভালো লাগে। মুদ্রণযন্ত্র হওয়ার পরে কবিরা বাহাদুর হয়ে উঠছেন। আমি যেহেতু ছাপতে পারি প্রকাশ করতে পারি। তাহলে বই করে ফেলি। এটা একজন কবিকে এমন এক অহংকারের জায়গায় নিয়ে গেছে। যা কল্পনা করা যায় না। তবে, আমি মনে করি সব কবিই চিত্রকল্পের দিকে আবার ফিরে আসবেন। যেখানে তিনি ছবি ব্যবহার করবেন, চিত্র ব্যবহার করবেন, আবার ধ্বনিটাকে নিয়ে আসবেন। মোট কথা কোনোটাই বাদ দিয়ে করবেন না।
জব্বার আল নাঈম: আপনি মুদ্রণ যন্ত্রের কথা বললেন। আমার মনে হচ্ছে, আরেকটি বিষয়ও টানা যায়। পাঠকের মনে রাখার সুবিধার্থে ছন্দের প্রচলন শুরু। এমনটা দাবি করতে পারি?
সাজ্জাদ শরিফ: ধ্বনি মানে ছন্দ নয়। ধ্বনি মানে মিল নয়। কবিতারর ক্ষেত্রে ছন্দ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এখনও রাখছে কিন্তু সেটাই শেষ নয়। অন্তঃমিলের ফলে যে মানুষ কবিতা মনে রেখেছে সবটা ভাবা ঠিক নয়। হোমারের কবিতার মিল নেই। কিন্তু, মানুষ মনে রেখেছে। ধ্বনি আছে। ব্যপারটা হচ্ছে কবিতায় ধ্বনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কবিতায় তো প্রেসক্রিপশন দেয়া যায় না। তবে, একেক জন কবি একেক ভাবে কবিতা লিখছে। আর এখনকার কবিরা যে জায়গায় আছেন সেখানে বেশিদিন থাকবে না। কারণ, পাঠকরা যেভাবে দ্বিমুখী হচ্ছে এটা একটা সমস্যা। এই সমস্যাগুলো অতিক্রমের জন্য কবিকেই এগিয়ে আসতে হবে। চিন্তা করতে হবে। আমি মনে করি কবিরা তা পারবেন।
জব্বার আল নাঈম: প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ এখনও মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম বা অন্যান্য কবি যারা বেশি অন্তমিলে কবিতা লিখেছেন তাদের বেশি পাঠ করে থাকে। গদ্য কবিতা সেভাবে পৌঁছাচ্ছে না বলা যায়। এটাকে কিভাবে দেখবেন?
সাজ্জাদ শরিফ: একাধিক কারণ আছে। আমি তো গবেষক নই, তাই হয়তো সব বলাও সম্ভব নয়। একটা গৌণ কারণ থেকে মুখ্য কারণে যাই। আমাদের এখানে যে কবিতা পড়তে হবে তার কোনো গুরুত্ব আছে? কবিতার জন্য যে সংবেদনশীলতা দরকার তা গড়ে তুলতে হবে। তা হয়? সেটা আমাদের এখানে নেই। আমাদের মানুষগুলো কীভাবে বাঁচে? কবিতা তো এমন একটি জায়গায় অবস্থান করবে— যেখান থেকে উঠে আসবে, তারপর মানুষ হিসেবে বাঁচবে। কবিতার আগে প্রাণি হিসেবে বাঁচতে হয়। তারপর মানুষ হিসেবে।
দ্বিতীয়ত, সমকালীন সময়ের কবিতাগুলো সব সময়ই জটিল মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের সময়ে তার কবিতা বোঝা যেত না। এগুলো পয়ার কবিতা। জীবনানন্দের সময়ে তার কবিতা বোঝা যেত না। এগুলোকে বলা হত হেয়ালী কবিতা। বোঝা যায় না। তখন সবাই বলা শুরু করল রবীন্দ্রনাথের কবিতা সহজ ছিল। বুদ্ধদেব বসু যে কিনা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেছিলেন। কিন্তু