শুক্রবার, ফেব্রুয়ারি ২১

জলজ লকার: এক রহস্যময় ডুবসাঁতার
: মাহরীন ফেরদৌস

0


“Museums are managers of consciousness. They give us an interpretation of history, of how to view the world and locate ourselves in it.”
—Hans Haacke

প্রায়ই ভাবি, মানুষ কেন যায় মিউজিয়ামে? কী পায় সেখানে? নীরব স্থাপনার ভেতর, আলো-আঁধারের খেলার মাঝে, যেখানে কথা বলতে হয় নিচু স্বরে কিংবা ইশারায়। সেখানে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে মূলত কী খোঁজে তারা? শিল্প? ইতিহাস? নাকি নিজেরই কোনো হারিয়ে যাওয়া রূপ?

Joloj-Locker-Full-Cover

জলজ লকার | মাহরীন ফেরদৌস | প্রচ্ছদ: সব্যসাচী মিস্ত্রী | প্রকাশক: কথা প্রকাশ | ধরন: উপন্যাস | মুদ্রিত মূল্য: ৬০০ টাকা | বইটি সংগ্রহ করতে এখানে ক্লিক করুন

আমি নিজেও খুঁজতাম এমন বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর। সে কারণেই ছুটির দিনগুলোতে ঘন ঘন চলে যেতাম মিউজিয়ামে—দীর্ঘক্ষণ ঘুরে বেড়াতাম নিস্তব্ধ, রহস্যময় গ্যালারিগুলোতে, যেখানে শিল্প শুধুমাত্র তুলির আঁচড়, পাথর কিংবা রঙ-বেরঙের খেলা নয়, বরং কোন অলিখিত ভাষা।

এমনই এক ভ্রমণের ধারাবাহিকতায় কয়েক বছর আগে উইচিটা আর্ট মিউজিয়ামের এক প্রদর্শনীতে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখা পেলাম নেটিভ আমেরিকান শিল্পী প্রেস্টন সিঙ্গলেটারির অনবদ্য সৃষ্টির—প্রদর্শনীর সবকিছু দুর্দান্ত মনে হলেও আমাকে সবচেয়ে বেশি স্তব্ধ করেছিল একটি কাচের তৈরি ধবধবে সাদা কাক।

কাক সাদা? কিন্তু কীভাবে এবং কেন? প্রকৃতিতে যেখানে সব কাক কালো! প্রেস্টনের কাক তবে কেন শুভ্রতার প্রতীক? কৌতূহলী হয়ে ট্যুর গাইডের কাছে জানতে চাইলাম, কিন্তু সে কিছু বলতে পারল না। শেষে এলেন মিউজিয়ামের কিউরেটর। বললেন,

“পৃথিবীর প্রতিটি শিল্পকর্মের পেছনে একটি গল্প থাকে।”

তারপর জানালেন, সৃষ্টির শুরুতে সব কাকই ছিল ধবধবে সাদা। কিন্তু পৃথিবীর আলোকে দৃশ্যমান করতে, অন্ধকারের ভিতরে ডুব দিতে এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গিয়ে কাক গ্রহণ করল সেই অন্ধকারকে। সাদা রং ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হলো কালোতে।

শুনে এক অদ্ভুত অনুভূতিতে আক্রান্ত হয়েছিলাম। সম্ভবত কোথাও না কোথাও হয়তো আমি জানতাম, এই গল্প এখানেই শেষ নয়।

সেই রাতে, বাড়ি ফেরার পর নোটবুকে হালকা কাটাছেঁড়া করতে করতেই ‘জলজ লকার’ উপন্যাসের প্রথম খসড়া লেখা শুরু করেছিলাম।

 


একটা জনপদ, যা কোথাও নেই, আবার সবখানেই আছে। আয়তনে ছোটো নয়, বড়োও নয়। কোনো এক আশ্চর্য ভারসাম্যে দাঁড়িয়ে আছে সেই জনপদ। সেখানের বাসিন্দারা জন্ম থেকে শুনে আসছে—এই নগরী কখনোই পৃথিবীর অংশ ছিল না। একদিন হুট করে, আকাশ চিরে, নেমে এসেছিল মাটিতে।

বা, এমন এক বিচিত্র নগরী যেখানে লোকেরা ভাবে, সহস্র বছর ধরে কোনো বিশাল মাছের পিঠে জেগে থাকা এক দ্বীপে বাস করছে তারা। তাই তো মাঝে মাঝে তাদের শহরটা টলমল করে, যেন সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসতে থাকা কোনো অদৃশ্য কাঠের পাটাতন।

সেই নগরীর মানুষগুলো আসলে কেমন? তাদের গল্প, সংকট ও শ্বাস নেওয়ার কাহিনি কেমন হতে পারে?

 


মানুষের নিঃসঙ্গতাকে সময় দিতে নগরীতে ঘুরে বেরায় উপন্যাসের গল্পকথক। কখনও বা আবার ছুটে যায় দোভাষী হয়ে বন পাহাড়ের জগতে। আরব্য রজনীর গল্পজগৎ থেকে নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে নেবার এক অনর্গত যাত্রা তাঁকে প্রতিনিয়ত করে বিপন্ন ও ক্লান্ত। কিন্তু তারপরেও সে খোঁজে নিজের শিকড়। কখনও তার সহোদরার কাছে ছুটে যেয়ে কখনও বা বছরের শেষ দিনে পড়ন্ত বিকেলে কোনো আগন্তুকের পিছু নিয়ে। এরইমাঝে তাঁকে ধাওয়া করতে থাকে নগরের সব খবর জানা এক ক্ষমতাশীল নারী। স্মৃতিকাতর করে, ফেলে আসা অসমাপ্ত, বিষণ্ণ এক প্রণয়। কিন্তু গল্পকথকের বেঁচে থাকার তাগিদে ক্রমশ বুনে যাওয়া সূতা এক সময় তাঁকে নিয়ে যায় অতীতের এক অসমাপ্ত অধ্যায়ের কাছে, গ্লানি-খেদ-অমীমাংসিত রহস্য মোড়া সেই অধ্যায় কি পারবে উপন্যাসের অন্তিম লগ্নে তাকে সব দায়ভার থেকে মুক্ত করতে? নাকি বিশ্বাসহীন আঁধারে গলে যেতে যেতে একদিন সে মিলিয়ে যাবে অতল গহ্বরে?

