নারিন্দা ভূতের গলিতে শুটিং শুরু হতে যাচ্ছে, প্রয়োজনীয় সেট নির্মাণ সম্পন্ন। কিছু দিন আগেই আমরা মগবাজার কাঁটা ক্যাম্প গুটিয়ে নিয়ে চলে এসেছি নারিন্দায়, ২০১৮ এর মার্চের শেষদিকে বা এপ্রিলের শুরুতেই। এপ্রিল-মে-জুন অসমাপ্ত প্রি-প্রোডাকশন ও অন্যান্য কাস্টিং ফাইনাল করার পাশাপাশি সে কালের সাহিত্য জার্নাল ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের বাড়ির একাংশ আমরা পুনর্নিমাণ-বিন্যাস করেছি। ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনের পাতকুয়াটা ঠিকঠাক করা হয়েছে। উঠোনের একাংশে একটি ছোটোমোটো জংলা তৈরি করা হয়েছে। সেখানে কিছু গাছগাছালি রোপণ করা হয়েছে। কয়েকরকম পাতাবাহার, কচু গাছ, লতাপাতা-ঘাস দেখা যাচ্ছে এখন। একটা বয়স্ক ডালিম গাছ এ বাড়িরই একপাশের ঘুপচি থেকে তুলে এনে উঠোনের পাতকুয়ার পাশে পুঁতে দেওয়া হলেও সে গাছ বাঁচল না। উঠোনে একটা ডালিম গাছ থাকল না। কিন্তু পাতকুয়ার গা বরাবর একটা নারকেল গাছ আছে, সেই নারকেল গাছের গা বেয়ে উঠে গেছে দীর্ঘতর একটি পানিপ্লান্ট। পুণ্যিরাতে নারকেল পাতার ফাঁক গলিয়ে চিরল চিরল জোসনার আলো পড়বে কুয়ার পাড়ে, আকাশের চাঁদ পড়বে কুয়ার জলে—এইসবই মাথায় তখন। ৩৬ ভূতের গলির বাড়িঅলা আবদুল আজিজ ব্যাপারী তো সিঙ্গেল লোক, তবে তাঁর আছে একজন ছুটা বুয়া, নিজামের মা; আর তার ভাড়াটিয়া দম্পতি—এছাড়া আর আছে কারা তার বাড়িতে? অবশ্যই মিসেস ডায়না আছেন। ডায়না হচ্ছেন রূপবতী স্ত্রী বিড়াল। বিড়ালের উপস্থিতি কাঁটা ছবিতে একেবারে লিড কোনো প্রোটাগনিস্টের মতোই।
পাতকুয়ার গা বরাবর একটা নারকেল গাছ আছে, সেই নারকেল গাছের গা বেয়ে উঠে গেছে দীর্ঘতর একটি পানিপ্লান্ট। পুণ্যিরাতে নারকেল পাতার ফাঁক গলিয়ে চিরল চিরল জোসনার আলো পড়বে কুয়ার পাড়ে, আকাশের চাঁদ পড়বে কুয়ার জলে—এইসবই মাথায় তখন।
আর একঝাঁক কবুতর আছে এই বাড়িতে, প্রায় পঞ্চাশটি; যদিও প্রথম দিকে আমাদের কিছু কবুতর অজানা কারণে মারা গেছে। যতগুলো কবুতর মারা গেছে, আমরা সেই সংখ্যাটা পূরণ করেছি আবার নতুন কবুতর কিনে এনে। আমি নিজে তো ছোটোবেলায় কবুতর পুষতাম, সেই ঝোঁক আবার ফিরে এলো কাঁটা শুটিং করতে গিয়ে। কবুতর পোষা একটি নেশা। মনে হয় কুকুর বিড়াল পোষাও নেশার মতোন। বাড়িভর্তি কবুতর, একটি বিড়াল, এ ছাড়াও তিন সময়ে আগত তিন দম্পতির ঘরের কোনায় দেখা যাবে খাঁচার মধ্যে তিন প্রকারের পাখি, ময়না, ঘুঘু ও টিয়া—দারুণ অ্যাম্বিয়েন্স হবে নিঃসন্দেহে। এমনিতে এ ছবির পাত্রপাত্রীদের সংলাপ তুলনামূলক কম, কিন্তু তা পুষিয়ে দেবে কবুতর, বিড়াল, ঘুঘু, ময়না, টিয়া। চিত্রনাট্য রচনার সময়েই এ সব ভাবনা মাথায় ছিল আমার। তখন, সেই নিউ এলিফ্যান্ট রোডে থাকার সময় তো আর আমি জানতাম না, কোথায় কাঁটার সেট করা হবে, কোথায় হবে আবদুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়ি? কিন্তু যেখানেই করা হোক না কেন, এ সব লাগবে, এটা চিত্রনাট্যের চাহিদা। সেই চাহিদা পূরণ করতেই আমাদের পুরনো ঢাকার নারিন্দায় তাঁবু ফেলা হয়েছে। ফাইনালি, শহীদুল জহিরের গল্প কাঁটার শুটিং শুরু হতে যাচ্ছে—যা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, আমাদের জীবনে। আমরা কারা? আমরা বারো জায়গার বারো ভূত, এসেছি ভূতের গলিতে, আবদুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে।
যখন পারিবারিক আয়োজনের বিয়ের আসর থেকে খুব গোপনে যেমন নববধূ সেজে থাকা কন্যা উঠে বাঁশবাগান দিয়ে পালিয়ে যায় তার পূর্বপ্রেমিকের হাত ধরে, সেই আসরে কন্যার বাপের কী দশা? সে কি আরেকটি মেয়ে পয়দা করে এনে বিয়ে দিতে বসবে? মেয়ে না হয় জন্মাল, নবজাতিকার সঙ্গে তো আর বিয়ে হবে না, তাকে বড়ো করতে হবে, তারপর একদিন বিয়ের আসরে সে বসবে, এরকমই তো, তাই না? তত দিন কি বরপক্ষ বরের আসনে বিয়ের জন্য বসেই থাকবে? আমার কিন্তু সেই পালিয়ে যাওয়া মেয়ের বাপের দশায় পড়তে হয়েছে। সেই চাপ নিতে হয়েছে। কোনো কেন্দ্রীয় চরিত্র তিন মাস রিহার্সেলের পর শুটিংও কয়েক দিন হয়ে গেল, সেই অবস্থায় সে নিজের ইচ্ছায় আঁতকা মিসিং হয়ে গেলে কী হয়! মাথায় ছাদ না আকাশ ভেঙে পড়ে? আমারও পড়েছে। আকস্মিক ‘কী হলো কী হলো’ ব্যাপার ঘটল বটে, কিন্তু এতে আর কী যায় আসে আমার? আরে ধুর। হ্যাঁ, টাকা কিছু নষ্ট হয়েছে। কারণ, চলে যাওয়া চরিত্রের ফুটেজ কোনো কাজে আসবে না। সেই চরিত্রের জন্য যা কিছু খরচাপাতি, সময় ও পরিশ্রম হয়েছে টিমের বা আমার; তা জলে গেল। তবে পৃথিবী এমন, শূন্যস্থান সে রাখতেই চায় না। সত্যি, হয়তো অর্থনৈতিক ক্ষতি মেনে নিতে হয়েছে, কিন্তু একজন চলে যাওয়ার পর যে এসেছে, সে যেন লক্ষ্মী হয়েই এসেছে। আমি হ্যাপি হই এই ভেবে যে, শুটিং শুরুর পর যে কেন্দ্রীয় অভিনেত্রীর মিসিংয়ের শিকার কাঁটা, সেই মেয়ের বদলে কাঁটায় যে কাস্টিং হলো ফাইনালি, তাকেই আমাদের দরকার ছিল। এবং তাকে পেয়েছি। দর্শক তাকে পাবে কাঁটায়, একজন শক্তিময়ী অভিনেত্রী হিসেবেই। সুতরাং কেউ চলে গেলে আদতে তা খারাপ নয়, কারণ, সে তো যাবেই। বরং যে এলো, যে এসে আরও ভালো কিছু করল, তাকে ভালোবাসা না জানিয়ে পারি আমি? পাঠক বা দর্শক, আপনি বা আপনারা পারবেন?
জুনের শেষে জুলাইয়ে শুটিং শুরু হলো, শুরু হলো বৃষ্টিও। তুমুল বৃষ্টিতে নির্মাণ করা সেটাংশ রক্ষা করতে আমাদের বিরাট বড়ো পলিথিন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হতো বটে, খুব টেনশনও হতো কিন্তু আমাদের তো বৃষ্টির সিকোয়েন্স আছে, সেগুলো শুট শুরু হলো। আর বৃষ্টির কারণে আমাদের লাগানো গাছ-ঘাস যেন প্রাণ পেয়ে লকলক করে উঠল। অর্থাৎ যা কখনো ক্ষতির কারণ, তাই হয়তো ভালো কিছুরও বাস্তবতা হয়ে ওঠে। এত দিনে আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ডের অ্যাপ্রেন্টিস টিমকে আমার আর অ্যাপ্রেন্টিস মনে হয় না, ওরা আমার চাহিদা বুঝতে শিখেছে, আমার মেজাজ হজম করতে শিখেছে। আমার সাহচার্য ও বন্ধুত্বও নিতে পারার জায়গায় ওরা পৌঁছেছে ততদিনে। ব্যস! শুটিং শুরু হয়ে গেল। কাঁটা নির্মাণ হতে চলল। বাংলাদেশে কাঁটা ছবি নির্মাণই এক ইতিহাস। আমাদের সামগ্রিক ভাবনাই এমন, কাঁটা ছবিটি যেন মানুষের মনের মধ্যে অনেক দিন থেকে যায়। শক্তিশালী দর্শকের কাছে যেন একবারের বেশি তার দেখতে ইচ্ছে হয়। এটুকুই চাওয়া আমার, আমাদের।