বড়ো কারণ, সম্ভবত এই আমাদের আধুনিক সময়। গত কয়েক দশকে যে জীবন নিয়ে আমরা বেঁচে আছি তাদের অধিকাংশই গ্রাম-গঞ্জের মানুষ। তাদের সঙ্গে আমাদের কবিতার একটা বিচ্ছেদ আছে এবং আমরা যে জীবনযাপন করি এটা সারা বাংলার মানুষের জীবনযাপন নয়। সমস্ত মানুষের জীবনযাত্রায় পা দিয়ে আমরা জীবনযাপন করছি। তাদের সঙ্গে আমাদের একটা বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। ফলে, আমার কবিতা ভাষার প্রকাশ। এবং আমি যেই জীবনে বাঁচি সেই জীবনে কবিতায় তো তার প্রকাশ ঘটবে স্বাভাবিক। যদিও জীবনযাপন এবং কবিতার ভাষায় মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। সেখানে কেবল জসীমউদদীনকে (জসীমউদদীনের সাহিত্য) পাওয়া যায়। আমাদের মধ্যে সেই পল্লী সাহিত্য পাওয়া যায় না। আবার যারা সংস্কৃতি যাপন করছে তারা হয় পালা দেখছে। না হয় জারি শুনছে। কিন্তু, করছে না।
জব্বার আল নাঈম: অনেকের ধারণা, অভাবের কারণে মানুষ সংস্কৃতি বিমুখ।
সাজ্জাদ শরিফ: একদমই না। ওদের সময়কার শিল্প সামগ্রিকভাবে আমাদের সেই জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মূলত জীবনের সঙ্গে সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন আছে। আমাদের রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা সব কিছু মূলত বিচ্ছেদের মধ্যে আছে। আমাদের দেশ মূলত দুইটা, যার মধ্যে কোনো ব্রিজ বা সেতু নেই এবং শিল্প ও সাহিত্য তার বাইরে নয়।
জব্বার আল নাঈম: আগে এত মিডিয়া ছিল না। মানুষের কাছে কবিতা সহজে পৌঁছাত না। এখন মিডিয়া কবিতা পৌঁছে দিচ্ছে তার পরও মানুষ পড়ছে না। কীভাবে দেখবেন এই বিষয়টা?
সাজ্জাদ শরিফ: হা হা হা… এটা এভাবে বলা কতটা ঠিক তা জানি না। কারণ, নজরুলের সময় অনেক কবি ছিল। রবীন্দ্রনাথের সময় অনেক কবি ছিল। তেমনি করে জসীমউদদীন বা জীবনানন্দের সময়েও অনেক কবি ছিল। কিন্তু মানুষ মনে রেখেছে এদের কয়েকজনকে। এরা যে অনেক বড়ো কবি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা তো আমাদের পিস্তল ঠেকিয়ে তাদের কবিতা মুখস্থ করার কথা বলেন নাই। তাদের কবিতা আমাদের মনে রাখাতে বাধ্য করেছে। এটাকে বিচ্ছিন্নতার কারণই বলব।
ওরা হচ্ছে—রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, যা রক্তকবরীতে পড়েছি তারা প্রদীপের তেল। সলতে জ্বালিয়ে আমরা আলো নিচ্ছি। তো এখন হয় কি, ওরা টিভিতে যদি দেখত তাহলেও হতো। তারা তো দেখতে পাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ জীবনযাপনের সাথে যখন বিনোদনের মিল খুঁজে পায় না তখন সেটাকে ফালতু বলে উড়িয়ে দেয়। মাথার উপর দিয়ে চলে যায়।
জব্বার আল নাঈম: কবিতা সব সময়ই উপমা উৎপ্রেক্ষা দাবি করে। এই দাবিটা সব সময়ই সত্য?
