তুমুল বৃষ্টিতে রেইনকোট ও গামবুট পরে ভিজতে ভিজতে তেহরানের রাস্তা ধরে বাসায় ফিরছে এক লোক। এমন বৃষ্টির দিনেও তার চোখে সানগ্লাস। মাঝে মাঝে ভ্রু কুঁচকে এদিক সেদিক ইতিউতি করছেন। হয়তো মেপে নিচ্ছেন কোনো দৃশ্য। চওড়া কপাল ও টাকওয়ালা মানুষটার বাড়ি ফেরার পথ থেকেই বেরিয়ে আসেন একজন আব্বাস কিয়েরোস্তামি।
তেহরান শহরের বৃষ্টির কথা বললে আমার মনে পড়ে একজন কিয়েরোস্তামির কথা। যেমন চেরি ফুলের স্বাদের কথা বললে আমার মনে পড়ে একজন কিয়েরোস্তামির কথা। হলুদ ট্যাক্সিতে চড়ে মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে যিনি ঘুরছেন রাস্তায়। এই পরিভ্রমণে আমরাও তার সঙ্গী হই।
কেন জানি না এখনো বৃষ্টি পড়লে আমার মনে পড়ে কিয়েরোস্তামির কথা, তার সিনেমার কথা মনে পড়ে। কাকতালীয়ভাবে কিয়েরোস্তামি যেদিন মারা যান সেদিন ঢাকাতেও বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি ট্রেনে করে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরছিলাম। ট্রেন যাত্রা সবসময় আমাকে বিষণ্ন করে দেয়৷ তবে বৃষ্টি, ট্রেন যাত্রা ও কিয়েরোস্তামির মৃত্যু সবমিলিয়ে বিষণ্নতা সেদিন আমাকে ধসিয়ে দিয়েছিল। সারাদিন আমি পাতা থেকে পাতার দূরত্ব মেপেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম। আমার বারবার মনে পড়ছিল প্রথম কিয়েরোস্তামি আবিষ্কারের কথা। কেমন ছিল অদ্ভুত সেই আবিষ্কার!
২০০৮-০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ার সময় কিয়েরোস্তামির সঙ্গে আমার পরিচয়। বন্ধু জাবেরের কাছ থেকে নিয়ে দেখেছিলাম ‘হোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম’। সে সময় কিছু শর্ট ফিল্মও দেখা হয়। সেই দেখা ছিল একেবারেই নতুন। এমন কিছু, নির্মাণ আগে দেখিনি। তবে আমার সেই কিয়েরোস্তামি দেখা ছিল আংশিক।
প্রথম সেই দেখার পর অনেকদিন কিয়েরোস্তামির আর কিছু দেখিনি। ২০১১-১২ সালের দিকে গিয়ে দ্বিতীয় বার কিয়েরোস্তামি দেখা শুরু করি।
কোনো এক মন খারাপ করা বিকেলে ‘টেস্ট অব চেরি’ দিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে কিয়েরোস্তামি দেখা শুরু করেছিলাম। দেখতে দেখতে সেদিন মি. বাদির সঙ্গে মৃত্যু পরোয়ানা হাতে আমিও রাস্তায় নেমে পড়েছিলাম। অদ্ভুত এক বিষণ্নতা ও ভালো লাগা সেদিন আমার ওপর চেপে বসেছিল। ঠোঁটের কোণে ভর করেছিল বিহব্বলতা। যা আমি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। সেদিন ব্যক্তির অস্তিত্বের সংকট ও দেখার আনন্দ দুটোই আমি বোধ করেছিলাম।
এক সাক্ষাৎকারে কিয়েরোস্তামি সিনেমায় কবিতার মতো বিমূর্ততার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। শেহেরজাদে ও আরব্য রজনীর মতো করে গল্প বলার যে ধারা সেটি থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলেছিলেন। নিজের প্রতিটি সিনেমায় এই সম্ভাবনাকে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করেছেন। তবে বিমূর্ততার ব্যবহারের পরও কিয়েরোস্তামি গল্প থেকে খুব বেশি দূরে ছিলেন না৷ কিন্তু তার গল্প বলার ভঙ্গিটা ছিল অভিনব। গল্প বলার সেই পদ্ধতিটা ন্যারেটিভকে শুষে নিতে পারে। তাই গল্প আপনার ওপর চেপে বসে না। দেখার সৌন্দর্যটাই বরং প্রমিনেন্ট হয়ে উঠে। যা আনন্দ ও বিষণ্নতার অনুভূতি নিয়ে আমাদের ওপর ভর করে। পাশাপাশি গল্পের যে সুর সেটিও কোনো না কোনোভাবে আমাদের ভেতর রয়ে যায়। সব মিলিয়ে কিয়েরোস্তামির ছবি যেমন গল্পের বোঝা চাপিয়ে দেয় না, তেমনি এটি কেবল পোয়েটিক কিংবা দার্শনিক আখ্যান হয়ে থাকে না। বাস্তবতার কাছাকাছি গিয়ে তুলে আনা চরিত্রগুলোর নিরীহ অভিব্যক্তি তার সিনেমার বড়ো শক্তি। যে কারণে, এই ধরনের সিনেমায় যে ইনোসেন্সের প্রয়োজন সেটিও বজায় থাকে।
এই সময়ে এসে অনেককেই বলতে শুনি কবিতার মতো সিনেমার কথা। এই ‘কবিতার মতো সিনেমা’র বিষয়টিতে আমার কিঞ্চিৎ আপত্তি আছে। আমার মনে হয়, কবিতা কবিতাই, সিনেমা হলো সিনেমা। একটাকে আরেকটা দিয়ে বিশেষায়িত করা অপ্রয়োজনীয়। কিয়েরোস্তামির সিনেমা নিয়েও অনেককে এমনটা বলতে শুনি। কিয়েরোস্তামি অবশ্য কবিও। তার কবিতা ও সিনেমার স্নিগ্ধতা অনেকটাই কাছাকাছি কিন্তু তবু দুটো একেবারে আলাদা। তার ক্ষেত্রেও একটা শিল্পমাধ্যমকে আরেকটা দিয়ে বিশেষায়িত করা নিষ্প্রয়োজন।
যাই হোক, আমি মূলত আমার অনুভূতি ও উপলব্ধির কিয়েরোস্তামি কেমন সেটা বলতে চেয়েছি। এমন না যে, এবারই প্রথম বলছি। এর আগেও আমি কিয়েরোস্তামি নিয়ে লিখেছি। আমি হয়তো সামনেও লিখব। আমার লিখতে ভালো লাগে। পৃথিবীর যে অল্প কটি আশ্রয়ে আমি নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে পারি কিয়েরোস্তামি তার একটি। তার সিনেমা হোক কিংবা কবিতায় আমি নিজেকে খুব সহজেই খুঁজে নিতে পারি।
কবি ও কথাসাহিত্যিক
জন্ম ১৯৮৮, চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর। প্রকাশিত বই : সূর্যাস্তগামী মাছ (কবিতা) ব্রায়ান অ্যাডামস ও মারমেইড বিষ্যুদবার (কবিতা) শেফালি কি জানে (না কবিতা, না গল্প, না উপন্যাস) ক্ল্যাপস ক্ল্যাপস (কবিতা) দ্য রেইনি সিজন (কবিতা) প্রিয় দাঁত ব্যথা (কবিতা) বিষাদের মা কান্তারা (উপন্যাস) সন্তান প্রসবকালীন গান (কবিতা)