ইতিহাসের তিনটি সময় নিয়ে কাজ কাঁটার। সুবোধ-স্বপ্না সিরাজগঞ্জের গ্রাম থেকে ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাসে এসে ভাড়াটিয়া হয় ভূতের গলির আবদুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯০ সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত তারা থাকবে এখানে। ব্যাপারীর যে ঘরে তাদের বসবাস, সেই ঘরে দুইটা দরজা ও আটখানা জানালা। অদ্ভুত সুন্দর একটি ঘর। আবার সেই ঘরেই ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময়ে সাতক্ষীরা থেকে আগত দম্পতি, সেই সময়ের সুবোধ-স্বপ্না ছিল ৩-৪ মাস। আবার ওই একই ঘরে ১৯৬৪ সালে, এক দুপুর থেকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত মাত্র এক দিনেরও কম সময় আমরা দেখেছি আরেক জোড়া সুবোধ-স্বপ্না। তিন সময়ের তিন দম্পতির সংসারের জিনিসপত্র তো আলাদা, জানালার পর্দা আলাদা, বিছানা-বালিশ-থালাবাসন-পুজো-পার্বণের সামগ্রী সবই আলাদা। আলাদা হওয়াই তো স্বাভাবিক। হয়তো সারাদিন শুটিং হলো একজোড়া দম্পতির, ওই ঘরে, রাতেই সেটের পরিবর্তন করে আরেকজোড়া দম্পতির শুট হচ্ছে। বিরাট চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছে তখন কাঁটা টিম। কাঁটার আর্টিস্ট শিডিউল করা ছিল অত্যন্ত জটিল একটা জান-কারবারি ব্যাপার। পাঁচশো মানুষকে টানা ফোন করতেও তিন দিন লাগে। ফোন যে করত কাঁটা টিম থেকে, তার কী অবস্থা হতে পারে সেসময়! জরুরি ভিত্তিতে শিডিউল অ্যাডজাস্ট করতে একেবারে হিমশিম খেতে হতো। হিমশিম কি খুব স্বাস্থ্যকর খাবার? এই খাবার খেয়েছে কাঁটা টিমের লোকেরা, কেউ খুব বেশিই খেয়েছে হিমশিম। কোনো কোনো দিন আমরা হিমশিম ভেজে পরোটা খেয়েছি সকালে, দেখি দুপুরে ভাতের সঙ্গে অন্যান্য তরকারির সঙ্গেও আছে হিমশিম ভর্তা। রাতেও হিমশিম, ঝোল করে রান্না করা হিমশিম। হিমশিম খুব সুস্বাদু, স্বাস্থ্যকর খবার। নবীন টিম, তাদের পক্ষ থেকে তাদের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কাজ তো আর আমি পাইনি। কারণ, তাদের তো প্রোডাকশন নিয়ে কারোরই পূর্ব কোনো প্রাক্টিক্যাল ধারণা ছিল না। কিন্তু আমার শুধু এইটুকু ভাবনা কাজ করত, এদের দিয়েই আমি আমার কাজটুকু উঠিয়ে নেব। নিয়েছিও। কতটুকু না পারা থাকল, কতটুকু পারা থাকল, আমার জানা থাকল। কিন্তু কাঁটা এই নবীন টিমকে নিয়েই করেছি আমি। শিক্ষানবিশ এই টিম নিয়েই যেমন করেছি প্রি-প্রোডাকশন, করেছি প্রোডাকশন। শুটিংয়ের পরপরই এলো করোনা দেবী, তিনি গিলে খেলেন দুই বছর এবং করোনা থাকতেই কাঁটার মামলা সংক্রান্তিতে গেছে আমার আরও দুইবছর চার মাস। এখন, ২০২৩ এ পোস্ট প্রোডাকশন শেষের দিকে। আমাদের জীবনই এমন, জীবনে এক এক সময়ে এক একগল্প। পোস্ট প্রোডাকশনের এই সময়ে এসে যতখানি দ্বীপান্তরিত আমি, গত চার বছর আগে এইরূপ ছিল না। নারিন্দা ক্যাম্প লোকে গিজগিজ করত। কেউই তার জীবনের পরের সময়ের চেহারাটা আগে দেখার সুযোগ পায় না। আবার এও সত্য, শুটিংয়ের সময় শুটিং করার পাশাপাশি যদি এই ‘জার্নি অব কাঁটা’ রচিত হতো, তাতে কারো শ্রম, কাঁটার কাজে কারো কারো তীব্র উপস্থিতি যেভাবে লেখা হতে পারত, এখন, শুটিং এর চার বছর পর এই পোস্ট প্রোডাকশন পিরিয়ডে বসে লেখা সেদিকে যাচ্ছে না। এই যাওয়া না যাওয়াই আমার কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই। আমি শুধু কাঁটাতে থাকতে পারি, থাকতে চেয়েছিও, তাই কাঁটাকে ফোকাস করব জার্নিতে।
সময়ের চলতি ভাষা দিয়ে আমি কিছুতেই সেদিনের ভাষা মেলাতে পারছি না। ইশ, যদি মেলাতে পারতাম! চার বছরে কারো কারো অনুভূতি অবিশ্বাস্য রকম দূরত্বও রচনা করেছে কাঁটার সঙ্গে! কাজেই, এখন লিখতে বসে যে কোনো কারণেই কাঁটা থেকে ছিটকে যাওয়া বা ছেড়ে যাওয়ার চরিত্রের পেছনে আমার কতদূর যাওয়া সম্ভব? আমার তো ভাবাবেগে ভেসে যাওয়ার সুযোগ নেই এবং তা নির্মাতার থাকে না। একটি প্রোজেক্টে শেষ পর্যন্ত থাকাই তো থাকা। তাই না? যে বা যারা থাকতে পারেনি, যে বা যারা থাকতে চায়নি, যে বা যারা নির্মমতার সঙ্গে কাঁটা-স্বপ্ন-নির্মাণকে পরিত্যাগ করাই উত্তম ভেবেছে, তার বা তাদের জন্যও কি আমি শুভেচ্ছা রাখব না? সে বা তারা তো ছেড়েই গেছে, না? সে বা তারা তো এক সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুকেই ফেলে গেছে নিজের বা নিজেদের পুঁজি-প্রতিষ্ঠা ও আত্মপসারের প্রয়োজনে। এই ফেলে যাওয়া কি খারাপ কিছু? কাঁটাকে কি উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি হিসেবে কেউ ব্যবহার করেনি? করেছে। সে করা কি অনৈতিক কিছু? অসমাপ্ত কাঁটার ঘাড়ে পা দিয়ে যতদূর ওঠা যায়, কেউ তো সেরকম উঠতে চেয়েছে বা উঠছেও। এ কি খুব দোষের? কাঁটা প্রডাকশনে কাজ করা অভিজ্ঞতার নগদ বাজার তো একটা হবেই, কেউ বা তারা সেই অভিজ্ঞতা বিক্রি করতে বাজারে বেরিয়ে পড়েছে। দূর থেকে দেখে যাওয়া ছাড়া আমি আর কীইবা করতে পারি? যে বাজার এড়িয়ে একদিন আমি সম্পূর্ণ নতুনদের নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কাঁটা নির্মাণ প্রশ্নে, সেই বাজারের প্রলোভন থেকে আমি কাকে আর দূরে রাখতে পারি? কাঁটার শেষ হওয়া পর্যন্ত সবাই কাঁটারই থাকুক, এ তো আমি চেয়েছিই, যা খুবই ন্যায্য। কিন্তু তা হয়নি।
কাঁটা প্রডাকশনে কাজ করা অভিজ্ঞতার নগদ বাজার তো একটা হবেই, কেউ বা তারা সেই অভিজ্ঞতা বিক্রি করতে বাজারে বেরিয়ে পড়েছে। দূর থেকে দেখে যাওয়া ছাড়া আমি আর কীইবা করতে পারি? যে বাজার এড়িয়ে একদিন আমি সম্পূর্ণ নতুনদের নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কাঁটা নির্মাণ প্রশ্নে, সেই বাজারের প্রলোভন থেকে আমি কাকে আর দূরে রাখতে পারি? কাঁটার শেষ হওয়া পর্যন্ত সবাই কাঁটারই থাকুক, এ তো আমি চেয়েছিই, যা খুবই ন্যায্য। কিন্তু তা হয়নি।
বাজারর থাবায় লুণ্ঠিত হতে দেখছি তখন আমার পরিশ্রম-স্বপ্ন-সময়-অর্থ-ভালোবাসা। কয়েকমাস ধরে, অভিজ্ঞতাহীন এদের তো আমিই সময়-অর্থ আর নিজেকে ঢেলে প্রস্তুত করেছিলাম, কাঁটার জন্য! কাঁটা শেষ হওয়ার আগেই এদের কাউকে কাউকে বিক্রি হতে দেখার বাস্তবতাও আমাকে দেখতে হলো! আহ, এও হয়? হয়। হলো তো! সত্যি, বাজারে নিজেকে যতটা বিক্রি করতে পারবে কেউ, সেই অনুযায়ীই তো পয়সা আসবে। এই সুযোগ কেন কেউ নেবে না? অবশ্য এসব দেখে আমার ভেতরে তখন কি কি ঘটেছে বা ঘটমান থেকেছে, তা কি খুব আলোচ্য কিছু? আমার ক্ষত নিয়ে আমি বসে থেকেছি, কাঁটার ক্ষতি নিয়ে আমি একা একা বিচলিত হয়েছি। আমার বিচলনই কাঁটার ক্ষতি, অনস্বীকার্য সত্যি। কাঁটার কী ক্ষতি হলো, এটা দেখতেও তো একজন লোক লাগবে, সেই লোক হয়ে বসে থেকেছি। রাশি রাশি ভাবনা দোলা দিয়ে গেছে। কিন্তু ভাবনার দোলা নিয়ে তো কথা হচ্ছে না, কথা হচ্ছে কাঁটা নিয়ে। কাঁটা একটি পিরিওডিক্যাল ছবি। কয়েকবছর কোনো বেকায়দায় পড়ে পার হতে হলে, এত ধৈর্য সকলের থাকবে, সে আশাই বা আমি করি কেন? না, এ বাড়াবাড়ি। অন্যায়। প্রশ্ন, আমি