সাজ্জাদ শরিফ: আসলে উপমা বা উৎপ্রেক্ষা নিয়ে ভালো আলোচনা করতে পারেন শিক্ষকরা। আমি কবিতা লিখি, কবিতা পড়ি, তরুণদের কবিতা পড়ি, কারো কারো কবিতা ভালো লাগে। কিন্তু সব কিছু মিলিয়ে যে কবিতা আগাবে সে রকম কবিতা আমি দেখি না। জোয়ারের সঙ্গে ভেসে যাবে এমন কাউকে পাচ্ছি না। বেশির ভাগই মন্দের ভালো লিখছেন। এটা আমাদের সময়ও ছিল, এই সময়েও আছে। আল মাহমুদের সময়ও ছিল। মন্দের পরিমাণ বেশি ছিল। ভালোর পরিমাণ কম। তো, যেটা বললাম, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প দিয়ে কবিরা নানান কিছু করেছেন, বস্তুত কবিতা শিল্পের জিনিস। মূলত আমি যা দেখছি তাই। আমাকে আনন্দ দিচ্ছে— এটাই। উপরের তলায় কিছু দেখছি না। এখানে মনে হয় শব্দের খেলাটাই প্রধান। মোবাশ্বেরের গল্পের মতো, কিন্তু মোবাশ্বেরের গল্প হচ্ছে তৃতীয় শ্রেণির গল্প। শেষে গিয়ে দেখা যায় একটা চমক দিচ্ছেন। যেটা ভাবছি সেটা না, শেষে অন্য কিছু বুঝাচ্ছেন। কবিতা হলো শেষের একটা উপলব্ধি। কারণ কবিতা যখন পড়ব, তখন আলাদা একটা অনুভূতি জাগ্রত হবে। কবিতা পড়ার আগে যে মানুষ ছিলাম, কবিতা পড়ার পর সে মানুষ থাকব না।
উপমা, উৎপ্রেক্ষা যাই হোক না কেন আমি চাই সেই ভাষার মধ্য দিয়ে এমন একটা উপলব্ধি যার ভেতর দিয়ে পৌঁছাতে চাই নতুন এক অভিজ্ঞতায়। কবিতা পড়ার পর আর সেই আগের মানুষটা থাকব না। আজকাল কিছু কবিতায় চিত্রকল্প বা উপমা মনে হয় উদ্দেশ্যহীন। কারণ কী? এ সময়ের কবিতায় উৎপলকুমার বসুর কবিতার বেশ প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেছিলেন, মানুষ যেভাবে কথা বলে আমি সেভাবেই কবিতা লিখব। একটা পাগল যার একটা কথার সঙ্গে আরেকটি কথার কখনই যোগসূত্র নেই, যার ফলে ওঁর কবিতা আমি ধরতে পারি না। যেখানে এক বাক্যের মধ্যে আরেক বাক্যের যোগসূত্র থাকবে না।
এ সময়ের কবিতায় উৎপলকুমার বসুর কবিতার বেশ প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেছিলেন, মানুষ যেভাবে কথা বলে আমি সেভাবেই কবিতা লিখব। একটা পাগল যার একটা কথার সঙ্গে আরেকটি কথার কখনই যোগসূত্র নেই, যার ফলে ওঁর কবিতা আমি ধরতে পারি না। যেখানে এক বাক্যের মধ্যে আরেক বাক্যের যোগসূত্র থাকবে না।
পৃথিবীকে চশমা পড়া অবস্থায় দেখলে এক রকম আবার খালি চোখে আরেক রকম লাগবে। অর্থাৎ আলাদা অনুভূতি। আর উৎপলকুমার বসুর কবিতার এক লাইনের সাথে আরেক লাইনের সম্পর্ক নেই। মনে হয় না আছে। কিন্তু সবটা পড়ে ফেলার পর আলাদা একটা অনুভূতি দাঁড়ায়। কিন্তু আমরা সবাই ঝাঁকে ঝাঁকে যদি তাকে অনুসরণ করি তাহলে কিভাবে কবিতা হয়? সে তো করেছে একটা বিশ্বাস বা তার নিজস্ব উপলব্ধির একটা জায়গা থেকে। এর ফলে কী হয়— হয় অনুসরণ প্রবণতা। অনেক সময় হয় কী, যারা ফলো করছে তাদের কথা বলছি, যার ফলে এলোমেলো একটা অর্থ বা ভাব দাঁড়ায়। বা কখনো কখনো, যারা খুব বুদ্ধিমান বা পারঙ্গম তারা