আফসার মিস্ত্রি দরজা খুঁজছে। এই বিকেলে হঠাৎ তার এই চিন্তা হয় যে সে দরজা খুঁজে পাচ্ছে না। দরজা খোঁজার জন্য ঘরের বাইরে দাঁড়ালে সে দেখে তার ছেলেরা, তার মেয়েরা দূরে যেতে যেতে তার সকল দরজা নিয়ে গেছে। অতঃপর আফসার মিস্ত্রি প্রান্তরের দিকে হাঁটতে থাকে, যেখানে বেশ কিছু বৃক্ষ ছায়া দেবার জন্য, দরজা হবার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আফসার মিস্ত্রি জানে প্রতিটি বৃক্ষ একাধিক দরজার সম্ভাবনা। তবে কতোটুকু হাঁটলে একটা বৃক্ষের নিকটে যাওয়া যায় কিংবা একটা বৃক্ষের ছায়ার নিচে যাওয়া যায় আফসার মিস্ত্রি বুঝতে পারে না। আফসার মিস্ত্রি দূর্বল শরীরে হাঁটতে থাকে। পৃথিবীর সকল হাঁটা অন্তহীন হলে তার হাঁটাও অন্তহীন। বৃক্ষসমূহের দূরত্বও অন্তহীন। আর এই যে বিকেল, সেও অন্তহীন হবার চেষ্টা করছে। বিকেলটা অন্তহীন হবার চেষ্টা করলে আফসারউদ্দীন মিস্ত্রি বিকেলটার প্রতি মমত্ব বোধ করে। বিকেলের এই দৈর্ঘ্য তার শরীরের সকল প্রান্তরে আনন্দ সঞ্চালিত করে। দূরে তাকায় সে— যখন প্রতিটি বিকেল মানুষকে আহবান করে নদীর পাড়ে যাও, যখন তোমার নিকট থেকে নদী সরে গেছে; সমুদ্রের পাড়ে যাও, যখন তোমার নিকট থেকে সমুদ্র দূরে গেছে; মাঠের বৃক্ষের নিকটে যাও, যখন মাঠের বৃক্ষ তোমার নিকট থেকে দূরে সরে গেছে। জলের আশ্রয় তার চিরকাল ভীতিকর মনে হলে বৃক্ষের ছায়ার দিকে সে হাঁটতে থাকে এই বিকেলে দরজা সন্ধানে।
যখন প্রতিটি বিকেল মানুষকে আহবান করে নদীর পাড়ে যাও, যখন তোমার নিকট থেকে নদী সরে গেছে; সমুদ্রের পাড়ে যাও, যখন তোমার নিকট থেকে সমুদ্র দূরে গেছে; মাঠের বৃক্ষের নিকটে যাও, যখন মাঠের বৃক্ষ তোমার নিকট থেকে দূরে সরে গেছে।
আফসার মিস্ত্রি চিরকাল— বাল্যকাল, যৌবনকাল, বৃদ্ধ কাল— কাঠের কাজ করে দেখেছে, বুঝেছে মানুষের সকল ছায়া, সকল আশ্রয়, সকল নিরাপত্তা লুকিয়ে আছে বৃক্ষের কাছে। সে দেখেছে মানুষ বৃক্ষ কর্তন করে তার গৃহে তক্তা এনেছে ছায়া ধরার জন্য, ছায়া মাখার জন্য, ছায়ার আশ্রয় পাবার জন্য। আফসার মিস্ত্রি কতো কতো বৃক্ষকে হত্যা করে মানুষের জন্য খাট বানিয়েছে, চৌকি বানিয়েছে, দরজা বানিয়েছে। এই বয়সে যখন দরজার ভেতর দিয়ে মৃত্যু প্রবেশ করে তখন সে নিজের গৃহের দরজা খুঁজে পাচ্ছে না। আর যদি সে তার দরজা খুঁজে না পায় তবে সে দরজা সে বন্ধ করবে কীভাবে। তার ভেতর এই চিন্তা শব্দ করে, সকল মানুষই কি নানা রকম গৃহ পার হতে হতে দরজা হারিয়ে ফেলে। সে তার সন্তানদের দিকে তাকিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে তারা পিতার দূরে, পিতার দরজার বাইরে। স্ত্রীর দিকে তাকিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে সে স্বামীর দূরত্বে, স্বামীর দরজার বাইরে। যদি সন্তান, স্ত্রী তার দরজা থেকে দূরে চলে যায়, সে তবে অন্তহীন বিকেলের পথ বেয়ে যাচ্ছে প্রান্তরের দিকে। যে প্রান্তর থেকে দীর্ঘ দীর্ঘ কাল কেটে এনেছে বৃক্ষ, দরজার কাঠের জন্য, খাটের কাঠের জন্য, লাঙলের কাঠের জন্য, আয়নার কাঠের জন্য।
