আমাদের দেশে প্রায় দুই দশক আগে মূল গানের কভার করার একটা প্রবণতা শুরু হয়েছিল। কলকাতায় তারও আগে। কলকাতায় শ্রীকান্ত আচার্য গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সাগর সেনের অনেক গান। ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’, ‘বঁধুয়া আমার চোখে জল এনেছে’, ‘যেন কিছু মনে করো না’— এরকম অনেক গান। একটা প্রজন্ম সেই কভার গান লুফে নিল। প্রজন্ম জানলই না মূল গানের শিল্পী কারা। ফলে সেই গানগুলো এই প্রজন্মের অনেকের কাছে শ্রীকান্ত আচার্যের গান হয়েই পরিচিতি পেল। মূল শিল্পীর কথা বললে ভ্রু কুঁচকে ছেলেমেয়েরা বলে ‘উনারা কারা, নাম তো শুনি নাই’। কী নির্মম! একই রকমভাবে আমাদের দেশে পলাশ-রিজিয়া গেয়েছিলেন অনেক অনেক কভার গান। যদিও সেসব এই সময়ে এসে হারিয়ে গেছে। তবে আব্দুল জব্বারের গাওয়া ‘ও রে নীল দরিয়া’ কিংবা খুরশিদ আলমের গাওয়া ‘চুমকি চলেছে একা পথে’ পান্থ কানাইয়ের কণ্ঠে শোনার পর প্রজন্মের একটা বড়ো অংশ জেনেছে গানটা পান্থ কানাইয়ের নামেই। এই প্রজন্ম ইতোমধ্যে ভুলতে শুরু করেছে আব্দুল জব্বার কিংবা খুরশিদ আলমের নাম। ব্যক্তিগতভাবে আব্দুল জব্বারের সঙ্গে কথাবার্তায় সেই আক্ষেপ আমি শুনেছিলাম।
তবে আব্দুল জব্বারের গাওয়া ‘ও রে নীল দরিয়া’ কিংবা খুরশিদ আলমের গাওয়া ‘চুমকি চলেছে একা পথে’ পান্থ কানাইয়ের কণ্ঠে শোনার পর প্রজন্মের একটা বড়ো অংশ জেনেছে গানটা পান্থ কানাইয়ের নামেই।
আজকাল বিভিন্ন অডিও লেবেল কোম্পানি তাদের পুরনো গান নতুন করে গাওয়াচ্ছেন বর্তমান শিল্পীদের দিয়ে। তাতে গানগুলো নতুন করে সাড়া ফেললেও একটা বিপদের আশঙ্কা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। কনকচাঁপা এখনও মঞ্চে ও টেলিভিশনে সরব, তবুও তার গান অনেকেই কভার করায় এবং সরাসরি সংশ্লিষ্ট অডিও লেবেল কোম্পানির উদ্যোগে হওয়ায় সেই গানগুলো প্রজন্মের কাছে ছড়াচ্ছে দ্রুত। ফলে কনকচাঁপার সেই গানগুলো আর নতুন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কনকচাঁপার গান হিসেবে থাকবে কি না, এটা একটা বড়ো প্রশ্ন হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা থেকে যায়।
আমাদের দেশের শ্রোতাদের মধ্যে একটা প্রবণতা স্পষ্ট, মূল গানের শিল্পী কারা তার খোঁজ সচরাচর তাঁরা নেন না। শ্রোতারা গানে শিল্পীর ভিডিও দেখে, টাইটেলে নাম দেখে, ডেস্ক্রিপশনে সবার ক্রেডিট দেখেও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন ‘এই গানের শিল্পী কে’। আর গানের গীতিকার ও সুরকারের কথা জানার তো প্রশ্নই আসে না। একটা আপত্তি ছিল এরকম— কভার যিনি করছেন তিনি মঞ্চ বা টেলিভিশনে অকেন সময়ই মূলশিল্পীর নাম বলেন না। কিন্তু এই যে আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় ভিডিওতে সব বর্ণনা থাকতেও যে চিনছেন না, এই দায় কে নেবে? তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আমাদের শ্রোতারা এখনও যথেষ্ট সচেতন নয়। আর এ বিষয়ে সচেতনতা বিষয়ক সামান্য উদ্যোগ গান সংশ্লিষ্ট কারোরই নেই। তাহলে বাংলা গানের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে?
