শুক্রবার, নভেম্বর ২২

ঘোলচক্কর : সুমন মাহমুদ

0

মনীষার সাথে আমার কীভাবে সম্পর্ক, সেটা এখন বলা কতটা যৌক্তিক, ভাবতে ভাবতে একটা সিগারেট ধরাই। সঙ্গম শেষে তার মুখটাই এখন মনে পড়ছে। এই মনে পড়া কতটা সংগত, সেটা নিয়ে বিশ্লেষণ করা আমার জন্য দুরূহ লাগে। জীবনের পাতলা নরম খোসাটা ছাড়িয়ে লুটেপুটে খেয়ে নিতে পারলে শান্তি পেতাম, সেটাই ভাবি বরং বেশি করে। এই ভাবনা থেকেই একদিন মনীষাকে নিয়ে পালিয়ে গেলাম। কোথায় পালালাম? কাউকে বলতে চাইনি কোনো দিন। কিন্তু বলা উচিত। কেন বলা উচিত, সেটা ভাবতে ভাবতে একটা কারণ অবশ্য খুঁজে পেয়েছি। আমি কিছু দিন পর নিঃস্ব হয়ে যাব। নিঃস্ব হতে গেলে একটা কারণ লাগে। কমন একটা কারণ আছে। কী সেটা?

কাউকে বলতে চাইনি কোনো দিন। কিন্তু বলা উচিত। কেন বলা উচিত, সেটা ভাবতে ভাবতে একটা কারণ অবশ্য খুঁজে পেয়েছি। আমি কিছু দিন পর নিঃস্ব হয়ে যাব। নিঃস্ব হতে গেলে একটা কারণ লাগে। কমন একটা কারণ আছে। কী সেটা?

অন্য কিছু না। ভুল। ভুলই একমাত্র কারণ নিঃস্ব হওয়ার। দারুণ সফলতার সাথে কেউ ব্যাবসা করছে। তরতরিয়ে বেড়ে চলেছে ব্যাবসা। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে একটা ভুল এসে বসে গেলেই হলো। মথুরাপুর বড়ো বাজারে একজনকে চিনি আমি। যখন ছোটোবেলায় দাদির হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওই বাজার পেরিয়ে মহিষকুণ্ডি যেতাম, সবাই জাকিরের দোকান বলতেই একনামে চিনত। জাকির অবশ্য ফুফা হয়। চাচাতো ফুফা। রমরমা ব্যাবসা তার। নিমেষে শেষ হয়ে গেল। নিজের ভাইয়ের কাছে বেচে দিতে হলো নামমাত্র মূল্যে। এখানে ভুল কী ছিল ভাবছেন? ভুল ছিল। কোনো এক ঘোলচক্করে পড়ে সিগারেটের সোনালি কাগজটায় সাদা গুঁড়া রেখে আগুন জ্বালিয়ে সেই যে নাকে টেনে নিতে শুরু করল, সেখানেই ভুল ছিল। সবকিছু হারিয়ে এখনো ভুলের কারণ অবশ্য সে খুঁজে পায়নি। খুঁজে পাওয়ার কথাও নয় অবশ্য। ঘোলচক্করে পড়লে ভুলকে কখনো ভুল মনে হয় না। আমিও ঘোলচক্করে পড়েছি। একই অফিসে চাকরি করার সুবাদে কিঞ্চিৎ বাতচিত হতো। এটুকুই যা। সেটা একটা সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে কোনো নিয়ামক হিসেবে কাজ করে বলে আমি কখনোই বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস না করার ব্যাপারে শতভাগ একমত। আমি নিজেই অফিসের নারী কলিগদের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলতে পারি না। তবে একটা ব্যাপার আমার নজর এড়াত না। মনীষা আর্ট ভালোবাসে। যদিও সে ইডেনের ছাত্রী। অবশ্য ইডেনের ছাত্রী হলেই যে আর্ট ভালোবাসা যাবে না, ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। প্রায়ই দেখি, তার আর্টিস্ট বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। কোনো কারণে আসা-যাওয়ার পথে চোখে পড়ে গেলে কিছুক্ষণ দাঁড়াই। কিন্তু কেন দাঁড়াই! দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখি। তারপর…

