এই লেখা যখন আপনি পড়ছেন অথবা পড়ছেন না, আমি ভেবে নিচ্ছি আপনি পড়ছেন; আপনি কাঁটা জার্নি পড়ছেন। আপনার ধারণা, এটা উপন্যাস? না, উপন্যাস না। এটা একটা জার্নি; ট্রু জার্নি। তো এই লেখা যখন আপনি পড়ছেন, এখন আপনি অতিক্রম করছেন পর্ব আট, কিন্তু পর্ব ১৩ তে কি কি আসবে বা কি জানা যাবে, তা পাঠক হিসেবে আপনার এই মুহূর্তে জানা নেই, কারণ, সে সব আপনি ১৩ পর্ব পড়তে পড়তেই জানবেন। কিন্তু এই জার্নির কথক হিসেবে আমার আবছায়া কিছু জানা আছে। আমার জানাটা আমার মেমোরিতে জমে আছে। তবে আপনি কি জানেন, আজ থেকে এক বছর পরের মধুমাস আপনার জীবনে কিভাবে যাপিত হবে? না, আপনি জানেন না আপনার পরের শীতকাল কীভাবে কাটবে? পরের গ্রীষ্মে আপনি কোথায় থাকবেন? আমিও জানি না। মানুষ জানে না। মানুষ জানে না, এই মূহূর্তে যার সঙ্গে খুব একটা খাতির খাতির বোঝাপড়া, যাকে ছাড়া চলছেই না, প্রায় প্রতিটি মুহূর্তই যার সঙ্গে শেয়ার করে পরস্পর অনুভবের তাপমাত্রায় জড়িয়ে থাকা হয়; একদিন, হয়তো পরের মৌসুমে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতও কালেভদ্রের একটা ব্যাপার হয়ে যাবে। হয়তো সেই অনুভবের মানুষটি আপনার আঙিনা ছেড়ে যাবে। একবার ছেড়ে গেলে আর আসা হবে না। দাশ বাবু লিখলেন, ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর!।’ তাই যা হয়, একবারই হয়। কেউ গেলে, একবারেই যায়। যাক, পা আছে মানুষের, মানুষ হেঁটে চলে যাক। ডানা আছে পাখিদের, পাখি উড়ে যাক। …এই পর্ব যখন আপনি পড়তে পড়তে এগিয়ে যাবেন পরের পর্বের দিকে, তা থেকে আমরা আরও কিছু জানব। কিন্তু পর্ব উনিশ-কুড়িতে যখন জার্নি পৌঁছবে, তখন কি আমাদের মনে থাকবে সাত বা আট পর্ব থেকে আমরা কী কী জেনেছিলাম? পর্ব এক, দুই, তিনে কী ছিল? নিশ্চয়ই মনে থাকবে। কিন্তু এখন এই আট পর্ব পড়তে পড়তে অবশ্যই আমাদের আগেভাগে জানা নেই, আগামীতে কী কী আসবে? কী কী রিয়েলিটি জাগতিক ও মনোজাগতিকভাবে ফেইস করতে করতে আমি আগাব বা আপনি আগাবেন বা আমরা আগাব? জার্নি অব কাঁটার বেলায় এই বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে প্রবেশ দেখা যাবে পর্বে পর্বে, আবার একটা সময় পর্যন্ত আগানোর পর আমরা কিছুটা অতীতের দিকেও ফিরে ফিরে তাকাব।
তখন যা কিছু অতীত, এই মুহূর্তে তা তা বর্তমান। যেমন, কাঁটা টিম এখন মগবাজারে। এখানে অডিশনে নেওয়া কয়েকশো লোকজনকে কাঁটার উপযোগী করে তৈরি করা হবে। পিরিওডিক্যাল ছবি হিসেব ইতিহাসের তিনটি সময়ের আলোকে প্রচুর প্রপস, কস্টিউম কালেকশন বা ক্রয় করা হবে বা হচ্ছে। শুধু পাত্রপাত্রীই নয়, নির্মাণ সহকারী ব্যাকগ্রাউন্ড টিমও তৈরি করা হলো মগবাজার কাঁটা ক্যাম্প অফিসে। তারপর চূড়ান্ত ভাবে কাঁটা প্রজেক্টের জন্য যে বাড়িটা লাগবে, সেই বাড়ি নিশ্চিত করতে হবে। ভূতের গলি মহল্লার ৩৬ নম্বর বাড়ির মালিক আবদুল আজিজ ব্যাপারী। সেই বাড়িতে মাটির উঠোন থাকতেই হবে। যেখানে পাতাবাহার ও অন্যান্য গাছগাছালি থাকা আবশ্যক। বাড়ির বয়স হতে হবে কমপক্ষে একশো বছর। বাড়ির সমান বয়সী একটি কুয়া থাকতে হবে উঠোনের এক কোণে। বাড়ির মূল বাসিন্দা তো অকৃতদার আবদুল আজিজ ব্যাপারী। তবে ছুটা বুয়া নিজামের মা তার প্রাত্যহিক কাজ করে দিয়ে যায়। বাড়ির ছাদের কোণে কবুতরের ঘর, কবুতররা বাকবাকুম করতে থাকবে। আর সেই বাড়িতে থাকবে এক মহিলা বিড়াল। থাকবে একজোড়া ঘুঘু। ঘুঘুর ডাক শুনতে শুনতেই ভিটায় ঘুঘুচারণ হবে। তো এ রকম একটি বাড়ি পেতে হবে, নইলে বাড়ি বানাতে হবে। বানালে তো আবার বাজেট নিয়ে আরও টানাটানি পড়বে, রিয়েল ফিলটাও পাব না, তাই বাড়িটি খুঁজতেই হবে। আমরা মগবাজারের কাঁটা ক্যাম্পে বসে নানারকম ভাবনার চক্করে থাকি। তাই এখন, অর্থাৎ ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আমরা প্রায় প্রস্তুত হয়ে যাই, কাঁটা শুটিং আসন্ন। এক ঝাঁক নতুন মুখ নিয়ে জার্নি শুরু, কী ক্যামেরার সামনের পাত্রপাত্রী, কী ক্যামেরার পেছনে আমার টিম। জীবনের নতুন এক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। বাজারি পাত্রপাত্রী দিয়ে কাঁটা হবে না, বুঝেছি। বাজারের নির্মাণ সহকারী টিম নিয়ে অন্তত এই প্রজেক্টে জার্নি করা যাচ্ছে না, তাও টের পাচ্ছিলাম। নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিল আমার ভেতরে, আমার সময়ের ভেতরে। তখন নিশ্চয়ই আমি জানতাম না, কে হবে কাঁটার আবদুল আজিজ ব্যাপারী? কারাই-বা হবে সুবোধ-স্বপ্না-কুলসুম-সেলুনের নাপিত-পাকিস্তানি আর্মি ও সেনাদল? তখন কিছুই জানা নেই, কে হবে ‘ছান্তি কমিটির ছর্দার’ মাওলানা আবু বকর? কে হবে রাজাকার কমান্ডার জব্বার ও কারা তার সহযোগী? কে হবে চৌরাস্তার মোড়ের ইয়োর চয়েস সেলুনের বিহারি নাপিত? আর কারা হবে কয়েকশো মহল্লাবাসী?
