খুব কম বই আছে যা পড়ার সঙ্গে ভাবায়। পড়া থামিয়ে ভাবতে হয়। কোনো শব্দে বা গঠনে বা বিচিত্র ভাবনায় কবি পাঠককে মগ্ন-অন্ধত্ব থেকে বিছিন্ন করে আনে। মনে হয়, যেন কোনো অভিযানের অংশে আছি। অনুজপ্রতিম কবি আলী আফজাল খান-এর ‘কালাচাঁন’ এমনই একটি কবিতার বই। শুধু পড়ার নয়, ভাবারও।
কবি শুধু কবিতায় আবদ্ধ নয়, চিন্তাশীল প্রাবন্ধিকও। সম্পাদনা করেন, ‘ভিন্নচোখ’ নামের একটি সাহিত্য পত্রিকা। ভিন্নচোখ প্রকাশনী থেকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে প্রকাশ করেন নানাবিধ বই, যার একটা অংশ সাহিত্যের নতুন নিরীক্ষামূলক ধারাকে নিবেদিত।
আলী আফজালের কবিতা, বাংলাদেশে তথা এপার বাংলার নিরীক্ষামূলক কবিতার ক্ষেত্রে অত্যন্ত মূল্যবান সংযোজন। কবিতাকে নতুন করা মানে তাকে ধ্বংস করা নয়। কবিতার প্রকাশ, যা অতি ব্যবহারে নিষ্প্রাণ হয়ে আছে, যেখানে পরিচিত পুরোনো ব্যবহারের গঠনে বিরক্ত হচ্ছে সচেতন পাঠক, নতুনের প্রয়াসী কবির নিষ্ক্রান্তি শুরু হয় এই বিন্দুটি থেকে। নতুন ভাবনার শত্রু হল ‘ফর্মালিজম’, গঠনের স্থিতাবস্থা। কেউ কেউ চেষ্টা করেন আঙ্কিক ফর্মুলায় পাল্টা গঠন আনার। কেউ বা আবহমানের অমূল্য রত্ন-সম্ভারে ডুব দেন। কারিগরি-বিদ্যার চূড়ান্তে চলে যান। আবার কেউ কেউ স্থিতাবস্থাকে প্রাথমিকভাবে ভাঙেন নতুন ভাবনা দিয়ে। আমার নিজের পছন্দ শেষেরটি। অন্য পন্থাগুলোর সঙ্গে কোনো লড়াই নেই, লেখালিখিতে লড়াই হবেই বা কেন? তবে পছন্দ একটা থাকেই এবং সকারণেই থাকে।
আলী আফজালের নিরীক্ষা ভাবনা-নির্ভর। এই ভাবনার পরিসরেই কবি গড়ে তুলেছেন তার পছন্দের আঙ্গিক। যা আমার নিজেরও খুব পছন্দের।
১.
‘সাদা কচ্ছপ জোছনা
ফুটন্ত চাঁদ
কিভাবে ধীরে ধীরে
ওয়াক!
একটা চোখের পাতা বন্ধ করো
অফ শ্যাডো, দেখো জলচরী জোছনা
তোমার শরীর ভ্রমণ করছে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক ছাত্র’ (খুরুলে প্যাঁচার রাত)
২.
‘ধীরে ধীরে
ধীরে ধীরে
বোধ ছায়ার অসীম গহ্বর
পেটের তলায় দাঁত, বদলে যায় ক্যালেন্ডার’ (পা)
৩.
‘মানুষ এক অপূর্ব আলো, তবু শরীরের অন্ধকার মায়া থাকে, হাতড়াই ঘরের
পড়শী আর খুলির কোটর, আজলায় ফেনিল শব্দ, চোখের নকশীকাঁথায় ফুটফুটে
শিশুর মত চোখ মেলে আছে মাদলমদির’ (লাবডাব)
কবিতা চেতনার কারুকাজ। ভাবনা হলো সুতো। আফজালের চেতনা ফ্রেমবন্দি নয় আর ভাবনার জগতটি বিশাল। তাই ওর লেখায় একটা কিছু বলার ইচ্ছে থাকে। এই বলাটা অর্থবোধক নয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, যদি হতো, নিবন্ধ হয়ে যেত। সচেতন আফজাল সেই বলার চাপ সামলে নিজের দক্ষতায় তার লেখাগুলোকে কবিতার আঙ্গিকে নিয়ে তো গেছেনই, গঠনের বৈচিত্র্যও বজায় রাখতে পেরেছেন। কবিতায় ‘এই হলে ওই হবে’ এই যৌক্তিক ভাঁড়ামোটা কবি অস্বীকার করেছেন আর যত করেছে এবং যেভাবে করেছেন তাতে আমি মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। অথচ মুগ্ধতা ভেঙে দেওয়ার যাবতীয় শস্ত্র কবি প্রয়োগ করেছেন তার লেখায়।
১. পলকহীন অপলক প্রহরিণী
২. অঙ্গুরী বিবশ রেখে রুহ রুয়ে যায়
৩. সেলাই সেলাই উৎসব/কি ভাবে ট্যাবু?
