ভান
নিজের বই নিয়ে নিজে জানান দেবার ব্যাপারটা মুশকিলের! আত্মীয় স্বজন ছাড়া প্রেমিকার বাপের সঙ্গে বিয়ের আলাপ দেয়ার মতো ব্যাপার! বই নিয়ে আমার যেইটা ঘটে সেটা হচ্ছে, আমার মনে হয় বইটার পাণ্ডুলিপি পাকাপাকি করার পর বাকিটা প্রকাশকের কাজ। বই নিয়ে প্রচার প্রচারণা কিংবা আলোচনা সমালোচনা ইত্যাদি খাড়া করা বা এইটার বিক্রি বাড়ানোর নানান কাবজাব প্রকাশকের দায়িত্ব। লেখক ফিরে যাবেন তার নিজের মোরাকাবায়। কিন্তু এইসব আফসোস মার্কা কথা বাড়ায়ে লাভ নাই, কারণ আমি শেষমেশ নিজের বই নিয়ে লিখছি এবং সেটার উন্নত প্রচারণা কামনা করছি মনে মনে।

চম্পাকলি লেন ও অন্যান্য নাটক | রোমেল রহমান | প্রকাশক: অনুপ্রাণন প্রকাশন | প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত | মুদ্রিত মূল্য: ৩৩০ টাকা | বইটি সংগ্রহ করতে এখানে ক্লিক করুন।
আদি কথা
কবিতার লোক আমি। একদা নাটক নিয়ে আগ্রহ জন্ম নিলো প্রবল! সম্ভবত মাইকেল মধুসূদন দত্ত আমার এলাকার সিনিয়র হওয়ায় এই ভাবের জন্ম। কারণ, তাঁর পরিচিতিতে ‘কবি ও নাট্যকার’ লেখা থাকত, যেটা এক অদ্ভুত উস্কানি ছিল আমার বালক মনে, আর আমার মেজো কাকার সূত্রে মাইকেল সমগ্র বাল্যকালে আমার নাগালে আসে এবং সেই ভাষা পুরাপুরি না বুঝলেও কসরতে এবং ডিক্সনারি সহযোগে নাড়াচাড়া কিংবা ঘাটাঘাটি করতে করতে যখন আমি টের পাচ্ছি কবিতা লেখা ছাড়া আমার আর উপায় নাই। সেই সময় পাড়ি দিতে গিয়ে ক্রমে অনুভব হয়— নাটক আমার সঙ্গে যাচ্ছে। কারণ লাইব্রেরিতে নাটকের বই খুঁজে খুঁড়ে বা পাঠ্যক্রমের টুকটাক নাটক পড়তে গিয়ে আমার কাছে এই কলামাধ্যম তুমুল আগ্রহের হয়ে ওঠে। যার বিস্তার দিনে দিনে ঘটে নাগালে পাওয়া নাট্য কিতাব পাঠ করার মধ্য দিয়ে, আর কোথাও লোকাল ফর্মের নাট্যকীর্তি নজরে পড়লে দাঁড়ায় যাওয়ার মধ্যে। হোক সেইটা অষ্টক গান, নীল পুজার পাটা নাচ, কিংবা ভাল্লুকের খেলা দেখানো সেই বুইড়া লোকটা যিনি তার চোপবাজি দিয়া আটকায় রাখত ভাল্লুকের থেকে আরও মনোহর মধুতে! অথবা ক্যানভাসারদের রসাত্মক উপস্থাপন। নাটক হয়ে এইসব জিনিস আমার কোমল অন্তরে তখন দাগ কাটে। আর এক সময় লিখে ফেলি একটা আস্ত কাব্যনাট্য ‘একটি তথাকথিত খুন বা মোয়াজ্জেম সমাচার’ যেই নাটক বাংলাদেশ বেতার খুলনায় আমার অজানাতেই প্রচার হয় এবং আমি দুঃখ পাই। কিন্তু ঘটনা ঘটে আমার লেজে জোড়া পালক আচমকা দেখতে পাই— কবি ও নাট্যকার! এই তকমার পুলক নিশ্চয়ই সেই সদ্য তারুণ্যের মধ্যে শিরশিরানি ঢালে।
আসল কথা
২০১৩ সালের আন্দোলনে সময় আমি ঝপ করে এক নিরীক্ষা করে বসি, ধারাবাহিক পথনাটক! ‘ফট্টিনাইন’ নামের একটা ধারাবাহিক পথনাটক আমি লেখা শুরু করি যেইটা খুলনা শিববাড়ি, নির্দলীয় গণমঞ্চে প্রতিদিন পার্ফম হতে থাকে একটা বিশেষ পদ্ধতিতে। দেখা যায় বিপুল সাড়া পড়ে যায়, এবং এই নাটকের কথা ছরায় যায় আমার শহরে, আর কিছু শ্লোগান জন্মায় এই নাটক থেকে! হাজার হাজার দর্শকের সেই উল্লাস আমার নাট্যভাষা আর নাট্যশিক্ষার বীজপাঠ দেয়। যেটা হাওয়া জল পেয়ে বাড়ে। এরপর বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, খুলনা জেলা সংসদ আমার নাটকের সঙ্গে একটা জার্নি দেয় যেটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই অর্থে, তারা আমার অনেকগুলা নাটক সারাদেশে তাদের অন্যান্য শাখায় ছড়িয়ে দেয়। এবং নিঃসন্দেহে দেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট, সন্ত্রাস, সহিংসতা