‘কহিবো বিবির নাম’ এক দীর্ঘ পথের নাম। এক অসম্ভব জেদ আর ভালোবাসার হিংস্রতা বা আসলেই ভালোবাসাকে সরল সহজ করে তোলার এক অলিখিত পরাবাস্তব চেষ্টা। বইয়ের ভেতর যেমন কোনো কথাই ঠিক সিদ্ধান্ত না, বা হ্যাঁ-না এর মধ্যে একটা ভীষণ টানাপোড়েনের আশঙ্কা দেখা যায়। বই আলোচনায়ও তেমনি ‘বা’ এসে যায়। লেখক বলছেন ‘আমি সব কথা ঘোলাটে করে উপস্থাপন করি; যেন, তোমরা সবকিছু বুঝে গিয়েও চিন্তায় থাকো আসলেই বুঝেছি তো! বা আমি এমন সামান্য সাহিত্যিক সত্তা, যে তার সৃষ্ট চরিত্রের ভেতর দিয়ে আত্মঘাতী।’
মলয় দত্তের পূর্ব প্রকাশিত বই ‘মায়ের হাঁসগুলিরে জংলা খালে দেবতার মতন লাগে’ (২০১৭)। ‘দ্যা অ্যাপেল ভেন্ডর এন্ড মাই জুলিয়েটস্’ (২০১৯)।প্রকাশিতব্য বই ‘সবিস্তারে কহনে না যায়’ এবং ‘সুইসাইড সানগ্লাস’।
‘কহিবো বিবির নাম’ বইয়ের গল্পগুলো গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের। সাধারণ মানুষের যৌনচিন্তা, কামনা, প্রেম, ভালোবাসা, কল্পনা বা অবচেতনের প্রলাপ। মহিলারা সব নরম কাপড়ের, ব্রেসিয়ারহীন অথচ অসম্ভব আবেদনময়ী, যাদের চেহারা জুড়ে অসহায়ত্ব আর ভালোবাসা সমান সমান। সকল পুরুষ চরিত্র অসম্ভব কামুক, লম্পট অথচ সরল ভালোবাসাকামী। তারা সবাই সবাইকে ভালোবাসছে, হাঁটছে, চলছে। কোথাও পৌঁছনোর দায়িত্ব একান্তই পাঠকের।
একবিংশ শতাব্দীর বসবাসে আমাদের চিন্তার যে দ্বিধা, আবছায়া। যেন যেকোনো দৃশ্যের দিকে আমরা তাক করে রেখেছি হাজারো সন্দেহ। সেই মনস্তাত্ত্বিক বা সাইকোলজিক্যাল ব্যলেন্সিং এর মাঝে যদি দৃশ্যত কোনো পথ থাকে তাহলে সেটাই হয়তো শিল্প। Erich From এর ‘Escape from Freedom’ এর সময়ে আমরা বাস করছি। অর্থাৎ একই সাথে স্বাধীনতা এবং সেই স্বাধীনতার শাসনকামী। এই আধুনিকতা বা উত্তরাধুনিকতার মধ্যে পরাবাস্তববতা এক অলিক বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে। মলয় দত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘যৌনতা এমন একটা ব্যাপার যেটা বিছানা নিয়েই কেবল চিন্তা না, এটা আমাকে আপনাকে অস্তিত্বের গভীরে প্রেরণ করে, শরীরের প্রতিটা তন্তু এর মধ্যে স্পন্দিত হয়। শুরু থেকে শেষ আর শেষের পরে দীর্ঘসময়ের পথে আমাদের রোমাঞ্চিত করে। যৌনতার মাঝে অবস্থান করে যৌনতাকে অস্বীকার করবেন তা তো হয় না বা আমার হয় না।’
সুতরাং এই যৌনতা বা বিষণ্নতা, প্রেমিকা এইসব তার লেখার মূল বিষয় বলা যায়। গল্পে তিনি প্রকাশ করে গেছেন তার ব্যক্তিগত মনোজগতকে। যেখানে গল্পে ঢুকেই আপনি চলে গেছেন কোনো এক গ্রামে বা কারো ব্যক্তিগত শোবারঘর বা রান্নাঘরে। গল্পে কোথাও কোনো ঘোষণা নেই। গল্পে এত এত চরিত্র, সহজেই যেকোনো চরিত্রকে মনে হবে চেনা বা আপনিই সেই। পীরুবালা গল্পের নায়িকা কে তবে? পীরুবালা নিজে? শ্যামলের বউ? ক্লডিয়া পার্কার? বা নায়কই বা কে? শংকর, মালেক, সমীর নাহ মাস্টারের ছেলে? পুরো গল্পে যে শ্যামলের বউয়ের রূপের ব্যাখ্যা অথচ তার নাম নেই কোথাও।
গ্রামভর্তি লোক নিয়ে মাস্টারের ছেলে এক পর্ণস্টারের দুনিয়ায় চলে যাচ্ছে। সে কি আসলেই আছে? সে কি সবাইকে একসাথে হিপনোটাইজ করে রাখল? নাকি সবাই One Flew over the Cuckoo’s Nest-এর মতো পাগল বা সুস্থ যারা একসাথেই চলে গেছে কোথাও। এইসবের মধ্যে সবসময়ই হাঁটাচলা করছে এক আকুল আবেদন এক বিষণ্নতা, অস্থিরতা। লাইনের পর লাইন শেষ না হওয়া। বিলকিস গল্পে, গ্রাম, বিদেশ সব মিলে এত আগ্রহী চোখ সবার।
