বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

কেন ইরান বিশ্বের সেরা সিনেমাগুলা বানায়? ।। অনুবাদ : কুলসুম হেনা

0

বিবিসি কালচারের সেরা একশো বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র সন্ধানের সাম্প্রতিক তালিকায় চারটি ইরানি চলচ্চিত্র উঁচু স্থান দখল করেছে। হামিদ দাবাশি দেশের এই অসামান্য চলচ্চিত্রীয় অর্জন উদযাপন করেছেন।


বিবিসি কালচারের একশো সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র তালিকার তিনটি চলচ্চিত্র আব্বাস কিয়ারোস্তামির ‘ক্লোজ আপ’ (৩৯), ‘হোয়্যার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম?’ (৯৪) এবং ‘টেস্ট অফ চেরি’ (৯৭)। একটি, আসগর ফরহাদির ‘অ্যা সেপারেশন’ (২১) যা এই তালিকার সেরা পঁচিশে স্থান পেয়েছে।

এটা সত্যি যে ইরানি চলচ্চিত্রের বেশ কিছু অনবদ্য ছবি এই সম্মানজনক তালিকায় স্থান পায়নি, আবার নির্বাচিত এই বিশেষ চলচ্চিত্রগুলিও অবাক করার মতো নয়। কেউ অন্য আরো অনেকসেরা কাজের কথা বলতেই পারেন যা সামনে আসা উচিৎ ছিল কিন্তু, কেউ এই চারটির গুরুত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। আবার বিশ্বমানের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে আব্বাস কিয়ারোস্তামির উঁচু আসন নিয়েও কথা বলতে পারবে না। ইরানি চলচ্চিত্রের প্রশস্ত চত্বরে গত একশো বছর বা তারও বেশি সময় ধরে বৈচিত্র্যময় পরিবর্তন হয়েছে কিছু অসাধারণ চলচ্চিত্র ঘটনার দ্বারা, এবং এর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ কিছু চলচ্চিত্র নির্মাতারা বিশ্ব মনোযোগে উঠে আসতে পেরেছেন।


Hena Pic 000


মোটকথা, বিবিসি কালচারের তালিকা তৈরিতে যে সমালোচকরা পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা সম্ভবত ইরানি ছবি বা অন্য যেকোনো ভাষার ছবি সম্পর্কে জেনেছেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোর মাধ্যমে। প্রধানত কান, ভেনিস, বার্লিন এবং লোকার্নো যেগুলো যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কোরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার অন্য চলচ্চিত্র উৎসবগুলোকে আড়াল করে ফেলে। ইরানের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মূল থেকে এই বড় চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে ইরানি ছবির যাত্রা পর্যন্ত পথটি অনেক দীর্ঘ এবং ঘুর পথের। এবং ইরানি চলচ্চিত্রের আরম্ভ এবং গন্তব্য উভয়েরই ঐতিহাসিক নির্মাণের সূত্রপাত হয়েছিল একটি বহুজাতিক পরিমণ্ডলে— যেখান ভারতের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফিল্ম স্টুডিওতে সর্বপ্রথম ইরানি চলচ্চিত্র তৈরি করা হয় সেখান থেকে এই ইউরোপিয় চলচ্চিত্র উৎসবগুলো পর্যন্ত। ইরানি চলচ্চিত্রের দীর্ঘ ইতিহাসে বর্তমান সীমান্তে পৌঁছানোর মতো মুহূর্তে কখনো ঘটেনি। সর্বপ্রথম সবাক ইরানি চলচ্চিত্র ডকতার-ই-লোর/ লোর গার্ল (১৯৩২),যেটা ‘দ্য ইরান অফ ইয়েসটারডে’ এবং ‘দ্য ইরান অফ টুডে’ হিসেবেও পরিচিত। এটি আরদেশি ইরানি এবং আবদুল হসিন সেপান্তার প্রযোজনা বম্বের ইম্পেরিয়াল ফিল্ম কোম্পানিতে নির্মাণ হয়।