বহুদিন পর একটা আবৃত্তি সংগঠনে দেখা। আমি তো থ। এমনটা হওয়ার কথা ছিল কখনো! আবৃত্তি শিখব, এই ভূত আমার মাথায় ঢুকে মাথাটা পাগল করে ছাড়ছিল মাস কয়েক হবে। ভর্তি হতে গেলাম। ভর্তি হতে গেলাম বলতে, গিয়ে ভাইভা দিতে হবে। সেটা উতরে গেলে ভর্তি হতে হবে। ভাইভা-ভাগ্য আমার বেশ ভালো। চাকরি কিংবা অন্য যেকোনো ভাইভায় আমি অনায়াসে উতরে যাই। কীভাবে যাই, জানি না। অথচ আমি ফ্লুয়েন্টলি কথা বলতেই পারি না। কেন পারি না, সেটা এখন আমি বুঝি। আর বোঝার পর থেকেই আমার মনে হয়েছে, আবৃত্তি শিখতে হবে। সেই আবৃত্তি শিখতে গিয়ে মনীষার সাথে দেখা হয়ে যাবে, এমনটা ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। মনীষাও আমাকে দেখে বিস্মিত! নানাভাবে মনীষাকে ফলো করার দিনগুলোতে একদিন আমার মনে হলো, চাকরিটা ছেড়ে দেবো। কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে পড়ি। আর ওই অফিসে যাইনি। মিজান ভাই। আমার বস। ফোনের পর ফোন দিলেও আমি তা রিসিভ করিনি। গুষ্টি মারি তোর চাকরির! কিন্তু মনীষা! মনীষা আর কী! আমার সাথে তো আর তার চাকরি ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ার মতো কোনো ব্যাপার ঘটেনি। স্বাভাবিকভাবে সে চাকরিজীবী রয়ে গেল। আমরা দূরত্ব নিয়ে দিন কাটাতে লাগলাম। মাঝেমধ্যে অবশ্য মনে হতো, মনীষা ও তার বন্ধুদের আড্ডায় গিয়ে আমি হাজির হতেই পারি। কিন্তু না। কেন যাব? যাওয়ার কোনো মানেই হয় না।

কেন পারি না, সেটা এখন আমি বুঝি। আর বোঝার পর থেকেই আমার মনে হয়েছে, আবৃত্তি শিখতে হবে। সেই আবৃত্তি শিখতে গিয়ে মনীষার সাথে দেখা হয়ে যাবে, এমনটা ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। মনীষাও আমাকে দেখে বিস্মিত! নানাভাবে মনীষাকে ফলো করার দিনগুলোতে একদিন আমার মনে হলো, চাকরিটা ছেড়ে দেবো। কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে পড়ি।

আরেহ! আপনি! কেমন আছেন?

ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

ভাবছেন, দেখা হওয়ার পর এসব দিয়েই আমাদের বাতচিত শুরু হয়েছে! মোটেও না। বহুদিন পর দেখা হওয়ার পর ধুরন্ধর আখ্যা জুটলে সেটাকে মন্দ না ভালো বলব, ভেবে পাইনি বেশ কিছুক্ষণ। সঙ্গম শেষে এখনো ধুরন্ধর শব্দটাই আমার কানে বেশি বাজে। সঙ্গমেও আপনি যত ধুরন্ধর হয়ে উঠবেন, ততই আবিষ্কার করতে থাকবেন। প্রতিবার সঙ্গমে মানুষের এত আবিষ্কারের নেশা ওঠে কেন, বুঝে উঠতে পারি না। সবাই আবিষ্কারের যাত্রায় শামিল হয়, কিন্তু কতটা আবিষ্কার করতে পারে, সেটার হিসাব কষে না। এটাই মনে হয় হওয়ার কথা!

আপনি না আর্ট পছন্দ করেন না। তো হঠাৎ এই কবিতার আসরে! মতিগতি তো ভালো ঠেকছে না!

আর বইলেন না। কিছু দিন ধরে আমার মনে হচ্ছে, আমি কারো সাথে প্রোপারলি কমিউনিকেট করতে পারছি না।

কেন কেন?

