নির্ঘুম রাত্রির জানালায় উঁকি দেয় চাঁদ। কেন যে চাঁদ ধরতে ইচ্ছে হয়! হলেও, অত উঁচুতে উঠব কী করে? তাকিয়ে দেখি, উঠোনের কুয়ার জলে টলোমলো করে বিম্বিত চাঁদ। চাঁদকে ধরতে গিয়েই কুয়োর মধ্যে পড়ে যাই আমি। এইটুকুই আমার স্মরণে আছে এখনো, আমি চাঁদ ধরতে চেয়েছিলাম। আমি কুয়োর মধ্যে পড়ে মরে গেছি। আমার লাশ তোলা হয়েছে, আমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে উঠোনে। আমার লাশ এই উঠোন থেকে কে নিয়ে যাবে? কোথায় নিয়ে যাবে? ভূতের গলির মহল্লাবাসী দাঁড়িয়ে দেখছে আমাকে। শুধু কি আমিই শুয়ে আছি? আমিই মরেছি একা? আমার বউ গেল কই? আমার বউও কি মরে গেছে? আমার বউয়ের লাশ কি আমার পাশেই শোয়ানো আছে? মরে গেছি বলেই কি আমি আমার বউয়ের লাশটা দেখতে পাচ্ছি না? আমার এখনো মনে আছে, আমি বউকে নিয়ে ভূতের গলির আজিজ ব্যাপারীর বাইত্তে ভাড়াটিয়া ছিলাম। আমার নাম সুবোধচন্দ্র দাস। আমার বউয়ের নাম স্বপ্নারানী দাস। আমরা এসেছি সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে। নাকি আমরা এসেছি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থেকে? আমার কিছুই মনে পড়ছে না ভালো করে। আমি আমার বউকে নিয়ে এসেছিলাম সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীপাড়ের সুহাসিনী গ্রাম থেকে। আমি চাকরি করতাম সিনেমা হলে। ‘কিন্তু অখন তো আমরা মইরাই গেছি।’ এরকম একটি স্বপ্নগ্রস্থ মুহূর্তে আমার ঘুম ভাঙে। আমি ঘুমাচ্ছিলাম মগবাজার কাঁটা ক্যাম্পে। সহকারীদের নিয়ে কাজ চলছে পুরোদমে। আমরা আর বেশিদিন অপেক্ষা করব না, শুটিংয়ে চলে যাব—এরকম তাড়না কাজ করছে কিন্তু কয়েকটি চরিত্র এখনো মেলেনি। যেমন, কুলসুম। কুলসুম চরিত্র কে রুপায়ণ করবে? কুলসুমকে কোথায় পাব আমরা? কুলসুম আদতে কে? কোথায় থাকে? তার ভূমিকা কী কাঁটায়? কুলসুম মরল ক্যামনে? মারল কারা?
কুলসুম এমন এক উচ্ছ্বল যুবতী, যার ভয় ডর কম। ভূতের গলির আলি আকবরের বাইত্তে থাকে সে, তার বা-বামা নেই। আলি আকবরের সংসারেই কুলসুম নিজের মেয়ের মতো জায়গা পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কুলসুমকে আমরা দেখতে পাব। ভূতের গলির সব্বাই যখন পাকিস্তানি মিলিটারি ও তাদের লোকাল মিলিশিয়া রাজাকারদের ভয়ে তটস্থ, তখন কুলসুম ড্যামকেয়ার। সে রাজাকারদের ভয় পায় না। রাজাকারদের বলদ হিসেবে চিহ্নিত করবার একটা ফন্দি আঁটে কুলসুম। বলদ বানায়ও। ‘কুলসুম জানত না, পুরুষ মানুষ লিয়া খেলন যায় কিন্তু রাজাকারগো লিয়া খেলন অত ছোজা না’। তাই এক সন্ধ্যায় কুলসুমকে মেরে ফেলে রাজাকাররা। কাঁটা গল্পের অন্যতম একটা শক্তিশালী চরিত্র কুলসুম। খাঁটি পুরান ঢাকার ভাষায় কথা বলে সে। বেশ কজন অভিনেত্রী কুলসুম চরিত্রে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করেছে কাঁটা ক্যাম্পে। তার মধ্যে টিভি ও সিনেমায় কাজ করছে এমন একজন তো আমাকে হুমকিই দিল ইমেইলে। ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে আমার জানশোনা আছে অনেক দিনের। আমাকে একটা ইমেইল করে সে, ‘স্বপ্না চরিত্র যদি নাও পাই, কুলসুম চরিত্রটি যেন আমি পাই। না দিলে জঙ্গি গোষ্টি জেএমবি ভাড়া করে তোমারে হত্যা করাব।’ রীতিমতো একটা থ্রেট।
এই ইমেইলের বিপরীতে আইনগতভাবে মামলাও করা যায়, কিন্তু আমি সেই অভিনেত্রীকে বললাম, ‘তোমার বয়েসি ফরিদাবাদের একজন মেয়েকে দিচ্ছি, তুমি তার কাছে ১৫ দিন খাঁটি পুরান ঢাকার ভাষা শেখো।’ কিন্তু কদিন শিখতে গিয়েই অভিনেত্রীর ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। আমিও একটা ক্রেইজি হুমকি থেকে রেহাই পেয়ে গেলাম। এবং খুঁজতে শুরু করি, পুরান ঢাকার কোনো মেয়েকে আমি পাব না কুলসুম চরিত্রের জন্য?’ এভাবেই একদিন পেলাম মৌমিতাকে। মৌমিতা পুরান ঢাকারই মেয়ে। কুলসুম চরিত্রের জন্য একদম খাপে খাপ হয়ে গেল। একদম নতুন হিসেবে কুলসুম চরিত্রে টানা প্রায় দুই মাস বা তার বেশি সময় রিহার্সেল করেছে মৌমিতা। খুব ভালো করেছে। কাঁটার দর্শক কুলসুমকে মনে রাখবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভূতের গলিতে প্রথম শহীদ যুবতী মেয়ে কুলসুম। সে আলি আকবরের বাড়ির কাজের মেয়ে ছিল। কাজের মেয়ে ছিল বলে কুলসুমের কথা ইতিহাস মনে রাখে না। কিন্তু কাঁটা ছবি দেখার পর কুলসুমকে দর্শক মনে রাখবে। মৌমিতা কাঁটা ছবিটি নিজের প্রথম কাজ হিসেবে খুব ভালোবেসে করেছে। তাই কাঁটা টিমও কুলসুম বা মৌমিতাকে পেয়ে আনন্দিত। দর্শকের সামনে কাঁটার মাধ্যমে কুলসুম প্রকাশিত হবে। মৌমিতা প্রকাশিত হবে, ভাবতেই ভাল্লাগে। এ কথা আমি অনুভব করি, ঢাকার টিভি, সিনেমা বা থিয়েটার পাড়া থেকে মৌমিতার চেয়ে ভালো কোনো পুরান ঢাকার ভাষা জানা পারফেক্ট মেয়ে পাওয়া মুশকিল ছিল। মৌমিতা একদমই কুলসুম হতে পেরেছে, সেটা আমার ব্যক্তিগতভাবেও ভালো লাগা। আমি জানি, কাঁটা দেখার পর দর্শকও কুলসুম চরিত্রটি ভালোবেসে গ্রহণ করবে।
গুণী অভিনেত্রী অপি করিমের সঙ্গে কাঁটা ক্যাম্পে এক সন্ধ্যা আড্ডা হয় টিমের। অপিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি অনেক বছর। যখন সরয়ারের, মানে, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর টিভি সিরিয়াল বা ছবিতে কাজ করছিলেন, সেই সময় থেকেই। অপিদের তখনকার তাজমহল রোডের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করতে গেছি সরয়ারের সঙ্গে। প্রথম আলোতে এক সাক্ষাৎকারে আমার কবিতা নিয়ে প্রশংসা করেছেন তিনি। যাই হোক, এরকম গুণী ও পরিচিত অভিনেত্রী বাংলাদেশেই কম আছে। কাঁটাতে তো সবাই নতুন ছেলেমেয়ে, তাদের সঙ্গেই অপির আড্ডা পাতিয়ে দিলাম কাঁটা ক্যাম্পে, এক সন্ধ্যায়। নতুন ছেলেমেয়েদের ক্যামেরার সামনে অভিনয় করার সময় স্বাভাবিক থাকা ও কাজটা করে যাওয়া নিয়ে তিনি তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন। গল্পগুজব হলো। কাঁটা ক্যাম্পে এসেছেন অনেক গুণীজন। সবাই প্রায় আমার বন্ধু। দীর্ঘদিনের বোঝাপড়া আছে। আমরা মগবাজার ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাব আবার পুরান ঢাকায়, সেউ প্রস্তুতি চলতে থাকে। কারণ, পুরান ঢাকাতেই তো শুটিং হবে। পুরান ঢাকার পুরান পুরান ষাট সত্তুরটা বাড়ি দেখা যাবে কাঁটাতে। কিছু গলি-উপগলি দেখা যাবে। একদিন ক্যাম্পে এলেন অভিনেতা, নির্দেশক তৌকীর আহমেদ। অভিজ্ঞতা শেয়ারের সুযোগ করে দিই ক্যাম্পের ছেলেমেয়ে বা অডিশনে পাওয়া আমাদের নতুন পাত্রপাত্রীদের।
তৌকীর আহমেদের নির্দেশনায় গিরিশ কার্নাডের ‘হয়বদন’ বেইলি রোডের মঞ্চে যখন দেখা যেত, আমি ‘হয়বদন’ এর সেটে অভিজিৎ চৌধুরীর সহকারী হিসেবে কাজ করতাম। একদিন কাঁটা ক্যাম্পে আসে গায়ক, শিল্পী ও নির্দেশক শিবু কুমার শীল। অবাক ব্যাপার, যখন কাঁটা ক্যাম্পে আসে অনিমেষ আইচ বা শিবু কুমার শীল, তখন ওরা আসে কাঁটা ক্যাম্পের পাত্রপাত্রীদের সঙ্গে জাস্ট অভিজ্ঞতা শেয়ার করতেই। অনিমেষ নির্মাতা, শিবুও নির্মাতা, দুজনেই আমার ঘনিষ্ঠ মানুষ। কিন্তু বিধির কি লিখন, পরে কাকতালীয়ভাবে কাঁটাতে অনিমেষ বা শিবু যুক্ত হয়ে গেছে অভিনয়ে। এটি মোটেও পূর্ব নির্ধারিত ছিল না। কাঁটার সহকারীরা ব্যাপারটা জানে, কে কে সুবোধ বা স্বপ্না চরিত্রে তালিকায় ছিল এবং ফাইনালি কিভাবে কে বা কারা ফিক্সড হয়ে গেল! কিন্তু তখনো আমরা আজিজ ব্যাপারী চরিত্রে কাস্টিং ফাইনাল করতে পারিনি। চিত্রনাট্য অনুযায়ী আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ মহল্লাবাসীর চরিত্র মেলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। দীপক সুমন, মনোজ প্রামাণিক, সাইফুল ইসলাম জার্নাল বা কাঁটা অডিশনের পাত্রপাত্রীদের ভেতর সুবোধ স্বপ্না হাতড়াচ্ছি তখন আমি। কাজী নওশাবা আহমেদ, শারমিন আঁখি, অজন্তা বড়ুয়া, পৃথা— পাইপলাইনে আরও অনেকেই স্বপ্না তখন। ফিক্সড করতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। একই সঙ্গে খুঁজছি আজিজ ব্যাপারীর বাড়ি বা আজিজ ব্যাপারীকেও। দিনরাত একাকার হয়ে যাচ্ছে তখন, কাঁটার প্রি-প্রোডাকশন চলছে তুমুল গতিতে। এরকম একটা পিরিওডিক্যাল ছবির প্রপস, কস্টিউম ফাইনাল করতে হচ্ছে, তাও প্রায় পাঁচশো চরিত্র যেখানে। ওহ! এখন ভাবলেও অবাক লাগে, তখন পারলাম কী করে? ওটা একটা যুদ্ধ, যুদ্ধে পারলাম কী করে বলে কোনো কথা নেই, পারতেই হবে বলে একটা প্রত্যয় থাকে। নির্বিকল্প নির্দেশ থাকে। ডিরেক্টর সেই নির্দেশ দাতা। পাত্রপাত্রী বা কাজের সহকারী ও টেকনিক্যাল টিম পালন করবে সেই নির্দেশ। তবেই একটি ছবি হয়ে উঠতে থাকবে।
অডিশনে অনেক পাত্রপাত্রী এসেছে কাঁটাতে অভিনয় করার আশায়। বেশিরভাগই পেয়েছি অডিশন থেকেই। এত চরিত্রের সিনেমা, তার সব্বাই নতুন, এরকম আমি আগে দেখিনি ঢাকায়। আমি যা দেখিনি, তাই আমি করতে চলেছি। তাছাড়া কতজনই তো অভিনয় করতে চায়। তবু একজন স্বপ্না চরিত্র পাওয়ার জন্য একদিন গেলাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে, নাটক, চারুকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের দু-একজন করে মাস্টার যারা আমার পরিচিত, তাদের সঙ্গে শেয়ার করি। ক্লাসে গিয়ে দেখি। একদিন গেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও চলচ্চিত্র বিভাগে। পাইনি। হয়তো আমি যাকে খুঁজছি, সে আছে আশপাশেই, কিন্তু কে সে? বেঁচে থাকলে যোগাযোগ করতাম উদয়শংকর বা বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে। তাই একদিন ফোন করি এদেশের প্রতিভাবান নাচের শিল্পী শিবলী মোহাম্মদকে। শিবলী ভাইয়ের বড়ো ভাই এদেশের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সাদি মোহাম্মদের সঙ্গে আমার আলাপ আছে বটে কিন্তু শিবলী মোহাম্মদের সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল না। শিবলী মোহাম্মদের নাচের স্কুলের শাখা আছে একাধিক। বেইলি রোড ও শেরেবাংলা নগর শাখায় দুই সন্ধ্যা বসে থাকি স্বপ্নাকে পাওয়ার জন্য। সত্যি, শিবলী মোহাম্মদের আন্তরিকতার কথা আমি কখনো ভুলব না। স্বপ্নাকে হয়তো পাইনি তাঁর নাচের স্কুলে, কিন্তু আমি যেন পাই, সেই জন্য তাঁর নাচের মেয়েদের ডাকলেন, তারা নাচল। একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান সাদি মোহাম্মদ ও শিবলী মোহাম্মদ। সত্যি, আমি কৃতজ্ঞ। টেলিভিশনে অভিনয় করছে এমন দু-দশ জন অভিনেত্রী ক্যারেক্টার পাওয়ার জন্য তখন তারা আমার ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলে যচ্ছিল কিন্তু আমি তো কাঁটাকে ইন্ডাস্ট্রির বাইরে থেকেই বানাতে চেয়েছি। বানাচ্ছি। নো ফর্মুলা। ফর্মুলা আমি জানি না। ফর্মুলার কাজ করে আসা লোকেদের রাখতে চাইনি। কাঁটা অর্গানিক কাজ হোক, এই চাওয়া খুব মনের মধ্যে আমার ছিলই। তাই টিভির অভিনেত্রীদের বলেছি, এই ছবিতে না। যেমন, শিবলী ভাইকে বললাম, ‘বিরজু মহারাজকে কাজে লাগাল ইন্ডিয়ান নির্মাতারা, বাংলাদেশের ছবি করিয়েরা কি আপনাকে দ্যাখে না?’
শিবলী মোহাম্মদ বলেন, ‘কই, ডাকে না তো!’
‘কোনোদিন আমি যদি নাচ-নির্ভর কোনো গল্প বানাই, আমার সঙ্গে থাকবেন?’
শিবলী ভাই বলেন, ‘থাকব।’
গানের লিরিক হয়তো এরকম যে, ‘আমার এ দেহ পাবি মন পাবি না।’ সেই নাচই বাংলা সিনেমার একটা চিরকালীন নাচ। আর অন্য দিকে নায়ক-নায়িকার নাচ তো থাকবেই, তারা নাচতে নাচতে একবার পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়াবে, একবার সাগরের বালু-তীর থেকে আগত ঢেউ পর্যন্ত ছুটে যাবে। দেখা যাবে, এর পরের দৃশই বিএফডিসির ঝরনা স্পটে দাঁড়িয়ে নাচছে নায়িকা। নায়ক তাল দিচ্ছে। নাচ চলছে এফডিসির শুটিং ফ্লোরে, সেই লেইট ফিফটিজ থেকেই।
আমি পুনরায় কৃতজ্ঞ হয়ে উঠি। খুব ছোটোবেলা থেকেই আমরা শিবলী-নীপার নাচের যুগল দেখে আসছি বিটিভিতে, পরে ঢাকার মঞ্চে। দুর্ভাগ্য, এদেশে নাচের বিকাশ হলো না। মোটাদাগে সামাজিক জড়তাই এর কারণ মনে হয়। একদা এদেশেই গুরু সদয় দত্তের ব্রতচারি নাচ শিখেছে ছেলেরা। আর আমরা বেশিরভাগ সময় একধরনের নাচই দেখলাম আমাদের বাংলা সিনেমায়, যেখানে ভিলেনের একটি আস্তানা থাকে। একদিন নায়িকাকে ভিলেনের লোকজন সেই আস্তনায় ধরে নিয়ে আসে। ভিলেন ততক্ষণে মদ টেনে চুর হয়ে আছে। ভিলেনের লোকেরা নায়িকাকে টেনে আনে মাতাল ভিলেনের সামনে। ভিলেন চাবুক হাতে গদির চেয়ারে বসা থাকবে। নায়িকা কানতে কানতে ভিলেনের কাছে হাত জোড় করে বলবে, ‘আমাকে ছেড়ে দাও। আমার মায়ের খুব অসুখ।’ ভিলেন তখন অট্টহাসি দেবে। হাতের চাবুক দিয়ে নায়িকাকে মারবে আর বলবে, ‘নাচো।’ নায়িকা তখন অনিচ্ছাসত্বেও নাচবে আর গান গাবে। গানের লিরিক হয়তো এরকম যে, ‘আমার এ দেহ পাবি মন পাবি না।’ সেই নাচই বাংলা সিনেমার একটা চিরকালীন নাচ। আর অন্য দিকে নায়ক-নায়িকার নাচ তো থাকবেই, তারা নাচতে নাচতে একবার পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়াবে, একবার সাগরের বালু-তীর থেকে আগত ঢেউ পর্যন্ত ছুটে যাবে। দেখা যাবে, এর পরের দৃশই বিএফডিসির ঝরনা স্পটে দাঁড়িয়ে নাচছে নায়িকা। নায়ক তাল দিচ্ছে। নাচ চলছে এফডিসির শুটিং ফ্লোরে, সেই লেইট ফিফটিজ থেকেই। সত্যি, শিবলী মোহাম্মদের নাচ নিয়ে কিছু একটা আমি করতে চাই, আগামীতে। এই স্বপ্ন রোপণ করে রাখি।
আমি নিজে চারুকলার মানুষ। তাই আমার কাজকর্মে চারুকলা চারুকলা রং-গন্ধ লেগে থাকবেই, এটা স্বাভাবিক। কাঁটাতে জড়িত হয়েছেন অনেক শিল্পী। একসঙ্গে একটি ছবিতে এত শিল্পীকে পাওয়া যে-কারোর জন্যই কঠিন। আমার জন্য সহজ। সাবলীল। ধ্রুব এষ কাঁটার পিরিওডিক্যাল প্রিন্ট মাধ্যমে কাজে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৯-৯০ সালের একাধিক জাতীয় দৈনিকে ছাপানো, ১৯৭১ বা ১৯৬৪ সালের যা কিছু প্রিন্ট প্রপস, সেগুলো করার দায়িত্ব ছিল ধ্রুব এষের ওপর। যেমন, ধ্রুব’দা এর আগে আমার সমস্ত প্রিন্ট রিলেটেড কাজ করেছেন, কাঁটাতেও যুক্ত থেকেছেন। স্ক্রিপ্টের একেকটি ভার্সন বের হতো, ধ্রুব’দার কাছে এক কপি চলে যেত। কাঁটাতে শিল্পকলা বিভাগে কাজ করেছে বীথিকা, শক্তি, তন্ময়, জুনিয়র ধ্রুব। কাঁটার জন্য কাজ করে দিয়েছেন শিল্পী শেখ আফজালসহ আরও কয়েকজন। কাঁটার তিন সময়ের তিন দম্পতির ঘরের দেয়ালে ব্যতিক্রমী ডিজাইনের একটি করে আয়না দেখা যাবে। সেই আয়না করে দিয়েছেন চারুকলার মৃৎশিল্প বিভাগের অধ্যাপক ড. আজহারুল ইসলাম চঞ্চল। কাঁটার আর্ট ডিরেক্টর শিল্পী মাহমুদুর রহমান দীপন। দীপন’দা রকস্টার আর্টিস্ট। জীবনে প্রথম ছবিতে কাজ করতে নামলেন আমার সঙ্গে। চারুকলার অভ্যন্তরে ছোটো পুকুরে যে তিনটা শিশু ভাস্কর্য, ত্রিভূ, ওটা দীপন’দার কাজ। যদিও তিনি মূলত পেইন্টার। জলরং, অ্যাক্রেলিকে দারুণ মুনশিয়ানা দেখিয়ে থাকেন। একসময় দেখতাম, চারুকলার সিরামিক বিল্ডিংয়ের বারন্দায় দীপন’দা আর অঞ্জন’দা—জাহিদুর রহিম অঞ্জন, তারা দিনরাত একাকার করে দিতেন। বছরের পর বছর। সিরামিক বারান্দা থেকে মাঝেমধ্যে তখন তাদের কেউ ভালোবেসে রিহ্যাবে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিলে তাদের বদলে কয়েকমাস সিরামিক বিল্ডিংয়ের বারন্দায় দুটি শালিক এসে বসে গল্প করত। আমি একদিন সেই শালিকদের কথাবার্তা শুনে ফেলছি। যদিও দুই শালিক, তবু তারা একা একা দুই শালিক। এক শালিক আরেক শালিকরে বলতেছে, ‘কী। আছে নাকি কিছু?’
অন্য শালিক বলে, ‘আছে।’
সেই দুই শালিক, যদিও তারা একা একা শালিক, তারা সিরামিক বিল্ডিংয়ের বারান্দায় বসে থাকে। এই শালিকরা কী করে! শালিকরা কি রাংতার পাতার নিচে ম্যাচের কাঠি জ্বালে? বিচি খায়? বড়ি খায়? কিছুদিন বাদে অঞ্জন’দা ও দীপন’দা রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার থেকে ফিরে এসে আবার দখল নেন সিরামিক বারন্দার। শালিক দুইটা দীর্ঘদিবস ও দীর্ঘরজনী সিরামিক বারন্দায় থেকে যান। কিন্তু শালিক নিয়ে তো কথা হচ্ছিল না। কথা হচ্ছিল আর্ট-কালচার নিয়ে। দীপন’দা কাঁটার আর্ট ডিরেক্টর। শিল্পী রফিকুন নবী, জামাল আহমেদ, শামসুজ্জাদোহা, রণজিৎ দাশ, শেখ আফজাল—এঁদের কন্ট্রিবিউশন আছে কাঁটাতে। সে সব অন্য পর্বে জানাব। বলছিলাম, আমার কাজকর্ম চারুকলা বাদ দিয়ে হবে না, হয় না। জীবন বকুলতলায় গেলে কিছু ফুল কুড়োনো ছাড়া কীই বা করতে পারি? কাঁটার অভিনয়ে, চারুকলারই সুবোধ দুজন, একজন অনিমেষ, একজন, শিবু; তন্ময় ও শক্তি—সুবোধের ভাই পরাণ। শুটিং চলাকালীন চারুকলার আরও শালিকেরা এসেছে ভূতের গলিতে। মনিরুজ্জামান শিপু, সাদিক আহমেদ, তপু, প্রশান্ত, মাসুদ হাসান উজ্জ্বল, মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান—কত জন যে! সবারই টুকরো টুকরো অংশগ্রহণ আছে কাঁটা ছবিতে। এত আর্টিস্টের সাপোর্ট আমার হতো না, যদি চারুকলায় জীবন নিবেদন না করতাম! জয়গুরু জয়নুল, জয়গুরু সুলতান, জয়গুরু কামরুল। চারুকলা থেকে নারিন্দায় কয়েকবস্তা শুকনো কাঁঠাল ও অন্যান্য গাছের পাতা গেছে শুটিংয়ে। সেটা পাঠিয়েছলেন চারুকলার দুজন স্টাফ, আমার বা কাঁটার প্রয়োজনে। একটা ছবিতে এতজন আর্টিস্টকে প্রয়োজন অনুযায়ী পাওয়া—বিরাট ব্যাপার। কাঁটা তা পেয়েছে, যা কাঁটা নির্মিত হতে কাজে লেগেছে।
