কবিতা আসলে কী? ভাবতে শুরু করলে খুব প্রিয় এক বইয়ের কথা মনে পড়ে, ভাস্কর চক্রবর্তী-র ‘শয়নযান’-এর—
“কবিতা কি স্তব্ধতার ভাষা? কবিতা কি জানার মাঝে অজানাকে সন্ধান? জীবন আর মৃত্যুর আলোছায়াময় খেলা? কবিতা কী, আচ্ছা, আমি বলছি। —আলোয় ভর্তি একটা পাহাড়, যে আলো শুধুই হাজার মোমবাতির। মোমবাতিগুলো সব জ্বলছে, আর পাহাড়টা আস্তে আস্তে ডানা ভাসিয়ে শূন্যে উড়ছে, আর ভেসে যাচ্ছে। কবিতা আমার কাছে ঠিক এইরকম। আলোয় সাজানো একটা পাহাড়ের ভেসে যাওয়ার মতো।”
![Khulite Haspatal](https://www.sree-bd.com/wp-content/uploads/2025/02/Khulite-Haspatal-208x300.jpg)
খুলিতে হাসাপাতাল | জুয়েইরিযাহ মউ | প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য | ধরন: কবিতা | প্রকাশক: চৈতন্য | মুদ্রিত মূল্য: ২৫০ টাকা | বইটি সংগ্রহ করতে এখানে ক্লিক করুন।
আমার মনে হয়, অনুভূতির নিঃসরণ যখন ছন্দবদ্ধ হয়ে ইমেজ দেখাতে পারে মগজকে সেটা কবিতা হয়ে ওঠে।
‘খুলিতে হাসপাতাল’ কবিতার সিরিজটা যখন লেখা শুরু করি তখন ২০১৬ সাল। তখন প্রথম কবিতার বই ‘তাসেরা বুকমার্ক’ প্রকাশিত হয়েছে মাত্র। আমার এমন হয়। একটা কবিতার সিরিজ পেরোনোর পরে আরেকটার দিকে ছুটে যায় মন। এই যেমন ‘খুলিতে হাসপাতাল’ এর প্রচ্ছদ যেদিন ফাইনাল হলো সেদিন আমি পরের সিরিজের প্রথম কবিতাটি লিখেছি এই ২০২৫-এর জানুয়ারিতে। তো ২০১৬ থেকে ২০২৪-এর শুরুর দিকে লেখা বাছাইকৃত কবিতাগুলো এখানে আছে। এর মধ্যে আমার কাছে মনে হয় নারীজীবনের স্পেসিফিক অনুভূতি বা নারীসত্তা, রাজনীতি, বন্ধুত্ব আর প্রেম গুরুত্ব পেয়েছে।
‘খুলিতে হাসপাতাল’ কেন নামটা এমন, এই প্রশ্ন অনেকে করেছেন আমায়। এর উত্তরে সেই সময়টার কথাই মনে পড়ে, যখন ২০১৬-তে কিছুটা বিক্ষিপ্ত, বিষণ্ন মন। যখন একটা ঝড় আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তখন কবিতা লেখার পরে মনে হচ্ছিল নির্ভার হচ্ছি। নিরাময় ঘটছে। হঠাৎ মনে হলো এই নিরাময় তবে মগজে ঘটছে, মগজে তবে একটা হাসপাতাল আছে নিশ্চয়। সেই থেকে ‘খুলিতে হাসপাতাল’।
বইটা ‘চৈতন্য’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে, বইমেলায় স্টল নম্বর ৬০৭-৬০৮। প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। বই আমার কাছে কেবল লেখা নয়, বই হাতে নিতেই যে আরাম-আরাম অনুভূতি হয়, প্রচ্ছদে-বাঁধাইয়ে, বইয়ের সাইজের ধরণে, বই আমার কাছে এ সমস্তকিছু নিয়েই বই। তাই এসব ব্যাপারে আমি সচেতন ছিলাম। প্রকাশক রাজীব চৌধুরীও যে বেশ যত্নশীল ছিলেন সে আমার দারুণ পাওয়া।
বিস্তারিত নিজের বই নিয়ে নিজের লিখে যাওয়াটা কষ্টের। ভাষাশৈলী, মেটাফোর কিংবা কবিতার অলিগলি নিয়ে কিছুই বলতে ইচ্ছে করে না, আড়ষ্টতা কাজ করে। মনে হতে থাকে এ কথা তো পাঠকের বলার কথা কিংবা পাঠকের নিস্তব্ধতায় জমে থাকার কথা। তাই আমি ‘খুলিতে হাসপাতাল’ নিয়ে যখন শ্রী-এর জন্যও লিখছি তখন কী যে সত্যি লিখে রাখা যায় ভাবছি ভীষণ। হয়তো লিখে রাখা যায় বাবার অসুস্থতার মুহূর্তদের, নীল অবসাদ, ওষুধের গন্ধ আর নির্ঘুম রাতের কথা। বাবাকে জীবনে প্রথমবারের মতোন এমন ম্লান দেখার যন্ত্রণার কথা। যে যন্ত্রণা আমাকে দিয়ে ‘বাবার অসুখ হলে’ লিখিয়ে নেয়।
কিংবা কবি সৌরভ মাহমুদ-এর কথা লেখা যায় কি? হিমঘরের সামনে আমি—মিতুল আহমেদ—হাসান জামিল এবং আরও অনেক চেনা-অচেনা-আধচেনা মুখেদের বসে থাকার কথা… হাসান-এর হাতে ধরা আইনী-কাগজের পাতার কথা, যেখানে একটা মাফলারের কথা লেখা থাকে আমাদের বিষণ্নতার ওপর পিঠে।
আমি কি লিখব ‘খুলিতে হাসপাতাল’ নিয়ে? আমার রজঃস্রাবের ব্যথা যে মাতৃত্বকে ধুয়ে দিচ্ছে প্রতি মাসে তার কথা? কিংবা ‘ধর্ষিতার কাটা-মাথা ইমেজ প্রেমিকের দেওয়া যৌন সুখ ভুলিয়ে দিচ্ছে হে রাষ্ট্র !’ —এমন লেখা কোনো লাইনের কথা?
আমি কি লিখব যে আমার ভেতর নিংড়ে লিখেছি সেখানে একটা কবিতায়—
“যে কোনো পুরুষই দীর্ঘ যাত্রায় ক্লান্তিকর। তবে মানুষ ব্যাপারটা চার্মফুল, ভ্রমণে রোমাঞ্চ জাগে। শহরের অনেক গাছেই আমি লিঙ্গ খুঁজে ফিরেছি, ছাল ওঠা সাদা, গাঢ় বাদামী কিংবা কালো!”
বরং লেখা থাক যাপনই কবিতা আমার, কবিতাতেই যাপন… সেইটুকু যদি কেউ স্পর্শ করে ‘খুলিতে হাসপাতাল’ এর মাধ্যমে তবে তার সাথে থাকবে আত্মার সংযোগ।
![Zuairijah Mou](https://www.sree-bd.com/wp-content/uploads/2025/02/Zuairijah-Mou.jpg)
লেখালেখির অঙ্গনে কবি ও কথাসাহিত্যিক হিসেবে জুয়েইরিযাহ মউ নিয়মিতভাবেই লিখে যাচ্ছেন। তার প্রকাশিত শিশুতোষ রহস্য উপন্যাস ‘টিলাগড়ের রহস্য’ এবং গল্পগ্রন্থ ‘সোনাপুরের মিলা’। আরেকটি গল্পগ্রন্থ ‘অস্তিত্বে কুহেলিকা কিংবা টুকরো টুকরো প্রাণের কথকতা’ প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ সালে। তার সর্বশেষ গ্রন্থটি কাব্যগ্রন্থ, শিরোনাম ‘তাসেরা বুকমার্ক’ যা ২০১৬ এর বইমেলায় প্রকাশিত হয়। তিনি সার্ক লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে ২০১৮ এবং ২০২২ সালে অংশগ্রহণ করেছেন।