মগবাজার কাঁটা ক্যাম্প সরগরম। শাহ নুরী হাই স্কুলের অপজিটে, রেললাইনের একদম পাশেই একটা চারতলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় ক্যাম্প। পুরনো বিল্ডিং। সারা দিনরাত ট্রেন যায়, ট্রেন আসে। শব্দ হয়। সেই শব্দের শাসন অতিক্রম করে আমরা কাঁটা ক্যাম্পে থাকি। চরিত্র বাছাই ও রিহার্সেল শুরু হয়। সবাই নতুন, কে কোন চরিত্রে বেটার হবে, এটা বুঝে ওঠা দরকার। যাকে ভাবছি, সে কি সেই চরিত্রের ভার বইতে সক্ষম? সেটা বুঝে নেওয়া দরকার। সময় দিতে পারবে তো পর্যাপ্ত?—সেটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। চরিত্রটাকে ভালবাসতে পারবে তো, এই অনভিজ্ঞদের দল? তার জন্য প্রস্তুতি দরকার। তিন চারশো লোক। কাঁটা ক্যাম্পে কখনো তাদের একসঙ্গে কল দেবার সুযোগ ছিল না। তাইলে লাগত একটা বড়ো অডিটোরিয়াম। আমাদের কাঁটা ক্যাম্পে তখন এক রুম অফিস, বাকি বড়ো রুমটা রিহার্সেল রুম। আর দুই রুমকে ধরে একটা লম্বা বারান্দা। কিচেন ছিল, রান্না হতো। খাওয়াদাওয়ার পর আবার তা ঢালার জন্য একটা বাথরুম ছিল। আর ট্রেন আসা যাওয়ার শব্দ ছিল। অফিসের নিচে মিঠাই নামে একটা মিষ্টির দোকান ছিল, সেদ্ধ ডিম বিক্রির একটা খোলা দোকান ছিল, হাঁসের ডিম বিক্রি হতো। সিনিয়র অভিনেতা এস এম মহসীন একসঙ্গে ৩টা করে হাঁসের ডিম খেতেন।
ভূতের গলির সবচেয়ে কম বয়সী বাড়িটার বয়সও হতে হবে একশো বছর। যেমন, আজিজ ব্যাপারীর বাড়ি। এ রকম প্রায় ষাট-সত্তুরটা বাড়ি দেখা যাবে কাঁটাতে। প্রাচীন গলিও আছে বিশ-বাইশটা। মনে রাখা দরকার, ঢাকা একটি প্রাচীন শহর। আবার বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীপাড়ে তার গ্রামের পর গ্রাম। সেই গ্রামের বাড়ি বা জেলা-থানা শহরের গঠন আর পুরান ঢাকা এক নয়।
তিনি কাঁটাতে একটা বড়ো চরিত্র করেছেন। শুটিং শেষ হওয়ার পর এলো করোনা, তিনি করোনা অতিক্রম করলেন বটে তবে হয়তোবা বার্ধক্যজনিত কারণেই আকস্মিক মারা গেলেন। মহসীন ভাইয়ের কস্টিউমের ব্যাগটা আমার বাসায় রয়ে গেছে এখনো। তো একদিন মগবাজার কাঁটা ক্যাম্প থেকে টিমের একাংশ গেল ফের পুরান ঢাকায়। উদ্দেশ্য, আবদুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়ি নিশ্চিত করা। যদিও আজিজ ব্যাপারীর বাড়ি ছাড়াও কাঁটা ছবিতে দেখানো হবে এমন একটি মহল্লা, মহল্লার নাম ভূতের গলি। ভূতের গলির বাড়িগুলোর বয়স যেমন তিনশো বছর, কোনোটার বয়স দুইশো বছর। ভূতের গলির সবচেয়ে কম বয়সী বাড়িটার বয়সও হতে হবে একশো বছর। যেমন, আজিজ ব্যাপারীর বাড়ি। এ রকম প্রায় ষাট-সত্তুরটা বাড়ি দেখা যাবে কাঁটাতে। প্রাচীন গলিও আছে বিশ-বাইশটা। মনে রাখা দরকার, ঢাকা একটি প্রাচীন শহর। আবার বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীপাড়ে তার গ্রামের পর গ্রাম। সেই গ্রামের বাড়ি বা জেলা-থানা শহরের গঠন আর পুরান ঢাকা এক নয়। পুরান ঢাকা আছে শুধু পুরান ঢাকাতেই। কাঁটা পুরান ঢাকার ভূতের গলি মহল্লার গল্প। ২০১৮ সালে যখন কাঁটার শুটিং চলে, তখনো বা এখনো আছে কিছু পুরান বাড়ি। তবে দিন দিন এসব বাড়ি ডেভেলপারদের হাতে চলে গেছে বা যাচ্ছে। সেই হিসেবে কাঁটা ছবিতে পুরান ঢাকার যত বাড়ি দেখা যাবে, প্রায় ষাট-সত্তুরটা; এক ছবিতে এত পুরানো বাড়ি আমি আগে দেখিনি; বিশেষত ঢাকার ছবিতে। এর একটা আর্কাইভাল ভ্যালুজ থেকে যেতে পারে। আমার ভাবনা ছিল, সিক্সটিজের একটি মহল্লা দেখাতে হবে, যে মহল্লার বাড়িগুলোর বয়স সিক্সটিজেই থাকবে শতবছর আগের। একদা ভজহরি সাহা স্ট্রিট ওরফে ভূতের গলির ৩৬ নম্বর বাড়িতেই জন্মেছিলেন শহীদুল জহির। যদিও সেই ঢাকা আর নেই। কতকগুলো নতুন বাড়ির পরে একটা পুরনো বাড়ি হয়তো টিকে আছে; কিন্তু সেই বাড়িওয়ালা হয়তো শুটিংয়ের ক্যামেরা দেখলেই মনে করে, ছবি তোলার পর তার বাড়িটা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হয়ে যাবে, তখন তাকে কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে তার বাড়িটা নিয়ে নেবে। তাছাড়া সব পুরান বাড়িওয়ালাই তো আর শুটিং পছন্দ করে না। পছন্দ করা যায়ও না। শুটিং হলে এক নিমিষেই সব ওলটপালট করে দেয় শুটিংয়ের লোকেরা। তার মধ্যেও ষাট-সত্তুরটা বাড়ি ধরা গেছে কাঁটাতে। পুরনো বাড়িগুলো তো আর সারিসারি নয়, ফাঁকে ফাঁকে নতুন বাড়ি।
সঙ্গতকারণেই কাঁটায় কাটা কাটা শট, পুরান ঢাকায়। তাই বলে বাংলাদেশ তো আর এমন নয়। বাংলাদেশ নদীর পাড়ের গ্রামের দেশ। সেই নদীতেই নারীরা দল বেঁধে জল আনতে যায়। কাঁটা ছবির পাত্রপাত্রী সুবোধ-স্বপ্না তো ওরকম কোনো নদীপাড়ের গ্রাম থেকেই পুরান ঢাকার ভূতের গলিতে ভাড়াইট্টা হয়ে এসেছে। এ রকমই তো গল্পটা। নাকি? পাঠক, আপনি কি শহীদুল জহিরের কাঁটা গল্পটা পড়েছেন? তিন চারবার না পড়লে ধরা কঠিন হয়ে যাবে, সে আপনি যত উঁচুস্তরের পাঠকই হোন না কেন? ‘বিশ্বসাহিত্য’ তুলোধুনা করা পাঠককেও আমি প্রশ্ন করেছি, ‘কাঁটা পড়েছেন?’
হয়তো তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ। পড়েছি।’
আমি বলি, ‘গল্পটা একটু বলা যাবে সংক্ষেপে, কি দিয়ে কি ঘটল?’
বিশ্বসাহিত্যের তুলো ধুনে বিচি বের করে, সেই বিচি জাঁতায় পিষে ছাতু বানিয়ে খাওয়া পাঠককে আমতা আমতা করতে দেখি। হ্যাঁ, দেখি। অনেক লেখক গোত্রের পাঠককেও এমন করতে দেখি। সত্যি, কাঁটা শহীদুল জহিরের এমন একটি ফিকশন, এটা নট অনলি ফিকশন, কিয়দংশ হিস্ট্রিও। কাঁটা, ১৯৮৯-৯০ সালের বাস্তবতায় গল্পটি চিত্রিত। তখনকার সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনার ইতিহাস কাঁটাতেও দেখা বা জানা যাবে। আর ১৯৮৯ সালে গল্পটি ডেলিভারি হতে হতে হতে দুইটা ফ্ল্যাশব্যাক আমাদের নিয়ে যাবে প্রথমে ১৯৭১ সালে, পরে ১৯৬৪ সালে। গল্পটি ১৯৮৯ সাল পেরিয়ে পরের বছর ‘৯০ সাল পর্যন্ত গড়াবে। কিন্তু জনাব জহির খুবই ক্রিটিক্যালি ডিল করেছেন এই গল্পের বয়ান। মোটা দাগে কাঁটা ১৯৯০, ১৯৭১ ও ১৯৬৪ সালের গল্প। কাজেই, প্রচুর যাকে বলে ‘পোচুর’ রেফারেন্স, পর্যাপ্ত এভিডেন্স, তথ্য-উপাত্ত পুশ করতে হয়েছে চিত্রনাট্যেই। কাঁটার ব্যাকগ্রাউন্ডে যুক্ত তখন নির্মাতা আবিদ মল্লিক। আবিদ, শুভ, স্টিলের দায়িত্বে হোসেইন আতাহার—ওরা বাড়ি দেখে এসে ছবি দেখাল আমাকে। সেই বাড়ি, যে বাড়িতে আমি রাত বারোটায় গেছিলাম অভিনেতা মনোজ প্রামাণিকের ফোনে। পরদিন আমিও গেলাম নারিন্দায়, শরৎগুপ্ত রোড, হলুদ মসজিদের পাশে।
নাসিরুদ্দিন স্মৃতি ভবন। দেশভাগ পূর্ববর্তী সময়ে কোলকাতায় মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন সম্পাদনা করতেন ‘সওগাত’ পত্রিকা। সেই সওগাত-এ লিখতেন সে সময়ের নব-উন্মেষিত বাঙালি মুসলমান লেখকেরা। ‘সওগাত’-এর একজন উল্লেখযোগ্য লেখক বা কবির নাম কাজী নজরুল ইসলাম। নাসিরুদ্দিনের মেয়ে সম্পাদনা করতেন সেকালে মেয়েদের-মায়েদের পছন্দের পত্রিকা ‘বেগম’। উনাদের নারিন্দার বাড়িটা আমার পছন্দ হলো বটে, কিন্তু শুটিং উপযোগী করতে বাড়ির মৌল কাঠামতে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে—তাইলে গল্পের আরও কাছাকাছি হয়ে উঠবে, বুঝলাম। তো, নারিন্দায় গিয়ে কী হলো বা কি করলাম, তা এই মগবাজারে বসে বলব কেন? তাছাড়া মগবাজার থেকে নারিন্দায় যাওয়ার আগে তো আমরা জানতাম না, ওখানে কীভাবে কি ঘটবে? তাই মগবাজারের ইতিহাস কিছুটা না বলে গেলে কাঁটা জার্নি কীভাবে হয়? মগবাজারের কাঁটা ক্যাম্পের পরেই আমরা পৌঁছুব নারিন্দায়। কাঁটার সেন্ট্রাল লোকেশন। আবদুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়ি।
নয়শো জনের ইমেইল থেকে প্রাথমিক একটা বাছাইয়ের পর তিনশো জনকে আমরা অডিশনে ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। গাজী রাকায়েত ভাইয়ের ইস্কাটনের ‘চারুনীড়ম’ কার্যালয়ে চারদিনের অডিশন প্রক্রিয়া শেষ হয়। সেই তিনশো জনকে কয়েক ধাপে কল করা হতো আমাদের মগবাজার কাঁটা ক্যাম্প থেকে। একেকদিন একেক গ্রুপের রিহার্সেল হতো। অন্য দিকে চিত্রনাট্যের চাহিদা অনুযায়ী প্রপস, কস্টিউম সংগ্রহ এবং কেনাকাটা চলতে থাকে। একটি গরিব দেশে, যেখানে মানুষ সব কিছুই বিক্রি করে খায় বা তাদের খেয়ে বাঁচতে হয়, সেখানে সহজে তো আর পিরিওডিক্যাল এলিমেন্টস জোটে না, এটাই বাস্তবতা। যেমন, ১৯৮৯-৯০ সাল দেখাতে হবে কাঁটাতে। সেই সময়ের ভূতের গলির চৌরাস্তার মোড়ে বিহারি নাপিত আব্দুল আলীর ‘ইয়োর চয়েস সেলুন’ আমরা দেখতে পাব ছবিতে। দেখব যে, ইয়োর চয়েস সেলুনের সামনে সবসময় দুটি কাঠের বেঞ্চ পাতা থাকে। সেই বেঞ্চে বসে গল্প-গুজবে সময় কাটাচ্ছে মহল্লার কিছু বয়স্ক মুরুব্বি। সেলুনঘরের দেয়ালে তদানীন্তন সিনেমার পোস্টার, সিনে পত্রিকা চিত্রালী সাঁটানো আছে। ক্ষুর-কাঁচির সেলুন ঘর। বোরাক চিত্র, কিছু ভিউকার্ড চোখে পড়ে। ফুটপাতের পাশের সেলুন, একটি বড়ো আয়নার সামনে দুটি কাঠের চেয়ার আছে। বিহারী নাপিত আলী ক্ষুর-কাঁচি দিয়ে চুল কাটা বা সেভিংয়ের কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৮৯-৯০ সালের চিত্র এটি। এখন, ব্যবহারযোগ্য ক্ষুর-কাঁচির প্রচলন তো উঠে গেছে। কোথায় পাব? অনেক খোঁজাখুঁজি করে ব্যবহারযোগ্য এক সেট ক্ষুর-কাঁচির ব্যবস্থা হলো, নাটোরের লালপুর থেকে। এই ব্যবস্থাটা করেছে শুভ। শুভ কাঁটার লাইন প্রোডিউসার। এই মুহূর্তে রংপুরে অবস্থান করছে শুভ। সেই এলিফ্যান্ট রোড থেকেই শুভ আমার সঙ্গে আছে। একদা কবিতাই শুভর সঙ্গে আমার পরিচয় করায়ে দেয়। সে অনেক আগে। তখনো কাঁটা প্রোজেক্ট ভাবনায় আসেনি আমার। কিন্তু কাঠের চেয়ার, যা ব্যবহার করা হচ্ছে এমন, কোথায় পাব? নতুন চেয়ারে হবে না। নতুন চেয়ার বানিয়ে সেটাকে পুরনো একটা রূপকাঠামো দিয়েও হয় বা হতে পারে। কিন্তু আমার তখন মনে হচ্ছিল, ঢাকা শহরে তো এখন সেলুনে প্রায় সবই ফোম ব্যবহার করা চেয়ার, কিন্তু অরিজিনাল ব্যাবহারিক চেয়ার পেলে লুকটা ভালো হয়। কোথায় পাব সেই চেয়ার? একদিন আমাদের এক ভাগনে, চঞ্চল এলো মগবাজার কাঁটা ক্যাম্পে। চঞ্চল ঝিনেদাও থাকে, ঢাকাতেও থাকে। ঢের অর্থ-সম্পদ ডিল করে। অনেক দিন পরে দেখা, আড্ডা হচ্ছিল। চঞ্চল কথায় কথায় বলল, ‘মামা, কাঁটা সিনেমার জন্য আমি কী করতে পারি?’ বললাম, ‘সেলুনে ব্যবহার করা হচ্ছে এমন দুইটা কাঠের চেয়ার ম্যানেজ করে দিতে পারবা?’ সেই চেয়ারের ব্যবস্থা চঞ্চল করেছে। চেয়ার নিয়ে কাণ্ড ঘটেছে বেশ।
ঝিনাইদহ থেকে যশোর যাওয়ার পথে বিষয়খালি বাজার, সেই বাজারের এক সেলুনের দোকান থেকে চঞ্চল কাঠের দুইটা ব্যাবহারিক চেয়ার কেনে প্রথমে, তারপর সেই চেয়ার ঢাকাগামী বাসের ছাদে তুলে দেবে, এমনই কথা। কিন্তু বাস ছাড়ার আগে মুহূর্তে নাকি ঝামেলা লেগে গেল। সেই সেলুনের শীল নাপিত এসে নাকি কাঁদো কাঁদ গলায় বলছে, ‘না, আমার সেলুনের চেয়ার বেচব না, ফিরায়ে নেব।’
‘কেন?’
‘চেয়ার বিক্রির পর আমার বাড়ির লোকজন বলতেছে কাজটা ভালো হয়নি। এতে আমার সর্বনাশ হতে পারে।’
‘কিসের সর্বনাশ?’
‘আপনারা চেয়ার নিয়ে কি করবেন তার ঠিক আছে? যদি চেয়ারে মন্ত্র মারেন? তাইলে তো আমার জীবন শেষ। আমার বউছেলেমেয়ে শেষ। আমি নাকি নির্বংশ হয়ে যাব?’