পাঁচশো চরিত্র নিয়ে প্রি-প্রোডাকশন করা কী জিনিস, জানা ছিল না। এত চরিত্র নিয়ে তো সিনেমা নির্মাণ হতে দেখিনি ঢাকায়। আমার চিত্রনাট্যে এই চরিত্র ঢুকেছে, সম্পূর্ণ আমার ইচ্ছায়। ভূতের গলি মহল্লাবাসী বলতে কি বোঝায়? কতজনকে বোঝায়? ১৯৮৯-৯০ সালে একদল মহল্লাবাসী, ১৯৭১ সালে আরেকদল মহল্লবাসী এবং ১৯৬৪ সালে আরেকদল মহল্লাবাসী। পুরো ভূতের গলির মহল্লাবাসীই কাঁটার ক্যারেক্টার। কাঁটা মহল্লাবাসীর গল্প। ভূতের গলি মহল্লাবাসীর অসহায়ত্ব, আত্মগ্লানি ও বিভ্রান্তির চক্র কাঁটা। কাজেই, পাঁচশো চরিত্র সেখানে কম হলো না বেশি হলো? থিয়েটার তো সাজেস্টিভ, সিনেমা সাজেস্টিভ নয়, রিয়েলিস্টিক। জনাব শহীদুল জহির যে লেখেন, ‘মহল্লাবাসী বলে সেই রাতে আকাশে চাঁদ ওঠে গোলাকার’ কিংবা সেই রাতে আকাশে কোনো চাঁদ ছিল না, ছিল অন্ধকার। সেই অন্ধকারে মহল্লাবাসী ধরলাম ইঁদুর ধরতে যায়। এই মহল্লাবাসী বলতে কতজন মানুষ? তাদের স্ট্যাটাস কী? তারা কে কোন বয়সের? কোনো নির্ণয় নেই। চিত্রনাট্য করতে বসে আমার শুধু মনে হচ্ছিল, অনেক মানুষ লাগবে। কমপক্ষে পাঁচশো। তাদের পিরিওডিক্যাল পোশাক, প্রপস—সে এক বিরাট কারবার। মগবাজার কাঁটা ক্যাম্পে চলছিল শেষ মুহূর্তের গোছগাছ। নারিন্দায় আমাদের শুটিংয়ের সেন্ট্রাল লোকেশন পেয়ে গেছি। মাটির উঠোনওলা শতবর্ষী বাড়ি। দোতলা বাড়ি। উঠোনে একটি পাতকুয়ো আছে। এই বাড়িই আজিজ ব্যাপারীর বাড়ি কিন্তু আজিজ ব্যাপারী কে? না, তখনো ঠিক হয়নি। খুঁজে চলেছি। একদিন ক্যাম্পে এলেন শাহীর হুদা রুমি। তাঁকে দিয়ে কি আজিজ ব্যাপারী করানো যায়? না, হবে না। একে তো রুমি ভাই জলহস্তি টাইপের ফিগার বানিয়েছেন, আর পুরান ঢাকার ভাষা তো তিনি পারবেনই না। ‘আপনি এত মোটা কেন?’ বিদায়লগ্নে এ কথা বলার পর চিরতরুণ রুমি ভাই কণ্ঠে তুললেন গীতা দত্ত, ‘তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার, কানে কানে শুধু একবার বলো, তুমি যে আমার…। আমারি পরানে আসি, তুমি যে বাজাবে বাঁশি/ সেই তো আমারই সাধনা, চাই না তো কিছু আর…/ ওগো তুমি যে আমার…’ রিয়েলি রুমি ভাই এনগেইজড হয়ে আছেন গত শতাব্দীর ফিফটিজ-সিক্সটিজে। সেই দিক দিয়ে কাঁটার চরিত্র আব্দুল আজিজ ব্যাপারীর সঙ্গে তাঁর একটা চরম মিল রয়েছে। সে তো ব্যক্তি রুমি ভাই আর কাঁটার চরিত্র আজিজ ব্যাপারীর ব্যাপার। আমার দরকার, ওল্ড ঢাকা থেকে আসা চরিত্র। রুমি ভাই এসেছেন সাতক্ষীরা থেকে। তাই হলো না। ব্যাপারী চরিত্র পাওয়া একটু কঠিনই হয়ে গেছে আমাদের জন্য। কাঁটা টিমের জন্য। লিড প্রোটাগনিস্ট।
একদিন ক্যাম্পে এলেন শাহীর হুদা রুমি। তাঁকে দিয়ে কি আজিজ ব্যাপারী করানো যায়? না, হবে না। একে তো রুমি ভাই জলহস্তি টাইপের ফিগার বানিয়েছেন, আর পুরান ঢাকার ভাষা তো তিনি পারবেনই না। ‘আপনি এত মোটা কেন?’ বিদায়লগ্নে এ কথা বলার পর চিরতরুণ রুমি ভাই কণ্ঠে তুললেন গীতা দত্ত, ‘তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার, কানে কানে শুধু একবার বলো, তুমি যে আমার…।