আবার ইদানীং আমাদের দেশের লোকজ বা ফোক গানের কদর বেড়েছে বহুগুণ। যেসব গানের গীতিকার ভাটি অঞ্চলের কিংবা বিভিন্ন অঞ্চলের। আধুনিক ইন্সট্রুমেন্ট ও সাউন্ডের মিশেলে সেই গান লুফে নিচ্ছেন সাধারণ শ্রোতারা। যারা কভার করছেন, তাদের অনেকেই মূল শিল্পী ও গীতিকার-সুরকারের নাম উল্লেখ করছেন না। ফলে কোনটা বাউল শাহ আব্দুল করিমের গান, কোনটা উকিল মুন্সীর গান, কোনটা রাধারমণের গান, সেসব গুলিয়ে ফেলছে। যেমন একটা বহুল জনপ্রিয় গানের নাম ‘বনমালী তুমি পরজনমে হইও রাধা’। এই গানে রাধা শব্দ থাকায় অনেকেই রাধারমণের নাম জুড়ে দিয়েছেন। অথচ গানের গীতিকার দ্বীন শরৎ। আবার ‘আমার মন মজাইয়া রে’ গানের গীতিকার না হয়েও সেই গানের সঙ্গে বাউল আব্দুল করিমের নাম প্রায় প্রতিষ্ঠিত। এরকম অসংখ্য গান নামে-বেনামে জনপ্রিয় হয়ে গেছে। প্রকৃত শিল্পীরা রয়ে গেছেন ‘সংগ্রহ’ নামের দায়সারা কাজের আড়ালে। এই ‘সংগ্রহ’ শব্দটা গানের সঙ্গে জুড়ে দিলে কেউ কিছুই বলছে না, কপিরাইট নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে না। যেহেতু ঝুঁট ঝামেলায় যেতে হচ্ছে না, তাই গানের শিল্পীর চেয়ে অধিক জনপ্রিয় হচ্ছে ‘সংগ্রহ’ নামের শব্দটাই। সামনে কোন দিন আসবে বাংলা গানে, কে জানে!
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন বাণী প্রচার হয়ে থাকে। যে কথা জীবনেও রবীন্দ্রনাথ বলেন নাই, সেই কথার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাম সেঁটে দেওয়া থাকে। সবচেয়ে বেশি হয় হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে। অনেকের অনেক সুবিধামতো কথার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের নাম জুড়ে দিয়েছেন যেন দ্রুত তা ভাইরাল হতে পারে। হয়েছেও তাই। অথচ হুমায়ূন আহমেদের লেখা মেহের আফরোজ শাওনের গাওয়া ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়’ গানকে প্রজন্মের অনেকে রবীন্দ্রসংগীত ভেবে নেয়, এমন মূর্খতা দেখা গেছে এত প্রচারের পরেও।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের কতখানি উপকার করল বা ক্ষতি করল— সে হিসেব করতে এই লেখা লিখতে বসিনি। তবে এ কথা সত্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত হয় গানের প্রকৃত স্রষ্টাগণ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের কতখানি উপকার করল বা ক্ষতি করল— সে হিসেব করতে এই লেখা লিখতে বসিনি। তবে এ কথা সত্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত হয় গানের প্রকৃত স্রষ্টাগণ। যেমন কেউ সমুদ্রে যাবার আগে তাকে ফেসবুক ওয়ালে লিখতে দেখি ‘চোখটা এত পোড়ায় কেন, ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও’। কিংবা কোথাও কেউ বেড়াতে যাচ্ছে, সেদিকে পাহাড় পেরিয়ে নদীর দেখা মেলে, খোলা জীপে কেউ ওড়না উড়িয়ে বা কেউ চুল উড়িয়ে যাচ্ছে, ক্যাপশনে লিখেছে ‘চলো না ঘুরে আসি অজানাতে’। অথচ তেমন কেউই উল্লেখ করেন না প্রথম গানটির গীতিকার ও শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী কিংবা দ্বিতীয় গানটির গীতিকার এসএম হেদায়েত আর সুর করেছিলেন লাকী আখন্দ। এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। শুধু যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন হচ্ছে, তা না। আমাদের প্রতিবেশি দেশে ইদানীং আমাদের গান জনপ্রিয় হওয়ায় তারা নিজের মতো গাইছে। যেমন দেলোয়ার আরজুদা শরফের লেখা, প্লাবন কোরেশীর সুরে ফজলুর রহমান বাবু গেয়েছিলেন ‘ইন্দুবালা’ শিরোনামের গান। সেই গান পুরো ভারতবর্ষ যেন মাতিয়ে দিয়েছে। অথচ সেই গান যারা পরিবেশন করছেন, তাদের অনেকেই গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীর নাম জানেন না। কয়েকদিন আগে সনি টিভির সুপারস্টার সিঙ্গার টু তে নদীয়ার মেধাবী কিশোর প্রাঞ্জল বিশ্বাস গেয়েছে ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটি। যে গানের শিল্পী আব্দুল জব্বার। মুকুল চৌধুরীর লেখা গানটি সুর করেছিলেন আলম খান। গানের নীতিমালা না থাকায় সনি টিভি ক্রেডিট দেয়নি কাউকেই। ফলে প্রাঞ্জলের গাওয়া গান ছড়িয়ে গেলেও আড়ালে থাকলেন মূল কারিগরগণ।
