প্যান্টের নিচের অংশটা একটু চিপ্যা স্যান্ডেলের কাদা ঝাইড়া নিয়া শারমিন খালার বাসার গেইট দিয়া ঢুকি আমি। গ্যারাজের মেঝেতে পানির দাগ ফালাইতে ফালাইতে সিঁড়ি কোঠার দিকে আগাই, লিফট না নিয়া সিঁড়ি বায়া দোতলায় উইঠা যাই। বিরতি দিয়া দিয়া কয়েকবার বেল চাপার পরে খালা নিজেই দরজা খুলেন। খালার জামার উপরে একটা অ্যাপ্রোন বান্ধা, মনে হয় রান্নাবাড়া করতেছিলেন। উনার অভ্যাস হইল কিছুদিন পর পর নতুন কোনো রেসিপি রান্না করবেন আর আশেপাশের সবাইরে ডাইকা খাওয়াইবেন। ঘরে ঢুইকা একপাশে দাঁড়াইয়া বলি, ‘একটা গামছা টামছা দেইন খালা, এক্কেরে ভিজ্যা গেছি।’ শারমিন খালা দ্রুত হাঁইটা ভিতরের ঘর থাইকা একটা ভাঁজ করা গামছা আইনা দেন। গামছাও যে কখনো ভাঁজ কইরা আলমারিতে গুছায়া রাখা যাইতে পারে তা এই বাসায় না আসলে কোনোদিন জানতে পারতাম না। মুখ মাথা মুছতে গিয়া টের পাই গামছাটাতে আলমারির ভেতরের গন্ধ লাইগা আছে। আমাদের বাসার গামছায় সব সময় রোদের গন্ধ থাকে। প্রতিদিন পশ্চিমের বারান্দায় মেইলা দেওয়া হয় সবার সব গামছা। সেইগুলি ভাঁজ কইরা আলমারিতে গুছায়া রাখার ইচ্ছা বা অবকাশ কারো হয় না।
উনার অভ্যাস হইল কিছুদিন পর পর নতুন কোনো রেসিপি রান্না করবেন আর আশেপাশের সবাইরে ডাইকা খাওয়াইবেন। ঘরে ঢুইকা একপাশে দাঁড়াইয়া বলি, ‘একটা গামছা টামছা দেইন খালা, এক্কেরে ভিজ্যা গেছি।’ শারমিন খালা দ্রুত হাঁইটা ভিতরের ঘর থাইকা একটা ভাঁজ করা গামছা আইনা দেন।
‘ব, ধোকলা খাবি?’ শারমিন খালা অ্যাপ্রোন খুইলা রান্নাঘরের দরজায় লাগানো হুকে ঝুলায়া ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বইসা বলেন।
‘ধোকলা কী জিনিস?’ জিগাইতে গিয়া আমি টের পাই পেটে ক্ষুধা ভালোই চাগার দিতেছে, সারাদিন তেমন কিছুই খাওয়া হয় নাই।
‘আইচ্ছা দ্যান।’ উদ্ভট নামের একটা খাবার খাইতে রাজি হইয়া যাই খানিকটা ক্ষুধার চোটে আর খানিকটা খালার ভয়ে। উনি সম্ভবত আজকে খারাপ মুডে আছেন, আমি আগেও লক্ষ করছি উনি যত বেশি পিসড অফ থাকেন তত উদ্ভট খাদ্য পাক করেন। আইজকার মেনুর নাম যথেষ্ট আজিব, তাই ধইরা নেওয়া যায় উনার মেজাজ বিলা আছে। যে খাবারই উনি সাধুক, মানা করলে ক্ষেইপা যাবেন হয়তো। আমি দেয়ালের ঘড়িটার দিকে তাকাই। গণশা’দা বলেছে রাত নয়টার বেশি যেন না বাজে কোনোমতেই। এখন ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজতেছে। জুন মাসের ভ্যাপসা গরম আর একটু পর পর বৃষ্টি আইজকা। এই সময়ে লাশ কয়েক ঘন্টা রাখলেই ফুইলা ঢোল হইয়া যাইতে থাকে। সেজন্যেই তাড়াহুড়া। শীতের দিন হইলে রাত সাড়ে এগারোটা কি বারোটা পর্যন্ত নাকি আরামসে রাখা যাইত। অন্তত গণশা’দার তাই মত। গণশা’দা হইল একজন ডোম, মর্গে চাকরি করে। সে দায়িত্ব নিয়া বলছে যে টাকাটা রাত নয়টার মধ্যে দিয়া দিলে দশটার সময় ক্লিয়ারেন্স দিয়া দেওয়া যাবে, চাইলে আইজ রাইতে জানাজাও পড়ায়া ফেলা যাইতে পারে। যদিও এশার ওয়াক্ত চইলা আসছে। দিন বড়ো এখন, সন্ধ্যা দেরি কইরা হয়, আর এশার ওয়াক্তও, কিন্তু আইজকা সারাদিনে আমার মনে হইল জুনের দিনও বেশি বড়ো না। সময় ব্যাপারটা আসলেই আপেক্ষিক।
শারমিন খালা একটা বাটিতে কইরা বিশ্রি হলুদ রঙের বর্গাকৃতি ভিজা ভিজা কয়েকটা জিনিস আমার সামনে আইনা রাখেন। বাটির তলায় তরল একটা জিনিস দেখা যাইতেছে, তেল কিংবা চিনির শিরার মতন দেখতে, তাতে ভাজা কাঁচা মরিচ আর কী একটা পাতা। ছোটো ছোটো দানাগুলি কি কালোজিরা নাকি সরিষা? আমি ইদানিং চোখে হালকা কম দেখতেছি। আইলসামির কারণে ডাক্তার দেখানো হইতেছে না।
‘এইডা হইল দক্ষিণ ভারতীয় একটা খাবার’, শারমিন খালা চেয়ারে বসে বলেন, ‘খায়া দেখ, ভালা না লাগলে পুডিং খাইস, ফ্রিজে পুডিং আছে।’ পুডিং এর নামে আমার মনটা চনমন কইরা উঠে। কিন্তু এখন খাইতে চাওয়ার মানে ধোকলা নামের এই আজিব বস্তুটাকে রিফিউজ করা। আমি এতক্ষণে টের পাই ক্ষুধা ব্যাপারটা কত সর্বগ্রাসী, মৃত্যু কিংবা লাশ পর্যন্ত ক্ষুধার সামনে খুব তুচ্ছ। আমি কইলাম, ‘দুইডাই খায়াম।’
তিন চাইরবার দ্রুত মুখে ঢুকায়া আমি জিনিসগুলি খায়া নেই। তেমন খারাপ না খাইতে। সামান্য টক, হালকা মিষ্টি আর নোনতা স্বাদ পাওয়া গেল। আমি বাটি আগায়া দিয়া বলি, ‘এখন পুডিং দ্যান।’ খালা খুশি হইয়া বাটিটা হাতে নিয়া পাকঘরের দিকে যান।
লিভিং রুমের একটা আরামদায়ক সোফার পাশে নিচু একটা কাঠের টেবিলে টিভির রিমোট রাখা। খালা মনে হয় রান্না করার ফাঁকে ফাঁকে টিভি দেখতেছিলেন। আমি রিমোট তুইলা নিয়া প্লে দেই। রুনা লায়লা এতক্ষণ নাচের একটা পোজ লইয়া খাড়াইয়া ছিলেন। আমি প্লে দিতেই উনি সরব এবং সচল হইলেন ‘বৃষ্টির ছন্দে বকুলের গন্ধে আমায় তুমি ফেলে যেও না।’
আমি ভাবতে থাকি শুরুটা কেমনে করা যায়। সরাসরি টাকা চায়া ফালানো উচিৎ হবে, নাকি আগে ঘটনার বর্ণনা দিইয়া লমু? ভাবতে ভাবতে আমার মনে হয় যেন অনন্তকাল চইলা যাইতেছে। খালা রান্নাঘর থাইকা পুডিং নিয়া আসতেছেন না। লিভিং রুমের একটা আরামদায়ক সোফার পাশে নিচু একটা কাঠের টেবিলে টিভির রিমোট রাখা। খালা মনে হয় রান্না করার ফাঁকে ফাঁকে টিভি দেখতেছিলেন। আমি রিমোট তুইলা নিয়া প্লে দেই। রুনা লায়লা এতক্ষণ নাচের একটা পোজ লইয়া খাড়াইয়া ছিলেন। আমি প্লে দিতেই উনি সরব এবং সচল হইলেন ‘বৃষ্টির ছন্দে বকুলের গন্ধে আমায় তুমি ফেলে যেও না।’ খালা একবার বলছিলেন, উনারা যখন ছোটো ছিলেন, বিটিভিতে কোনো প্রোগ্রাম না থাকলে নাকি রুনা লায়লার গানগুলি ছাইড়া দিত। সেই থাইকা অভ্যাস হইয়া গেছে, কোনো কিছু করার না থাকলে উনি রুনা লায়লার গান দেখেন, ইউটিউবে। নতুন কিছুর জন্য অপেক্ষা করার জন্য নাকি রুনা লায়লার গানের চাইতে ভালো কোনো পুরাতন জিনিস নাই!
এইবারে ক্রিস্টালের একটা বাটিতে সোনালি রঙের একটা ছোটো চামুচ দিয়া বড়ো এক টুকরা ক্যারামেল পুডিং আইনা দ্যান শারমিন খালা। আমার হুট কইরা খুব কান্দা আইসা যায়। আমার মনে পড়ে, লিরার খুব প্রিয় খাবার ছিল ক্যারামেল পুডিং। সে একবার আস্ত একটা পুডিং বাক্সে কইরা নিয়া আসছিল, নিজে বানায়া। সেই বাক্স চুইয়া ক্যারামেল পইড়া কী একটা দরকারি কাগজ ভিজ্যা যাওয়াতে আমি ওরে বেশ বকাঝকা করছিলাম। আর কোনোদিন সে পুডিং খাবে না, ভাবতে গিয়া আমার পেট থাইকা একটা ভারী জিনিস গড়ায়া গড়ায়া গলার কাছে আইসা যায়, গলা ব্যথা করে আর চোখ একটু একটু জ্বলতে শুরু করে, আমি বাটিটা নিয়া সাইড টেবিলের উপরে রাইখা লিভিং রুমের পাশের বাথরুমে ঢুইকা যাই। চোখে মুখে পানি ছিটা দেই। তারপরে মনে হয় পরিষ্কার বাথরুম পাওয়া গেছে, মুইতা নেওয়া ভালো। আজকে সারাদিন খাওয়ার সময় যেমন পাওয়া যায় নাই, ওয়াশরুমে যাওয়ার সময়ও পাই নাই।
‘পুডিং ঠিক আছে নাকি রে?’ খালা সোফায় আরাম কইরা বইসা বলেন। আমি বলি, ‘হ, ঠিক আছে, মজা হইছে।’ আসলেই মজা হয়, ঘন দুধের প্রায় হলুদ পুডিঙের একপাশে চকলেট রঙের ক্যারামেল, ফ্রিজ থাইকা বাইর করা পুডিঙের এক টুকরা মুখে দিলেই মনে হয় জুহি চাওলার কথা, লিরার পুডিংপ্রীতির কথা মনে পড়াতে আইজ আর জুহি চাওলারে মনে পড়ে নাই। লিরার ব্যাপারে আমার সকল অপরাধবোধ চাগাড় দিয়া উইঠা জুহি চাওলার বড়ো চোখ আর গোলাপি ঠোঁটের সঙ্গে হলুদ পুডিঙে খয়েরি ক্যারামেলের সংযোগ-অযোগ্য সমন্ধ নিয়া ভাবার অবকাশ হয় নাই। রুনা লায়লা এখন গাইতেছেন ‘যখন থামবে কোলাহল।’ আমি খাওয়া শেষ কইরা পানি খাইতে উইঠা যাই। পানি খাইতে খাইতে ঠিক করি সরাসরি ঘটনায় চইলা যাব।
‘খালা, আপনে সাকি টাওয়ারের ঘটনা হুনছুইন?’
শারমিন খালা নিজের ফোনে কী জানি দেখতে দেখতে হাসতেছেন, ইউটিউবে রুনা লায়লার গান চলতেইছে, কিন্তু বুঝলাম, সেই দিকে উনার মনোযোগ নাই। হয়তো যে নতুনের জন্য উনি অপেক্ষা করতেছিলেন সেইটা আইসা গেছে উনার জীবনে।
‘দ্যাখ দেহি কারবারডা’ খালার ঠোঁটের স্মিত হাসিটা সশব্দ হাসিতে টার্ন নেয় আর উনি দুইলা দুইলা হাসতে থাকেন।
‘কী হইছে?’ আমি ভাব লই যে তেমন ভালোমতো লক্ষ করি নাই। ভাবটা নিজের কাছেই লই, কারণ খালার মনোযোগ পুরাটাই নিজের মোবাইল ফোনে। আমি উনার ফোনের দিকে উঁকি দিতেছি কি না সেইটা নিয়াও উনি কনসার্নড না।
‘আমগর এক ব্যাচমেট আমারে ইন্সটাগ্রামে মেসেজ পাঠাইছে, “ইউ আর এইজিং লাইক ফাইন ওয়াইন, গার্ল”, হিহিহি…বুড়া বয়সেও রং কমে না, হিহিহি… পোলাডা কিউট আছে।’ আমার খালার জন্য মায়াই লাগে। খালু বহুত দিন হইল দেশের বাইরে থাকেন, ইউরোপের কোন একটা দেশে, দেশের নাম ঠিক মনে নাই, শুনা গেছে উনি সেই দেশে আরেকটা বিয়াও করছেন। বেচারা মিডল এইজের ফান্দে পইড়া এক ধরনের স্টার্ভেশনে ভুগতেছেন বইলা অনুমান করি। অনলাইনে প্রেমিক খুঁজতে থাকা মাঝবয়েসী মহিলাগর জন্য জরুরি ব্যাপারই মনে হয়।
আমার ফোন ভাইব্রেট করতেছে। পকেট থাইকা ফোনটা বাইর করি। গণশা’দা। উনার একটা কিছু কাম আছে খাগডরের দিকে। টাকাটা আমি দিব কি দিব না বইলা দিলে যাইতেগা পারে। আমি ফোন ধইরা বলি পাঁচ মিনিটের মধ্যে কল ব্যাক করতেছি।
‘খালা’, আমি ডাকি, বেশ ডেস্পারেট হইয়াই ডাকি, ‘আপনের লগে একটা আলাপ আছিন।’
খালা ফোনের স্ক্রিন অফ কইরা পাশে রাইখা দিয়া সোজা হইয়া বসেন। আমি এই মহিলার এই অভ্যাসটা পছন্দ করি। সিরিয়াস আলাপ শুনার সময় উনি পূর্ণ মনোযোগ দেন। কিন্তু সমস্যা হইল, উনি অধিকাংশ ব্যাপারকেই সিরিয়াস বইলাই ভাবেন না। খুব সম্ভাবনা আছে আমার আজকের সমস্যাটারেও উনি উড়ায় দিবেন। আগে উনি এইরকম ছিলেন না। বছর খানেক আগে খালুর বিবাহের গুজব ছড়ায় পড়ার পরে থাইকা একটু অন্যমনস্ক হইয়া গেছেন। সেই সময়ে একবার আমারে কইতেছিলেন, ‘মাইনষে বিয়া করে ক্যান, ক দেহি আব্বা?’ আমি ভ্যাবলার মতন চায়া থাকা সমীচীন মনে না কইরা কইলাম, ‘বাচ্চাকাচ্চা পয়দা করার জন্যে মনে হয়।’ উনি হাইসা কইলেন, ‘নারে পাগল, তাইলে পোলাপান নাই এমন জামাই বউ এক লগে থাকত না।’ আমি তখন চুপ কইরা উনার ব্যখ্যার লাইগ্যা অপেক্ষা করতেছিলাম। কিন্তু আইজকা আমার দার্শনিক আলাপের সময় নাই।
‘ক’, খালা সোজা আমার দিকে তাকান।
‘সাকি টাওয়ার থাইকা পইড়া এক মাইয়া মইরা গেছে গতকাল রাইতে, হুনছিলেন?’
‘হ, হুনছিলাম, সুইসাইড নাকি করছে?’
‘না, এক্সিডেন্ট, রেইলিঙের উপরে বইছিল, টাল সামলাইতে না পাইরা পিছন দিয়া পইড়া গেছে, মাথা নিচে পড়ছে, স্পট ডেড।’
খালার চোখ দেইখা বুঝি, উনি পরের আলাপ শুনবার চাইতাছেন। যথেষ্ট ইন্ট্রো দেওয়া হইছে মনে কইরা আমি বলি, ‘মেয়েটা আমার পরিচিত ছিল। অর ডেডবডি ছাড়াইতে হইব লাশকাটা থাইকা, কিছু ট্যাহা লাগব।’
‘তর গার্লফ্রেন্ড নাকি?’ খালার কণ্ঠ নার্ভাস শুনায়। আমি উনারে আশ্বস্ত করি, ‘না, এমনেই বন্ধু।’
‘মাইয়ার বাপ মায়ে কো?’ এইটা অবশ্য স্বাভাবিক প্রশ্নই, অপমৃত্যুর ক্ষেত্রে থানা পুলিশ বা সাংবাদিক সামলানের দায় পরিবারেরই হওয়ার কথা।
‘অর আব্বা জীবিত নাই, মা আর ছোটো এক ভাই’, লিরার মা-ও যে আপন মা না সেইটা বলাও মনে হয় দরকার।
‘আইচ্ছা, সুইসাইড করে নাই তুই শিওর জানস?’
‘হ, জানি, আর করলেও তো এখন লাশ ছাড়াইতে হইব খালা, কাইল রাইতের ঘটনা, আইজকাও মাডি না দিলে মুশকিল’, আমি টের পাই আমার গলার স্বর সামান্য কাঁইপা গেল। খালা কি এখন ভাবতেছেন আমার বন্ধু মইরা গেছে আর আমি উনার বাসায় বইসা গপগপ কইরা ধোকলা আর পুডিং খাইতেছি!
‘তো, তর বান্ধবী কি সাকি টাওয়ারেই থাকত? হেই বিল্ডিঙের বাসাভাড়া ত ম্যালা’ খালা হয়তো ভাবতেছেন টাকাটা আমার অন্য কাজে দরকার, আমি উছিলা বানাইতেছি, অগর আর যা কিছুরই অভাব থাক, ট্যাকার অভাব নাই।
‘না, ওইখানে অরা থাকে না, ওর কোন এক বন্ধুর বাড়ি বেড়াইতে গেছিল… উনারা পুলিশরে ট্যাহাপয়সা খাওয়াইছেন, মার্ডার কেইস হইয়া যাইতে পারত নাইলে।’
‘তর ট্যাহা লাগতাছে কেইল্যাইগ্যা তাইলে?’ খালা সোফা থাইকা উঠতে উঠতে বলেন।
‘ডোমরে দিমু।’
সে আমারে ছাইড়া যে পোলার লগে গেছিল গিয়া সেই সাঈদ পড়ত মেডিক্যাল কলেজে। আমি আর খোঁজ রাখি নাই অরা একলগে আছে কি নাই। সাঈদ ছাড়াও অর ম্যালা বন্ধুবান্ধব ছিল। হেগর কারোর লগেই সে গেছিল সাকি টাওয়ারে।
আমার হঠাৎ কইরা খুব ক্লান্ত লাগতে থাকে। মনে হয় পইড়া থাকুক লিরার লাশ এমএমসির মর্গে। আমার কী? সে আমারে ছাইড়া যে পোলার লগে গেছিল গিয়া সেই সাঈদ পড়ত মেডিক্যাল কলেজে। আমি আর খোঁজ রাখি নাই অরা একলগে আছে কি নাই। সাঈদ ছাড়াও অর ম্যালা বন্ধুবান্ধব ছিল। হেগর কারোর লগেই সে গেছিল সাকি টাওয়ারে। যতদূর ধারণা করা যায়, পার্টিতে মদফদ খাইছিল, নাইলে রেইলিং থাইকা ধাক্কা মাইরা নিচে ফালায় দিবে এমন শত্রুতা কারো লগে অর থাকার কথা না। লিরা খুব চমৎকার মেয়ে, মানে চমৎকার ছিল আর কি, ইংরেজিতে যারে বলে এডোরেবল। অরে খুন করার হইলে আমারই করার কথা, আমি যেহেতু করি নাই, তার মানে এইটা এক্সিডেন্টই। সুইসাইড করার কথা না অর, আর সুইসাইড কেউ অন্য কারো বাড়ির ব্যালকনি থাইকা পইড়া করেও না। এইসব ব্যখ্যা খালারে দিমু কি না সিদ্ধান্ত নিতে নিতে দেখি খালা নিজের শোয়ার ঘরের দিকে আগাইতেছেন।
আমি গণশা’দারে ফোন করি। দুইবার রিং হওয়ার পরে সে ধরে, ‘মামু, ভাও হইছে?’
‘হইতাছে’, আমি অনুমানের উপরেই বইলা দেই। অথচ এত ঝামেলার দরকার ছিল না, আমি কইলে গণশা’দা ফ্রিতেই ব্যবস্থা কইরা দিতে পারত, খালি হের সাগরেদগরে কইয়া দিত দ্রুত কাম সাইরা ঠিকঠাক রিপোর্ট দেওনের ব্যবস্থা করতে, তাইলেই চলত। আমার এই ফেভার নিতে একটু লজ্জা লাগছে, গণশা’দা ডোম বইলা না, বরং গণশা’দা লিরারে চিনত বইলা। সাঈদের লগে প্রেম হওয়ার পরে সে আনন্দমোহন কলেজের চেয়ে বেশি থাকত মেডিক্যাল আর বাকৃবি ক্যম্পাসে। সাঈদের লগে অরে ঘুরতেও দেখছে গণশা’দা। ব্রেইকাপের পরে ম্যালাদিন লাশকাটা গেইটের দিকে যাই নাই আমি। গাঞ্জা খাইতে চাইলে গণশা’দা ছাড়াও বহুত উপায় আছে। চাইরমাস পরে দেখা হইতেই গণশা’দা ভুরির উপরে বান্ধা লুঙ্গির গিঁট খুইলা আবার ভালামতন বাইন্ধা একগাল হাসি দিছিল, কইছিল, ‘মামু, জিন্দেগিতে যেইডা করবা না হেইডা হইল মাইয়া মাইনষেরে দাম দিবা না, এরা হইল ট্যাহাপয়সার লাহান, যহন যার হাতে তহন তার’ গণশা’দার একটা গিরস্ত বউ, আর দুইটা মাইয়া মানুষ আছে, হেরা পাশাপাশিই থাকে। কেউ হাসপাতালে চাকরি করে, কেউ করে না। কিন্তু সে যখন ইচ্ছা যার কাছে ইচ্ছা যাইতে পারে।
আমার মনে হইছে মাগনা ক্লিয়ারেন্স চাইলে গণশা’দা মনে করতে পারে লিরা আমার লগে ছিল না বইলা আমি ওর লাইগ্যা কোনো খরচপাতি করতে চাই না, কিংবা আমার কিছু আসে যায় না। আসলে আমার লিরার জন্য কিছু হইলেও আইসা যায়, কিংবা হয়তো বেশি আইসা যায় নিজের জন্যে। লিরার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কী আইবো সেইটার চাইতে বেশি আইসা যায় গণশা’দা আমারে কী ভাবল সেইটা নিয়া। কারণ আইদার ওয়ে, সে আর জীবিত নাই, তার বডি কাঁটাছিড়া করা হইল কি না, জানাজা কে পড়াইল বা আদৌ পড়াইল কিনা তাতে অর কী আর আসে যায়? বাসার লোকজনের দরকার সুইসাইড না সেইটা প্রমাণ করা, নাইলে হুজুররা জানাজা পড়াইতে চায় না। সাকি টাওয়ারের মুরাদ ভাইয়ের দরকার এক্সিডেন্ট প্রমাণ করা, নাইলে মার্ডার কেইসে পড়বে… এইগুলি ছাড়াও, আমার মনে হইছে, ওর পেটে মদ ছিল এই খবর দুনিয়ার লোকের জানার দরকার নাই। একজন মানুষ মইরা গেছে, এমনিতেই ভয়ংকর মৃত্যু, তার পড়ে যদি এইসব স্ক্যান্ডাল ছড়ায়, তাইলে সেটা মৃতের প্রতি অন্যায়, কিন্তু সে আমার এক্স না হইলেও কি আমি চেষ্টা করতাম এইটুক করতে?
শারমিন খালা একটা চামড়ার বাক্স হাতে কইরা নিয়া আইসা সোফায় বসেন। বাক্সটার উপরে পশুর চামড়ার টুকরা লাগানো, লোমগুলি গাঢ় বাদামী রঙের। আমার হঠাৎ মনে হইল, পশুর চামড়ার মতন মাইনষের চামড়াও যদি এমনে বাক্স বানায়া রাইখা দেওন যাইত তাইলে কেমন হইত? ধরা যাক, লিরার শইল্যের চামড়া দিয়া এমন একটা বাক্স বানানো হইল, মাথার চামড়ায় চুলগুলি ঝুলতে থাকল।
‘কত লাগব তর? ডোমগরে ট্যাহা দিলে কি অরা বডি কাঁটাছিড়া না কইরাই ছাইড়া দিব।’
আমার মনে হইল পুরাটা প্রক্রিয়ার জটিলতা কিংবা সংকট খালারে বুঝাইতে গেলে নয়টা বাইজা যাবে। আমি কইলাম, ‘খালা, আমি আবার আইতাছি, আয়া বুঝায়া কমুনে, আমনে আমারে তিন হাজার ট্যাহা দেইন অহন, গণশা’দা বাইরে খাড়ায়া আছে।’
‘গণশা’দা ক্যাডা?’
‘ডোমের সর্দার, উনারেই দেওন লাগব এইডা।’
খালার মনে হয় ধারণা হইছিল আমার বিশ পঁচিশ হাজার বা তার উপরে কোনো এমাউন্ট লাগব, উনি যে বাক্স আনছেন তাতে অন্তত পঞ্চাশটা এক হাজার ট্যাকার নোট রাখা, রাবার ব্যান্ড দিয়া বান্ধা বান্ডেল থাইকা উনি আমারে তিনটা নোট বাইর কইরা দ্যান।
খালার মনে হয় ধারণা হইছিল আমার বিশ পঁচিশ হাজার বা তার উপরে কোনো এমাউন্ট লাগব, উনি যে বাক্স আনছেন তাতে অন্তত পঞ্চাশটা এক হাজার ট্যাকার নোট রাখা, রাবার ব্যান্ড দিয়া বান্ধা বান্ডেল থাইকা উনি আমারে তিনটা নোট বাইর কইরা দ্যান। বাক্সের ভিতরে মনে হয় খালার কিছু গয়নাপাতিও। এই মহিলা বাসায় এত টাকা আর গয়না রাইখা দেয় ক্যান? ডাকাইতের ভয় নাই নাকি?
‘মাইয়াডার লগে তর প্রেম আছিল আগে?’
আমি কী কমু বুইঝা পাই না। আমি যে লিরারে একদিন রাস্তার উপরে দুনিয়ার লোকের সামনে ঠাইসা চটকনা মারছিলাম সেইটা তো আর খালারে বলা যায় না, ও লাশকাটা ঘরের টেবিলে প্রেম করতে কেমন লাগতে পারে এই প্রশ্ন করাতে আমি অর রুচি নিয়াও প্রশ্ন করছিলাম, ওরে পারভার্ট কইছিলাম।তখন স্বপ্নেও ভাবি নাই সে কোনো দিন আসলেই লাশকাটা ঘরের টেবিলে শুইব… সম্পর্ক ছিল অরলগে, কিন্তু সেইটা আসলে কী রকমের সম্পর্ক তা নিয়া আমি নিজেও নিশ্চিত ছিলাম না। হয়তো ‘সে আমার’ কিংবা ‘সে আমার কথা শুইনা চলবে’ ধরণের একটা চিন্তা থাইকা আমি চাইতাম সে আমার পাশে থাকুক, য্যামনে পোষা বিলাই বা কুত্তা গায়ে গায়ে লাইগা থাকে। এইটা প্রেম হইলে প্রেম, না হইলে না-ই। কিন্তু একজন মানুষ কি কখনো আরেকজনের হয়? তিনটা এক হাজার টাকার নোট হাতে নিয়া আমার আবার গণশা’দার বাণী মনে পড়ে, মাইয়া মানুষ হইল ট্যাহা পয়সার লাহান, যহন যার হাতে তহন তার।
একটা মাইয়া মানুষের বডি যখন লাশকাটা ঘরের টেবিলে শুয়ায়া কাটা হয় তখন কি সে ডোমের হইয়া যায়?
কথাসাহিত্যিক