আমার খুবই প্রিয় একজন মানুষ ছিলেন ঢাকা শহরে, গীতিকার ও নিউমোরোলজি বিশেষজ্ঞ কাওসার আহমেদ চৌধুরী। কাওসার ভাইয়ের সঙ্গে সর্বশেষ যোগাযোগ ছিল ফেসবুক মেসেঞ্জারে। কাঁটা নিয়েও তাঁর অনেক জিজ্ঞাসা ছিল। আমার কবিতা পছন্দ করতেন। একদা কোলকাতায় তাঁর ভালো যোগাযোগ ছিল। সিনেমার সঙ্গেও সম্পর্ক ছিল কাওসার ভাইয়ের। সম্ভবত পূর্ণেন্দু পত্রীর সঙ্গে কাজ করতে চেয়েছিলেন একদা। বলেছেন আমাকে। কত বিখ্যাত গান তাঁর লেখা—কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে…কে না শুনেছে? কাওসার ভাই বললেন, ‘দুই প্যাকেট সিগারেট নিয়ে বাসায় চলে আসো।’ আমি যেতে পারিনি। আজ সকালেও বাপ্পার সঙ্গে এই নিয়ে আফসোস করলাম অনলাইনে। বাপ্পা টেলিভিশনে চাকরি করলেও, ও শিল্পী। জাতশিল্পী। সৌরদীপ বাপ্পা। বাপ্পাকে বললাম, ‘কাওসার ভাইয়ের জন্য আমার মন খারাপ হয়ে যায়।’ বাপ্পা বলল, ‘কাওসার ভাই মারা যাননি। বেঁচে আছেন।’ একদিন কাওসার ভাই জানতে চাইলেন, ‘কাঁটাতে গান কী কী থাকছে?’
কাঁটার গান নিয়ে কথা বলব আরেকদিন। এখন, মগবাজারের ক্যাম্পে আমার যে সমস্ত বন্ধুরা এসেছে, তাদের কথা একটু বলে আসি। নাকি? এডিটর ইকবাল কবীর জুয়েল এসেছে এক সন্ধ্যায়। এক সন্ধ্যায় আসার কথা ছিল আতিকের। আতিক আসতে পারেনি। লাল মোরগের ডাকে, মানুষের বাগানে পেয়ারার সুবাস ছড়ানোর নেশা করছিল বোধ হয়। সেই কতকাল আগে আমাদের বন্ধুত্বের দিন শুরু হয়। তখনো আমাদের গোঁফ পাতলা, আমরা শাহবাগে দিন গুজরান করি। আতিকের সঙ্গে নড়াইলে সুলতান কাকুর জন্মদিনেও দেখা হয়েছে সেই ডাক বিভাগের চিঠিপত্র লেখা দিনে। আর সরয়ারকে এখন সবাই ফারুকী নামেই চেনে। বাংলাদেশের ছবিকে আন্তর্জাতিক একটা লেভেলে নিয়ে যেতে সরয়ার কাজ করে যাচ্ছে। সরয়ার ও আমি টই টই করে ঘুরতাম একসময়। কীরকম দিন ছিল আমাদের, সারা দিন হয়তো চারুকলা বা উদ্যানেই কাটিয়ে দিয়েছি। রিকশায় ঘুরে বেড়াতাম। কোথায় যেতাম, কোথায় যেতাম না, তা এখানে অত বলার কিছু নেই। বিস্তারিত আত্মজীবনী লেখার সুযোগ পেলে লিখব তখন। তখনো সবাই ব্যাচেলর। আর এখন তো ওদের বউ-বাচ্চার সংখ্যা একাধিক। বাচ্চা একাধিক, মান্যযোগ্য। বউ? একাধিক হতে পারে? অবশ্য বাল্যবেলা থেকে মনে মনে বউ ধরলে বউ কয়টা হয়, সেই প্রশ্ন তো রাখতেই পারি জাতির কাছে। এক সন্ধ্যায় সরয়ারের সঙ্গে কাঁটা টিমের নতুন ছেলেমেয়েদের আলাপ-আড্ডার ব্যবস্থা করি। কাঁটা ক্যাম্পে রতন পাল এসেছিলেন এক সন্ধ্যায়। রতন’দার সঙ্গে সিনেমা নিয়ে আগামীতে একটা কাজ করার ইচ্ছে আমার জেগে থাকল। আকরাম, আকরাম খান, এসেছিল নারিন্দা ক্যাম্পে। আড্ডা। স্রেফ আড্ডা দিয়েই একটা জীবন কাটানো যায় কি না, সেই ডিসকোর্স চলতে পারে। এটা ঠিক, মগবাজার ক্যাম্পে আড্ডা বসত খুব। আড্ডায় বসেই আমার কাজ ভাল্লাগে। জীবন তখন তুমুল ব্যস্ত, মগবাজার ক্যাম্প টু আমার বাসা, মগবাজার চেয়ারম্যান গলি। এর বাইরে দুনিয়া