১.
ছেলেবেলায় যখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের শুরুতে বাবার সঙ্গে হাট করে বাড়ি ফিরত কমল, তখন ভাবত আকাশের চাঁদটাও ওদের সাথে হাঁটে। সে বিশ্বাস কবে কে ওর মাঝে গেঁথে দিয়েছিল, সে কথা হয়তো ওর বিধিলিপিতেও লেখা নেই। বসন্ত পেরিয়ে যাওয়া রাতের বুকে তখনো কিছু দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ছিল। ধীরে ছাড়া নিশ্বাসের মতো তিরতিরে বাতাসে যখন পথের পাশের গাছের পাতাগুলো ফিসফিস করে অপার্থিব ভাষায় কথা বলত, কমল তখন ওর বাবার ঊরুর আরও কাছে ঘেঁষে আসত। হয়তো ততক্ষণে সে দেখে ফেলেছে এমন কিছু, যা দেখেনি কেউ। কমলের বাবা ওর কাঁধে হাত রাখলেই কমল আবার চেয়ে দেখত আকাশে, কখনো সেখানে থাকত পূর্ণিমার চাঁদ, কখনো অগণিত তারা।
ঠিক তাও না, ধূসর রঙের চাঁদ ছিল তখন। ঠিক যেমন মা বানাতেন, তালের রুটি। এখন ইলিশের গায়ের মতো রুপালি। নৌকার পাটাতনে চিত হয়ে সে চাঁদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে একবার বাঁ হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে নদীর দিকে চেয়ে দেখল কমল।
আজও আকাশের গায়ে লেগে আছে একটা চাঁদ। সন্ধ্যায় একটা পেতলের থালার মতো মনে হয়ছিল। ঠিক তাও না, ধূসর রঙের চাঁদ ছিল তখন। ঠিক যেমন মা বানাতেন, তালের রুটি। এখন ইলিশের গায়ের মতো রুপালি। নৌকার পাটাতনে চিত হয়ে সে চাঁদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে একবার বাঁ হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে নদীর দিকে চেয়ে দেখল কমল। জলের বুকে বিম্বিত চন্দ্রমা। দুহাত ভাঁজ করে মাথার নিচে দিয়ে চিত হয়ে পড়তেই মনে পড়ল মান্না দে-র সেই গান, ‘মম সরসীতে তব উজল প্রভা, বিম্বিত যেন লাজে…’। জলে আছড়ে পড়ছে দাঁড়, একটু পরপর। সে আঘাতে উঠছে তরঙ্গ। ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে চাঁদ। হঠাৎ, সেই পূর্ণিমার নিচে ভাসতে ভাসতে গান ধরল মাঝি,
‘আগে যদি জানতাম রে কোকিল
পিরিতের এত জ্বালা
নিতাম না আর গলেতে রে
প্রেম কলঙ্কের মালা।’
২.
—কমল, তুমি ‘রক্তকরবী’ পড়েছ?
—না, রবীন্দ্রনাথ পড়া হয়নি তেমন।
—তবে তো তুমি নন্দিনীকেও চিনবে না।
—নন্দিনীকে চেনা কেন জরুরি? তোমাকে চিনলে চলবে না?
—তেমন করে চিনলেই বা কই?
—তুমি চিনেছ?
—তোমাকে তো সেই কবেই চিনেছি। তোমারে দেখিয়া কাটে মোর রজনি।
—কেমন করে?
—তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।
যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো,
আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা ॥
গানের সঙ্গে বুঝি ভেসে যেতে চায় সময়। সময়ের স্রোতে ভেসে যায় মনের কোণে কোণে জমে থাকা স্বেদ, ক্লেদ। রাত্রির মুখের দিকে অপলক চেয়ে থাকে কমল।
—কমল, তুমি একটা গান গাও না?
—আমি কি গাইতে পারি নাকি? ধুর। চলো চলো, ক্লাসের দেরি হয়ে যাবে।
৩.
