ছেলেবেলার ‘ভূতালোচনায়’ সবার আগে লিকলিকে কোনো নারী ভূতের কথাই মাথায় আসত। যে ভূতের বয়স যত বেশি সে তত কামেল। পরনে সাদা শাড়ি থাকাই নিয়ম; তবে শিফন কি না ঠিক জানি না। মাথায় এলোচুল থাকবে এবং সেটা বৃক্ষ ছাপিয়ে এক্কেরে মাটি ছুঁইছুঁই। ভূতেরা কেন যে খোঁপা বাঁধে না তা ইবলিশ ছাড়া আর কেউ হয়তো পরিষ্কার বলতে পারবে না। কার্যসিদ্ধির জন্যে সে যুগের ভূতেরা যেকোনো উঁচু মগডালে স্থান করে নিত। তাল, তেঁতুল, নারকেল, সুপারি, বাঁশঝাড় এসবে চলত বেশ। নিচু গাছ ছিল বেজায় অপছন্দ। রাতের আঁধারে কোনো ভূত কচুগাছের ওপর বসে আছে এমনটা বাপের জন্মে কেউ শোনেনি।
স্থান-কালভেদে ভূতদের পোশাকআশাক নানা রং ও ডিজাইনের হতে পারে। যেমন নরওয়েতে সাদা শাড়ি পরে এলোচুলে কোনো ভূত ‘পোজ’ দেবে বলে মনে হয় না।
তো কী হতে পারে? স্কার্ট? অবশ্যই হতে পারে। সেক্ষেত্রে ভূত মাটিতে থাকার সম্ভাবনা ষোলআনা। কারণ স্কার্ট পরে গাছে ওঠার সাহস কারো নাই। সে ভুত হলেও।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোটোখাটো বিরতি পেলেই আমি বাড়ির পথ ধরতাম। এর একটা কারণ হলো ফুটবল। তখনো গ্রামে গিয়ে ‘খ্যাপ’ খেলার অভ্যেসটা ছিল। তাতে পয়সা পাওয়া যেতো না বটে তবে কমবেশি নামডাক হতো। আমি খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম বলব না, তবে ফুটবলার বন্ধুরা কেন জানি ‘টানতো’ খুব।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোটোখাটো বিরতি পেলেই আমি বাড়ির পথ ধরতাম। এর একটা কারণ হলো ফুটবল। তখনো গ্রামে গিয়ে ‘খ্যাপ’ খেলার অভ্যেসটা ছিল। তাতে পয়সা পাওয়া যেতো না বটে তবে কমবেশি নামডাক হতো। আমি খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম বলব না, তবে ফুটবলার বন্ধুরা কেন জানি ‘টানতো’ খুব।
তখন সেপ্টেম্বর মাস। ১৯৯৩ সাল।
সে রাতে ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার পথেই টের পেয়েছিলাম আবহাওয়া বেশ ‘চরম’। বৃষ্টিভেজা সকালে বরিশাল নেমে বাস ধরে পটুয়াখালী যাই। গিয়ে দেখি শহরেও বেদম বৃষ্টি। যাত্রা পথে সবুজবাগে ছোটো খালার বাসায় গিয়েছিলাম। বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই দেখে খালা বললেন— আজ বরং থেকে যা। কাল যাস।
কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। যাবই। বেলা তিনটার দিকে নিউমার্কেট ঘাট থেকে লঞ্চে উঠতে হবে। রিকশায় নিউমার্কেটে যেতে যেতে দেখি ঘন কালো মেঘ আকাশ ছেয়ে আছে। সেই সাথে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি।
ছোট্ট দোতলা লঞ্চ। তিনটার পরে নিউমার্কেট ঘাট থেকে ছেড়েছে। যাবে আমতলী। শহরের উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া লাউকাঠি নদী পায়রাকুঞ্জে গিয়ে পায়রা নদীর সাথে মিশেছে। পায়রা সরাসরি তালতলী দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। লাউকাঠি নদী পর্যন্ত ভালোই ছিল। কিন্তু পায়রায় পড়তেই নদী কেমন অচেনা হয়ে গেল। ঝোড়ো বাতাস, বৃষ্টি আর উত্তাল ঢেউ কাগজের নৌকার মতো দোলাতে লাগল আমাদের। নদীর পশ্চিম দিকে বিশাল চর থাকায় সুকানিরা এখান থেকে পশ্চিমে পাড়ি না দিয়ে বরং বামদিক ধরে চালিয়ে যেত। এরপর মির্জাগঞ্জের সোজাসুজি এলে উত্তর দিক বরাবর পায়রা নদী পাড়ি দিত। আজও তাই হলো।