নেই। কবিতাও ভুলে গেছি তখন আমি। আদতে কোনো একটা কাজে মগ্নতা এতই আসে আমার, দুনিয়ার আর কিছু খেয়াল থাকে না। অর্থাৎ যখন যা করি, নিজেকে নিংড়ে দিয়ে করি। নিজেকে ঢেলে দিই পুরোটাই। মনে হয়, কাজই আমাকে সুস্থ রাখে। তুমুল ব্যস্ত কাজে তুমুল সুস্থ আমি। তবু দুই-দুইটা হার্ট অ্যাটাকের মধ্যে আমার নিজেকে শিকার হতে দেখেছি। সেটা এই কাঁটা করার মধ্যেই। আরেকটি পর্বে হার্টের খবর বলব।
এই পর্বে তো অনেক লিখে ফেলছি। আমার জানা নেই, কোন পর্বে কি কি লেখা হবে। লিখতে লিখতে যা মনে আসে, তাই লিখি। হয়তো লেখা ‘শ্রী’তে মেইল করার পর মনে পড়ে, আরে, আরও কত কিছুই না আসতে পারত এই পর্বে। আসেনি, লেখার মুহূর্তে মনে পড়েনি বলে। তখন ভাবি, আচ্ছা, আগামী পর্বে না হয় গত পর্বের মনে না পড়া কথাগুলো বলে দেব। কিন্তু সেই আগামী পর্ব লেখার সময়ও যদি মনে না পড়ে আগের না বলা কথা, আমার কিইবা করার আছে! এখন ঘুম আসছে আমার। ঘুমের মধ্যে কুরোসাওয়ার ক্যারেক্টার হয়ে আমি কি ঢুকে পড়ছি এরকম কোনো ক্যানভাসে, যার মধ্য দিয়ে গমখেতে কাক দেখতে পাচ্ছি না, দেখছি, ইয়োর চয়েস সেলুন। দেখছি, ডালপুরির দোকান। দেখছি বিভিন্ন গলি। দেখছি, ভূতের গলি। দেখছি ৩৬ ভূতের গলি। আবদুল আজিজ ব্যাপারীর দোতলা বাড়ি। যার এক পাশে ভাড়াটিয়া হয়ে বসবাস করছে এক দম্পতি। দম্পতির নাম, সুবোধচন্দ্র দাস ও স্বপ্নারানী দাস। নির্ঘুম রাত্রির জানালায় উঁকি দেয় চাঁদ। কেন যে চাঁদ ধরতে ইচ্ছে হয়! হলেও, অত উঁচুতে উঠব কী করে? তাকিয়ে দেখি, উঠোনের কুয়ার জলে টলোমলো করে বিম্বিত চাঁদ। সেই চাঁদকে ধরতে গিয়েই কুয়োর মধ্যে পড়ে যাই আমি। এইটুকুই আমার স্মরণে আছে এখনো, আমি চাঁদ ধরতে চেয়েছিলাম। আমি কুয়োর মধ্যে পড়ে মরে গেছি। আমার লাশ তোলা হয়েছে, আমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে উঠোনে। আমার লাশ এই উঠোন থেকে কে নিয়ে যাবে? কোথায় নিয়ে যাবে? ভূতের গলির মহল্লাবাসীরা দাঁড়িয়ে দেখছে আমাকে। শুধু কি আমিই শুয়ে আছি? আমিই মরেছি একা? আমার বউ গেল কই? আমার বউও কি মরে গেছে? আমার বউয়ের লাশ কি আমার পাশেই শোয়ানো আছে? মরে গেছি বলেই কি আমি আমার বউয়ের লাশটা দেখতে পাচ্ছি না? আমার এখনো মনে আছে, আমি বউকে নিয়ে ভূতের গলির আজিজ ব্যাপারীর বাইত্তে ভাড়াটিয়া ছিলাম। আমার নাম সুবোধচন্দ্র দাস। আমার বউয়ের নাম স্বপ্নারানী দাস। এ কী! একই স্বপ্ন কি আমি আবার দেখছি? বারবার দেখছি? কাঁটা কি কোনো স্বপ্নগ্রস্থ পুনরাবৃত্তির গল্প?
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৫ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৬ষ্ঠ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৭ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৮ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৯ম পর্ব
জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস: ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।