সব সময় আমার পথনাটক রচনার অন্যতম উপজীব্য হয়ে উঠেছে। গণমানুষের অধিকার আর শ্রমিক আন্দোলন আমাকে জড়িয়ে রেখেছে তাদের সংসারে। সেই সব দিনের মধ্যে দিয়ে নাটক জন্মেছে। যখন আমার ছোটো শহরের মুরুব্বি নাট্যজনেরা আমাকে নিরিখ করেছে— ‘এই ছেলে নাটকে গালি দেয়! নাটকের নামে অপসংস্কৃতি ছড়াচ্ছে’ ইত্যাদি ট্যাগে। এবং ক্রমে দেশ নিয়ন্ত্রণবাদের কঠিন সংস্কৃতির ফাঁপড়ে পড়ে, এক সময় দেখি রাজনৈতিক নাটক বন্ধ হয়ে যাওয়ার সূক্ষ্ম জালে আমার নাটকগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এই সময়ে সাহিত্য পত্রিকা মৃৎ আমাকে দিয়ে বেশ কিছু বড়ো নাটক লিখিয়ে নিয়েছে কয়েকটা সংখ্যায়।
চম্পাকলি লেন ও অন্যান্য নাটক
চম্পাকলি লেন ও অন্যান্য নাটক বইটার ফ্লাপে লেখা আছে —
“পাঁচটি নাটক নিয়ে ‘চম্পাকলি লেন ও অন্যান্য নাটক’ গ্রন্থটি নাটকের এক অনবদ্য সংগ্রহ। গ্রন্থটিতে তীব্র রাজনৈতিক সচেতনতা এবং ক্ষুরধার সংলাপ গণমানুষের স্বর হয়ে বেরিয়ে এসেছে। মঞ্চ না-কি পথনাটক? আদতে বিবিধ মাধ্যম উপযোগী নাটকগুলোর মধ্যে সম্প্রীতি, বিভেদ, বাক স্বাধীনতা, সন্ত্রাস, সহিংসতা কিংবা নাভিশ্বাস উঠে যাওয়া মানুষের গল্পগুলো রম্য কিংবা তীক্ষ্ণ তীর্যক স্বরে উচ্চারিত, যা বাংলা নাট্যের চিরকালীন অবয়বকে বুকে নিয়ে নতুন ভাষ্যে রূপান্তর। এই গ্রন্থের নাটকগুলোর অন্যতম মাধুর্য এর কাব্যময়তা। মানুষের অভেদ সংগ্রামের এক গুপ্ত বাঞ্ছা নিহিত হয়ে আছে নাটকগুলোর গহীনে।”
ফ্লাপের এইসব কথা পড়ার পর বাড়তি কথা দিয়ে চিড়া ভেজানো বাচালতা ছাড়া আর কিছু না। এছাড়া বইয়ের শুরুতে এক পাতা মুখবন্ধ আছে যেখানে আরও কিছু আলাপ শোনা যাবে।
তবে বেশ অনেক বছর নাটক লিখতে লিখতে আমার মনে হয়েছে, এইবার বই আকারে জমা করে দিয়ে দেওয়া যাক। অন্তত যারা আমার নাট্যযাত্রার সঙ্গী কিংবা যারা নাটক গুলা করতে চায় তাদের অনেকেই আমার সঙ্গে যোগাযোগের লাইন পায় না। অন্তত প্রকাশকের প্রচারণার গাড়ি চেপে নাটক গুলা আরও ছড়াক। এই গ্রন্থের আকার দীর্ঘ করা যেত, অন্তত এক ডজন নাটক দিয়ে ভালো একটা সাইজের বই বানালে কায়দার হতো হয়তো। কিন্তু নাটক করা আমার মফস্বল বা গ্রাম গঞ্জের নাট্যকর্মীদের পকেটের হাল আমার খুব ভালো জানা। তাই ৫টা নাটক দিয়ে অল্পের মধ্যে রান্নাটা করেছি। আর আমার প্রকাশকদের মধ্যে আবু এম ইউসুফ অন্য ধাঁচের আদম। নাটকের বই বিক্রি হবে কি না এই কিসিমের কোনো চাপ বা প্রশ্ন তার নাই। তিনি শুধু পাণ্ডুলিপি পড়ে একবার জানতে চাইলেন, ‘পলিটিকাল নাটক, সংলাপে যেইসব কথাবার্তা আপনার কোনো সমস্যা হবে না তো?’ আমি তাকে জানাই, ‘সমস্যার কিছু নাই।’ ইউসুফ ভাই জানান, ‘তাহলে করে ফেলি।’ এই দুই কথার মধ্যে দিয়ে বই আকারে জন্ম নেয়, চম্পাকলি লেন ও অন্যান্য নাটক।
লেজের কথা
পথনাটক তো একটা হাতিয়ার, যেটা নিয়ে খোলামেলা ঘোরাফেরা করতে দিতে নারাজ রাষ্ট্র নামক ব্যবস্থাপনা। শাসনযন্ত্র ভালোবাসে মিউমিউ বা জি-হুজুর জি-হুজুর! বই আকারে রাজনৈতিক নাটক হাজির করা মানে— রাষ্ট্রের চাপরাশিরা যেটার ভার সহ্য, সরানো বা প্রদর্শন কিংবা সংরক্ষণ করার এক অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যায়। আমি হয়তো বই আকারে প্রকাশের মধ্যে দিয়া সচেতনভাবে সেইটাই করলাম! বইটি চলতি বইমেলায় পাওয়া যাবে অনুপ্রাণন প্রকাশনীর ৬৯৫-৬৯৭ নম্বর স্টলে।
মঙ্গল হোক সবার।