কাকড়াবুনিয়া বাজারের ঘাটে লঞ্চ যখন ভিড়ল তখন অন্ধকার নেমে গেছে। যদিও মাগরিব হতে সামান্য একটু বাকি। আমার পরনে কালো জিন্স, সাথে সাদা রঙের হালকা প্রিন্টেড শার্ট, পায়ে কেডস। তখন জামা-প্যান্ট সাধারণত বঙ্গবাজার অথবা ঢাকা কলেজের সামনের মার্কেট থেকে কেনা হতো। বলতে গেলে এসবই ছিল আমাদের সময়ের সুপারমার্কেট। শহীদুল্লাহ্ হলের ছাত্র হওয়ায় নিঃসন্দেহে আমি ‘বঙ্গপ্রেমী’। শুধু কেডস এলিফ্যান্ট রোড বা ফার্মগেট থেকে কালেকশন করতাম।
সেদিন আমার সাথে কোনো ছাতা ছিল না। তাই গাঢ় অন্ধকার, বাতাস আর অল্প ছাঁটের বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। আমার সাথে তেমন কেউ নেমেছে বলে আজ আর মনে পড়ে না। নামলেও অমন দূর্যোগে সেই সংখ্যা বেশ নগণ্য। নেমে দেখি বাজার খা খা করছে। সব দোকানের ঝাপ ফেলে দেওয়া।
সেদিন আমার সাথে কোনো ছাতা ছিল না। তাই গাঢ় অন্ধকার, বাতাস আর অল্প ছাঁটের বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। আমার সাথে তেমন কেউ নেমেছে বলে আজ আর মনে পড়ে না। নামলেও অমন দূর্যোগে সেই সংখ্যা বেশ নগণ্য। নেমে দেখি বাজার খা খা করছে। সব দোকানের ঝাপ ফেলে দেওয়া।
বাড়ি যেতে কম-বেশি দুই কিলোমিটার হাঁটতে হবে। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে একটা খাল এসে বাজারের পাশ দিয়ে পায়রা নদীতে পড়েছে। এই খালের দু’পাশে বেড়িবাঁধ আছে। আমরা থাকি খালের পশ্চিম পাড়ে আর ‘ছাড়াবাড়ি’ ও আমার বড়ো চাচার বাড়ি পূর্ব পাড়ে। পারমুটেশন-কম্বিনেশন করতে করতে কী মনে করে পূব পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। আমার কাছে টর্চ নেই। তাই রাস্তার মাঝ বরাবর হাঁটতে থাকলাম। দশ ফুট দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। হাই স্কুল পেরিয়ে স্লুইসগেট পার হয়ে ডানে মোড় নিলাম। মিনিট দশেক হাঁটার পর লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মান্নান ভাইদের বাড়ি ছাড়িয়ে সামনে এগোতেই পড়লাম বিরান এলাকায়। এখানে খালের দু’পাশে কোনো ঘরবাড়ি নেই। বেড়িবাঁধের দু’দিকে যতদূর চোখ যায় ধূ-ধূ ফসলের মাঠ। জামাকাপড় ততক্ষণে ভিজে একসা। চুল বেয়ে টপাটপ পানি পড়ছে। সেসব ছাপিয়ে একবুক ভয় নিয়ে আবছা আলোয় বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি।
এমন দুঃসময়ে গ্রাম-গঞ্জে গান গাওয়ার রেওয়াজ ছিল। জোরে জোরে গান গেয়ে একা পথ চলতে শুনেছি। এটা আসলে ভূত ও মানুষদের যুগপৎ জানান দেওয়া যে আমি এ পথ ধরে যাচ্ছি। ভূত এসে ক্যাঁক করে ধরে ফেললেও আত্মচিৎকারে মনুষ্য জাতিকে জানানোর একটা মওকা অন্তত পাওয়া যাবে। সিস্টেম ভালো। আমাদের করিম চাচা একলা পথে এমনভাবে গলা উঁচিয়ে গান গাইতেন। কিন্তু আজকে এ রাস্তায় মনুষ্য বসতি না থাকায় আত্মচিৎকার দেওয়ার কোনো মানে হয় না। অতএব খামোখা গাইতে যায় কে? হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে হলো এ পথ ধরে গেলে তো চাচার বাড়ি পৌঁছার আগেই সেই বিখ্যাত ‘ছাড়াবাড়ি’ পড়বে।
ছাড়াবাড়ির আরেক নাম কাপালি-বাড়ি (আসলে কাপালিক হবে)। এ বাড়িটা কোনো এক সময় হিন্দু পরিবারের মালিকানায় থাকলেও আমার দাদা খরিদ করার সময় এবং এরপর থেকে আজ পর্যন্ত এ বাড়িতে কেউ কোনোদিন থাকেনি। একই ভাবে পরে আছে। ফেলে রাখা বা ছেড়ে যাওয়া বাড়ি থেকেই হয়তো ‘ছাড়াবাড়ি’ নাম হয়েছে। বড়ো বড়ো শিরিষ, কড়ই, আম, জাম, তাল, নারকেল, বাঁশ, বেত আর কলার ঝাড় পুরো বাড়ি অন্ধকার করে রাখত। দিন-রাত সমান। দক্ষিণ-পূব দিকে একটা ছোট্ট পুকুর আছে। এ বাড়ি লাগোয়া অন্য কোনো বাড়ি না থাকায় এবং সঙ্গত কারণে শশ্মান থাকা স্বাভাবিক এমন ধারণা থেকে ভূতের গল্প ডালপালা ছড়িয়েছে বেশ। ছোটোবেলায় গল্প শুনেছি ও বাড়িতে কে নাকি রাতের বেলা লম্বা চুলের ভূত দেখেছে। তাল গাছের মাথায় বসে ছিল। সাদা শাড়ি পরা সে ভূতের হাতে কারো ধোলাই খাওয়ার কথা অবশ্য শুনিনি। তবে তেনারা চাইলে যে কাউকে পাশের খালে পুঁতে রাখতে পারে। সেটাই ছিল আসল ভয়। ছেলেবেলায় তাই দিনে-রাতে ওই বাড়িকে আমরা সমান ভয় পেতাম।
ছাড়াবাড়ি’র আরেক নাম কাপালিবাড়ি (আসলে কাপালিক হবে)। এ বাড়িটা কোনো এক সময় হিন্দু পরিবারের মালিকানায় থাকলেও আমার দাদা খরিদ করার সময় এবং এরপর থেকে আজ পর্যন্ত এ বাড়িতে কেউ কোনোদিন থাকেনি। একই ভাবে পরে আছে। ফেলে রাখা বা ছেড়ে যাওয়া বাড়ি থেকেই হয়তো ‘ছাড়াবাড়ি’ নাম হয়েছে।
এতোক্ষণে বিরান এলাকা পেরিয়ে এসেছি। এরপর খলিফা বাড়ির মোড় ঘুরে কবিরাজ বাড়ির দিকে চলেছি। বড়ো চাচার বাড়ির সামনে দিয়ে খাল পার হওয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে তার আগে সেই আসল বাড়ি পার হওয়া দরকার।
কবিরাজ বাড়ি ছাড়াতেই আমার কলিজা ধুকুপুকু করতে শুরু করল। তবু এগিয়ে চলেছি। ছাড়াবাড়ি সামনেই। সীমানা থেকে দশ-পনেরো গজ থাকতেই হঠাৎ কে যেন আমার নাম ধরে ডাকল।
কে, শিপার নাকি?
অন্ধকারে ঠাহর করতে না পেরে বললাম—
হ্যাঁ
ঢাকা থেকে আসলা?
জ্বি ভাই।
ততক্ষণে চাচাতো ভাই মোখলেসকে চিনতে পেরেছি। সে ছাড়াবাড়ির উল্টো দিকে খালের ওপাড় থেকে আমায় ডাকছে।
আবার জিগ্যেস করল—
খাল পার হবা কেমন?
গিয়া দেখি
আমার কাছে নৌকা আছে। তোমারে পার করে দেই?
আমার গা থেকে একশ চার ডিগ্রি জ্বর নেমে গেল। আমি একা একা কোনোমতেই ‘ছাড়াবাড়ি’র সীমানায় যেতে চাইনি। ঐ রাস্তা কে পাড়ি দেয়! বারবার মনে হচ্ছিল মাঝামাঝি যেতেই ছেলেবেলার সেই ভূতের সাথে দেখা হয়ে যাবে। কী আশ্চর্য! তখনই মোখলেস উদ্ধার করতে চলে এলো! আমি খুব করে চাচ্ছিলাম কেউ ‘ছাড়াবাড়ি’ পার হওয়ার সময় আমায় সঙ্গ দিক। অথচ ভাই আমাকে পুরা খাল পার করে দিল।
২.
আজও আমার মনে যে প্রশ্নগুলো তাড়িয়ে বেড়ায় তা হলো—
মোখলেস কীভাবে জানল যে আমি ‘কাপালি-বাড়ি’ এড়াতে চাই?
খালের ওপাড় থেকে অন্ধকারে সে আমাকে চিনল ক্যামনে?
অমন দূর্যোগের রাতে ঠিক ঐ সময়টায় সে কেন বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল?
অন্যদিকে যদি সে না হয় তাহলে আমাকে নৌকায় খাল পার করে দিল কে?
আর সত্যি সত্যি মোখলেস যদি আমাকে পার করেও থাকে সেটা হবে কাকতালীয়। কী জানি! হয়তো কাকতালীয়ই হবে বিষয়টা।
এই ‘হয়তো’ দূর করাই মুশকিল। বিজ্ঞান এই ‘হয়তোর’ উত্তর এখনো পায়নি। তালাশে আছে। তবে নিশ্চয়ই একদিন পাবে।
কী জানি!
হয়তো!
লেখক-নাম রুহুল আমিন শিপার হলেও কাগুজে নাম রুহুল আমিন। শিপার ডাকনাম। ১৯৭২ সালে বরিশালের বাকেরগঞ্জে মাতুলালয়ে জন্ম। পৈত্রিক বাড়ি পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জে। পড়ালেখা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে। পরে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে আইন শাস্ত্রে স্নাতক হয়েছেন। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রায় দুই যুগ আগে তিনি পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেন। বর্তমানে পুলিশ সদর দপ্তরে ডিআইজি পদে কর্মরত এ কর্মকর্তা সুদান ও লাইবেরিয়ায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়েছেন। প্রকাশিত ভ্রমণগদ্যের বই ‘দ্রাবিড়ের আর্য দর্শন’।