মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩

কল্যাণী রমা’র কয়েকটি ছোটোগল্প

0

আমার ঘন যামিনীর মাঝে


আকাশ থাকে রাতের আঁধারে। সেদিন আমি ভেবেছিলাম কোনোদিন খুব অন্ধকারেও যদি ডুবে যাই, আমি ঠিক আলো খুঁজে পাব। মানুষের ভাবনাগুলো মানুষের হৃৎপিণ্ডের থেকে আস্তে নিঃশ্বাস নেয়। তাই আলো আমি খুঁজে পাইনি।

কিন্তু নিঃশ্বাস নেওয়ার বাইরেও মানুষের হাতের মুঠোয় একটা ম্যাজিক থাকে। জাদুকরের হাতের ভিতর থেকে যেমন লাল, নীল সিল্কের রুমাল কিংবা সাদা, সাদা কবুতর ডানা ছটফটিয়ে জাদুর স্টেজের এ মাথা থেকে ও মাথা হাসি আর আনন্দে ভরিয়ে দেয়, ঠিক তেমনি মানুষের জীবনের একমাত্র ম্যাজিক হলো— মানুষ আঁধারে বাঁচে।


পিয়ানো


ছেলেবেলায় আমাদের বাড়িতে গানের স্কুল বসত। আমি গান করতে পারি না। কিন্তু বন্ধু-বান্ধবদের সাথে হারমোনিয়ামের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতাম। বাড়িতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওস্তাদ হরিপদ দাদু আসতেন। আমি পুরো ছেলেবেলা তানপুরার পাশেও গন্ধ শুঁকে শুঁকে কাটিয়েছি। আমার কুকুর পপি যেমন। ও চায়কোভস্কি বাজাতে পারে না। পিয়ানোর নিচে গিয়ে একটু আগে যে ওই পিয়ানো বাজিয়ে চলে গেছে, তার ফেলে যাওয়া গন্ধ শোঁকে।

আমার কাছেও ফেলে যাওয়া গন্ধ সবসময়ই জলজ্যান্ত, পুরো মানুষের চেয়ে দামি। আজ গান থেমে গেছে। এই পিয়ানো দু’ভাগ করে তার কাঠ সের দরে বেচে দেওয়া হবে। হাটের মাঝে সেই চ্যালাকাঠ ডাঁই করে রাখা হয়েছে— আলু, পিঁয়াজের পাশেই।

ঘরের দরজার গোল-মসৃণ, তেল-চকচকে নব; বহু একলা দুপুরে তাকিয়ে দেখা জানালার বাইরের আকাশ; যে কোনো সময়েই শূন্যে ঝুলে পড়বার কড়িকাঠ— আমি সবই দেখতে পাচ্ছি। স্খলিত মানুষকে ভালোবাসতে পারিনি বলে আমি ওদের ভালোবেসেছিলাম। ওদের রক্ত-ঝরাটুকু ওরা আমার শূন্য পিগি ব্যাঙ্কে যত্ন করে রেখে দিচ্ছে।

এ পিয়ানোতে আর কেউ কোনোদিন ‘আভে মারিয়া’ বাজাবে না।


অপেক্ষা


বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বাবাকে মেরে ফেলে। তখন আমার বয়স সাড়ে চার। আমি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বাবার জন্য অপেক্ষা করে থেকেছি। তবে মুখ ফুটে সে কথাটা কাউকে বলতে পারিনি। যেসব মানুষের বয়স চারপাশের বড়ো মানুষদের মতো হয় না, তারা বুকের ভেতর কথা লুকিয়ে রাখতে পারে।

বালিকাবেলায় আমি বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করেছি। বৃষ্টিতে সবুজ আর গোলাপি রঙের চুলের মতো কড়ই আর শিরীষফুল কীভাবে ভিজে যায় তা দেখবার জন্য।

যখন আমার তরুণী বয়স, আমি আমার প্রেমিকের জন্য ট্রেন স্টেশনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেছি। কিছু ট্রেন এসেছে, কিছু ট্রেন আসেনি।

মধ্যবয়সে অপেক্ষা করেছি অতিথির জন্য। জানালা দিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখেছি কিভাবে জাফরানের রঙ দুধের ভেতর গলে গলে যায়।

জীবনের শেষপ্রান্তে এসে আমি আজকাল আর কারো জন্য, কিংবা কোনোকিছুর জন্য অপেক্ষা করি না। অপেক্ষা করি না কোজাগরী পূর্ণিমার জন্য। শিউলিফুলের জন্য। নতুন কনের চোখ জলে ভিজিয়ে দেওয়া বিসমিল্লাহ খানের সানাই কিংবা দুর্গাপূজার ঢাকের শব্দের জন্য।

আমি কোথাও গেলে আমার কুকুর শুধু আজও সারাদিন দরজার সামনে অপেক্ষা করে বসে থাকে। ও এখনো মানুষ হয়নি!


ড্যাফোডিল


প্রেমের মৃত্যু মানুষের মৃত্যু থেকে ভয়ানক। মানুষের মৃত্যু হলে মৃত্যুবার্ষিকী থাকে। মৃত মানুষের কবরে ফুল দেওয়া থাকে। প্রেমের মৃত্যু হলে জীবন্ত মানুষের দিকেও ফিরে তাকানো থাকে না।

তবু মানুষ অদ্ভুত প্রাণী। যে বাড়ি ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে, যে বারান্দা ছেড়ে— তার আঙিনায় সে কোনো এক হেমন্তে হাজার ড্যাফোডিল লাগিয়ে ফেলে। ওই ড্যাফোডিলের ফুটে ওঠা সে কোনোদিন দেখতে পাবে না বরফ শেষ হওয়ার পর।

ড্যাফোডিলও অদ্ভুত ফুল। বিষাক্ত। কিন্তু প্রতি বছর ওরা ছড়িয়ে পড়ে। আগের বছরের থেকে বেশি করে। এক সময় পুরো মাঠ ছেয়ে ফেলে। যে এই ড্যাফোডিল লাগিয়েছিল তার জন্য না হলেও অন্য পথচারীদের জন্য। রাস্তা দিয়ে যারা হেঁটে যাবে তাদের চোখ ঝলসে দিয়ে অনেক বরফের পরে।


তবু মনে রেখো


যদি পড়িয়া মনে
ছলোছলো জল না ই দেখা দেয় নয়নকোণে
তবু মনে রেখো।’

রবিঠাকুরের এই গানটা যখনই শুনি, আমার হৃৎপিণ্ডের সব তার ছিঁড়ে যায়। আমি এ গান শুনতে পারি না। না শুনেও থাকতে পারি না। আমার নিজের মৃত্যুর থেকেও ভয়ংকর মনে হয় আমায় কেউ ভুলে যাবে সেই নির্মমতাটুকু।

নিজের কথা যদি ভাবি, তখন মনে হয় আমি তো গতবছর স্টার ম্যাগনোলিয়া গাছটায় যে রবিন পাখি বাসা বেঁধেছিল, তাকে ভুলে যেতে পারিনি। যা কিছু নিঃশ্বাস নেয়, তাকে ভুলে যাওয়া যায় না। আর যা কিছু নিঃশ্বাস নেয় না— চাঁদের মতো, নদীর মতো, মাটির মতো— তাকেও কি ভুলে যাওয়া যায়?

যদি তার প্রাণের কোথাও আমি দাগ না কেটেও থাকি, আমার কথা মনে করে তার চোখে যদি জল নাও আসে— তবু সে মনে রাখুক। মনে রাখুক সব বেদনার কথা, মনে রাখুক সব প্রেমের কথা। কেননা মানুষের জীবন যে অমৃতের গল্প।

সেই গল্পের কথা যেন ভুলে না যাই তার জন্য সেদিন আমি এক ফরগেট-মি-নট ফুল দিয়ে বানানো আংটি কিনে এনেছি। সত্যিকারের ফুল প্রেস করে বানানো। হালকা নীল রঙের। মাঝখানে একটু হলুদ।

মনে পড়ছে আমি কোথায় যেন পড়েছিলাম ফরগেট-মি-নট ফুলের জন্মকথা। ঈশ্বর সব ফুলে রঙ দেওয়া শেষ করে তুলি গুছিয়ে রাখছেন। খুব ক্ষীণ স্বরে ছোট্ট একটি ফুল ঈশ্বরকে তখন বলেছিল, ‘হে ঈশ্বর, আমার রঙ কোথায়? ফরগেট-মি-নট।’ ঈশ্বরের কাছে খুব অল্প একটু হালকা নীল রঙ ছাড়া আর কোনো রঙ তখন ছিল না।

ফরগেট-মি-নট তার জীবনে সেই অল্প একটু রঙ পেয়েই খুব খুশি হয়ে উঠেছিল।

শেষ যুদ্ধে মানুষও তৃপ্ত হোক।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কল্যাণী রমা-র জন্ম ঢাকায়। ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ভারতের খড়গপুর আই আই টি থেকে ইলেকট্রনিক্স এ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল কমুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বি টেক করেছেন। এখন আমেরিকার উইস্কনসিনে থাকেন। অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করছেন ম্যাডিসনে। প্রকাশিত বই: আমার ঘরোয়া গল্প; হাতের পাতায় গল্পগুলো – ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা; রাত বৃষ্টি বুনোহাঁস – অ্যান সেক্সটন, সিলভিয়া প্লাথ, মেরি অলিভারের কবিতা; মরণ হ’তে জাগি – হেনরিক ইবসেনের নাটক; রেশমগুটি; জলরঙ; দমবন্ধ

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।