কেন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেব? যে যতটুকু পেরেছে, করেছে, যে যতটুকু অনেস্টি বজায় রাখতে পারার যোগ্যতায় তৈরি হয়ে আসা ক্যারেক্টর, সে তাই রেখেছে, এর বেশি আমি চাচ্ছিই বা কেন? না বাপু, এ একদম ঠিক না। যখন টিম গঠন করেছিলাম, তখন টিমের সবাই যে যার মতো মনোবাসনা নিয়ে এসেছে কাজ করতে। কতখানি কার মাথায় কাঁটা ছিল আর কতখানি ছিল উচ্চ নম্বরের সিঁড়ির বাসনা, তা আমি বুঝব কীভাবে? আমি তো শুধু একটি ছবি নির্মাণ-স্বপ্নের ভেতরেই বাস করছি, অন্যেরা সব্বাই তাই-ই করবে, সে নিশ্চয়তা পাব কোথায়? টিম প্রধান হিসেবে সবার মনের ভেতরে যাওয়ার সামর্থ কি আমার আছে? আবার যেটুকু তাদের পক্ষ থেকে পেয়েছি, সেও কি অনেক নয়? সেই অনেক না ঢাললে তো কাঁটা শুটিঙই সম্পন্ন হতো না। তাই আমি কৃতজ্ঞও থাকব আজীবন, সবার প্রতিই। কারণ, তারাই কাঁটার নির্মাণ টিমের সদস্য। কেউ কেউ দূরে থেকেও কাঁটার খুব সঙ্গে থেকেছে, তারা যেমন ক্যামেরার পেছনে থাকা কেউ কেউ, ক্যামেরার সামনে থাকা কেউ কেউ খুব এনার্জি জুগিয়ে গেছে দুঃসময় বাস্তবতায়, আমার সঙ্গে দেখা করেছে, ফোনে কথা বলেছে। কাঁটা নিয়ে অনুভব শেয়ার করেছে আমার। আজ কার কথা আমি কীভাবে লিখব এই জার্নিতে? তীর্থযাত্রীদলও সবাই একসঙ্গে পৌছুতে পারে না গন্তব্যে, আর এ তো একটি সিনেমা।
যদিও, এ আমার চাইল্ড। মাতৃত্বের জঠরজ্বালা থেকেই কাঁটা আমার শিশু। কাজেই, কে কীভাবে দেখেছে বা কোলে তুলে নিয়েছে শিশুটাকে, আমার চোখ এড়াবে না কিছুই। তাই জার্নি অব কাঁটাতে ইচ্ছে থাকলেও কত কথা অলিখিত থেকে যাচ্ছে। লেখা লিখিত হওয়ার আগেই শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। লেখা ওদিকে আগাচ্ছেই না। ওদিকে আবার কোন দিকে? ওই যে আমার নিঃসঙ্গ বসে থাকার দিকে। নিঃসঙ্গতা দানকারীদের দিকে। আমি লেখাকে বলেছিলাম, ‘কি গো, ওদিকে যাবা না?’ লেখা বলল, ‘এত দরকার নেই। যারা টিকে আছে তোমার পাঁজরে, তাদের কথাই লেখো। আগের কথা আবছায়া মেরে আসতে পারো সামান্যই।’ আমি লেখার কথা শুনতে বাধ্য হই, লেখাও তো আমার কথা শোনে। লেখার সঙ্গে সংসার করি আমি, লিখতে গেলে আর মিথ্যে লিখতে পারি না। নিজের মুখে যা এড়িয়ে যেতে পারি অবলীলায়, লেখার সময় কোনো কিছু এড়াতে পারার ক্ষমতা আমার থাকে না।লেখার সময় আমি সত্যি ধ্যানস্থ এক প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়ি। তখন আমার পাঁজরে কেমন দগদগে দাগ ধরা পড়ে! এই দাগ কখনো দেখা যাবে না। বরং দাগ হয়ে থাকুক কাঁটা, দর্শকের মনে, সেই চেষ্টার বিন্দুমাত্র কমতি রাখার অধিকার নেই আমার, তা আমি জানি। যাপিত জীবনের গ্লানি মুছে যাবে একদিন, কিন্তু কাঁটা ছবিকে আমার মনের মতো করে ভালো করে তোলার জন্য আমি যা যা করতে পারি, করছি, করব। দর্শকের চোখে একদিন কাঁটা দেখব আমি, এই চাওয়া থেকে আমি সরে যেতে পারি না। তাহলে শহীদুল জহিরের কাছে আমি কি কৈফিয়ত দেব? বাংলাদেশের মানুষ, যারা ভালো গান শুনতে ভালোবাসে, ভালো ছবি দেখতে ভালোবাসে, কবিতা পড়তে পছন্দ করে, উপন্যাস পড়ে, মঞ্চে ভালো নাটক দেখতে যায় কিম্বা যারা ভালো ভাবনার ভেতরে বসবাস করতে চায়, তাদের সামনে আমি দাঁড়াব কী করে? যারা চায়, বাংলাদেশেও চিন্তাশীল ছবি হোক, তাদের মুখোমুখি আমাকে দাঁড়াতে হবে না?
