ইন্দ্রাকে দেখছি বোধ হয় বছর আটেক পর। যখন ভার্সিটিতে ছিল তখন ছিপছিপে একহারা গড়ন ছিল ওর। এখন মুখটা গোলগাল হয়েছে, কথাবার্তায়ও একটা ভারিক্কি ভাব এসেছে। ওর পরনে একটা টেরাকোটা রঙের টপস আর প্রগাঢ় নীল ডেনিম। সবমিলিয়ে অপূর্ব লাগছে ওকে। আমি ওভাবে দেখছিলাম বলে বোধ হয় একটু অস্বস্তিতেই পড়লো মেয়েটা।
ইন্দ্রা এবার একাই এসেছে। একটা আমেরিকান ভার্সিটিতে পিএইচডি শেষ করে সে পোস্ট ডক্টরাল শুরু করবে কিছুদিনের মধ্যে। বিয়েটিয়ে করেনি এখনও। আমি টিপিক্যাল বাঙালিদের মতো জিজ্ঞেস করতেই ইন্দ্রা এত সুন্দর করে উত্তর দিল! এমন ঝটপট কথা বলা ওর চিরকালের স্বভাব। আমিই ব্যাপারটা ভুলতে বসেছিলাম।
বিয়ের প্রসঙ্গ শুনে ইন্দ্রা বললো— আপনার শিষ্য হয়ে আমি কী করে পারি সংসারকেই প্রথমে বেছে নিতে! সবাই বিয়েই তো করে নিচ্ছে, আমি না হয় অন্য কিছু করি।
পরিচয়ের শুরু থেকেই ওর এমন স্পষ্ট করে কথা বলার ভঙ্গি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমার মনে হতো ওই বয়সে যদি আমি ওর মতো হতাম তবে হয়তো জীবনটা আরও অন্যরকম হতে পারতো। আজকে ইন্দ্রাকে সামনে পেয়ে নতুন করে ভাবছি ওর মুখের আদল নাকি ওর ওই ভঙ্গি কোনটা বেশি ভালো লাগতো আমার।
বিয়ের প্রসঙ্গ শুনে ইন্দ্রা বললো— আপনার শিষ্য হয়ে আমি কী করে পারি সংসারকেই প্রথমে বেছে নিতে! সবাই বিয়েই তো করে নিচ্ছে, আমি না হয় অন্য কিছু করি।
তা বেশ! কিন্তু আজকাল এমন কথা বললে লোকে শুরুতেই ফেমিনিস্ট বলে গাল দেয়!
আমার কথা শুনে ইন্দ্রা শব্দ করে হেসে উঠল। ওর কানে পাথরের দুল জোড়া আলোর প্রতিফলনে ঝকমক করছে। আমি আড়চোখে ওকে দেখছি আর ভাবছি কেন এই হাসিটা আমার বরাবরই অত চেনা লেগেছে।
ইন্দ্রা সেই হাসিমুখ ধরে রেখেই বলল— চল্লিশের আগে বিয়ে আমি করছি না ম্যাডাম। দুয়েকজনের সাথে অন্তরঙ্গতা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু আরো সময় নিতে চাই।
আমি ওকে আমার পড়ার ঘরে নিয়ে এলাম। এই ঘরটাই বাসায় আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা, অবসরের ঠাঁই৷ জানালার চওড়া কার্নিশ জুড়ে সাজিয়ে রাখা মানিপ্ল্যান্ট আর কয়েনের পাতায় রোদের ফিতেরা কাঁপছে। চকচকে সবুজ রঙগুলো দেখে আঙুল দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিল মেয়েটা। তারপর ফ্লোরে পাতা শতরঞ্জিতে গিয়ে আরাম করে বসলো। বোধ হয় ওরও এখানে ভালো লাগছে।
আমি একা থাকলেও ঘরদোর প্রায় সবসময়ই বেশ পরিপাটি থাকে। করোনার উপদ্রব শুরু হবার পর এই প্রথম আমার কাছে কেউ বেড়াতে এলো। ঘরে একা থাকতে থাকতে আমি হাঁপিয়ে যাচ্ছিলাম। ইন্দ্রা আসবে জেনে মনে মনে খুব খুশি হয়েছি। তাই অল্প অল্প করে অনেক কিছু নতুন করে গোছগাছ করেছি। নিজে পোশাকে-আশাকে যেমনই হই না কেন ঘরদোর গোছগাছের ব্যাপারে আমাকে সৌখিন বলা চলে।
ইন্দ্রা হয়তো ঘন্টাখানেক থাকবে৷ তবু যদি আমার অনুরোধে রাতটা এখানে থেকে যায় সেই ভেবে ড্রয়িংরুমের সাথে লাগোয়া রুমটাও গোছানো হয়েছে৷ দরজা জানালায় টারকুইজ রঙের পর্দাগুলো নতুন। কুশন কভারগুলোও বদলেছি। বসার ঘরে নেপাল থেকে আনা শোপিসগুলো সাজানো হয়েছে। রঙবেরঙের প্রেয়ার ফ্ল্যাগগুলো ঝুলছে দুটো দরজায়।
খুব সুন্দর তো! এগুলো আপনার করা?
দেয়ালে নকশা করা ফ্রেমগুলো দেখছে ইন্দ্রা। ময়ূরের ছড়ানো পেখম আর ফুল উপচে পড়া ফুলদানি। এ দুটো বেশ পুরনো কাজ। তখন সেলাই খুব প্রিয় একটা নেশা ছিল আমার। আজকাল আবার সেই নেশা চেপেছে। সেলাই করতে করতে কত স্মৃতি ডুবসাঁতার থেকে মাথা তুলে তাকায়, কানেকানে ডাক দিয়ে যায় আমাকে। হারিয়ে ফেলা মুখগুলো মনে পড়ে দিনভর। ‘সর্বাঙ্গ জ্বলে, একশ পাঁচ ডিগ্রি জ্বর’— এসব বোধহয় শুধু কবিতার লাইন নয়।
ইন্দ্রা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বোধ হয় আমার চোখেমুখে সেই জ্বরের আভাস দেখতে পেয়েছে মেয়েটা। আমি হড়বড় করে বললাম— চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর সময় কাটাতে কত রকমের উপায় যে বের করতে হয়েছে, জানো তো!
বইয়ের তাকগুলো দেখতে দেখতে ইন্দ্রা এবার বললো— আপনি এখন আর ঘুরতে যান না কোথাও?
সত্যি একটা সময় ঘুরে বেড়িয়েছি অনেক। প্রতিবছর দুই তিনবার করে বেরিয়ে পড়তাম একা একা৷ তখনকার দিনে একা একটা মেয়ের জন্য সহজ ছিল না ব্যাপারটা। তবু হাজারটা ঝক্কি সামলে জেদ করেই ঘুরতাম আমি। এখন তো বয়স হয়েছে, হাঁটুতে ব্যথা, হাওয়া লাগলেই বুকে কফ জমে বিচ্ছিরি অবস্থা হয়। আর করোনা আসবার পর তো সবরকম ঘোরাঘুরিই বন্ধ হয়ে গেছে। নেহাত বাজারটা করতে হয় বলে বের হই দু-সপ্তাহে একবার।
ইন্দ্রা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বোধ হয় আমার চোখেমুখে সেই জ্বরের আভাস দেখতে পেয়েছে মেয়েটা। আমি হড়বড় করে বললাম— চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর সময় কাটাতে কত রকমের উপায় যে বের করতে হয়েছে, জানো তো!
ইন্দ্রা আমার কথা শুনতে শুনতেই বইয়ের তাক থেকে ছবির অ্যালবামটা হাতে নিল। আমার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে আমি মাথা নেড়ে বললাম— হ্যাঁ, ওখানে আমাদের ছবিগুলো আছে।
আমাদের ছবি মানে আমার আর ইন্দ্রার মায়ের। আর পুলকেরও। ইন্দ্রা বেশ সময় নিয়ে ছবিগুলো দেখছে। আমার কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছে শিপ্রা। দুজনেই দুটো বেনি করেছি, গায়ে প্রায় একই রকম ফ্লোরাল প্রিন্টের জর্জেট শাড়ি। ইন্দ্রা মাঝেমাঝে মুখ তুলে তাকাচ্ছে আমার দিকে।
বাড়ির ছাদের পিকনিকে ইন্দ্রার মা শিপ্রাকে আমি মুখে তুলে খাওয়াচ্ছি এই ছবিটা আছে পরের পাতায়। তখন ও বোধ হয় মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে আর আমি উচ্চমাধ্যমিক। ক্যাম্পাসে বোগেনভিলিয়ার ঝাড়ের সামনে বসে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছি আমরা, পরনে বেল বটম। তখন আমি অনার্স ফাইনাল। পুলক আমার পাশে দাঁড়িয়ে ঘাড় কাত করে শিপ্রাকে দেখছে, শিপ্রা মুখ টিপে হাসছে আর আমি কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছি ওদের মাঝখানে। এই ছবিটা বোধ হয় সরিয়ে রাখলেই ঠিক হতো। ফেসবুকেও দেওয়াটা ভুল হয়েছিল। নইলে ইন্দ্রা বোধ হয় কিছুই জানতে পারতো না৷
ওকে কিছুক্ষণের জন্য একা ছেড়ে দিয়ে রান্নাঘরে এলাম আমি। ফুটন্ত পানিতে চা পাতা ছড়িয়ে দিতে দিতে নিজেকে সামলে নিচ্ছিলাম। সত্যি বলতে গত দু-দিন ধরে কথার পর পর কথা সাজিয়ে যতটা প্রস্তুতি নিয়েছি সেসব আসলে কিছুই ছিল না। আসন্ন বোঝাপড়ার আশঙ্কায় আমার ভেবে রাখা কথাগুলো এখন কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।
ইন্দ্রার কাছে শুনেছি ওর মায়ের শরীরটা নাকি ভালো নেই। তাই সে এবার বাংলাদেশে আসতে পারেনি। ইন্দ্রাকে একাই আসতে হলো ভিসা সংক্রান্ত কিছু কাজে। পুলকের কথা আমি মুখ ফুটে কিছুতেই জিজ্ঞেস করতে পারছি না। সেদিন ফেসবুকে পুরনো ছবি শেয়ার করার পর ইনবক্সে ইন্দ্রার মেসেজটা এলো। মাত্র কদিন আগে আমাকে ফেসবুকে খুঁজে পেয়েছিল ইন্দ্রা। আমার টাইমলাইনে শিপ্রা আর পুলকের সাথে ছবিটা দেখে ও খুব অবাক হয়ে বলল— আপনি তাহলে আমার বাবামায়ের বন্ধু ছিলেন!
আমি তখন এসি রুমে বসে কুলকুল করে ঘামছি। কী নির্মম কাকতাল এটা! আমার একসময়ের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রী, প্রিয় মানুষ ইন্দ্রা চৌধুরী তাহলে আর কেউ নয়, শিপ্রা আর পুলকের মেয়ে। একটা সময় যারা আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিল, ইচ্ছে করেই যাদের থেকে দূরে সরে গেছি জীবনের অদ্ভুত কাটাকুটি খেলায় হেরে গিয়েছিলাম বলে— তাদেরই আত্মজা ইন্দ্রা!
ইন্দ্রা সেদিনই ওর বাবামায়ের কিছু ছবি পাঠালো আমাকে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম শিপ্রা এখনো কী সুন্দর রয়েছে! পুলককে দেখতে গিয়ে আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠছিল বারবার। এখনও মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল। কানের দুপাশে রুপালি রেখাগুলো যেন আরো বেশি সুদর্শন করে তুলেছে ওকে। আমি চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসটাকে ছেড়ে দিতে দিতে ইন্দ্রাকে লিখলাম— তুমি দেখতে অনেকটাই বাবার মতো হয়েছ!
উত্তরে ইন্দ্রা লিখল— হ্যাঁ, আমি বাবারই মেয়ে, বাবা আমার মুশকিল আসান। আর মায়ের সাথে খুব ঝগড়া, কথায় কথায় আড়ি হয় এখনও।
মা মেয়ের খুনসুটির দৃশ্য কল্পনা করে অনেক অনেকদিন পর বুকের ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল আমার। শিপ্রা সবসময় চাইতো ওর ফুটফুটে একটা মেয়ে হোক। ওর ইচ্ছেটা পূরণ হয়েছে। আর পুলক নিশ্চয়ই খুব ভালো বাবা হয়েছে। নইলে মেয়ে এমন ভক্ত হয় কী করে।
আমার সামনে বসে চা খেতে খেতে ইন্দ্রা বলল— জানেন ম্যাডাম, বাবা ভীষণ কাজ পাগল আছে এখনও। দেশে আসার সময় পায় না একেবারেই। তাছাড়া মাকে একা রেখে আসা যেত না।
পুলকের কথা শুনতে শুনতে আমি ওকে দেখছি। এই বুদ্ধিমতী, স্মার্ট মেয়েটা আমার নিজের সন্তান হতে পারত। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে কেমন হতো যদি আমিই ওর মা হতাম!
ইন্দ্রা বলে চলেছে— তবু এবার বাবা-মা এলে বেশ হতো, কতদিন পর আপনাদের দেখা হয়ে যেত ভাবুন! আপনার খোঁজ পেয়ে ওরা খুব খুশি হয়েছে।
কোলের উপর বালিশ নিয়ে পা ছড়িয়ে বসেছে ইন্দ্রা। এক টুকরো শিপ্রা আর অনেকটুকু পুলক যেন আমার ঘর জুড়ে কলকল করছে। আমার ইচ্ছে করছে ওকে আমার কাছে রেখে দিই, ইচ্ছে করছে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘক্ষণ ওর উত্তাপ নিই, যেন একফোঁটা হলেও খুব চেনা কোনো ঘ্রাণ পাই, যেন আমার ভেতরের কান্নাটা বেরিয়ে আসে শেষবারের মতো।
চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে মুখে দিতে দিতে ইন্দ্রাবললো— মা কিন্তু একটা গিফট পাঠিয়েছে। আমাকে দেখতে দেয়নি। আপনি আমার সামনেই খুলে দেখুন না এটা, আমার খুব দেখার শখ যে মা কী এমন দিয়েছে আপনাকে!
ইন্দ্রার হাত থেকে প্যাকেটটা নিতে নিতে আমিও ভাবলাম এতদিন পর শিপ্রা আমাকে কী দিতে পারে! ভেতরে ভেতরে কাঁপছি আমি। সবকিছুর আগল কি আজকেই খুলে দিতে হবে!
ইন্দ্রা খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। অগত্যা তখনই প্যাকেটটা খুলে জিনিসটা বের করলাম।
সাদা আর নীল রঙে বোনা একটা মাফলার বেরিয়ে এলো।
ওহ গড! এটা কবে করলো মা! তাকে তো কখনো উল বুনতে দেখিনি!
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু জোড়া নাচিয়ে ইন্দ্রা বলে উঠলো— এই না হলে বন্ধু!
বন্ধু! আমি অস্ফুটে কয়েকবার করে উচ্চারণ করছি শব্দটা৷ ইন্দ্রা আমার কাছে এসে বসেছে। অঝোরে কাঁদছি আমি। সবকিছু ভুলে আমি সেদিনের মতো কাঁদছি। একটা ডানাভাঙা পাখির মতো সেদিন এমন কেঁদেছিলাম। ইন্দ্রা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। মেয়েটা জানে না এই মাফলার আমার নিজের হাতে বোনা। কাউকে বলিনি ওটা পুলককে দেব বলে শখ করে বানাচ্ছিলাম। শেষদিন শিপ্রা এসে একরকম ছিনিয়ে নিয়ে গেল ওটা। মাথার দিব্যি দিয়ে বলেছিল কেউ যেন না জানে। এটা ওর সবচেয়ে প্রিয় যে জন, সেই ভালোবাসার মানুষটিকে সে দিতে চায়।
অনেকদিনের প্রতিবেশী হলেও আমি ওকে নিজের বোনের মতো স্নেহ করতাম। ও কিছু একটা আবদার করবে আর আমি তা রাখবো না এমন হয়নি কখনও। সেদিন মাফলারটা দেওয়ার সময় ভেবেছি শিপ্রার জন্য এটুকু ত্যাগ তো করাই যায়। পুলককে না হয় আরেকটা বানিয়ে দেব। তখন আমি বুঝিনি জীবন কখনও সে সুযোগ আমাকে দেবে না।
এবং জীবন মাঝেমাঝে যেন গল্পকেও হার মানায়। এমন সব চমক নিয়ে সে অপেক্ষা করে থাকে যে সেসবের সামনে দাঁড়িয়ে সমস্ত অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়। জগত সংসারের সবকিছুই অসাড় লাগে। আমারও তেমন লেগেছিল যেদিন পুলক মাফলারটা গলায় জড়িয়ে ক্যাম্পাসে এলো। ভালোলাগায়, আনন্দে চোখমুখ ঝলমল করছিল ওর! তাই আমার রক্তশূণ্য চেহারার দিকে ওর নজর যায়নি। সত্যি বলতে ও কখনও আমাকে ভালো করে লক্ষই করেনি। করলে হয়তো দেখতে পেত অনেক কিছুই।
পুলকের মুখ থেকে আমি কিচ্ছু শুনতে চাইনি। শুধু এক নিঃশ্বাসে বলেছি— তোদের একসঙ্গে খুব মানাবে রে!
