১.
সোমবারের ভোর ছিল বৃষ্টিহীন ও উষ্ণ। অরিলিও এসকোভার একজন ডিগ্রিহীন দন্তচিকিৎসক। সেই ভোরে ঘুম থেকে উঠে ছয়টা বাজতে না বাজতেই চেম্বার খুলে বসলেন। চেম্বারে এসে কাচের বাক্স থেকে কিছু নকল দাঁত বের করে রাখলেন যেগুলো তখনও প্লাস্টারের ছাঁচে আটকানো ছিল। মুঠোয় করে কিছু যন্ত্রপাতি এনে টেবিলের উপর এমনভাবে সাজালেন যেন ওগুলোর প্রদর্শনী চলছে!
গলায় সোনালি বোতাম বাঁধা, কলারহীন ডোরাকাটা শার্টের সাথে ফিতে দেওয়া প্যান্ট পরা ছিল ডাক্তারের গায়ে। চর্মসার চেহারা হলেও দেহগড়ন বেশ খাড়া। আশপাশে কি হচ্ছে সেদিকে তাঁর খেয়াল নেই। তিনি বধিরের মতো একদৃষ্টিতে, এক ধ্যানে কাজ করছিলেন।
সবগুলো জিনিস টেবিলে সাজানো হয়ে গেলে, ড্রিলটাকে চেয়ারের কাছে টেনে নিয়ে নকল দাঁতগুলো ঘষতে লাগলেন। সে যেন কাজের মধ্যে থেকেও নেই। অবচেতনেই ড্রিল পাম্প করছেন, এমনকি যখন সেটার প্রয়োজন ছিল না, তখনও!
আটটার খানিক পরে জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ালেন তিনি। দেখলেন পাশের বাড়ির ছাদে দুটো মনমরা বাজার্ড রোদে গা শুকাচ্ছে। ফের কাজে বসে মনে হলো আবার বৃষ্টি হতে পারে। এগারো বছর বয়সী ছেলের তীক্ষ্ণ আওয়াজে কাজের ছন্দপতন ঘটল।
আটটার খানিক পরে জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ালেন তিনি। দেখলেন পাশের বাড়ির ছাদে দুটো মনমরা বাজার্ড রোদে গা শুকাচ্ছে। ফের কাজে বসে মনে হলো আবার বৃষ্টি হতে পারে। এগারো বছর বয়সী ছেলের তীক্ষ্ণ আওয়াজে কাজের ছন্দপতন ঘটল।
‘বাবা…’
‘কি হলো?’
‘মেয়র জানতে চাইছেন তুমি তার দাঁত তুলবে কি না।’
‘ওকে বলে দাও আমি চেম্বারে নেই।’
তিনি একটা সোনার দাঁত ঘষামাজা করছিলেন। একহাত দূরে সেটাকে ধরে আধবোজা আণুবীক্ষণিক দৃষ্টিতে ভালোমতো খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। এমন সময় ছোটো বসার ঘরটা থেকে ছেলের আওয়াজ আবার শোনা গেল।
‘তিনি বলছেন তুমি এখানে আছো, কারণ সে তোমার গলা শুনতে পাচ্ছেন।’
২.
ডাক্তার কাজ চালিয়ে যান। কাজ শেষ করতে না করতেই বললেন, ‘বুঝলাম।’
তিনি আবার ড্রিল চালাতে থাকলেন। কার্ডবোর্ডের যে বাক্সটায় বাকি জিনিসগুলো রাখা থাকে তা থেকে দাঁতের ব্রিজের বেশকয়েকটা টুকরো বের করে আনলেন সোনা ঘষার জন্য।
‘বাবা’
‘কী?’
ডাক্তার আগের মতোই কাজ করে যেতে থাকলেন।
‘মেয়র বলছেন তুমি তার দাঁত না তুললে সে তোমায় গুলি করবে।’
তাড়াহুড়ো না করে, খুবই ধীরস্থিরভাবে তিনি প্যাডেল চালানো বন্ধ করে সেটাকে দূরে ঠেলে দিলেন। টেবিলের নিচের ড্রয়ারের পুরোটা টেনে বের করলেন। ওতে একটা রিভালভার রাখা ছিল।
‘ঠিক আছে। ওকে এসে আমায় গুলি করতে বলো।’
হাতটা ড্রয়ারের কোণে রেখে দরজার উল্টো পাশে চেয়ার ঘুরিয়ে বসে আছেন ডাক্তার। মেয়র ততক্ষণে দরজায় হাজির। তার মুখের বাম পাশটা কামানো। তবুও যন্ত্রণায় ফুলে ওঠা ডান দিকের গালে দিন পাঁচেকের না-কামানো দাঁড়ি উঁকি দিচ্ছে। ডাক্তার দেখতে পেলেন তাঁর নিস্তেজ চোখেও বহু দিনের হতাশা আঁকা। ড্রয়ারটা আঙুলের আলতো চাপে বন্ধ করে মৃদুস্বরে বললেন—
‘বসুন।’
‘শুভ সকাল!’