ইরানি চলচ্চিত্রের দীর্ঘ ইতিহাসে বর্তমান সীমান্তে পৌঁছানোর মতো মুহূর্তে কখনো ঘটেনি। সর্বপ্রথম সবাক ইরানি চলচ্চিত্র ডকতার-ই-লোর/ লোর গার্ল (১৯৩২),যেটা ‘দ্য ইরান অফ ইয়েসটারডে’ এবং ‘দ্য ইরান অফ টুডে’ হিসেবেও পরিচিত। এটি আরদেশি ইরানি এবং আবদুল হসিন সেপান্তার প্রযোজনা বম্বের ইম্পেরিয়াল ফিল্ম কোম্পানিতে নির্মাণ হয়।

এখানে একটা বৃহত্তর কাঠামোর সম্পর্ক রয়েছে যা ইউরোপ থেকে অটোমান এবং রাশিয়ার সাম্রাজ্য হয়ে— এবং সর্বদিক থেকে মিশর এবং ভারত পর্যন্ত বর্ধিত করে। এটা ছিল পার্শি গদ্য এবং কবিতার জাগরণের পাশাপাশি ইরানি ভিজুয়াল এবং পারফর্মিং আর্টের উত্থান।

ফোরুখ ফারুখজাদ (১৯৩৫-১৯৬৭) তাঁর সময়ের একজন প্রতিনিধিত্বকারী কবি এবং ইরানি চলচ্চিত্রের ইতিহাসকেও উজ্জ্বল করেন। একটা ছোটো ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র ‘দ্য হাউজ ইজ ব্লাকে’র (১৯৬২) মাধ্যমে ফারুখজাদ ইরানি চলচ্চিত্রের একটি সৃজনশীল পথ নির্মাণ করেন যেটা থেকে এটি সরে যায়নি। কুষ্ঠ রোগিদের একটি বসতিতে এই ডকুমেন্টারির শুটিং করা হয়। একটি অভিনব ও ভিত্তি ভাঙন প্রক্রিয়ায় ‘দ্য হাউজ ইজ ব্লাক’ সত্য ও কল্পনার সমন্বয়কে সংজ্ঞায়িত করেন।


Hena Pic 00

‘এ সেপারেশন’ সিনেমার একটি দৃশ্য


সেই দুর্ভাগ্যের দশক শেষ হওয়ার আগেই দারিয়ুস মেহেরজুইর ‘দ্য কাউ’ (১৯৬৯) ইরানের বাইরে আসে এবং ১৯৭১ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়। সেখানে এটা সমালোচনা পুরস্কার (ফিপরেসসি) জিতে নেয়। এটা গোলাম হেসেন সায়েদির ছোটোগল্পের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। বিস্ময়কর দৃশ্যায়ন এবং অসাধারণ বর্ণনাভঙ্গিতে ‘দ্য কাউ’ একজন গ্রামবাসীর গল্প বলে এবং পশুপাখির সাথে তার অভিনব মানবিক সম্পর্কের গল্প বলে।

 

বিপ্লব ও স্বীকৃতি
যদিও ১৯৭০ সালে ইরানি চলচ্চিত্রের জন্য খুব সংকটময় উন্নয়ন হয়েছিল। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব বিশ্ব মনোযোগ দখল করে নেয়। যেটা এই নজর ফিরিয়ে আনে সেটি হলো আমির নাদেরির প্রধানতম কাজ ‘দ্য রানার’ (১৯৮৪)। যখন এটা নান্তেসে তিন মহদেশের উৎসবে দেখানো হয়েছিল তখন এটা ছিল একটা কিছুর উদঘাটনের মতো। ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার অনেকগুলো জায়গায় এটা শুটিং করা হয়।‘দ্য রানার’ এটার নিজের একটি চলচ্চিত্রের ল্যান্ডস্কেপ নির্মাণ করে। একটা ছোটো ছেলের সম্মোহনী দৌড়ের ক্ষমতা, তার এককিত্বকে থেকে নাদেরি একটা গভীর আন্দোলিত, রূপকীয় তাৎপর্য প্রদান করে।


Hena Pic 2

‘দ্য রানার’ সিনেমার একটি দ্শ্য


‘দ্য রানারে’র বৈশ্বিক সাফল্যের পরেই বিশ্ব আব্বাস কিয়ারোস্তামিকে লক্ষ করে, যখন তাঁর ধ্রুপদী চলচ্চিত্র ‘হোয়্যার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম? (১৯৮৪) লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম দেখানো হয়। সেই সময়ে আব্বাস কিয়ারোস্তামি পরিচিত ও যথেষ্ট সফল চিত্র-পরিচালক ছিলেন ইরানের, কিন্তু ইউরোপে তাঁর গ্রহণটি তাঁকে ভিত্তোরি দ্য সিকার ‘বাইসাইকেল থিভস’ (১৯৪৮), ইয়াসুজিরো ওজুর ‘টোকিও স্টোরি’র (১৯৫৩), সত্যজিৎ রায়ের ‘অপু ট্রিলজি’র (১৯৫৫-১৯৫৯) পাশেই স্থান দেয় এবং তাঁর কাজকে বৈশ্বিক মর্যাদা ও তাৎপর্য দেয়।

সেই সময়ে আব্বাস কিয়ারোস্তামি পরিচিত ও যথেষ্ট সফল চিত্র-পরিচালক ছিলেন ইরানের, কিন্তু ইউরোপে তাঁর গ্রহণটি তাঁকে ভিত্তোরি দ্য সিকার ‘বাইসাইকেল থিভস’ (১৯৪৮), ইয়াসুজিরো ওজুর ‘টোকিও স্টোরি’র (১৯৫৩), সত্যজিৎ রায়ের ‘অপু ট্রিলজি’র (১৯৫৫-১৯৫৯) পাশেই স্থান দেয় এবং তাঁর কাজকে বৈশ্বিক মর্যাদা ও তাৎপর্য দেয়।

যখন কিয়ারোস্তামি ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে বিশ্বমঞ্চে নিজেকে প্রতিনিধিত্বশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, মখমলবফ পরিবার তখন ইরানীয় চলচ্চিত্রের ভাবমূর্তিতে একটি তীক্ষ্ম প্রভাব রাখে । বিশেষভাবে যখন সামিরা মখমলবফ তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘দ্য আপেল’ (১৯৯৮) কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয় তখন বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর।

আমি সেবছর ওই উৎসবে ছিলাম এবং দেখেছিলাম কিভাবে রাতারাতি ইরান সম্পর্কে একটা দাঁড়িওয়ালা রাগী লোক (খোমেনি) থেকে উজ্জ্বল হাসির তরুণ পরিচালকের দিকে বদলে যায়। এটা ছিল সেই পরিবতর্নের মুহূর্ত যখন একটা বৈশ্বিক গ্রহণে ইরানের চলচ্চিত্র বদলে যায় এবং এটার সাথে সাথে ইরানও।


Hena Pic 1

‘দ্য কাউ’ সিনেমার একটি দৃশ্য


সেই একই দশকে জাফর পানাহি আন্তর্জাতিক সমালোচনা পুরস্কার জিতে নেয় যখন তাঁর ‘দ্য সার্কেল’ (১৯৯৯) চলচ্চিত্রটি প্রথম যখন ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়। জাফর পানাহি ছিলেন কিয়ারোস্তামির সহকারী কিন্তু তিনি গুরুর চলচ্চিত্র পরাক্রমকে সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকে নিয়ে যান, যা কিয়ারোস্তামির চলচ্চিত্র আগ্রহের বাইরের জায়গা । প্রাথমিকভাবে তিনি পরিমিতি রেখে বিচারাধীন বিষয়গুলিতে আঘাত করেন। কিন্তু খুব দ্রুতই তিনি গ্রেফতার হন গ্রিন মুভমেন্টে (২০০৮-২০১০) তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে এবং কারাবাসের মেয়াদ স্থগিত করার জন্য সাজাপ্রাপ্ত হন। তিনি যেসব চলচ্চিত্র ইউরোপিয় চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে পাঠাতেন সেসব নির্মাণ করা থেকে তাঁকে নিষিদ্ধ করা হয়।

আসগর ফরহাদির দৃশ্যমান উত্থান ইরানি চলচ্চিত্র কী দিতে পারে সে সম্বন্ধে ধারণাই বলে দেয়। ফারহাদির পারিবারিক ছবি ‘অ্যা সেপারেশন’ (২০১১) সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে জিতে নেয় আকাডেমি পুরস্কার ২০১২– এবং পাঁচবছর পরে ২০১৬ সালে সেই একই পুরস্কার জিতে নেয় তাঁর ‘দ্য সেলসম্যান’ চলচ্চিত্রটি। ফরহাদি মঞ্চনাটকের পটভূমিকা থেকে চলচ্চিত্রে এসেছেন এবং মঞ্চগত চেতনা থেকে তাঁর ছবিগুলোতে গভীরভাবে নাটকীয়তা থেকে যায়। ফরহাদির ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি মাহমুদ কালারির অসামান্য সিনেমাটোগ্রাফি এই নাটকীয় ধারার সিনেমার সংজ্ঞায়নে ভূমিকা রেখেছে।

ইরানি চলচ্চিত্রের বৈশ্বিক মঞ্চায়ন কিছু সেরা কাজকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি দেয়, নান্দনিকভাবে এবং বিষয়গতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মতামত পাওয়া যায় যা দেশের চলচ্চিত্রিয় উপস্থাপন এবং ভবিষ্যৎ প্রজনের চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের অনুপ্রেরণা দেয়।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এই প্রক্রিয়ায় এমন কিছু অসাধারণ ইরানির ছবি এই মনোযোগটা পাওয়ার যোগ্য ছিল কিন্তু তা এর মধ্যে প্রবীন শিল্পীদের ভেতর প্রধানত ফারুখ গাফফারি, ইব্রাহিম গোলেস্তান এবং বাহমান ফারমানারার চলচ্চিত্রগুলো রয়েছে যাদেও কাজে দৃষ্টি পড়েনি।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এই প্রক্রিয়ায় এমন কিছু অসাধারণ ইরানির ছবি এই মনোযোগটা পাওয়ার যোগ্য ছিল কিন্তু তা এর মধ্যে প্রবীন শিল্পীদের ভেতর প্রধানত ফারুখ গাফফারি, ইব্রাহিম গোলেস্তান এবং বাহমান ফারমানারার চলচ্চিত্রগুলো রয়েছে যাদেও কাজে দৃষ্টি পড়েনি। ইরানের কিছু প্রতিভাধর নারী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মাধ্যমেও ইরান উপকৃত হয়েছে যেমন রাখসান বানিয়েতেমাদ, মারজিয়েহ মেশকিনি এবং মানিজেহ হেকমত, তারাও তাঁদের প্রাপ্যটা পায়নি।

ইতোমধ্যে ইরানের বাইরে, এবং এর আন্তঃদেশীয় উৎসের উর্বরভূমি থেকে এ ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নতুন একটি প্রজন্ম উদিয়মান হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে রামিন বাহরানি (চপ শপ, ২০০৭) এবং শিরিন নিশাত (ওমেন উইদাউট মেন, ২০০৯)। এই পরিচালকরা, যাদের ইরানি চলচ্চিত্রের সবচেয়ে স্থায়ী অনুষঙ্গগুলির গভীর শেকড় রয়েছে, তারাই এখন এটার ভবিষ্যৎকে অজেয় অঞ্চলের দিকে নিয়ে যাবে।


Hamid Dabashi

হামিদ দাবাশি

হামিদ দাবাশি নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরানের সামাজিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস, তুলনামূলক সাহিত্য এবং বিশ্বচলচ্চিত্র পড়ান। তাঁর বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ক্লোজ আপ : ইরানিয়ান সিনেমা, পাস্ট, প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার’ (ভার্সো, ২০০১)।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন। সাহিত্যের গবেষণায় ব্রতী। প্রবন্ধ লেখেন। অনুবাদ করতে ভালোবাসেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।