ফরাসগঞ্জের কিছু বাড়ি ও গলির চেহারায় প্রায় তিনশো বছরের বেশি সময়ের স্মৃতি ছুঁয়ে আছে। একদা ফরাসিদের কলোনি গড়ে ওঠাকে কেন্দ্র করে এই নামকরণ—ফরাসগঞ্জ। এর এক পাশে সূত্রাপুর থানা কমপ্লেক্স, অন্যপাশে শ্যামবাজার—পেঁয়াজ রসুনের আড়ত ও কাঁচাবাজার। তারই পাশ দিয়ে প্রবাহিত বাঁধ ও বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গার ওপারে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ। ওপারে বিরাট বিরাট জাহাজ ও কার্গো নির্মাণ-মেরামত চলছে। এক মুহূর্তে মনে হতে পারে, বুড়িগঙ্গার ওপারটা কোরিয়ান কোনো ছবির সেট। ফরাসগঞ্জের উলটিনগঞ্জ ঘাট থেকে এখনো, এই ২০২৩ সালেও সারাদিন খেয়া নৌকা পারাপার বহাল আছে। পাঁচ টাকায় নদী পারাপার, অবশ্য ঘাটেও পাঁচ টাকা চার্জ। অদূরে পোস্তাগোলা ব্রিজ চোখে পড়ে; কিন্তু এখান থেকে বুড়িগঙ্গার ওপারে নৌকায় যাওয়া আসা তুলনামূলক সহজ বলেই এখনো খেয়া ঘাট টিকে আছে। শতখানেক নৌকা চলছে। মানে কিছু মানুষের জীবিকা এখনো নৌকা, ঢাকা শহরের নদী বুড়িগঙ্গায় তাদের রুটি-রুজি-বেঁচে থাকা! কারণবশত এবং সাময়িক হিসেবেই আমি ফরাসগঞ্জে যখন বসবাসের জন্য আসি, তখন শীতকাল। বুড়িগঙ্গা শুকিয়ে আছে। এরমধ্যেও বড়ো বড়ো লঞ্চ, যাত্রীবাহী জাহাজ কিংবা মালবাহী কার্গো চলাচল করছে। সন্ধ্যার পর থেকেই মূলত বরিশালগামী, চাঁদপুরগামী বা খুলনাগামী জাহাজ ছেড়ে যায়। ভোরে আবার ঢাকায় ঢোকে সেসব জাহাজ। আমি উলটিনগঞ্জ বাঁধের নৌকাঘাটে বসে দেখি সন্ধ্যার বুড়িগঙ্গা, দূরে সদরঘাটের আলো ঝিকিমিক করে। নদীতীরে রাত হয়ে যায়। এ কথা সত্য, শুধু ‘কাঁটা’র জন্যই আমার পুরান ঢাকায় আগমন ও বসবাস শুরু। এবং আমার সার্বক্ষণিক সহকারী হিসেবে গজেন’দা নিযুক্ত। ফরাসগঞ্জে অপুদের বাড়িতে উঠলাম, বসন্ত কুমার দাস রোডে, বাড়িটার বয়স ২০১৭ সালেই ২৭৮ বছর।
ঢাকা শহরের পত্তনকালের দিকে গড়ে উঠেছে ফরাসগঞ্জ। ওখানে এখনো কিছু প্রাচীন বাড়ি টিকে আছে, আর আছে কালীচরণ সাহা রোডে; তবে ক্রমশ ডেভেলপারদের হাতে চলে যাচ্ছে। তারপর বহুতল বিশিষ্ট নতুন বিল্ডিং উঠছে। অপুদের বাড়ির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, চিপা গলি দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে যেমন দোতলায় উঠে যাওয়া যায়, বাড়ির ভেতরেরই এক কোণে চিপা কায়দায় আরও একটা চিপাময় মাথা নিচু করে হেঁটে যাওয়ার একটা লাইন বা উপগলি আছে। যে উপগলি শুধু একজন মানুষের শরীরের সমান জায়গা নিয়ে চলে গেছে আরও ভেতরের দিকে। অন্ধ প্রকোষ্ঠ নাকি? দিনেও অন্ধকার। এবং সেই চিপার মাথায় আরেকটি হিডেন বাড়ি। দুই রুমের। মাঝখানে এক চিলতে উঠোন। তখন গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন সেই অংশে। পানির লাইন বিচ্ছিন্ন। একটা বিচ্ছিন্ন কেবল লাইন সংযোগ করে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে আমি এখানে উঠব বলে। উঠোনের কোনা দিয়েও একটা হেঁটে যাওয়ার লাইন বা আরও উপগলি। নাকি কুপগলি? একজনের শরীরের সমান জায়গা নিয়ে কুপগলি, সেই কুপগলি ধরে হেঁটে গেলেই টয়লেট। বাড়ির বয়সী প্রাচীন টয়লেট, দরজা নেই। তবে দেয়ালটা এমনভাবে বানানো যে, টয়লেটে বসলে অর্ধেক খোলা থাকবে, অর্ধেক দেয়ালে আড়াল দেবে। অন্য কেউ চিপা লাইন বা এই কুপগলির মাথায় একই টয়লেট বরাবর আসছে দেখলে আগেই বসে থাকা লোকটি গলায় একটা খাঁকারি মারলেই সে আর এগুবে না। গলার আওয়জ হচ্ছে ট্রাফিক সিগন্যাল। মানে তুমি আর আইসো না, একজন তো অলরেডি টয়লেটে অবস্থান করছেই। এরকম কায়দার টয়লেট আমি দেখেছি শতবর্ষ প্রাচীন এসব বাড়ির অভ্যন্তরে এখনো টিকে আছে। সূত্রাপুর, ফরাসগঞ্জ, কাগজিটোলা, নারিন্দা, শরৎগুপ্ত রোড, র্যাংকিন স্ট্রিট, দক্ষিণ মৈশুণ্ডি, লক্ষ্মীবাজার, শিংটোলা, ঢালকানগর ইত্যাদি এলাকা বা ভূতের গলিতে আমি এরকম টয়লেট দেখেছি। অপুর জীবন বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে থাকা। আদিতে অপুরা টাঙ্গাইলের মানুষ। ইটালি-প্রবাসের এক যুগ কাটিয়ে আসার আগে অপু যখন বাম ঘরানার ছাত্র সংগঠনে ঢাকায় সক্রিয়, সেই সময় বা তার কিছুটা আগেও হতে পারে—আমারও কেটেছে কিছুকাল মফস্বলে, একই সংগঠনের ঝুলবারান্দায়। যাই হোক, আমি অপুদের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হয়ে উঠে পড়লাম। প্রায় পনেরো বছর পর এক পরিত্যাক্ত অংশ ভাড়া হলো নতুন করে, আমাকে দিয়ে। বড়ো কয়েকটা ইঁদুর চোখে পড়ল। চোখে পড়ল একটা বিড়াল। হুলো, না হুলি? প্রথম দিন সেটা বুঝতে পারিনি। পাঁচিলের দেয়াল দিয়ে একটা বানর হেঁটে গিয়ে মিট করল আরেকটা বানরীর সঙ্গে। বানর চুমু খাচ্ছিল তার গার্লফ্রেন্ডকে। নিজের চোখে দেখলাম। তখন বাড়ি-ঘরদোরের অবস্থা দেখে বা দেখিয়ে অপু আমাকে সান্ত্বনা দিল, ‘ও মানুষ থাকলি দুইদিনেই পরিত্যাক্ত ভাব চলে যাবে। তবে চুনকাম করানো লাগবে। দেখি, কী করা যায়!’
আমি অপুদের বাড়ির সেই হিডেন কম্পাউন্ডে যখন উঠি, তখন অপুর বাবা বেঁচে ছিলেন। তিনি ওয়ার্কাস পার্টির কমরেড। আর অপুর বউ-বাচ্চা থাকে দোতলায়। অপুর বাবা একদিন আমাকে ডাকলেন, বললেন, ‘পুরান ঢাকা নিয়ে সিনেমা বানাইবেন, পুরান ঢাকারে দ্যাখছেন?’
বললাম, ‘দেখতেই আসছি।’
কমরেড প্রশ্ন করেন, ‘আপনের বাড়ি কই?’
‘ঝিনাইদহ।’
সিনিয়র সিটিজেন অপূর্বর বাবা কমরেড আমাকে বললেন, ‘ও যশোর! আপনে তো তাইলে পুরান ঢাকার ভাছা জানেন না!’
‘না।’
‘হুনেন, কয়ডা ক্যালা ক্যাঠা বহায়া দিলেই হয়া যায় না। পুরান ঢাকার ভাছা মিয়া ভাছা না, বাজনা, টোকা দিলে বাজে।’
এই পর্যন্ত আলাপের পর আমি একটু সাহস দেখাই সিনিয়র কমরেডকে, বলি, ‘আমার গল্পের লেখক জন্মাইছেন ভজহরি সাহা স্ট্রিট, ভূতের গলি।’
‘হালাই ভি রাইটারের নাম কী?’
‘শহীদুল জহির।’
‘ছহিদুল জহির? নাম ছুনি নাইক্কা।’
এবার আমি বলি, ‘হুনেন, হ্যায় কিন্তু বড়ো রাইটার। বহুত ম্যাজিক দেখাইছে লেখার মধ্যে।’
কমরেড চোখ বড়ো করে ফেললেন, ‘হাঁচাই?
‘হুম, হাঁচাই।’
কমরেড চুপ করে আছেন দেখে আমিই তাঁকে প্রশ্ন করি, ‘আমার কতা বুজা পারছেন?’
‘হুম, পারতাছি।’
আলাপ চলত আমার, এই সিনিয়র সিটিজেনের সঙ্গে। চলাফেরা প্রায় বন্ধ তাঁর, তাই সারা দিন শুয়েই থাকতেন। সত্যি, ঢাকার বাইরে থেকে যারা ঢাকায় পড়তে আসে, পড়ালেখা শেষে চাকরি বা ব্যাবসা যাই করুক, তারা বসবাস করতে থাকে ঢাকায়। সেই ঢাকা পুরান ঢাকা না। নতুন ঢাকা। দুইটা দুই সংস্কৃতির শহর। নতুন ঢাকা ঠিক তার কোনো সুনির্দিষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত নয়, কারণ, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন বাংলা ভাষার মানুষ তারা। এক ফ্ল্যাটে সিলেটি তো আরেক ফ্ল্যাটে নোয়াখালীর মানুষ নতুন ঢাকায়। এক অঞ্চলের লোক শুটকি মাছ পছন্দ করে তো অন্য অঞ্চলের মানুষ কেউ শুটকি মাছ রান্নার ঘ্রাণেই বমি করে ফ্যালে। কিন্তু পুরান ঢাকার চরিত্র চিহ্নিত। ভাষাও প্রায় এক। ঢাকাইয়া ভাষা। তবু পুরান ঢাকার ভাষার ধ্বনিমাধুর্য নিয়ে হাসাহাসি করে বাইরে থেকে এসে ঢাকায় বসবাসকারী বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষিত মানুষরা। এরকম পদ্ধতির শিক্ষা যে শিক্ষা হয়নি, শিক্ষা হয় না, তা এরকম ‘হাসাহাসি’র দৃষ্টিভঙ্গিতেই নিহিত আছে। অথচ ঢাকা বলতেই আদিতে পুরান ঢাকা। নতুন ঢাকায় তো কেউ ঢাকার লোক নয়, সারাদেশের লোক, ঢাকার বাইরের লোক, জীবিকার জন্য এসে থেকে যাওয়া আর কি! কিন্তু পুরান ঢাকায় তো তারা প্রায় নব্বুই ভাগই স্থায়ী বাসিন্দা, বংশ পরম্পরা তাদের পুরাণ ঢাকাতেই। মহল্লা পঞ্চায়েত দ্বারা পরিচালিত। কাজেই উভয়পক্ষের মানসিকতাও এক নয়। যে জন্য ইদানীং আদি ঢাকাবাসী বা আমরা ঢাকাবাসী বলে সংরক্ষণবাদী সাংগঠনিক তৎপরতাও চোখে পড়ে আমাদের। পুরান ঢাকার ভাষা নিয়ে অপুর বাবার কথাটি আমি চিত্রনাট্যে এডাপ্ট করেছি বাড়িওয়ালা আবদুল আজিজ ব্যাপারী চরিত্রের একটি সংলাপে। আমি কৃতজ্ঞ কমরেডের কাছে। কী কথা, ‘পুরান ঢাকার ভাছা মিয়া ভাছা না, বাজনা’। এরকম শ্লাঘা ভার্সাই থেকে ফেরা রাজনারায়ণ দত্তের ত্যাজ্যপুত্র গৃহত্যাগী মধুসূদনও দেখাননি।
সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে হলো, ফরাসগঞ্জে। বাড়ির যে অংশে উঠেছি, তা তো পরিত্যাক্ত। কাজেই বালতিতে করে পানি টেনে আনতে হতো বাড়ির প্রথম অংশের ভেতর থেকে। ছোটো বালতিতে করে পানি এনে এনে উঠোনে রাখা বড়ো বালতি ভরাট হলেই গোসল সারা যেত। অর্থাৎ ‘আমিও কি টানিনি বালতিতে জল?’ গ্যাস তো নেই। গজেন’দা বলল, ‘টাকা দ্যাও, অপু যদ্দিন গ্যাস লাইনের ব্যবস্থা না করতে পারতেছে, তদ্দিন আমি একটা কেরোসিন স্টোভেই রান্নাবান্না করি। টাকা দ্যাও, স্টোভ কিনে আনি, কেরোসিনও তো লাগবে।’ কিন্তু স্টোভের রান্না খেতে গিয়ে দেখলাম, খাবারে একটা কেরোসিন কেরোসিন ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকা শহরে থেকেও, ২০১৭ সালে যে স্টোভে কেরোসিনে রান্না করে খেতে হবে, এটা এখানে আসার আগে তো ধারণার মধ্যেও আসেনি। অবশ্য অব্যবহৃত প্রায় পরিত্যাক্ত দেখে আমিই সেধে ভাড়া নিয়েছি। কাউকে অভিযুক্ত করার নেই আমার। গজেন’দা নিজে থেকে ফোনে মেসেজ দিয়ে অ্যাপ্লাই করেছে, ‘সঙ্গে থাকতে চাই, কাজ করতে চাই।’ উনি আমার বয়সে সিনিয়র। অভিনেতা ও টেলিভিশন ফিকশন নির্মাতা কচি খন্দকারের দুইটা টেলিভিশন সিরিয়ালে গজেন’দা গজেন্দ্রগমন নামে অভিনয় করে কিছু মহলে তার একটা পরিচিতিও অর্জন করেছে। আমি ফরাসগঞ্জে আসার আগে তো কয়েক মাস শংকর-জাফরাবাদ ছিলাম, শংকর থেকে এখানে আসার এক সপ্তাহ আগেই গজেন’দা আমার একজন সার্বক্ষণিক সহকারী হিসেবে রিক্রুট হয়েছে। গজেন’দার থাকা-খাওয়া সব আমার উপরে। বোনাস হচ্ছে, গজেন’দা জানাবোঝা লোক, আলোপাতা খুব মসৃণ করে কাটতে পারে। স্ক্রিপ্ট কারেকশনেও তার সহযোগিতা বুদ্ধিবৃত্তিক। আহ, গজেন’দার হাতের লেখা ছিল কী সুন্দর! সত্যিই সুন্দর। মুক্তদানার মতো ঝকঝকে বলে না, সেই রকম? এরই মধ্যে, গতবছর গজেন’দা মরে গেছে, মাগুরায়। মাগুরাতেই ছিল বাড়ি। অক্টোবরের ৮ বা ১০ তারিখে, ২০২২ সালে। শামস সুমনদের উদ্যোগে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গজেন্দ্রগমন স্মরণ সভা হয়েছে। সেখান থেকে আমাকে ফোন করে সব জানিয়েছে অভিনেতা কচি খন্দকার। গজেন্দ্রগমন নাম তার, একদিন শুনলাম শাহবাগেই, কার কাছে তা মনে নেই। প্রধানত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা রমনা কালীমন্দিরই গজেন’দার গমনাগমনের জায়গা হলেও ছবির হাট, জগন্নাথ হলের মাঠ, মন্দির, মাঠের গ্যালারি বা নানান মন্দিরে মন্দিরে কাটাত। কিছুকাল লালবাগ-মোহাম্মদপুর বা অন্য আবাসিক অঞ্চলেও তার থাকাথাকি হতে পারে। ঢাকার বাইরে গাজীপুরেও ছিল কিছু দিন। মাঝেমধ্যে গাজীপুরে যেত। কয়েক দিন পর দেখতাম, আবার সে শাহবাগ প্রান্তর ছাড়িয়ে পাবলিক লাইব্রেরির সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছে। গজেন’দা কোথায় যাচ্ছে? আপাতত উদ্যানে। অবশ্য অনেক বছর আগে থেকেই আমি তাকে চিনি, তিনি সনৎকুমার শিকদার। বাড়ি মাগুরার মোহাম্মদপুরে হলেও সনৎ’দা থাকত ঝিনেদায়। আমি যখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি ঝিনাইদহ সরকারি কেশবচন্দ্র কলেজে, ছাত্রাবাসে থাকি, সেই কলেজেই সনৎ’দা পড়ত বিএ ক্লাসে। বাইসাইকেলে চালিয়ে টিউশনি করতে তার যাওয়া আসা দেখতাম। কথাও হতো একটু-আধটু। এরপর বহুবছর বাদে আবার তাকে ঢাকায় পেলাম গজেন্দ্রগমন হিসেবে। অতএব সেই সনৎ’দা-ই পরবর্তীতে কচি ভাইদের বানানো গজেন’দা, আমার সহকারী হিসেবে ফরাসগঞ্জে থাকল কয়েকমাস। তো কেরোসিন স্টোভের রান্না খেতে ভালো লাগছিল না, না লাগলেও গ্যাসের লাইন যে কদিন না পাই, কেরোসিনই খেতে হবে। অপুদের বাড়ির সামনেই, কয়েকবাড়ি পর বিহারীলাল জিউ মন্দির। সেই মন্দিরে সকাল-সন্ধ্যা কীর্তন অর্চনা হয়। দেখলাম, ৪ দিনের কীর্তন যজ্ঞ শুরু হয়েছে। দুপুরে ও রাতে মন্দিরের ভেতরে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে দুই-তিনশো ভক্তকুল খাবার নিচ্ছে, খাচ্ছে মন্দির প্রাঙ্গণে বসেই। আর গজেন’দা তো আগে থেকেই মন্দিরে মন্দিরেই ঘোরা বিবাগী মানুষ। বললেন, ‘শোনো, অপুর কথা অনুযায়ী গ্যাসের লাইন তো এক সপ্তাহেও সেট হলো না। তুমার খাওয়াও অসুবিধে হচ্ছে। বলতেছ, কেরোসিনের গন্ধ। কই, আমি তো পাইনে। এখন তুমার যদি সমস্যা না হয়, চলো মন্দিরে যাই, লাইনে দাঁড়াই। আগামী ৪ দিন অষ্টপ্রহর নামযজ্ঞ, দুপুরে ও রাতে খাওয়া-দাওয়া ফ্রি। খাবা? তাইলে লাইনে চলো।’
বললাম, ‘আপনি যান। মন্দিরে খান। আপনি তো মন্দিরের লোক। আমি মন্দিরের ফ্রি নিরামিষ খেতে পারব না।’
গজেন’দা চলে গেল জিউ মন্দিরে, কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল, ‘দেকে আলাম; এত লোক কেউ কারো চিনবিনানে।’ এদিকে পেটে খিদে নিয়ে কতক্ষণ আর কুলীনগিরি দেখানো যায়? এক ধরনের জড়তাগ্রস্থ মন নিয়ে আমি গজেন’দার সঙ্গে গিয়ে দাঁড়ালাম বিহারীলাল জিউ মন্দিরের ভেতরে। দেখি, ভক্তকুলের খিদে পাওয়া মানুষের লাইন দাঁড়িয়ে গেছে। আমি ও গজেন’দা গিয়ে লাইনের শেষে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের পেছনেও অনেক ভক্ত দাঁড়িয়ে গেল। আমি কি তখন খুব বেশি অনভ্যস্তার শিকার হচ্ছিলাম লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায়? একটা ট্যাবু আমাকে আটকে লজ্জিত করে দিচ্ছিল না? একটা সামাজিক জড়তাও কি হচ্ছিল না আমার মধ্যে? গজেন’দা সেটা বুঝতে পেরে সান্ত্বনা দিচ্ছিল বারবার, ‘শোনো, ছিনেমা বানাতি আইচ না পুরনো ঢাকায়?’ আমি আমার সামনে দাঁড়ানো গজেন’দার চোখের দিকে তাকালাম, গজেন’দা হাসে আমাকে দেখে, বলে, ‘আরে, মন্দিরে মন্দিরেই তো খাইয়ে বাঁচে আছি কতবছর। চুপচাপ থাকো। আর মাত্র ১৭ জন আমার সামনে সিরিয়ালে আছে। আমি আঠারো। তুমি উনিশ…’ হঠাৎ আমাকে পেছন থেকে কেউ ডাক দিল, আমি ঘুরে তাকালাম সেই দুপুরের মন্দিরের ভেতরে খাবারের লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায়, অনেক লোকের ভেতর থেকে একজন আমাকে ডাকতেছে। একজন খুব অবাক হয়ে বলতেছে, ‘আরে টোকন দা, আপনি এইখানে, এই লাইনে দাঁড়ায়ে কী করতেছেন?’ দেখি, জয়দেব দাঁড়ানো। জয়, আর্টিস্ট। শাহবাগে চারুকলার সামনে জয়কে অনেক দেখেছি তরুণ ঘোষ-সুলেখা চৌধুরীদের সঙ্গে আড্ডা দিতে, খুব বেশি কথা হয়নি আমার সঙ্গে। জয় আমাকে দেখে আশ্চর্য, কিছুতেই বুঝতে পারতেছে না যে, আমি বিহারীলাল জিউ মন্দিরের মধ্যে খাবারের লাইনে কেন দাঁড়ানো আছি! জয় ওই মন্দিরের উৎসব আয়োজকদের একজন। ধরা খেয়ে গেলাম জয়ের কাছে। জয় আমাদের দুজনকে লাইন থেকে বের করে নিয়ে গেল মন্দিরের ভেতরের একটি ঘরের বারান্দায়, সেখানে বসেই খাওয়া-দাওয়া হলো। নিরামিষ। তবে জয় আমার জন্য একটু ঘিয়ের ব্যবস্থা করল। জয়কে নিয়ে অপুদের বাড়িতে গেলাম। অপু-জয় ওরা প্রতিবেশী। অবশ্য জয়রা বিক্রমপুরের লোক, এখন ফরাসগঞ্জের বাসিন্দা। জয় যুক্ত হয়ে গেল কাঁটাতে। প্রায় দিনই কাঁটার প্রয়োজনের প্রাচীন গলি ও বাড়ি খুঁজতে বেরুতাম জয়ের সঙ্গে। জয় সব পুরনো বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেত আমাকে। আর্টিস্ট জয় কাঁটা টিমের লোক হওয়াতে খুব সুবিধা হলো আমার ফরাসগঞ্জে। আমার একটু নিঃসঙ্গতা কাটানোর ব্যবস্থাও হলো। যে সব বাড়িতে কখনো শুটিং হয়নি বা শুটিংয়ের অনুমতি দেয়নি বাড়িওয়ালা, জয় আমাকে সেই সব বাড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করায়ে দিয়েছে এবং পরে শুটিংয়ের সময় সেই সুবিধা কাঁটা টিম পেয়েছে। ফরাসগঞ্জের কথা বললে আমাকে বাবু ভাইয়ের কথা বলতেই হবে, তিনশো বছরের বাড়ি লক্ষ্মী ভিলার সামনেই বাবু ভাইয়ের বাড়ি। পৈতৃকভাবেই তাদের ফার্নিচারের ব্যাবসা। অনেক খাট-পালঙ্ক ও নানারকম জরুরি প্রপস দিয়ে কাঁটা শুটিংয়ের সময় বাবু ভাই সহযোগিতা করেছেন। কাঁটার একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছেব বাবু ভাই। এখনো ফরাসগঞ্জে গেলে আমি একবার অপু ও বাবু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা না করে আসি না। একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে। ফেসবুকেও বাবু ভাইকে পাইছি। বাবু ভাইয়ের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করেছি। কাঁটা ছবি ফরাসগঞ্জের বাবু ভাই, অপু, জয়ের কাছে কৃতজ্ঞ থেকে যাবে। তারা আমার আত্মার সঙ্গে মিশে গেছে।
ফরাসগঞ্জে বসবাসের দিনগুলো আমার স্মৃতির ঝাঁপি উপচে দিয়েছে। অপুদের বাড়ির যে বিসাইড গ্রাউন্ডে আমি উঠেছি গজেন’দাকে নিয়ে, সেখানে দুই রুম। এক রুমে আমি, এক রুমে গজেন’দা। মাঝখানে এক চিলতে উঠোন। সেই উঠোনে কোনো কোনো রাতে ভাঙাচোরা জ্যোৎস্নার আলো এসে পড়ে, আমি সেই জ্যোৎস্নারাতে বসন্ত কুমার দাস রোডে শুয়ে শুয়ে কি কি ভাবতাম, কেমন করে আমার দিনরাত চলে যেত! সেই উঠোনে বৃষ্টিও আসে। বৃষ্টির সময় ইঁদুরগুলো ঘরে চলে আসত। বিড়ালকেও দেখতাম, চুপ করে বারান্দায় বসে বৃষ্টির গান শুনছে। এরকম বসবাসের জীবন আমি আগে তো পাইইনি, পরেও পাব বলে মনে হয় না। কাঁটা আমাকে বিস্তর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। সে দিনগুলো ছিল কিছুটা কষ্টের বটে, আজ তা এক গভীর আনন্দ। পেছন ফিরে তাকাতেও ভাল্লাগে। তো সেই চার দিন মন্দিরের সেবা গ্রহণের পর আবার কেরোসিন স্টোভে ফিরে যাই আমরা। কিছুদিন পর অবশ্য গ্যাসের লাইন লাগল। অভ্যস্ত হতে থাকলাম ফরাসগঞ্জে, বুড়িগঙ্গার ধারে, মিল ব্যারাকের পাশে, পুরান ঢাকায়।
তখনো আমার বাসায় বাসায় নেট সংযোগ হয়নি। মাঝেমধ্যেই শুভ আসে, আসে মিথুন। দু-একদিন করে ওরা থাকেও আমার ও গজেন’দার সঙ্গে। তখনো কাঁটার পূর্ণ টিম গড়ে ওঠেনি, কিন্তু উঠছে ধীরে ধীরে। আমার সঙ্গে লেখালেখিরও একটা দূরত্ব বাড়ছে। এর মধ্যেই একদিন ফোন দিল শিশু-সাহিত্য ও রম্য লেখক তাপস রায়, রাইজিং বিডি থেকে। বলল, ‘আল মাহমুদের উপরে একটা গদ্য দেন, মাহমুদ ভাইয়ের জন্মদিন আসন্ন।’ বললাম, ‘নেট নেই বাসায়। লেখা ইমেইল করব কীভাবে?’ তাপস বলল, ‘আপনি কাগজেই লেখেন, আমি আসতিছি বিকালে। ফরাসগঞ্জে আপনার ঠিকানা দেন।’
অদ্বৈত মল্লবর্মণের ওপরে কথা বলতে ঢাকা থেকে আমন্ত্রিত হয়ে লেখক আনোয়ারা সৈয়দ হক ও আমি যাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। পরদিন ঢাকায় ফেরার পথে ভাবি বললেন, ‘ফরাসগঞ্জে কোথায় থাকো, নিয়ে চলো।’ আনোয়ারা সৈয়দ হকের ভাই স্বপন’দাও ছিলেন সেই ট্রিপে। ভাবি ও স্বপন’দা প্রবেশ করলেন আমার সেই কাঁটা আস্তানায়। স্বপন’দা বললেন, ‘এ বাড়ি কত পুরনো?’
‘২৭৮ বছরের।’
ভাবি বললেন, ‘তোমার হক ভাইকে বিয়ের পরে আমরা লক্ষ্মীবাজারের কাছে এরকম একটি অ্যানসিয়েন্ট বাড়িতেই উঠছিলাম। কাজেই বেশি পুরনো বাসা কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় নতুন না। তা কদ্দিন থাকবা এই যক্ষপুরীতে?’ ফরাসগঞ্জের খুব কাছেই চকবাজার। চকবাজারের কৃতি সন্তান বাংলাদেশে নয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সিনেমাটোগ্রাফার মাহফুজুর রহমান আসতেন আমার এই আস্তনায়। মাহফুজ ভাই খুব ধূমপান করতেন, ঘামতেন, আমার মতোই। কাঁটাতে তিনি কাজ করবেন, এরকমটি ভাবার সুযোগ হয়েছিল শিল্পী মাসুক হেলালের কল্যাণে। ফ্রান্স ফেরৎ বিখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার ও আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেন বললেন, ‘আমারে নাও ক্যামেরায়। চলো, তোমার সঙ্গে জার্নি করি একটা।’ আনোয়ার ভাইয়ের লাশ হোটেলে পাওয়া গেল পান্থপথে, তখন আমরা কাঁটা শুটিং করতিছি। ২০১৮ তে। প্রকৃত ভাবনা হচ্ছে, আমি এত সিনিয়র কাউকে এই প্রজেক্টে ভাবছিলাম না। মাহফুজ ভাইও করোনায় ধরাশায়ী হয়ে গেলেন। আমার সৌভাগ্য, এরকম দুজন সিনেমাটোগ্রাফারের সান্নিধ্য আমি পেয়েছি। একদিন আমাকে ফরাসগঞ্জে দেখতে এলেন কবি, কবিতাপাঠক, সাংবাদিক ও কাঁটার অন্যতম শুভাকাঙ্ক্ষী ফখরুল ইসলাম হারুণ, সঙ্গে রেজাউল। রেজাউল বাংলাদেশ সরকারের বিচার বিভাগে কর্মরত। একবেলা গল্পগুজব করি। কাঁটা নিয়ে কথা হয়। ফরাসগঞ্জে যখন থাকি, ইমতিয়াজ ঢাকায় এলো। ততদিনে ও বিয়ে করে ফেলেছে। আমি শহীদুল জহিরের কাঁটা নিয়ে ছবি বানাচ্ছি, ওরাও জানে। ফরাসগঞ্জ থেকে শাহবাগে খুব একটা যাওয়া আসা তখন আর হতো না আমার। আমি বাসা থেকে বেরুলাম, ইমতিয়াজের সঙ্গে দেখা হলো, দুজনে গেলাম সাদিক ভাইয়ের বাসায়। নানারকম তর্কবিতর্ক-আড্ডায়, সাদিক ভাইয়ের বাসায়। মধ্যরাত হয়ে গেল। হইহুল্লোড় হলো। ইস্কাটন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় বাস পাব কি না জানি না, সাদিক ভাই তাঁর গাড়ির ড্রাইভারকে ডাকলেন। সেই মধ্যরাতে কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ, কবি মোহাম্মদ সাদিক এলেন ফরাসগঞ্জে। আমি অপুদের বাড়ির সামনে নামলাম। তাঁরা ফিরে গেলেন। আমি ঢুকে পড়লাম সেই মাথা নিচু করে কিছুটা কুঁজো হয়ে হেঁটে যাওয়া চিপাস্যু চিপা উপগলির প্রান্তে, যেখানে গজেন’দা হয়তো আমার অপেক্ষায় আছে কিংবা গজেন’দা তখন বাসাতেই নেই। বিহারীলাল জিউ মন্দির, নইলে শ্যামবাজার শিব মন্দির নইলে নদীর ধারে, বুড়িগঙ্গা বাঁধের ওদিকে। কোথায় গজেন’দা?
ফরাসগঞ্জ আসার আগে আমি ছিলাম কয়েকমাস শংকর-জাফরাবাদে। তারও কয়েকমাস আগে ছিলাম নিউ এলিফ্যান্ট রোডে, প্রায় বারো বছর একটানা এক বাড়িতে। সেই বাড়িতে থাকতেই কাঁটা মন্ত্রণালয়ের অনুদানপ্রাপ্ত হয়। মনে আছে, যখন স্ক্রিপ্ট লিখতাম একটা ঘরে, অন্য ঘরে শুভ আমার জন্য চচ্চড়ি মাছসহ নানারকম তরকারি রান্না করত। পরে শুভ কাঁটার লাইন প্রোডিউসার। এলিফ্যান্ট রোড থেকে শংকর, শংকর থেকে ফরাসগঞ্জ, ওখান থেকে মগবাজার, নারিন্দা, মহানগর প্রজেক্ট, হাতিরপুল ভূতের গলি পর্যন্ত শুভ আমার সঙ্গেই জার্নিতে আছে। এই হাতিরপুল ভূতের গলি থেকে নর্থ সার্কুলার রোড হয়ে এই মুহূর্তে আমি পুনরায় নিউ এলিফ্যান্ট রোডে। আগের বাসায় নয়, আগের বাসার পাশেই। এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় থাকতেই সাকিল আমার এডি হিসেবে কাজ করে। সাকিল সৈকত ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়ারই স্টুডেন্ট ছিল। টিভিতে কাজ করার সময় সাকিল আমার সঙ্গে যুক্ত হয়। কাঁটার স্ক্রিপ্ট কম্পোজ, বাঁধাই করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া পর্যন্ত সাকিলই তো ছিল একমাত্র এডি আমার। সব কাজই করেছে। ওর মধ্যে ভালো ছবি বানানোর ক্ষুধা আছে। এই ক্ষুধাই সাকিলকে উচ্চতায় নিয়ে যাবে। দেশ টিভির প্রোমো প্রোডিউসার আবৃত্তিকার রুবেল কুদ্দুস চাকরি ছেড়ে দিলেন, যুক্ত হলেন কাঁটার সঙ্গে। রুবেলের মোটর বাইক থাকায় আমার কাজের খুব গতি বাড়ল। রুবেল অনেক পরিশ্রম করেছেন কাঁটার জন্য। রুবেলের বন্ধু গৌতম সাহার কাছেও আমি কৃতজ্ঞ থাকব আজীবন। সাংবাদিক ফখরুল ইসলাম হারুণ কাঁটার স্পন্সরের জন্য আমাকে কত জায়গায় যে নিয়ে গেছেন, তা আর কেউ জানে না। ‘নৃ’ নির্মাতা রাসেল আহমেদ, আলোকচিত্রী ও সাংবাদিক ঈয়ন, সিনেমাটোগ্রাফার ড্যানিকে নিয়ে এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় কাঁটার মিটিং করেছি। মিটিং করেছি শংকরেও। শংকরে এসে পেয়েছি শব্দগ্রাহক নাহিদ মাসুদকেও। কিছু মিটিং করেছি রাসেলের মনসুরাবাদের বাসায়। রাসেলের বউ ইথেল যুক্ত হয়ে গেল কাঁটা টিমে। ইথেল দেখবে কাঁটার কস্টিউম, ভাবা হলো। ইথেল কাঁটার স্ক্রিপ্ট পড়ে খুব ভালো ফিডব্যাক দিল। চলচ্চিত্রের শিক্ষক ও নির্মাতা রাজীবুল হোসেনের শংকরের অফিসে বসে কাজ এগোতে চাইলাম। বসলামও কয়েকদিন। ওখানেই আলাপ হলো অভিনেতা ও নির্মাতা কায়েস চৌধুরীর সঙ্গে।
এলিফ্যান্ট রোডে থাকাতে একবার গেলাম মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান রুবানা হকের সঙ্গে দেখা করতে। কাঁটার শেয়ার বিক্রি করা নিয়ে কথা হলো। আমি ৪৯ পার্সেন্ট শেয়ার বিক্রি করব, বিনিময়ে ৫০ লাখ টাকা নেব নির্মাণ ব্যয়ের অংশ হিসেবে। আর সরকারি অনুদানের অর্থে আমি ৫১ পার্সেন্ট অংশের মালিকানায় থাকব। রুবানা আপার পক্ষে নাগরিক টিভি থেকে আব্দুন নূর তুষারের সঙ্গে আমার কয়েকটি বৈঠকেই আমি বুঝলাম, হচ্ছে না। এভাবে হবে না। আবার শংকরে থাকাকালীন আরেকজনকে কো-প্রোডিউসার হিসেবে নিতে আলোচনা এগুলো। নিকেতনে সেই আলোচনা হচ্ছিল। আমি ও কাঁটার ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর রাসেল চলে যেতাম নিকেতনে, সেই কো-প্রোডিউসারের সঙ্গে মিটিংয়ে। মিটিং সফল হচ্ছিল বলেই মনে হচ্ছিল। কাঁটা ছবিতে একদল পাকিস্তানি আর্মি মুভ করে। কিছু রাজাকার আছে। কাজেই ১৪/১৫টা চাইনিজ রাইফেল ও ৩টা থ্রি নট থ্রি রাইফেল লাগবে প্রপস হিসেবে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমার লোকেরা যোগাযোগ করে। তারা জানায়, কমপক্ষে এক মাস চারদিন আগে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে লেটার দিতে হবে। কাঁটা টিম থেকে লেটার দেওয়া হলো। কিছু পাত্রপাত্রী ঠিকঠাক করা হয়ে গেল। ৩ জোড়া সুবোধ ও স্বপ্না আছে কাঁটাতে। ভাবলাম, একজোড়া হোক না হয় কলকাতার পাত্রপাত্রী। সেই মোতাবেক যোগাযোগ। অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তী ও সোহিনী সরকারের সঙ্গে। সব কিছু ঠিকঠাক হচ্ছিল, এ সময় সেই কো-প্রোডিউসারের সঙ্গে আমার নীতিগত কারণে বনিবনা কন্টিনিউ হলো না। ওদিকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাকে পাচ্ছে না, কারণ, আমার ফোন বন্ধ। বন্ধ, কারণ, প্রোডিউসারের সঙ্গে আলোচনা আর এগুনোর পথে থাকল না। আমি অনেককে নিয়েই কাজে এগিয়ে গিয়েছিলাম। সেই আগানো আর হচ্ছে না, কিছুটা চাপে পড়েই ফোন বন্ধ করে দিলাম সাময়িকভাবে। কিন্তু ঝিনাইদহে বাড়ির সঙ্গে একটা যোগাযোগ তো ছিলই। বাড়ি থেকেই জানাল, সেনাবাহিনী দফতর থেকে আমাকে না পেয়ে আমার বাড়িতে যোগাযোগ করেছে। রিকুইজিশন লেটার অনুযায়ী সুশৃঙ্খল এই বাহিনী থেকে চাইনিজ রাইফেল ও থ্রি নট থ্রি বরাদ্দ হয়ে গেছে। আমি সেগুলো নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করছি না কেন, সেই মর্মে খোঁজা হচ্ছে আমাকে।
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস: ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।