কেন, জানি না। এই কমিউনিকেট না করতে পারাটা আমাকে অনেক প্যারা দেয়। এই যে একই অফিসে চাকরি করেছি, কিন্তু কখনো আপনার সাথে ফ্লুয়েন্টলি কথা বলতে পেরেছি? পারিনি। অথচ পারা উচিত ছিল।

ভালো কথা, আপনি উধাও হলেন কোথায়?

উধাও হলাম কে বলল! চাকরি করব না, তাই আর ওই অফিসে যাইনি। চাকরি না করলে অফিসে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। গেলেই তো এই নিয়ম মানতে হবে, সেই কাগজ দাখিল করতে হবে। এত সব ক্যাচালের মধ্যে আমি নাই।

তাহলে…

কোনো তাহলে নাই। তাহলের খুঁজে কী পেলেন!

প্রতি শুক্রবার ক্লাস। ক্লাস মানে আবৃত্তি শেখার আনজাম। ভালোই লাগে। কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করলে বেশ ভালো লাগে। মনে হয়, আমি যেন কবিতার চরিত্র। কখনো বিরহ, কখনো সুখ, কখনো দুঃখ। অনেক কিছু ঘটতে থাকে। আমিও ঘটতে দিই। ঘটুক না! মনীষা কবিতা হয়ে ওঠে। আমার চরিত্রযাপন তার ভালো লাগতে শুরু করে। ক্লাস শেষ করে দুজনে দুপুর পর্যন্ত আড্ডা। দুধ চা, সিগারেট। মাঝেমধ্যে শিঙাড়া। ডিম খিচুড়ি খেয়ে গন্তব্য। মাঝে সে ভারতে ঘুরে এসে পকেট পারফিউম আর চকলেট হাতে ধরিয়ে দেয়। এখন অবশ্য এই পারফিউম অ্যাভেইলেবল। মনি পারফিউম গিফট দেখে বলে বসে, দোস্ত, কাউকে পছন্দ করলে নাকি পারফিউম দেয় শুনেছি।

দুজনের কখনো তুমিতে নেমে আসা হয়নি। আমরাই নামিনি। বাই দ্য ওয়ে, সবকিছুরই একটা আলাদা মাধুর্য আছে। আমরা সেই মাধুর্য আবিষ্কারের নেশায় মত্ত হতে থাকি।

দুর, ক্লাস ভাল্লাগছে না। কী বালের আবৃত্তি শেখা! আমার সাথে যাওয়ার ইচ্ছা আছে?

অবশ্যই আছে।

কোথায় কীভাবে জানি না, গেলে এখনই যেতে হবে।

ওকে, আই অ্যাম রেডি। লেটস গো।

অ্যান্ড, আমরা বেরিয়ে পড়ি। টিএসসির সেই আবৃত্তি ফেলে আমরা বেরিয়ে পড়ি। বেরিয়ে পড়ি বলতে, একটা কুঠুরির পথ ধরে হাঁটতে থাকি। যে কুঠুরিতে মনীষা কবিতা, আমি তার চরিত্র। কখনো সুখ, কখনো বিরহ, কখনো ভীষণ সূর্যরশ্মি। আমরা কবিতা আর চরিত্র যাপন করি। যাপন করতে করতে কুঠুরি আর কুঠুরি থাকে না। ভীষণ সূর্যরশ্মিতে ভেসে যায়।

কুঠুরি ভেঙে তুইয়ে নেমে আসা আমরা দুজন ঘোলচক্করের শহরে ফিরে আসি।

তারপর!!!

তারপর আর কী!

সঙ্গম শেষে মনীষা। মনীষা শেষে সঙ্গম। বেখাপ্পা এক ঘোলচক্করের সাথে যাপন শেষে থুতু গিলে ফেলি। সম্পর্ক একটা শুয়োরের বাচ্চা… নিঃস্ব হওয়াই শ্রেয়…

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম কুষ্টিয়ায়। ছড়া ও কবিতা লিখে চলেছেন। বাংলা একাডেমি তরুণ লেখক প্রশিক্ষণ কোর্সের ষষ্ঠ ব্যাচে ছিলেন। বর্তমানে প্রথম আলোয় সম্পাদনা সহকারী হিসেবে কর্মরত। প্রকাশিত ছড়ার বই: ‘টাপুর টুপুর টুপ’ (২০১৬) ও ‘কিলিক কিলিক মেঘের ঝিলিক’ (২০১৮)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।