রাত্রির এলোমেলো কামরার মাঝে দাঁড়িয়ে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখে কমল। এক দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথের একটা বিশাল আকারের ছবি ঝোলানো। রাত্রির প্রথম প্রেম। কমলের পরিচিতা প্রায় সব তরুণীর ‘কমন’ প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ। এদের অনেকে ঠিকমতো দুটো রবীন্দ্রসংগীত শোনেওনি কখনো। আবার অনেকে সত্যিই রবীন্দ্রনাথের প্রেমিকা হতে চায়, যেমন রাত্রি।
দুটো কাগজ এখনো পড়ে আছে ভার-চাপা হয়ে। হাতে তুলে দেখে, একটাতে শুধু চোয়ালের আদল পড়েছে, আরেকটায় চোখ। কাজ ফেলে রাখা রাত্রির স্বভাব। মাঝে মাঝে ও বলত, ‘আমি তো যামিনী, শেষ হব না। তোমার জীবনে আসবে না উষা।
টেবিলে ছড়ানো রঙের প্যালেটে অদ্ভুত সব রঙের মিক্সচার। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও রং আলাদা করতে পারে না কমল। দুটো কাগজ এখনো পড়ে আছে ভার-চাপা হয়ে। হাতে তুলে দেখে, একটাতে শুধু চোয়ালের আদল পড়েছে, আরেকটায় চোখ। কাজ ফেলে রাখা রাত্রির স্বভাব। মাঝে মাঝে ও বলত, ‘আমি তো যামিনী, শেষ হব না। তোমার জীবনে আসবে না উষা। ’
জানলা-ঘেঁষা সোফায় বসে, হাতলে রাখা তোয়ালে তুলে নেয় কমল। সেখানে এখনো রাত্রির গায়ের গন্ধ। মনে পড়ে লোডশেডিংয়ের এক রাতে এই সোফায় পা তুলে বসে রাত্রি গেয়েছিল,
ঝড়কে আমি করব মিতে, ডরব না তার ভ্রুকুটিতে
দাও ছেড়ে দাও, ওগো, আমি তুফান পেলে বাঁচি॥
৪.
ক্লাস শেষে চলত আড্ডা। এ এমন এক সময়ের গল্প, যখন তরুণদের আড্ডা মানে সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প আর রাজনীতির আলোচনা। জহির, রাশেদ, মিতু, শেফালি, রাশেদা, কমল, রাত্রি, কবির সাধারণত এক সঙ্গে বসে আড্ডা দিত। এখানে আসলে কমল আর রাশেদ বহিরাগত। ওরা মেডিকেলের ছাত্র। বাকিরা সবাই সমাজবিজ্ঞানের। জহির ঘোর কমিউনিস্ট, তার প্রেমে পড়ে মিতুও কমিউনিজমের পাঠ নিতে শুরু করেছে। কবির চুপচাপ থাকে। আরেকটা টিউশনি জোটানোর চিন্তা তার মাথায়। শেফালি আর রাশেদা চায় ভালো রেজাল্ট করে এখানেই শিক্ষকতা করবে। এইসব নিয়ে কথা বলতে বলতে কখনো তারা সামসময়িক সিনেমার আলাপ করে। কখনো চাল ডালের কথাও ওঠে। কিন্তু সব থেমে যায় রাত্রির গানের সাথে সাথে। সন্ধে নামতেই সবাই এই একটা অনুরোধ করবে একসাথে। কমলের জন্মদিনে রাত্রি গেয়েছিল,
দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ও পারে—
আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে
৫.
মাঝির কণ্ঠ থেমে যায় একসময়। কমলের চোখের তারায় কাঁপে আকাশের চাঁদ। মনের মাঝে তার সমুদ্রে ঝড় ওঠে। বৈঠার ঝুপ ঝুপ শব্দের আড়ালে পড়ে থাকে হৃদয়ের ধুকপুক। স্মৃতির আকাশে জ্বলজ্বলে হয়ে থাকে একেকটা দিন। পাশ কেটে যাওয়া নৌকো থেকে উড়ে আসা মেছো গন্ধ ছাপিয়ে নাকে লাগে চুলের সুবাস। নৌকার সঙ্গে নদীর কথার আওয়াজ ছাপিয়ে কানে বাজে শেষ কিছু কথা। কিছু ব্যর্থ অনুনয়—
ও যে মানে না মানা।
আঁখি ফিরাইলে বলে, না, না, না।