অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ‘শ্মশানগামী জোছনা’ থেকে
মধ্যবর্তী অনুসন্ধান
তরুর মতো অকাতর বিস্ময়ে
বিলুপ্ত দিঘির মতো তৃষ্ণার ঘেরাটোপে—
কঠোর নিয়ম নিংড়ে নিয়ে—
আবদ্ধ আভিজাত্যের কবচ পড়েছি।
নির্যাতিতদের চোখের অভিযোগে
মাটিগামী আকাশের নিচে
ভেসে বেড়ানো মেঘের বৃষ্টিতে—
করুণা কামনার ধারাবাহিকতায় নয়
এই সংক্ষিপ্ত চিঠি—
মনে রেখো বজ্রপাতের ইতিহাস
এ এক পরিপূর্ণ স্পন্দিত সত্তার
বিবেচিত উপস্থিতি।
জীবন-মৃত্যুর মধ্যবর্তী অনুসন্ধানে
অকাট্য যুক্তি আর প্রজ্ঞায়—
অসুস্থ নিয়তির উপর নির্ভর না ক’রে
অহিংসা জাগিয়ে তুলবার আকাঙ্ক্ষায়
আমাদের চলে যাওয়া
তোমাদের একদিন অপরাধী সাব্যস্ত করবে।
সংকীর্ণ সময়ের ধারায়
এখনো অনেক পথ পেরুতে বাকি
এইসব ব্যর্থ অনুরাগ অভিযোগ—
বিরক্তিকর হতে পারে কারো কারো-নিকটে
তবে তোমরা যে পরস্পরের কাছে প্রতারক
তাতে কোনো সন্দেহ নেই; তা দেখে
বিস্ময়ে অ-মুগ্ধ আমাদের চোখ!
তোমাদের চতুর্দশপদী স্বভাব
শৃগালের লোভী চোখের মতো উলঙ্গ।
পৃথিবীর বনাঞ্চল
ধরে নিলাম তুমি হয়ে গেছ বসন্তের কোকিল—
কিংবা শরতের নীলাভ বিকেল
আগামী আষাঢ় কিংবা শ্রাবণে
তুমুল বৃষ্টিপাতে ভেসে যাবে তুমি
ঘাস আর পৃথিবীর বনাঞ্চলে
কোথাও না কোথাও থেকে যাবে
অ-বিলুপ্ত দু-চারটে ফড়িং আর জোনাকি
আকাশের পাড়াগাঁয়ে উঠবে তারকা—
অতঃপর
এই অবাক পৃথিবী হতে
নারীদের বেণী বেয়ে উঠে যাব—
আবার ফিরেও আসব—
রূপোর ঝুমকো পড়া কানের পাশ দিয়ে
নামতে থাকব চিবুক ঘেঁষে
ঠোঁটের যাবতীয় শৈলী ছুয়ে
আপেল বাগান পেরিয়ে
চলে যাব কামরাঙ্গার অনুসন্ধানে।
অস্থায়ী অন্ধকার
একটা জাহাজ আসবে ব’লে
চন্দ্রভুক রাতে সমুদ্রের গর্জন শুনি
দেখি, শেষ রাতে কীভাবে
রাশিরাশি কালো জলের ভেতরে
চাঁদ ভেঙে চুরমার হয়ে
জলজ নক্ষত্রে পরিণত হয়।
শুনবার অপেক্ষায় থাকি—
মাঝ-সমুদ্র হতে অতর্কিত হুইসেল
অনতিদূরে নোঙর ফেলবে কাপতেন
আমি ডিঙি ভাসিয়ে ছুঁতে যাই
বিশাল জাহাজের গায়ের কালো দাগ।
অস্থায়ী অন্ধকারের খেয়ালে
অসংখ্য ক্ষুধার্ত মুখ হিশহিশ ক’রে—
কাপতেন দাঁড়ায় দূরবিন হাতে
সবুজ সংকেত আসে জেটির অভিমুখ হতে।
আমরা পরিচয়হীন খালাসি
আর আমাদের শরীরজুড়ে
উর্দি পড়া কাফনের ভেতরে ক্ষতচিহ্ন।
পৃথিবীর পথে
তুমি পাশে ছিলে না বলেই
পিচ্ছিল পথগুলো পার হতে শিখেছি
হচ্ছে একলা চলার নির্মোহ নির্মাণ
তোমার না থাকায় পৃথিবীর পরিক্রমায় উদ্ভ্রান্ত হইনি।
তুমি এখন কার পাশে হাঁটো
কাকে দেখাও পৃথিবীর অন্ধকার সুরঙ্গ
সে কী চলতে শিখেছে নির্জন পথে?