‘আপনাকেও’, ডাক্তার প্রতিউত্তর করলেন।
ছুরি-কাঁচিগুলো যখন ফুটছিল, মেয়র তখন চেয়ারে মাথা রেখে কিছুটা আরাম খোঁজার চেষ্টায় ছিলেন। তার শ্বাস তখন বরফ-বাষ্পের মতো।
খুবই সাধারণ একটা চেম্বার। কাঠের চেয়ারটা পুরোনো, প্যাডেল ড্রিল আর সিরামিকের বোতল সমেধ একটা কাচের বাক্স। চেয়ারের উল্টো দিকে কাঁধসমান উঁচু পর্দা দেওয়া একটা জানালাও আছে।
মেয়র যখন বুঝলেন এবার তার চিকিৎসা শুরু হতে যাচ্ছে, তিনি পা দুটো জড়ো করে বেশ বড়ো একটা হা করলেন।
অরিলিও এসকোভার মেয়রের মাথাটা আলোর দিকে ঘোরালেন। সংক্রমিত দাঁত পরখ করার পর, আঙুলের চাপে খুব সাবধানে মেয়রের চোয়াল বন্ধ করে দিলেন।
৩.
‘দাঁত তোলার কাজটা অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়াই করতে হবে।’
‘ওমা! কেন?’
‘কারণ আপনার মাড়িতে ফোঁড়া হয়েছে’
মেয়র করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কোনোরকমে বললেন, ‘আচ্ছা’।
একটু হাসারও ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। কিন্তু ডাক্তার ততে কোনো সায় দিলেন না। তিনি গরম জলে ডোবানো ছুরি-কাঁচির পাত্রটা টেবিলে রাখলেন এবং খুবই ধীরস্থিরভাবে জল থেকে দুটো চিমটা তুললেন। জুতোর ডগা দিয়ে পিকদানিটা ঠেলে দিয়ে তিনি বেসিনে গেলেন হাত ধুতে। মেয়রের দিকে তার কোনোপ্রকার ভ্রুক্ষেপ লক্ষ করা গেল না। এদিকে মেয়রের দৃষ্টি সবসময় ডাক্তারের দিকে।
একটু হাসারও ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। কিন্তু ডাক্তার ততে কোনো সায় দিলেন না। তিনি গরম জলে ডোবানো ছুরি-কাঁচির পাত্রটা টেবিলে রাখলেন এবং খুবই ধীরস্থিরভাবে জল থেকে দুটো চিমটা তুললেন। জুতোর ডগা দিয়ে পিকদানিটা ঠেলে দিয়ে তিনি বেসিনে গেলেন হাত ধুতে। মেয়রের দিকে তার কোনোপ্রকার ভ্রুক্ষেপ লক্ষ করা গেল না।
সংক্রমিত দাঁতটা ছিল নিচের পাটির একটা আক্কেল দাঁত। ডাক্তার পা ছড়িয়ে বসে গরম ফরসেপ দিয়ে দাঁতটা চেপে ধরলেন।
যন্ত্রণায় মেয়রের হাতদুটো চেয়ারের হাতল আঁকড়ে ধরে সর্বশক্তি দিয়ে পা জোড়া জড়ো করে মাটির সাথে চেপে রাখলেন।
তার তলপেট জুড়ে হিমশীতল শূন্যতা খেলে যাচ্ছিল!
কব্জিতে সামান্য মোঁচড় দিলেন ডাক্তার।
ক্ষোভহীন, বরং তিক্ত সহানুভূতি নিয়ে বললেন—
‘আপনাকে এখন আমাদের কুড়িটা লাশের হিসেব চোকাতে হবে।’
মেয়রের চোয়ালের হাঁড়গুলো যেন ভেঙে পড়ল। তার চোখভর্তি জল। তবুও দাঁত বের না করা পর্যন্ত তিনি দম আটকে রাখলেন। কান্না ভেজা চোখেই দাঁতটা দেখলেন।
এই যন্ত্রণা এতটাই বিভৎস যা গত পাঁচ রাতের কষ্টের কাছে অপরিচিত!
ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে, হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি পিকদানির উপর ঝুঁকে পড়লেন। পোশাকের সমস্ত বোতাম খুলে প্যান্টের পকেটে থাকা রুমালটা হাতরে খুঁজছিলেন। ডাক্তার তাকে একটা পরিষ্কার কাপড় এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘চোখ মুছে নিন।’
মেয়র তাই করলেন। তিনি অনবরত কাঁপছিলেন!
হাত ধোয়ার সময় ডাক্তার দেখতে পেলেন ভেঙে পড়া ছাদে বেশ কিছু ধুলো জড়ানো মাকড়সার জাল। ওতে মরা পোকামাকড় আর মাকড়সার ডিমও আটকে আছে। হাত মুছে তিনি ফিরে এলেন।
‘বিশ্রাম করুন। নুনজল দিয়ে কুলকুচি করতে ভুলবেন না যেন।’ ডাক্তার বললেন।
মেয়র উঠে দাঁড়িয়ে পোশাকের বোতাম খোলা অবস্থাতেই হালকা সামরিক কায়দায় সম্মান জানিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালেন।
বাইরে বেরিয়ে ডাক্তারকে বললেন, ‘বিলটা পাঠিয়ে দেবেন।’
‘আপনার কাছে নাকি টাউন অফিসে?’ ডাক্তার প্রতিউত্তরে বললেন।
মেয়র আর ফিরে তাকালেন না। দরজা বন্ধ হলে আড়াল থেকে বললেন :
‘একই তো কথা!’
জন্ম ২০০৭ সালের ১৩ই মে বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলায়। পৈত্রিক নিবাস দিনাজপুরের চিরিরবন্দেরের নানিয়াটির গ্রামে। বাবার চাকরিসূত্রে থাকেন সিরাজগঞ্জে। বি.এল. সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছেন। নিয়মিত সংগীত সাধনার পাশাপাশি, লেখালেখি ও আঁকাআঁকির প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ।