কৈশোরের শুরুতে সাধারণত দাড়ি বা উচ্চতার মতো প্রেমও মোটামুটি ছেলেদের শরীরে এসে ভীড় করা শুরু করে। মেয়েদের ক্ষেত্রেও ধরে নিচ্ছি ব্যপারটা একই (দাড়ির ব্যপারটা বাদে)। প্রথম জীবনের ওই শাশ্বত বোকা বোকা প্রেম পরবর্তী জীবনে নস্টালজিয়া হয়ে ব্যস্ত সময় থেকে হালকা ছুটি দেওয়া বাদে আর তেমন কোনো কাজে আসে না। এই সিনেমার ব্যপারটাও অনেকটা ওরকম। ব্যস্ততা, ব্যর্থতা, বুগিচুগি এক্সিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিসের মধ্যে এরকম সিনেমাগুলো মনে করিয়ে দেয় যে কেন সিনেমা ইজ প্রবাবলি দ্যা বেস্ট ভার্সন অফ লাইফ। শীতের সময় গরম পানি দিয়ে গোসল করার সময় যতক্ষণ পানিটা গায়ে থাকে ততক্ষণ পুরো শরীরে এক অদ্ভুত আরাম ছড়িয়ে পরে। কিছুক্ষণের জন্য মনে থাকে না যে আমার জীবনে হাজারও সমস্যা। ফ্লিপড নামের এই সিনেমা আমাকে শীতকালে গরম পানি দিয়ে গোসল করার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। আমি বোকা বোকা ভাষায় যা লিখছি জ্ঞানী লোকেরা তাকে এস্কেপিজম বলে ব্যখ্যা করতে পারে অবশ্য।
একটা সময় ছিল যখন আমাদের সর্বোচ্চ দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল সন্ধ্যার আগেই কিভাবে বাসায় ঢোকা যায়। বন্ধুবান্ধব হৈচৈ, ভয়, ভালোবাসা সব মিলিয়ে জীবন আমাদেরকে তখন চুম্বকের মতো টানছিল। জীবন থেকে পালানোর তখনো দরকার পরেনি আমাদের কারো। জীবনের ওই সময়ের একটা গল্প নিয়েই বানানো রব রেইনারের সিনেমা ‘ফ্লিপড’।
আমি ভেবেছিলাম শুরুতেই সবাইকে জানিয়ে দেব যে প্রেমের গল্পে যেসব স্টোরি আর্ক থাকে মানে যেসব বর্তমানে ক্লিশেতে পরিণত হয়েছে আর কি, তার অনেককিছুই আছে এই সিনেমায়। কিন্তু তারপর আমার মনে হলো আমি বোধহয় সিনেমাটাকে হার্শলি জাজ করছি। জীবনটাও তো ক্লিশেই অনেকটা। ভালোবাসা আসে, ভালোবাসতে হয়, এরপর মন ভাংগে এরপরে আবার ভালোবাসা আসে আবার নিজেকে গুছিয়ে কোনোমতে ভালোবাসতে হয়।
‘ফ্লিপড’ অবশ্য ভালোবাসা ‘ক্ষনস্থায়ী’ এমন সিনিকাল কোনো মেসেজ দেওয়া চেষ্টা করেনি। ‘ফ্লিপড’ প্রথম প্রেমের গল্প। মস্তিষ্কের কোনো এক কোণে সাজিয়ে রাখা অনূভূতির গল্প। ‘ফ্লিপড’ যেখানে আলাদা সেটা হলো বেশিরভাগ সময়ে প্রেম, হার্টব্রেক সবকিছুরই একপাক্ষিক গল্প নিয়ে বেচে থাকি আমরা। ‘ফ্লিপড’ দুইপক্ষেরই গল্প। তাই শুরুতে কার পক্ষে থাকা উচিত সেটা বুঝতে একটু অসুবিধা হয়। কিন্তু পরে বোঝা যায় কোন গাধাটা ভালোবাসা বোঝে না।
থিয়েট্রাকালিটি বাদ দিয়ে একচুয়াল গল্পটা নিয়ে যদি কথা বলতে হয় তাহলে শুরু করতে হয় জুলি বেকারকে দিয়ে। সে প্রেমে পরে যায় তাদের এলাকায় নতুন আসা ব্রাইস লোস্কির। ব্রাইসের সবকিছুই তার ভালো লাগে। ব্রাইসের হাসি, ব্রাইসের চুল এমনকি ব্রাইসের গন্ধও। কিন্তু ব্রাইসের জুলিকে অতটা ভালো লাগে না। খানিকটা অপছন্দই করে সে। জুলি বেকার কিন্তু হার মানে না। সে তার প্রথম প্রেমের ব্যপারে হার মানতে প্রস্তুত না। সে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। যেহেতু ইন্টারেকশনটা দুই পক্ষের দিক থেকেই দেখানো হয় তাই কখনো এই প্রেম প্রেম খেলা খুব সুইট ইনোসেন্ট আবার কখনো বর্ডারলাইন অবসেশনের এর পর্যায়ে পরে যায়। তবে এটাও বোঝা যায় যে দু’জনের কেউই নিজের ইমোশনের সাথে পুরোপুরি পরিচিত না। হওয়ার কথাও না কারণ তারা দুজনেই হাইস্কুলের বাচ্চা।
সমস্যা শুরু হয় তখন যখন জুলি বুঝতে পারে ব্রাইস তার স্বপ্নে যতটা সুন্দর বাস্তবে অতটা সুন্দর না। আর ব্রাইস তো জুলিকে নিয়ে স্বপ্নই দেখে না। সে কোনোভাবে এই মেয়েকে ভুলে যেতে পারলেই বাঁচে।
ইয়াং এডাল্ট বা টিনএজ ভালোবাসার গল্পগুলোতে বেশিরভাগ সময় একজন বৃদ্ধ লোক বা মহিলা থাকেন। যিনি পুরো সিনেমায় তেমন কথা বলেন না কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ সবাইকে নিজের পারস্পেক্টিভ দিয়ে ধন্য করেন এবং গল্পের প্লট এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন।
ইয়াং এডাল্ট বা টিনএজ ভালোবাসার গল্পগুলোতে বেশিরভাগ সময় একজন বৃদ্ধ লোক বা মহিলা থাকেন। যিনি পুরো সিনেমায় তেমন কথা বলেন না কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ সবাইকে নিজের পারস্পেক্টিভ দিয়ে ধন্য করেন এবং গল্পের প্লট এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। তার কোটগুলো দর্শক স্ক্রিনশট মেরে মাইডে দেয় এবং নির্দিষ্ট কারো মেসেজের আশায় বসে থাকে। এই সিনেমায় ওই ডামবলডোর/ গ্যান্ডালফ হচ্ছে ব্রাইস এর দাদু। তিনি তার জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য দিয়ে ব্রাইসকে বোঝাতে সক্ষম হন যে জুলি বেকারের মতো মেয়ে আর হয় না। এবং ব্রাইসও আস্তে আস্তে জুলিকে ভালোবাসতে শুরু করে। এবং এখান থেকে হালকা একটা সমস্যা শুরু হয়।
ইন্টারফেরেন্সের মতো ভালোবাসাতেও দুই পক্ষ একই সময়ে একই ফেইজে না থাকলে কিছুই হয় না। এটা জীবনের এক অদ্ভুত সমস্যা। ব্রাইস জুলির প্রেমে এমন একসময়ে পরে যখন জুলি আস্তে আস্তে তাকে ভুলতে শুরু করেছে। তাদের সম্পর্কের ডায়নামিকটা তখন তাই পরিবর্তন হয়ে যায়। এতদিন জুলি ব্রাইসের পেছন পেছন ঘুরলেও এবার ব্রাইস জুলির পেছনে হন্য হয়ে ঘোরা শুরু করে। জুলিকে নিয়ে বাজে কথা বলায় নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে মারামারিও করে। জুলি সব দেখে। কিন্তু সে তো আর ব্রাইসকে ভালোবাসতে পারবে না কখনো। শেষ পর্যন্ত কি হয় সেটা না বলি।
সিনেমেটিক ইম্প্রেশনের কথা বলে শেষ করি। এই সিনেমার ডায়ালগ, ডিরেকশন, সিনেমেটোগ্রাফি, এক্টিং তেমন কিছুই আপনার মনে থাকবে না। দুইপক্ষের পারস্পেক্টিভের ব্যপারটাও বইয়ে যতটা ইন্টারেস্টিং, সিনেমাতে বারবার ইনার মনোলোগ ব্যবহারের কারণে সেই ব্যপারটা একটু পরেই বিরক্ত লাগা শুরু হয়। এই কারণে ডিরেক্টর রব রেইনারকে দোষারোপ করাই যায়।
রব রেইনার কোনো এক অদ্ভুত কারণে সিনেমার ঘটনাকাল রেখেছেন ৬০ এর দশকে। এমনটা হতে পারে যে ১৯৪৭ এ জন্মানো রব রেইনার নিজের টিনএজ সময়টাতে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন।
সিনেমার কাহিনি নেওয়া হয়েছে ২০০১-এ বের হওয়া ইয়াং এডাল্ট বই ‘ফ্লিপড’ থেকে। ওয়েন্ডেলিন ভ্যান ড্রানেনের লেখা মূল বইটিতে ওয়েন্ডেলিন যে ভালোবাসার কথা বলেছিলেন সেই ভালোবাসা অনেক কন্টেম্পোরারি। কিন্তু রব রেইনার কোনো এক অদ্ভুত কারণে সিনেমার ঘটনাকাল রেখেছেন ৬০ এর দশকে। এমনটা হতে পারে যে ১৯৪৭ এ জন্মানো রব রেইনার নিজের টিনএজ সময়টাতে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। এবং তার উদ্দেশ্যও হয়তো ছিল তার বয়সী মানুষদেরকে আবার একবার টিনএজ ভালোবাসার অনূভূতি মনে করিয়ে দেওয়া। তাই ডিরেকশন, এক্টিং, ডায়ালগ এমনকি গল্পও যদি মনে না থাকে, এই সিনেমা আপনাকে কেমন ফিল করিয়েছে সেই কথাটা নিশ্চিতভাবেই মনে থেকে যাওয়ার কথা। সিনেমার আর কাজই বা কি এটা বাদে?
প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র। কিন্তু আগ্রহ এবং প্যাশন সিনেমাকে কেন্দ্র করে। সিনেমা নির্মাতা হবার উদ্দেশ্যে সে একাধিক শর্টফিল্ম তৈরি করেছে। সিনেমা নির্মানের পাশাপাশি লেখালেখিতে আগ্রহী। প্রকাশিত অনুবাদের বই রিচার্ড ফাইনম্যানের লেখা ‘সিক্স ইজি পিসেস’।