সমতলের কবি টুব করে উধাও হলেন অসভ্য ও আগ্রাসী শহরে, এ খবর পৌঁছে গেছে আদিবাসীদের গ্রামে। সেখানে অনেক ছেলেমেয়ে তাঁকে বাবা বলে মেনেছে, কেন না, প্রগাঢ় এক অপত্য স্নেহে তারা লালিত হচ্ছিল বাবার, বাবার নাম, মাহমুদুল হাসান মাছুম। আপাদমস্তক কবি। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ তে জন্মেছিলেন নওগাঁয়। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে কবি মাহমুদুল হাসান মাছুম মারা গেলেন ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ভোরে, ঢাকা শহরে। হার্ট অ্যাটাকের পর হাসপাতাল…এদেশের কোনো হাসপাতাল একজন কবিকে খুব ভালো চিকিৎসা দিতে পারে কি? দিতে চায় কি? প্রায় অফিসিয়ালিই ফাটকাবাজির এই দেশে একজন কবির জন্য কতখানি আর খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা বরাদ্দ থাকে! ফড়িয়া বা ফোড়েরা ঢাকা শহরে সংস্কৃতিকর্মীর নাম নিয়ে দিব্যি দাপটে বসবাস করে। সংস্কৃতির চেয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধুই যেখানে বেশি, সেখানে কবি টিকে থাকতে পারেন? আবার কবি ও কবিতার সংগঠনও কম নয় ঢাকা শহরে। তাহলে?
শহরে কবিও কি এক জাতের হয়? পাড়াগাঁর লালন ফকির ভেবে বললেন, শহরের ষোলোজনাই বোম্বেটে। ফলত, সিক্সটি প্লাস এইজের কবি মাহমুদুল হাসান মাছুমকে আমরা কখনো দেখিনি প্রধান কোনো দৈনিকের সাহিত্য পাতায়। দৈনিকে তো সেই একই কুমির ছানার গল্পের মতো কয়েকটি নাম ছাপা হয় সারাবছর। তাই নিয়েই কী মহাজনী চ্যাদরামো উগরে দেয় সাহিত্য সম্পাদক। আদতে কর্মচারী সাহিত্য সম্পাদক মূল সম্পাদকের বাণিজ্যপনাকেই সাহিত্য হিসেবে বাজারজাত করে যাচ্ছেন। নিশ্চিত, এই বাজারে কবি মাহমুদুল হাসান মাছুম ছিলেন কুমড়ো ফুলের মতো, টাটকা এবং দুর্লভ তো বটেই। তাই তার স্বাদ সবাই নিতে পারেনি। আর কলকেপনা উড়িয়ে দিয়ে আরও কলকে প্রত্যাশী লিটল ম্যাগাজিনের আত্মগর্বী চিৎকারপাড়ায়ও মাছুম প্রণিধানযোগ্যভাবে দৃশ্যমান নন। কিন্তু নিজের বয়সের চেয়ে অনেক কম বয়সের তারুণ্যের সঙ্গে তাঁর অপার ঘনিষ্ঠতা ছিল, হৃদয় নিংড়ানো যোগাযোগ ছিল। নগরীর কোন দূর আবাসিক এলাকা থেকে কবি আসতেন শাহবাগে, শাহবাগ তাঁকে চিনত। কবি মাহমুদুল হাসান মাছুম আসতেন স্বাধীনতা উদ্যানে, উদ্যান তাঁকে জানত। উদ্যানের নাগলিঙ্গম গাছটি তাঁকে ডেকেছিল, বইমেলার ধুলো তাঁকে মেখেছিল। আমরা কবি মাহমুদুল হাসান মাছুমকে দেখেছি বাংলা একাডেমির নিকটবর্তী পরমাণু কমিশনের সামনে ফুটপাতে, চায়ের দোকানে, দেখেছি রমনা কালি মন্দির—পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে, দেখেছি টিএসসিতে, দেখেছি আজিজ মার্কেট—কাঁটাবন কনকর্ড এম্পোরিয়ামের নতুন বইপাড়ার আড্ডায়। শিল্প-সাহিত্য তারুণ্যের আড্ডা তাঁর খাদ্য ছিল। কবিতা তাঁর অক্সিজেন ছিল। সত্যি, কেউ কবিতা চেয়ে নিয়ে ছাপাল কি ছাপাল না, এ নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র খেদ ছিল না। কিন্তু তিনি ব্যস্ত হতেন অন্যদের কবিতা ও গল্প-উপন্যাসের বিস্তৃতি নিয়ে, অন্যদের শিল্পের বিস্তার নিয়ে। এই গুণের গুণিনকে কোথায় পাব আর? এই ভালোবাসা কে বিলাবে আর? অন্যের জন্য নিজ থেকেই নিজেকে এমন বিলিয়ে দেবার মানুষ আজ আছে? কবি মাহমুদুল হাসান মাছুমকে তাই খুব বেশি জানতে পারি না আমরা। আমরা থাকি ‘সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে’, করুণ ডাঙায়।
শিল্প-সাহিত্য তারুণ্যের আড্ডা তাঁর খাদ্য ছিল। কবিতা তাঁর অক্সিজেন ছিল। সত্যি, কেউ কবিতা চেয়ে নিয়ে ছাপাল কি ছাপাল না, এ নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র খেদ ছিল না। কিন্তু তিনি ব্যস্ত হতেন অন্যদের কবিতা ও গল্প-উপন্যাসের বিস্তৃতি নিয়ে, অন্যদের শিল্পের বিস্তার নিয়ে। এই গুণের গুণিনকে কোথায় পাব আর? এই ভালোবাসা কে বিলাবে আর?