কেন যে এখন এই অপরাহ্ণে যাত্রা শুরু করেছে বৃক্ষ শোভিত প্রান্তরের দিকে। দরজা অন্বেষণে তার এই প্রান্তর অভিমুখে যাত্রা হলে বৃক্ষ বিষয়ে, তার পেশা বিষয়ে, তার জীবন বিষয়ে কতো কথা এখন তার চারপাশে প্লাবিত হয়। বৃক্ষের নিকটে গেলে সে তার দরজা ফেরত পাবে কি না তা জানে না সে। তবু তার বৃক্ষের দিকে যাত্রা অব্যাহত থাকে। বৃক্ষের দিকে যেতে যেতে সে তার পেছনে তাকায়। একটা তো নদী ছিল। নদীতে সাঁতরাতে সাঁতরাতে ক্লান্ত হলে বৃক্ষের শরীর থেকে নৌকা বের করে এনে চড়েছে, পার হয়েছে ক্লান্তি। নৌকা চড়ার ভেতর, নদী জয়ের, জল জয়ের, ক্লান্তি জয়ের কি ভীষণ উল্লাস ছিল। নদীর ভেতরে কোনো কোনো শব্দ জমা আছে, কারা করে সে সকল শব্দ তা জানার জন্য, সে সকল শব্দকে তুলে আনার জন্য সে ছিপ তৈরি করেছে, ছিপে বড়শি দিয়ে নদীর অন্তরে পাঠিয়েছে বড়শির ফাঁদ। সেখান থেকে উঠে এসেছে মাছ। সে মাছ খেয়ে বুঝেছে জলের অন্তরে যাওয়া যায় না বড়শি দিয়ে, স্নান দিয়ে। নদীর এপার থেকে ওপারে গিয়ে তার মনে হয়েছে নদী পার হওয়া হলো না। নদীর জলে সাঁতার কেটে, নদীর জলে গোসল করে মনে হয়েছে সাঁতার কাটা হয়নি, গোসল করা হয়নি। বৃক্ষের দিকে যেতে যেতে সে দেখে নদীর সাঁতার, নদীতে নৌকা আরোহন চিরকাল নয়। তারপর তার ক্ষুধা লাগে। বাবা কাঠের মিস্ত্রি হিসাবে তাকে প্রশিক্ষণ দিলে সে কাঠমিস্ত্রি হয়। নদী থেকে প্রান্তরে যায়। প্রান্তর সবার জীবিকার আশ্রয় হলে সে প্রান্তরকে ভালোবাসে। ভালোবাসে প্রান্তরের বৃক্ষসমূহকে। প্রান্তরে কতো রকম যে বৃক্ষ। বাবার সঙ্গে প্রান্তরে গিয়ে সে দেখেছে বাবা কিভাবে বৃক্ষ কেটেছে করাত দিয়ে। তারপর সে সকল বৃক্ষ থেকে তার বাবা তক্তা বের করেছে, দরজা বের করেছে, জানালা বের করেছে, খাট বের করেছে, মানুষের আরাম ও নিরাপত্তা বের করেছে, চুলার আগুন বের করেছে, পাখির নিরাপত্তাহীনতা বের করেছে। বাবার হাতে বৃক্ষটির পরাজয়ের পূর্বে সে বৃক্ষটিকে জয় করার চেষ্টা করেছে। সে বৃক্ষটিতে আরোহণ করেছে হিলারীর মতো, তেনজিংয়ের মতো। বৃক্ষটির প্রতিটি শাখায় চড়ে চড়ে বৃক্ষটিকে জানাতে চেয়েছে তার শরীরের, তার মনের যে ঘোড়াসমূহ তাকে উত্তাল করে রাখে, তাকে তারা মৃত্যুর আগে দেখুক। সে বৃক্ষের শাখায় শাখায় আরোহন করে নিজেও বুঝেছে পুনরায়, মানুষের শরীরের ভেতর জমা আছে, কতো কতো ঘোড়া। এসব ঘোড়া যুদ্ধে যেতে চায়, দেশ জয় করতে চায়। সে যে সকল ঘোড়া দিয়ে প্রান্তরের বৃক্ষগুলোর ভেতর যে সকল রাজ্য থাকে সে রাজ্যগুলো দখল করতে গিয়ে দেখে যে সকল রাজ্য দখল করা যাচ্ছে না তার ভেতরের অজস্র ঘোড়া দিয়ে। সে আরও জানে শরীরের ভেতরের ঘোড়া শরীর থেকে অনবরত বেরিয়ে যেতে চায়। অথচ কি বিস্ময় তার গ্রামে কোনো ঘোড়া নাই। তার শরীরের ভেতর এতো ঘোড়া অথচ এ গ্রাম ঘোড়াহীন। গ্রামে ঘোড়া না থাকলে, আর ঘোড়া আরোহণের ইচ্ছা তার আরও প্রবল হলে সে গ্রামের পথে পথে, প্রান্তরে প্রান্তরে ঘুরতে থাকে ভেতরের ঘোড়াগুলোকে ঘাস খাওয়াবার জন্য। এসকল ঘোড়া ঘাস খায় যখন সূর্যোদয়ে আলোর ঘোড়াসমূহ নেমে আসে গ্রামের নদীর পাড়ে। এ সকল ঘোড়া ঘাস খায় যখন অন্ধকারের ঘোড়াসমূহ নেমে আসে নদীর নরম জলে।
আফসারের বয়স বাড়লে বাবার নিকট থেকে বাবার সকল নির্মাণ কৌশল সে শিখে ফেলে। বাবার নাম যদি হয় ওয়াজউদ্দীন মিস্ত্রি তবে তার নামও হয়, হয়ে যায় আফসারউদ্দীন মিস্ত্রি। এই নাম তার ভালো লাগে। কাঠমিস্ত্রি। তার বাবার বয়স বাড়তে বাড়তে দাড়ি পর্যন্ত এলে আফসার দেখে তার বাবার কাছে সমাধি নির্মাণ শিল্পও আছে। তার বাবার নিকট থেকে সে জানে মানুষের মৃত্যু হলে কাঠমিস্ত্রি তার শেষ আশ্রয় হয়। সে শিল্প, সে আশ্রয়স্থলটির নাম জানে— কফিন। তার বাবার কফিন শিল্প জানা থাকলে আফসারও জেনে যায় তার নির্মাণ শিল্প। তার বাবা জানায় কফিনেরও দরজা থাকে। কতো আগে মিশরে এ শিল্প রাজদরবারে বিকাশ লাভ করেছিল। কফিনের দরজা দিয়ে মানুষ অন্য কোথাও যায় অথবা যায় না। দরজার রহস্য এই যে তা একই সঙ্গে মূর্ত ও বিমূর্ত। মৃত্যুর পর সে দরজা খোলে অথবা খোলে না।
তার বাবার কফিন শিল্প জানা থাকলে আফসারও জেনে যায় তার নির্মাণ শিল্প। তার বাবা জানায় কফিনেরও দরজা থাকে। কতো আগে মিশরে এ শিল্প রাজদরবারে বিকাশ লাভ করেছিল। কফিনের দরজা দিয়ে মানুষ অন্য কোথাও যায় অথবা যায় না।
ক’দিন পর, নীরবতা যায়, সরবতা যায়। অনেকদিন পর। একদিন আফসারের বাবা ওয়াজউদ্দীন মিস্ত্রি আফসারকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রান্তরের বৃক্ষ সমূহের নিকটে যায়। ওয়াজউদ্দীন মিস্ত্রি তার কাঠশিল্প নির্মাণের সকল যন্ত্রপাতি আফসারউদ্দীনকে দিয়ে জানায় সে আর কখনো কাঠ কাটবে না। হাতুড়ি, বাটালি, করাত প্রভৃতিতে আর স্পর্শ দিবে না। সে কাঠের সকল নির্মাণ শেষ করে দিয়েছে। তার ভেতরে আর কোনো নির্মাণ জমা নাই, কর্তন জমা নাই, ঘোড়া জমা নাই, দৌড় জমা নাই। আফসারউদ্দীনের বাবা ওয়াজউদ্দীন জানায় তার ভেতর দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমা ভিক্ষা জমা হয়েছে, অনুশোচনা বোধ জমা হয়েছে, প্রার্থনা জমা হয়েছে। সে সকল ক্ষমা ভিক্ষা, সে সকল প্রার্থনা, সে সকল অনুশোচনা এখন সে করতে চায়— যাও পাখি, ক্ষমার পাখি, প্রার্থনার পাখি, অনুশোচনার পাখি শরীর ডিঙিয়ে, দরজা ডিঙিয়ে না ওড়া আকাশে। ওয়াজউদ্দীন আরও জানায় প্রার্থনার আগে আমার আছে ক্ষমা ভিক্ষা। ওয়াজউদ্দীন ক্ষমা ভিক্ষার জন্য প্রান্তরের সেই সকল স্থানে তাকায় যেখানে এক সময় বৃক্ষ ছিল। ওয়াজউদ্দীন কিভাবে ক্ষমা ভিক্ষা করবে তা দেখার জন্য আফসারউদ্দীন কৌতুহলী হয়। ওয়াজউদ্দীন নিধন হওয়া বৃক্ষ সমূহের নিকট কিভাবে ক্ষমা ভিক্ষা করবে জানে না। সে দেখেছে মানুষ কান্নার ভিতর দিয়ে, দু’হাত জোড় করে, মুখ নিচু করে, মানুষের নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করে। ওয়াজউদ্দীন বিবেচনা করে সকল ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়ার ভেতর অতীত ত্রুটি, অতীত ভুলের প্রমাণ কোথায়। আফসারউদ্দীন দেখে তার পিতা ওয়াজউদ্দীনের কাঁধে রয়েছে একটা বড়ো ভর্তি-ঝুলি। ওয়াজউদ্দীন সে ভর্তি-ঝুলি মাটিতে নামিয়ে তার মুখ খোলে। ঝুলিটা ওল্টায়। ঝুলি থেকে গড়িয়ে পড়তে থাকে অনন্ত পাথর রাশি। ঝুলি থেকে অন্তহীন পাথর পতন দেখে আফসারউদ্দীন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়। বিস্মিত হয় ওয়াজউদ্দীন নিজেও। কি বিস্ময় যে এতো পাথর জমে ছিল কিভাবে এ ঝুলিতে। ঝুলি থেকে পাথর পড়তে থাকে। ওয়াজউদ্দীন ঝুলি থেকে পাথর পতন দেখতে দেখতে নিজ পুত্র, নিজ প্রতিবিম্ব আফসারউদ্দীনকে জানায় ঝুলির পাথর রহস্য। যতবার সে এ প্রান্তরের বৃক্ষ কেটেছে তক্তা বের করার জন্য, দরজা বের করার জন্য, ততবার নিজ গৃহে গিয়ে দেখেছে তার সংসারের ঝুলির ভেতর পাথর জমা হয়েছে। ওয়াজউদ্দীন এরপর পিতা থেকে পথিক হয়, যে পথিক গৃহ ডিঙিয়ে, পথ ডিঙিয়ে দূরে যায়, যে দূরে জমা আছে সংসারের প্রথম ধ্বনি। ওয়াজউদ্দীন এবার আরও জানায়, জানাতে পারে, এ ঝুলি তার বাবার, কিংবা তার বাবার, কিংবা তার বাবার— যতদূর অতীতে যেতে পারে মানুষের জন্ম ততদূর পর্যন্ত মালিকানা থাকে এ পাথরের ঝুলির। ঝুলি থেকে পাথর পতন শেষ না হলে ওয়াজউদ্দীন ঝুলির মুখ বন্ধ করে। এরপর প্রান্তরের কোথাও একটা কুয়া থাকলে ওয়াজউদ্দীন সে সকল পাথরের টুকরা সেই কুয়ার ভেতরে ফেলতে থাকে। কুয়ার ভেতর প্রাচীন জল থাকলে জলের শব্দ উঠে আসে কুয়ার গভীর থেকে। ওয়াজউদ্দীন আর আফসারউদ্দীন দেখে জলের ভেতর পাথর ফেললে পাথরের শব্দ নয়, জলের শব্দ উপরে ভেসে আসে। তাদের ভালো লাগে এই যে জল কী মহান ক্ষমতাবান যে, পাথর বা যা-কিছু তার সংস্পর্শে আসুক তা তার, অর্থাৎ জলজ শব্দে রূপান্তরিত হয়। একজন ওয়াজউদ্দীন কতো পাথরই বা ফেলতে পারে। পাথর যদি অন্তহীন তবে ওয়াজউদ্দীন থামে। পাথর পতন থামে। সে অনুভব করে কোনো ক্ষমা ভিক্ষা শেষ পর্যন্ত আয়ত্ব করতে পারে না পাথরের নিঃশেষিত হওয়া। কোনো ক্ষমা ভিক্ষা পারে না মানুষের ঝুলিতে জমা হওয়া পাথর নিঃশেষ করতে। অতঃপর ওয়াজউদ্দীন মিস্ত্রি তার ছেলে আফসারউদ্দীনকে দু’টো ঝুলি দিয়ে বলে গৃহের দিকে যাও, জীবনের দিকে যাও। তারপর ওয়াজউদ্দীন সমাধি নির্মাণ শিল্পের ভেতরে কোনো এক অসুখে গমন করলে আফসারউদ্দীনকে হরিণগাছী গ্রামের সবাই ডাকতে থাকে আফসার মিস্ত্রি বলে। আফসার মিস্ত্রি জেনে যায় বৃক্ষ হত্যার নানান শিল্প কৌশল। করাত, বাটালি, হাতুড়ি আর বৃক্ষের মৃত্যু দিয়ে সে নির্মাণ করতে থাকে দরজা, জানালা, লাঙল, চেয়ার, টেবিল, খাট, ড্রেসিং টেবিল। আর এ নির্মাণ শিল্পে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে হরিণগাছী গ্রামের সকল গৃহে, সকল মানুষের কাছে।
২.
হরিণগাছী গ্রামে আজ শুক্রবার। কী কথা, শুক্রবার শুধু হরিণগাছীতে হবে কেন। শুক্রবার তো স্থান নয়, ব্যক্তি নয়, কেন ভিন্ন ভিন্ন হবে আজকের নাম। শুক্রবার যদি সময় তবে তা সর্বত্র বিরাজমান একইভাবে। যদি সব জায়গায় সময় এক রকম নয় তবে তাই হোক, সে বিতর্ক স্থগিত থাক। তবে এটা ঠিক যে হরিণগাছী গ্রামে শুক্রবার বন্ধবার। শুক্রবার যদি বন্ধবার হয় তবে আমিনা খাতুনের কাছে সকল দিনই শুক্রবার। তার জন্ম হয়েছিল শুক্রবারে। সে বড়ো হয়েছিল শুক্রবারে, তার বিয়ে হয়েছিল শুক্রবারে। তার কৈশোর এসেছিল শুক্রবারে, তার যৌবন এসেছিল শুক্রবারে। তার স্বামীর মৃত্যু এসেছিল শুক্রবারে। তার বৃদ্ধকাল এসেছে শুক্রবারে। তার গ্রাম শুক্রবার হলে, তার দেশ শুক্রবার হলে তবে সে শুক্রবারের বাসিন্দা। তার স্বামী, তার ছেলেরা শুক্রবারের বাইরে অবস্থান করলেও সে একলা শুক্রবারের ভেতর। কতোগুলো শুক্রবার পরপর সাজানো হলে তার চুল পেকে যায়, তার রূপালি ত্বক কুঁচকে যায়, তার পা দুটো দুর্বল হয়ে যায়, হাত থেকে আয়না পড়ে যায়, জানে না সে, যদি সে গণনাও না জানে।
শুক্রবারের বাইরে একদিন শনিবার— বৃষ্টি হলো দূরের প্রান্তরে— যাওয়া হলো না— পায়ের কাছে ইঁদুরের গর্ত, ইঁদুরে তার ভয়। শুক্রবারের বাইরে একদিন রবিবার— মেঘের গর্জন দূরের প্রান্তরে— যাওয়া হলো না— পায়ের কাছে ইঁদুরের গর্ত, ইঁদুরে তার ভয়। তারপর সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার— যাওয়া হলো না— কতো যে ইঁদুর গমনের সকল পথে, বের হবার সকল পথে।
আমিনা খাতুন শুক্রবারের ভেতর থেকে বের হবার জন্য বালিকা কালের কথা স্মরণ করতে চায়। বালিকাকালের ভেতর একটা প্রজাপতি উড়তে উড়তে শনিবার, কিংবা রবিবার, কিংবা সোমবার, কিংবা মঙ্গলবার, কিংবা বুধবার, কিংবা বৃহস্পতিবারের দিকে উড়ে গেলেও সে বালিকাকালে যেতে পারে না। সে দেখে তার সকল প্রান্তর, সকল প্রজাপতি শুক্রবারের বাইরে। বিয়ের পর স্বামী মজিদ দরজা বন্ধ করে জানালার নিকটে নিয়ে গিয়ে জানালা উপহার দিয়ে বলে শুক্রবারের বাইরে যাও। প্রসাধন-টেবিল উপহার দিয়ে বলে শুক্রবারের বাইরে যাও। শুক্রবারের বাইরে একদিন শনিবার— বৃষ্টি হলো দূরের প্রান্তরে— যাওয়া হলো না— পায়ের কাছে ইঁদুরের গর্ত, ইঁদুরে তার ভয়। শুক্রবারের বাইরে একদিন রবিবার— মেঘের গর্জন দূরের প্রান্তরে— যাওয়া হলো না— পায়ের কাছে ইঁদুরের গর্ত, ইঁদুরে তার ভয়। তারপর সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার— যাওয়া হলো না— কতো যে ইঁদুর গমনের সকল পথে, বের হবার সকল পথে।
৩.
শরীরের ভেতর এতো বিকাল জমেছে যে এই বিকেলে আফসার মিস্ত্রি প্রান্তরের দিকে যেতে পারে না। প্রান্তরের বৃক্ষের সঙ্গে তার দেখা হবার ভীষণ দরকার ছিল। বৃক্ষ থেকে এখন কতো দূরে অবস্থান তার জানতে পারে না। তারপর এই বিকেলে হঠাৎ দরজা খুঁজে না পেলে তার মনে হয় সে কোনো গৃহে ঢুকতে বা কোনো গৃহ থেকে বের হতে পারবে না। যদি সে কোনো গৃহে ঢুকতে বা কোনো গৃহ থেকে বের হতে না পারে তবে কোথায় অবস্থান এখন তার। সে এক বিকাল থেকে আরেক বিকেলে যায়। দেখে যে, কী আশ্চর্য যে, মানুষের সকল বিকাল যেন অতীতকালের সংরক্ষণশালা। বিকালটাকে অতীতকাল মনে হলে তার খুব ক্ষুধা লাগে। ভীষণ ক্ষুধা, দীর্ঘদিনের অবদমিত ক্ষুধা বেরিয়ে আসতে চায়। তার ইচ্ছা হয় এ গ্রামের সবার বাড়ির রান্না করা খাবার সে খাবে। সে আরও দেখে এ গ্রামের সকল বাড়ির দরজা তার দ্বারা তৈরি হলেও কখনো কোনো বাড়ির ভেতর তার ঢোকা হয়নি। হরিণগাছী গ্রামের দুই শ বাড়ির ভেতর কি আছে, সে সকল গৃহের চুলায় কি রান্না হয়, কেমন রান্না হয় হঠাৎ এখন তার জানতে ইচ্ছে করে। তখন তার এ বোধ হয়, যদি এ সকল বাড়ির খাবার যদি সে অন্তত একবার খেতে পারে তবে হয়তো সবার বাড়ির ভেতরটা দেখার ও ভেতরে প্রবেশ করার অনুভূতি সে পাবে। আর এও সে ভাবে যেহেতু প্রান্তরের বৃক্ষদের নিকট তার আর যাবার সাধ্য নাই তা হলে গ্রামের এ সকল বাড়ির খাবার, চেয়ে খাওয়া ভিক্ষুকের মতো চেয়ে খেয়ে তাকে ক্ষমা ভিক্ষা চাইবার একটা ধরণ বলতে পারে। সে খাবার চেয়ে খাওয়ার একটা ওজুহাত তৈরি করে। সে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে জানায় তার বৃদ্ধ স্ত্রীকে স্বপ্নে সে কার কার বাড়িতে কি কি খাবার খেয়েছে। সে খাবারের বর্ণনা দেয়। ভাতের বর্ণনা দেয়, মাছের বর্ণনা দেয়, মাংশের বর্ণনা দেয়, দুধের বর্ণনা দেয়, বর্ণনা দেয় আরও নানারূপ খাবারের। এ সকল খাবারের বর্ণনা শুনে তার স্ত্রী খুব মুগ্ধ। তার স্ত্রী দেখে এ সকল খাবার সে কখনো তার স্বামীকে খাওয়াতে পারেনি। তার স্বামীর কাছে এতো সব খাবারের বর্ণনা কিভাবে জমা ছিল, কিভাবে জানা ছিল তা ভেবে সে বিস্মিত। এখন তার মনে হয় মৃত্যুর আগে মানুষ বুঝি অনুভব করে কতো সব খাবার তার খাওয়া হয়নি বিগত জীবনে। আর এ নিয়ম এ গ্রামে বহুকাল যে কারো কারো কিংবা সবারই মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকে অন্যের বাড়িতে খাবার খেতে ইচ্ছে হয়, খাবারের বর্ণনা দিতে ইচ্ছে হয়।
আফসার মিস্ত্রি অপরের বাড়িতে খাবার খাওয়ার স্বপ্নটা প্রতি রাতেই দেখে। স্বপ্নের খাবারের বর্ণনা দিতে দারুণ ভালো লাগে স্ত্রীকে। তার স্ত্রী বিমর্ষ হয় এই ভেবে যে তার রান্না করা কোনো খাবার তার স্বামীর বর্ণনায় নাই। আফসার মিস্ত্রির খাবারের বর্ণনায় কতো যে বৈচিত্র্য, কতো যে সৌন্দর্য, কতো যে কৌশল তা দেখে তার স্ত্রীর ঈর্ষা হয়, কষ্ট হয়। হায় কতো হতভাগিনী সে, তার স্বামীর স্বপ্নের খাবারের রান্না কখনো করেনি সে, কখনো জানেনি সে। তার স্বামী কখনো এ সকল খাবার তার নিকটে খেতে চায়নি, খেতে পায়নি। আফসার মিস্ত্রির স্ত্রী সে সকল বাড়িতে গিয়ে জানায় আফসার মিস্ত্রির স্বপ্নের খাবার সাধ। গ্রামের সে সকল বাড়ি থেকে আফসার মিস্ত্রির জন্য তাদের বাড়িতে সাজিয়ে রাখা প্লেটে, গামলায়, বাটিতে খাবার আসে। খাবার খেয়েও আফসার মিস্ত্রি দেখে গ্রামের কোনো বাড়ির ভেতরই সে প্রবেশ করতে পারছে না। কতোকাল একটা গৃহে বাস করলে কিংবা গৃহের কোনো খাবার খেলে একজন প্রবেশ করতে পারে গৃহের ভেতর! গ্রামের কোনো গৃহে প্রবেশের স্বাদ আফসার মিস্ত্রি অনুভব না করতে পারলে সে বাঁশির কথা ভাবে। সে তো যৌবনে বাঁশি বাজাত। সে তার পুরনো ঝুলির ভেতর থেকে বাঁশি টেনে বের করে। ধুলা পরিষ্কার করে বাঁশিতে ঠোঁট লাগায়। বুকের ভেতর যে বাতাস বহুদিন জমা ছিল সে বাতাসে সে বাঁশিতে সুর তোলে। এই বাঁশির সুর উড়ে যাক এ গ্রামের সকল গৃহে। সুর যায় পথ পেরিয়ে, দেয়াল পেরিয়ে, দরজা পেরিয়ে, বাঁশি পেরিয়ে, বাঁশ পেরিয়ে, গ্রামের সকল বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে। একদিন যায়, দু’দিন যায়। বাঁশির সুর যায়। একদিন ফেরে না, দু’দিন ফেরে না। বাঁশির সুর ফেরে না। আফসার মিস্ত্রি জানে তার কোনো গৃহে প্রবেশ হবে না কোনো ভাবেই।
৪.
শুক্রবারের বাইরে বের হতে না পারলে আমিনা খাতুন রাজহাঁস পোষে। সে দেখে এ সকল রাঁজহাস প্রান্তর, প্রান্তরের বাতাস, প্রান্তরের শস্য ভালোবাসে; জল, জলের সাঁতার ভালোবাসে। সে এ সকল রাজহাঁসের গ্রীবা সমূহে শুক্রবার বেঁধে দিয়ে গৃহের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। এ সকল রাজহাঁস সকালে বের হয়ে প্রান্তরের হাওয়ায় হাঁটে, দৌড়ে বেড়ায়। দীঘিতে, পুকুরে, নদীতে স্নান করে, সাঁতার কাটে। উড়বে না তারা। মাংশ মাটিকেন্দ্রিক হলে মাটি থেকে পা তুলতে পারে না। সন্ধ্যায় সে সকল রাজহাঁস গৃহে ফিরে এলে আমিনা খাতুন তার গৃহের মেঝের দিকে তাকায়। সেখানে রাত, সেখানে ইঁদুরের গর্ত। সে পুনরায় জানে তার শুক্রবারের বাইরে যাওয়া হচ্ছে না। তারপর সে বুদ্ধি বদলায়। গৃহের পাশে কিছুটা জমি থাকলে সে সেখানে কয়েকটা হাস্নাহেনা ফুলের গাছ লাগায়। এই ফুল গাছ সমূহে সে জল ঢালে। তার বাড়ির মাঝখানে যে পুরাতন কুয়ো তার জল দেয় ফুলগাছ গুলোর গোড়ায়। মাথার উপর সূর্যের যে উজ্জ্বলতম আলো তা পায় সে সকল ফুলগাছ। সবচেয়ে বড়ো জানালা দিয়ে দূরের যে বাতাস প্রবাহিত হয় তা লাগে ফুলগাছগুলোর শরীরে। মাটির গভীর থেকে শেকড় বেয়ে উঠে আসে মমতা, বাতাসের গভীর থেকে উঠে আসে গন্ধ, সূর্যের আলো থেকে নেমে আসে উষ্ণতা— এবার দেখো আমিনা খাতুনের হাস্নাহেনা গাছগুলো বড়ো হচ্ছে। হাস্নাহেনা গাছগুলোতে ফুল ধরলে গ্রামের লোকেরা ফুলগুলো ও জমিটুকুকে ফুলের বাগানের স্বীকৃতি দেয়। আমিনা খাতুন একদিন শুক্রবারে, প্রতিদিন শুক্রবারে হাস্নাহেনা ফুলগুলোকে বলে তারা তার গৃহ থেকে বেরিয়ে গিয়ে মুক্ত করুক তার শরীরে, মনে, গৃহে জমে থাকা শুক্রবারকে। রাতের অবসর, দিনের অবসর যখন চিরকালের বন্ধুর মতো বুকে এসে শুধায় শুক্রবারের কথা, তখন বোঝে সে শুক্রবার নড়াচড়া করছে তার গৃহের সকল বস্তুতে, সকল অবস্তুতে।
৫.
যদি তার পুরনো বাঁশির সুর কোনো গৃহে নিয়ে যেতে না পারে আফসার মিস্ত্রিকে তবে সে পুরাতন জলে ডুব দেয়। এ গ্রামের সকল লাঙল তার তৈরি হলে এ গ্রামের সকল খাদ্য নিরাপত্তায় তার অংশগ্রহণ ছিল। এ গ্রামের সকল দরজা, সকল জানালা তার তৈরি হলে গ্রামের সকল নিরাপত্তায় তার অংশগ্রহণ ছিল। এ গ্রামের সকল চৌকি, সকল খাট তার তৈরি হলে গ্রামের সকল বিশ্রামে তার অংশগ্রহণ ছিল। আচমকা এক ফোটা বৃষ্টি পড়ে মনের কোথাও। মনে পড়ে তার আমিনা খাতুনের কথা। এ গ্রামে সে এসেছিল মজিদের বউ হয়ে। তার রূপ যদিও ছিল নির্জনতাপ্রিয়, তবুও সে রূপ ছায়ার নমনীয়তায় এ গ্রামের সকল তরুণকে উদ্দীপ্ত করেছে দিন-রাত। তরুণরা তো সে রূপের ছায়ার জন্য দূরে গেছে, দূরের প্রান্তরে। প্রান্তরের সকল ছায়ায় তারা বাঁশি বাজিয়ে জানিয়ে দিয়েছে রূপের ভেতর কী তীব্র বেদনা চির প্রবহমান। আর তখনই তো আফসার মিস্ত্রি বাঁশিকে চিনেছিল, বাঁশের সাঁকোকে চিনেছিল। জেনেছিল বুকের ভেতর কতো নদীর নির্জন শীতল বাতাস জমা থাকে। মজিদ একদিন এসে আফসার মিস্ত্রিকে জানায় তার স্ত্রী আমিনা খাতুন আয়না বসাবার জন্য আয়নার কারিগর চায়। আফসার মিস্ত্রি তো আয়নার কারিগর নয়। তবুও সে দুই তক্তার মাঝখানে আয়না বসিয়ে নির্মাণ করে দেয় আমিনা খাতুনের প্রসাধন টেবিল। আর সেই দুই তক্তায় সে খোদাই করে দেয় দু’টো সাপ। মজিদ সম্বন্ধে এক কথা এখানে বলা যায় যে, সে ছিল হরিণগাছী গ্রামের পালোয়ান। হাডুডু খেলায় সে কতোবার যে মেডেল পেয়েছে সে কথা বলুক খেলার মাঠের দর্শকেরা। সকল খেলার এক সময় মৃত্যু হলে হাডুডু খেলোয়াড় মজিদের মৃত্যু আসে সাপের ছোবলে। মজিদের মৃত্যু সাপের ছোবলে হলে হরিণগাছী গ্রামের লোকেরা বলেছিল মানব পতনের, খেলার পতনের আদিম কথা। হরিণগাছী গ্রামের সকল ঘর থেকে তখন সাপ বের হবার গল্প শোনা গেল। আফসার মিস্ত্রির এই জ্ঞান উদিত হয় যে তার চিন্তার ভেতর, নির্মাণ কৌশলের ভেতর কী করে সাপের প্রতিবিম্ব এসেছিল প্রসাধন টেবিল নির্মাণের সময়। সে তখন স্মরণ করে আমিনা খাতুন আসার পর গ্রামের তরুণেরা প্রান্তরের নির্জনতায় কতো দীর্ঘশ্বাস অথবা দীর্ঘসাপ ছেড়েছিল বাঁশিতে বাঁশিতে, শস্যদানায় শস্যদানায়। এ সকল বাঁশির সুর, এ সকল শস্য দানা গৃহে গেলে তাদের গৃহে গৃহে ইঁদুরের গর্ত, অতঃপর সে সব জায়গায় সাপের গর্ত দেখা যায়। আর এই জ্ঞান এই গ্রামে সিদ্ধ যে এই গ্রামের প্রতিটি গৃহের ভিত্তিতে থাকে ইঁদুরের গর্ত, আর ইঁদুরের গর্তে সাপ ঢুকলে আমিনা খাতুনের গৃহে মৃত্যু আসে সাপের ফণা বেয়ে।
৬.
বাষ্প শব্দটা আমিনা খাতুনের মনে আসে। সে অনুভব করে মানুষ প্রতিনিয়ত বাষ্প হয়। দিনের তাপে, রাতের তাপে মানুষ বাষ্প হলে আমিনা খাতুন নিজের শরীরের দিকে তাকায়। তার শরীর বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে কোন আকাশে তার সন্ধান করার চেষ্টা করে সে। তার নিজস্ব আকাশ না থাকলে তার শরীরের বাষ্প কোথায় গিয়ে জমা হয়ে মেঘ হয় অথবা হয় না, বৃষ্টি হয় অথবা হয় না জানে না সে। তার শরীর ক্ষুধার ভেতর, ক্ষুধার ব্যর্থ নিবারণের ভেতর দিয়ে কোথায় যাচ্ছে জানে না সে। সে ভাবার চেষ্টা করে তার শরীরে কার কার অধিকার ছিল। অধিকার ছিল বাল্যকালের, মরে গেছে বাল্যকাল; অধিকার ছিল যৌবনকালের, মরে গেছে যৌবনকাল; অধিকার আছে বৃদ্ধকালের, তবে এখন আমিনা খাতুন বৃদ্ধ। জানে না সে আর কতোটুকু বাষ্প জমা আছে তার শরীরে। সে জানে এতোটুকু কথা যে, যতদিন শরীরের বাষ্প তৈরি করার সামর্থ্য আছে ততদিন সে ক্ষুধা ও ব্যর্থ ক্ষুধা নিবারণের চক্রে ঘুরবে। চিন্তা পোশাক পাল্টালে আমিনা খাতুন বাঁশের মতো কিংবা বাঁশির মতো লাঠিতে ভর দিয়ে প্রান্তরের দিকে তাকায়। প্রান্তরের ভেতর কতো সব মেঘাচ্ছন্ন ছায়া। তার শরীরের ছায়া। এক শরীরে মানুষের কতো যে ছায়া। এই যে সকালবেলা, শিশুর ছায়ায় প্রান্তরে কতো সব ফুল আহার পায়; এই যে দুপুরবেলা, তরুণের ছায়ার প্রান্তরে কতো সব অশ্ব দূরত্বের সন্ধান পায়; এই যে লাঠি হাতে বৃদ্ধকাল, পুনরায় তাকাই শরীরের সকল আঙিনায়— আমি তখন আমি নই, অন্য কেউ। তবুও বলি, আমিনা খাতুন বলে, লাঠি তাকে যতটুকু অধিকার দেয়। শরীরকে তার চিরকাল বাগান বলে জ্ঞান হয়েছে— কতোবার কতো ফুল, প্রজাপতি কাছে আসে। শরীরকে তার চিরকাল নদী বলে মনে হয়েছে— কতো নৌকা পাল তুলে যায় কতো বাণিজ্যে। শরীরকে তার চিরকাল একটা দ্বীপ মনে হয়েছে— চারপাশে অচেনা জল চোখের কাছে ঋণী। শরীরকে তার আরও কতো কিছু মনে হলে বোঝে ফুল বাষ্প হলে শুধু বাগান, জল বাষ্প হলে শুধু দীর্ঘ আধার।
৭.
এই কথা এখন এখানে লিপিবদ্ধ হোক, এ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কালরাতে আফসার মিস্ত্রি দরজা খুঁজে পেয়েছিল, আমিনা খাতুন শুক্রবারের বাইরে যেতে পেরেছিল— তাদের মৃত শরীর দেখি এই শ্রাবণে কতোদূর সমাধিহীন ভেসে যায়।
জন্ম ১৯৬৮, কুষ্টিয়ায়। বর্তমানে সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করছেন। লেখেন বিভিন্ন লিটলম্যাগে। সম্পাদিত লিটলম্যাগ : নিজকল্পা। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : জল আসে মানুষের দীঘিতে, মানচিত্রকর, আমাদের গ্রামে একটা পাখিচোর আছে, বিড়াল পোষা প্রতিবেশিনীরা, কোথায় কোথায় ঘুমিয়েছিলাম এবং মেয়াদোত্তীর্ণ নিরাপত্তাসমূহ। উপন্যাস : কেউ মরছে না ।