বুদ্ধি, চালাকি জ্ঞান নয়। চাতুর্যপনা শিল্পীকে দিয়ে হয় না। কোনো প্রকার চালাকি নয়, সত্যে সমর্পিত থাকার সাধনাই শিল্পীর জীবন, আমি শিল্পের জন্যই তালগাছে বাবুই হতে চেয়েছি। কিন্তু ‘সময়, সবুজ ডাইনি,’ প্রি-প্রোডাকশন ও প্রোডাকশন পর্বের দুই বছরের নিবিড় দায়ত্বশীলতার সঙ্গে থাকার পর আর ধরে রাখতে পারিনি টিমের বড়ো অংশকেই। যেন কোনো ঝড়ে সব ভেঙে চুরে গেছে বাড়িঘরদোর। ভালোবাসার ভিটেখানি আগলে ধরে আমি বসে আছি শুধু। দেশে করোনা এসেছে, দেড় বছর প্যানিকে কেটেছে সবার। কাঁটা সংক্রান্ত মামলাতেই আমি আরও দুবছর চার মাস কোর্টকাচারি করে ২৩ সালের মাঝামাঝি এসে মুক্ত হয়েছি, অতএব, বেলা কিছু গড়িয়েছে। প্রি-প্রোডাকশন-প্রোডাকশন পর্বের কাউকে কাউকে পোস্ট প্রডাকশন পর্বে ডাকতে গিয়ে দেখেছি, যাকে ডাকলাম, সে তো সুদূর আসমানে উঠে গেছে, ডেকে মাটিতে নামানো যায় না আর। মাটিতে না নামলে তো তার সঙ্গে আমার কথা হতে পারে না। আমি জানি না এই অবস্থাকে কী নামে অভিহিত করা যায়! এই বাস্তবতা আমার আগে দেখা হয়নি। কাঁটা আমাকে সেই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। মানুষকে নানাভাবে চেনার জন্য জীবন পেয়েছি আমরা। অবশ্য কাঁটা যদি কারো জন্য উপরে ওঠার সিঁড়ি হয়ে কাজ করেছে বা করে থাকে, তার কি তখন কাঁটার কথা মনে থাকে আর? কাঁটার কথাই যার মনে না থাকে, আজ ‘জার্নি অব কাঁটা’ রচনাকালে সেই আগের বাস্তবতা কীভাবে লিপিবদ্ধ করতে পারি? বরং লিখতে পারি ‘চেনা মুখের দেখন হাসি, পাল্টাও তুমি তবু তোমায় দেখতে আসি।’
মাটিতে না নামলে তো তার সঙ্গে আমার কথা হতে পারে না। আমি জানি না এই অবস্থাকে কী নামে অভিহিত করা যায়! এই বাস্তবতা আমার আগে দেখা হয়নি। কাঁটা আমাকে সেই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল।
পালটে যায় পরিপার্শ্ব। ইউক্রেন রাশিয়ার আগ্রাসনের শিকার হলো। আমেরিকার যুদ্ধশিল্প আরও নতুন মাত্রায় উন্নীত এখন। বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্ব আরও চরম আকার ধারণ করছে। এরকম দিনলিপির মধ্যে ঢুকে পড়ে আমার কি কারো প্রতি অনুযোগ থাকার সুযোগ আছে? অনুযোগ রেখে লাভ কি? আমি দার্শনিক প্রেক্ষাপটে সত্যের দিকে ধাবিত হতে চেয়েছি। তাই সত্যের সঙ্গে থাকাটা আমার বেঁচে থাকারই অংশ। সত্য অনুভব করতে পারলে আমি স্বস্তি পাই। নিশ্চয়ই আগামীতে আরও স্বস্তি রচনা করব। অনুভবকে লিখে ফেলতে পারলে মাথাও পরিষ্কার হবে। আমিও মাথা পরিষ্কার করতে চাই। জার্নি অব কাঁটা—এই ধারাবাহিকেই থরে থরে সব লিখতে হবে, এমন নয়। নানাভাবেই তা প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার আছে। আমার অনুভূতি-অনুভব আমি পাঠক-দর্শকের সঙ্গে নিবিড়ভাবে শেয়ার করব, এ অবশ্যই আমার কাজ, আমার জীবনাচরণেরই অংশ। ফলত, তুমি যদি ভালোবাসার ফল আমাকে খেতে দাও, আমি সেই ফলের গল্পটা লিখব। ফলের মধ্যে যদি প্রাণহারী পোকা ঢুকিয়ে রাখো, আমি মরতে মরতেও সেই প্রাণঘাতী পোকার কথা লিখতে বাধ্য। তাই পোকার কথা বা ফলের কথা বা তোমার কথাও লিপিচিত্রিত প্রকৌশলে আমি রেখে যাব বাংলা ভাষায়। কেন না, তা আমার জীবনেরই অংশ। জীবনকে তেমন কিছু দিতে না পারলেও জীবনকে এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য আমার কোথায়? আমার জীবন বাংলা ভাষার জীবন। কাঁটা বাংলা ভাষার ছবি। ভাবনায় আছে দু-তিন ভাষায় সাবটাইটেল করা হবে কিন্তু ছবির ভাষা তো বাংলা। আর গল্পের বিস্তৃতি বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান। সামাজিক যে প্রেক্ষাপটে কাঁটা নির্মিত, সেই প্রেক্ষাপট এখনো বিদ্যমান আছেই বাংলাদেশ বা ভূ-ভারতে। এই প্রেক্ষাপট ট্র্যাজেডির, বেদনার। কিছুতেই যেন বা আমরা বেদনাকে হটাতে পারছি না, পারি না। অথচ আমরা বেঁচে আছি, বেঁচে থাকে আমাদের মর্মন্তুদ বেদনাও।
অ্যাট অ্যা গ্লান্স কাঁটা, ইটস নট অ্যা ফিল্ম, ইটস ট্র্যাজেডি!
তাহলে, কাঁটার শুটিং শুরু হয়ে গেল, আনন্দ এলো মনে। আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে প্রায় সিক্সটি পার্সেন্ট সিকোয়েন্স, তাই এই বাড়িতেই ক্যামেরা ওপেন হলো। কাঁটার ক্যামেরা চালাবার দায়িত্ব নিয়েছে রোমান, তাইজুল ইসলাম রোমান। রোমানের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া ছিল অনেক বছর ধরেই। তবে কাঁটাই প্রথম বড়ো আকারের কোনো প্রোজেক্ট, রোমানের। আমারও। আমাদের সবার জন্যই তো। রোমান বিয়ে করল কাঁটা শুট করতে করতেই। আমরা নারিন্দা থেকে দল বেঁধে গেছি আশুলিয়া জিরাবোতে, রোমানদের বাড়িতে, বিয়ে খেতে। আরও কত জায়গায় যে গেছি তখন নারিন্দা থেকে, কত কি খেয়েছি। নারিন্দায় এক অন্যরকম জীবন আমরা রেখে এসেছি!
সনি এফএক্স ফাইভ ক্যামেরায় শুট শুরু হলো কাঁটার, পাশাপাশি ছিল সনির একটি হ্যান্ডি। হ্যান্ডি কিন্তু ফোর কে। সিংঙ্গাপুর থেকে হ্যান্ড টু হ্যান্ড এই হ্যান্ডি আমরা কিনে আনার ব্যবস্থা করেছি বিহাইন্ড দ্য সিন শুট করার জন্য। আমরা যখন সেই হ্যান্ডি ব্যবহার করি, তখনো ঢাকায় সনির শো রুমে ক্যামেরা সেই মডেল এসে পৌছয়নি। কাঁটার টু পার্সেন্ট শট নেয়া এই সনিতেই। বাকি ৯৮ ভাগ শুট সনি এফএক্স ফাইভে। আর হোসেইন আতাহার চালাত স্টিলের জায়গা থেকে ওর নাইকন ডিএসএলআর। এ ছাড়াও আমার ভাগ্নি বর্ষার একটি ক্যানন ডি ফাইভ ছিল স্টিলের জন্য। ছিল কস্টিউম-প্রপস এর কন্টিনিউটির জন্য একটি ছোটো সনি ডিজিটাল ক্যামেরা। আর ম্যাক পিসি ছিল ক্যাম্পে, দিনের শুট করা ফুটেজ রাতে দেখার জন্য। নারিন্দা ক্যাম্পে একটি রুম ছিল কাঁটার ডিভাইস রুম। ওই রুমে রোমান ঘুমাত।
ইতিহাসের তিনটি আলাদা সময় ও প্রায় পাঁচশোর অধিক পাত্রপাত্রী নিয়ে শুরু হলো কাঁটার শুটিং, এ সত্যিই এক মহাযজ্ঞ আমাদের জন্য। সেই যজ্ঞের পৌরহিত্যের দায়িত্ব ইতিহাস দিয়েছে আমার ওপরে, আমার সঙ্গে আছে সেই ১২/১৩ জনের বিহাইন্ড দ্য টিম। লোকেশন, প্রথমত আজিজ ব্যাপারীর বাড়ি। বাকি ৩৫ ভাগ কাজ পুরান ঢাকারই আরও কিছু বাড়ি, গলি, গলির মোড়ের সেলুন ঘর, চা পুরির দোকান এবং অবশিষ্ট ৫ ভাগ কাজ হবে ঢাকার বাইরে, যেগুলো আমরা করেছি মুনশিগঞ্জের পদ্মা নদী, নরসংদীর কিছু এলাকায়। শুটিং মানেই একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ফিলিংস, চাপ কিন্তু তা বড়ো আনন্দের ব্যাপার। আমরা দুই তিন দিন শুটিং করি তো ১ বা ২ দিন বিরতি দিয়ে পুনরায় শুটিং করি। পিরিওডিক্যাল ছবি হওয়ার কারণে প্রপস ও কস্টিউমের কন্টিনিউটিতে সবসময় সূক্ষ্ম হিসাব রাখতে হতো, যাতে করে কোনো রকম ভুল হওয়ার সুযোগ না থাকে। কারণ, দর্শকের কাছে ভুলের কোনো ক্ষমা নেই। দর্শকের চেয়ে নির্মম তো কোনো প্রেমিকপ্রেমিকাও হয় না, যেমন, দর্শকের চেয়ে বেশি প্রেম আর কেউ দিতেও পারে না। কাজেই সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই।
আজ জার্নি অব কাঁটা লিখছি যখন, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক। আগেকার দিনে এরকম বৃষ্টিকে বলা হতো মুষলধারে বৃষ্টি। ঠিক এরকম বৃষ্টির দিনেই নারিন্দায় শুরু হয় কাঁটার শুটিং। আমার সঙ্গে একদল ছেলেমেয়ে ছিল, যারা না থাকলে কাঁটা হতো না। তাদের সেই গেরিলা দীক্ষায় অংশগ্রহণ না থাকলে আমি একা একা কী করতাম? প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবনকে তারা সেক্রিফাইস করেছে কাঁটার জন্য, সেই নয় মাস এবং তার আগের পাঁচ মাস। জীবনের তেরোটা মাস কি সহজ কিছু? কেউ বাড়িতে বউ বাচ্চা রেখে চলে এসেছিল। ঈদ গেছে, পুজো গেছে, কাঁটা ক্যাম্প থেকে তারা বাড়িতে যায়নি। বর্ষা গেছে, শীত গেছে, তাঁরা কাঁটা ক্যাম্পে নিবিড় দায়িত্বের সঙ্গে কাজ করে গেছে। কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসে কাঁটায় জয়েন করেছিল। কারো একাডেমিক