গানের মূল শিল্পীর পরিচিতি ফিকে হচ্ছে আজকাল। আর গীতিকার কিংবা সুরকার তো এদেশেই চির অবহেলিত। আমরা সবকিছুতেই অনুকরণ করি পাশের দেশ ভারতকে। অথচ সে দেশে গুলজার, জাভেদ আখতার বা সমীর যে পরিমাণ সম্মান পেয়ে থাকেন, তা যেন আমাদের দেশে অকল্পনীয়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বছর দুই আগের ইন্ডিয়ান আইডলের মঞ্চে নিয়ে আসা হয় অসুস্থ সন্তোষ আনন্দকে। সেখানে তার সম্মানে নেহা কাক্কার গেয়ে শোনান সন্তোষ আনন্দের লেখা আর লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারলালের সুরে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘এক প্যায়ার কা নাগমা হ্যায়’। সম্মান পেয়ে সন্তোষ আনন্দ আবেগাপ্লুত হয়ে যান। আমাদের দেশে অনেকেই সেই দৃশ্য শেয়ার করেছেন আর হাহাকারে শামিল হয়েছেন। অথচ এই ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারিনি। আমাদের দেশের টেলিভিশনে কখনও এভাবে কোনো গীতিকারকে সম্মান জানাবার ঘটনা বিরল।
সম্মানের পাশাপাশি সম্মানির ব্যাপার প্রাসঙ্গিক হয়। গানের শিল্পীরা কিছু নগদ অর্থ পেলেও গানের গীতিকার ও সুরকারেরা এদেশে চির বঞ্চিত। তাদেরকে রয়্যালটিতে যেমন বঞ্চিত করা হয়, পরবর্তীতে তাঁর নাম উচ্চারণের কৃপণতাও লক্ষ্যণীয়।
আগের আলোচনা রেখে সময়ের কথা বলি। আমাদের দেশে তরুণ মুন্সীর গান ‘চলে যদি যাবি দূরে স্বার্থপর’, স্টিলার ব্যান্ডের লিটনের গাওয়া গান ‘তুমি কি আমায় আগের মতো বাসো ভালো’, টিডব্লিউ সৈনিকের গান ‘তুমি আমার ঘুম’, আবিদার গাওয়া ‘প্রজাপতিটা যখন তখন’ কিংবা আমি লুৎফর হাসানের গাওয়া সোমেশ্বর অলির লেখা ‘ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো’ গানের গীতিকারের নাম তো জানার কথাই না, শিল্পীর নাম জানে না এদেশের আশিভাগ শ্রোতা। এই দায় কার?
এখন এইসব গান যদি কভার হতে শুরু করে, দেখা যাবে কভার করা কোনো ট্র্যাক যদি অধিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়, তাহলে আগের ভার্সন আর কেউ শুনবে না। কী হবে তাতে? বেঁচে থাকতে, সুস্থ ও সবল থাকতে, গান গাওয়ার পর্যাপ্ত সক্ষমতা থাকতেও মূল শিল্পীকে নিজেকে যুদ্ধ করে প্রমাণ করতে হবে যে, গানটা একদিন তিনিই প্রথম গেয়ে জনপ্রিয় করেছিলেন।
এখন এইসব গান যদি কভার হতে শুরু করে, দেখা যাবে কভার করা কোনো ট্র্যাক যদি অধিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়, তাহলে আগের ভার্সন আর কেউ শুনবে না। কী হবে তাতে? বেঁচে থাকতে, সুস্থ ও সবল থাকতে, গান গাওয়ার পর্যাপ্ত সক্ষমতা থাকতেও মূল শিল্পীকে নিজেকে যুদ্ধ করে প্রমাণ করতে হবে যে, গানটা একদিন তিনিই প্রথম গেয়ে জনপ্রিয় করেছিলেন।
বাংলা গান বাংলাদেশের অনন্য সম্পদ। বাংলা গান নিয়ে যথাযথ কাজ করা জরুরি। শ্রোতাদের সচেতন করতে হলে জরুরি গান সংশ্লিষ্টদেরও এ ব্যাপারে নানান পদক্ষেপ নেয়া। তা না হলে গান পরিচয়হীন হয়ে পড়বে। যা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। বাংলা গান বাংলাদেশের অনন্য সম্পদ। বাংলা গান নিয়ে যথাযথ কাজ করা জরুরি। শ্রোতাদের সচেতন করতে হলে জরুরি গান সংশ্লিষ্টদেরও এ ব্যাপারে নানান পদক্ষেপ নেয়া। তা না হলে গান পরিচয়হীন হয়ে পড়বে। যা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।
‘ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো’ গান গেয়ে গায়ক হিসেবে পরিচিত। তিনি গান লেখেন, সুর করেন এবং নিয়মিত গেয়ে থাকেন। ইতোমধ্যে নিজের ও অন্যের জন্য লিখেছেন পাঁচ শতাধিক গান। লিখছেন ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস মিলিয়ে প্রায় সব শাখাতেই। কাজ করছেন একটা অডিও ভিজুয়াল প্রতিষ্ঠানে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে।