মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩

টোকন ঠাকুরের ধারাবাহিক : জার্নি অব কাঁটা : পর্ব ১৪

0

মগবাজার চেয়ারম্যান গলিতে আমার বাসা থেকে গেলেও বাজার রেলাইনের পাশে অবস্থিত আমাদের কাঁটা ক্যাম্পের অবসান হতে যাচ্ছে। মগবাজার ক্যাম্পে কাঁটার পাত্রপাত্রী অডিশন ও প্রি-প্রোডাকশন হয়েছে বলা চলে। একটি নির্মিতব্য ছবিকে কেন্দ্র করে অনেক স্মৃতি, অনেক ইতিহাস জমা হয়ে থাকল আমাদের ছোট্ট জীবনে, আমার জীবনে। মগবাজারে ক্যাম্পেই পাঁচশো চরিত্রের প্রায় ৯৫ ভাগ কাস্টিং হয়ে গেল। বাকি পাঁচ ভাগ হাতে থাকল নারিন্দার জন্য। নারিন্দাতে প্রোডাকশন হবে। আজিজ ব্যাপারীকে তখনো পাইনি, তাকে ছাড়াই আমরা মগবাজার কাঁটা ক্যাম্প থেকে নারিন্দায় চলে যাচ্ছি। কোথাও চলে যাওয়া মানেই তো কোথাও ছেড়ে আসা। যেন-বা জাহাজ নোঙর তুলে ছেড়ে যাচ্ছে মগবাজার পোতাশ্রয়। যেখানে প্রায় চার-পাঁচ মাস আমরা তাঁবু গেড়েছিলাম। তাঁবুর নাম কাঁটা ক্যাম্প। আমরা যাচ্ছি আরেক বন্দরে, বন্দরের নাম নারিন্দা। সেখানে তাঁবু গাড়ব, শুটিং করব। তখন, নারিন্দায় গিয়ে কি মনে পড়বে মগবাজার ক্যাম্পের কথা? অবশ্য শুটিং বাস্তবতায় প্রিভিয়াস কিছু মনে পড়ার সুযোগ নেই, আমার নেই, আমি তা জানি। শুটিং শেষ করার পর মধ্যবর্তী যে সময়টা অপ্রত্যাশিতভাবে চলে গেল কাঁটা প্রোজেক্টে, তা যাওয়ার কথা ছিল না। কয়েকটি কারণে গেছে। আজ আর সেই কারণ ব্যাখ্যা করার কিছু নেই, বরং এ বছরেই ছবিটি দর্শকের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, সেই আয়োজনেই ব্যস্ত আছি এখন।


p 14. 4

আবদুল আজিজ ব্যাপারী চরিত্রের অভিনেতা কায়েস চৌধুরীর তিনদশকের চুল কেটে ফেলা হচ্ছে


মধ্যবর্তী সময়টা আমাকে পীড়া দেয়। মানুষের অপেক্ষা আছে কাঁটা দেখার, তাও আমি জানি। মধ্যবর্তী অপ্রত্যাশিত সময় যে গেল, সময়ই আমাকে অন্তরীণ করে ফেলল। এখন ছবির কাজ প্রায় সম্পন্ন হওয়ার পথে আছে। কাজ এগোচ্ছে। তাই বাংলাদেশের ছবির দর্শক কিংবা লেখার পাঠক কিংবা যে কেউ—তার সঙ্গে আমি যোগাযোগ করছি জার্নি অব কাঁটা রচনা দিয়ে। কত না দুর্যোগে পড়েছি, হাতে হাতকড়াও পরেছি, থানায় হাজতের শিক ধরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছি, আমার জন্য কেউ আসছে কি না! নিউমার্কেট থানার সামনে সেই রাতে কী ঘটেছে, শাহবাগে কী ঘটেছে—কিছুই আমার জানা হয়নি। ফেসবুকে কী ঘটেছে, তাও জানলাম পরদিন কোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার পর। কারণ, লকআপে ঢুকলে মোবাইল ফোন, বাসার চাবিও জমা নিয়ে নেয়। এত কিছু ঝুটঝামেলায় পড়লেও একটি ভালো ছবি বানানোর প্রত্যয় থেকে আমি কিন্তু এক ইঞ্চিও সরে যাইনি। নিজের কাছে নিজের আমার এইটুকুই সান্ত্বনা। তাই জার্নি অব কাঁটা রচনা একটা যোগাযোগের সাঁকো। যারা সিনেমা দেখে থাকেন, ভালো সিনেমা দেখতে আগ্রহী থাকেন, সিনেমার ভালোমন্দ নিয়ে দুচার কথা বলাবলি করেন, তাদের সঙ্গে তো আমার দেখা হবে। অপেক্ষায় যেমন কাঁটা, অপেক্ষায় আমিও। আর একটু সময়ের সাঁকো পার হলেই কাঁটা দেখা হবে।

কাঁটার জাহাজ মগবাজার ছেড়ে নারিন্দায় পৌঁছুল ২০১৮-র এপ্রিলের শুরুতেই। প্রথমে প্রোডাকশনের কয়েকজন উঠে গেল নারিন্দা ক্যাম্পে। ক্যাম্প নিয়েছি আমরা মাসিক ভাড়া চার্জে। কিন্তু বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই, গ্যাস নেই। পানি আছে। মামলা খেয়ে গ্যাস-বিদ্যুৎ লাইন আগেই কাটা পড়ে আছে। এই বাড়িতে আমরা কয়েকমাস থাকব, শুটিং করব, কীভাবে? বাড়িতে রান্নাবান্না কীভাবে হবে? প্রশ্নের পরে প্রশ্ন ওঠে। স্বাভাবিক, বাসযোগ্য তো হতে হবে! তারপরই না থাকা, শুটিং করা! কাঁটার সিনেমাটোগ্রাফার রোমান সিটি কর্পোরেশন ও বিদ্যুৎ বিভাগের লোকদের ডেকে এনে কথাবার্তা বলে শেষ পর্যন্ত ডাইরেক্ট রাস্তার খাম্বা-লাইন থেকে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে ফেলল। বড়ো সিলিন্ডার গ্যাসও কেনা হলো। পানি তো ছিলই। টিমের একাংশ উঠে পড়েছে আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে। লাইন প্রোডিউসার শুভ উঠল তিনতলার একমাত্র রুম হাওয়া ঘরে। রোমান উঠেছে নিচতলার একটি রুমে, যে রুমকে পরে আমরা ডিভাইস রুম হিসেবে গণ্য করতাম। কয়েকজন উঠল নিচতলার বড়ো ঘরটিতে। যে ঘরকে পরে আমরা কাঁটা ক্যাম্প নারিন্দার অফিস রুম হিসেবে দিনের বেলায় ব্যবহার করেছি। কাঁটার ফিমেলদের জন্য দোতলার মাস্টার রুম বরাদ্দ। পরিত্যাক্ত-ভালো মিলিয়ে ২৫টা রুম ওই বাড়িতে। এটি সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের বাড়ি। তাঁর কন্যা নূরজাহান বেগম ‘বেগম’ পত্রিকা বের করতেন এই বাড়িতে থেকেই।


p 14. 8

সুবোধচন্দ্র দাস ১৯৭১— চরিত্রের অভিনেতা শ্রীমন্ত বসু


নূরজাহান বেগমের স্বামী শিশুসাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান। তবে নাসিরুউদিন চলে আসেন কোলকাতা থেকে দেশভাগের সামান্য আগে, তখন এই বাড়ির মূল মালিক বাস করতেন এখানে। তিনি চলে যান পশ্চিমবঙ্গে। কারণ, তিনি ছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বী। দেশভাগে তাঁকে চলে যেতে হয়। দেশভাগের মাধ্যমে এই বাড়ি কিনে নিয়ে এখানে চলে আসেন একজন মুসলমান। মুসলমানের নাম মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন, তিনি কোলকাতায় একদা সওগাত পত্রিকা করতেন, তাতে লিখতেন কাজী নজরুল ইসলাম। পরে যিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। নারিন্দার এই বাড়ির মালিক বদল থেকেই দেশভাগের ইতিহাস পাওয়া যায়। অবিভক্ত বাংলার হিন্দু-মুসলমানের গতিবিধি ধরা যায়। সপ্তাহখানেকের মধ্যে নারিন্দা ক্যাম্পে আমিও উঠে গেলাম। নাসিরুদ্দিনের বাড়িতে যেটা অথিথি কক্ষ, সেই রুমেই আমার থাকার ব্যবস্থা হলো এবং পরবর্তী নয় মাস আমি সেই রুমেই থেকেছি। মুক্তিযুদ্ধ করেছি যেন-বা, একটি ছবির জন্য, ছবির নাম কাঁটা। কাঁটা দ্য ফিল্ম। গল্প কাঁটার লেখক বাংলা ফিকশনের নয়া কারিগর শহীদুল জহির। ২০০৮ এ প্রয়াত তিনি। তবে তাঁর ইস্কাটনের ছয়তলা কোর্টারটারের বাসায় এক ঈদের রাতে বিনা নোটিশে আমি উপস্থিত হই। প্রচুর চা-সিগারেট খাই তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্তেই। পরে আর দেখা হয়নি, কোনো দিন দেখা হবেও না। আমি তাঁর গল্প কাঁটা নিয়ে ছবি বানাচ্ছি, এটা তিনি জানলেন না! আমি জনাব জহিরের প্রবল অনুরাগী ভক্ত পাঠক, সেই ১৯৯২ সাল থেকেই, যখন আমি খুলনা আর্ট কলেজের ছাত্র ছিলাম।

নারিন্দার এই বাড়ির মালিক বদল থেকেই দেশভাগের ইতিহাস পাওয়া যায়। অবিভক্ত বাংলার হিন্দু-মুসলমানের গতিবিধি ধরা যায়। সপ্তাহখানেকের মধ্যে নারিন্দা ক্যাম্পে আমিও উঠে গেলাম। নাসিরুদ্দিনের বাড়িতে যেটা অথিথি কক্ষ, সেই রুমেই আমার থাকার ব্যবস্থা হলো এবং পরবর্তী নয় মাস আমি সেই রুমেই থেকেছি। মুক্তিযুদ্ধ করেছি যেন-বা, একটি ছবির জন্য, ছবির নাম কাঁটা। কাঁটা দ্য ফিল্ম।

৩৬ ভূতের গলি, নারিন্দা, ঢাকা। এই ঠিকানায় পৌঁছে গেছি আমরা। প্রায় ১২-১৪ জনের একটি টিম, সেটাই প্রোডাকশনকালীন কাঁটার প্রথম ব্যাকগ্রাউন্ড টিম। পরে টিম থেকে কেউ হয়তো বিচ্যুত হয়ে বিযুক্ত হয়েছে, আবার কেউ যুক্ত হয়েছে, যুক্ত হয়ে কাজে আরও গতি বাড়িয়েছে। এটাই হয়। একটি তীর্থযাত্রায় সকলে একসঙ্গে রওয়ানা দিয়েও সবাই পৌঁছুতে পারে না। তবে প্রথম যে টিম নারিন্দায় পৌঁছায়, তারা গিয়েছিল মগবাজার ক্যাম্প থেকেই। লোকেশনে পৌঁছে প্রথমেই আমরা বাড়িটা সংস্কারে মনোযোগ দেই। বাড়িটাকে কাঁটা চিত্রনাট্যের উপযোগী করতে হবে তো! অন্যদিকে আজিজ ব্যাপারীকে চূড়ান্ত করতেই হবে—এরকম একটা সিদ্ধান্তে চলে আসি। পুরান ঢাকার এক নিঃসঙ্গ বাড়িওয়ালা আবদুল আজিজ ব্যাপারী। যাকে কাস্টিং ফাইনাল করি, তাঁর মাথায় মেয়েদের মতো চুল ছিল। ত্রিশ বছর ধরে বড়ো হওয়া সেই চুল। ব্যাপারীর ক্যারেক্টার বায়োগ্রাফি পড়লেন তিনি, কাঁটার সিনোপসিস পড়লেন। বললেন, ‘আমি কনভিন্সড। একটু বেশিই।’

বলি, ‘ব্যাপারীর তো চুল থাকবে না।’

তিনি বললেন, ‘থাকবে না।’

আমি বললাম, ‘রাজি?’

কায়েস চৌধুরী বললেন, ‘রাজি।’

আমি সহকারীদের ডাক দিলাম। বললাম, ‘নাপিত কই?’

‘ওই যে, আইতেছে।’

অর্থাৎ নাপিত রেডিই ছিল। চুল কাটানোর কথা বলার দুই মিনিটের মধ্যেই কায়েস চৌধুরীর চুল কাটা শুরু হয়ে গেল। কারণ, আমি অভিনেতা-নির্মাতা কায়েস চৌধুরীকে সেভাবে চিনি না, আমি চিনতে চাই আবদুল আজিজ ব্যাপারীকে, যার বাড়ি এই ভূতের গলিতে। অর্থাৎ আমরা আবদুল আজিজ ব্যাপারীকে পেয়ে গেছি। কাঁটার শুটিং ডেট ঘোষণা করার আগে মনে হলো, বাড়িটাকে ওলটপালট করে ফেলতে হবে। ভাবনা শেয়ার করি টিমের সঙ্গে, আর্ট ডিরেক্টরের সঙ্গে। ভাবনাটা হচ্ছে, ৩৬ ভূতের গলির বাড়িটা হবে এমন, যাতে করে নাসিরুদ্দিনের বাড়ির পেছন দিককে করা যায় সামনের দিক, সামনের দিককে পেছনের দিক। একটা বড়ো পাঁচিল বানাতে হবে, পাঁচিলের বয়স হতে হবে শতবর্ষী। বাড়িতে শানবাঁধানো উঠোন ছাড়া বাকি যে অংশটুকুতে এখনো মাটি আছে, সেই অংশে একটা বাগান বানাতে হবে। পাতাবাহার গাছ, নানান গাছ ও ঘাস কেনা শুরু হলো আমাদের। সেই গাছাগাছালির ছত্রছায়ায় একখানা তুলসীগাছ থাকবে, তুলসীগাছ বাতাসে দোল খাবে। আর পাঁচিলের গা ঘেঁষে বাড়ির সামনে দিয়ে থাকবে একটি রাস্তা, রাস্তার অপজিটেও একটা দুইশো বছরের বাড়ির স্ট্রাকচার বানাতে হবে। ব্যস! নির্মাণ শুরু হয়ে গেল। কদিন পর দেখি, বাড়ির কোনাকুনি একটা গলি অবলুপ্ত হয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই অবলুপ্ত গলির দুইপাশের বাড়িওয়ালা চায় না, গলিটি দৃশ্যমান হোক বা এটি কেউ ব্যবহার করুক। অথচ গলিটি সরকারি। দুই পাশের বাড়িও পড়েছে দুই পঞ্চায়েতে। সিটি কর্পোরেশনের লোকেরা এলো, গেণ্ডারিয়া থানার পুলিশ এলো। দখলীকৃত গলির দুই পাশের বাড়িওয়ালার সঙ্গে আমাদের, পুলিশের, সিটি কর্পোরেশনের লোকেদের একবেলা ফাটাফটি ঝগড়া হলো। শেষে এই কথা শুনে আমরা গলিটা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হই যে, শুটিংয়ের পরে আমরা আবার গলিটা ময়লা মাটি ফেলে যেন ভরাট করে যাই। ওকে। তাই সই। আগে তো গলিটা উদ্ধার হোক! পঞ্চাশ বছর পর গলিটা আবার উন্মোচিত হচ্ছে। কিছু লেবার, কাঁটা টিমের লোকেদের দ্বারা টানা কয়েক দিনের মাটি-কাঁদা-ময়লা উঠিয়ে গলি উদ্ধারের পর মনে হলো, এই গলিটা না হলে কাঁটা চিত্রায়ণ করা অসম্ভব ছিল আমাদের জন্য। খুব ভালো হলো, খুব ভালো হলো কাঁটা নির্মাণের জন্য। কিন্তু দুই মাস সময় লাগল, অর্থও গেল।


p 14, 1

তিনতলার ছাদে কবুতরের ঘর সেট করছে সিনোমাটোগ্রাফার রোমান


এর মধ্যে আমরা কবুতরের ঘর বানিয়েছি। ষাটটা কবুতর সেখানে রাখা হয়েছে। যদিও প্রথম দিকে আমাদের কিছু রাজসিক কবুতর মারা পড়েছে বেজি কিংবা আমরা ধরতে পারিনি এমন কোনো কারণে। কবুতরগুলো বাড়ির উঠোন থেকে উড়ে আসবে ছাদে, ছাদ থেকে উড়বে স্বপ্নারানী দাসের ঘরের চৌকাঠে, এমন তো স্ক্রিপ্টে আমিই লিখেছি। তাই এমনটাই করতে হবে। করা হলোও। কবুতরের ঘর ফাইনালি তৈরি করেছে রোমান, কাঁটার সিনেমাটোগ্রাফার। মূলত কাঁটা ছবির প্রধান পাত্রী একটি মহিলা বিড়াল, তাঁর গর্ভে বাচ্চা থাকবে, পেট উঁচু দেখা যেতে হবে। এককথায়, কাঁটার প্রধান চরিত্র একটি পোয়াতি বিড়াল। পোয়াতি বিড়ালটাই কাঁটার অনলি ওয়ান স্টারকাস্ট। আর পাসিং দিয়ে যাবে একজোড়া ঘুঘু, একটি সবুজ টিয়া এবং একটি কালো ময়না। বাড়ির উঠোনে আছে পাতকুয়া। সেখান থেকে বালতিতে জল তোলে সুবোধচন্দ্র দাসের পোয়াতি বউ স্বপ্না রানী দাস।

ঘুঘু, টিয়া, ময়না, কবুতর নিয়েও লিখতে হবে, কেন না, ওরাও কাঁটার পাত্রপাত্রী। এর মধ্যে পোয়াতি বিড়ালই হচ্ছে তারকাশিল্পী, আগেই বলেছি। এমন কি কাঁটাতে বাড়িওয়ালা আবদুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে স্ক্রিনে সবচেয়ে বেশি সময় থাকে মনে হয় বিড়ালটিই। কাঁসার বাটিতে তাঁকে দুধ খেতে দেয় স্বপ্না।

একটি পরোনো গলিই পঞ্চাশ বছর পরে প্রকাশ্য করা হলো। কত কাহিনি ঘটল, সবই কাঁটার জন্য। এভাবেই বসু বাজার পঞ্চায়েত প্রধান শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের একটা বোঝাপড়ার সম্পর্ক হয়, তখন তাঁকে দিয়ে আমরা করিয়েছি কাঁটার একটা বড়ো চরিত্র। গেণ্ডারিয়া থানা পুলিশের সঙ্গেও একটা সম্পর্ক হলো। পরে ১২টা চাইনিজ রাইফেল ও ৩টা থ্রি নট থ্রি যে কাঁটাতে ইউজ করা হলো একাধিক দিন, সেই সূত্র ধরেই। আর পোয়াতি বিড়াল নিয়ে কত যে মজার গল্প জমেছে আমাদের টিমের মধ্যে, তাও কিছু লেখা প্রয়োজন। ঘুঘু, টিয়া, ময়না, কবুতর নিয়েও লিখতে হবে, কেন না, ওরাও কাঁটার পাত্রপাত্রী। এর মধ্যে পোয়াতি বিড়ালই হচ্ছে তারকাশিল্পী, আগেই বলেছি। এমন কি কাঁটাতে বাড়িওয়ালা আবদুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে স্ক্রিনে সবচেয়ে বেশি সময় থাকে মনে হয় বিড়ালটিই। কাঁসার বাটিতে তাঁকে দুধ খেতে দেয় স্বপ্না। বিড়াল নিয়েই গল্প তৈরি হয় কাঁটার মধ্যে। বিড়ালটার অনেকগুলো বাচ্চা ছিল। আমাদের সেই সব বাচ্চা আটকে রেখে শট নিতে হতো। আর এই মা বিড়াল, যিনি আমাদের চরিত্র, তিনি দুধ খেতেন না। আমরা ভাবলাম কনডেন্সড মিল্ক বলেই হয়তো খাচ্ছে না। অরজিনাল গরুর দুধ জ্বালিয়ে দিলেও উনি খেলেন না। কেন খেতেন না বা খেলেন না, তা উনিই জানেন। উনি বলতে আমি শ্রীমতী বিড়ালের কথা বলছি আর কি! যেকোনো ধরনের মাছেও বিড়ালিনীর রুচি নেই। তাহলে তাঁকে কাঁটা সেটে কী দিয়ে ধরে রাখব? কয়েকমাস তো তাঁকে আমাদের লাগবেই। কাঁটার লাইন প্রোডিউসার শুভ কয়েকদিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের পর বলল, ‘এই বিড়াল শুধু ইলিশ ও রুই মাছ কাঁচা না, ভাজি করে দিলেই খাচ্ছে। তাই একটা বুদ্ধি করছি।’