আমরা যখন সেকেন্ড ইয়ার শিপ্রা তখন সবেমাত্র আমাদের ডিপার্টমেন্টে এসে ভর্তি হয়েছে। ক্যাম্পাসেও মেয়েটা সারাদিন আমার সাথে ছায়ার মতো ঘুরতো। তাই আমার বন্ধু পুলকের সাথে ওর রাতারাতি ভাব হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। হয়তো তখন থেকেই ওরা একে অন্যের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছিল। শুধু আমার একতরফা অনুভূতির আভাস কেউ পায়নি।
পুলক সেদিন মাফলারটা গলায় জড়াতে জড়াতে বলেছিল— জানতে চাইলি না কে সেই মেয়ে? ওকে তুই খুব ভালো করে চিনিস, তোদের প্রতিবেশী।
পুলকের মুখ থেকে আমি কিচ্ছু শুনতে চাইনি। শুধু এক নিঃশ্বাসে বলেছি— তোদের একসঙ্গে খুব মানাবে রে!
অনেক ভেবেচিন্তে শিপ্রার জন্য একটা উপহার কিনেছিলাম তখন। আমার মনে হয়েছিল ওই একটা উপায়ে আমার সমস্ত কথা শিপ্রাকে বলা হয়ে যাবে। কান পাতলে হয়তো পুলকও জেনে যাবে যা বলতে চেয়েছি কখনও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওদের বিয়ের উৎসবে আমি যেতে পারিনি। আমার নিজেকে নিয়ে ভীষণ ভয় ছিল। যদি নিজেকে সংযত রাখতে না পারি। যদি ওদের চোখে চিরদিনের জন্য করুণার পাত্র হয়ে যাই। ওদের বিয়েতে তাই আমি যাইনি শেষমেশ।
নিজেকে অল্প অল্প করে সরিয়ে নিয়েছিলাম। বিয়ের পরপরই পুলক শিপ্রাকে নিয়ে ঢাকায় চলে গেছে বলে খবর পেয়েছিলাম। যাওয়ার আগেও আমাদের দেখা হলো না। মাঝেমাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করতো, এই যে এমন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল একটা মানুষ, তাই বলে কি তাকে আর খুঁজতে নেই? ওদের কাছে আমার প্রয়োজন কত দ্রুত ফুরিয়ে গেল!
ইন্দ্রা চলে যাবার সময় ওর হাতে করে শিপ্রার জন্য আমিও উপহার পাঠালাম। সেদিনের পর থেকে আমার বইয়ের তাকেই ছিল গীতবিতানটা। এই এতকাল ধরে আমার কথাগুলো বন্দি করে রেখেছিলাম যে গানগুলির মাঝে তাই পাঠিয়ে দিলাম ওকে। দূর প্রবাসে বসে শিপ্রা বইটা হাতে নিলে দেখতে পাবে নকশা কেটে খুব চেনা অক্ষরে প্রথম পাতায় কেউ লিখেছিল— ‘শিপ্রার বিয়েতে ইলা আপা।’
জন্ম ২ এপ্রিল, চটগ্রামে। তার শৈশব কৈশোর কেটেছে বিভিন্ন মফস্বল শহরে। পেশায় চিকিৎসক। লেখালেখিতে তিনি মনের খোরাক খুঁজে পান। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থসমূহ : কিছু গল্প অবাঙমুখ (২০১৮), নৈর্ঋতে (২০২০), বিহঙ্গম (২০২১)।