বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

টোকন ঠাকুরের ধারাবাহিক : জার্নি অব কাঁটা : পর্ব ১৯

0

‘দ্যাছ ছাধিন হইছে, মহল্লায় ট্যাপের পানি আইচে মাগার আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনের পাতকুয়াটা অহনো রয়া গেল!’— এই আফসোস ঘনীভূত হয় ভূতের গলির মহল্লাবাসীদের মনে। ১৯৮৯-৯০ সালে ভূতের গলির লোকেরা নিজেদের মধ্যে এরকম অস্বস্তি আলোচনা করে। তাদের হয়তো কিছু একটা সন্দেহ হয়। তারা ইয়োর চয়েস সেলুনের সামনে পেতে রাখা বেঞ্চে বসে নানান কথাই আলাপ করে, তারা গলির মোড়ের চা-পুরির দোকানে বসে নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে এবং ক্রমশ কিছু একটা অনুমান করে। অনুমান-সন্দেহ দূর করতে তারা আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে যায়। গিয়ে, কী দেখতে পায়? হ্যাঁ, ঠিকই, ভূতের গলির বাড়িঅলা আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনে পাতকুয়াটা এখনো আছে। পাতকুয়ার পাশে পড়ে আছে দড়ি বান্ধা একটি বালতি। সেই বালতিতে জল তোলা হয়। জল কে তোলে? জল তোলে ব্যাপারীর ভাড়াটিয়া সুবোধচন্দ্রের বউ স্বপ্নারানী দাস।


p 19. 1

কাঁটা ছবিতে আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনের পাতকুয়াই একটি বড়ো ক্যারেক্টর


মোদ্দা কথা, কাঁটাতে কুয়া নিজেই একটা ক্যারেক্টর হিসেবে উপস্থিত আছে। অনেক পুরোনো দিনের একটি কুয়া। বাড়িটার বয়স প্রায় শতবছরের বেশি। অতএব কুয়ার বয়সও তেমনই। কুয়ার গায়ে কোথাও কোথাও শ্যাওলা পড়েছে। এই কুয়ার মধ্যে নরনারী হত্যা হবে? ভাবলেই কেমন লাগে! মানুষ কেন মারা যাবে কুয়ার মধ্যে? কুয়া কি কুফা লাগা কুয়া? এই কুয়া কি ফাঁসির মঞ্চ নাকি?

এই প্রশ্নে মীমাংসা দেখা যাবে কাঁটাতে। আদতেই কি মীমাংসা দেখা যাবে? মীমাংসা কি না বলা যায় না, তবে হত্যা বা মৃত্যুর ঘটনা তো আমরা দেখতেই পাব। কুয়ার অনতিদূরে উঠোনের আরেক পাশে যে পাতাবাহারের ছোটোমোটো জঙ্গল, তারই ছত্রছায়ায় একটি তুলসীগাছ লাগানো আছে। হয়তো তুলসীগাছ বাতাসে মৃদু দোল খাচ্ছে। বাংলাদেশের কোনো মুসলিম বাড়িঅলার উঠোনে এরকম তুলসীগাছ কি সচরাচর লাগানো থাকে? না, থাকে না। কিন্তু আবদুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনে আছে তুলসীগাছ। অতএব, এটা কোনো এড়িয়ে যাওয়ার বিষয় নয়—তাই মহল্লাবাসীদের এই নিয়ে টেনশন আছে, অনুমান-সন্দেহ আছে। ব্যাপারীর বাড়িতে আগত ভাড়াটিয়া দম্পতি সুবোধ-স্বপ্না; সেই স্বপ্নাই যে তুলসীগাছ লাগিয়েছে। স্বপ্নাই যে তুলসীগাছের গোড়ায় জল মাটি দিয়ে লেপে দেয়, তাও আমরা জানি। স্বপ্নাই তো পুজো করে, আমরা দেখতে পাই। কুয়ার মতোই তুলসীগাছও আরেক ফ্যাক্টর বা অ্যাক্টর হিসেবে অভিনয় করেছে কাঁটা ছবিতে। প্রায় ৬টা তুলসীগাছ, একই সাইজের গাছ আমরা ব্যাকআপে রেখে শুটিং শুরু করেছি। তুলসীগাছ মরে গেছে, ব্যাকআপ থেকে আবার একটি একই রকম গাছ রোপণ করা হয়েছে একই জায়গায়। অর্থাৎ কুয়া ও তুলসীগাছ নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করছে ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনে, কাঁটা ছবিতে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে ভূতের গলির মানুষ, বিশেষ করে বয়স্ক কিছু বাসিন্দা।


p 19. 11

তুলসীগাছের ছবি তুলে নিচ্ছে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন, শুট করা হচ্ছে মাটিতে শুয়ে


প্রায় পনেরো জনের বেশি সিনিয়র সিটিজেন অভিনয় করেছেন কাঁটা ছবিতে। এঁদের মধ্যে কয়েকজন ডাবিং করার আগেই প্রয়াত হয়েছেন। নির্মাতা-অভিনেতা জনাব কায়েস চৌধুরী ও সিনিয়র অভিনেতা এসএম মহসীন প্রয়াত হয়েছেন, যা আমাদের জন্য, কাঁটা টিম মেম্বরদের জন্য অত্যন্ত বেদনার। দু-এক দৃশ্যে অভিনয় করা পান্না ও গজেন’দা মারা গেছে। একজন সহকারী টুটুল, মারা গেছে। এই লেখা যখন লিখছি, আজ, ২৯ আগস্ট ২০২৩ তারিখে রংপুর থেকে কাঁটার লাইন প্রোডিউসার শুভ ফোন করে জানাল, পুরান ঢাকার বাপ্পি মারা গেছে গতকাল। বাপ্পি পুরান ঢাকায় বিভিন্ন গলির লোকেশন শনাক্ত করে দিয়েছে কাঁটার জন্য। বাপ্পির কথা মনে পড়ে গেল। শুভর বন্ধু ছিল বাপ্পি। খুবই শান্তশিষ্ট যুবক বাপ্পি, চলে গেল? কী অসুখ হয়েছিল ওর, এখনো জানি না আমি। আমার শুধু সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, যখন ও কাঁটা ক্যাম্পে এসে বলত, ‘চলেন, আজ আরও দুইটা গলি দেখাব, যা আপনি আগে দেখেননি। কাঁটা এইসব প্রিয় মানুষের কাছে ঋণী থেকে যাচ্ছে। মানুষের মৃত্যুর উপরে তো আমাদের হাত নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই।

কত কিছুই তো নেই। আছেও তো কত কিছু। এই নেই বা আছে নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা, জার্নি। আমরা প্রত্যেকেই কিন্তু নিজের নিজের মতো জার্নিতে আছি। তুমি হয়তো কোথাও যাচ্ছ, তুমি তোমার গন্তব্যে চলেছ, এটা তোমার জার্নি। আমিও কোথাও যাচ্ছি, এটা আমার জার্নি। আদতে আমি কাঁটা জার্নিতে আছি।

নেই নেই নেই, কত কিছু নেই। কত কিছুই তো নেই। আছেও তো কত কিছু। এই নেই বা আছে নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা, জার্নি। আমরা প্রত্যেকেই কিন্তু নিজের নিজের মতো জার্নিতে আছি। তুমি হয়তো কোথাও যাচ্ছ, তুমি তোমার গন্তব্যে চলেছ, এটা তোমার জার্নি। আমিও কোথাও যাচ্ছি, এটা আমার জার্নি। আদতে আমি কাঁটা জার্নিতে আছি। গ্রন্থে মুদ্রিত শহীদুল জহিরের গল্প কাঁটার চিত্রনাট্য রচিত হয় আমার হাতে, হয়ে সেটা মন্ত্রণালয়ে জমা পড়ে। প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়। তারপর সেই চিত্রনাট্য আরও বিস্তারিত হতে থাকে, আমার হাতেই হতে থাকে। দিনে দিনে চিত্রনাট্যের ডেভেলপমেন্ট ঘটতে থাকে। ২১তম ভার্সন যখন, তখন, অর্থাৎ এখন, আমরা দেখছি সেই চিত্রনাট্য শুটিং হচ্ছে। এখন বলতে কিন্তু এই ২০২৩ নয়, ২০১৮ কে নোটিস করছি। কয়েকশো পাত্রপাত্রী কাঁটার চিত্রনাট্যে, তারাই ভূতের গলির মহল্লাবাসী। তারাই আসে কুয়া দেখতে, তুলসীগাছ দেখতে। তাদের সঙ্গে এসব আমরা যেমন দেখতে পাই, কাঁটার দর্শকও তা দেখতে পাবেন।


p 19. 10

চিন্তামগ্ন সহকারী আর্ট ডিরেক্টর শক্তি ভৌমিক, সহকারী পরিচালক সৌরভ কর্মকার ও লাইন প্রডিউসার শুভ


আমি সেই চিত্রনাট্যের ভেতরে প্রবেশ করেছি, করেই আছি। আমার মনে পড়ে, কোথাকার এক শ্যামাপাখি তখন চিত্রনাট্যের ভেতরে ওড়াউড়ি করে। তারপর একদিন বা কোনো একদিন সেই শ্যামাপাখি, সেই তুমি, চিত্রনাট্যের আঙিনা ছেড়ে উড়ে যাও! চিত্রনাট্য থেকে বেরিয়ে তুমি কোথায় গেলে? হয়তো কাঁটা চিত্রনাট্য তোমাকে ডেকেছিল, তুমি কাঁটার অংশ ছিলে, যখন তুমি চিত্রনাট্য থেকে বেরিয়ে বাজারের দিকে গেলে তখন তো তুমি আর কাঁটার কেউ থাকলে না! কারণ, কাঁটা বাজার এড়িয়ে বানানো ছবি, এটা মনে রাখতে হবে। আমি বাজারের পণ্য চিনি না কাঁটার প্রশ্নে, তাই তোমাকেও চিনি না। নিশ্চয়ই চিনতাম একদিন, শ্যামাপাখি, যখন তোমাকে বাজারে পাওয়া যেত না, কাঁটাতে পাওয়া যেত। তাই চিনতাম, দোকানের প্রোডাক্ট হওয়ার পর আর চিনতে পারি না, চিনি না—এরকম ঝাপটানির বাতাবরণে হয়তো কেউ পড়তে পারে, আমিও পড়লাম। কিন্তু অর্গানিক টোন বজায় রাখতেই আমি বাজার এড়িয়ে কাঁটা নির্মাণে এসেছি, সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছি। যে কেউ চলে গেলেও আমি এই সিদ্ধান্তেই থেকে যাব। আমার পরিশ্রম বাড়বে, কষ্ট বাড়বে, এই তো? সে তো মেনেই নিয়েছি।

তবে কি বাজার-বিরুদ্ধতা আছে কাঁটার? আছে। কাঁটা বাজার এড়িয়েই নির্মিত ছবি। যখনই কারোর মধ্যে নিজেকে বাজারে বিক্রির প্রতিযোগিতায় নামতে দেখি, তখন তাকে তো অর্থেই কেনা যায়। অবশ্য আমি অর্থ সংগ্রহ করে রাখিনি। আরে, আমি তো অর্থ কেনার জন্য নিজেকে বেচতেই পারিনি। চাইওনি। ব্যাপারটা নীতিগত। কাজেই, কাঁটা নিয়ে আমি খুব সতর্ক থেকেছি বা থাকি এবং থাকব, বাজার ফ্লু যেন একে আক্রান্ত করতে না পারে। বাজারে গড়পড়তা চকচকে পণ্য পাওয়া যায়, জানি, এক্সক্লুসিভ কিছু পাওয়া যায় না, তাও জানি। মানুষও জানে। তুমি কি জানো? নিশ্চয়ই জানো! কাঁটাকে বাজার পণ্যের বাইরের কিছু করতে চেয়েছি বা চাই আমি। কাজেই, দর্শক হিসেবে আপনি যখন কাঁটা দেখবেন, আপনাকে আমি বাজারি প্রোডাক্ট দেখাতে বসাচ্ছি না, এ কথা অ্যাডভান্সই বলে রাখতে পারি। জী, বলে রাখলাম, কেন না, আমি তা বলতে পারি। আমি যা ভেবেছি তা বলতে পারি, আমি যা করেছি তা বলতে পারি। তাই বাজারের স্বাদ লাগা ঘ্রাণ কাঁটায় নেই, রাখিনি। বাজার, বাজার বলতে বাজারি প্রবণতার চরিত্রই সুনির্দিষ্ট করে বোঝাচ্ছি এখানে।


p 19. 3

এক সন্ধ্যায় সুবোধ-স্বপ্নার ঘরের চারপাশে জ্বলে ওঠে কয়েকশো মোমবাতি


এক সন্ধায় শত শত মোমবাতির আলোয় আলোকিত হয় সুবোধ-স্বপ্নার স্বপ্নের ভুবন। মোমের আলোয় কেমন দেখতে তারা, তা দেখতে হবে না বা দর্শককে দেখাতে হবে না? অন্ধকারে কয়েকশো মোমবাতি জ্বলে উঠলে কি জোনাকির মতো লাগে আলো? অবশ্য জোনাকি ওড়াউড়ি করতে পারে, মোমবাতি পারে না। মোম গলে গলে যায়, আলো জ্বলে। সেই আলো-আগুনের ছবি ধরতে চেয়েছি। তখন, স্বপ্নাকে কি আমাদের আকস্মিক রাধে রাধে লাগে? সুবোধের হাতেও তো কানুর বাঁশি দেখা যায়? আমরা কি তখন ভূতের গলিতে থাকি না আর? আমরা কোথায় যাই? আমরা কি যমুনা নদীতীরের কোনো গ্রাম দেখতে পাই? গ্রাম থেকেই তো এসেছে সুবোধ ও স্বপ্না। সিনেমা হলে চাকরি করে সুবোধচন্দ্র। বসবাস করে ভাড়াটিয়া হিসেবে ভূতের গলিতে, নারিন্দায়। এই শহর, এই মহল্লায় তাদের তো আর আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। বরং আছে মহল্লবাসী, আছে মহল্লাবাসীদের কৌতূহল। সুবোধ-স্বপ্না কি সেই কৌতূহলের শিকার হয় একদিন? নাকি কৌতূহলের চেয়ে বেশি কিছু জমা হয়! সেই বেশি কিছু কি পাবলিক মব? পাবলিক মব কাকে বলে? জার্নি অব কাঁটায় এত এত প্রশ্ন, প্রশ্নের পরে প্রশ্ন। প্রশ্নের শেষ নেই। উত্তর দেবে কে?

কাঁটা উত্তর দেবে। কাঁটা আপনার প্রশ্নের উত্তর দিক, আমি চেয়েছি। একই সঙ্গে কাঁটা আপনাকে আরও প্রশ্নের মুখোমুখি করবে, করুক তা চাই! এই প্রশ্নোত্তরের দোলাচলে আপনি দোলেন কি না, সে জন্যই তো আপনাকে ছবিটি দেখতে হবে। আপনি কাঁটা দেখছেন সেই দৃশ্য আমাকে দেখতে হবে। যার যেভাবে সুখ।


p 19. 5

অমন করে কারা যায় পেতলের কলসিকাঁখে নদীর দিকে


কাঁটা টিমের লোকেরা সহ্য করেছে আমাকে, কীভাবে করেছে? দলগত কোনো কাজে আমি শান্ত থাকতে চাইলেও পারি না। কেউ না কেউ যখন তুলনামূলক অকার্যকর থাকে, একটু দৌড়ালেই যখন একটা গুড রেজাল্ট বের হয়ে আসে, কেউ যখন ঝিমিয়ে পড়ে, তখন আমার শান্ত থাকার ইচ্ছা অটোমেটিক উধাও হয়ে যায়। আদিষ্ট হই, ক্ষেপে যাই আমি। বিশ্রী ভাষায় পরিবেশ অস্থির হয়ে ওঠে, সেই ভাষা নিক্ষিপ্ত হয় আমার মুখ থেকে। পরে আমি টের পাই, এভাবে রাগারাগি করলাম? অবশ্য রাগারাগি সুললিত ভাষায় হয় কি না, আমি জানি না। রাগারাগি ছাড়া দলগত কাজ আমার আর নামেই না। কারো নামে কি, বঙ্গদেশে? অবশ্যই এই রাগের জন্য আমি আমাকে অভিযুক্ত করি কিন্তু সেটা রাগারাগির পরে। ততক্ষণে রাগারাগি করে যাচ্ছেতাই করে ফেলা হয়তো হয়েই গেছে। চুপচাপ রাগারাগি করা যায়? হয়তো যায়, সেই যাওয়াটা আমার জানা নেই। প্রোডাকশন তো ধ্যানের জায়গা হয়নি এদেশে এখনো, এটা যথেস্ট লেবারি ওয়ার্ক। ইটভাটার শ্রমিকের মতোই ঘাম ঝরানো কাজ। কাজেই হয়নি মনে হলে তা মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। কোটি দর্শকের ভেতর থেকে কেউ প্রশ্ন করবে অনেক বছর পরেও, কাজের মান নেমে গেলে, এই ভাবনা তাড়িত করে আমাকে। তাছাড়া আমার নিজের কাছে যা অগ্রহণযোগ্য, আমার প্রোডাকশনে আমি তা হতে দিতে পারি না। আমার মেজাজই আমার প্রোডাকশন। মনে পড়ল, বেশ আগে প্রথম আলোর সঙ্গে এক ইন্টার্ভিউতে অভিনেত্রী অপি করিম একবার বলেছিলেন, ‘টোকন ঠাকুরের কবিতার ভক্ত আমি, অসম্ভব মেজাজ আছে তাঁর কবিতায়’— আমার ছবিতেও আমার মেজাজই দেখা যাবে। আমিও তো একজন দর্শক।

সামগ্রিক জীবন এগিয়ে যাওয়া এই সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে আমার যা ধারণা, তার প্রয়োগ তো ঘটবেই আমার কাজে। যখন তা দলগত হয়, সেইখানে সবাই তো আর একই রকম প্রস্ততি নিয়ে আসে না, আর আমি ধরেই নেই যে, এরা এ সবই বুঝবে, বুঝে সেই অনুযায়ী কাজ করবে। কিন্তু তা যখন হয় না, তখন আমার চিন্তার কাজ নেমে যায়, এটা দেখেই আমার রাগ হয়।

কবিতা পড়া, উপন্যাস পড়া, চিত্রকলা দেখা, নাটক দেখা, গান শোনা, নাচ দেখা, ভাস্কর্য দেখা, মানুষের নানারকম জীবন দেখা, চিন্তা অনুধাবন করা, ইতিহাস-ঐতিহ্য-রাজনীতি-ধর্ম-অর্থনীতি বা মানুষের বেঁচে থাকা, সামগ্রিক জীবন এগিয়ে যাওয়া এই সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে আমার যা ধারণা, তার প্রয়োগ তো ঘটবেই আমার কাজে। যখন তা দলগত হয়, সেইখানে সবাই তো আর একই রকম প্রস্ততি নিয়ে আসে না, আর আমি ধরেই নেই যে, এরা এ সবই বুঝবে, বুঝে সেই অনুযায়ী কাজ করবে। কিন্তু তা যখন হয় না, তখন আমার চিন্তার কাজ নেমে যায়, এটা দেখেই আমার রাগ হয়। সেই রাগের নামই মেজাজ। আহ মেজাজ! জয়তু মেজাজ মহারাজ। আমার রাগ-মেজাজই আমার প্রোডাকশন, তখন তাই মনে হয়। আমার রাগ-মেজাজই দৃশ্যগাথায় ধরতে হবে, এমন একটা তীব্রতার শিকার হয়ে পড়ি। কাঁটা টিমের লোকেরা নিঃসন্দেহে সেই তীব্রতার শিকার হয়েছে। হয়তো সেই রাগ নিতে পারে না সবাই। কেউ কেউ পারে, অথবা পারে না। সরে যায়।


p 19. 4

তিনটি আলাদা সময়ের ছবি কাঁটাতে অসংখ্য পিরিওডিক্যাল প্রপস ব্যবহার করা হয়েছে


শত শত পিরিওডিক্যাল প্রপস কাঁটাতে ঢুকেছে। সুবোধ-স্বপ্নাদের চরিত্রের সংখ্যাও একাধিক। ১৯৬৪ সালের যা কিছু প্রপস-কস্টিউম, তা কাঁটাতে ব্যবহার হয়েছে ৬৪ সালের সিনগুলোতে। ১৯৭১ সালের যা যা প্রপস-কস্টিউম, তা তো আর ১৯৮৯-৯০ সালে ব্যবহার হয়নি। সবই আলাদা আলাদা। এত এত চরিত্র কাঁটাতে, চরিত্রদের জামাকাপড়, ঘড়ি, চশমা, স্যান্ডেল-জুতা, আংটি, গয়নাগাটি সবই আলাদা। মেটেরিয়াল সময়ে সময়ে বদলে যাবে, তা স্বাভাবিক। কাজেই বিরাট একটা চাপ ছিল কাঁটা নির্মাণে। সেই চাপ নিয়েই আমরা কাঁটা নির্মাণ করেছি। কেন না, আমরা যেন পিরিয়ডটা ঠিকমতো ধরতে পারি, সেই চিন্তা মাথায় ছিল আমার। একই সিনেমার মধ্যে তিন সিনেমা কাঁটা অর্থাৎ এক গল্পের মধ্যেই তিনটি আলাদা আলাদা গল্প চিত্রিত এই ছবিতে। তাই ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না কোনোভাবেই। নানান লেয়ার আছে কাঁটাতে। বাংলাদেশ তো সব বিচারেই গরিব দেশ। এ দেশের লোকেরা জমির দলিল ছাড়া পুরোনো আর কিছুই সংগ্রহে রাখতে মনোযোগী নয়। দুই তিন প্রজন্ম আগের কোনো কিছুই যেন আমাদের সংগ্রহে নেই, এই বাস্তবতার মধ্যে এত জিনিস আত্মীকরণ করতে আমাদের অর্থ যেমন গেছে, সময় লেগেছে, পরিশ্রম গেছে, ধকল গেছে। কেন এসব গেল? একটাই কারণ—ঠিকঠাক একটি পিরিয়ডিক্যাল টোন-মাত্রা যেন আমরা ধরতে পারি। পিরিওডিক্যাল ছবি বাংলাদেশে আগে যা নির্মিত হয়েছে, আমাদের দর্শকের চোখে যেন তাদের দেখার অভিজ্ঞতায় বেশি কিছু সংযুক্ত করতে পারি।


p 19. 6

টেনশনে পড়ে গেছে সুবোধচন্দ্র দাস ও স্বপ্নারানী দাস, ১৯৭১


নদীর ধার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পেতলের কলসিকাঁখে সখিরা, কেন? স্বপ্না নদীতে নাইতে গেছে। স্বপ্নাকে নদীর ভেতরে ডুবে যেতে দেখছি আমরা। তিন স্বপ্নার মধ্যে একাত্তরের স্বপ্না বা তার স্বামী সুবোধচন্দ্র বেশি চাপে পড়ে যাওয়া ক্যারেক্টর। স্বামী-স্ত্রী এক বিছানায় শুয়ে থাকলেও টেনশনের মাত্রা এতই বেশি যে, তাদের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে যায়। যুদ্ধের মধ্যে ধরা পড়ার আতঙ্কে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তাদের দিনরাত পার হয়। কিন্তু অন্য দুই জোড়া সুবোধ-স্বপ্না আরেক রকম জীবন পার করে কাঁটা ছবিতে; এবং তিন সুবোধই সিনেমা হলে চাকরি করে। এই হচ্ছে অবস্থা। অবস্থার নাম কঠিন অবস্থা। কিন্তু ওই যে, ‘কঠিনেরে ভালবাসিলাম’ তাই কাঁটা গল্প নিয়ে ছবি বানানোর প্যাশন পশেছে মাথায়। এক্ষেত্রে আমারই বা আর কী করার থাকে! প্যাশনেট ছোকরা আমি। ফ্যাশনেট নই।

পুরান ঢাকায় কাঁটার শুটিং হয়েছে ৯৮ ভাগ, বাকিটা গ্রাম-নদী। মহল্লাবাসীরা ভূতের গলি ছেড়ে পালিয়ে যেতে চাইলে তারা বিভিন্ন গলি-উপগলি পার হয়ে নদীর দিকে যায়, নদী পার হয়। কিন্তু নদীর ওপারেও বেশিদূর আগানো যায় না, ‘চাইরোদিকে মেলেটারি।’ তাই তারা ফের ফিরে আসে ভূতের গলিতেই। আমাদের শুটিং চলতে থাকে টানা, আমরা আজিজ ব্যাপারীর বাড়িকে শুটিংয়ের মূল স্টেশন বানাই। ওখান থেকে পুরান ঢাকার অন্যান্য শুটিং শেষ করতে ব্যস্ত থাকি এবং ঢাকার বাইরে বড়ো বাসে করে দুইবার আমরা মুন্সিগঞ্জে যাই।

কাঁটা গল্পটি লেখা পুরান ঢাকার ভজহরি সাহা স্ট্রিট বা ভূতের গলির প্রেক্ষাপটে। কাজেই পুরান ঢাকার একটি মহল্লা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি ছিল ছবি বানানোর জন্য, তা আমরা করতে চেষ্টা করেছি। প্রায় ষাট-সত্তরটা পুরোনো বাড়ি, বাড়িগুলোর বয়স প্রায় দুই বা তিনশো বছরও, সেই বাড়িগুলো ধরেছি। কিন্তু ২০১৮-১৯ সালের বাস্তবতায় পুরান ঢাকায় তো ষাটের দশকে দেখা সেই বাড়িগুলো সারিসারি অবস্থায় আর নেই। একটি পুরোনো বাড়ির পরে দশ বা পনেরোটা বাড়ির পরে আবার হয়তো একটি পুরোনো বাড়ির অবস্থান। কোথাও কোথাও একটা পুরোনো বাড়ি পার হয়ে হয়তো পঞ্চাশটা নতুন বাড়ি, তারপর আবার একটা পুরোনো বাড়ি। সেক্ষেত্রে আমরা সারিসারি বাড়ি একটানা তো পাব না, পাইওনি। কাজেই কাঁটায় কাটা কাটা শট ধরতে হয়েছে। কিছু পুরোনো গলি ছিল হাতে, ক্যামেরা ঢুকেছে সেই গলি ও সেই পুরোনো বাড়ির সামনে। একটিও নতুন বাড়ি ধরিনি। কাঁটায় তো গত শতকের সিক্সটিজের পুরান ঢাকা, নতুন বাড়ি বা খাম্বা বা মোবাইল নম্বরযুক্ত সাইনবোর্ড বা নেমপ্লেট—এ সব থাকতে পারে না। নতুন প্রপস থাকবে কেন? ডিজিটাল প্যানা প্রিন্টের কিছু থাকবে কেন? এটা এত সহজ কিছু ছিল না আমাদের জন্য যে, ষাট-সত্তরটা পুরোনো বাড়িকেও শুটিংয়ের জন্য পাওয়া যাবে! আমি ফরাসগঞ্জ ছিলাম যখন, তখন থেকেই যোগাযোগ অব্যাহত রেখে যাচ্ছি বাড়ির মালিকদের সঙ্গে। আর্টিস্ট জয়দেব, ফরাসগঞ্জের বাবু ভাই, আর্টিস্ট শিবু কুমার শীল, অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান বিভিন্ন বাড়ির মালিককে আমার হয়ে বলে দিয়েছেন। আমি নিজেও কিছু বাড়ির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি যখন ফরাসগঞ্জে অপুদের বাড়িতে থাকতাম। অঙ্কুর প্রকাশনীর প্রকাশক মেসবাহ ভাইও এ ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন। কথায় কথায় মেসবাহ ভাই বললেন, ‘শহীদরা ধুপখোলা মাঠে খেলতে আসতে যখন হাইস্কুলে পড়ত।’ তিনি শহীদুল জহিরের কথা বলছিলেন। আরও সহযোগিতা করেছেন লেখক বুলবুল চৌধুরী, বুলবুল চৌধুরীর বন্ধু মোজাম্মেল ভাই, যার বাসা ছিল ফরিদাবাদ, হরিচরণ রায় রোডে। ওই জায়গাটা একদম মফস্বল শহরের মতো ছিমছাম, গলি দিয়ে টুং টাং রিকশা চলছে। পাশেই বুড়িগঙ্গা প্রবাহিত। ওটা একেবারে পোস্তাগোলা শ্মশানঘাটের নিকটে। অর্থাৎ কাঁটা ছবির মূল লোকেশন ভূতের গলি বা পুরান ঢাকা। যে ঢাকার বয়স প্রায় কয়েকশো বছর। কাঁটার ক্যারেক্টর সুবোধ ও স্বপ্না এই পুরান ঢাকাতেই ভাড়াটিয়া হয়ে এসেছিল বসবাস করার জন্য।


নদীতে শুটিংয়ের আগে পরিস্থিতির নিবিড় পর্যবেক্ষণ


সুবোধ-স্বপ্না এসেছিল নদীপাড়ের গ্রাম থেকে। আবার, বৃহত্তর বাংলাদেশ দেখতেও পুরান ঢাকার মতো নয়। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। তাই সুবোধ-স্বপ্না যেহেতু গ্রাম থেকে এসেছে, নদী পার হয়েই এসেছে, শহীদুল জহিরের কাঁটা গল্পে কোনো গ্রাম-ন্যারেশন সরাসরি না থাকলেও আমাদের ক্যামেরা গ্রামে গেছে, নদীতে নেমেছে। সেই গ্রাম ও নদী আমরা শুট করেছি মুন্সিগঞ্জের মালির অঙ্ক বাজারের পাশে মৃতবৎ পদ্মা নদী ও হলদিয়া বাজারের পাশের নদীতে। এমন এক জায়গায় চলে গেছি আমরা, খাম্বা ও মোবাইল টাওয়ার থাকবে না, এমন লোকেশনে, শেষে নদীর এপার ওপার আমরা শুটিংয়ের জন্য নিজেদের মধ্যেও কোনোরকম ফোন নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলাম না। সেটা আবার শুটিং ম্যানেজমেন্টের জন্য এক সমস্যা। সেই সমস্যায় পড়েছি আমরা। এছাড়া নরসিংদীর পলাশ থানার ভেতরে, ঘোড়াশাল নেমে একটি গ্রামে গেছি, সারা দিন শুট করেছি। প্রান্তরব্যাপ্ত ফাঁকা মাঠের মধ্যে একটি মাটির রাস্তা পাওয়া তো সহজ ছিল না, অনেক খুঁজে ওখানে পেয়েছিলাম। সেই গ্রামের নাম এখন আমার মনে নেই। গত শতকের ষাটের দশকের গ্রামান্তরের মাটির রাস্তা চেয়েছিলাম। কয়েক জায়গায় খুঁজে মনের মতো পাইনি কিন্তু ওখানে মিলেছে। আর শুটিং করেছি মাটির একটি বাড়িতে, নরসিংদীর জিনার্দীতে। ১৯৭১ সালের ঢাকায় আসার আগেই, সুবোধ-স্বপ্নার হয়তো বিয়ে হয়েছিল ১৯৭০ সালে। তখন তাদের সেই বিয়ের জন্য একটি মাটির বাড়ি খুঁজে পেলাম জিনার্দিতে। উঠোনে কলাগাছ পুঁতে সন্ধ্যায় হ্যাজাকের আলোয় বিয়ে। হ্যাজাক এনেছিল কাঁটার একজন সহকারী পরিচালক জ্যানেট অভী। হ্যাজাক এনেছিল পুরান ঢাকার রাইছাবাজার থেকে, ভাড়া করে। রায় সাহেব বাজারই কিন্তু রাইছাবাজার। যাই হোক, জিনার্দীতে শুটিংয়ের সময় হ্যাজাক দুইটা সচল থাকলেও বাকি দুইটা কেল্লা ফতে হলো। ২টা হ্যাজাক গোল্লায় গেলে কী হবে? সুবোধচন্দ্র দাস ও স্বপ্নারানী দাসের তো বিয়ে হলো বাকি ২টা হ্যাজাকের আলোয়। সুবোধ সনাতন ধর্মের নিন্মগোত্রের চরিত্র। হয়তো মুচি বাড়ির ছেলে, একটু ভদ্র করে যাকে লোকে বলে ঋষিপল্লীর ছেলে। মেট্রিক ফেল, তাই ঢাকায় গিয়ে খুব শহুরে কাঠামোর জীবনযাপন তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সিনেমা হলের চাকরি, তার মাইনে দিয়েই এক রুম ভাড়া করে তাদের সংসার শুরু হয়। সেভাবেই, ভূতের গলিতে আগত চরিত্রের সঙ্গে আমরা একটুকরো গ্রাম ও একপশলা নদী রেখে আসি কাঁটা ছবিতে। যতই কাঁটা খুব পুরাতন শহর-বাস্তবতার ছবি হোক, বাংলাদেশের ছবি তো! নদীমাতৃক দেশের ছবিতে নদী না থাকলে দেশখানি ধরা পড়ে নাকি?


p 18. 8

কাঁটার পাত্রপাত্রী এসেছেন সমাজের নানান পেশা থেকে


আমিও বড়ো হয়েছি এক গাঙের পাড়ে। গাঙের নাম কুমার। কুমার নদ। এদেশের নদীই আমাদের প্রথম ইশকুল। আমি মামাবাড়ি যেতাম নদী পার হয়ে। ঝিনেদা শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নবগঙ্গা নদী। যশোরে ভৈরব, কুষ্টিয়ায় গড়াই নদী। খুলনায় ছিলাম কয়েক বছর। খুলনাকে প্রতিদিন স্নান করিয়ে যাচ্ছে ভৈরব ও রূপসা। বাগেরহাটে বন্ধু সনাতনদের বাড়িতে গেলাম, ওদের বাড়ির পাশে রায়মঙ্গলা নদী। এ সব আমার ছেলেবেলায় দেখা নদী। বাংলাদেশের গঞ্জ-বাণিজ্য সম্ভার একদা গড়েই উঠেছিল নদীপাড়ে। বাংলাদেশের গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে শুনি, গানের ভেতর দিয়ে ভেসে আসে—’এখানে রমণীগুলো নদীর মতো, নদীও নারীর মতো কথা কয়।’ তাই নদীকে এড়িয়ে বাংলাদেশের ক্যানভাস সম্পূর্ণ হতে পারে না। কুসুমকুমারী দাশের ছেলে তো বড়ো কবি, লিখেছেন না, ‘রাই সর্ষের ক্ষেত, তারই পাশে নদী, নদী তুমি কোন কথা কও?’ কাজেই, কাঁটাকেও নদীহীন করতে পারি না। করিনি তো! নদীই তো কত উপন্যাস-ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে গেছে বাংলায়। অন্যত্রও, অন্য ভাষাতেও নদী নানানভাবে সাবজেক্ট হয়ে আছে। কবিতা ও গানে নদী তো বিরাট অধ্যায়। তাই কাঁটাতেও নদী প্রবেশ করেছে। খরচাপাতি হয়েছে বটে এসব কিছু করতে গিয়ে, একেবারে নদীর মধ্যে জলে ভাসমান চরিত্রকে ধরতে কার্পণ্য করিনি আমরা।

নদীতে নামলেও আমাদের কাহিনি কিন্তু পুরান ঢাকার, ভূতের গলির। গলির মোড়ের সেলুন ঘর বা চা-পুরির দোকান এবং ঘুরে ফিরে আজিজ ব্যাপারীর বাড়ি, বাড়ির উঠোন, সিঁড়ি, ও ছাদই আমাদের সেন্ট্রাল লোকেশন।


polayon por mohollabasi

২৭ মার্চ ১৯৭১, কারফিউ শিথিল করায় ভূতের গলির পলায়নপর মহল্লাবাসী


নারিন্দা কাঁটা ক্যাম্প থেকে আমাদের স্বপ্নারা শাঁখারী বাজারে গিয়ে বেছে বেছে নিজেদের অলংকার কিনে এনেছে। দিন দিন হাতের শাঁখাও তো নকাশায় কিছু পরিবর্তিত হয়ে গেছে বা যাচ্ছেই। আমাদের লাগবে কাঁটার তিন সময় অনুযায়ী যে ডিজাইন বা সে সময়ে যে নকশা ছিল, সেরকম। শাঁখা অবশ্য খুব পরিবর্তনের মধ্যে যায়নি তেমনভাবে, এখনো সামুদ্রিক শঙ্খ থেকেই শাঁখা হচ্ছে। তবে অন্যান্য অলংকারে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এটা আমরা খেয়াল করেই ব্যবহার করেছি। তবে পোশাকে পরিবর্তন হয়েছে যথেষ্ট। জগতই পরিবর্তনশীল। মানুষ নিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই আজকের অবস্থানে এসেছে। তবু সব মানুষ কি একই সঙ্গে সমপরিমাণ পরিবর্তনে যায়? না। যায় না। শ্রেণী থেকে শ্রেণী, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির জীবন একই সময়ের হয়েও আলাদা হয়ে থাকে। সবার অর্থনৈতিক কাঠামো, শিক্ষা কাঠামো এক হয় না। আমাদের স্বপ্নারা মুচিবাড়ির ছেলের বউ হলেও তারা তো আর গ্রামের বাসিন্দা থাকে না, তারা গ্রাম থেকে শহরে চলে আসে। স্বপ্নাদের ‘সুয়ামিরা’ সিনেমা হলে চাকরি করে। তাই সিনেমা সিনেমা ফ্লেভার কিছু থাকেই তাদের জীবনে। এ সব আমরা খেয়াল করেছি। কাঁটা টিমের সবাই তা মনোযোগ দিয়েই নির্মাণে নেমেছিল। হয়তো তখন খেয়ালের অন্তর্গত জলাধারে ছিল এক বালিহাঁস, আমি সেই বালিহাঁসের কথা তো লিখিনি কিছুই, অথচ জার্নি অব কাঁটার আনুষ্ঠানিক প্রি-প্রোডাকশন থেকে প্রোডাকশন পিরিয়ড পর্যন্ত কি বালিহাঁস ছাড়া এগিয়েছে? বালিহাঁসটা বালিকা বালিকা। একটা পর্ব কি আমি সেই বালিহাঁস-বালিকার কথা লিখতে পারি? লিখতে কি পারব? কারণ, আমাকে বালিহাঁস তার ডানায় চড়িয়ে কোথায় যে নিয়ে গেছে, আমি বালিহাঁসটিকে কোথায় কীভাবে খুঁজে পেয়েছি, কীভাবে বুকের মধ্যে পেয়ে সারা রাত না ঘুমিয়ে জেগে তারপর আবার কীভাবে উড়ে গেছে কোন দিকে, সবই কি লেখা যাবে জার্নিতে? কেন যাবে না? কী-বোর্ড তো লিবার্টি অর্জন করেছে আমার, বাংলাদেশে, নাকি? তাই বালিহাঁসের ঠোঁটে আমি শস্যদানা হয়ে গেছি, বালিহাঁসও কি আমার বুকের মধ্যে কুই কুই করে ঘুমায় না?…এই, এ সব কী হচ্ছে? কিছুই হচ্ছে না। নাকি হচ্ছে? হলে কী হচ্ছে? কেন হচ্ছে? কেমন করে হচ্ছে? হচ্ছে মানে কী হচ্ছে? কী হচ্ছে মানে লিখতে লিখতে লেখা কোথায় চলে যাচ্ছে? লেখা কি আমাকে নির্জন বনভূমির পাশে ঝিলের ধারে নিয়ে যাচ্ছে? ওখানে যাচ্ছি কেন আমি?


p 19. 8

শুটিং চলছে নারিন্দা, সূত্রাপুর, ফরাসগঞ্জ, গেণ্ডারিয়া, মামুর মাজারের মোড়সহ নানান লোকেশনে


বললাম না, বালিহাঁস? বালিহাঁসের কথা আমি ভূর্জপত্রে লিখব। মোবাইল ফোনে টেক্সট আদান-প্রদানকালে আমি ভূর্জপত্র কোথায় পাব?

তবে বিধান কি আমাকে টাকা দিচ্ছে না ডলার দিচ্ছে? বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ খালি হয়ে যাচ্ছে পত্রিকায় পড়ছি, সেই ডলার কি মেরে দিয়ে বিধান আমাকে দিচ্ছে? অন্য কোথাও দুই লাইন কিছু লিখলেও টাকা কত দেবে, তা আমার আগেই জানা থাকে। ‘শ্রী’ তো এখনো বাজারের বিজ্ঞাপন-নির্ভর লাভজনক কিছু নয় তাও ‘কত করে দিচ্ছে পর্ব অনুযায়ী’, এই প্রশ্ন আমাকে নিতে হচ্ছে।

এই পর্বে আরেকটি কথা আমি উল্লেখ করতে চাই। ‘শ্রী’তে জার্নি অব কাঁটা লিখে প্রতি পর্বে আমি কত করে পাচ্ছি? কত টাকা আমাকে ‘শ্রী’ সম্পাদক বিধান সাহা দিচ্ছে—ইদানীং এরকম প্রশ্নে আমাকে পড়তে হচ্ছে। প্রিয়জনেরাই এ প্রশ্ন করছেন। আর কত পর্ব লিখব, সেই প্রশ্নও করছেন। হয়তো অনেক টাকা দিচ্ছে আমাকে বিধান, আর কত পর্ব লিখব তা আমি জানি না। লেখা যতদূর যায়, আমিও যাব। আপাতত ভাবনা এই, কাঁটা রিলিজের কিছু দিন আগেই জার্নি লেখা বন্ধ হবে, সে আর বেশি দিন নেই। পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজ চলছে, এখন কয়েকটি গীত রেকর্ড করতে হবে। জার্নি অব কাঁটা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তখন অন্যান্য গণমাধ্যমে ছবির সার্বিক প্রচারণা করা হবে। তবে বিধান কি আমাকে টাকা দিচ্ছে না ডলার দিচ্ছে? বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ খালি হয়ে যাচ্ছে পত্রিকায় পড়ছি, সেই ডলার কি মেরে দিয়ে বিধান আমাকে দিচ্ছে? অন্য কোথাও দুই লাইন কিছু লিখলেও টাকা কত দেবে, তা আমার আগেই জানা থাকে। ‘শ্রী’ তো এখনো বাজারের বিজ্ঞাপন-নির্ভর লাভজনক কিছু নয় তাও ‘কত করে দিচ্ছে পর্ব অনুযায়ী’, এই প্রশ্ন আমাকে নিতে হচ্ছে। এতে খুব বিচলিত হওয়ার কিছু নেই, বরং তাঁরা হয়তো আমার প্রতি তাদের ভালোবাসাই ব্যক্ত করছেন। ভালোবাসা টাকা দিয়ে মাপা যায় না, যে কেউই জানে। তাহলে সম্পূর্ণ ভালোবাসাতেই গড়ে তোলা বিধান সাহার ‘শ্রী’ আমাকে কত টাকা করে দিচ্ছে, এই প্রশ্নও অবান্তর হয়ে যায়, তাই না?

ভালো থাকবেন বন্ধুরা। আগামী পর্বের দিকে তাকিয়ে আছি আমি, জানি না, কী লেখা হবে! জানি না, কী পড়বেন আপনি। আগে তো লিখতে হবে, তারপরেই না পড়তে পড়তে জানা যাবে সে সব কথা! তাই শুধু টাকা টাকা করবেন না তো, টাকাকে উলটে দিন, ক এর ওপর আলগোছে একটা চন্দ্রবিন্দু বসান, দেখবেন টাকা আর টাকা নেই, টাকা কাঁটা হয়ে গেছে। কাঁটা নিয়েই তো কথা হচ্ছে, টাকা নিয়ে তো নয়! জয় হোক, ভালোবাসার জয়।


আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৫ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৬ষ্ঠ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৭ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৮ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৯ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১০ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১১
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১২
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৩
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৪
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৫
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৬
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৭
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৮


কাঁটা প্রোডাকশন ফটোগ্রাফি : হোসেইন আতাহার

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস:  ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।