৪. সাফোকেশনে খুঁজি ডুবুরি পোষাক, ভাবি আজই ডাকু হবো নাকি?
৫. অগ্নিগর্ভের দো-চোয়ানি জ্বালা
৬. হেয়ারপিন বাঁকের পরে খাদ/আস্ত একটা চলমান আত্মা
৭. শ্লেষ্মাস্তরে ফ্লাইওভার, বিলবোর্ড, টেলিভিশন
৮. যেটুকু হামেহাল উড়ায় অঘোরী বালক সেটুকুই তার অন্তর্জলী ফোটন
৯. তারারন্ধ্রে খুব ঘষে আসে তাবৎ ভাষাবিদের মুনশিয়ানায় আশ্চর্য সরোদ
১০. গলার বাক্সে বর্ষা বসেছে বেদম
পাঠক পড়ুন। থমকে যান। প্রশ্ন করুন। মুগ্ধ হন। বেরিয়ে আসুন। ট্রিগারড হন। নিজের কবিতা লিখুন। এই ১০টি পঙ্ক্তি এটা করতে সক্ষম বলেই আমি মনে করি। যা ‘বাহ’ বলার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ! আলী আফজালের কবিতায় সেই রসদ আছে যা মুগ্ধতার পরিসরের বাইরে রয়েছে। আধুনিক, উত্তরাধুনিক ইত্যাদি সময়বন্দি ভাবনায় যে বাধ্যতা থাকে, মানা বা না-মানার, দেশ-কালখণ্ডের ‘কালাচাঁন’-এর কবিতায় কবি তাকে অতিক্রম করেছেন। থিতু হয়েছেন নিজের জগতে। যদি মেনে নেন, হে পাঠক, যে, কবিতা একটি অভিযান তাহলেই এই বইটির পাতা ওল্টাবেন। গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি রোমাঞ্চিত হবেন। রোমাঞ্চ একটা অন্য-নিরপেক্ষ অনুভূতি, ভালো বা মন্দ লাগা দিয়ে যাকে মাপা যায় না। শেষ করছি কবির একটি কবিতা দিয়ে
চলন্ত
সময়
চলন্ত
চোখ
কাঁধ
ঠোঁট
তৃষ্ণার্ত
মনোভাব
মেঘের
ক্যাটওয়াক
নদীতে
পা
ঝলমল
রোদ
বিস্ফারিত
ভালবাসা
বিস্ফারিত
মনোভাব
তৃষ্ণার্ত
ঠোঁট
কাঁধ
কটি
পা
চোখ
চলন্ত
সময়
চলন্ত
অনন্ত
ভালবাসা
ভারতের ওড়িশা রাজ্যে অবস্থিত ইস্পাতনগরী রাউরকেলায় ছোটোবেলা থেকে প্রথম যৌবন কেটেছে। স্নাতক খড়গপুর কলেজ থেকে। সরকারি ব্যাংকে চাকরি, এখন রিটায়ার্ড। পত্রিকা সংপৃ: ‘দ্রিদিম’, ‘কবিতা ক্যাম্পাস’ এবং এখন ‘নতুন কবিতা’। লেখালিখির সূত্রে কিছু প্রকাশিত বই আছে। কবিতা এবং গদ্যর। ঘুরে বেড়ানো আর গানে আসক্ত। বর্তমানে পশ্চিম বাংলার খড়গপুরের বাসিন্দা তবে ব্যাঙ্গালোরেও একটা পা থাকে। সেখানে পারিবারিক কারণে থাকতে হয়।