‘দস্তুরমতো কেবল ঘটনাই নয়, রীতিমতো এক সংঘটন। চোর ডাকাত বংশের ছেলে হঠাৎ কবি হইয়া গেল।’
এই হলো তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসের আরম্ভ। উপন্যাসের নায়ক নিতাই তখনও কবি হয়ে ওঠেনি। কবিগানের দলে ঢুকেছে মাত্র। কিন্তু জীবনের আশ্চর্য বিরহবকুল পথে ছড়াতে ছড়াতে সে দেখে জীবনে ঝড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়িটা সহজে মেলে না। তবু জীবনের এই গুড়ো গুড়ো বিস্ময়ের দিকে, অক্ষম বেদনার দিকে তাকিয়ে, বাতাসের ধমনীতে সে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়—‘জীবন এত ছোট কেনে?’ এই তৃষ্ণা, এই প্রশ্নই নিতাইকে কবি করে তুলেছিল, কবিয়ালের আসরে তার জয় পরাজয়গুলো নয়।
অন্যদিকে, চিলির আইলা নিগ্রাতে এক অকম্মার ধাড়ি পোস্টম্যান। সমুদ্রের ধারে মৎস্যজীবী জনপদে রোদ, নুন আর মেটাফর বিলি করে। নিরক্ষর জনপদে তাঁর চাকরি খুব সরল। তিমি মাছের মতো ভারী একগাদা চিঠি তাঁকে বয়ে নিয়ে যেতে হয়, খুদে মাছ ধরার বোটের মতো তাঁর সাইকেল। কিন্তু সেই নিরক্ষর সমুদ্রপৃথিবীতে চিঠি বিলি করার মতো কেই-বা আছে? আছেন একজনই, তিনি পাবলো নেরুদা। দুনিয়াখ্যাত কবি আর কমুনিস্ট। সুইডেন থেকে আসা চিঠিগুলো যিনি যত্ন করে পড়েন, কেননা তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে নোবেল পুরস্কার। কবিই পোস্টম্যানের একমাত্র ক্লায়েন্ট। পোস্টম্যানের যা বেতন তাতে নুনের ব্যবস্থা হলেও পান্তার ব্যবস্থা নেই, বলতে গেলে মিনিমাগনার চাকরি। আয়ের উপায় একটাই, নেরুদার দেওয়া মোটা বকশিস। কবির সঙ্গে খাতির রাখাটা জরুরি, এই ছুতোয় পোস্টম্যান তাঁর বই কিনে অটোগ্রাফ নিতে যায়। জিজ্ঞেস করে কবিতা কী। নেরুদা বললেন কবিতা হচ্ছে মেটাফর। পোস্টম্যান মেটাফর বোঝে না, কবি তাকে নানাকিছুর সাথে বলেন তুমি যখন বলো আকাশ ছলছল করে উঠছে, সেটা একরকম মেটাফর। পোস্টম্যান বলে আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছিল যেন শব্দের ঢেউয়ে ঢেউয়ে আমার ভাবনার ডিঙি যেন কেঁপে চলেছে! আচ্ছা, আমাদের এই পৃথিবীটা হয়তো অন্যকিছুর উপমা! কবি বিস্মিত হয়ে তাকান, সামনে বসে থাকা এক পোস্টম্যানের দিকে নয়, যেন সামনে বসে থাকা এক কবির দিকে!
পোস্টম্যানের ধান্দা সুবিধার নয়। কবির কাছে যেসকল পত্র আসে অধিকাংশই ধিঙ্গি ধিঙ্গি মেয়েদের প্রেমপত্র। মারিও হিমেনেজ, আমাদের পোস্টম্যান, তার ইচ্ছে এই যে কবির ওপর তার একটা অধিকার আছে, কবির এই বিপুল সম্মান আর প্রতিপত্তির ভাগ কিছুটা তো তারও, সে কি কবির বন্ধু হতে পারে না? আর তাতে কি আইলা নিগ্রার দুর্ধর্ষ পীন পয়োধরা মেয়েরা তাকে একটু বেশি গুরুত্ব দেবে না? হিমেনেজেরই বা দোষ কী? বেচারা এক মেয়ের প্রেমে পড়েছে। সে ধরল কবিকে– তোমার বই পড়েই আমার এই হাল, নাহলে কি আমি প্রেমে পড়ি? মেয়েটিকে বলি তাঁর হাসি প্রজাপতির মতো, আর কিউবার নীল অন্ধকারের মতো তাঁর দেহ? এখন তুমিই আমার উজ্জ্বল উদ্ধার। নেরুদা প্রমাদ গুণলেন, এই বয়সে এই অবস্থায়, এই ব্যস্ততায় মেঘদূতগিরি করা কি তাঁর পোষাবে? তাঁর ওপর যেখানে হিমেনেজের রয়েছে এক ভয়ংকর ভবিষ্যত-শাশুড়ি। কবি দায়িত্ব নিলেন। তিনিই হলেন হিমেনেজের ঘটক, সংঘটক, গডফাদার। হিমেনেজ সংসারী হলো। বদল এলো চিলিতেও। নেরুদার কমুনিস্ট পার্টি সরকারে গেল, পৃথিবীর প্রথম নির্বাচিত কমুনিস্ট সরকার। নেরুদা আইলা নিগ্রা ছেড়ে চলে গেলেন প্যারিসে, রাষ্ট্রদূত হয়ে। নোবেল পুরস্কার পেলেন, আর হিমেনেজ গাটের কড়ি খরচ করে বিরাট পার্টি দিল আইলা নিগ্রায়। কিন্তু অশনি সংকেত দেশের কোণে কোণে, খাদ্য সংকট, মজুতদার, বিশৃঙ্খলা, সরকারবিরোধীদের প্রবল বিক্রম, এবং প্রেসিডেন্ট নিহত হলেন বিদ্রোহীদের হাতে। নেরুদা ফিরে এলেন, অসুস্থ, ক্যানসারে আক্রান্ত, তাঁর ছোট্ট নিবাস, আইলা নিগ্রার সমুদ্রতটের নিভৃত কুটির। পোস্ট অফিস সেনাবাহিনীর দখলে, নেরুদার বাড়ির চারপাশে উর্দিধারীদের টহল। সরকারি আড়ালের মধ্যেই খোঁজ পাওয়া যায় নেরুদা মৃত।
কবি চলে গেলেন। কিন্তু পোস্টম্যান? যে ভেবেছিল এই পৃথিবীটা আসলে অন্য বহুকিছুর উপমা? আইলা নিগ্রার ঝকঝকে হৃদয়ের রোদ, তুলনাহীন নীল, খাঁড়িতে ফিসফাস জলের শব্দ, মাছের কানকোর শিহরণ? আর তার কাছে থাকা নেরুদার উপহার দেওয়া নোটখাতা, যেখানে সে লিখে রাখত তাঁর আইলা নিগ্রাকে? তাঁর প্রেমিকাকে? তাঁর মেটাফরগুলোকে?
আমরা কিছুদিন পরে দেখব, তাঁর বাড়ির সামনে এসে থামবে উর্দিচালিত ভারী মোটরগাড়ি, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে যাওয়া হবে তাকে। তাঁর উপমাগুলো বহন করে বেড়াব আমরা, যারা বিশ্বাস করি পৃথিবীটাই আসলে অন্য বহুকিছুর উপমা, আর জীবন এত কিছুর পরেও কেন এত ছোটো? গোলার্ধ থেকে গোলার্ধে, কবি হবার বা হয়ে উঠবার বেদনা এক ও সমান্তরাল।
উপরে কথিত কাহিনিটি লিখেছেন আন্তনিও স্কারমেতা। ইংরেজি অনুবাদে যার নাম দ্য পোস্টম্যান। উপন্যাসের ভূমিকা প্রহেলিকাময়, দক্ষিণ আমেরিকার লেখকদের বিখ্যাত প্রিয় গোলকধাঁধা সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে পাঠক ধন্দে পড়ে যাবেন, এটা কি উপন্যাস, প্রতিবেদন, আত্মকথন নাকি অন্য কোনো কিছুর উপমা? উপন্যাসের শেষটাও আপনাকে প্রশ্নে রাখবে নিশ্চিত। এ উপন্যাসের নায়ক নেরুদা বা মারিও হিমেনেজ নয়, এ উপন্যাসের নায়ক কবিতা স্বয়ং।
সাগুফতা শারমীন তানিয়ার দারুণ ও কখনো দুর্গম অনুবাদে আপনি দেখবেন উপকূলের এক কাব্যময় পৃথিবী, সার্ডিন মাছের সংশয়, বিবাদমান পাখিদের দল, শশব্যস্ত কাঁকড়াদের দঙ্গল, সরাইখনার হল্লা, আনন্দমধুর বোকা মানুষের হৃদয়, আর সাহারা পাড়ি দেওয়া সেনাদের মতো তৃষ্ণার্ত জেলেদের জীবন।
কবিরাই তো চিরকালের সেই পোস্টম্যান, যে আপনার বাড়ি বাড়ি উপমার হাহাকার বিলি করে, বিনা বেতনে, একান্ত রক্তপাতে।
জন্ম গোপালগঞ্জ, ১৯৮৭। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান ও গণিতের শিক্ষার্থী ছিলেন। গত এক যুগ ধরে দৈনিক ও সাময়িকীসহ বিভিন্ন মাধ্যমে লিখছেন। প্রকাশিত লেখার মধ্যে রয়েছে কবিতা, গদ্য, গল্প, অনুবাদ এবং বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ, নিবন্ধ। সাহিত্য, বিজ্ঞান, সভ্যতার ইতিহাস, অর্থনীতি তাঁর পাঠ ও চর্চার বিষয়। প্রকাশিত বই : ‘ডুবোপাহাড়’ (২০১৭, কবিতা), ‘প্রাচীন বিজ্ঞান’ (২০১৭, বিজ্ঞান/ ইতিহাস)