 


‘জলজ লকার’ এমন এক উপন্যাস যেখানে মিথ, ম্যাজিক রিয়েলিজম, সামাজিক সংকট ও ব্যক্তিগত স্মৃতি-বিস্মৃতির রহস্যময় ও বিচিত্র এক ভ্রমণ লেখা হয়েছে। উপন্যাসের বিন্যাসে আছে ব্যক্তিগত সংকট, অস্তিত্বের লড়াই, একাকীত্ব ও কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলার অনবরত চেষ্টা।

এই কাহিনি কখনও দুঃখ-দুর্দশা মোচনের, কখনও বা রাজনৈতিক ও পারিবারিক কুচক্রে ঢেকে যাওয়া পৃথিবীর মোড়ক উন্মোচনের। যেখানে সমাপ্তি অবধারিত জানার পরেও আমরা কোনো এক সুন্দর সর্বনাশের দিকে ধাবিত হতে থাকি উৎসুক পথিক হয়ে। অপেক্ষা করি কোনো ফুটফুটে সুন্দর দিনের।

 


তবে, কিছু গল্প কখনোই পুরোপুরি বলা যায় না। ধীর পায়ে কিছু অস্বস্তি ও জড়তা ঘিরে ধরে সেই গল্প বলার পথ। তারপরেও, কোনো এক নির্জন ঘরে বসে, লেখার টেবিলে পাতার পর পাতা শব্দ রচনা করে আমরা সেই না-বলা গল্পটা বলে যেতে চাই। লিখতে চাই এমন কিছু, যা আমাদের রক্তের ভেতর বেঁচে থাকার প্রবণতা করে তোলে স্পষ্ট। যা নষ্ট করে আসা অজস্র সময়ের মাঝে সদ্য জন্ম নেওয়া গাছের মতো মাথা তুলে দাঁড়ায় রোদের আশায়। আর সেই গাছের কোমল দুটি পাতায় হাত বোলাতে বোলাতে আবারও আমরা ফিরে যাই গল্প বলার তীব্র আকাঙ্ক্ষার কাছে।

আমরা আবার দেখি, এক অন্ধকার ঘরে কালো টেবিলের ওপর রাখা উপন্যাসের ফাইল। সেখান থেকে উন্মুক্ত হয় একটি রহস্যময় দরজা। যা দিয়ে ফিরে যাওয়া যায় অতীতে ফেলে আসা এক অদ্ভুত প্রদর্শনীতে।

সেখানে আছে একটি সাদা কাক, যা থেকে পরে হয়ে ওঠে জলের ওপর টলমল করা নগরী, কিছু চরিত্র, একটি গল্প, রূপান্তর এবং অস্তিত্বের তীব্র সংকট।

 

এই উপন্যাসের গল্পটা কতটা সত্য, কতটা কাল্পনিক, তা নিয়ে কথা বলার হয়তো প্রয়োজন নেই। আমাদের নীল সবুজ পৃথিবী অমীমাংসিত রহস্যে ভরপুর। আর সে কারণেই হয়তো রহস্যই কখনও কখনও আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র প্রেরণা হয়ে ওঠে। তবে সবশেষে বলব, আজকের পৃথিবীতে, যেখানে যুদ্ধ, অস্থিরতা আর বিচ্ছিন্নতা আমাদের গিলে খাচ্ছে, যেখানে সোশ্যাল মিডিয়ার রিলস আর নোটিফিকেশন আমাদের মনোজগৎ দখল করে নিচ্ছে—সেই বাস্তবতা থেকে যদি এই উপন্যাসের পৃষ্ঠাগুলো অন্তত একজন পাঠককেও সাময়িকভাবে সরিয়ে নিতে পারে, তাহলেই নির্মল আনন্দ স্পর্শ করে যাবে আমাকে।

‘জলজ লকার’-এর আখ্যান ও রহস্যময় জগতে আগ্রহী পাঠকদের স্বাগতম। পড়তে পড়তে পাঠক যেন খুঁজে পান এমন এক অচেনা অথচ চেনা জগৎ যার জন্মের শুরু নেই, শেষ নেই, তবু সেখানে সাময়িক পথ চলাতেই আনন্দ। বইটি বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে কথাপ্রকাশের প্যাভিলিয়ন নম্বর ২৫-এ।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

বাংলা কমিউনিটি ব্লগের স্বর্ণযুগে মূলত লেখালেখির হাতেখড়ি, সাহিত্য চর্চা এবং বই প্রকাশ। ব্যবসায় শিক্ষা ও হিসাববিদ্যায় পড়ালেখা করলেও শিল্প-সাহিত্যের দোরগোড়ায় তাকে ফিরে আসতে হয়েছে নিয়ত। প্রকাশিত গ্রন্থ : ‘গল্পগুলো বাড়ি গেছে’, ‘কাচবন্দি সিম্ফনি’ এবং ‘সাদা পালকের নির্জনতা’। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাসে বসবাস।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।