না কি অনাবাদি উপত্যকায়
হারিয়ে ফেলেছ তোমার পায়ের ঘুঙুর?
তোমার ভেতরে এতো অন্ধকার!
ইন্দ্রিয়র আলো ফেলেও
খুঁজে পাচ্ছ না হৃদয়ের দ্যুতি
অমাবস্যা কেটে গিয়ে চাঁদ উঠুক
জোয়ার ভাটায় পূর্ণ হোক চাঁদের চিলেকোঠা
পূর্ণিমার জোছনা পড়ুক শ্মশানে
তারপর খুঁজে দেখব
কে আগুন দিয়েছে চিতায়
কে পুড়িয়েছে তোমার ভালোবাসার শরীর
কোন শ্মশানের সেই পুরোহিত।
কবিতা লেখা পাপ
আজকাল তুমি
বিষণ্নতায় ডুবে থাকছ জেনে
সমুদ্রের গ্রীবা ছুঁয়ে থাকছে
পর্যুদস্ত দিনের ভগ্নাংশ
প্রচলিত বাতাসের অনুকূলে
ছেড়ে দিচ্ছ দীর্ঘশ্বাস
আর অভিনব রাতের অন্ধকার হতে
মুঠো ভরে বিলুপ্ত জোনাকি ধরে
কাচের বয়ামে আটকে রাখছ!
অথচ সৈকত জুড়ে
তুমুল বৃষ্টিপাতের বার্তা পেয়েছে নাবিক
অন্ধকার পালক ফুলিয়ে
ধীরে ধীরে ঘন হচ্ছে রাতের প্রহর
একটা জাহাজের খোলে বাঁধা ডিঙি
আর সমুদ্রের ঢেউ উত্তাল প্রেমে মেতেছে।
কাচ-পোকার তলপেটে
জ্বলছে নিভছে গেরুয়া দ্যুতি
শহরের সাজ-ঘরে
নগ্ন শরীর চাটছে পুরনো অসুখ
তবুও তোমার জানালায়
আসন্ন রাতের কান্না
ফোঁটায় ফোঁটায় নিঃশব্দে
শার্শি বেয়ে নেমে চলেছে
প্ররোচিত চিৎকারে। কিন্তু কেন?
কবিতা লেখা একপ্রকার পাপ
যা কিনা প্রতিনিয়ত আমি ক’রে থাকি
তোমার অসুখের কথা ভেবে-টেবে
আবারও কবিতা সেলাই করা শুরু করলাম।
ভূভাগের সকল কবি, কবিতায়
এসব অভিনব পাপের বিনাশ চিহ্ন আঁকে
সূর্য দেবতা হেলিওস যখন
ভূপৃষ্ঠে মাথা তুলে চলমান হয়
অন্যপৃষ্ঠের অন্ধকারে তখন
রাশিরাশি তারকা ঝিলমিল করে
আর আমার ভেতরে জেগে ওঠে পাপের সরীসৃপ।
অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ‘ঔপনিবেশিক অন্ধকার’ থেকে
নক্ষত্রের দীর্ঘায়ু
দক্ষিণের দূর্লভ বাতাস
‘জানালা ছুঁয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে
একটি চিঠি ফেলে গেছে আমার ঘরে’
ঠিক চিঠি নয় চিরকুট বলা যায়
খুলে দেখি (?) প্রশ্নবোধক চিহ্নটি
প্রথম বাক্য বন্ধনীতে বন্দি!
তারপর
বাক্যটি বিন্যাস হয়েছে সমীকরণে
তাতে লেখা রয়েছে
‘উত্তর ডুবে গেছে পশ্চিমাঞ্চলে’!
আমার ডান হাত সহসাই
‘বাম ভ্রুর উপরটা চুলকিয়ে
ঝুলে থাকল আমারই কাঁধে’
অথচ মনে হচ্ছে কাঁধটি আমার নয়।
কাঁথায় ন্যাপথলিনের গন্ধ—
আমার মাথা ঘুরছে! বাইরে অন্ধকার
ঘরের আলো নিভিয়ে খানিক দাঁড়ালাম
ব্যালকনিতে—
একটা প্যাঁচা বিশ্রীভাবে ডাকল কোথাও
শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা শিহরন নেমে গেল!
ভাবতে অবাক লাগছে—
শহরে এখনো প্যাঁচারা বসবাস করে!
দু’হাতে বারান্দার গ্রিল ধরে
মাঝরাতের শহরটা বুঝবার চেষ্টা করে
ব্যর্থ হয়ে চোখের নৈকট্য ছেড়ে
যাবতীয় উদ্বেগ মস্তিষ্কের পিটুইটারি প্রবাহে
নেমে আসতে শুরু করল—ষড়যন্ত্র।
পশ্চিম আকাশের মানচিত্রে
দূরের নক্ষত্রগুলো যাই যাই করছে
আমার চোখের কোণ ফিরে পেল বিশ্বাস
নক্ষত্রের দীর্ঘায়ু কামনা করে
ফিরে এলাম শোবার ঘরে।
বিছানার চাদর টেনেটুনে
ভাঁজগুলো খানিকটা সোজা করে
বোবা বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজে
মঙ্গল গ্রহের আশীর্বাদ কামনা করে
ন্যাস্ত করলাম মাতৃভূমির শিয়রে।
কারণ মা বলেছিল
‘খোকা চাঁদ-তারার উপর বিশ্বাস রাখিস’।
আমিই পঞ্জিকা
একুশ-বায়ান্ন-একাত্তর
মার্চ পঁচিশ-ছাব্বিশ
চৌদ্দ-ষোলো ডিসেম্বর
এইসব যাবতীয় দিনগুলো ফিরে এলে
আমরা চেতনায় মাকড়শা হয়ে যাই
গর্ভের অসংখ্য চেতনার ডিমে উত্তাপ দেই।
নির্দিষ্ট সময়ে নিরাপদ জরায়ু ছেড়ে
বেরিয়ে আসে ছানারা অনিরাপদ আশ্রমে।
অতঃপর নিজের জালে বন্দি হয়ে
আত্মাহুতি দেয় মাকড়শা মায়ের শরীর
মা মাকড়শার মুক্তি নেই, মুক্তি আসেনি কখনো।
অর্ধশতাব্দী ধরে জাল বুনে চলেছে
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কৈফিয়ত দিয়ে যাচ্ছে
গর্ভধারণ করছে আর মৃত্যুবরণ করছে মা।
পরিশ্রান্ত তবুও ক্ষোভ নেই তার।
ফড়িঙের চোখে দেখা পৃথিবী—
ঢেলা চোখের আয়তনে সবই ঘাস
সবুজের প্রাচুর্যে রোদের অনুকূলে বাঁচার প্রয়াস।
পাখনায় পৃথিবীর যাবতীয় অংক
শিল্পীর পেন্সিল তাকে অনুকরণ করে
করে অনুবাদ চিত্রকল্পে—কবির হৃদয়।
মা মাকড়সা মরে গেছে
রকমারি ফড়িং বিলুপ্ত প্রায়—
আমাদের আর কিছু অবশিষ্ট নেই
আমরা শুধু দিন-মাস-বছরের পঞ্জিকা।
অনুভব কেন্দ্র
সাজেক নাকি মেঘের রাজ্য!
ভাবছি, এ নামের উৎপত্তি কীভাবে?
কোনো অচ্ছুৎ কবি কি লিখেছে সেই ইশতেহার
কে তার মাতা-পিতা, সাকিন কোথায় তার?
শুনেছি ওখানে উঁচু উঁচু পাহাড় আছে
পাহাড়ের পাঁজরে রয়েছে বিলাসী অনুভব কেন্দ্র
আমি কখনও যাইনি—দেখিনি ওদিক
অনুভব করিনি সেসব কেন্দ্রেরশীতাতপ রোগ
যেতেও চাই না ওসব আরোপিত কেন্দ্রে।
আমি তো অসুখ সারাতে পাহাড়ে আসি
থাকি ভাঙাচোরা বাড়ি-ঘরের নির্মোহ মমতায়
ভাতে খাই হলুদ ফুলের ভর্তা
আর নুন-মরিচের আগুন।
ঘাসের মমতায় সকালের রোদ ধরে ওম নেই—
রাতে মদে কুয়াশা মেশাই আগুন পোহাই আর
পাতায় পড়া শিশিরের শব্দ শুনি রাতভর।
…