‘আমরা চেয়ারে মন্ত্র মারব না, চেয়ার সিনেমার সেলুন ঘরে ব্যবহার হবে।’
‘ঢাকায় কি চেয়ারের অভাব পড়ছে? আমার চেয়ার ফেরৎ দেন।’
ফাইনালি, চেয়ার বাসের ছাদ থেকে নামানোর আগেই বাস ছেড়ে দেয়। চঞ্চল আমাকে ফোন করে জানিয়ে দিল, ‘মামা, চেয়ার সন্ধ্যার মধ্যেই ঢাকার গাবতলী পৌঁছে যাবে।’
কিন্তু চেয়ার আসেনি। ছয় থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যেই চেয়ারের বাস গাবতলী এসে যাওয়ার কথা। আমি মগবাজার ক্যাম্প থেকে লোক পাঠালাম গাবতলী। কিন্তু সেই বাস নাকি ঢাকায় আসেনি!। পরদিন জানা গেল, সেই বাস সাভারে এসে দুর্ঘটনায় পড়ে। বাস থেকে যাত্রীরা নেমে অন্য গাড়িতে করে ঢাকায় ফেরে। চেয়ার থেকে যায় সাভারে, বাসের ছাদে। বাস তখন পুলিশের জব্দ করা মাল, চেয়ারও। আমরা পড়লাম ফ্যাসাদে। এবং ২৪ ঘন্টা পরে ফ্যাসাদ থেকে উদ্ধার পায় চেয়ার, চেয়ার চলে আসে মগবাজার কাঁটা ক্যাম্পে। বিহারী নাপিত আব্দুল আলীর চরিত্রে কাস্টিং তখন আমাদের বন্ধু, অভিনেতা আমিনুর রহমান মুকুল। নাটোর থেকে আনা ক্ষুর-কাঁচি দিয়ে, সেই চেয়ারে বসিয়ে চুল কাটা অনুশীলন শুরু হয়ে গেল। মুকুল সেলুনের ক্ষৌর কর্মটি শেখার জন্য মগবাজার কাঁটা ক্যাম্পের পাশেই এক সেলুন ঘরে কদিন সারা দিন সময় দিলেন। সেই সেলুনের নাপিতের সহকারী হিসেবে ট্রেনিং শুরু। কদিন পর কাঁটা ক্যাম্পে সবার চুলদাঁড়ি ক্ষুরকাঁচি দিয়ে কাঁটা শুরু হলো সেই ঐতিহাসিক চেয়ারে বসিয়ে। কিন্তু সেলুনের কাজ এমনই কাজ, এটা দীর্ঘদিন ধরে অনুশীলন না করে এলে এই চরিত্রে কর্মরত অবস্থায় অভিনয় সম্ভব নয়। সম্ভব যে নয়, তার প্রমাণ, মুকুল কাঁটা টিমের যাদেরই চুল দাঁড়ি কেটেছেন, তারা পরদিন বলেছে, ‘উফ, ব্যথা হয়ে গেছে মাথা।’ হবেই তো! তখন ভাবনার মধ্যে এলো, সেলুনের কাজ করে থাকে এমন একজন অভিনেতা হলেই ব্যাপারটা ভালো হয়। সেভাবেই, আমরা পরে পেয়ে যাই অভিনেতা অশোক শীলকে। বিভিন্ন ধরনের ছোটো ছোটো ক্যারেক্টার তিনি আগে করেছেন বটে, তবে কাঁটায় তার চরিত্রটি মোটেই ছোটো নয়। বরং গল্প-তরঙ্গের মূল স্টেশনটি তো এই সেলুন ঘরই। বিহারী নাপিত আব্দুল আলী চরিত্রে খুব ভালো কাস্টিং হয়ে গেল অশোক শীল। বিহারী নাপিত, কিছুটা উর্দুও তার সংলাপে আছে, খুব ভালো ডেলিভারি করেছেন অশোক’দা।
উপযুক্ত লোকেশন, কাস্টিং, প্রপস, কস্টিউম—এসব নিয়ে দারুণ ব্যস্ত সময় কেটেছে আমাদের, মগবাজারে, কাঁটা ক্যাম্পে। পিরিওডিক্যাল ছবি হিসেবে প্রপস, কস্টিউম খেয়ালে নিতেই হবে। ১৯৯০ সালে সিনেমার নায়িকাদের নানারকম ভিউকার্ড পাওয়া যেত বাজারে, কেউ কেউ হাতে রেডিও নিয়ে ঘুরত, রেডিও থেকেই দূরদূরান্তের সংবাদ শুনত মানুষ। ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি তো একটা বিরাট ফ্যাক্টর হয়ে ছিল সাধারণ মানুষের কাছেই। ঢাকা বা বাংলাদেশ-ভারতের কিংবা বিশ্বের বড়ো কোনো সংবাদ বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে পেতে চেয়েই মানুষ রেডিওতে নির্ভরতা খুঁজত। টেলিভিশন তো তখন ঘরে ঘরে আসেনি, কোনো কোনো বাড়িতে ছিল। টেলিভিশনে খবর দেখার এত অভ্যাস ও সহজাত সুযোগ ছিল না, যতটা ছিল রেডিওতে। পাশাপাশি মানুষ পত্রিকা পড়ত। সচরাচর দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক বাংলা, দৈনিক ইনকিলাব দেখা যেত সাধারণ মানুষের হাতে। যেমন, একাত্তর সালে পড়ত দৈনিক পাকিস্তান। ১৯৬৪ সালের প্রপসও তাই আলাদা কিছু। কাজলদানি দিয়ে স্বপ্না চোখে কাজল লাগায়, ৬৪ সালে। কত কিছু যে… প্রায় আড়াই হাজার পিরিওডিক্যাল প্রপস ঢুকেছে কাঁটায়। পাঁচশো চরিত্রের কস্টিউমও একটা ব্যাপার। বিশেষ করে ১৯৬৪, ১৯৭১ ও ১৯৯০—তিনটি সময়ের কস্টিউম। অনেক জামাকাপড়, অনেক শাড়ি।
গাবতলী পার হয়ে আমিনবাজার। আমিনবাজার পার করে কিছুদূর যেতেই, সাভারের আগেই হেমায়েতপুর। হেমায়েতপুর নেমে দুই কিলো ভেতরে একটি ফাঁকা মাঠ, মাঠের মধ্যে একটা বাড়ি, টালি বাড়ি। টালিবাড়ির নামেই মৌজার নামকরণ হয়ে গেছে টালিবাড়ি মৌজা। টালিবাড়িতে বসে হাওয়া খায় শিল্পী কনক আদিত্য ও শিল্পী ইশরাত জাহান। দুজনেই চারুকলার ছাত্র। বুটিক হাউস ‘দেশাল’ সাম্রাজ্যের সৃজনশীল অধিপতি। নতুন নতুন ডিজাইনে দেশাল বাংলাদেশে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের সাক্ষর রেখেছে। প্রথম দিকে মানে লেইট নাইনটিজে দেশালের একটি রঙের টি-শার্ট, পাঞ্জাবী বা চাদর আমার শরীরে থাকত। মনে হয় আমার জন্যই বানানো হতো। তখন দেশাল ছিল শুধু আজিজ মার্কেটে, যেখানে আমাদের যৌবন আমরা অকাতরে ঢেলে দিয়েছি একদা। সে এক সময় এসেছিল শাহবাগে। শাহবাগ তখন বাংলা কবিতার তরুণ রাজধানী। আমরা বন্ধুরা তখন সন্ধ্যায় একেকটা জোনাকি। আমরা মাঠের রাখাল। আমরা বাজাই বাঁশি। আমরা কত কিছু ভালোবাসি। চারুকলার ছাত্র ছিলাম বলে টিএসসি থেকে শাহবাগ আমার উঠোন বাড়ি। আজিজ মার্কেট আমার বারান্দা। কাঁটাবন-নীলক্ষেত খেলার মাঠ। আজিমপুর-পলাশী বা ওদিকে হাতিরপুল-বাংলামটর-ইস্কাটন আমার পাশের বাড়ি। আমাদের বাড়িতে দু’দুটো বাগান। একটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, একটা রমনা। একটা মিউজিয়াম আছে আমাদের বাড়ির কোণায়, জাতীয় জাদুঘর নামে যা আজ পরিচিত। কয়েকটি হাসপাতাল আছে বাড়ির আশপাশে। আজিজের দিনগুলোতে আমরা ছিলাম। কবি বন্ধু, লেখক বন্ধু, গায়ক বন্ধু, নায়ক বন্ধু, নির্মাতা বন্ধু, বেকার বন্ধু, নেশার বন্ধু, পেশার বন্ধু—সব ছিল আমাদের। ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে সেই সময়, সেই বন্ধুত্ব।
অবশ্য কারো কারো সঙ্গে এখনো অটুট বন্ধুত্ব টিকে আছে। শাহেদ সাফায়েত, আদিত্য কবির, ব্রাত্য রাইসু, শামীম কবীর, মজনু শাহ, মারজুক রাসেল, জাফর আহমদ রাশেদ, কামরুজ্জামান কামু, নূরুল আলম আতিক, মাসরুর আরেফিন, জহির হাসান, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, ফিরোজ এহতেসাম, আশরাফ রোকন, মাহবুব কবির, আকরাম খান, রাশেদ এন চৌধুরী, সনতু বেলাল, পারভেজ চৌধুরী, আলফ্রেড খোকন, বদরে মুনীর, গাজী মাহতাব উদ্দিন হাসান…কতজনের নাম একটানে মনে আসে। আবার এখন মনে এলো না কিন্তু একটু পরেই মনে পরবে, এ রকমও বন্ধু আমার আছে। সবারই থাকে। তারেক শাহরিয়ার, জাহিদুর রহিম অঞ্জন, আহমদ ছফা, ফরহাদ মজহার, এস এম সুলতান বা আব্দুর রাজ্জাক…বা আল মাহমুদ-শামসুর রাহমান, সুনীল-শক্তি-বিনয় কে নেই আমাদের দুর্বিনীত দিনে? র্যাবো, মালার্মে, বোদলেয়র… ইয়েসেনিন, মায়াকোভস্কি, মোহাম্মদ খসরু, বব ডিলান, গুন্টার গ্রাস, সুবিমল মিশ্র, তিরিশের তিন বাড়ুজ্যে, কমলকুমার-অমিয়ভূষণ আমাদের বন্ধু। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আমাদের বন্ধু, যেমন বন্ধু সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল’দা আমাদের বন্ধু। এস এম সুলতান, সুমন চট্টোপাধ্যায়, বা ছেউড়িয়ার লালন ফকির, কে নেই আমাদের আড্ডায়? সেলিম মোরশেদ, শহীদুল জহির, অদিতি ফাল্গুনী, প্রশান্ত মৃধা, আহমাদ মোস্তফা কামাল, কফিল আহমেদ, রাইহান রাইন, মামুন হুসাইন, পারভেজ হোসেন, নভেরা, ম্যুর, শামীম শিকদার, সিমন দ্য বোভোয়ার, ওরহান পামুক, হুমায়ুন আজাদ—সবাই আমাদের বন্ধু। নীটশে আমাদের বন্ধু। গগ্যা, মাতিস, দালি, দেলাক্রোয়া, কুরোসাওয়া আমাদের বন্ধু। বন্ধু বুঝলাম, কিন্তু সবাই কি আজিজ মার্কেটে আসতেন? আসতেন কি আসতেন না, সেই কথা তো এখানে দরকার নেই। আর, আমিও ছিলাম জার্নি অব কাঁটায়, ছিলাম টালিবাড়ি—এসব ফেলে এখন শাহবাগ আজিজ মার্কেটে কেন?
কনকের গলায় গান শুনি। কনক মানুষটা একালের, কিন্তু ওর গলাটা শ্রী চৈতন্য দেবের সময়কার, মনে হয়। সেই সময় থেকেই একটা মায়াতুর গলা আমাদের আহবান করে, ‘তুমি আমার পাশে বন্ধু হে, একটু বসিয়া থাকো…’। বসে বসেই কনকের দোতারার টান শুনি।
টালিবাড়ির কাঠের বারান্দায় দখিনা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে কনক-ইশরাতের সঙ্গে কাঁটা নিয়ে শেয়ার করি। কনক কাঁটার স্টোরি লাইন শুনে দারুণ আকর্ষণ বোধ করে। পুরনো দিনের গল্প উঠে আসে টালিবাড়িতে, কনকের সঙ্গে, ইশরাতের সঙ্গে। যে দিন ছিল আমাদের চারুকলায়, সেইসব দিন এসে ঢুকে পড়ে লীলাবতী দিঘির ধারে, টালিবাড়ির বাঁশ-কাঠ পাটাতনে। খুব আনন্দ হয়। খুব ভালো লাগে সেই দিন। কনকের গলায় গান শুনি। কনক মানুষটা একালের, কিন্তু ওর গলাটা শ্রী চৈতন্য দেবের সময়কার, মনে হয়। সেই সময় থেকেই একটা মায়াতুর গলা আমাদের আহবান করে, ‘তুমি আমার পাশে বন্ধু হে, একটু বসিয়া থাকো…’। বসে বসেই কনকের দোতারার টান শুনি। এর আগে একবার ‘রাজপুত্তুর’ প্রোডাকশনের সকল পোশাক বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল দেশাল থেকে। খুব সুন্দর হয়েছিল। কাঁটার কস্টিউম বলতে অনেক শাড়ি লাগবে, তিন সময়ের পাত্রীরা পরবে। সেই অনুযায়ী ইশরাত বলে দিয়েছিল ঢাকায় দেশালের কয়েকটি শো রুমে। আমরা কাঁটা টিম নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেশালের শো রুমে গেলাম। শাড়ির নকশা দেখে দেখে প্রচুর শাড়ি বাছাই করে বিরাট বিরাট কার্টুনে সেই শাড়ি নিয়ে চলে গেলাম মগবাজার, কাঁটা ক্যাম্পে। যেকোনো একটা শাড়ির ব্যাকাপে একই শাড়ি আরও তিন বা চারটা নিলাম আমরা। ‘শুটিংয়ের সময় যদি একটা শাড়ি তাৎক্ষণিক ছিঁড়ে যায় বা ভিজে যায়! এটা ইশরাতই আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল। কাঁটার জন্য সরাকরি অনুদানের এক কিস্তি অর্থের পর আমি একটি বড়ো স্পন্সর পাই ফরাসগঞ্জ থেকে মগবাজার আসার কদিন পরেই। সেই স্পন্সরের বুনিয়াদেই কাঁটা ক্যাম্প, অডিশন, কাঁটা টিম গঠন বা সামগ্রিক তোড়জোড় শুরু। তৃতীয় সাপোর্ট দেশাল থেকে, কনক ও ইশরাতের কাছ থেকে। কাঁটা একটা ভালো ছবি হবে, এ ব্যাপারে আমার আত্মবিশ্বাস ও দায়বদ্ধতা আরেক ধাপ বাড়িয়ে দেয় টালিবাড়ি। কাঁটা তো এখন নির্মাণ প্রায় দ্য এন্ড। এই পর্যায়ে কাঁটা টিম অনেক বড়ো রকম কৃতজ্ঞ এই দুজন মানুষ ও দেশাল প্রতিষ্ঠানটির কাছে। দুজন বলতে কনক ও ইশরাতের কথা বলছি আমি। দেড়কোটি টাকা শুধু প্রোডাকশন ব্যয় ছবির, যেহেতু এটা শহীদুল জহির, যেহেতু এটা কাঁটা, যেজেতু প্রায় পাঁচশো পাত্রপাত্রী, যেহেতু এখানে তিনটি আলাদা আলাদা পিরিয়ড, যেহেতু পিরিওডিক্যাল প্রপস বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে প্রায় সংরক্ষিতই নেই। পাঁচশো পাত্রপাত্রীর রেমুনারেশন ও ব্যকগ্রাউন্ড টিমের রেমুনারেশন কত হবে, যদি প্রায় সিক্সটি প্লাস ডেইজ শুট ডেট হয়! সেটি পরিপূর্ণভাবে যুক্ত হলে আরও অর্থ যুক্ত হবে দেড় কোটির টাকার সঙ্গে। একই লোকেশনে আমরা শীত ধরেছি, বর্ষা ধরেছি, গ্রীষ্ম ধরেছি নয় মাসে। হ্যাঁ, নয় মাসে প্রোডাকশন-যুদ্ধ করেছি। অনেক বিপদের মুহূর্ত এসেছে, সেই বিপদের সাঁকো পার হয়ে গেছি পরিশ্রম, আত্মবিশ্বাস ও ভালোবাসায়। অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা পার করেছি আমরা। আমাদের টিম খুব কষ্ট করেছে। আমার মেজাজ সহ্য করেছে। যেদিন কনকের সঙ্গে শেয়ার হয় টালিবাড়িতে, কনক আমাদের কাঁটা টিমের একজনকে বলছিল, ‘চিনি তো, ঠাকুরের মেজাজ ঠিক রাখার জন্য শুটিং সেটে এমন কাউকে সবসময় রাখা যায় না, যাকে দেখে মেজাজ ঠিক থাকবে? তাইলে কিন্তু ভালো হবে।’ কনক আর রাহুল গড়েছিল গানের দল ‘জলের গান’। জলের গান-এর কত গান যে মানুষের মুখে মুখে ফেরে! রাহুল আমার প্রথম চাইল্ড ‘ব্ল্যাকআউট’ এর প্রধান দুই চরিত্রের একজন। আরেকজন তানভীর। তানভীর আত্মহত্যা করেছে।
টালিবাড়ি থেকে ফেরার পথে হেমায়েতপুর আসতে আসতেই ব্যাপক বৃষ্টি। আমরা ঢাকার পথে যখন, ততক্ষণে টালিবাড়ির মাঠজুড়ে বৃষ্টি, যেরকম বৃষ্টি আসে গগনডাঙায়। গগনডাঙা ভেসে যায় বৃষ্টিতে; রাতে, ভেসে যায় জ্যোৎস্নায়। কাঠের পাটাতনে বসে খুঁড়ো তামাক সাজিয়ে দুটো টান মেরে দোতারা নিয়ে বসে। খুঁড়ো গলা চড়ায় হাওয়ায়; হাওয়া ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে এক গলিতে ফেলে দেয়। সেই গলি, ভূতের গলি। কনকের শাশুড়ি বা ইশরাতের মা লালবাগের মেয়ে। তিনি এসেছেন কাঁটা ক্যাম্পে, আমাকে পুরান ঢাকার ভাষা ও পারিবারিক সংস্কৃতির ব্যাপারে জানিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন। কতটুকুই বা আর নিতে পেরেছি তাঁর কাছ থেকে? ভীষণ জানাশোনা মানুষ। এই মুহূর্তে তাঁর নাম আমার মনে আসছে না। আমাদের বিহাইন্ড দ্য ক্যামেরায় উনার সাক্ষাৎকার নিয়েছি আমরা। নারিন্দায়, কাঁটার সেটে বসে। কত মানুষ যে একটি ছবিকে হয়ে উঠতে জড়িয়ে পড়েন, তার কোনো হিসেব থাকে না।
কাঁটা ক্যাম্পে সুবোধ-স্বপ্না, আজিজ ব্যাপারীর জন্য তখন অভিনেতা কনফার্ম করার চেষ্টা করছি আমরা। কুলসুম কনফার্ম করার চেষ্টা করছি। কিন্তু মাওলানা আবুবকর কে হবে? একজন পাক্কা মাওলানা লাগবে, যাকে দিয়ে আবার অভিনয়টা বের করা যাবে। চরিত্রের বিবরণ অনুযায়ী শব্দগ্রাহক বন্ধু নাহিদ মাসুদ বলল, ‘মোসলেম ভাইকে দ্যাখেন, আমার মনে হয়, আপনি যা চাচ্ছেন, পাবেন।’ মোসলেম ভাই থাকেন পাবনা শহর থেকে দশ কিলো দূরে টেবুনিয়া বাজার, সেই বাজার থেকে আড়াই কিলো দূরের বারোইপাড়া গ্রামে। প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের মাটির ময়না ও রানওয়ে ছবিতে মোসলেম ভাই অভিনয় করেছেন বা তারেক ভাই তাকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন। নাহিদের থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে মোসলেম ভাইকে ফোন করি। মোসলেম ভাই কবি ইদ্রিস আলীকে নিয়ে এসেছিলেন কাঁটা অডিশন ক্যাম্পে, গাজী রাকায়েত ভাইয়ের চারুনীড়মে। মোসলেম ভাই মগবাজার ক্যাম্পে চলে এলেন, বললেন, ‘আমারে স্ক্রিপ্ট দেন। মুখস্ত করে ফেলাই।’ বললাম, ‘আপনি তো পাবনার লোক, কিন্তু মাওলানা আবুবকর চরিত্রটি পুরান ঢাকায় এসেছিল হয়তো নোয়াখালীর ছাগলনাইয়া থেকে। কাজেই, কথা বলবে নোয়াখালীর ভাষায়। পারবেন না?’
মোসলেম ভাই বলেন, ‘আল্লাহ ভরসা।’ মোসলেম উদ্দিন পাবনা থেকে এসে এসেই থাকেন কাঁটা ক্যাম্পে, কখনো আমার মগবাজারের বাসায়। নারিন্দায় শুটিং চলাকালে এসে থাকতেন। পরে আমার বর্তমান বাসাতেও এসেছেন। পাবনায় আমি তাঁর বাড়িতে গিয়ে থেকেছি। মনে আছে, শুটিং চলাকালীন এক রাতে মোসলেম ভাই পাবনা থেকে ঢাকায় এলেন। তিনি গাবতলীতে যখন সিএনজি বাহনে ওঠেন, বলেছেন, ভূতের গলি মসজিদের সামনে নামায়ে দেবেন আমাকে।’ রাত চারটার সময় মোসলেম ভাইয়ের ফোন পেলাম। বললেন, ‘আমি এখন ভূতের গলি মসজিদের সামনে আছি। আপনারা কই?’
‘কোন ভূতের গলি?’
‘ভূতের গলি কয়ডা? আমি হাতিরপুল ভূতের গলি মসজিদের সামনে আছি। স্ক্রিপ্টে তো ভূতের গলিই লেখচেন আপনি?’
‘এই কি জীবনের প্রহসন, মোসলেম ভাই?’ মোসলেম ভাই বলেন, ‘ঠিকই আছে। মনে করেন এটাই আমার প্রতিবাদ। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পাইনি, তাই রাজাকারের লিডার হয়ে গেলাম ভূতের গলিতে। হা হা হা।’ হাসতে থাকেন মোসলেম ভাই।
আমরা তখন নারিন্দায়, হলুদ মসজিদের পাশে, শরৎগুপ্ত রোডে। আর স্ক্রিপ্টের ভূতের গলি তো ভজহরি সাহা স্ট্রিট, সেইটা তো আমরা বানাচ্ছি। কিন্তু মোসলেম ভাই স্ক্রিপ্টে পড়েছেন ভূতের গলি, তাকে বলা হয়েছে, চলে আসেন শুটিং শুরু হয়ে গেছে ভূতের গলিতে। তিনি এসেছেন। কিন্তু রাত চারটায় পৌঁছেছেন হাতিরপুল ভূতের গলিতে। আমি নারিন্দা থেকে লোক পাঠালাম হাতিরপুলে, সেই রাত চারটায়। মোসলেম ভাই পৌঁছলেন নারিন্দায়। আমি অনেক আনন্দিত, কাঁটার মাওলানা আবুবকর চরিত্রে মোসলেম ভাইকে পেয়ে। মোসলেম উদ্দিন এক বিরল ধরনের মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। হাসিখুশি মানুষ। তিনি জানান, ১৯৭১ এ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তাঁর নাম ওঠেনি। পাবনার এক রাজাকারকে ধরে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নিয়ে আসেন, কালে একদিন সেই রাজাকারও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পায়, বেতন ভাতা পায়। অথচ মোসলেম ভাইয়ের নাম ওঠেনি মুক্তিযোদ্ধার সরকারি তালিকায়। এ এক আশ্চর্য গল্প। এ রকম গল্প বাংলাদেশে আরও রয়েছে, সে কথা আমরা শুনে আসছি। আর কী কাকতালীয়! মোসলেম ভাইকে করতে হলো ভূতের গলির শান্তি কমিটির নেতা চরিত্র। রাজাকারদের নির্দেশ দাতা তিনি। ‘এই কি জীবনের প্রহসন, মোসলেম ভাই?’ মোসলেম ভাই বলেন, ‘ঠিকই আছে। মনে করেন এটাই আমার প্রতিবাদ। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পাইনি, তাই রাজাকারের লিডার হয়ে গেলাম ভূতের গলিতে। হা হা হা।’ হাসতে থাকেন মোসলেম ভাই। এই পর্বে কাঁটার অন্যতম প্রধান একটি চরিত্র মাওলানা আবুবকর, তাঁকে বা মোসলেম ভাইকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। পরে মগবাজার থেকে যখন আমরা নারিন্দায় পৌঁছুব, তখন মোসলেম ভাই বা মাওলানা আবুবকরকে নিয়ে আরও কাহিনি জানাব। কাহিনির শেষ নেই।
কাঁটার অডিশনেই আমরা পেয়েছি মোসলেম ভাইকে। পরের পর্ব থেকে কাঁটার পাত্রপাত্রীদের পরিচয় করাতে থাকব আমরা। যেমন, এই পর্বে মাওলানা আবুবকরকে আপনারা, দেখতে পেলেন, তাঁর সম্পর্কে কিছু জানতে পারলেন। মোসলেম ভাইই কাঁটার অন্যতম প্রধান অভিনেতা। আগেই বলেছি, বিরল ধরনের মানুষ মোসলেম উদ্দিন, যিনি কাঁটাতে হয়েছেন মাওলানা আবুবকর। এবং তারেক মাসুদের মাটির ময়নাতে ছিলেন বড়ো হুজুর, রানওয়েতে ছিলেন উর্দু ভাই। কিন্তু কাঁটাতেই তিনি তুলনামূলক বেশি সময় স্ক্রিনে থাকেবন দর্শকের সামনে, আপনাদের সামনে। দেখবেন, একজন মাওলানা কেমন জমকালো অভিনয় করেছেন কাঁটা ছবিতে।
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৫ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৬ষ্ঠ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৭ম পর্ব
জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস: ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।