p 14, 6

মহল্লাবাসীরা চা-নিমকপারা খাচ্ছে সুবোধ স্বপ্নার সংসারে। বাটিতে দুধ খাচ্ছে মহিলা বিড়াল ডায়না


‘কী বুদ্ধি?’

‘বিড়ালকে তো দরকার ও বাটিতে মুখ লাগিয়ে চুমুক দিয়ে দুধ খাচ্ছে, তাই তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাইলে ইলিশ পিসকে হতে হবে দুই ইঞ্চি উচ্চতা-প্রস্থ, আর দুধ হবে মাছের চেয়ে সামন্য একটু বেশি। দেখা যাক, কী হয়!’

দেখা গেল, দুধের বাটি রাখা আছে, অন্যান্য ক্যারেক্টার ইন করছে শটে, শুভ বিড়ালকে দেখিয়ে ভাজা ইলিশের পিস ফেলে দিল দুধের বাটিতে। বিড়ালিনী দৌড়ে এলেন। কী করবেন তিনি? ভাজা ইলিশের পিস তো দুধের বাটিতে ফেলান হয়েছে কৌশলগত কারণে; দুধের পরিমাণও এমন, মাছের পিস দেখা যায় না। কিন্তু পোয়াতি বিড়ালকে তো দেখানো হয়েছে যে, ভাজি ইলিশ বাটিতে ফেলা হয়েছে। মাছ ভাজির ঘ্রাণ ছড়িয় আছে বাতাসে। উপায় না থাকায় বিড়াল তখন দুধের বাটিতে জিব্বা লাগায়, দুধ চেটে খায়। দুধ চাটতে চাটতে বাটি থেকে দুধ কমে গেলে যেই ইলিশের পিস উকি দেয়, বিড়াল তখন তার আসল উদ্দেশ্য যে মাছের পিস খাওয়া, সেই মাছের পিস মুখে কামড়ে ধরে দিয়ে ফ্রেম আউট হয় কখনো, কখনো ফ্রেমে থেকেও যায়। তো বিড়াল যতক্ষণ দুধ চাটে বাটি থেকে, ততক্ষণে আমাদের সুবোধ বা স্বপ্না বা আজিজ ব্যাপারী বা মহল্লাবাসির কথাবার্তার কাজ শেষ হয়ে যায়। এভাবেই, বিড়াল এক সময় বুঝে ফেলে যে, তাঁকে ছাড়া আমাদের টিম অচল। তখন তাঁর স্টারডমের চাপ নিতে হয় আমাদের। মাঝে একবার বা দুইবার বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে কয়েক দিনের জন্য বিড়ালিনী কোনো বিল্ডিংয়ের নিরিবিলি কোনাকে ম্যাটার্নিটি বানিয়ে চারপাঁচটা করে বাচ্চা দিয়ে ফেলে। তখন কদিন শুটিং বন্ধ থাকে। এরকম একবার হওয়ায়, অন্য একটা বিড়াল এনে কাজ করতে গিয়ে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এমন হয়েছে যে, চিত্রনাট্য অনুযায়ী বিড়াল লাগবে সিকোয়েন্সে, কিন্তু বিড়ালকে খুঁজে পাচ্ছে না প্রোডাকশনের লোকেরা, তখন শুটিং বন্ধ থেকেছে শুধু বিড়ালের শিডিউল পাচ্ছি না বলে। তবে কদিন বাদেই ফিরে এসেছে আমাদের স্টার বিড়াল। মহিলা বিড়াল। পোয়াতি বিড়াল। কাঁটার বিড়াল। বিড়ালের নাম, প্রিন্সেস ডায়না। বিড়ালকে ধরে নিয়ে নদীর ওপারে ফেলে দিয়ে আসে অ্যালান পো। বাবু গজেন্দ্র গমন করেছে অ্যালান পো চরিত্রটি। গজেন’দা মরে গেছে গতবছর। গজেন’দা আমার ফরাসগঞ্জ পর্বে রান্নাবান্না ও স্ক্রিপ্টে সহকারী হিসেবে কাজ করত। তার কথা লিখেছি অন্য পর্বে। বিড়াল ও কবুতর—পরস্পর প্রায় সাংঘর্ষিক অবস্থানে বাস করছে তাঁরা, কাঁটাতে। বিড়াল কম ভোগায়নি আবদুল আজিজ ব্যাপারীকে। ব্যাপারী বিড়ালকে শাস্তি দিতে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সেসব দেখা যাবে কাঁটা ছবিতে।


p 14. 7

শুটিং লোকেশনে শিল্পী মনিরুজ্জামান শিপু, সাদিক আহমেদসহ চারুকলার একদল আর্টিস্ট


রুম্মান শাহরু পাশের বাড়ির মেয়ে। স্বপ্নারানী দাসের সঙ্গে তার খাতির আছে। শাহরু বাখরখানি নিয়ে আসে স্বপ্নার জন্য, স্বপ্না শাহরুকে নিমকপারা খেতে দেয়। শাহরু বলে, ‘বৌদি, আপনে তো আমারে আইতেই কন না, আপনার নিমকপারাই আমারে লইয়া আহে।’ রুম্মান কাঁটাতে উপস্থিত আছে সপ্রতিভভাবে। পুরান ঢাকারই মেয়ে শাহরু, স্বতস্ফূর্ত তাঁর অভিনয় । এমনিতে রুম্মান থিয়েটার কর্মী। কাঁটা শুটিংয়ের অনেক আগেই ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। কাঁটাকে ভালোবাসা দিয়ে গ্রহণ করেছে শাহরু। কাঁটার একজন সহকারী শ্রীমন্ত বসু। কাঁটা টিমে ও কৃতি রঞ্জন নামেই অধিক পরিচিত। কৃতি কাঁটাতে একটা মর্মান্তিক ক্যারেক্টার করেছে। বলা যায়, সুবোধ-চতুষ্টয়ের মধ্যে কৃতিকে দিয়েই সবচেয়ে কঠিন সুবোধটি করিয়েছি। সেই গল্প বিরাট গল্প।

কৃতির ওজন ৭৫ কেজি। বললাম, ‘যুদ্ধের সময় সুবোধ তো বউ নিয়ে টেনশনে পড়ে যাবে, স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়াও কমে যাবে। এই সুবোধকে ৭৫ কেজি মাংসওলা হৃষ্টপুষ্ট দেখানো যায় কি না! যায় না কোনোভাবেই। এক মাস সময় দিলাম, ১০ কেজি মাংস ফেলে দাও গতর থেকে।’


p 14. 2

কাঁটার প্রিন্ট মেটেরিয়াল প্রস্তুত হচ্ছে; উপবিষ্ট প্রয়াত বুলবুল চৌধুরী, ধ্রুব এষ, মাহমুদুর রহমান দীপন ও টোকন ঠাকুর


কাজটা এত সহজ ছিল না। কৃতি সেই পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করল লেটার মার্কস নিয়ে। সময় এক মাসের কদিন বেশি লাগল হয়তো কিন্তু কৃতি আর আগের কৃতি থাকল না। আমাদের বানানো পাঁচিলের পাশের রাস্তায় ইট ফেলে দুড়মুস দেওয়া হলো কৃতির হাতে। অন্যরাও করেছে রাস্তার কাজটা তবে প্রধানত কৃতিই শ্রম দিল বেশি, মাসখানেকের বেশি। রাস্তাও দুড়মুসের চাপে সম্পন্ন হয়ে যেতে লাগল আর কৃতিরও সেই হৃষ্টপুষ্ট ভাবটা কমে যেতে শুরু করল। স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় একবার কাঁটা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে মিডফোর্ড হাসপাতালে ভর্তিও হলো কৃতি। দুই দিন পর ক্যাম্পে ফিরে এলো। আরেকবার পালিয়ে গেল নারিন্দা ক্যাম্প ছেড়ে। তারপর ফোন বন্ধ। কীভাবে পাই তখন ওকে? বিরাট টেনশন। ওর বোন চামেলী বসুর কবিতার বই ছিল ক্যাম্পে, সেই বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে ওকে দুদিনের মধ্যেই ধরে আনা হয়েছে ক্যাম্পে। কৃতির বাবা-মা, ভাই বোনেরাও জানেন ওর কাঁটা জার্নির কথা। তাই একটা পারিবারিক সাপোর্ট ছিল। কৃতি রঞ্জন ও ওর প্রয়াত বাবাকে নিয়ে একটা পর্বে বিস্তারিত লিখব, সত্যি এ এক অমানবিক-মানবিক বাস্তবতার মুখোমুখি পড়ে যাওয়া আমাদের, আমার। আমি কাঁটার চিত্রনাট্য করেছি। ডিরেকশন দিচ্ছি। এবং আমিই প্রোডিউসার, ব্যয়বহুল ছবি কাঁটার।