লেখাপড়া ছিন্ন হয়ে গেছে বছরখানেকের জন্য। এই সেক্রিফাইসের প্রতিদান আমি কীভাবে দিতে পারি? অবশ্যই কাঁটার নির্মাণ অংশীদার তারা। কত দুর্যোগ গেছে, তারা আমার সঙ্গেই কাঁটা ক্যাম্প আঁকড়ে থেকেছে। কারো কারো বাবা-মা অসুস্থ, হাসপাতালে, কোনো রকম হাসপাতালে গিয়েই আবার সে তা তারা ফিরে এসেছে কাঁটা ক্যাম্পে। এরকম দিন আমার হয়তো আর আসবে না। কাঁটা টিমও এরকম দিন আর পাবে না। মাতৃত্বের জঠরজ্বালায় আমার ভেতরে তাদের জন্য টান কাজ করে, তারা ছিল ধাত্রী, আমার বাচ্চা বিয়োবার কালে, কাঁটা সেই বাচ্চা। সত্যি, এরকমই ফিল হয়।
আমি ফিল করি কাঁটার পাত্রপাত্রীদের। তারা তো প্রায় ৯৯ পার্সেন্টই নতুন। কী কষ্টই না করেছে তারা কাঁটা শুটিংয়ে। একই দৃশ্য একাধিক দিন নিয়েছি, তারা কত আপন জনের মতো শট দিয়ে গেছে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। ভোর পাঁচটায় শট নিয়েছি, তারা এসেছে রাত চারটের দিকে, এ সব সহজ না। রাতে চাঁদটা কুয়ার মধ্যে পড়তে পারে ভেবে আর্টিস্ট কল দেওয়া হয়েছে রাত ২ টায়, তারা এসেছে। রাত তিনটায় চাঁদ পড়েছে কুয়ার জলে, সেই শট নিতে হবে না? আর্টে ম্যাডনেস প্রয়োগ আগেও হয়েছে। কাঁটাতেও হয়েছে। মানুষ দেখবে কাঁটা, সবার পরিশ্রম স্বার্থক হবে, এই তো প্রত্যাশা। মানুষ দেখবে ম্যাডনেস। ফিল্ম সকল আর্টকে আত্মীকরণ করে নিজে তৈরি হয়—এটাই তো চূড়ান্ত বিচারে একটা ম্যাডনেস। পাগলামি ছাড়া একদল মানুষ জীবনের সব কিছু বাদ দিয়ে এসে এরকম করে নাকি? কাজেই, কাঁটার পাত্রপাত্রীদের জন্য, কাঁটার টিম মেম্বরদের জন্য আমার ভালোবাসা সবসময় বয়ে যাবে। একটুআধটু রাগ যা করি বা করেছি, সেই রাগটুকুকেও শিল্পকলায় উত্তীর্ণ করতে চাই আমি। মা রাগ করবে না বখে যাওয়া সন্তানটির জন্য? মা ব্যথা পাবে না? মার ব্যথা তো সুসন্তান একদিন বুঝবেই। কাঁটা ছাড়া আর কিছুর জন্যই তো আমার রাগারাগি নেই, হাহাকার নেই, আনন্দ নেই, উচ্ছ্বাস নেই। আমারও তো জীবন থেকে কিছু সময় গেছে এই বাচ্চাটি বিয়োতে গিয়ে! সেই কিছু সময় কিন্তু অন্য যে কারো তুলনায় পাঁচগুণ বেশিই হয়তো! আমি তো কিছুতেই ছেড়ে যেতে পারি না শিশুটিকে ফেলে রেখে! মা না?
কাঁটাও দর্শকের মুখোমুখি হতে মুখিয়ে আছে। পাত্রপাত্রী, কাঁটা টিমের সব্বাইকে নিয়ে ছবিটা একসঙ্গে দেখতে বসব। আহ! এ এক অন্যরকম আনন্দ! বাচ্চা বিয়োবার আনন্দ। কাঁটা শহরের পুরনো একটি মহল্লার মানুষের গল্প। মহল্লায় কত কত বাড়ি, কমপক্ষে ষাট-সত্তুরাটা বাড়িই কাঁটার সেট—যে বাড়িগুলোর বয়স প্রায় দুই-তিনশো বছর করে। এ সব নিয়েই তো ভূতের গলি। জীবনে একটি ছবি বানাতে গিয়ে আমরা ভূতের গলিতে ছিলাম। ভূতগ্রস্থ ছিলাম কী?
পর্বে পর্বে জানা যাবে। পড়তে থাকুন বন্ধুরা…
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৫ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৬ষ্ঠ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৭ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৮ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৯ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১০ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১১
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১২
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৩
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৪
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৫
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৬
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৭
কাঁটা প্রোডাকশন ফটোগ্রাফি : হোসেইন আতাহার
জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস: ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।