আমরা পাহাড় ভ্রমণে যাই। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে আদিবাসীদের গ্রাম। অনস্বীকার্য সত্যি, এদেশের সমতল ও পাহাড়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রবহমান। পাহাড়ের মানুষ বা আদিবাসী মানুষ সমতলকে সরলরেখার মতো বিশ্বাস করতে পারে না। বিশ্বাস করবার কারণও আছে কি? জানি না, সমতলকে নিয়ে পাহাড়ের অভিজ্ঞতালব্ধ সন্দেহ কোনোদিন দূর হবে কি না! কিন্তু সমতলের মানুষ কবি মাহমুদুল হাসান মাছুম পাহাড়ে যেতেন। আমাদের নিয়ে যেতে প্ররোচিত করতেন। পাহাড়ের মানুষ বা আদিবাসী মানুষ তাঁকে তাঁদেরই একজন বলে গ্রহণ করেছিলেন। এ কেমন ভালোবাসা তাঁদের? পাহাড়ে অনেক ছেলেমেয়ে তাদের কবি বাবাকে হারিয়ে ফেলে আর্তনাদ করছে। মাহমুদুল হাসান মাছুমের নিজেরও দুই মেয়ে সন্তান তাদের বাবাকে হারিয়ে হাহাকার করছে। এক মেয়ে বাবার ফেসবুক আইডি থেকে স্ট্যাটাস দিয়ে বারবার বাবার হার্ট অ্যাটাকের পর আপডেট জানিয়ে কবির সুহৃদ বন্ধুদের নোটিস করেছে। তবে সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত হয়তো সবাই ঘুমিয়ে থাকে, তাই সহযোগিতা সেভাবে আসেনি। অবশ্যই কষ্টদায়ক অধ্যায়। কবির স্ত্রী নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন। সব চেষ্টাকে লা-পাত্তা করে কবি চলে গেলেন, কবি হারিয়ে গেলেন। পাহাড়ের প্রত্যন্ত গ্রামে তিনি মৈত্রী পাঠাগার গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম, সে লক্ষ্যে কাজও করছিলেন। সেটি আর হবে কি এখন? নাকি ‘কবি মাহমুদুল হাসান মাছুম মৈত্রী পাঠাগার’ গড়ে উঠবে আমাদেরই সামষ্টিক প্রচেষ্টা ও দায়িত্ব—কর্তব্য—ভালোবাসায়?