p 14. 5

রুম্মান শাহরু ভূতের গলিতে পাশের বাড়ির মেয়ে, স্বপ্নারানীর সঙ্গে তার খুব ভাব


কাঁটায় খুব সামান্য সময় স্ক্রিনে থাকবে অভিনেতা আনন্দ খালেদ। খালেদকে বাংলাদেশের দর্শক প্রায় সব্বাই চেনে। আমিও চিনি। আমি চিনি এভাবে যে, সন্ধ্যার পর খালেদ শাহবাগে আসত, প্রায় নিয়মিতই। টেলিভিশন-সিনেমায় কাজ করছে দীর্ঘদিন। তো খালেদ এমন একজন পাঠক, কবিতার পাঠক, কবিতার পাঠক তো আর সচরাচর এমএ-বিএ পাস করলেই হয় না, কিংবা উপন্যাস-গল্প পড়া লোকেরাও যে সবাই কবিতার রস পান করতে পারবে, এমনটাও নিশ্চিত না। সিলেক্টিভ পাঠক তৈরি হয় কবিতার, সবসময়; এতেই হয়তো কবিতার মঙ্গল। কবিতার উঁচু দরের পাঠক নিজেও মহাজন হয়ে থাকে। কবিতা যে উঁচু শ্রেণির টেক্সট, এইটাও সব ‘শিক্ষিত’ লোক জানে না। তবে কিছু পাঠক জেনে যায়, কবিতা কী জিনিস! আনন্দ খালেদ সেই জেনে যাওয়া পাঠকের একজন। আমার কবিতা নিয়ে কত কত আলোচনা তুলেছে খালেদ, তার ইয়ত্তা নেই। আমাদের আলোচনা চলেছে সন্ধ্যার পর, শাহবাগ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। প্রায় দুই দশকের মেলামেশা আমাদের। খালেদ অভিনয়ে পপুলার হলেও ওর গান নিয়ে একটা আত্মমগ্নতা আছে, অনেকেই হয়তো জানে, আমিও জানি। শহীদুল জহিরকে নিয়েও কথা হয়েছে খালেদের সঙ্গে অনেক, কাঁটার বাইরেও আলোচনা চলে আমাদের। আমি খালেদকে পছন্দ করি ওর রুচি, ম্যাচিউরিটির জন্য। ও আমার একজন প্রিয়জন। কাঁটাতে দর্শক ওকে পাবে। বিভিন্ন প্রোডাকশনে নিজের নিয়মিত কাজের শিডিউলের বাইরে কাঁটার জন্য, আমার জন্য খালেদের এই ভালোবাসা আমার মনে থাকবে। ওর জন্যও সবসময় আমার ভালোবাসা আছেই।


প ১২। 16

ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনের পাতকুয়ার পাড়ে শীতভোরে স্বপ্নারানী দাসের স্নান


একবার, কলেজে ভর্তি হতে আমি ঢাকায় এসেছিলাম, জিঞ্জিরায় ছিলাম মাসখানেক। সে বছর দেশে মহাবন্যা হয়। ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক পানির নিচে ভেসে যায়। আমি ফিরে যাই ঝিনাইদহ, ভর্তি হই স্থানীয় কেশবচন্দ্র কলেজে। তারপর চলে যাই খুলনায়, খুলনা আর্ট কলেজের ছাত্র হই। তিন বছর ছিলাম খুলনা শহরে। পই পই করে ঘুরতাম সারা শহর। পই পই মানে কী? জানি না। যা জানা নেই, তা লেখার কী আছে? কিছু নেই। তাইলে লিখলাম যে! এখন লিখে ফেলছি, কী করা যায়?

ঢাকায় চলে আসি খুলনা থেকে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস বা হলে থাকলাম কয়েকবছর। ওখান থেকে বেরিয়ে প্রথমে বাসা নেই ফার্মগেইট, সুরমা হোটেলের পেছনে। ওখান থেকে কাজীপাড়া দক্ষিণ মনিপুর। তারপর কাঁঠালবাগান। তারপর আজিমপুর। পুনরায় কাঁঠালবাগান। গেলাম মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটি। আবার কাঁঠালবাগান। তারপর কিছু মাস রায়েরবাজার মুক্তি সিনেমা হলের সামনে এক বাসায়। তারপর ডলফিন গলি-কলাবাগান। কিছুদিন শুক্রাবাদ। এরপর আসি নিউ এলিফ্যান্ট রোড। আতিক সুকু যে বাসাটায় থাকত, সেই বাসায় উঠি, ওরা চলে যায় উত্তরায়। কোনো বাসাতে ছয়মাস, এক বছর বা দুইবছর ছিলাম আমি। এলিফ্যান্ট রোডে এক বাসাতেই বারো বছর থাকি আমি। তারপর কাঁটাবিদ্ধ হই। যাই শঙ্কর-জাফরাবাদ। ফরাসগঞ্জ। মগবাজার। এখন চলে এসেছি নারিন্দা, শুটিংজোনেই এখন থাকা আমার, আমার টিমের।


p 14. 9

অভিনেতা আনন্দ খালেদ যেমন সংগীতানুরাগী, তেমনি বাংলা কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক


নারিন্দার পৃথিবী আর আসবে না—এমন ছিল সেই সময়, শুধু এইটুকু বলতে পারি। বিশাল একটি বাড়ি, বাড়ির মালিক আবদুল আজিজ ব্যাপারী। আমরা তাঁর বাড়িতেই নয় মাস থাকি, শুটিং-যুদ্ধ করি। দোতলা একটি পুরোনো বাড়ি। বাড়িতে একটি উঠোন। উঠোনের উপরে আকাশ, আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে একঝাঁক কবুতর ওড়ে, কবুতরগুলো প্রোডাকশনের টাকা দিয়েই কেনা। বিড়াল আছেন বাড়িতে, আগেই বলেছি বিড়ালের নাম ডায়না। হতে পারে সে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য কিন্তু কীভাবে যেন ভূতের গলিতে এসে পড়েছে, আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে! বাড়ির ভাড়াটিয়া সুবোধচন্দ্র দাসের বউ এই বিড়ালকে কাঁসার বাটি ভরে দুধ খেতে দেয়। এইসবের সঙ্গেই তখন আমার বসবাস। বাড়ির সেটে কিছু পুনর্নিমাণ করার ছিল, সেই কাজ চলতে থাকে। দীপন’দার সঙ্গে একটি টিম কাজ করে যাচ্ছে। কিছু লেবার রাখা আছে। একজন কাঠমিস্ত্রী, রাজমিস্ত্রি, একজন মহিলা বাবুর্চি ও একজন পুরুষ বাবুর্চি তখন মাসিক বেতনে রাখা। আজিজ ব্যাপারীকে নিয়ে রিহার্সেল করে নিই একটু, তিনি পরে যুক্ত হয়েছেন কাঁটায়। রিহার্সেল চলে অন্যান্য চরিত্রেরও। এদিকে সেট নির্মাণ শেষ হতেই এলো ঝড়বাদলের দিন। ঝড়বাদলে কিসের শুটিং? আগে বানানো সেটটা রক্ষা করা বেশি জরুরি। বৃষ্টি এলেই টিমের লোকেরা দল বেঁধে দৌড়ে গিয়ে বানানো সেটা রক্ষা করতে সামিয়ানার মতো করে পলিথিন দিয়ে ঢেকে ফেলত। সত্যি, নারিন্দা আমার এবং আমাদের জীবনে গভীর এক প্রভাব রেখে গেছে। নারিন্দার ভূতের গলিতেই শহীদুল জহিরের জন্ম। কাঁটা ভূতের গলিরই গল্প।

ভাড়াটিয়া সুবোধচন্দ্র দাসের বউ এই বিড়ালকে কাঁসার বাটি ভরে দুধ খেতে দেয়। এইসবের সঙ্গেই তখন আমার বসবাস। বাড়ির সেটে কিছু পুনর্নিমাণ করার ছিল, সেই কাজ চলতে থাকে। দীপন’দার সঙ্গে একটি টিম কাজ করে যাচ্ছে। কিছু লেবার রাখা আছে। একজন কাঠমিস্ত্রী, রাজমিস্ত্রি, একজন মহিলা বাবুর্চি ও একজন পুরুষ বাবুর্চি তখন মাসিক বেতনে রাখা।

শহরের যেকোনো রাস্তা চলে গেছে ভূতের গলির দিকে, টের পাই। ভূতের গলিতেই থাকলাম আমরা, কাঁটার জন্য। সত্যি, নির্মাণকালীন আমি বুঝতেও চাইনি যে, কাঁটার বাইরে দুনিয়ায় কিছু আছে, সুবোধ-স্বপ্না-আজিজ ব্যাপারী, মহল্লাবাসি ও কাঁটার বিহাইন্ড দ্য ক্যামেরা টিম নিয়েই আমার থাকা, বেঁচে থাকা তখন। সেট পুনর্নিমাণের কাজ চলছে। কাঁটার পাত্রপাত্রীরা সেটে থাকা শুরু করল। শুটিং জার্নির গল্প, একই লোকেশনে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ধরার দিন। দিন বা রাত ধরে ধরে আমরা ফোর টেরা হার্ডড্রাইভে জমা করতে শুরু করলাম। আমাদের সনির একটা হ্যান্ডি ফোরকে ছিল। প্রচুর ডকুমেন্টস ধরে রাখা হচ্ছিল। কী করা হচ্ছিল? কটুমেন্স ধরে রাখা হচ্ছিল। কটুমেন্স কী রে ভাই?

ও সরি। কটুমেন্স নয়, ডকুমেন্স।


আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৫ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৬ষ্ঠ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৭ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৮ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৯ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১০ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১১
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১২
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৩


শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস:  ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।