পুরুষেরা দলবেঁধে একই কল্পনায় ঢুকছে বের হচ্ছে। গ্রাম জুড়ে সবাই একই ঘটনায় আছে আবার সবাই এর মধ্যে আলাদা করে ভেবেও যাচ্ছে নিজেদের যৌনতা। তারা একে অপরের যৌন জীবন নিয়ে চিন্তিত আর আলোচনা ও জুড়ে যাচ্ছে। অথচ এইসব কথায় এত দীর্ঘ রূপক এত দীর্ঘ ব্যাখ্যা এত এত শব্দ যে চাইলেই সেইসবকে অশ্লীলতা বলা যায় না। কিন্তু সেখানে হাজারও প্রশ্ন করা যায়। এই যে গ্রামভর্তি লোক নিয়ে মাস্টারের ছেলে এক পর্ণস্টারের দুনিয়ায় চলে যাচ্ছে। সে কি আসলেই আছে? সে কি সবাইকে একসাথে হিপনোটাইজ করে রাখল? নাকি সবাই One Flew over the Cuckoo’s Nest-এর মতো পাগল বা সুস্থ যারা একসাথেই চলে গেছে কোথাও। এইসবের মধ্যে সবসময়ই হাঁটাচলা করছে এক আকুল আবেদন এক বিষণ্নতা, অস্থিরতা। লাইনের পর লাইন শেষ না হওয়া। বিলকিস গল্পে, গ্রাম, বিদেশ সব মিলে এত আগ্রহী চোখ সবার। সাধারণ জীবনের কতদূরের কতগুলা মানুষ। গ্রামজুড়ে সব পুরুষ মিলে টুকরো টুকরো করে স্বপ্ন দেখছে বিলকিসকে নিয়ে। সবাই মিলে একসাথে আশা করে বিলকিসকে। কোনো হিংস্রতা, কামনা ছাড়াই, তারা সবাই মিলে কেবল বলতে চায় এক হাজার দুঃখের কথা।
তারচেয়েও সবচে বড়ো এবং দীর্ঘ পথ হয়তো রাবেয়ার। হয়তো সমুদ্রের মতো অজানা। রাবেয়া মায়ের মতো এক প্রেমিকা। রাবেয়ার স্বামী তাকে অন্য পুরুষ হয়ে দেখে আর ভালোবাসে। সমুদ্রের জলের শাসন রেখে বাবার দেওয়া শাদা ঘোড়া শাসন করে জেলেপাড়ায় থাকে আর সেকান্দার আলীর সাথে রাবেয়াকে নিয়ে ভাবে। ঘোড়ার নাম কুতুয়ামোহন। যাদের সবার সঙ্গে হাঁটতে চলতে হঠাৎ গল্প থেকে রাবেয়া হারিয়ে গেছে গভীর সমুদ্রের মাঝে। ‘যে যার মতো ফিরে যায় আর দাঁড়িয়ে ঘুমানো কুতুয়ামোহনের ক্লান্তির দিকে তাকিয়ে সবার থেকে যখন আলাদা হয়ে যাই বা ঘুমিয়ে যাই তখন রাবেয়া আমার কেউ না, আমিও রাবেয়ার কেউ না।’ তাহলে রাবেয়াও নেই? এতক্ষণ কাদের সংসার ছিল? কোথায় ছিল সমুদ্র? আদৌ আছে? নাকি নেই? এ যেন এক অলৌকিক অস্থিরতা কেবল। পুরো পথ জুড়ে অস্থিরতা আর দৃশ্য। দৃশ্যের পর দৃশ্য। চিত্রপট পাঠকের দায়িত্ব।
‘যে যার মতো ফিরে যায় আর দাঁড়িয়ে ঘুমানো কুতুয়ামোহনের ক্লান্তির দিকে তাকিয়ে সবার থেকে যখন আলাদা হয়ে যাই বা ঘুমিয়ে যাই তখন রাবেয়া আমার কেউ না, আমিও রাবেয়ার কেউ না।’ তাহলে রাবেয়াও নেই? এতক্ষণ কাদের সংসার ছিল? কোথায় ছিল সমুদ্র? আদৌ আছে? নাকি নেই? এ যেন এক অলৌকিক অস্থিরতা কেবল। পুরো পথ জুড়ে অস্থিরতা আর দৃশ্য। দৃশ্যের পর দৃশ্য। চিত্রপট পাঠকের দায়িত্ব।
‘কহিবো বিবির নাম’-ই তার সবচেয়ে বড়ো ধোঁয়াশা। জিজ্ঞাসা নেই, স্বীকারোক্তি নেই বা বলবারই ইচ্ছে নেই। বিবির নাম আছে অনেক কিন্তু আসলেই সেই বিবি কে তার স্পষ্ট কোনো চরিত্র নেই। হয়তো আছেও।
গল্প লেখার ধরণই যেন এ বইয়ের সবচে বড়ো বিস্ময়। কোথাও আপনাকে নিয়ে বোঝাচ্ছে না যে ব্যাপারটা এমন। ঘটনাটা এমন। যেকোনো দৃশ্য থেকে আপনি তুলে নিতে পারেন যেকোনো দৃশ্য বা চরিত্র। গল্পের ভাষা সাধারণ মানুষের এবং একই সাথে কাব্যিক। কবিতার থেকে ছোটোগল্পের দিকে মলয় দত্তের যে চলাফেরা সেটি দৃশ্যতই বোঝা যায় যেভাবে রাবেয়ার নাম বাতাসে উড়ছে প্রফুল্ল জবার মতোন।
কবিতা ও গদ্য চর্চা করেন। পাশাপাশি বই পড়া ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে ভালোবাসেন।