পুরান ঢাকায় ঘোরাঘুরি করলে মহল্লায় বান্দর পড়বে না, এটা তো হয় না। হালাই ভি ছহিদুল জহিরের গপ্পো লিয়া লারাচারা কৈরা বান্দর ছাড়া ক্যামনে কী? অবশ্য বানরকুল আর আগের মতো নেই। বান্দর কমে গেছে। ‘কাঁটাতেও বান্দর না থাকলে এইটা যে পুরান ঢাকায় “ছুটিং” করা বা পুরান ঢাকার মহল্লা বানায়ে তোলা ছবি—তা তো হবে না রে সেলিম! কি বলিস?’ সেলিম রান্না করতে করতে মাথা নাড়ায়। সেলিম হাসে, বলে, ‘আবার জিগায়?’ সেলিমের রান্নার হাত সত্যিই প্রশংসাযোগ্য। নারায়ণগঞ্জের ছেলে সেলিম ১২ বছর বয়স থেকে প্রোডাকশনে কাজ করে, এখন কি চল্লিশ হবে না? আতিকের সঙ্গে ‘জলছবি’তে কাজ করেছে, সামিরের সঙ্গে ‘গাঁও’তে কাজ করেছে। মধ্যে কয়েকবছর সেলিম আবুধাবি ছিল। সেখানে নানারকম কাজ করত। ছোটোখাটো একজন শেফ সেলিম। রান্নায় একটা সিদ্ধি এসে গেছে ওর হাতে। সেলিম শুধু আলুই রান্না করত এমন ভাবে, অপুদের বাড়ির সেই আস্তনায়, দোতলা থেকে অপুর স্ত্রী, জুরাইনের মেয়ে, তখন সাউন্ড করত—’ভাইয়া, কী গোস্ত রান্ধন হইতাছে?’
আমি সেলিমের দিকে তাকাই, সেলিম দোতলার দিকে তাকায়, বলে, ‘এটা কোনো মাংস না ভাবি, শুধু আলু রান্না করতিছি’। ভাবি হয়তো তা বিশ্বাস করেনি। কিছুক্ষণ পরে আবার সাউন্ড করে ভাবি—’গোস্ত রান্ধনের ঘ্রাণ পাইতাছি তো!’ এই হচ্ছে সেলিমের রান্নার কারিশমা। গজেন’দা অবসরে যাওয়ার পর সেলিম আমার রান্নায় নিযুক্ত তখন। বললাম, ‘সেলিম, ওই দ্যাখ, দেয়ালের উপর বান্দর’।
পুরান ঢাকায় এমনিতেই বান্দর বাস করে এখনো। কিন্তু শুটিংয়ের সময় কি বান্দর শিডিউল দেবে? দেবে না কেন? আমরা নাকি বান্দরদের নৃতাত্ত্বিক আত্মীয়! আমি মনে করতে চেষ্টা করি, আমার ছোটোবেলাতেও, ঝিনাইদহের গাড়াগঞ্জ বাজারে বান্দর খেলা দেখাইতে আসত এক লোক, বিশেষ করে হাটের দিন। বান্দরের সঙ্গে সেই লোকটা কথা বলত। বান্দর তার কথা অনুযায়ী খেলা দেখাত, নাচ দেখাত। ‘দেখাও তো বাবু, ঘরজামাই কীভাবে বউয়ের খোঁচা খাইয়া বেজার বসে থাকে?’ ‘দেখাও তো বাবু, ধরা খাওয়ার পর চোর কীভাবে দারোগা বাবুর পায়ে ক্ষমা চায়?’ ‘এবার দেখাও তো বাবু, নতুন জামাই কেমন করে শ্বশুরবাড়ি যায়?’… কিন্তু পুরান ঢাকার বান্দর খেলা দেখাবার বান্দর না, বান্দর এখানে আবাসিক সিটিজেন। বিভিন্ন পুরনো বাড়ির ঘুপচি, ভাঙা পাচিল, পরিত্যাক্ত চিলেকোঠায় বান্দররা বাস করে পুরান ঢাকায়। একবার ধামরাই গিছলাম কাঁটার লোকেশনের সন্ধানে। তখন ওখানেও দেখেছিলাম অনেক বান্দর। কাঁটাতেও বান্দরের উপস্থিতি আবশ্যক। বান্দর কি কো-আর্টিস্ট হিসেবে পাসিং দেবে, না সেটের প্রপস হিসেবে চুপচাপ বসে থাকবে?
ফরাসগঞ্জে কাঁটার মিটিং কয়েকদিন পরপর বসত। স্বামীবাগ থেকে আসত মাহমুদুর রহমান দীপন। মাসুক হেলাল আসেন সেই মিরপুর চিড়িয়াখানা থেকে। রাসেল-ইথেল আসে আদাবর থেকে। ড্যানী ও লীনা আসে রামপুরা থেকে। নাহিদ মাসুদ ও দীপক সুমন আসে লালমাটিয়া থেকে। জিগাতলা থেকে শুভ তো আসেই, মিথুন আসে বাড্ডা থেকে।
ফরাসগঞ্জে কাঁটার মিটিং কয়েকদিন পরপর বসত। স্বামীবাগ থেকে আসত মাহমুদুর রহমান দীপন। মাসুক হেলাল আসেন সেই মিরপুর চিড়িয়াখানা থেকে। রাসেল-ইথেল আসে আদাবর থেকে। ড্যানী ও লীনা আসে রামপুরা থেকে। নাহিদ মাসুদ ও দীপক সুমন আসে লালমাটিয়া থেকে। জিগাতলা থেকে শুভ তো আসেই, মিথুন আসে বাড্ডা থেকে। আমি, সেলিম তো আছিই। ততদিনে গজেন’দা কোথায় যেন চলে গেছে। মাঝেমধ্যে ফোন করে প্রচ্ছন্ন হুমকি দেয়, ‘কী, কাঁটার শুটিং ধরবা কবে? আমি তো দাঁড়িগোঁফ আর রাখতি পাত্তিছিনে। একটা চাকরির কথা হচ্ছে কিন্তু, বেতন বারো হাজার টাকা দিয়ে শুরু। কও, কী করব?’
‘তাইলে অ্যালান পো অন্য কেউ করবে, তুমি দাঁড়িগোঁফ ফেলে দাও। যাও, চাকরি করো।’
গজেন’দা এবার একটু নরম হয়ে আসে, ‘না মানে অ্যাদ্দিন আমি ক্যারেকটারডা মনের মদি রাখে দিছি, একন কি কচ্ছ তুমি?’
‘হুম। আরেকটু রাখো। একটা কাজ দিচ্ছি শোনো, যদ্দিন শুটিং শুরু না হয়, তুমি রাস্তাঘাটে মহিলা বিড়াল দেখলিই কোলে তুইলে নিবা। আদর করবা। মহিলা বিড়ালের সঙ্গে ভাব-খাতির বাড়াবা। তুমি তো ধরো অ্যালান পো। বিড়াল তোমার কো-আর্টিস্ট। এইডাই অ্যালান পো চরিত্রের হোমটাস্ক। বুঝছ ব্যাপারডা?’
এদিকে সেলিমও রান্নাবাড়ার ফাঁকে ফাঁকে একা একাই রিহার্সেল করে আরেকটা চরিত্র। চরিত্রের নাম আলামিন। আলামিনের বাড়ি থাকবে বিক্রমপুরে। একাত্তর সালের মার্চে সে ঢাকায় আসে এবং তার আত্মীয় ভূতের গলির বাড়িওয়ালা আবদুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে ওঠে। আলামিন আটকে পড়ে ঢাকায়। আব্দুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে তার থাকার জায়গা হয়। সে সময়ই, ঢাকা সেনানিবাস থেকে সেনারা বেরিয়ে ২৫ মার্চের কালরাত বা গণহত্যা ঘটায়। পরদিন ২৬ মার্চ সারাদিন ঢাকাসহ পূর্বপাকিস্তানের বড়ো বড়ো শহরে কারফিউ জারি থাকে, কোথাও কোথাও গোলাগুলি চলতে থাকে। পুরো পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করা হয়। সে এক ভয়ানক থমথমে অবস্থা। পরদিন, ২৭ মার্চ ভোর থেকে অর্ধবেলা কারফিউ শিথিল করে প্রশাসন। যাতে ঢাকা শহর থেকে সাধারণ মানুষ নিরাপদে পালাতে পারে। আলামিনও মহল্লাবাসিদের সঙ্গে পালাবে। পরে একদিন পাকিস্তানি সেনার গুলিতে আচমকা মরে পড়ে থাকবে আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনে। সেলিম সেই আলামিন চরিত্রের অনুশীলন করে কাজের ফাঁকে। মাঝে মধ্যে সেলিম ঘুম থেকে উঠতে চায় না। আমি ডাক দিলে সে বলে, ‘আলামিন পাকিস্তানি আর্মির গুলি খাইয়া মইরা পইড়া আছে, রিহাচ্ছিল চলতাছে। একঘণ্টা পর রিহাচ্ছিল শেষ হইব।’ আলামিন চরিত্র রিহার্সেলের নামে সেলিম আলস্য করছে। একটা মজার সম্পর্ক ওর সঙ্গে আমার। সেলিমের মূল কাজ আমার ও ওর জন্য ভাত তরকারি রান্না করা, গোসল করার পানি বালতিতে টেনে আনা…এই রকম আর কী। এর মধ্যেই একদিন সেলিম এক কাজ করল। এক কিশোরী মেয়ে, সেভেনে পড়ে, সেই মেয়ে ও তার মাকে নিয়ে হাজির আমার ওই আস্তনায়। বললাম, ‘ব্যাপার কী রে?’
মাঝে মধ্যে সেলিম ঘুম থেকে উঠতে চায় না। আমি ডাক দিলে সে বলে, ‘আলামিন পাকিস্তানি আর্মির গুলি খাইয়া মইরা পইড়া আছে, রিহাচ্ছিল চলতাছে। একঘণ্টা পর রিহাচ্ছিল শেষ হইব।’ আলামিন চরিত্র রিহার্সেলের নামে সেলিম আলস্য করছে। একটা মজার সম্পর্ক ওর সঙ্গে আমার।
সেলিম বলল, ‘মাইয়া নায়িকা হইব, ওর মার লগে কথা কন। আপনের তো নায়িকা লাগব?’
‘নায়িকা লাগব তোরে কইছি আমি?’
সেলিমও তর্ক করে, ‘নায়িকা ছাড়া ছিনেমা করবেন ক্যামনে?’
‘চুপ কর।’
সেই কিশোরী ও তার মা ভাঙাবাড়ির চারপাশে চোখ বুলিয়ে তো বিশ্বাসই করতে পারছে না যে, আমরা ফিল্মের জন্য ওখানে গেছি বা আছি। কিন্তু দু-একটি কথা তো বলতেই হলো। মেয়েটিকে বললাম, ‘তুমি কি বাংলাদেশের সিনেমা দ্যাখো?’
মেয়েটি দারুণ উৎসাহে জানাল, ‘দেখি।’
‘কোন ছবিটা সবচেয়ে বেশি মনে আছে তোমার?’
‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’
বললাম, ‘বলো কী! পড়ালেখা না করলে হবে? কেবল তো সেভেনে উঠেছ।’
মেয়েটি আমার ভুল শুধরে দিয়ে বলল, ‘স্যার, মন বসে না পড়ার টেবিলে তো সিনেমার নাম। দুইবার দেখছি আমি।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। সেলিম, উনাদের নিয়ে যা। এফডিসির পথে যেতে হবে উনাদের।’
সেলিম আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, ‘বস, হইব না? শিখায়ে পড়ায়ে নিলে পারব না?’
‘ভাত-ডাল রান্না কর তুই। আমি বুড়িগঙ্গার ধারে যাচ্ছি।’
আমি ঘর থেকে বের হই। মনে আসে সেলিমের কথা। ২০০৩ সালের শেষ দিকে একটি টেলিভিশন ট্র্যাভেল শো বানানোর কাজে আমরা যখন চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান ও রাঙামাটি যাই, সেলিম সেই টিমে ছিল প্রোডাকশন বয়। আমি ছিলাম স্ক্রিপ্ট রাইটার। সম্ভবত ভাইয়া গ্রুপের একটি কাজ ছিল সেটা। বন্ধু আজহার ছিল ‘জলছবির দেশে দেশে’ নামে সেই প্রোগ্রামের ডিরেক্টর, ক্যামেরায় তখনকার ইটিভির মহিউদ্দিন ভাই, আমাদের জয়ন্ত প্রোডাকশন ব্যবস্থাপনা—এই এরকম আর কি, এগারো জনের একটা টিম। তো তখন, এক রাতে রাঙামাটিতে দিনের শুটিং শেষ করে সন্ধ্যার পর বাংলোয় ফেরার পথে চাকমা ছেলেরা আমাদের মাইক্রোবাস ঘিরে ধরে। লেকের ধারে বাঁধের ওপর দাঁড় করাল আমাদের মাইক্রোবাস। চাকমা ছেলেরা নির্দেশ করল, গাড়ি থেকে নেমে আমরা যেন গাড়ির হেডলাইটের সামনে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়াই। দাঁড়াতে বাধ্য আমরা। কারণ, ওটা সমতল না রে ভাই, ওটা পাহাড়। ওরা পাহাড়পুত্র। তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। পাহাড়ে ওদের কথা না শুনে চলার আপনি বা আমরা যে কেউ না, সেটা টের পেলাম একটু পরই। দমাদম শুরু হলো। বাঁশ দিয়ে, লাঠি দিয়ে। দা-এর উলটো পাশ দিয়ে। পাহাড়ের সেই আতঙ্কজনক ভয় পাওয়া ও আহত হওয়া রাতে এই সেলিম আমার বাঁপাশে দাঁড়ানো ছিল। চাকমা ছেলেরা প্রাথমিকভাবে জাতিগত বৈরিতার একটা উজ্জ্বল উদাহরণ তৈরি করে ফেলল। আমাদের এক দফা মাইর হয়ে গেল। এবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু। এক পর্যায়ে মৌসুমি চাকমা ওর চাকমা মামার হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে একটা বাঁশ হাতে নেয় এবং ঝুলন্ত বিদ্যুতের তারে বাড়ি মারে। আকস্মিক ইলেক্ট্রিসিটি চলে যায়। অন্ধকার হয়। মৌসুমি চিৎকার করে আমাদের উদ্দেশে বলে, ‘আপনারা পালান, এরা আপনাদের মেরে ফেলবে।’ পাহাড়ি শ্যামল মেয়েটি ছিল আমাদের অনুষ্ঠানের অ্যাংকর। এটা পাহাড়ি ছেলেরা মানতেই পারেনি। সেই জন্য আমাদের তখন মাইর হচ্ছে, আর আমরা ভাবছি, জানডা পাহাড়েই গেল! তো, মৌসুমি মেয়েটির সেই নির্দেশের পর আমরা যে যার মতো অন্ধকার পাহাড় পথে ছুটতে তাকি। কক্সবাজার থেকে কিনে আনা বার্মিজ স্যান্ডেল পা থেকে খুলে কোথায় যে ছিটকে পড়ে!
এক পর্যায়ে মৌসুমি চাকমা ওর চাকমা মামার হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে একটা বাঁশ হাতে নেয় এবং ঝুলন্ত বিদ্যুতের তারে বাড়ি মারে। আকস্মিক ইলেক্ট্রিসিটি চলে যায়। অন্ধকার হয়। মৌসুমি চিৎকার করে আমাদের উদ্দেশে বলে, ‘আপনারা পালান, এরা আপনাদের মেরে ফেলবে।’
দৌড়াচ্ছি। খালি পায়ে যেখানে পাহাড়ে হাঁটাই মুশকিল আর আমরা কিছু বাঙালি ছেলে দৌড়চ্ছি জীবন বাঁচানোর জন্য। রিয়েলি থ্রিল। আহ। এখন চাইলেও ওরকম অভিজ্ঞতা আর পাব না। দৌড়তে দৌড়তে ক্লান্ত হয়ে গেলেও থেমে যাওয়ার সুযোগ নেই। পেছন থেকে গালি, বাঙালি হিসেবে সেই আমার প্রথম জাতিগত গালি শোনা হলো। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি সামনে একটি ঝাপখোলা দোকান—‘আনোয়ারা ট্রেইলার্স’—ঢুকে পড়ি দোকানের ভেতর। সেই দোকানিরা বাঙালি, তাদের বাপদাদারা হয়তো একদা সেটেলার হয়েই পাহাড়ে গিয়েছে। তাই ‘আনোয়ারা ট্রেইলার্স’ দোকান দেখে ঢুকে সেদিন সত্যিই মনে হলো, এবার বাঁচতেও পারি, এটা তো বাঙালিদের দোকান। বললাম, ‘ভাই, ঝাপ বন্ধ করেন ভাই বাঁচান।’ দোকানদার কোনো প্রশ্ন না করেই যেন এক মুহূর্তেই সব বুঝে ফেলল এবং তার একজন সহকারিসহ মুহূর্তেই দুজন দুটি দা বা রাম দা বা রামের ভাই লক্ষণ দা বের করল এবং চিটাগাঙের ভাষাতেই যা বলল, ‘ঝাপ বন্ধ করব না, ঝাপ খোলা থাকবে। ভাইসা আসি নাই। আমার বাপ-দাদারা সেটেলার হইতে পারে কিন্তু আমি তো জন্মাইছি এই পাহাড়ে। এই পাহাড় আমাদের। আপনারা ভয় পাবেন না।’ আপনারা বলতে আমাদের সেই ট্র্যাভেল শো টিমের এগারোজনের মাত্র একজনই আমার সঙ্গে তখন, এই মোহাম্মদ সেলিম। আর কে কোথায় অন্ধকারে জীবন নিয়ে পালাইছে, কিছুই জানি না তখন। সেলিম শুধু আমারে বলল, ‘বস, মরলেও আছি আপনের লগে। আমারে ফেলায়ে যাবেন না।’ সেই সেলিম এখন আমার ফরাসগঞ্জের আস্তনায় থাকে, রান্নাবান্না করে। আজ তো এক কিশোরী মেয়ে বা হবু নায়িকাও নিয়ে এলো—যার মন পড়ার টেবিলে বসেই না। তো সেই ‘জলছবির দেশে দেশে’ ৩/৪ পর্ব শুট করে রাঙামাটির ঘটনায় সব বন্ধ হয়ে গেল। তার দুই সপ্তাহ পরে সরয়ারের প্রথম ছবি ‘ব্যাচেলর’ এর শুট ছিল কক্সবাজার। একটি মাইক্রোবাসে সরয়ার, মারজুক রাসেল, জাহিদুর রহিম অঞ্জন, ইলোরা গওহর ও তার মা-মেয়েসহ আমি যাচ্ছিলাম কক্সবাজার। রাস্তায় মাইক্রোবাসে রাঙামাটির ঘটনাটা শেয়ার করি। আবার একচোট হাসাহাসি করি আমরা আমাদের সেই অন্ধকার রাতে দৌড়ানোর দৃশ্য ভেবে ভেবে। সরয়ার বলল, ‘তাইলে তুই কক্সবাজারে বেড়াতে আসছিস এবং ফরীদি ভাইয়ের সঙ্গে হঠাৎ তোর দেখা হবে, তারপর একইভাবে ক্যামেরার সামনে ঘটনাটা শেয়ার করবি ফরীদি ভাইয়ের সঙ্গে?’
বললাম, ‘অন্য কাউকে দিয়ে করা, যারা অভিনয় করতে চায়। আমি পারব না। আমার জড়তা এসে যাবে তুই অ্যাকশান বলার আগেই। ঝামেলা বাদ দে। আমি খালি খাওয়া-দাওয়া করব, হোটেলে ঘুমাব। সমুদ্রে সাঁতার কাটব। তোরা শুটিং নিয়ে থাক।’ কিন্তু সরয়ার একটা ডিজাইন করেই ফেলছে। আমাকে বাধ্য করল সরয়ার, ‘তোকে তো অভিনয় করতে হবে না। তুই টোকন হিসেবেই থাকবি, ফরীদি ভাই তোর সঙ্গে কিছু কথাবার্তা শেয়ার করবে।’ কিন্তু সরয়ার সেদিন ঠিকই টের পাচ্ছিল আমাকে হুমায়ুন ফরীদির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে, আমি কিছুতেই পারছিলাম না। কিন্তু অভিনয় করিয়ে নিতে আমার ভালো লাগে। কাঁটাতে প্রায় পাঁচশো চরিত্র। স্ক্রিপ্ট ডেভেলপ করতে করতে কী করে ফেলছি, হিসেব আছে?
এই সময়টা বা এর আগে এলিফ্যান্ট রোডে থাকতেই আমার ঝিনাইদহের সঙ্গে যোগাযোগ একপ্রকার বন্ধপ্রায়। মা-বাবা, বোন ও ভাগ্নিরা কেমন আছে, সেই খবরও রাখা হয় না। প্রায় পাঁচবছর আমার তখন ঝিনেদায় যাওয়াই হয় না। ফোনে এক-আধটু কথাবার্তা চালু ছিল, এই যা। একটা বিচ্ছিন্নতার মধ্যে পড়ে আছি তখন। একটা সুড়ঙ্গ দিয়ে হামাগুড়ি দিচ্ছি। মনে করছি যে, সুড়ঙ্গের শেষে আলো আছে, আকাশ-মাটি-দিগন্ত আছে। বেঁচে থাকবার আনন্দ আছে। বেঁচে থাকাই বা কাকে বলে? নিজের করতে ইচ্ছা কাজটি করতে না পারলে তখন বেঁচে থাকাও কি বেঁচে থাকা মনে হয়? আমার তো কিছু কাজ করতেই হবে। কিছু ছবি বানাতেই হবে। কাঁটা তার একটি।
আমার ভাগ্নি তোরসা তাথৈয়ের বয়স তখন চার; ওকে বলেছি, চুল কাটিস না, বড়ো হোক চুল। পরবর্তী আরও চার বছর চলছে, ওর চুল অনেক বড়ো হয়ে গেছে; কিন্তু কাঁটায় যে চুলসহ ও স্ক্রিনে উপস্থিত থাকবে, সেটি কখন কীভাবে? শুটিং ডেটই তো পড়ে না! এ নিয়ে পরিবারের লোকেরা আমাকে কথা শোনায়। বিশেষ করে গরমের সময় বাচ্চা মেয়ের এত বড়ো চুল ওকে ভোগাচ্ছে। মাথা ও ঘাড় ঘেমে যাচ্ছে। আমি ফোনে ফোনেই কথা বলে যাচ্ছি, তাথৈ ছোটো থেকে বড়ো হয়ে উঠছে, ওর সঙ্গে দেখাই হচ্ছে না। কারণ, আমি ঝিনাইদহে যাচ্ছি না তখন কয়েকবছর। তাথৈ একটা সেক্রিফাইস করে যাচ্ছে মামার জন্য, মামার ছবি কাঁটার জন্য। কাঁটা আমার পথে তখন, কাঁটা আমার চোখে, কাঁটা আমার মাথায়। ক্রুশবিদ্ধ যিশুর যন্ত্রণা বুঝতে চেয়ে সুনীল গাঙ্গুলি কবিতা লিখেছেন বটে, আমি কবিতা লিখিনি। কিন্তু দুচোখে কাঁটাবিদ্ধ অবস্থায় নির্ঘুম রাত্রি তো যাপন করেছি! এতে করে, কবিতা আমাকে ছেড়ে গেছে। ঢাকার পত্রপত্রিকার চাপাচাপিতে বা বিশেষ করে বিভিন্ন পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার জন্য চাপে ফেলেই যা লিখিয়ে নিল কিছু লেখা, এখনো তাই নিয়ে যাচ্ছে। হয়তো কবিতা লেখা থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার জন্য আমি এখন এলপিআর এ আছি। কবিতা অনেকটা আমার বড়ো বউ হয়ে গেছে, সে-ই আমার সব কিছুর প্রথম। কিন্তু ছবি হয়ে গেছে আমার ছোটো বউ। ছোটোবউয়ের ঠাটবাট বেশি। বড্ড জ্বালায়। তখন বড়ো বউয়ের কথা মনে পড়ে।
হয়তো কবিতা লেখা থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার জন্য আমি এখন এলপিআর এ আছি। কবিতা অনেকটা আমার বড়ো বউ হয়ে গেছে, সে-ই আমার সব কিছুর প্রথম। কিন্তু ছবি হয়ে গেছে আমার ছোটো বউ। ছোটোবউয়ের ঠাটবাট বেশি। বড্ড জ্বালায়। তখন বড়ো বউয়ের কথা মনে পড়ে।
মাঝেমধ্যেই তরুণ নির্মাতা সন্দিপ বিশ্বাস ও ওর স্ত্রী লক্ষ্মী, আমার জন্য খাবার নিয়ে চলে আসত ফরাসগঞ্জে; মাঝে মাঝে পিঠা-পুলি নিয়ে চলে আসত। সন্দিপ অপুদের বাড়িতে থাকা অবস্থায় আমার ভিডিও সাক্ষাৎকার নিয়েছে। সন্দিপের ক্যামেরায় আমার আরও অনেক ধরনের সাক্ষাৎকার ধরা আছে। ফরাসগঞ্জ নিবাসের ছবি যেমন আমি তুলেছি, তুলেছে ‘নৃ’ নির্মাতা প্রয়াত রাসেল আহমেদ। ছবি তুলেছে ঈয়নও। কিন্তু এখন যখন ‘জার্নি অব কাঁটা’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে ‘শ্রী’ অনলাইন পোর্টালে, তখন আর সেসব স্টিলস হাতের কাছে পাচ্ছি না। সন্দিপকে বললাম, কিছুই কি করা যায় না? ফরাসগঞ্জে যে ভিডিও ইন্টারভিউ করে রেখেছে আমার, সেই ভিডিও থেকেই সন্দিপ স্টিল মুড করে পাঠিয়েছে কিছু। দুইশ আশি বছরের অপুদের বাড়ির সেই প্রাগৈতিহাসিক দেয়াল, উঠোন, রান্নাঘর ইত্যাদি ধরা আছে ছবিতে। কাঁটা জার্নিতে অনেক ছবি ছাপা হয়েছে, অনেক ছবি ছাপা হবে। কিন্তু ফরাসগঞ্জের ছবির গুরুত্ব খুব গোপনে আমার কাছে থেকে যাবে।
একদিন কাঁটা প্রসঙ্গে মতি ভাইয়ের সঙ্গে একান্তে কথা বলা বলার জন্য কারওয়ানবাজারে যাই। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে শিডিউল করা ছিল। মতি ভাইয়ের অফিস রুমের পেছনে যে ছোট্ট আরেকটি রুম, সেই রুমে বসে কথা হয়। খুব মজাদার একটি বিস্কুট খেতে দিলেন মতি ভাই। কাঁটা নিয়ে কথা উঠল। মতি ভাই বললেন, ‘সিনেমা করতে গিয়ে কি আপনার কবিতা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে না?’
মতি ভাইকে বলি, ‘প্রথমাকে তো আমি আমার কবিতার পাণ্ডুলিপি দিয়ে দিছি। আর প্রকাশের সেই প্রথম সপ্তাহ থেকে এখন পর্যন্ত প্রথম আলোতে মনে হয় আর যে কারোর চেয়ে আমার কবিতাই বেশি ছাপা হইছে। আমার কবিতাই তো সবচেয়ে বেশি ছাপে প্রথম আলো, পড়েন না?’
‘পড়ি। কিন্তু সিনেমা কি আপনার বেশি ভাল্লাগে?’
মতি ভাই কি আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন? আমি তো গেছি ফান্ডিংয়ের জন্য! বললাম, ‘মতি ভাই, সিনেমার পরিসর বড়ো। বেশি মানুষের কাছে ইচ্ছাটা পৌঁছানো যায়।’
‘তা যায়। তবু আপনার কবিতার দিকে খেয়াল রাখবেন। আর ফান্ডিংয়ের জন্য আমার চেয়ে আনিসেরই সমাজে যোগাযোগ বেশি। আনিসের সঙ্গে কথা বলেন।’
আনিসুল হক বললেন, ‘চলো, তোমারে নিয়া রনির সঙ্গে বসি।’ বলেই আনিস ভাই চরকি বরাবর রেদওয়ান রনিকে ফোন দিলেন। রনির সঙ্গেও কথা হলো আমার পরে আবার কথা হবে। সেদিন আনিস ভাইয়ের মধ্য দিয়ে অন্যত্র যে অর্থ-সাউন্ড পাইছি, তা এবং কাঁটার দেড়কোটি টাকার ফান্ড ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কথা জার্নি অব কাঁটাতে আসবে আরও পরে, অন্য একটি পর্বে। এখন আপাতত আছি ফরাসগঞ্জে। একদিন উল্টিনগঞ্জ ঘাটের নৌকায় পার হয়ে ওপারে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে যাই। মনে পড়ল, অনেক আগে, যখন আমি প্রথম ঢাকায় আসি, ছিলাম মাসখানেক, সেই ১৯৮৮ সালে, বন্যা হলো, আমি তখন উঠেছিলাম জিঞ্জিরায়। অনেক দূর হেঁটে গিয়ে তারপর নৌকায় এক টাকা দিয়ে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে সদরঘাট যেতাম। ওখান থেকে বাসে চড়ে গুলিস্তান হয়ে শাহবাগ। তখনো চারুকলায় ঢুকিনি আমি। সবে শহর ঢাকায় ঢুকতে উঁকি দিচ্ছি আর কি!
বর্ষা এলো ফরাসগঞ্জে। বর্ষা বিভাবরী; আমার ভাগ্নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, ছাপচিত্রে পড়ালেখা করছে। বর্ষা জানত যে আমি পুরান ঢাকায় আছি, ফরাসগঞ্জে। বর্ষা অপুদের বাড়িতে এলো। বাড়ি-টাড়ি পরিস্থিতি সব দেখল। ওর চোখ ছানাবড়া। রাতে থাকল ফরাসগঞ্জে, পরদিন সকাল সকাল আমার মায়ের ফোন পেলাম। মা বলল বা কেঁদেই ফেলল ফোনে, ‘তুই নাকি একটা পাঁচশ বছরের ভাঙা বিল্ডিঙে উঠেছিস পুরোন ঢাকায়? সেখানে নাকি সাপখোপ আছে?’ পরিস্থিতি ঘোলা হয়ে গেল। এতদিন ঝিনাইদহে, বাড়িতে কেউ কিছুই জানত না, বর্ষা এসে দেখে ওর একমাত্র মামার খবর সব কিছু বলে দিয়েছে। বুঝলাম, ফরাসগঞ্জের সিনে-লোকেশন-অ্যাডভেঞ্চার জীবন আমার শেষ হয়ে আসছে। এবার ছাড়তে হবে অপুদের বাড়ি। এ বাড়িতে থেকে তো যথেষ্ট সংশোধন করছি স্ক্রিপ্ট। বিভিন্ন পুরোনো বাড়ি ও গলি খুঁজে খুঁজে রাখলাম। শুটিংয়ে জোন শিডউল করতে সুবিধা হবে। তাছাড়া কোনো দিন পুরান ঢাকায় আবাসিক থাকিনি, থাকা হলো। অনেক কিছু শেখা হলো—সেইটাই তো বড়ো ব্যাপার। বান্দর দেখা হলো, মাঠা বাখরখানি খাওয়া হলো। বুড়িগঙ্গার পাড়ে থাকা হলো। সাকরাইনের ঘুড়ি ওড়ানো দেখলাম। সংক্রান্তি শব্দটা পুরান ঢাকায় সাইজ হয়ে নাম হইছে সাকরাইন। নতুন ঢাকার মানুষ আমি, নতুন ঢাকাতেই ফিরে যেতে হবে। তবে ফরাসগঞ্জে থাকা অবস্থায়, এক রাতে, প্রায় বারোটা নাগাদ, আমাকে ফোন করে অভিনেতা মনোজ প্রামাণিক। মনোজ বলল, ‘টোকন’দা কাঁটার জন্য মাটির উঠোনের বাড়ি কি পাইছেন?’
পরিস্থিতি ঘোলা হয়ে গেল। এতদিন ঝিনাইদহে, বাড়িতে কেউ কিছুই জানত না, বর্ষা এসে দেখে ওর একমাত্র মামার খবর সব কিছু বলে দিয়েছে। বুঝলাম, ফরাসগঞ্জের সিনে-লোকেশন-অ্যাডভেঞ্চার জীবন আমার শেষ হয়ে আসছে। এবার ছাড়তে হবে অপুদের বাড়ি। এ বাড়িতে থেকে তো যথেষ্ট সংশোধন করছি স্ক্রিপ্ট। বিভিন্ন পুরোনো বাড়ি ও গলি খুঁজে খুঁজে রাখলাম।
‘না। গতকাল মুনশিগঞ্জের আব্দুল্লাহপুর ঘুরে এলাম, বাড়ি যা দেখছি পছন্দ হয়নি।’
‘এখন আসতে পারবেন?’
‘কোথায়?’
‘নারিন্দায়।’
সেই রাতে নারিন্দায় যে বাড়ি দেখতে গেলাম, সেই বাড়ির কথা আমাকে আগে একবার বলেছিলেন শিশুসাহিত্যিক মাহবুব রেজা। যার কাছে আমি কাঁটা স্ক্রিপ্টের সংলাপে পুরান ঢাকাইয়া ভার্সন করার কাজটি করে নিয়েছিলাম জনকণ্ঠ অফিসে বসে; অনেক আগেই। মনোজের সঙ্গে দেখা হলো। সেই বাড়িতে তখন একটা প্রোডাকশনের কাজ চলছিল এবং মনোজ সেখানে কাস্ট। মনোজ জানত কাঁটা স্ক্রিপ্ট, পড়েছিল আমি এলিফ্যান্ট রোডে থাকতেই। সেই অনুযায়ী নারিন্দার বাড়িটা দেখে মনোজই আমাকে ফোন করেছে। মনোজ তখনো কাঁটায় কাস্ট, আমার ভাবনায়। যে বাড়ি দেখলাম, হয়তো চলবে এই বাড়ি কিন্তু রাত তো, ভালো করে দেখতে পারলাম না। ফিরে গেলাম ফরাসগঞ্জে। ফরাসগঞ্জে তখন একটা মায়া তৈরি হয়ে গেছে আমার। যে কারণে, পুরান ঢাকা ছেড়ে এসেও আমি এখনো হুট-হাট ফরাসগঞ্জে চলে যাই। অপুদের বাড়িতে একটা ঢুঁ দিই, বাবু ভাইয়ের সঙ্গে একবার যোগাযোগ হয়। জয় মনে হয় এখন ফরাসগঞ্জে থাকে না, ফরাসগঞ্জে গেলে আমার জয়ের কথা মনে পড়ে। একটা মেয়ে, জগন্নাথে পড়ত, আসত আমার কাছে অপুদের বাড়িতে, তখন কাঁটাতে কস্টিউমে কাজ করবে বলে কথাও হচ্ছিল। জ্বর নিয়েও কদিন ধরে কস্টিউমের ব্রেক ডাউন করছিল সে। অবাক ব্যাপার, এই মুহূর্তে মেয়েটির নাম আমার মনে পড়ছে না, এই মনে না পড়ার জন্য আমার ধারণা, কোভিডের টিকাই দায়ী। আমার ইদানীং মনে হয়, ৩ টা টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আমার মেমোরি অনেক ডিলিট হয়ে গেছে। হ্যাঁ, সত্যি, আমার তাই মনে হয়।
আমার সাত মাস ফরাসগঞ্জ নিবাসের স্মৃতি নিয়েই তো একটা বই লেখা যেতে পারে। কিন্তু এখানে যা কিছুই ন্যারেশন, কাঁটাকেন্দ্রিক। রিয়েলি, আমার ফরাসগঞ্জের দিন শেষ হয়ে এলো। বর্ষা ঝিনেদায় চলে গেল। কয়েকদিন পর মা আমার নামে পাঠাল এক লাখ টাকা। তার একটা অংশ দিয়ে অপুদের বাড়ির বকেয়া ভাড়া পরিশোধ করে দিলাম। বললাম, ‘ওই দিকে চলে যাচ্ছি।’
অপু বলল, ‘থাকেন না হয় আর কিছুদিন।’
‘না’
‘শুটিং করবেন না?’
‘শুটিং না করলে ছবি হবে কীভাবে?’
আমি ও শুভ বেরিয়ে পড়লাম নতুন ঢাকায়। প্রথমে যাই কারওয়ান বাজার। দুই-আড়াই বছর কবিতার সম্মানী তোলা হয়নি প্রথম আলো থেকে। সেদিন তুলতে গিয়ে দেখি, প্রায় তেরো হাজার টাকা জমে আছে। সেই টাকা আর আমার মায়ের পাঠানো এক লাখ টাকার অর্ধেক তখন আমার কাছে ছিল। তাই নিয়ে মগবাজার চেয়ারম্যান গলির একটা বাসা পছন্দ হয়ে গেল এবং বাড়িওয়ালাকে ভাড়া অ্যাডভান্স করে দিলাম। বাইরে সেদিন বৃষ্টি, বাইরে তখন শ্রাবণ…
আমার মা-বাবা ও বোনদের সাপোর্ট ছাড়া কাঁটা নির্মাণ সম্ভব ছিল না। ঝিনেদা বা ঢাকার বাসায় আমার যত বন্ধুবান্ধব এসেছে ও আসে, সবাই আমার মায়ের হাতের রান্না খেয়েছে। তরুণ সরকার, জাফর আহমদ রাশেদ, মারজুক রাসেল আরও কত বন্ধু ঝিনাইদহে গেছে আমাদের বাড়িতে। ঢাকার বাসায় মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, নাসিমুল খবীর ডিউক বা অনেক বন্ধুই আমার মায়ের হাতে রান্না খেয়েছে একাধিক দিন। আমার সব বন্ধুর মাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। খেয়েছি সরয়ারের মায়ের হাতের রান্না।
অন্য দিকে আমি কবিতার ভেতর দিয়ে, ছবির ভেতর দিয়ে, এক আলুলায়িত স্বপ্নের ভেতর দিয়ে পৌঁছাই আরেক দেশে। সেখানে গিয়ে উচ্চারণ করি, ‘এই আকাশ আমার পিতা/ এই মাটি আমার মা/ আমি তাদের সন্তান, ওই দিগন্ত/ কিন্তু ভূগোল মাস্টার বলছেন—/ দিগন্ত একটি ধারণা মাত্র।’
আতিকের ‘লাল মোরগের ঝুটি’ দেখলাম। গেলাম মিরপুর সনি সিনেপ্লেক্সে, আমার মা, ছোটো বোন বীথি ও ভাগ্নি বর্ষা ছিল সঙ্গে। ছবির বিরতিপর্বে আমার মা ডাক দিল আতিককে, ‘খাঁটি খাঁটি, একদম খাঁটি। আতিক, তুমি একাত্তরের এরকম দৃশ্য দ্যাখোনি তো, বানালে কী করে?’ পরে, ছবিটি পুরস্কৃত হলে, মা তখন ঝিনেদায়, আমি ফোন করে বললাম, মা বলল, ‘বলছিলাম না, একদম খাঁটি? ভালো সিনেমা।’ এখন, এখনো, এই বয়সেও সত্য আমার জন্য, আমার মা ঢাকায় এসে আমার জামাকাপড় কিনে দেন। জুতা-স্যান্ডেল, মোজা কিনে দেন। আমার মা মনে হয় শুধু আমাকে নিয়ে চিন্তা করেই সময় পাড় করেন। আমার দুই বোনই মা-বাবাকে দেখে রাখে ঝিনেদায়। আমি সিঙ্গেল আছি বলেই হয়তো এখনো আমার মায়ের কাছে আমি শিশুই থেকে যাচ্ছি, বড়ো আর হচ্ছি না। মায়ের ডাকনাম বুড়ি, মামাদের ছোটো বোন। অন্য দিকে আমি কবিতার ভেতর দিয়ে, ছবির ভেতর দিয়ে, এক আলুলায়িত স্বপ্নের ভেতর দিয়ে পৌঁছাই আরেক দেশে। সেখানে গিয়ে উচ্চারণ করি, ‘এই আকাশ আমার পিতা/ এই মাটি আমার মা/ আমি তাদের সন্তান, ওই দিগন্ত/ কিন্তু ভূগোল মাস্টার বলছেন—/ দিগন্ত একটি ধারণা মাত্র।’
কাঁটা চিত্রনাট্য প্রতিযোগিতার জন্য যেদিন এটা প্রথম মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে যাই, সেদিনের কথাও কিছু বলে আসা দরকার। এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় স্ক্রিপ্ট আমি হাতে লিখি। মন্ত্রণালয়ে ১১ সেট জমা দিতে হয়। জমা দেওয়ার সময় ছিল ত্রিশ দিন বা এক মাস। আমি শেষ দিনে সব কিছু করতে গেছি। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। শাহবাগ-নীলক্ষেত অঞ্চল সাপ্তাহিক ছুটির দিন, অফিস মার্কেট বন্ধ। সাকিল ও শুভ সব দায়িত্ব নিল। বলল, ‘মালিবাগ-মৌচাক অঞ্চল তো আর বন্ধ না, ওইদিকে যাই চলেন।’ ১১ সেট চিত্রনাট্য ও আনুষাঙ্গিক কাগজপত্র ফটোকপি-বাঁধাই করতে করতে দুপুর পার, বিকাল ৪টার মধ্যে জমা দিতে হবে মন্ত্রণালয়ে। আমার কাছে থাকা টাকা শেষ। শুভ কোত্থেকে বাকি টাকা জোগাড় করে আনল। তাই দিয়ে বাঁধাই-ফটোকপির বিল মিটিয়ে মালিবাগ থেকে একটা রিকশায় উঠি। যখন আমরা মন্ত্রণালয়ের গেইটে পৌঁছাই, চারটা বেজে পনেরো মিনিট। জমা দিতে পারিনি। এক মাস সময় ছিল, এতদিনে কাজ কর্ম শেষ করে জমা না দিয়ে শেষ দিনে দিতে যাওয়ার ফল মিলল হাতে নাতে। ব্যাপক মন খারাপ হলো। কদিন পর মন ভালোও হলো এই ভেবে যে, যেটা জমা দিচ্ছিলাম সেটা তো ছিল শর্ট লেন্থের প্রজ্ঞাপন, ফুললেন্থ প্রজ্ঞাপনেই না হয় জমা দেবো কাঁটা। ফুললেন্থই হওয়া উচিত কাঁটার। এক গল্পে তিন গল্প কাঁটা। একটি মহল্লা। মহল্লার সব্বাই পাত্রপাত্রী। ফুললেন্থ ছাড়া সম্ভব, কহতব্য কাহিনি? কয়েক মাস পর ফুললেন্থের প্রজ্ঞাপন জারি হলে প্রথম দিনেই জমা দিলাম কাঁটা স্ক্রিপ্ট, ১১ সেট।
এক বর্ষার দিনে আমরা ফরাশগঞ্জ থেকে মগবাজার রওয়ানা দিলাম। যেন-বা একটা কাফেলা যাচ্ছে এক মরু থেকে আরেক মরুতে। শুভ ছিল সেদিন। ছিল ছড়া লেখক বোরহান আহমেদ। এবং সেদিন পুনরায় গজেন’দা উপস্থিত আমাদের মাঝে, সেই শংকর থেকে ফরাসগঞ্জ যাওয়ার সময় যেমন সঙ্গে ছিল। বৃষ্টিতে বইপত্র ভিজে কিছুটা ক্ষতি তো হলোই। ক্ষতি তো হচ্ছেই। যেন-বা আমার চিরকাল ক্ষতি হচ্ছে বৃষ্টিতে, যেন-বা আমার ক্ষত হচ্ছে পুণ্যি রাতে, আমি বিক্ষত হচ্ছি ভোরের ঘাসের শিশিরের স্পর্শেও। আর আমি শীতল হওয়ার বদলে উলটো পুড়ে যাচ্ছি দখিনা হাওয়ায়। আমার হয়তো ভালো লাগছে না।
কিন্তু ভালো লাগার সন্ধানে আমি জনপদ থেকে কুঁড়েঘর কিংবা ভাঙা প্রাসাদ, জঙ্গল বা মরুভূমির দিকেও সাপের মাথার মণি ধরতে বেরিয়ে পড়েছি, সেই কবে…। জার্নি টু বি কন্টিনিউড।
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৫মপর্ব
জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস: ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।