তাদের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কাব্য সম্পূর্ণ করলে মনে হয় আলাদা চমক আছে। আমি তো শব্দের উপর পা দিয়ে উপরে উঠতে চাই, উপরে উঠলে আমি আরও অনেক কিছু দেখতে পাব, এটাতে সংকট হয় মাঝে মাঝে; কিন্তু সবারটা এমন নাও হতে পারে। কেউ কেউ আছেন অনেক ভালো লেখে বা অন্যরকম কিছু দেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে যে একটা হিস্টোরির মতো হয়, এখন তা চলছে। এটাই ভয়ের ব্যপার।
জব্বার আল নাঈম: উৎপলকুমারের কথা বললেন বা পাগলের কথা আওড়ানোর কথা বললেন, আমরা যদি এর কোনো একটার আলাদা অর্থ খুঁজি তাহলে, সেটাকে উত্তরাধুনিকের উদাহরণ বলা যায়। তাহলে আমি বলব উৎপল উত্তরাধুনিক কবিতার চর্চা বা টাচ করেছেন।
সাজ্জাদ শরিফ: আমার কথা সোজাসাপটা, আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার তর্ক হলো তত্ত্বীয় জগতের তর্ক। সাহিত্য জগতের তর্ক না। কবিরা যখন এসব তর্ক সাহিত্য জগতে নিয়ে আসে তার চেয়ে মারাত্মক কিছু আমি দেখছি না। কবির কাজ লেখা। কবিরা তর্কে যাবেন কেন। নজরুল কোনো তর্কে যেতেন না। রবীন্দ্রনাথ যেতেন না। কবি দেখবেন মানুষ কি করে। সেটা কি কবি দেখছেন? এর বাইরে অন্য কিছুর দেখার দরকার আছে বলে মনে করি না। আধুনিকতার সমালোচনা হিসেবে উত্তরাধুনিকতা বা পোস্ট মর্ডানিজম এসেছে। এটা আমার কাছে সম্পূর্ণরূপে তত্ত্বগত একটি জায়গা। যারা এটা নিয়ে কথা বলেছেন, তারা গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রশ্ন খুঁজেছেন। আমি মনে করি পোস্টমর্ডানিজম নিয়ে যারা কথা বলে সে রকম একজন গায়েত্রী চক্রবর্তী, উনি দেরিদা প্রথম অনুবাদ করেছিলেন, আমার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন যে, কবির এসব নিয়ে ব্যাখা বা তর্কে যাবার কি দরকার, কবির কাজ কবিতা লেখা। গায়েত্রী বলেছিলেন বলে নয়, এটা আমি নিজেও বিশ্বাস করি। কিন্তু তত্ত্বের জগতের লোকের কাছে কবি যাবেন কেন? কবি যাবেন প্রাইমারি লেভেলের লোকের কাছে। এটা ফালতু নিয়ম। আমি মনে করি দূরবীন আকাশ থেকে নামিয়ে মানুষের দিকে নিয়ে আসা উচিত। নিচের দিকে তাক করাতে হবে। তাহলেই একজন কবির সত্তা ভালোভাবে প্রকাশ পাবে। হা হা হা…
কবি ও কথাসাহিত্যিক। জন্ম ১১ নভেম্বর, ১৯৮৬; চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার বদপুর গ্রাম। হিসাব বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। পেশায় সাংবাদিক। বর্তমানে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়েটিভ বিভাগের সঙ্গে যুক্ত। ‘জীবনের ছুটি নেই’ পাণ্ডুলিপির জন্য পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০২০। প্রকাশিত বই : তাড়া খাওয়া মাছের জীবন [কবিতা; শুভ্র প্রকাশ, ২০১৫], বিরুদ্ধ প্রচ্ছদের পেখম [কবিতা; বিভাস প্রকাশন, ২০১৬], এসেছি মিথ্যা বলতে [কবিতা; চৈতন্য, ২০১৭]। কিশোর উপন্যাস :বক্সার দ্য গ্রেট মোহাম্মদ আলী [ অন্বেষা প্রকাশ, ২০১৯]।