কবি মাহমুদুল হাসান মাছুমের কবিতার বইগুলো কোথায় পাওয়া যাবে? তাঁর কবিতার বই ‘বংশোদ্ভূত জোনাকিরা’, ‘হিমঘরে পাখিসঙ্গ’ ‘সবুজ কবিতার ঋণ’। আরও দুটি নতুন কবিতার বই ‘শ্মশানগামী জ্যোৎস্না’ ও ‘ঔপনিবেশিক অন্ধকার’ মেকাপ-গেটাপ করা প্রায় শেষ। নিজে এসে কনকর্ডে প্রুফ দেখে যাচ্ছিলেন। এই বই দুটি প্রতিশ্রুতিশীল নবীন প্রকাশনী জাগতিক থেকে প্রকাশের পথে। প্রকাশনার তদারকি করতে কবি কনকর্ডে আসতে আসতেই হঠাৎ হারিয়ে গেলেন! কীভাবে বের হবে বই দুটো এখন? আমরা যারা তাঁর ঘনিষ্ট ছিলাম বলে ভাবি, ভাবতে চাই, তারা কি স্মৃতিময় লেখা, তাঁর কাব্যের প্রাপ্য মূল্যায়ন, কবির কিছু ছবি ও জীবনপঞ্জি সাজিয়ে একটি ছোট্ট স্মারকপুস্তক করতে পারি? এবং আশা করতে পারি, একদিন ‘কবি মাহমুদুল হাসান মাছুম রচনাসমগ্র’ প্রকাশিত হবে? কে দায়িত্ব নেবে? কাউকে না কাউকে তো নিতেই হবে। কবি মরে গেলেও কবিতারা যেন হারিয়ে না যায়, সেই অভিপ্রায় থেকেই এমন ভাবনা করি। সদিচ্ছা ও মনোযোগ দিলে আমরা তা পারি। আমাদের এই পারাটা জরুরী, তাহলেই হয়তো কবিকে হারিয়ে ফেলবার হাহাকার ও ব্যথা কিছুটা লাঘব হবে। হয়তো একদিন আমরাও পাহাড়ে ঘুরতে যাব, দূরে উপত্যকার মতো কবিই আমাদের তাকিয়ে দেখবেন। আমরা হয়তো জানব না, ঠিক কোন উপত্যকার নাম কবি, মনো-পাহাড়ের কোন উপত্যকাটি মাহমুদুল হাসান মাছুম?
কবিকে যখন হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের ফ্লোরে শুইয়ে রাখা হয়, তিনি তাঁর ছোটোমেয়েকে ডেকে বলেন, ‘একটা ছবি তোল তো মা, দরকার আছে।’ সেই ছবিতে কবি মাহমুদুল হাসান মাছুম শুয়ে আছেন হাসপাতালের দেয়ালে হেলান দিয়ে। সেই ছবিই তাঁর শেষ ছবি। জীবিত অবস্থায় সে-ই তাঁর শেষ শুয়ে থাকা, আগ্রসী ও অসভ্য ফাটকাদের শহরের হাসপাতালের দেয়ালে হেলান দিয়ে থাকা।
কবির সংসারে কয়েকটি বিড়াল আছে। কবি বিড়াল পুষতেন। বিড়ালগুলো এতিম হয়ে গেছে। কবির মৃত্যুর পরে বিড়ালেরাও বুঝতে পেরেছে তাদের অভিভাবকের হারিয়ে যাওয়া। খায়নি তারা, এ খবর আমরা পেয়েছি তাঁর মেয়ের লেখা থেকে। আমরা জেনেছি, কবিকে যখন হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের ফ্লোরে শুইয়ে রাখা হয়, তিনি তাঁর ছোটোমেয়েকে ডেকে বলেন, ‘একটা ছবি তোল তো মা, দরকার আছে।’ সেই ছবিতে কবি মাহমুদুল হাসান মাছুম শুয়ে আছেন হাসপাতালের দেয়ালে হেলান দিয়ে। সেই ছবিই তাঁর শেষ ছবি। জীবিত অবস্থায় সে-ই তাঁর শেষ শুয়ে থাকা, আগ্রসী ও অসভ্য ফাটকাদের শহরের হাসপাতালের দেয়ালে হেলান দিয়ে থাকা। এরপর কবির মরদেহ ঢাকা থেকে নওগাঁয় নিয়ে গিয়ে কবরে নামানো হয়। কবি হারিয়ে গেলেন তাঁর ভালোবাসার পৃথিবী থেকে। কবির অনুপস্থিতে তাঁর কবিতারা আমাদের সঙ্গে থেকে গেল। কবির অনুপস্থিতে তাঁর অনুভূতিগুলো আমাদের চারপাশে জেগে থাকল।
কবির এমন অকস্মাৎ প্রয়াণের পর আমরা টের পাই, বড্ড অবহেলা করেছে তাঁকে চলমান সাহিত্যের সমাজ। অবহেলা করেছি আমরা, মনোযোগ দেইনি আমিও। সেভাবে অ্যাটেনশন দিয়েছি কি, মাহমুদুল হাসান মাছুমের কবিতার প্রতি? অথচ তাঁর সঙ্গ তো ঠিকই নিয়েছি! দেখা হতো, আড্ডা হতো, ফেসবুক মেসেঞ্জারেও যোগাযোগ চলেছে আমাদের, অথচ একটু নিবিড়ভাবে তাঁকে অবলোকন করিনি। এতবার পাহাড়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন, যেতে পারিনি। আমরা শহরের দাস হয়ে গেছি। বেরুতেও পারি না। কবি মাহমুদুল হাসান মাছুম এই দাসত্ব থেকে মুক্ত ছিলেন। হুটহাট পাহাড়ে চলে যেতেন। সেখানে অনেক কিশোর-কিশোরী তাঁর ছেলেমেয়ে, অনেক তরুণ-তরুণীর তিনি বাবা, এরকম অর্জন ঢাকা শহরের আর কোনো কবির আছে বলে আমার জানা নেই। ভেতরে তাঁর সহজ মানুষ, সেই মানুষটির মনের দেশ পাহাড়, সেই মানুষটার পাঁজরে ছিল আদিবাসীদের গ্রাম। মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে এক সন্ধ্যায় কথায় কথায় বললেন, ‘পাহাড়ে যাবেন বর্ষায় আর শীতে, খালি যাওয়া আসার খরচ আপনার, থাকা খাওয়া সব আমার উপরে।’ একদিন বললেন, ‘গোঁফ রেখে দেন। ভাল্লাগবে।’ বললেন, ‘কাঁটা’ ছবিটা কবে দেখব?’ এমন ভালোবাসার মানুষ আর পাব না। এমন সহজ মানুষ সহজে মিলবে না এ জটিল বাংলায়।
পাহাড়ের সহজ মানুষ এই সহজ মানুষটিকে চিনে ফেলেছিল। সে জন্যই তো আজ কান্না, পাহাড়ে, কাঁদছে তাঁর ছেলেমেয়েরা। অন্তলালিত চোখে তাকালে দেখা যাবে, উপত্যকায় থমকে আছে কুয়াশা। কুয়াশার ভেতর দিয়ে ফুটে উঠছে খুব গোপনে আহত কবির মুখ, মাহমুদুল হাসান মাছুমের মুখ। তাঁর মৃত্যুর পর একজন পাহাড়ি ছেলে লিখেছে, ‘বাবার হয়ে আপনারা পাহাড়ে আসবেন?’
আকাশে তারারা জ্বলবে, পাহাড় স্তব্ধমুখর দাঁড়িয়ে থাকবে কবির অপেক্ষায়। কবি আর কোনোদিন পাহাড়ে যাবেন না। কবিকে আমরা শাহবাগে আর দেখব না। কবি আসবেন না বইমেলায়। দূরে বসে কোথাও কোনো পাঠক-পাঠিকা তাঁর কবিতার বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে পড়বেন—ধরবেন কবির অন্তরের ব্যাকুলতাকে। অনেক দিন যাবে, আমাদের স্মৃতি কিছু ধূসর হয়ে উঠবে। আমাদের আড্ডায় না থেকেও কবি উপস্থিত থাকবেন আমাদের আলোচনায়। আমরা নতমুখে মাহমুদুল হাসান মাছুমের জন্য সন্তপ্ত হব। একদিন হয়তো সন্তাপ কমে আসবে। আমাদের ঠিক মনে আসবে কি, মাহমুদুল হাসান মাছুম আমাদেরই একজন ছিলেন? আমাদেরই একজন হয়ে আছেন তিনি। এই থাকতে পারার ভীষণ যোগ্য তিনি। নাগরিক অনেক প্রচারসর্বস্ব নামি কবিরও এরকম থাকা আমরা হয়তো অনুভব করি না, করব না। পাহাড়ের সহজ মানুষ এই সহজ মানুষটিকে চিনে ফেলেছিল। সে জন্যই তো আজ কান্না, পাহাড়ে, কাঁদছে তাঁর ছেলেমেয়েরা। অন্তলালিত চোখে তাকালে দেখা যাবে, উপত্যকায় থমকে আছে কুয়াশা। কুয়াশার ভেতর দিয়ে ফুটে উঠছে খুব গোপনে আহত কবির মুখ, মাহমুদুল হাসান মাছুমের মুখ। তাঁর মৃত্যুর পর একজন পাহাড়ি ছেলে লিখেছে, ‘বাবার হয়ে আপনারা পাহাড়ে আসবেন?’ এইখানেই কবির অমরত্ব, যে অমরতা যথেষ্ট কবি-কবলিত ঢাকা শহরের আর কোন কবির অর্জনে এসেছে? মাহমুদুল হাসান মাছুমকে তাই আমরা ভুলতে পারছি না। তাঁর বিড়ালগুলো তাঁকে ভুলতে পারছে না। যে বিড়ালগুলোকে তিনি নিজের বাচ্চা বলে ডাকতেন। ভুলছে না তাঁকে পাহাড়ও। অগণন মানুষের ভেতরে এই বেঁচে থাকাকে তিনি হয়তো মরণোত্তর উদযাপন করছেন।
শহর ব্যস্ত। আমরা এই আগ্রাসী ও অসভ্য শহরের দাস। অথচ মানব জীবন দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য ব্যয় করবার কথা আমাদের, জ্ঞান সেই প্রত্যয় উসকে দিয়েছে আমাদের। কবি শহর ছেড়ে ফিরে গেছেন দূর মফস্বলে। সেখানে তাঁর কবর হয়েছে মায়ের কবরের পাশে, বাবার কবরের ভেতরে। সেই কবরের উপরে কি কোনো হিজল গাছ তাঁকে সন্ধ্যায় সঙ্গ দিচ্ছে রোজ, আড্ডা দিচ্ছে কবির সঙ্গে? রিয়েলি আমরা তাঁকে খুব মিস করছি। অপার স্মৃতির নিমজ্জনে ডুবে যাচ্ছি আমরা। প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলার ব্যথায় আক্রান্ত হচ্ছি আমরা।
প্রিয় মাছুম ভাই, যথার্থ মনোযোগ দিতে পারিনি আমিও আপনার দিকে, আপনার কবিতার দিকে। আত্মগ্লানি এসে গলার কাছে দানা বাঁধছে। আর একবার দেখা হলে এসব কথা আপনাকে বলতে পারতাম। দুঃখ, কোনোদিন আর দেখা হবে না। এইখানেই আমাদের সীমাবদ্ধতা, মৃত মানুষের সঙ্গে আমাদের আর কোনোদিন দেখা হয় না। শেষ কথাটি তাঁকে আর বলা হয় না। খুব অসহায় বোধ করি। দূর থেকে কবির কবরের শিয়রে নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকি। ব্যর্থতা ও অপরাধ বোধ থেকে পালাতে চাই, যদিও চাইলেই সেই সুযোগ আর দেন না মৃত কোনো মানুষ। জীবিত মানুষের ক্ষমতা এইখানে শেষ। আপাতত লেখাটি শেষ করছি মাহমুদুল হাসান মাছুমের একটি কবিতা দিয়ে। কবিতার নাম, ‘সাবেক খতিয়ান।’
‘আমি তোমাদের জন্যে কবিতা লিখি না
তোমাদের প্রত্যাশা অসংখ্য ধূলিকণার মতো
ফানুসের মতো ক্ষণস্থায়ী ভালো লাগা তোমাদের।
আমি কবিতা লিখি অনাগতদের উদ্যেশ্যে
যারা এখনো জরায়ুতে প্রবেশ করেনি
পৃথিবীর জলবায়ুতে যারা অচ্ছুৎ হয়নি
তাদের জন্যে আমি কবিতা লিখি।
আমি বিশ্বাস করি
তারা আমার কবিতা পাঠ করে
নিজেদের পূর্বপুরুষের ব্যর্থতা-স্বার্থকতা
আর পঙ্কিল ইতিহাসের গোপন পৃষ্ঠা খুঁজে পাবে
পাবে ভ্রান্ত সময়ের উপাসকদের তাবৎ ভণ্ডামি
এবং সাবেক খতিয়ান আর দাগ নম্বর।’
আপনার বক্তব্য খুব পরিষ্কার, মাছুম ভাই। জীবদ্দশায় কোনোদিন পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে পড়া হয়নি। আপনাকেও জানানো হয়নি। তাই আপনাকে জানাও হয়নি আমাদের। কবি, অন্তরের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি আপনাকে। আমার মন ও মর্মে আপনি অমর থেকে গেলেন।
জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস: ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।